দুনিয়ার আযাব ও আখেরাতে আযাব: মুক্তি কীরূপে?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

বাঙালি মুসলিমের অপরাধ

আযাব শুধু পরকালের বিষয় নয়, দুনিয়ার বিষয়ও। মানব জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হলো সে আযাব থেকে বাঁচা। জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো সে আযাব থেকে বাঁচায় ব্যর্থতা। তবে সে আযাব থেকে বাঁচার পথটি অতি সহজ-সরল। যেমন অতীতে বেঁচেছে বহু দেশের ও বহু ভাষার বহু কোটি মানুষ। সেটি হলো, যে উদ্দেশ্যে মানবের সৃষ্টি সে এজেন্ডাকে ধারণ করে বাঁচা। যখন ব্যর্থতাটি সে এজেন্ডা নিয়ে বাঁচায়, তখনই অনিবার্য হয় প্রতিশ্রুত আযাব। তখন আযাবের হাতিয়ারে পরিণত হয় শুধু ভূমিকম্প, সুনামী, ঘুর্ণিঝড় ও মহামারী নয়, বরং নৃশংস জালেম শাসকও। তখন ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় শয়তানকে। তখন শয়তানের কাজ হয় তাকে জাহান্নামে নেয়া। তবে শয়তান শুধু ইবলিস নয়, বরং নমরুদ, ফিরাউন, মুজিব, হাসিনার ন্যায় প্রতিটি জালেম শাসকই। তারা সবাই কাজ করে ইবলিসের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে। ইবলিসের এজেন্ডা তো মানুষকে জাহান্নামে নেয়া।  

মহান আল্লাহ তায়ালা শয়তানকেও যে আযাবের হাতিয়ার রূপে নিয়োগ দেন -সে ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কুর’আনে। বলা হয়েছে:

وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ ٱلرَّحْمَـٰنِ نُقَيِّضْ لَهُۥ شَيْطَـٰنًۭا فَهُوَ لَهُۥ قَرِينٌۭ

অর্থ: “এবং যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিল রহমানের যিকর থেকে, তার উপর চাপিয়ে দেই শয়তানকে; সে তখন তার সঙ্গীতে পরিণত হয়।” -সুরা জুখরুফ, আয়াত ৩৬)।  

উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালার যিকর তথা স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াকে গুরুতর অপরাধ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে -যা অনিবার্য করে দুনিয়ার আযাব ও জাহান্নামের আযাব। সে অনিবার্য করা হয় যিকিরশূণ্যদের উপর শয়তানকে নিয়োগ করে। কারণ, কর্তৃত্ব যখন শয়তানের, তখন অসম্ভব হয় সিরাতাল মুস্তাকীমে তথা জান্নাতের পথে চলা। আল্লাহ তায়ালার যিকর তথা স্মরণের অর্থ শুধু তাঁর নামে স্মরণ নয়; বহু সূদখোর, ঘুষখোর এবং প্রতারকও হাতে তসবিহ নিয়ে তাঁর নাম জপে। এখানে তাঁর যিকব বা স্মরণ বলতে বুঝায় তাঁর পক্ষ থেকে অর্পিত খেলাফতের দায়িত্বের স্মরণ। সে দায়িত্বের মধ্যে এসে যায় তাঁর মহান রব’য়ের এজেন্ডাকে বিজয়ী করা। সে ঘোষিত এজেন্ডাটি হলো: প্রতিষ্ঠা পাবে একমাত্র তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন, নির্মূল হবে মিথ্যা ও দুর্বৃত্তি এবং প্রতিষ্ঠা পাবে সত্য ও সুবিচার। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের লড়াই ছিল তো সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করা নিয়ে।

সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করার কাজে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা দিলে চলে না, প্রতিষ্ঠা দিতে হয় ইসলামী রাষ্ট্র -যেমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। একজন দাসকে যেমন সর্বক্ষণ তার প্রভুর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্বের স্মরণ নিয়ে বাঁচতে হয়, সেরূপ স্মরণ নিয়ে বাঁচতে হয় প্রতিটি ঈমানদারকেও। গুরুতর অপরাধ হলো সে দায়িত্ব পালনে অবাধ্য বা বিদ্রোহী হওয়া। তখন অনিবার্য হয় শাস্তি। বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষ নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করে। কিন্তু তাদের মাঝে কতজন বাঁচে সে অর্পিত দায়িত্বের স্মরণ নিয়ে? অপরাধ তো এখানে সে দায়িত্বের কথা ভূলে যাওয়ার। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারই কি দেশে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনকে বিলুপ্ত করে রাখেনি? তাদের ক’জন রাজ পথে নেমেছে তাদের রব’য়ের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার লড়াই নিয়ে?  

 

বাঙালি মুসলিমের অর্জিত আযাব

বাংলাদেশে বুকে মহান রব’য়ের নামের যিকিরের বড় বড় হালকা বসে; শরীর হেলিয়ে দুলিয়ে বহু কসরত করে তাঁর নামের যিকির হয়। কিন্তু অর্পিত খেলাফতের দায়িত্বপালনের কাজে তাদের মেহনত নাই। একাজে কেউ তাদের শ্রম, মেধা, অর্থ ও রক্তের বিনিয়োগ নাই।  ফলে দেশটিতে প্রতিষ্ঠা পায়নি তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। এবং নির্মূল হয়নি দুর্বৃত্তি; প্রতিষ্ঠা পায়নি সুবিচার। কোন দেশে জালেম শাসকের দখলদারী দেখে বুঝা যায়, সে দেশের জনগণের পক্ষ থেকে কতটা অবাধ্যতা হয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফার দায়িত্ব পালনে। এমন অবাধ্যদের ঘাড়ে শয়তান চাপানো হবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? মুজিব-হাসিনার নৃশংস ফ্যাসিবাদী শাসনের আযাব কি তারই আলামত নয়?     

মহান রব’য়ের অনুমতি ছাড়া গাছের একটা পাতাও পড়ে না; তাই যে আযাব মুজিব-হাসিনার শাসনের মধ্য দিয়ে এসেছিল -সেটি তাঁর অনুমতি ছাড়া আসেনি। মুজিব-হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের আযাব দেখে নিশ্চিত বলা যায়, বাঙালি মুসলিমের পক্ষ থেকে বড় রকমের ব্যর্থতা হয়েছে দায়িত্ব পালেন। এবং এ আযাব এসেছে নিজ হাতের কামাই রূপে। মুজিব আমলে আযাব এসেছে ভারতীয় অধিকৃতি, লুণ্ঠন এবং লুণ্ঠন জনিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ রূপে -যা মৃত্যু ঘটায় ১৫ লাখের বেশী মানুষের। আযাব এসেছে গণতন্ত্রের মৃত্যু ও একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিবাদ রূপে। আযাব এসেছে বিশ্বের দরবারে ভিক্ষার তলাহীন ঝুড়ির অপমান নিয়ে। এবং হাসিনার আমলে আযাব এসেছে নৃশংস ফ্যাসিবাদ, গুম-খুন-চুরি-ডাকাতি,ব্যাংক ডাকাতি, সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থ পাচার, গণহত্যা, সেনাহত্যা, ফাঁসি, আয়না ঘর নিয়ে।    

 

অভাব দূরদৃষ্টি ও ঐক্যের

বাঙালি মুসলিমে বড় অভাব দূরদৃষ্টি ও ঐক্যের। তারা ব্যর্থ হয়েছে শত্রুর কৌশল বুঝতে। বাঘ এক সাথে একটাই শিকার ধরে। সেটি হজম করার পর আরেকটি শিকার ধরে। এক সাথে দুটি শিকার ধরে না। সে রীতি স্বৈরাচারী শাসকদেরও। তারাও একটা একটা করে রাজনৈতিক শত্রুদের ঘাড় মটকায়। ফ্যাসিবাদী হাসিনা তার শিকার ধরার কাজটি কর্নেল ফারুক ও তাঁর সাথীদের দিয়ে শুরু করেছিল। জামায়াত, বিএনপি ও হেফাজতের নেতাকর্মীগণ তখন হাসিনার রাজনৈতিক শত্রু নির্মূলের সে নিষ্ঠুর তাণ্ডবটি নীরবে দেখছিল। কেউ কোন আওয়াজ তোলেনি। কর্নেল ফারুক ও তার সঙ্গীদের ফাঁসির হুকুম যখন শোনানো হয় তখন জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ বলেছিলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেল। প্রায় একই সুরে কথা বলেছিল বিএনপির মওদুদ আহমেদ এবং জাতীয় পার্টির হুসেন মহম্মদ এরশাদ।

এরপর আসে জামায়াত নেতাদের উপর নির্যাতনের পালা। তখন বিএনপি ও হেফাজতে নেতাকর্মীগণ নীরব থেকেছে। হয়তো তারা ভেবেছিল, জামায়াত তো তাদের লোক নয়। জামায়াতকে বরং তারা প্রতিদ্বন্দী ভাবতো। অতএব তাদের নির্মূলে বরং নিজেদের লাভ দেখতো। তাছাড়া বিএনপি নেতৃত্বে রয়েছে ভাষানীপন্থী বামদের প্রভাব। এ বামেরা কোন কালেই জামায়াতের বন্ধু ছিল না। তারা ভাবতো, খুনি হাসিনা যদি জামায়াতকে নির্মূল করে দেয় তবে তাদেরই শত্রু কমবে।  এরপর শুরু হলো হিফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গণহত্যার পালা। বিএনপির নেতা-কর্মীগণ সেটিকেও নীরবে দেখেছে; প্রতিবাদে রাস্তায় নামেনি। এরপর শুরু হলো বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে গুম, খুন ও নির্যাতনের পালা। জনগণ তখনও রাস্তায় নামেনি। কারণ জনগণকে রাস্তার নামানোর তেমন চেষ্টাও হয়নি।

এরপর হামলা শুরু হলো খোদ জনগণের জানমাল ও ইজ্জতের উপর হামলা। ডাকাতি হয়ে গেল জনগণের ভোট এবং কবরে গেল গণতন্ত্র। দেশ জুড়ে প্লাবন এলো গুম, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের। ক্যান্টনমেন্টগুলোতে  গড়ে উঠলো আয়না ঘর। সমগ্র দেশ পরিণত হলো জেল খানায়। এসবই সম্ভব ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের মাঝে দূরদৃষ্টি ও ঐক্য না থাকার কারণে। দেশ যে কতটা ভয়ানক অবস্থার দিকে যাচ্ছে -সেটি তারা শুরুতে বুঝতেই পারেনি। ফলে সংঘবদ্ধ লড়াই যখন জরুরি ছিল তখন তারা নীরব ও নিষ্ক্রিয় থেকেছে। অথচ ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ তো দুর্বৃত্ত জালেমদের হামলা থেকে রাষ্ট্রকে পাহারা দেয়া। এ কাজের রয়েছে জিহাদের মর্যাদা। একাজে ব্যর্থ হলে পূর্ণ ইসলাম পালন দূরে থাক নিরাপত্তা নিয়ে বাঁচাটাই তখন অসম্ভব হয়। খুনি হাসিনার আমলে তো সেটিই হয়েছিল।  

নেকড়ে বাঘ যেমন কারো বন্ধু নয়, স্বৈরাচারী দুর্বৃত্ত শাসকগণও তেমনি কারো বন্ধু নয়। তারা সবার শত্রু। তাই মহল্লায় নেকড়ে ঢুকলে বিভক্ত হলে চলে না। তখন সবাই মিলে সে বাঘকে বধ করতে হয়। সেটিই সভ্য সমাজের রীতি। স্বৈরাচারী শাসকগণ হিংস্র পশুর চেয়েও বেশী হিংস্র। পশু গণহত্য বা গণধর্ষণ করে না। কিন্তু সেটি করে মানবরূপী পশুগণ। তাই স্বৈরাচারী শাসক তাড়াতে সভ্য জনগণকে একতাবদ্ধ হতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের ব্যর্থতাটি বিশাল। ঘরবাড়ী থেকে আবর্জনা সরানোর জন্য সভ্য রুচি লাগে। তেমনি রুচি লাগে দুর্বৃত্তের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে সভ্য দেশ গড়তে। বাংলাদেশীদের ব্যর্থতা এখানেই। সভ্য রুচি থাকলে তারা কি কখনো গণতন্ত্রের শত্রু বাকশালী মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা বলতো?

 

জিহাদের বিকল্প নাই

অতি গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো, শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন তেলাওয়াত ও কুর’আন হিফয ও দোয়াদরুদ ব্যক্তি জীবনে পরিশুদ্ধি আনলেও তা দিয়ে রাষ্ট্র পরিশুদ্ধির কাজটি হয়না। ফলে রাষ্ট্র জালেম-অধিকৃতই থেকে যায়। সে কাজের অস্ত্র হলো জিহাদ। এটিই হলো মানব জীবনের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কাজ। এ কাজে অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিশাল খরচ আছে। কিন্তু যারা পশুর ন্যায় শুধু পানাহার ও  প্রজনন নিয়ে বাঁচতে চায় তাদের সভ্য কাজে রুচি থাকে না। ফলে চোখের সামনে গণহত্যা ও ধর্ষণ দেখেও যেমন গরু যেমন নীরবে ঘাস খায়, পশু চরিত্রের মানুষগুলোও নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে। ইসলাম এরূপ জিহাদশূণ্যদের বেঈমান বলে। আর যদি  এ বেঈমানগণ ঈমানের দাবী করে -তবে তাদের মুনাফিক বলে। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ও কুর’আনে হিফজ তাকে মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচাতে পারেনা।

মহান আল্লাহ তায়ালার হিসাব-নিকাশটি অতি সহজ। জান্নাতে যেতে হলে প্রতিটি ঈমানদার বাঁচতে তাঁর সক্রিয় খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। এখানে নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার অর্থই হলো অর্পিত দায়িত্বের সাথে গাদ্দারী। বুঝতে হবে জালেমের শাসন মানেই শয়তানের খলিফাদের শাসন। বিজয়টি সেখানে শয়তানের। আল্লাহ তায়ালার খলিফা হওয়ার কারণে প্রতিটি ঈমানদারের দায়িত্ব হলো শয়তানের সে দখলদারীকে নির্মূল করা। ইবাদতকে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত, দোয়া-দরুদ ও কুর’আনে হিফজে সীমিত রাখলে শয়তানের দখলদারী নির্মূলের কাজটি হয়না। ফলে মহান আল্লাহর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার কাজটিও হয়না। ব্যর্থতাটি এখানে সে ব্যক্তির যাকে খলিফার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। সে ব্যর্থতার শাস্তি হলো, দুনিয়াতে জালেমের শাসন এবং আখেরাতে জাহান্নাম। নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়া-দরুদ এরূপ গাদ্দারকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাতে পারে না। এমন কি আব্দুল্লাহ বিন উবাইদের মত যারা নবীজী (সা:)‌’র পিছনে নামাজ পড়েছিল তারাও বাঁচেনি। ২৬/০৫/২০২৫    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *