শেখ মুজিবের অপরাধ এবং বাঙালি মুসলিমের অপরাধ (২য় পর্ব)

ফিরোজ মাহবুব কামাল

মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ফিরাউন একাই শুধু অপরাধী নয়, তাকে যারা নেতা, পিতা ও ভগবানের আসনে বসায় তারাও অপরাধী। কোন অপরাধের কাজই ফিরাউন একাকী করতে পারে না। যারা তাকে সহযোগিতা দেয়, অপরাধী তারাও। তাই আযাব শুধু ফিরাউনের উপরই আসেনি, ভয়ানক আযব এসেছে মিশরের সমগ্র জনগণের উপরও। মহান আল্লাহতায়ালার অভিন্ন নীতি তো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। তাই বিপদ শুধু মুজিবের একার উপর আসেনি। বার বার বিপদ এসেছে বাংলাদেশীদের উপর। রোজ হাশরের বিচার দিনে তাই শুধু শেখ মুজিবেরই বিচার হবে না, বিচার হবে মুজিবের অনুসারীদেরও।

ব্যক্তির ঈমান, ইলম, তাকওয়া ও প্রজ্ঞার পরীক্ষাটি শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের ন্যায় ইবাদতে হয় না। সে পরীক্ষাটি অতি নিখুঁত ভাবে হয় নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে। এখানেই ব্যক্তির ঈমান, আক্বীদা, দর্শন ও প্রজ্ঞা ধরা পড়ে। এখানেই অধিকাংশ মানুষ ফেল করে। দিনে রাজা রাখে এবং রাত তাহাজ্জুদে কাটায় ,এমন ব্যক্তি যদি ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তকে নেতা বা নেত্রী রূপে গ্রহণ করে –সে কি জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পায়? একজন ব্যক্তি যতই নামাজী বা রোজাদার হোক, সঠিক গন্তব্যে পৌছতে হলে অবশ্যই তাকে সঠিক ট্রেনে উঠতে হয়। ভূ্ল ট্রেনে উঠে সেটি সম্ভব নয়। তেমনি ইসলামবিরোধী শক্তির পরিচালিত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাহনে চড়ে কি কখনোই জান্নাতে পৌঁছা যায়?

চাষাবাদ, ব্যাবসা-বাণিজ্য, চাকুরি-বাকুরি ও পেশাদারীতে ভূল-ত্রুটির কারণে কেউ জাহান্নামে যাবে না। এরূপ ভূল-ত্রুটি কম-বেশী প্রায় সবাই করে। করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালা সেগুলি মাফ করে দিবেন। কিন্তু শয়তানের খলিফাদের নেতা বানানোর ক্ষেত্রে যে ভূল -সেটি অমার্জনীয়। কারণ এটি বস্তুত ভূল নয়; বরং ঠান্ডা মাথায় সংঘটিত গুরুতর অপরাধ। অপরাধটি এখানে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের। অপরাধ এখানে তার সার্বভৌমত্ব ও তার শরিয়তী আইন বিলুপ্ত করার। অপরাধ এখানে শয়তানকে বিজয়ী করার। বাংলাদেশে মাটিতে শয়তানের হিন্দুত্ববাদী খলিফাদের যেরূপ বিশাল বিজয় এবং মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তার শরিয়তী আইন যেরূপে বিলুপ্ত -সেটি তো এই অপরাধের কারণেই। ফলে এ গুরুতর অপরাধ মাফ পায় কি করে? তাই ঈমান, ইলম ও তাকওয়ার প্রকাশ শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে দেখালে চলে না, দেখাতে হয় রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতিতে দল ও ইমাম বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে।

প্রশ্ন হলো, বাঙালি মুসলিমগণ অতীতে কতটা প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে, কতটা ধোকা খেয়েছে এবং কতটা পথ হারিয়েছে রাজনীতির অঙ্গণে নেতা বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে? এগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যারা বলে যে, জনগণ কখনো ভূল করে না, তারা ডাহা মিথ্যা বলে। জনগণ শুধু ভূল করে না, ভয়ানক আকারের ভূল করে। ভারতের ১২০ কোটি হিন্দু গরু পূজা, মুর্তি পূজা, সর্প পূজা ও লিঙ্গ পূজা করে। এগুলি কি সঠিক সিদ্ধান্ত?  দল ও নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমগণ যে ১৯৭০ -৭১’য়ে বিশাল ভূল করেছে -তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে?

নেতা ও দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলিমগণ যে প্রচণ্ড ভাবে প্রতারিত হয়েছে -সেটির প্রমাণ পেতে বেশী দেরী হয়নি। গণতন্ত্র যখন কবরে যায়, রক্ষিবাহিনীর হাতে যখন মারপিঠ শুরু হয়, অনাহারে যখন বুমি খেতে বাধ্য হয় এবং দুর্ভিক্ষে যখন ১৫ লাখের মৃত্যু হয় -তখনই বাঙালিগণ বুঝতে পেরেছে নেতা নির্বাচনে বিশাল ভূল হয়ে গেছে। সে ভূলটি আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুল মালেক উকিলও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ১৫ আগস্টের পর বলেছিলেন ফিরাউনের পতন হয়েছে। কিন্তু সে ভূলটি বুঝে ঊঠার বহু আগেই বাঙালি মুসলিমের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।

দল ও নেতা নির্বাচনে বাঙালি মুসলিমগণ সেরূপ ভূল ১৯৪৭ সালে করেনি। ফলে সেদিন বিনা যুদ্ধে তারা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিল। সে দেশে কখনোই দুর্ভিক্ষ আসেনি। ফলে পেটের দায়ে কাউকে সন্তান বিক্রি করতে হয়নি। বস্ত্রের অভাবে কাউকে জালপড়া বাসন্তিও হতে হয়নি। সেদিন আয়ন ঘরে গিয়ে কাউকে গুম-খুনের শিকারও হতে হয়নি। এবং সেদিন ভারতীয় রাডারের নীচে গোলাম হতে হয়নি। ১৯৭০ সালে নেতা নির্বাচনে গুরুতর ভূলের কারণেই দেশের রাজনীতি দখলে গেছে ভারতের সেবাদাসের হাতে। ফিরাউনের ন্যায় নৃশংস ফ্যাসিস্টও নেতা হতে পেরেছে। নেতা নির্বাচনে যে বিশাল ভূল হয়েছে -সে বোধের তীব্রতা নিয়েই ১৯৭৫’য়ে ১৫ আগস্টে  ঢাকার রাজপথে প্রতিবাদ না হয়ে উৎসব হয়েছে।

অতীতে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলিমগণ কোথায় কোথায় ভূল করেছে –তা নিয়ে আজ অবধি কোন বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন হয়নি। কারণ, সেরূপ নিরপেক্ষ মূল্যায়নের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাই। সে জন্য চাই সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার অবাধ স্বাধীনতা। সেটি আজ অসম্ভব। কারণ, দেশটির উপর চলছে বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদের প্রচণ্ড তান্ডব। এরূপ পরিবেশে ফ্যাসিবাদের নৃশংস নায়ক ও গণতন্ত্রের খুনিকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। প্রশংসা-কীর্তন গাওয়া হয় ভোটডাকাতির। আদালতের বিচারকগণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরগণও ভোটডাকাতিকে বলে সুষ্ঠ নির্বাচন। নির্মোহ বুদ্ধিবৃত্তিক বিচারের কাজ কি এরূপ রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাসিবাদের অধীনে থেকে সম্ভব? ফ্যাসিবাদের এমন দখলদারীতে শাসক দলের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটালে দেশদ্রোহী হতে হয় এবং জেলে যেতে হয়।

মুজিবের নীতি ও রাজনৈতিক এজেন্ডার মূল্যায়নে জরুরী হলো, ইসলামের এজেন্ডা কি এবং মুসলিমের ঈমানী দায়ভারটিই বা কী –সে বিষয়টি সঠিক ভাবে জানা। জানতে হয় রাজনীতিতে মুসলিমদের কল্যাণ বা অকল্যাণের বিষয়গুলি। জানতে হয় রাজনীতির হালাল-হারামের বিষয়গুলি। সেগুলি বুঝলেই সুস্পষ্ট বুঝা যাবে, ইসলামের সাথে মুজিবের রাজনীতির বিরোধটি কোথায়। তখন বুঝা যাবে, মুজিব কোথায় পথ হারিয়েছিলেন। বস্তুত মুজিবের নীতি ও তাঁর রাজনৈতিক এজেন্ডার মূল্যায়ন করতে হবে ইসলামের এজেন্ডাকে সামনে রেখেই। একমাত্র তখনই বুঝা যাবে, ইসলামের এজেন্ডার সাথে মুজিবের গাদ্দারীটা কোথায়। কারণ সঠিক পথটি না জানলে ভূল পথের বিচ্যুতি কতটা বিশাল -সেটি জানা যাবে না।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের পাঠ্য বইয়ে ইসলামের এজেন্ডা এবং মুসলিমের ঈমানী দায়ভার নিয়ে কোন আলোচনা নাই। রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে কীরূপে সংঘটিত হয় মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ -তা নিয়ে একটি পৃষ্ঠাও পড়ানো হয় না। অথচ সে বিষয়গুলি জানা প্রতিটি মুসলিম নর-নারী জন্য ফরজ। এক্ষেত্রে অজ্ঞতা নিয়ে কি নেতা নির্বাচন করা যায়? গৃহের পাহারাদার নির্বাচনেও সততা ও ঈমান-আক্বীদার খোঁজ নিতে হয়। আর নেতার কাজ তো দেশবাসীর স্বাধীনতা, ধর্ম, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির পাহারাদারী। কোন বেঈমান, ধোকাবাজ, মিথ্যুক ও বিদেশী শক্তির চর দিয়ে কি সে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্ভব?  অন্ধ ও বধিরদের ধোকা দেয়া যেমন সহজ, তেমনি সহজ হলো অজ্ঞদের ধোকা দেয়া। এমন অজ্ঞ ব্যক্তিগণ নামাজ-রোজা পালন করেও রাজনীতিতে পথ হারায়। এরূপ অজ্ঞ ব্যক্তগণই ব্যর্থ হয় মুজিবের সঠিক মূল্যায়নে। এমন অজ্ঞরা এমন কি ভয়ানক অপরাধীকেও বন্ধুর আসনে বসায়।

শিক্ষার ব্যর্থতাই বাংলাদেশের সকল ব্যর্থতার কারণ। ইসলামের  অতি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে শিক্ষা না দেয়াই বাংলাদেশের শিক্ষানীতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বা মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী ব্যক্তিটিও জানতে পারে না, তাঁর থেকে মহান আল্লাহতায়ালা প্রত্যাশাটি কি? জানতে পারে না, রাজনীতিতে নবীজী (সা:)’র লিগ্যাসি কি? এরূপ অজ্ঞতার কারণেই বাংলাদেশের একজন প্রবীন প্রফেসর, মসজিদের একজন ইমাম বা মাদ্রাসার একজন প্রবীন শিক্ষকও গর্ব করে বলেন, তিনি রাজনীতিতে নাই। তিনি ভাবেন, রাজনীতিতে না থাকাটিই হলো সততা, প্রজ্ঞা ও ধর্মপরায়নতার প্রমাণ! এটি যে ভীরুতা, কাপুরুষতা ও নিরেট অজ্ঞতা –সে বোধটুকুও তাঁর নাই।

অথচ রাজনীতিতে না থাকার অর্থ নবীজী (সা:)’র সূন্নতের উপর না থাকা। তাঁরা এটুকুও বুঝেন না,  নবীজী (সা:)’র সূন্নতের পথে না থাকর অর্থ আল্লাহতায়ালার পথে না থাকা –যার ঘোষণা এসেছে সুরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ ইসলামী রাষ্ট্র গড়ায় রক্তাক্ত জিহাদ করলেন, নবীজী  (সা:) নিজে ১০টি বছর সে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করলেন এবং সে রাষ্ট্রের সুরক্ষা দিতে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হলেন –সে মহান সূন্নত থেকে এসব জিহাদ-বিমুখ ইমাম, আলেম ও প্রফেসরগণ কি শিখেছে? শিখলে তো বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় আসতো। এজন্যই বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামকে পরাজিত করতে এবং আল্লাহর শরিয়তী আইনকে আদালত থেকে বিলুপ্ত রাখতে কোন বিদেশী কাফির বাহিনীকে যু্দ্ধ করতে হয় না। সে কাজটি নিজ খরচে করে দেয় মুসলিম নামধারী ইসলামের স্বদেশী শত্রুগণ। এমন দেশে নামাজী এবং রোজাদার ব্যক্তিগণও নিজেদের অর্থ, শ্রম ও ভোট দিয়ে ইসলামের স্বঘোষিত শত্রুদের বিজয়ী করে। এরাই ইসলামপন্থীদের পরাজয় নিয়ে উৎসব করে। এবং নিজেদের রাজস্বে দেশটির আদালতে আল্লাহতায়ালার আইনের বদলে কাফেরদের আইনকে বাঁচিয়ে রাখে -যে আইনে জ্বিনাও হালাল, যদি তা সম্মতিতে হয়। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের যুগে কি সেটি ভাবা যেত? এরূপ বিচ্যুতি কারণ একটিই। সেটি হলো কুর’আনী জ্ঞানে গভীর অজ্ঞতা। পবিত্র কুর’আনের শিক্ষা থেকে দূরে সরার কারণেই মানুষ ইসলাম থেকে এতোটা দূরে সরেছে।

ইসলামের শুরুটি নামাজ-রোজা দিয়ে হয়নি, বরং হয়েছে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করে। শিক্ষাদানের কাজটি সফল ভাবে হলে মুসলিম নর-নারীদের মন-মানস পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানে আলোকিত হতো। তখন তাদের চিন্তা-ভাবনা, চরিত্র ও রাজনীতিতে পরিশুদ্ধি আসতো। তখন তারা পূর্ণ ইসলাম পালনে আপোষহীন হতো এবং দুর্বৃত্তদের নির্মূলে জিহাদে নামতো। তখন বাংলাদেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রশাসন, বিচার-আচারসহ সর্বক্ষেত্রে বিপ্লব আসতো। ইসলামের শত্রুগণ তখন শত্রুরূপে চিহ্নিত হতো এবং তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতো। দেশের জনগণ তখন চিনতে পারতো সত্যিকার বন্ধুদের। বাংলার বুকে তখন সভ্য, ভদ্র ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র নির্মিত হতো। তখন বঙ্গীয় এই উর্বর বদ্বীপে নির্মিত হতো ইসলামের শক্তিশালী সিভিলাইজেশনাল স্টেট। নবীজী (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামদের যুগে তো সেটিই হয়েছে। ১০/১০/২০২০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *