শিক্ষায় কুশিক্ষা, উপেক্ষিত কুর’আন এবং সংকটে বাঙালি মুসলিম

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 প্রসঙ্গ: সুশিক্ষা ও কুশিক্ষা

হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া মাত্রই মৃত্যু অনিবার্য হয়। শক্তিশালী দেহ ও হাত-পা তখন কাজ দেয় না। তেমনি দেশবাসী সুশিক্ষা না পেলে দেশের উত্তম জলবায়ু, উর্বর কৃষিভূমি, বিশাল জনসংখ্যা, তেল-গ্যাস এবং বিপুল খনিজ সম্পদ কাজ দেয় না। তখন বড় বড় সোনার খনি ও হিরার খনি নিয়েও দেশ দরিদ্র ও দুর্বল হয়। বরং সে সম্পদ তখন বিশ্বের নানা প্রান্তর থেকে ক্ষুধার্ত ডাকাতদের ডেকে আনে। ফলে জাতীয় জীবনে নেমে আসে নৃশংস পরাধীনতা ও গোলামী। এর উদাহরণ হলো খোদ বাংলাদেশ। এক সময় সুবে বাংলা সমগ্র বিশ্বে সমৃদ্ধশালী দেশরূপে পরিচিত ছিল। বিশ্বজুড়া বাজার ছিল তার মসলিন ও মখমলের ন্যায় উন্নত বস্ত্রশিল্পের। প্রসিদ্ধ ছিল তার জাহাজ নির্মাণ শিল্প। ১৭০০ সালের দিকে বিশ্বের সমুদয় জিডিপির শতকরা ২৫ ভাগ জোগান দিত ভারতীয় উপমহাদেশ। সে সময় বিশ্ব জিডিপির ১২ শতাংশ জোগান দিত সুবে বাংলা একাই। তবে বাংলার সে অঢেল সম্পদ দেশবাসীর জন্য গোলামী উপহার দিয়েছে। বাংলা পরিণত হয় সমগ্র এশিয়ার বুকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির প্রথম গোলাম রাষ্ট্রে। ফলে বাঙালির জীবনে শুরু হয় নৃশংস ঔপনিবেশিক ডাকাতি যা ১৭৬৯-৭০ সালে ডেকে আনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ –যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর রূপে পরিচিত। সে দুর্ভিক্ষে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার মৃত্যু ঘটে। অপরদিকে জ্ঞানের বলে মরুবাসী আরব মুসলিমগণ বিশ্বশক্তির জন্ম দেয়।

দেহের জন্য যেমন হৃৎপিন্ড, দেশবাসীর জন্য তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষা। এজন্যই যারা বিজয় ও গৌরব চায় তারা সর্বপ্রথম শিক্ষার উন্নয়নে হাত দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটি হয়নি। ফলে বিশ্বের এক হাজার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে একটিও বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয় নাই। এশিয়ার ৪০০টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝেও বাংলাদেশী কোন বিশ্ববিদ্যালয় নাই। অথচ সে তালিকায় নেপালের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে; পাকিস্তানের রয়েছে কয়েকটি। এ থেকে বুঝা যায় বাংলাদেশে শিক্ষাখাত কত উপেক্ষিত। শিক্ষা দেয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। জ্ঞান থেকেই পুষ্টি পায় ব্যক্তির রুহ ও আত্মা। জ্ঞানের অভাবে অশিক্ষিত বা কুশিক্ষিত ব্যক্তিটি তখন পশুর ন্যায় শুধু দেহ নিয়ে বাঁচে। মারা পড়ে তার বিবেক বা রুহ। এমন ব্যক্তি নিজ দেহকে কাজে লাগায় স্রেফ জৈবিক তাড়না মেটাতে। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা এমন মৃত বিবেকের মানুষদের পশু নয়, বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর বলেছেন। মানব ইতিহাসের সকল নৃশংস বর্বরতাগুলো ঘটেছে এরূপ মানবরূপী পশুদের হাতে। একমাত্র সুশিক্ষাই বাঁচাতে পারে সেরূপ ভয়ানক পরিণতি থেকে। সুশিক্ষার গুরুত্ব তাই পানাহারের চেয়ে কম নয়। খাদ্য বাঁচায় দেহ, আর জ্ঞান বাঁচায় মানবতা। মানবতা না বাঁচলে স্রেফ দেহ নিয়ে বাঁচা কি আদৌ সুখের হয়? আজকের মানব সভ্যতার মূল সংকট তো এই মৃত মানবতা। ফলে মানুষ পরিণত হয়েছে হিংস্র পশুর চেয়েও নৃশংস জীবে।

কিসে মানবের কল্যাণ এবং কিসে মহা অকল্যাণ –সে বিষয়টি মহান আল্লাহতায়ালার চেয়ে আর কে অধিক জানেন? সে গভীর প্রজ্ঞা ও জ্ঞান নিয়েই আল্লাহতায়ালা নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ হওয়ার আগে জ্ঞানার্জন ফরজ করেছিলেন। অথচ আজ মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে শিক্ষার ময়দানে পিছিয়ে পড়ে। জ্ঞানশূণ্য মানুষেরাই বিবেকশূণ্য ও ভাবনাশূণ্য হয়। পশুকে মানুষ বানানো অসম্ভব, তেমিন অসম্ভব হলো জ্ঞানশূণ্য মানুষকে ঈমানদার বানানো। ইমারত গড়তে প্রথমে ভিত লাগে; তেমনি ঈমানদার হতে প্রথমে জ্ঞান লাগে। এরূপ জ্ঞানহীনদের সম্মন্ধে মহান আল্লাহতায়ালা বয়ান অতি ভয়ানক। এদের সম্মন্ধে পবিত্র কুর’আনে বলা   হয়েছে: এরা চোখ থাকলেও দেখে না, কান থাকলেও শুনে না এবং মগজ থাকলেও ভাবে না। বলা হয়েছে, এরাই হলো সর্বনিকৃষ্ট জীব। মনুষ্যরূপী এসব জীবেরা বন্য পশুর চেয়েও যে অধিক বর্বর ও হিংস্রতর হতে পারে -ইতিহাস সে বিবরণে ভরপুর। দুটি বিশ্বযুদ্ধে এরাই সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। ধ্বংস করেছ হাজারো নগর-বন্দর, লক্ষ লক্ষ ঘরাড়ি এবং অসংখ্য কলকারখানা, রাস্তাঘাট ও দোকানপাট। দু’টি শহরের উপর নিক্ষেপ করেছে পারমানবিক বোমা। মানবরূপী এরূপ জীবদের হাতে কোন দেশ অধিকৃত হলে সেদেশ রেকর্ড গড়ে দুর্বৃ্‌ত্তি, সন্ত্রাস, ডাকাতি, হত্যা, গণহত্যা, অশ্লীলতা, ধর্ষণ ও বর্বর স্বৈরাচারে। পৃথিবীর নানা দেশে এরূপ জীবদের হাতেই পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদ, স্বৈরতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও কম্যুনিজমের ন্যায় নানারূপ হিংস্র মতবাদের প্রতিষ্ঠা ও বীভৎস নাশকতা ঘটেছে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, কাশ্মির ও আরাকানে যেরূপ ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা ঘটেছে -সেটি কোন বন্য পশু, সুনামী, ভূমিকম্প ও রোগ-জীবাণুর কারণে নয়। বরং কারণটি হলো: জর্জ ডব্লিউ বুশ, টনি ব্লেয়ার, ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুটিন, বাশার আল আসাদ, জেনারেল আবুল ফাতাহ আল-সিসি ও নরেন্দ্র মোদীর ন্যায় মানবরূপী দানবদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। তাদের কারণে সন্ত্রাস, হত্যা এবং গণহত্যা স্রেফ খুনি ও ডাকাতদের পেশা থাকেনি, সেটি বহু রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। এরূপ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের কোয়ালিশনই ভয়ানক আন্তর্জাতিক যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। তাদের সন্ত্রাসটি তাদের বিরুদ্ধেও যারা আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ ও ইসলামের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ময়দানে নামে। লক্ষ্যণীয় হলো, মানবরূপী এসব দানবগণ কোন জঙ্গলে বেড়ে উঠেনি। বরং শিক্ষা পেয়েছে বিভিন্ন দেশের প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নিজের সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা তাদেরকে নৃশংস দানব হতে বাধা দেয়নি। বরং দক্ষতা বাড়িয়েছে নৃশংসতায়। নিরক্ষর হলে এরূপ ভয়ানক অপরাধের সামর্থ্য এরা পেত না। ফলে যে নৃশংস গণনির্মূল আদিম যুগে কখনোই ঘটেনি, সেগুলি ঘটছে আধুনিক কালে। দৈহিক রোগ নির্ণয়ে দেখতে হয় রোগী কি খায় ও পান করে। তেমনি নৈতিক রোগের ক্ষেত্রে দেখতে হয় শিক্ষাঙ্গণে কি শেখানো হয় –সে বিষয়টি।

 

ব্যর্থতার পথ ও সফলতার পথ

দৈহিক সুস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করতে করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালা নানারূপ পানাহার দিয়েছেন। তেমনি ইহলৌকিক শান্তি এবং পরলোকে জান্নাত সুনিশ্চিত করতে লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। নাযিল করেছেন আসমানী কিতাব এবং সে ধারার সর্বশেষ কিতাব হলো পবিত্র কুর’আন। মানব জাতির কল্যাণে মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান হলো এই পবিত্র কুর’আন। পবিত্র কুর’আনই হলো ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের পথে একমাত্র নির্ভূল রোডম্যাপ। একমাত্র কুর’আনই দেখায় জান্নাতে পৌঁছার পথ। সে সাথে প্রকাশ করে দেয় জাহান্নামের পথের আলামতও। কী করে জান্নাতের এ রোডম্যাপটি সনাক্ত করা যায় এবং কী করে সেটির অনুসরণে মানব সন্তানদের সক্ষমতা বাড়ানো যায় –শিক্ষাঙ্গণে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা আর কি হতে পারে? তাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে জ্ঞানদান করা। যে শিক্ষাব্যবস্থায় এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি গুরুত্ব পায় না –সেটিকে কি আদৌ কোন শিক্ষা বলা যায়? অথচ এ বিষয়ে গুরুত্ব না দেয়াই বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলির শিক্ষানীতি। আজকের মুসলিম উম্মাহর সকল ব্যর্থতার মূল কারণ শিক্ষাঙ্গণের এই ব্যর্থতা।

অপর দিকে প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের সকল সাফল্যের মুলে ছিল নবীজী (সা:)’র প্রণীত শিক্ষানীতি। তিনি নিজে ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভকে তিনি আমৃত্যু ইবাদতে পরিণত করেন। সে সময় শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল, মানব সন্তানদের আল্লাহতায়ালার নিষ্ঠাবান খলিফা ও জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলা। মুসলিমদের হৃদয়ে বদ্ধমূল করা হয়েছিল জান্নাতের রোডম্যাপ এবং সেটির অনুসরণে আপোষহীন আগ্রহ। পাঠদান হতো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ টেক্সটবুক আল-কুর’আন থেকে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব গড়ে উঠেছিল নবীজী (সা:)’র প্রণীত শিক্ষানীতির কারণেই। মানব ইতিহাসের আর কোন কালেই এরূপ চরিত্রবান ও আত্মত্যাগী মানুষ গড়ে উঠেনি। শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। তাদের সে অর্থদান, শ্রমদান ও রক্তদানের ফলেই গড়ে উঠেছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। সে আমলে বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ গুণ বৃহৎ রাষ্ট্রের শাসকদের জন্য কোন প্রাসাদ নির্মিত হয়নি। খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর খলিফার বাসস্থান ও লেবাসে কোন পরিবর্তন হয়নি। বাস করেছেন পূর্বেকার মাটির ঘরেই। গায়ে দিয়েছেন পূর্বের তালী লাগানো পিরহান। খলিফাগণ একাকী রাস্তায়, মহল্লায় ও হাটে-বাজারে ঘুরেছেন। একাকী ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইমামতি করেছেন। অথচ বাংলাদেশের কোন মন্ত্রী, এমপি বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাস্তায় একাকী নামে না। সাথে দলবল থাকে। খলিফা উমর (রা:) মদিনা থেকে জেরুজালেম প্রায় ৭ শত মাইল পথ সফর করেন একজন মাত্র সহচর ও একটি উঠকে সাথে নিয়ে।

 

অবহেলিত কুর’আন এবং সেক্যুলারিজমের নাশকতা

চিকিৎসা শাস্ত্রের বই না পড়ে ডাক্তার হওয়া যায় না। তেমনি পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান ছাড়া মুসলিম হওয়া যায় না। এতে অসম্ভব হয় ঈমান ও তাকওয়া নিয়ে বেড়ে উঠা। তখন অসম্ভব হয় জান্নাতের উপযোগী রূপে বেড়ে উঠা। তাই মুসলিমের জন্য ফরজ শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত নয়, কুর’আনের জ্ঞানার্জনও। নবীজী (সা:)’র হাদীস: “তোমাদের মধ্যে তারাই শ্রেষ্ঠ যারা কুর’আন শিখে এবং অন্যদের কুর’আন শিক্ষা দেয়।” তাই পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানদান ছাড়া মুসলিম দেশের শিক্ষানীতি প্রণীত হতে পারে না। শিক্ষাঙ্গণে কুর’আন পরিত্যক্ত হলে গাদ্দারী হয় ইসলামের সাথে। বিদ্রোহ সেখানে আল্লাহর বিরুদ্ধে। তখন শিক্ষাখাতে বিপুল শ্রমব্যয় ও অর্থব্যয়েও কাঙ্খিত বিপ্লবটি আনে না। অথচ মুসলিম দেশের শিক্ষানীতিতে এই মৌলিক বিষয়টিই সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত। শিক্ষাঙ্গণে কুর’আনী রোডম্যাপের কোন স্থান নেই। স্কুল-কলেজে যা পড়ানো হয় -তাতে স্থান পায় না জান্নাতের যোগ্য রূপে বেড়ে উঠার বিষয়টি। গুরুত্ব পায়না মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় হওয়ার বিষয়টিও। বরং গুরুত্ব পায় সেগুলিই যা দেশী-বিদেশী শাসকের বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সফল চাকর-বাকর হওয়ার জন্য জরুরি। সেক্যুলার শিক্ষানীতির এটিই তো মূল কথা।

সেক্যুলারিজমের অর্থ, পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির চেতনা নিয়ে বাঁচা। সেক্যুলার শিক্ষায় এজন্যই গুরুত্ব হারায় পারলৌকিক কল্যাণের ভাবনার নিয়ে বাঁচা। এ নীতিতে শিক্ষার চৌহদ্দি ও বিষয়াবলী শুধু ইহকালীন কল্যাণের বিষয়ে সীমিত। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এ শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য ছিল, ব্রিটিশ শাসনের আজ্ঞাবহ গোলাম সৃষ্টি। এসব অনুগত গোলামদের কারণেই ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসন ১৯০ বছর স্থায়ী হয়েছে। শিক্ষাদানের সেক্যুলার অঙ্গণে অনন্ত-অসীম পরকালের কল্যাণের বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনার কোন স্থান নাই। ফলে ছাত্র-ছাত্রীগণ ব্যর্থ হয় জান্নাতের যোগ্য রূপে বেড়ে উঠতে। তখন গুরুত্ব হারায় সিরাতাল মুস্তাকীম খুঁজে পাওয়া ও সে পথে চলার বিষয়টি। ফলে গুরুত্ব হারায় মহৎ গুণে মহান আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার বিষয়টিও। একারণেই শুরু হয় নৈতিক অবক্ষয়। সেক্যুলার শিক্ষার এটিই হলো সবচেয়ে বড় নাশকতা। জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ, বর্ণবাদী নির্মূল, উপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও কম্যুনিজমের ন্যায় তাবত ধ্বংসাত্মক মতবাদের জন্ম সেক্যুলারিজমের গর্ভে। এ শিক্ষা যেমন জাহান্নামে নেয়, তেমনি দুর্বিষহ করে পার্থিব জীবনও। মানব জাতির সকল ব্যর্থতার মূল কারণ এখানেই। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ ও নানারূপ সংকটের পাহাড় গড়ে মানুষ সেটি প্রমাণও করছে। অথচ শিক্ষার মূল লক্ষ্য হতে হয়, বান্দাকে মহান আল্লাহর আজ্ঞাবহ খলিফায় পরিণত করা। তাঁকে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলা। এখানে শিক্ষা কাজ করে বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধির হাতিয়ার রূপে। নইলে মানুষ শয়তানের খলিফায় পরিণত হয়।

পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান থেকে দূরে থাকায় মানুষে যে শুধু মুসলিম রূপে বেড়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে -তা নয়। ব্যর্থ হচ্ছে মৌলিক মানবিক গুণে বেড়ে উঠাতেও। উন্নত রাস্তাঘাট, কলকারখানা, যুদ্ধাস্ত্র, ভোগ্যপণ্য ও আকাশচুম্বি টাওয়ার নির্মাণ শ্রেষ্ঠ কর্ম নয়। শ্রেষ্ঠ কর্ম তো শ্রেষ্ঠ মানব নির্মাণ। এমন মানবগণই মহান আল্লাহতায়ালার বিচারে জান্নাতের যোগ্য বিবেচিত হয়। ইসলামের শ্রেষ্ঠ নবী (সা:)’র সূন্নত তো এমন উন্নত মানব সৃষ্টি। তাঁর হাতে প্রাসাদের বদলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব সৃষ্টি হয়েছে। অথচ মুসলিম দেশগুলিতে আজ বিপুল হারে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা, প্রাসাদতুল্য গৃহ ও আকাশচুম্বি টাওয়ার নির্মিত হলেও শ্রেষ্ঠ মানব নির্মিত হচ্ছে না। বরং ব্যাপক ভাবে বেড়ে উঠছে জাহান্নামের উপযোগী মানুষ। এরাই বাংলাদেশের মত একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, অশ্লীলতা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি ও সংস্কৃতি। প্রশ্ন হলো, শরিয়ত, হুদুদ, খেলাফা, জিহাদ ও মুসলিম বিশ্বের একতার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে কি জান্নাতের যোগ্য হওয়া যায়? ইসলামের মৌল বিধানগুলির বিরুদ্ধে এরূপ বিদ্রোহ তো জাহান্নামে টানে। অথচ জান্নাতমুখি মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও অর্জন তো বিশাল। এমন ব্যক্তির প্রতিটি মুহুর্ত এবং প্রতিটি সামর্থ্য ব্যয় হয় নেক আমলে। তাঁর হাতে শুধু শুরা, শরিয়ত, হুদুদ, জিহাদ ও খেলাফাই প্রতিষ্ঠা পায় না, নির্মূল হয় অবিচার, দুর্বৃত্তি ও স্বৈরাচারী অপশক্তি। তখন নিরাপত্তা পায় জনগণের জানমাল ও ইজ্জত-আবরু। কোন রাষ্ট্রে সে কাজটি না হলে বুঝতে হবে, নামে মুসলিম হলেও ইসলাম থেকে সে রাষ্ট্রের জনগণ ও শাসক শ্রেণীর বিচ্যুতিটা বিশাল।

মুসলিমদের আজকের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি স্রেফ রাষ্ট্রের উপর স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তদের অধিকৃতি নয়। বর্ণ, ভাষা ও ভূগোল-ভিত্তক বিভক্তিও নয়। বরং শিক্ষানীতি ও শিক্ষাঙ্গণের উপর দুর্বৃত্তদের দখলদারি। ফলে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্ত উৎপাদনের কারখানায়। সেটি ধরা পড়ে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, স্বার্থপরতা, দুর্বৃত্তি, আত্মঘাতী যুদ্ধ, সন্ত্রাস, হত্যা, অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের সয়লাবে। এমন কি প্রচণ্ড ব্যর্থতা ব্যর্থতার কারণগুলি বুঝাতেও। এরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতার কারণে কুর’আন না বুঝে পড়ে এবং তা থেকে শিক্ষা না নিয়েও তারা মুসলিম রূপে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। সেটি যে সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অসম্ভব -সেটি বুঝার সামর্থ্যও তাদের নাই। ঈমানবিনাশী এরূপ অজ্ঞতার নির্মূল এজন্যই ইসলামের মূল মিশন। এ কাজটি অসম্পূর্ণ রেখে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে কি কোন বিপ্লব আনা যায়? মহান আল্লাহর দরবারে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্মটি এজন্যই শিক্ষালাভ ও শিক্ষাদান।

 

আল্লাহতায়ালার শিক্ষানীতি ও অপশিক্ষার নাশকতা

মানবকে মানব এবং সে সাথে ঈমানদার রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষাদানের উদ্যোগটি খোদ মহান আল্লাহতায়ালার। তাই মানবকে তিনি শুধু পানাহারই দেন না, প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানের আয়োজনও করেছেন। অথচ পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ ও উদ্ভিদের ন্যায় অন্যান্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। শিক্ষাদানের সে কাজটি না হলে যে লক্ষ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানবকে সৃষ্টি করেছেন -সেটিই পুরাপুরি ব্যর্থ হয়ে যেত। কীরূপে মানব মানবিক গুণে বেড়ে উঠবে, কীরূপে সে মহান আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালন করবে এবং কীরূপে জান্নাতের যোগ্য হবে –সে বিষয়গুলি সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার চেয়ে অধিক কে জানে? মানবকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে মহান আল্লাহতায়ালার সে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজীটি বুঝা যায় লক্ষাধিক নবী-রাসূল প্রেরণ এবং আসমানী কিতাব নাযিলের মধ্যে। সে লক্ষ্যে পবিত্র কুর’আন হলো সমগ্র মানব জাতির জন্য সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ টেক্সট বুক। এজন্যই পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানলাভ মানব জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে। কুর’আনের এ জ্ঞান ছাড়া পশুবৎ ইতর জীব হওয়া থেকে যেমন পরিত্রাণ মেলে না, তেমনি মুক্তি মেলে না জাহান্নামের যাত্রী হওয়া থেকেও।

মুসলিমগণ যখন গৌরবের শীর্ষে ছিলেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ করেছিলেন –তাদের সে সাফল্যের মূলে ছিল কুর’আনী জ্ঞান। জ্ঞানই ব্যক্তির চেতনা, দর্শন, কর্ম, আচরণ ও সংস্কৃতিতে বিপ্লব আছে। মানব তখন মহামানবে পরিণত হয়। নইলে মানব সন্তান অতি অসভ্য ও নৃশংস  কাফেরে পরিণত হয়। মুসলিম বিশ্বে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কমতি নেই। কমতি নেই ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাতেও। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মুসলিমগণ ইতিহাস গড়ছে ভাতৃঘাতী বিভক্তি, দুর্বৃত্তি, স্বৈরাচার, গুম, খুন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। গণতন্ত্র, মানবতা ও মৌলিক মানবিক অধিকার অধিকাংশ মুসলিম দেশেই কবরে শায়ীত। উন্নয়নের সূচকে (development indicators) নীচে নামায় তারা কাফেরদেরও হার মানিয়েছে। ব্যর্থতার কারণটি মূলত শিক্ষায় তথা জ্ঞানের রাজ্যে। পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানকে সিলেবাসের বাইরে রাখায় ছাত্রদের দর্শন, কর্ম ও চরিত্রে কোন বিপ্লব আসছে না। কুর’আনী জ্ঞানের ভান্ডার থেকে জ্ঞান লাভ ও সে জ্ঞানের অনুসরণ ছাড়াই এ জগতে বিজয় লাভ, সম্মান লাভ ও শান্তি লাভ সম্ভব -সেটি বিশ্বাস করলে কি কাফির হওয়ার জন্য মূর্তিপূজার প্রয়োজন পড়ে? অথচ এমন একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস দখল জমিয়ে আছে মুসলিম দেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ণধারদের মগজে। ফলে পবিত্র কুর’আন থেকে শিক্ষা দান ও শিক্ষা লাভের বিষয়টি বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলির পাঠ্যক্রমে আদৌ গুরুত্ব পায়নি। ফলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্য়ালয়ের ছাত্র-ছাত্রীগণ তাদের ছাত্র জীবন শেষ করে কুর’আন বুঝার সামর্থ্য অর্জন না করেই। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষানীতির এটিই হলো সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। অথচ কুর’আন বুঝার সামর্থ্য ও গুরুত্বটি কোন মামূলী বিষয় নয়। সে সামর্থ্য ছাড়া ন্যায়-অন্যায় চেনা, সিরাতাল মুস্তাকীমে চলা এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার সামর্থ্য সৃষ্টি হয় না।

রাস্তার দু্’পাশে যে অসংখ্য সাইন বোর্ড -সেগুলি দেখা ও বুঝার সামর্থ্য না থাকলে পৃথিবীর কোন দেশেই এমন অযোগ্য ব্যক্তিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হয়না। কারণ, সে সাইন বোর্ডগুলি দেয় বিপদ-আপদের আগাম হুশিয়ারি ও পথের নির্দেশনা। সেগুলি না বুঝে সঠিক পথে ও সঠিক ভাবে গাড়ি চালনা অসম্ভব। সে সামর্থ্য অন্ধ ও অবুঝ ব্যক্তিদের থাকে না। রাস্তায় গাড়ি চালাতে নামলে তারা দুর্ঘটনা ঘটায়। সেরূপ বিপদ ঘটে জীবনচালনার ক্ষেত্রেও। এ পার্থিব জীবনে বস্তুত প্রতিটি ব্যক্তিই একজন ড্রাইভার। নিজের জীবন-গাড়ির স্টিয়ারিংটি তো তারই হাতে। এখানে দায়ভারটি আরো গুরুতর; এখানে পথ হারালে পৌঁছতে হয় অনন্ত অসীম কালের জন্য জাহান্নামের আগুনে। তাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্কিল বা দক্ষতাটি ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রশাসনিক বা বৈজ্ঞানিক পেশার নয়, বরং সেটি সঠিক পথে ও সঠিক ভাবে জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা। সে লক্ষ্যে পবিত্র কুর’আন হলো একমাত্র সঠিক রোড ম্যাপ। তাই সঠিক পথে জীবন পরিচালনা করতে হলে পবিত্র কুর’আন বুঝতেই হবে। এছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। কুর’আন থেকে দিক নির্দেশনা না নিলে বিপথগামী হতেই হবে। কুর’আনী জ্ঞানের অপরিসীম গুরুত্ব তো একারণেই।

পবিত্র কুর’আন দেয়, কোনটি হারাম ও হালাল, কোনটি শ্লীল ও অশ্লীল এবং কোনটি ন্যায় ও অন্যায় সে বিষয়ে সিগনাল। সে সিগনালগুলি দেখা, বুঝা ও অনুসরণের যোগ্যতা না থাকলে পথভ্রষ্টতা অনিবার্য। সে পথভ্রষ্টতায় জুটে জাহান্নাম। আজ মুসলিম দেশগুলির রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদলত ও প্রশাসনে যে প্রচণ্ড পথভ্রষ্টতা -তার কারণ তো কুর’আনী বিধি-নিষেধগুলি নিয়ে অজ্ঞতা এবং সেগুলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিদ্রোহের কারণে বিপুল ভাবে বেড়েছে পথভ্রষ্ট মানুষের সংখ্যা। এদের কারণেই এমন কি মুসলিম দেশেও পরাজয় বেড়েছে ইসলামের। যে ব্যক্তির সমগ্র জীবন কেটেছে কুর’আন অর্থসহ না বুঝে পড়ে, সে সামর্থ্য তার মধ্যে সৃষ্টি হবে কীরূপে? সে যে পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামমুখি -সেটিই বা বুঝবে কীরূপে? সেটি বুঝতে হলেও তো সিরাতাল মুস্তাকীমের রোডম্যাপটি চিনতে হয়। একমাত্র তখনই জানা সম্ভব, তার নিজের অবস্থান সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে কতটা দূরে।

তবে এখানে বিষয়টি শুধু অজ্ঞতার নয়, বরং সেটি ইসলামের বিরুদ্ধে দুশমনির বিষয়ও। সে দুশমনির কারণেই আগ্রহও নেই সিরাতাল মুস্তাকীম চেনায়। ফলে আগ্রহ নাই কুর’আনের জ্ঞানার্জনে। যে ব্যক্তি চীনে যেতে চায়, সে কি কখনো ইংল্যান্ডের পথের খোঁজ নিবে? একই অবস্থা ইসলামের দুশমনদের। জান্নাতের পথে চলায় যাদের আগ্রহ নেই এবং পরকালের উপর যাদের বিশ্বাসও নাই, তারা কেন জান্নাতের পথের খোঁজ নিবে? নইলে জাহান্নামে পথ এবং জান্নাতের পথ –এ দুটি ভিন্ন পথ যে একত্রে চলে না, সেটি বুঝে উঠা কি এতোই কঠিন? এরাই সিলেবাসে কুর’আন শিক্ষার সুযোগ দিতে রাজী নয়। এরা নিজেদের ইসলামের অনুসারী রূপে পরিচয় দেয় নিছক অন্যদের ধোকা দেয়ার লক্ষ্যে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সেটি জরুরিও। নিজেদের মুসলিম নাম ও মুসলিম পরিচিতিকে তারা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে। মহান আল্লাহতায়ালা তাদের সে কপট চরিত্রটি তুলে ধরেছেন সুরা মুনাফিকুনে। সে মুনাফিকিটি আরো সুস্পষ্ট রূপে ধরা পড়ে যখন সেক্যুলারিজম, ন্যাশনালিজম, সোসালিজম ও স্বৈরাচারের পূজারী এবং শরিয়তের প্রচণ্ড বিরোধী হয়েও তারা মাথায় টুপি দেয়, তসবিহ হাতে জনসম্মুখে হাজির হয়, দাড়ি রাখে, নামাজ-রোজা পালন করে, হজ্জ-উমরাহ করে, মানুষকে ইফতার খাওয়ায় এবং জনসভায় দাঁড়িয়ে বলে “আমিও মুসলিম।”

 

অবহেলিত কুর’আন

পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ -সেটি বুঝতে হলে মানব জীবনের মূল লক্ষ্যটি বুঝতে হয়। মানব জীবনে মৃত্যু বা অন্ত বলে কিছু নাই, আছে স্রেফ ইহকালীন জীবন থেকে পরকালীন জীবনে ইন্তেকাল তথা স্থানান্তর। এরপর শুরু হয় অনন্ত-অসীম কালের পরকালীন জীবন। সে পরকালীন জীবনে যেমন জান্নাত প্রাপ্তির ন্যায় বিশাল প্রমোশন আছে, তেমনি জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হওয়ার ভয়ানক আযাবও আছে। প্রমোশন বা পুরস্কার লাভের জন্য লাগাতর পরীক্ষাও আছে। কারণ, প্রমোশনের জন্য অনিবার্য হলো পরীক্ষা। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা তাই এ পার্থিব জীবনকে পরীক্ষাকালীন জীবন রূপে ঘোষণা দিয়েছেন। এবং ফল ভোগের জন্য হলো আখেরাত। সে অনিবার্য পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার জন্য যেমন তাগিদ দিয়েছেন, তেমনি হুশিয়ারীও দিয়েছেন। যেমন সুরা আনকাবুতের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন: “মানুষ কি মনে করে নিয়েছে যে ঈমান এনেছি -এ কথা বললেই তাকে ছেড়ে দেয়া হবে? অথচ তাদের পূর্বে যারা এসেছিল আমরা তাদেরও পরীক্ষা করেছি; (পরীক্ষার মধ্য দিয়ে) আল্লাহ জেনে নিয়েছেন ঈমানের দাবীতে কে সদ্যবাদী এবং কে মিথ্যুক।”

যেখানেই পরীক্ষায় পাশের প্রশ্ন, সেখানেই নিবিড় জ্ঞানার্জনের প্রশ্ন। কারণ অজ্ঞতায় পাশ জুটে না। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় পাশ করতে সিলেবাস মেনে পড়াশুনা করতে হয়। নির্দেশিত টেক্সট বইটি বার বার পড়তে হয়। সে নির্ধারিত টেক্সট বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই যতই পাঠ করা হোক তাতে পাশ জুটে না। একই কারণে টেক্সট বই পড়তে হয় পরকালে প্রমোশন বা পুরস্কার লাভের প্রয়োজনে। পবিত্র কুর’আন হলো সেই নির্ধারিত টেক্সট বই। অন্য বই পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি জুটতে পারে, কিন্তু এ পরীক্ষায় পাশ জুটে না। জান্নাতও জুটে না। তাই কুর’আনের জ্ঞান থেকে দূরে থাকার বিপদটি ভয়াবহ। তখন ব্যর্থতা অনিবার্য হয়। এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদতটি হলো কুর’আনের জ্ঞানার্জন। এবং শ্রেষ্ঠ দানটি হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান দান।

মানব সৃষ্টি নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার স্ট্রাটেজি ও সূন্নতটি বুঝা যায়, মহান নবীজী (সা:)’র উপর সর্বপ্রথম নাযিলকৃত পবিত্র কুর’আনের ৫টি আয়াতের দিকে নজর দিলে। প্রথম নাযিলকৃত সুরা আলাকের ৫টি আয়াত নামাজ-রোজা বা হজ্জ-যাকাত ফরজ করতে নাযিল হয়নি। নবীজী (সা:)’র সাথে প্রথম সংযোগেই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁকে “ইকরা” তথা পড়ার হুকুম দিয়েছেন। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের হুকুম এসেছে প্রায় এক যুগ পর। লক্ষ্য এখানে নবীজী (সা:) ও তাঁর অনুসারীদের মাঝে পবিত্র কুর’আন পড়া তথা তা থেকে জ্ঞান লাভের সামর্থ্য সৃষ্টি। নবীজী (সা:) নিরক্ষর ছিলেন। কাগজের পৃষ্ঠা থেকে কুর’আন পাঠের সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তিনি পাঠ করতেন তার স্মৃতির পাতায় খোদিত কুর’আন থেকে। লক্ষণীয় হলো, কুর’আন পাঠের সামর্থ্য বাড়াতেই মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সূদান, মরক্কো, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজিরিয়া, মালি, মৌরতানিয়ার ন্যায় বহুদেশের জনগণ নিজেদের মাতৃভাষাকে দাফন করে আরবী ভাষাকে নিজ ভাষা রূপে গ্রহণ করেছিলেন। কুর’আনের জ্ঞানার্জন তাদের কাছে পরীক্ষায় পাশের জন্য প্রায়োরিটি রূপে গণ্য হয়েছিল।

মাতৃভাষা পরিত্যাগ করা মানব ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। মানুষ ভাষার জন্য বাঁচে না। বরং ভাষাকে বাঁচতে হয় মানুষের প্রয়োজন মেটাতে।  সে সামর্থ্য না থাকলে মানব জীবন থেকে সে ভাষাকে বিদায় নিতে  হয়। যেমন কবরে গেছে সংস্কৃত ভাষা। ইউরোপ-আমেরিকায় এসে নানা ভাষার লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে ইরাজী, ফরাসী ও নানা বিদেশী ভাষা শিখছে। সেটি নিছক উপার্জন বাড়াতে। এবং সেটি অন্য ভাষীদের দর্শন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রশাসন ও ব্যবসার সাথে সংযোগ বাড়াতে। কিন্তু মানবের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তো অনন্ত-অসীম কালের পরকালীন জীবনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো। সে জন্য অপরিহার্য হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে এবং তাঁর নাযিলকৃত কুর’আনের সাথে গভীর সংযোগ স্থাপন। সে জন্য জরুরি  হলো কুর’আনের ভাষা শিক্ষা। সে কারণেই প্রথম যুগের মুসলিমগণ নিজেদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে কুর’আনের ভাষা শিখেছেন। এতে তাদের যেমন সিরাতাল মুস্তাকীম চেনার সামর্থ্য বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সে পথে চলার সামর্থ্য। সে সাথে বেড়েছে ঈমানের পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য। সে কালে তাদের গৌরব ও বিজয় এসেছে তো সে পথেই। আর আজকের মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে পথভ্রষ্টতায়। পথের রোডম্যাপটি না জানলে -পথভ্রষ্টতাই তো স্বাভাবিক। আর পথভ্রষ্টতায় কি বিজয় বা ইজ্জত জুটে? সেটি তো অপমান ও জাহান্নামের পথ।

পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচাই তো মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। বিদ্যাশিক্ষার লক্ষ্য হতে হবে সে এজেন্ডা পূরণে সহায়তা দেয়া। মানব জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন ইস্যু কি থাকতে পারে?  সে এজেন্ডাকে মানব মনে স্থায়ী ভাবে বসাতেই তো ৫ ওয়াক্ত নামাজের প্রতি রাকাতে সুরা ফাতেহা পাঠের বিধান। এবং সুরা ফাতেহাতে যে দোয়াটি নামাজের প্রতি রাকাতে পাঠ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেটি সম্পদ লাভ, সন্তান লাভ, ক্ষমতালাভ বা সুস্বাস্থ্য লাভের দোয়া নয়, বরং সেটি হলো সিরাতাল মুস্তাকীম পাওয়া এবং পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার দোয়া। এটিই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়া। এবং এই দোয়াটি শিখিয়ে দিয়েছেন মহা দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালা। শুধু তাই নয়, কোনটি সিরাতাল মুস্তাকীম এবং কোনটি ভ্রষ্টতার পথ –সে জ্ঞানটিও তিনি অতি বিস্তারিত ভাবে দিয়েছেন পবিত্র কুর’আনে। পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জন এজন্যই ফরজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকের মুসলিম জীবনে কতটা গুরুত্ব পেয়েছে সিরাতাল মুস্তাকীম খুঁজে পাওয়া এবং কতটা গুরুত্ব পেয়েছে পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার বিষয়টি? সে বিষয়ে ভয়ানক অবহেলা ধরে পড়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। বরং পথভ্রষ্টতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশর ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রমটি পরিচালিত হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত টেক্সট বুক পবিত্র কুর’আনকে পরিহার করার মধ্য দিয়ে। শিক্ষাব্যবস্থা পরিণত হয়েছে কুর’আনের নির্দশনা থেকে দূরে সরানোর হাতিয়ারে। এভাবে মুসলিমদের রাজস্বের অর্থে কার্যকর করা হচ্ছে শয়তানের এজেন্ডা। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম ও তাঁর শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় বিদ্রোহ এবং এর চেয়ে বড় অবাধ্যতা আর কি হতে পারে?

 

শিক্ষাদানে আল্লাহতায়ালার সূন্নত

সুরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা নিজেকে যেমন সব কিছুর স্রষ্টা (খালেক) এবং সকল সৃষ্টির প্রতি দয়াময় (আকরাম) রূপে পেশ করেছেন, তেমনি পেশ করেছেন অসংখ্য অজানা জ্ঞানের মহান শিক্ষাদাতা রূপেও। তাঁর নিজের ভাষায়: “আল্লামা ইনসানা মা লাম ইয়ালাম”। সুরা রাহমানের শুরুতে মহান আল্লাহতায়ালা নিজেকে রাহমান তথা পরম করুণাময় হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। দ্বিতীয় আয়াতে সে করুণার নির্দশন রূপে নিজেকে উল্লেখ করেছেন কুর’আনী জ্ঞানের শিক্ষক রূপে। বলেছেন: “আল্লামাল কুর’আন।” অর্থ: তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুর’আনকে। তাই শিক্ষাদান করা মহান করুণাময়ের পবিত্রতম সূন্নত। এবং যে ব্যক্তি কাউকে পবিত্র কুর’আন শিক্ষা দেয়, সে বস্তুত অনুসরণ করে মহান আল্লাহতায়ালার সে পবিত্র সূন্নত। এ জীবনে মহান আল্লাহতায়ালা সূন্নত পালনের চেয়ে বড় ইবাদত আর কি হতে পারে? মহান নবীজী (সা:)’র হাদীসে কুদসী: “তাখাল্লুকু বি আখলাকিল্লাহ।” অর্থ: তোমরা নিজেদের আখলাক গড়ে তোল মহান আল্লাহতায়ালার আখলাকের অনুকরণে। এবং সেটি দেখা গেছে মহান সাহাবাদের মাঝে। মহান আল্লাহতায়ালার জ্ঞানদানের সে পবিত্র সূন্নতটি পালন করতে গিয়ে নবীজী (সা:) নানা জনপদে ঘুরেছেন। এজন্য কারো থেকে তিনি কোন মজুরী চাননি। বরং জ্ঞানদানের মিশনে তিনি প্রচণ্ডভাবে আহত ও অপমানিত হয়েছেন। জ্ঞানদানের কাজে নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের কুর’বানীও কি কম? পবিত্র কুর’আনের শিক্ষক রূপে তাঁরা বহু হাজার মাইল দূরের নানা অজানা দেশের গ্রামগঞ্জে পৌঁছেছেন। ইসলামের আলো জ্বালাতে জিহাদ করেছেন, অনেকে শহীদও হয়েছেন। তাদের সে কুর’বানীর কারণেই ইসলাম বিশ্বময় বিস্তার পেয়েছে। এবং বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছে মুসলিম উম্মাহ।

 

ধর্মব্যবসায়ীদের কান্ড

শিক্ষাদানে মুসলিমদের ব্যর্থতা বিশাল। মহান আল্লাহতায়ালার সে সূন্নত মুসলিমদের মাঝে বেঁচে নাই। বেঁচে নাই নবীজী (সা:)’র সূন্নত। ইসলামের এ শ্রেষ্ঠ ইবাদতটি অর্থলোভীদের চাকুরিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি সমাজেই কত রকম পেশা এবং অর্থ উপার্জনের কত পথ! হযরত আবু বকর (রা:) বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন ইমামে আযম আবু হানিফা (রহ:)। ইসলামের ইতিহাসের বড় বড় আলেমগণ কখনোই ওয়াজকে অর্থ উপার্জনের পেশায় পরিণত করেননি। সেটিকে তারা ইবাদত মনে করতেন। ইবাদতে অর্থ কিসের? অথচ কি বিস্ময়! ওয়াজ ছাড়া অর্থ-উপার্জনের আর কোন পেশাই এই আলেমগণ খুঁজে পেলেন না। পচনটি এতটা গভীরে পৌঁছেছে যে, অর্থলাভের প্রতিশ্রুতি না পেলে ওয়াজের জলসায় তাঁরা হাজির হন না এবং ওয়াজ করেন না। অথচ জ্ঞানদানের ইবাদতে নবীজী (সা:) আরবের বিভিন্ন জনপদে নিজি খরচে এবং নিজ বাহনে ঘুরেছেন। এ কাজে কখনোই তিনি কারো থেকে কোন মজুরী নেননি, বরং বিনিময়ে পাথর ও গালি-গালাজ খেয়েছেন। নবীজী (সা)’র সে মহান সূন্নত আজ আর বেঁচে নাই। এই পবিত্র ইবাদত বেতনভোগীদের পেশাদারীতে পরিণত হয়েছে। এহেন ধর্মব্যবসায়ীদের কারণে নবীজী (সা:)’র যুগের ইসলাম খোদ মুসলিম ভূমিতেই অপরিচিত হয়ে পড়েছে। এরই ফল হলো, মুসলিম সন্তানেরা বেড়ে উঠছে ও ধর্ম পালন করছে কুর’আনী  জ্ঞানের গভীর অজ্ঞতা নিয়ে। ফলে তাদের জীবনে গুরুত্ব পায়নি কুর’আন শিক্ষা, শরিয়ত, হুদুদ, খেলাফা, উম্মাহর একতা ও আল্লাহর তায়ালার পথে জিহাদ। তারা ভেবে নিয়েছে, ইসলামের এ বিধানগুলি না মেনেও ইসলাম পালন সম্ভব। এমন একটি ভাবনার কারণেই নবীজী (সা:)’র ইসলাম তাদের কাছে মৌলবাদ বা সন্ত্রাস মনে হয়। এবং সে ইসলামের যারা প্রতিষ্ঠা চায় তাদের হত্যা করাটাকে বৈধ মনে করে। তাদের হত্যার কাজে ইসলামের দেশী শত্রুরা এমন কি বিদেশী কাফরদের সাথে কোয়ালিশনও গড়ে!

শিক্ষাক্ষেত্রের ব্যর্থতাগুলি শুধু শিক্ষাঙ্গণে সীমিত থাকে না। তখন কুশিক্ষার নাশকতা রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রশাসন, আইন-আদলত, মূল্যবোধ, ব্যবসা-বাণিজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণ দেয়া যাক। মুসলিম জীবনে হারাম হলো বিভক্তি গড়া এবং ফরজ হলো একতার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আজ মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গতে যুদ্ধ হয়। এবং সে যুদ্ধে মুসলিম ভূমিত হিন্দুত্ববাদী কাফের শত্রুদের ডেকে আনাও দেশপ্রেম গণ্য হয়। বিচ্ছিন্ন দেশ গড়ার হারাম কর্ম নিয়ে প্রতি বছর উৎসবও হয়। ইসলাম থেকে দূরে সরাটি মুসলিম জীবনে এতই গভীর যে, ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে ৫০টির অধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত মুসলিম উম্মাহর যে মানচিত্র গড়া হয়েছে –সে বিভক্তি নিয়ে তাদের মাঝে কোন বেদনা নেই। সামান্যতম দুঃখবোধও নাই। বরং বিভক্তির এই হারাম মানচিত্রকে বাঁচিয়ে রাখাই তাদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রতিরক্ষা নীতি ও বিদেশ নীতিতে পরিণত হয়েছে। ভৌগলিক বিভক্তির প্রতীক যে জাতীয় পতাকা -সেটির পূজা নিত্যদিনের আরাধনায় পরিণত হয়েছে। এমন কি যারা নামাজী ও আলেম -তাদের মাঝেও এরূপ নিষিদ্ধ বিভক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ নেই। কিসে আল্লাহতায়ালা খুশি হন এবং কিসে নারাজ হন –তা নিয়ে তাদের মাঝে কোন ভাবনা নাই। এমন কি যারা নিজেদেরকে ইসলামপন্থী নেতাকর্মী রূপে জাহির করে তারাও কাফেরদের বিজয় এবং মুসলিম দেশ ভাঙ্গার দিনগুলি নিয়ে রাস্তায় উৎসবমুখর মিছিল বের করে। উম্মাহর দেহে এরূপ বিভক্তির দেয়াল নিয়ে বাঁচাকে তারা হালাল করে নিয়েছে। এভাবেই লাগাতর অবাধ্যতা হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার সে কঠোর নির্দেশটির যাতে বলা হয়েছে: “ওয়া তা’সিমু বি হাবলিল্লাহি জামিয়াঁও ওলা তাফাররাকু” (অর্থ: মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরো আল্লাহতায়ালার রশি তথা কুর’আনকে এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না।) -(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৩।) প্রশ্ন হলো, কুর’আনী হুকুমের এমন অবাধ্যতা নিয়ে কি প্রকৃত মুসলিম হওয়া যায়? এরূপ বিদ্রোহে কি জুটে মহান আল্লাহতায়ালার রহমত? এরূপ বিভক্তি নিয়ে বাঁচা যে প্রতিশ্রুত আযাবের পথ -সে হুশিয়ারিটি এসেছে সুরা আল-ইমরান ১০৫ নম্বর আয়াতে। মুসলিম জীবনে এরূপ ব্যর্থতা ও বিচ্যুতি এবং হারাম রাজনীতিতে এরূপ আসক্তি দিন দিন গভীরতর হচ্ছে শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভে গভীর ব্যর্থতা থেকে। এবং সেটি ঘটছে পবিত্র কুর’আন থেকে দূরে সরার কারণে।

গৌরব-কালের মুসলিমদের থেকে আজকের মুসলিমদের অমিলগুলি বিশাল। তবে মূল পার্থক্যটি হলো, আজকের মুসলিমগণ বিচ্ছিন্ন হয়েছে পবিত্র কুর’আন থেকে। ফলে তাদের চলার পথটি প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের থেকে ভিন্ন। রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ, ধ্যানধারণায় সেক্যুলারিজম, অর্থনীতি সূদ, সংস্কৃতিতে অশ্লীলতা, বুদ্ধিবৃত্তিতে ভ্রষ্টতা এবং একতার বদলে বিভক্তি -এরূপ নানা বিচ্যুতি ভর করেছে আজকের মুসলিমদের উপর। ফলে অসম্ভব হচ্ছে সত্যিকার মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। গৌরবকালে মুসলিম জীবনে এরূপ বিচ্যুতি ছিল না। পবিত্র কুর’আনের দেখানো রোডম্যাপটি ছাড়া অন্য কোন মত ও পথ তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের পথটি ছিল বিশ্বের বুকে সবচেয়ে শক্তিশালী সভ্যতা রূপে উত্থানের। অথচ আজ ইতিহাস গড়ছে কাফিরদের হাতে পরাজয়, অধিকৃতি, নির্যাতিত, নিহত ও অপমানিত হয়ে। সে সাথে গ্রহন যোগ্যতা পাচ্ছে শরিয়ত বর্জন, অশ্লীলতা, পতিতাপল্লী, সূদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, স্বৈরাচার ও  মিথ্যাচারকে বৈধতা দিয়ে বাঁচা। ইসলামের বিপক্ষ শক্তির হাতে এরূপ পরাজয় নিয়ে এমনকি আলেমদের মাঝেও কোন ক্ষোভ নেই। প্রতিরোধও নাই। আগুনের শিখা থাকলে উত্তাপও থাকে। তেমনি কুর’আনী জ্ঞানে আলোকিত মন থাকলে অনাচার, মিথ্যাচার ও পাপাচারের বিরুদ্ধে জিহাদও থাকে। সে জিহাদ না থাকায় প্রমাণিত হয় অশিক্ষা ও কুশিক্ষার হাতে তাদের চেতনার ভূমি কতটা প্লাবিত।

 

সওয়াব বনাম অবাধ্যতা

পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানদান ও জ্ঞানার্জনকে যেরূপ ওহী নাযিলের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়েছিল -সেটিই মুসলিমদের কাছে আজ সবচেয়ে গুরুত্বহীন। আজ কুর’আন পড়া হয় স্রেফ সাওয়াব হাসিলের জন্য, জ্ঞানার্জনের জন্য নয়। হিদায়েত বা নির্দেশনা নেয়ার জন্যও নয়। রাজনীতি, আইন-আদালত, শিক্ষা ও প্রশাসনে নির্দেশনা নেয়া হয় পাশ্চাত্যের কাফিরদের থেকে। ফলে মুসলিম দেশগুলিতে কাফিরদের দর্শন, আইন, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির এতো বিজয়। পবিত্র কুর’আন থেকে নির্দেশনা নেয়ায় আগ্রহ থাকলে সেটি বুঝাতেও আগ্রহ থাকতো। বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে এমন মানুষের সংখ্যা বহু লক্ষ যারা জীবনে সমগ্র কুর’আন বহুবার পাঠ করেছে। কিন্তু একটি বারও পুরা কুর’আন শরীফ বুঝে পাঠ করেনি। পবিত্র কুর’আনের যে আয়াতগুলি নামাজে পাঠ করা হয়, সেগুলির সঠিক অর্থই বা ক’জনে জানে? অথচ নামাজে ধ্যানমগ্নতা আসে তো পঠিত আয়াতগুলির অর্থ বুঝাতে। নামাজের ওজন তো এভাবেই বাড়ে। নামাজ তখন মুমিনের যিকরে পরিণত হয়। সেটি না হলে মন অধিকৃত হয় লাগামহীন চিন্তায়।

সে ধ্যানহীনতা থেকে মু’মিনের নামাজকে বাঁচাতেই মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ: “ইয়া আইয়োহাল্লাযীনা আ’মানু লা তাকরাবুস সালতা ওয়া আনতুম সুকারা হাত্তা তা’লামু মা তা’কুলুন” অর্থ: হে ঈমানদারগণ, তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়োনা যদি মাদকাসক্ত হও এবং যতক্ষণ না তোমরা যা বলো তা বুঝতে না পারো। -(সুরা নিসা, আয়াত ৪৩)। এই আয়াতটি তখন নাযিল হয়েছে যখন মদপান হারাম ঘোষিত হয়নি। ফলে কেউ কেউ মদ্যপ অবস্থায় নামাজে হাজির হত। মাদকাসক্ত ব্যক্তি এমন কিছু বলে  যার অর্থ সে নিজেও বুঝে না। তবে সে অবস্থাটি তো তাদেরও যারা কুর’আনের ভাষা বুঝে না। নামাজে দাঁড়িয়ে মাদকাসক্তদের ন্যায় তাদের মনেও কোন রূপ ধ্যানমগ্নতা বা মনযোগ থাকে না। তবে পার্থক্যটি হলো, মদের আছড় কয়েক ঘন্টা পর দূর হয়, কিন্তু কুর’আনের ভাষা যারা বুঝে না, তাদের জীবনে নামাজে ধ্যানমগ্ন হতে ব্যর্থ হওয়ার সমস্যাটি আজীবনের জন্য থেকে যায়। সেটি দূর করতেই অতীতে মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সূদান, মরক্কোসহ বহু দেশের মুসলিমগণ নিজেদের মাতৃ ভাষা পাল্টিয়ে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছিলেন। কুর’আন বুঝা, তা থেকে জ্ঞান লাভ করা এবং অপরকে সে জ্ঞানদান করার গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে নবীজী (সা:)’র হাদীস থেকেও। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজে কুর’আন থেকে শিক্ষা নিল এবং অন্যকে কুর’আন শেখালো সে ব্যক্তিই সবার মধ্যে উত্তম।” কিন্তু এই জ্ঞানদানের কাজটি বাংলাদেশে কতটুকু হচ্ছে?

কোন ভাল পাঠ্য পুস্তক বহুশত বার না বুঝে পড়লেও তাতে পরীক্ষায় পাশ জুটে না। না বুঝে পুস্তক-পাঠ শুধু অর্থহীনই নয়, বেওকুফিও। এতে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। কোন শিক্ষক যদি ছাত্রদের এরূপ নছিহত দেয় যে পরীক্ষায় পাশের জন্য টেক্সবইটি না বুঝে পড়লেও পাস জুটবে, এমন শিক্ষককে কেউ কি মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ বলবে? এরূপ উদ্ভট কথা বলা ও বিশ্বাস করা –উভয়ই তো বুদ্ধিহীনতা। অথচ বাংলাদেশে সে বুদ্ধিহীন আচরনটি হচ্ছে পবিত্র কুর’আনে সাথে এবং সেটি না বুঝে তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে। এমন আচরণ সওয়াব দিবে না, বরং গুনাহ বাড়াবে।

এ পার্থিব জীবনে প্রতি পদে ও প্রতি মুহুর্তে ঈমানের পরীক্ষা হয়। ঈমানদার ব্যক্তি মহান আল্লাহতায়ালার করুণা লাভ ও জান্নাত লাভের যোগ্য বিবেচিত হয় সে পরীক্ষায় পাশের পরই। পাশের সে সামর্থ্য বাড়াতেই মহান রাব্বল আলামিন নাযিল করেছেন পবিত্র কুর’আন। প্রশ্ন হলো, সে সামর্থ্য কি পবিত্র কুর’আন না বুঝে পড়লে সৃষ্টি হয়? পবিত্র কুর’আনের কোথাও কি না বুঝে কুর’আন পাঠের ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে? নবীজী (সা:) বলেছেন, পবিত্র কুর’আনের প্রতিটি অক্ষর পাঠে রয়েছে নেকী। কিন্তু সেটি কি না বুঝে পড়ায়? খাওয়ার অর্থ খাদ্যকে শুধু মুখে পুরা নয়। বরং সেটি চর্বন করা, গিলে ফেলা এবং হজম করা। নইলে সেটি খাওয়া হয় না। বিষয়টি যে কোন বিবেকমান মানুষই বুঝে। তাই কাউকে খেতে বললে গিলতে বলাটি অনর্থক। গিলা যে খাওয়ার সাথে যুক্ত সেটি যে কোন ব্যক্তিও বুঝে। তেমনি কোন বই থেকে কিছু পড়ার অর্থ হলো, যা পড়া হয় সেটি বুঝা। নইলে সেটিকে কি পড়া বলা যায়? অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে ঘরে ঘরে না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াতের ন্যায় পরম বিবেকহীনতার মহড়া হচ্ছে। বিস্ময়ের বিষয় হলো, পবিত্র কুর’আনের সাথে কৃত সে কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণকে দেশের আলেমদের পক্ষ থেকে সওয়াবের কাজ রূপে জায়েজ করা হয়!

কুর’আন কি এ জন্য নাযিল করা হয়েছে যে, মানুষ হিদায়েতের এ মহানগ্রন্থ টি স্রেফ পাঠ করবে এবং তা বুঝবে না এবং তা থেকে শিক্ষাও নিবে না? না বুঝে তেলাওয়াতে প্রচণ্ড অবাধ্যতা হয় সে নির্দেশের। পবিত্র কুর’আনে বলা হয়েছে, “ফাযাক্কের বিল কুর’আন”। অর্থাৎ কুর’আন দ্বারা মানুষকে সাবধান করো। বলা হয়েছে, “জাহিদু বিহি জিহাদান কাবিরা।” অর্থ: কুর’আন দিয়ে বড় জিহাদ করো। বড় জিহাদ বলতে বুঝায়, নফসের বিরুদ্ধে এবং চেতনার জগতে দুষ্ট ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। এ জিহাদটি অস্ত্রের নয়, জ্ঞানের। এ বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে যারা বিজয়ী হয় একমাত্র তারাই রণাঙ্গণে শত্রু নিধনে হাজির হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি কুর’আন বুঝে না এবং বুঝতেও আগ্রহী নয় সে ব্যক্তি সে বড় জিহাদ করবে কীরূপে? তার উপর কুর’আনের বানী প্রভাব ফেলবে কেমনে? কুর’আনের অস্ত্রটি হলো তার জ্ঞানসমৃদ্ধ পবিত্র বাণী। ফলে সেটি তখনই কাজ দেয় যখন সে জ্ঞানের প্রয়োগ হয়। তাছাড়া মহান আল্লাহতায়ালার যে কোন হুকুমের অবাধ্যতাই তো কবিরা গুনাহ। ফলে কুর’আন না বুঝার কারণে তাঁর হুকুমের যে অবাধ্যতা হচ্ছে -তাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। এ অবাধ্যতার ভয়ানক কুফলটি হলো, এতে অসম্ভব হচ্ছে পবিত্র কুর’আন থেকে হিদায়েত লাভ এবং পথচলায় ভ্রষ্টতা থেকে বাঁচা। ফলে বাড়ছে গুমরাহি ও পথভ্রষ্টতা।

না বুঝে কুর’আন পাঠ মুসলিম জীবনে ভয়ানক বিপদ ডেকে আনছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে কুর’আন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য। মুসলিমদের এরূপ ব্যর্থতায় একমাত্র শয়তানই খুশি হতে পারে। অথচ এ নিয়ে মুসলিমদের নিজেদের চেতনাশূণ্যতা কি কম? অশিক্ষায় ও কুশিক্ষায় একটি জনগোষ্ঠিকে যে কতটা চেতনাশূণ্য করতে পারে -এ হলো তার নজির। পাথরের উপর বীজ গজায় না। তেমনি চেতনাশূণ্য মানুষের উপর সত্যের বানীও কাজ দেয় না। ওহীর জ্ঞান রুহের খাদ্য রূপে কাজ করে। সে জ্ঞানের অভাবে চেতনা জগতে তখন মহামারি শুরু হয়। মিথ্যার ফেরীওয়ালারা সত্যের শত্রু; অতীতে এরাই হযরত নূহ (আ:)’র ৯৫০ বছরের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল। মুসলিম উম্মাহর উপর আজ এদেরই দখলদারী। মিথ্যার সে দখলদারী বলবান হয়েছে মুসলিম বিশ্বের উপর ঔপনিবেশিক কাফেরদের শাসন এবং পরবর্তী কালে তাদের প্রতিপালিত ও মদদপুষ্ট সেক্যুলারিস্ট খলিফাদের শাসনের কারণে। রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে জাহান্নামে নেয়া বাহনে। বাংলাদেশের মত দেশে মুসলিমদের বিপদটি তাই ভয়াবহ। চেতনা জগতের এ মহামারি থেকে যে কুর’আনী জ্ঞান বাঙালি মুসলিমদের মুক্তি দিতে পারতো -সেটির চর্চাই আজ অতি সীমিত ও সংকুচিত। কুর’আন না বুঝে শুধু তেলাওয়াতে সেটি কোন কালেই হওয়ার নয়। এতে বিপন্ন হচ্ছে শুধু পার্থিব জীবনই নয়, আখেরাতের জীবনও। ফলে মিথ্যার ফেরীওয়ালাদের শাসন থেকে মুক্তি ও তাদের সৃষ্ট অশিক্ষা ও কুশিক্ষার জঞ্জাল সরানোর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ জগতে আর কি হতে পারে? ১ম সংস্করণ ০৬/০৩/২০১৮; ২য় সংস্করণ ৩০/০১/২০২২।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *