রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং জিম্মি জনগণ -১

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 দখলদারি সন্ত্রাসীদের  

বাংলাদেশের ইতিহাসে যারা সবচেয়ে নৃশংস সন্ত্রাসের নায়ক তারা মহল্লার চোর-ডাকাত, পেশাদার খুনি বা কোন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার নয়। সেটি খোদ রাষ্ট্র। বাংলাদেশে সে ভয়ংকর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সাথে জড়িত হলো দেশের পুলিশ, ডিবি, R.A.B, বিজিবি এবং সেনা বাহিনীর লোকেরা। ২০১৩ সালের ৫ই মে’ শাপলা চত্বরে নিরপরাধ মানুষ হত্যার যে নৃশংস তাণ্ডবটি ঘটলো -সেরূপ গণহত্যার সামর্থ্য কি দেশের পেশাজীবী চোর-ডাকাত, খুনি ও সন্ত্রাসীদের আছে? যেখানে স্বৈরশাসক থাকবে অথচ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং সে সন্ত্রাসে গণহত্যা থাকবে না –তেমনটি ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি। তাই সেরূপ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যেমন হালাকু, চেঙ্গিজ ও হিটলারের আমলে হয়েছে -তেমনি আজও হচ্ছে। কারণ,পুরনো স্বৈরশাসকগণ কবরেও গেলেও সে সরকারি সন্ত্রাস নব্য নৃশংসতা পেয়েছে নতুন স্বৈর শাসকদের হাতে। তাই যে নৃশংস গণহত্যা ২০১৩ সালের ১৪ই আগষ্ট কায়রোর রাবা আল আদাবিয়ার ময়দানে ঘটেছে -সেটি হিটলারের আমলে কোন জার্মান নগরীর গণ-জমায়েতে ঘটেনি। এটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক ভয়ংকর রূপ। মিশরের স্বৈরশাসক জেনারেল আবুল ফাতাহ সিসির নির্দেশে সেখানে প্রায় ১২০০ নিরস্ত্র মানুষকে সেনাবাহিনী কামান দেগে হত্যা করেছিল এবং আহত করেছিল বহু হাজারকে। নিহত ও আহতের মাঝে নারী, শিশুও ছিল। তাদের অপরাধ, তারা মিশরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। একই রূপ নৃশংস রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীগণ সিরিয়ায় প্রায় ৬ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এবং প্রায় দেড় কোটি মানুষকে ঘরছাড়া করেছে।

স্বৈরশাসকের হাতে কোন দেশ অধিকৃত হলে সে দেশের পুলিশ, প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা পরিণত হয় স্বৈরশাসকের চাকর-বাকরে এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাতিয়ারে। মানব সভ্যতার এরূপ বিশাল ক্ষতি কি কখনো হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের হাতে হয়েছে -যা হয়েছে স্বৈরশাসকের হাতে? রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তখন স্রেফ ভোটডাকাতি, মানবাধিকার হনন ও গণতন্ত্র হত্যায় সীমিত থাকে না। বরং তার বীভৎস রূপটি প্রকাশ পায় খুন, গুম, গণ-গ্রেফতারি, ধর্ষণ, অত্যাচার, ব্যাংক লুট, শেয়ার মার্কেট লুট, সরকারি ট্রেজারির সঞ্চয় লুট, সরকারি প্রজেক্টের অর্থলুট এবং নানাবিধ অপরাধ কর্মের মধ্য দিয়ে। এরূপ কুশাসনে অপরাধীগণ পায় তাদের অপরাধ কর্মকে নির্ভয়ে চালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স। তখন সরকারের এজেন্ডা হয়, স্রেফ নিজেদের কুশাসনকে টিকিয়ে রাখা। নিরস্ত্র জনগণের উপর দখলদারি জমাতে স্বৈরাচারী সরকারের মূল অস্ত্র হলো মিথ্যা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। নিজেদের অপরাধগুলি লুকাতে চোর-ডাকাতেরা কখনোই নিজেদেরকে চোর-ডাকাত বলে না, বরং সভ্য মানুষের বেশ ধরে রাস্তায় নামে। তেমনি সন্ত্রাসী এবং স্বৈরাচারী এ সরকারও নিজেদের সন্ত্রাসী ও স্বৈরাচারী বলে না। জনগণের ভোটের অধিকার, মিছিল-মিটিং ও মত-প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার পরও নিজেদেরকে গণতন্ত্রী বলে বড়াই করে। সে সাথে সন্ত্রাসী বলে প্রতিবাদী নিরস্ত্র নাগরিকদের। এটি অবিকল ডাকাতদের পক্ষ থেকে গৃহস্থ্যকে ডাকাত বলার মত। এভাবে তারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তও করছে। তাই প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, সন্ত্রাস কাকে বলে এবং স্বৈরাচারই কাকে বলে -সে বিষয়গুলি মোটা দাগে পরিস্কার করা।

সন্ত্রাসের আভিধানিক অর্থ, রাজনৈতিক লক্ষ্যে শক্তির প্রয়োগ তথা ত্রাস সৃষ্টি।  অর্থাৎ যেখানেই ত্রাসের সাথে রাজনীতির মিশ্রণ সেখানেই সন্ত্রাস। শক্তির প্রয়োগ স্রেফ অর্থ লাভে হলে তখন সেটিকে বলা হয় ডাকাতি। এজন্যই ডাকাতী ও সন্ত্রাস -উভয়ই পরস্পরের কাজীন। ডাকাতেরা অর্থ ছিনতাই করে; আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীরা ছিনতাই করে জনগণের স্বাধীনতা, মানবিক অধিকার এবং ভোট। ভোট ছিনতাইয়ের অপরাধে তাদেরকে ভোট-ডাকাতও বলা হয়। সন্ত্রাস কখনোই খালি হাতে হয় না। এজন্য অপরিহার্য হলো অস্ত্র। কারণ, অস্ত্রের প্রদর্শণী ও প্রয়োগ ছাড়া মানুষকে ভয় দেখানো যায় না। ফলে ত্রাসও সৃষ্টি করা যায় না। তাই রাজনৈতিক দলের নিরস্ত্র কর্মী বা নাগরিককে সন্ত্রাসী বলাটি গৃহস্থ্যকে ডাকাত বলার মত। দেশের অস্ত্রের বড় বড় ভাণ্ডারগুলি কোন ব্যক্তির ঘরে, মসজিদ-মাদ্রাসায় বা রাজনৈতিক দলের অফিসে থাকে না। সে গুলী থাকে সেনানীবাসে ও পুলিশ ফাঁড়িতে। ফলে সে অস্ত্রের মালিক সরকার। সরকার স্বৈরাচারী হলে, সে অস্ত্রের প্রয়োগ হয় জনগণের বিরুদ্ধে। কারণ, সেটি হয় অবৈধ সরকারের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। অথচ কোন বৈধ গণতান্ত্রিক সরকারের সে প্রয়োজন থাকে না। প্রতিটি নির্বাচন সরকার বেঁচে থেকে জনগণের সাহায্য ও সমর্থনে। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে যে সরকার সংসদের ১৫৩ সিট থেকে কোন ভোটই নিল না এবং যে সব সিটে নির্বাচন হলো সেখানে শতকরা ৫ জন ভোটার ভোট দিল না –এমন একটি সরকার তো জন্ম থেকেই অবৈধ। এরূপ অবৈধ সরকারের জন্ম কখনোই ভোটে হয় না, হয় অস্ত্রের ঔরসে। এজন্যই শেখ হাসিনার সরকার ২০১৪ সাল থেকেই এক অবৈধ সরকার। এরপর শেখ হাসিনা সে অবৈধ দখলদারীর নবায়ন করে ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর নিরেট ভোট ডাকাতীর মাধ্যমে। এমন সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বনটি হলো অস্ত্রের প্রয়োগ। এমন প্রতিটি অবৈধ সরকার যেমন স্বৈরাচারী হয়, তেমনি অসভ্য ও সন্ত্রাসীও হয়। অপর দিকে নিরস্ত্র হওয়ার কারণে স্বৈরাচার-অধিকৃত রাষ্ট্রের কোটি কোটি নাগরিক পরিণত হয় অসহায় জিম্মিতে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সে অপ্রতিরোধ্য সামর্থ্যের কারণেই নগণ্য সংখ্যক ইংরেজ পক্ষে সম্ভব হয়েছিল বিশাল ভারতের উপর ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন। শেখ হাসিনাও শত্রুদের ব্যবহৃত সেই অভিন্ন পথটিই ধরেছে।

ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে স্বৈরাচারী সরকারগুলির স্ট্রাটেজী বিশ্বের সর্বত্রই দ্বিমুখী। এক). অস্ত্রের উপর নিরংকুশ মালিকনা তথা মনোপলিকে লাগাতর বহাল রাখা। দুই). দেশের জনগণকে সব সময় নিরস্ত্র ও দুর্বল রাখা। ঔপনিবেশিক শাসনামলে এরূপ নীতি ছিল দখলদার বিদেশী শত্রুদের। তখন জনগণ লাঠি হাতে, এমন কি খালি হাতে রাস্তায় নামলেও তাকে সন্ত্রাস বলা হতো। অপরদিকে সরকারি বাহিনী কামান ও ট্যাংক নিয়ে গণহত্যায় নামলেও তাকে সন্ত্রাস না বলে আইনের শাসন বলা হতো। ঔপনিবেশিক শাসন অবসান হয়েছে। কিন্তু এখন একই সন্ত্রাসী নীতি প্রয়োগ করছে জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দেশী শত্রুরা। বিশ্বের প্রতিদেশে স্বৈরাচারী সরকারগুলির একই নীতি। স্বৈরাচারী হাসিনা এক্ষেত্রে আদৌও ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম ছিল না স্বৈরাচারী শেখ মুজিব ও এরশাদ।

কিন্তু এতো নৃশংসতার পরও স্বৈর শাসকদের মনে ভয় থেকেই যায়। সন্ত্রাসের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হিংস্র পশুগুলি যেমন জঙ্গল ছেড়ে জনপদে নামতে ভয় পায়। তেমন ভয় থাকে স্বৈরাচারী শাসকেরও। সে ভয়টি কোটি কোটি নাগরিকের হাতে মারা পড়ার। সে জনভীতির কারণে সকল স্বৈরশাসকেরাই স্ব-আরোপিত গৃহবন্দী। ব্রিটিশ বা কানাডার ন্যায় গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রীগণ তাই নির্ভয়ে ট্রেনে সফর করতে সমর্থ হলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গৃহের বাইরে বেরুতে ভয় পায়। কারণ গণভীতি। আরো কারণ, জনগণের বিরুদ্ধে তাদের কৃত অপরাধগুলো নিয়ে তারা অজ্ঞ নয়। জনগণ যে তাদের কতটা ঘৃণা করে সেটি তারা ষোল আনা জানে।

তারা আরো জানে, স্বৈরাচার নিপাতে জনগণ একবার জেগে উঠলে তাদের হাত থেকে বাঁচানোর সামর্থ্য অস্ত্রের থাকে না। অস্ত্র তখন গুদামেই থেকে যায়। নইলে রাশিয়ার জার নিকোলাস, ইরানের বাদশাহ মহম্মদ রেজা শাহ, মিশরেরর প্রেসেডেন্টে হুসনী মোবারক এবং বাংলাদেশের মুজিব ও এরশাদের কেন পতন ঘটবে? স্বৈরাচারী শাসক ও তার চাকর-বাকরেরা যে বিষয়টি বুঝে না তা নয়। বুঝে বলেই রাস্তায় নিরস্ত্র মানুষের ঢল দেখলেই তারা ভয়ে কাঁপে। অধিক ভয়ে সুস্থ্য মানুষও পাগলে পরিণত হয়; এবং প্রলাপ বলে নিরেট পাগলের ন্যায়। এরুপ বিকারগ্রস্ততার কারণে দেশের নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষও তাদের কাছে সন্ত্রাসী মনে হয়। রাস্তায় নিরস্ত্র কিশোর-কিশোরীদের মিছিলের উপর শত শত সশস্ত্র পুলিশ ও দলীয় গুণ্ডাদের নামানোর পিছনে কাজ করেছে তো সে ভয়। একই রূপ ভয়ের কারণে হাসিনা সরকার ২০১৩ সালে ৫ মের কামান দেগে শত শত নিরস্ত্র আলেমকে হত্যা করেছে শাপলা চত্বরে। কোন সুস্থ্য ও স্বাভাবিক মানুষ কি সেটি কি ভাবতে পারে? হৃদয়ে শরিষার দানা পরিমাণ মানবতা আছে তেমন কোন মানুষও কি এতোটা নৃশংস হতে পারে?

বাংলাদেশের মাটিতে ছাত্র-ছাত্রীর বিশাল মিছিল বা লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ কি নতুন কিছু? এরূপ মিছিল ও সমাবেশ যেমন ব্রিটিশ আমলে হয়েছে, তেমনি পাকিস্তান আমলেও হয়েছে। কিন্তু সেসব সমাবেশগুলিকে কি কখনো শাপলা চত্বরের ন্যায় বধ্যভূমি বানানো হয়েছে?  ছাত্রীদের মিছিলের উপর কি সশস্ত্র যৌন সন্ত্রাসী নামনো হয়েছে? কোন সভ্য মানুষ কি সেটি ভাবতে পারে? স্বৈরশাসনের এখানেই বিপদ। নিজেদের গদি বাঁচাতে নৃশংস, অসভ্য বা বেহায়া হওয়াটি তাদের কাছে কোন ব্যাপারই নয়। কারণ, এটি তাদের বাঁচা-মরার বিষয়। তাদের কথা, গদি বাঁচাতে ও সে সাথে প্রাণ বাঁচাতে সব কিছুই জায়েজ। সিরিয়ার বাশার আল আসাদ ৬ লাখ মানুষকে হত্যা ও দেড় কোটি মানুষকে ঘরছাড়া করেছে এবং ৬০ লাখ মানুষকে দেশছাড়া করেছে তো এমন এক নৃশংস চেতনাতেই্।

তাই জাতির জীবনে বড় বড় আযাবগুলি শুধু ভূমিকম্প, সুনামী বা ঘুর্ণিঝড় নয়, বরং সবচেয়ে বড় আযাব হলো হলো দুর্বৃত্তদের স্বৈরশাসন। তখন অসম্ভব হয় পূর্ণ দ্বীন পালন তথা পূর্ণ মুসলিম হওয়া। একারণেই ইসলামে শ্রেষ্ঠ ইবাদত নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত বা দান-খয়রাত নয়, সেটি হলো স্বৈরশাসকের নির্মূলের জিহাদ। ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো জিহাদ। আর উত্তম জিহাদ হলো: “জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা।” এটি হলো নবীজী (সা:)’র হাদীস। এমন জিহাদ না হলে ইসলামের বিজয় আসে না। তখন দেশ অধিকৃত হয় চোরডাকাত, ভোটডাকাত ও ক্ষমতালোভী দুর্বৃত্তদের হাতে। তখন গণজীবন থেকে বিলুপ্ত করা হয় প্রকৃত ইসলাম। তখন অসম্ভব হয় নবীজী (সা:)’র ইসলাম নিয়ে বাঁচা –যাতে রয়েছে শরিয়ত, হুদুদ, খেলাফত, মুসলিম উম্মাহর একতা। এজন্যই বাংলাদেশে নবীজী (সা:)’র ইসলাম বেঁচে নাই। নবীজী (সা:)’র ইসলাম বাঁচলে তো ইসলামী রাষ্ট্র, স্কুল-কলেজে কুর’আনী জ্ঞানদান, শরিয়ত ও হুদুদ ভিত্তিক আদালত, ইসলামের বিশ্বভাতৃত্বের চেতনা, জিহাদ –এসবও তো থাকতো। অপর দিকে বাংলাদেশের মুসলিমদের ইসলাম থেকে এতোটাই দূরে সরানো হয়েছে যে, ইসলামের এই পরাজয় নিয়ে তাদের মাঝে কোন বেদনাবোধ নাই। বরং তাদের দিনরাতগুলি ধুমধামে কাটছে ইসলামের শত্রুশক্তির বিজয় ও মহান আল্লাহর দ্বীনের নিরংকুশ পরাজয় নিয়ে। তারা বাঁচছে স্রেফ নিজ নিজ এজেন্ডাকে বিজয়ী করা নিয়ে। মুসলিমদের গৌরবকালে কি এমন গাদ্দারীর কথা ভাবা যেত?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *