রবীন্দ্রসাহিত্য, হিন্দুত্বের বিজয় এবং বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতার সংকট

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 বাঙালি মুসলিমের রবীন্দ্রাসক্তি ও আত্মপচন   

 রোগ দেখা দিলে সাথে সাথে সে রোগের কারণ খুঁজতে হয় এবং দ্রুত তার চিকিৎসাও শুরু করতে হয়। রোগ যেমন দৈহিক হতে পারে, তেমনি নৈতিকও হতে পারে। দৈহিক রোগের ন্যায় নৈতিক রোগের আলামতগুলিও গোপন থাকে না। দেহের রোগে হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শক্তিহীন হয়। আত্মপচনে মৃত্যু ঘটে বিবেকের। তাতে বিলুপ্ত হয় নীতি, নৈতিকতা ও চরিত্র। চুরি-ডাকাতি, ভোট-ডাকাতি, সন্ত্রাস, গুম, খুন, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্ষণে উৎসব, লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে হত্যা, পুলিশী রিম্যান্ডে হত্যা, ক্রসফায়ারে হত্যা–এ রূপ নানা নিষ্ঠুরতা তখন নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তখন অতি নির্মম ও নিষ্ঠুর কাজেও বিবেকের পক্ষ থেকে কোন রূপ বাধা থাকে না। এরই ফলে রাস্তাঘাটে শুধু অর্থকড়ি, গহনা ও গাড়ি ছিনতাই হয় না, নারী ছিনতাইও শুরু হয়। শুধু ধর্ষণই হয়, দলবদ্ধ ধর্ষণও হয়। পত্রিকায় প্রকাশ, মাত্র গত তিন মাসে দেশে ১২৩ জন মহিলা ছিনতাই ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। (দৈনিক আমার দেশ, ২৬/০৫/২০১৫)। তবে সব ধর্ষিতাই যে থানায় এসে নিজের ধর্ষিতা হওয়ার খবরটি জানায় -তা নয়। কারণ পুলিশের কাছে বা আদালতে ধর্ণা দিলেও অপরাধীর শাস্তি মেলে না বরং তাতে সমাজে ধর্ষিতা রূপে প্রচার পাওয়ায় অপমান বাড়ে। অধীকাংশ ধর্ষণের ঘটনা তাই গোপনই থেকে যায়। ফলে ধর্ষিতা নারীদের আসল সংখ্যা যে বহুগুণ বেশী –তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়।

চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের ন্যায় নানা পাপ বস্তুত একটি অসুস্থ চেতনার সিম্পটম। রোগ-জীবাণু দৈহিক রোগ ঘটায়, কিন্তু অপরাধ কর্ম ঘটে অসুস্থ চেতনার কারণে। এবং চেতনাকে অসুস্থ করে বিবেকনাশক দর্শন। তাই জনগণের মাঝে দৈহিক রোগের মহামারি শুরু হলে দেহের মাঝে লুকানো রোগ-জীবাণুর যেমন তালাশ করতে হয়, তেমনি রাষ্ট্রে দুর্বৃত্তির প্লাবন বাড়লে বিষাক্ত দর্শনটির খুঁজে বের করতে হয়। মানুষের প্রতিটি কর্ম, আচরণ ও অপরাধের পিছনে একটি দর্শন কাজ করে। দর্শনই চরিত্র ও কর্মের নিয়ন্ত্রক। মানব সন্তানেরা জন্মসূত্রেই অসভ্য, দুর্বৃত্ত ও অপরাধী হয় না। গরুপূজারী, সর্পপূজারী বা লিঙ্গপূজারী রূপেও তাদের জন্ম হয় না। তারা অসভ্য, দুর্বৃত্ত ও অপরাধী হয় এবং ধর্মে পৌত্তলিক হয় সেই সব দর্শন ও ধ্যান-ধারণার কারণে -যা তাদের মগজে লাগাতর ঢুকানো হয় জন্মের পর তাদের নিজ গৃহে, নিজ মহল্লায়, নিজ স্কুল-কলেজে এবং নিজের আশেপাশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে। তাই কোন দেশে দৈহিক রোগের মহামারি লাগলে যেমন সংশ্লিষ্ট জীবাণুর তালাশ করতে হয়, তেমনি নৈতিক মড়ক লাগলে রোগাগ্রস্ত মানুষের মনের দর্শনটি খুঁজতে হয়। এবং চিকিৎসা সেখান থেকেই শুরু করতে হয়ে।

মানব সন্তানদের জান্নাতের উপযোগী বানানোর কাজটিই হলো এ পৃথিবী পৃষ্ঠে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প। এ শিল্পই নির্ধারণ করে জনগণ জান্নাতে যাবে, না জাহান্নামে যাবে। নির্ধারণ করে, সেদেশে সভ্য সমাজ নির্মিত না অসভ্য সমাজ নির্মিত হবে। এই মহান শিল্পটি প্রতি যুগেই ছিল নবী-রাসূলদের। কোন দেশে এ শিল্প গুরুত্ব না পেলে জনগণ তখন জাহান্নামের যোগ্য হয়ে গড়ে উঠে। দেশ ও সমাজ তখন সভ্য জীবন-যাপনের অযোগ্য হয়ে উঠে। নবী-রাসূলদের এই পথটি তাদের নিজেদের আবিস্কৃত পথ নয়। এটি ছিল মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার দেখানো পথ। লক্ষণীয় হলো, তাদের কাজের শুরুটি পানাহার, বাসস্থান, পোষাক, কৃষি বা শিল্পে বিপ্লব দিয়ে হয়নি। বরং শুরু করেছিলেন জনগণের বিশ্বাস, দর্শন, আক্বীদার ভূমি থেকে। এ শিল্পের মূল হাতিয়ারটি হলো ওহীর জ্ঞান। পবিত্র কুর’আন হলো ওহীর জ্ঞানের সর্বশেষ গ্রন্থ। আরবের অসভ্য মানুষগুলো যে দর্শনের বলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবে পরিণত হয়েছিলেন –তা হলো এই কুর’আনের দর্শন। মানব ইতিহাসের এটিই হলো সবচেয়ে পরীক্ষিত ও সবচেয়ে শিক্ষণীয় বিষয়। অথচ সে শিক্ষাটি বাংলাদেশে আজ উপেক্ষিত। গাদ্দারী এখানে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীন ইসলামের সাথে। 

 

নতুন চৈতন্য দেব

বাংলাদেশে যে দর্শনটিকে স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের মগজে প্রবেশ করানো হয় -সেটি আদৌ ইসলামের নয়। বরং সেটি রবীন্দ্রনাথের এবং রাবীন্দ্রিক গোত্রের লেখক-লেখিকাদের। বাঙালি হিন্দুদের হাজারো দেব-দেবীর মাঝে রবীন্দ্রনাথ হলো আরেক দেব। তারা তাকে গুরুদেব বলে। বাঙালি হিন্দুদের অধিকাংশই তাই রবীন্দ্রপূজারী। তারা চায়, বাঙালি মুসলিমগণও রবীন্দ্র পূজায় অভ্যস্থ হোক। ১৯৭১’য়ের পর তাদের সে এজন্ডাই বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে। শেখ মুজিব নিজেও ছিলেন রবীন্দ্রপূজারী। মুজিব কোনদিন কুর’আন পড়েছেন কিনা -সে প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না। কিন্তু তিনি যে নিয়মিত রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য পাঠ করতেন ও রবীন্দ্রসঙ্গীত যে তাঁর অতি প্রিয় সঙ্গীত ছিল -সে কাহিনী বহুল পরিচিত। বস্তুত বাঙালি মুসলিমদের শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিতে ইসলামকে সরিয়ে রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিত দর্শনের চাষাবাদের শুরু শেখ মুজিবের হাতে। সে দর্শনের বীজটি বপন করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রূপে রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা”র ন্যায় একটি পৌত্তলিক গানকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে। ইসলামী চেতনার বিজয় রুখতে গানের শক্তি বিশাল। এক কালে বাঙালি হিন্দুদের মুসলিম হওয়া রুখতে চৈতন্য দেবকে ময়দানে নামানো হয়েছিল। এখন মুসলিমদের ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজে নামানো হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে। বাঙালি সেক্যুলারিষ্ঠদের এটিই হলো মূল স্ট্রাটেজী। তাই মুজিব আমল থেকেই স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ানো হয় নানাবিধ রবীন্দ্র সাহিত্যের চর্চা। বাংলা এ্যাকাডেমীর কাজ হয় রবীন্দ্র সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বাড়াতে বেশী বেশী বই প্রকাশ করা। বাঙালি মুসলিমের চেতনায় রবীন্দ্রনাথের বিজয় বাড়াতে হয় সিরাজগঞ্জে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয় রবীন্দ্র বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়। এরূপ সরকারি উদ্যোগের ফলেই বাংলাদেশের বুকে বুদ্ধিবৃত্তির মূল ধারাটি আজ হিন্দু রেনেসাঁ আমলের রবীন্দ্র-বঙ্কিম-শরৎচন্দ্র কেন্দ্রীক কলকাতার বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা। এখানে ইসলামের কোন স্থান নেই।  

বাংলাদেশ শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের হলে কি হবে, স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচীতে ইসলাম, কুর’আন, নবীজী (সা”)’র জীবনী পাঠের কোন স্থান নাই। কিন্তু রবীন্দ্র সাহিত্যের সাথে রবীন্দ্র-জীবনের খুঁটিনাটি পড়ানো হয়। পাকিস্তান আমলে “দ্বীনিয়াত” নামে যে বইটি স্কুলে পড়ানো হতো সেটিও শেখ মুজিব ক্ষমতায় বসার সাথে সাথে বিলুপ্ত করে দেয়। কারণ, ইসলামের চর্চা বাড়তে দিলে তো রবীন্দ্র চেতনাকে প্রতিষ্ঠা দেয়া যায় না। যে বইগুলি ইসলামের কথা বলে সেগুলি নিষিদ্ধ করাই হিন্দুত্ববাদী ভারত এবং ভারতসেবী বাঙালি ফ্যাসিস্টদের নীতি। এভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয় বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে ইসলামী দর্শনের প্রবেশকে। বাঙালির চেতনার অঙ্গণে এভাবেই প্রকটতর হয় ইসলামের শূণ্যতাটি। এখান থেকেই বাঙালি মুসলিমদের চেতনা রাজ্যে যেমন পচনের শুরু, তেমনি শুরু হয় দ্রুত নিচে নামা। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি, দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে পাঁচবার প্রথম, গণতন্ত্র হত্যা, ফ্যাসিবাদের নৃশংস ও অসভ্য তান্ডব, দেশজুড়ে ভোটডাকাতির বিশ্বরেকর্ড –এসবের কারণ বাংলাদেশের জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতি নয়। বরং এরূপ অসভ্যতার শুরু শিক্ষাঙ্গণ থেকে ইসলামকে নির্বাসনে পাঠানোর পর। কারণ শিক্ষার সিলেবাস থেকে দ্বীনিয়াত বা কুর’আনের পাঠ বিলুপ্ত করার পরও ছাত্রদের বিবেক, নীতি-নৈতিকতা ও ঈমান সুস্থতা পাবে -সেটি তো আশা করা যায়না। তখন বাড়বে দুর্বৃত্তি ও বেঈমানি –সেটিই তো স্বাভাবিক। জাহিলিয়াত যুগের আরবগণ যে কারণে কন্যাদের জীবন্ত দাফন করতো এবং সন্ত্রাস, রাহাজানি, ব্যভিচারী, কলহ-বিবাদ ও গোত্রীয় যুদ্ধে ডুবে থাকতো –সেটির জন্যও আরবের আলো-বাতাস, জলবায়ু ও পানাহার দায়ী ছিল না। তার মূলে ছিল তাদের অসুস্থ ধর্মীয় দর্শন এবং তা থেকে সৃষ্ট আত্মপচন ও মৃত বিবেক। এরূপ আত্মপচনের ফলেই আরবগণ নানারূপ নিষ্ঠুরতায় নেমেছিল। আত্মপচন নিয়ে বাঁচারও প্রবল নেশাগ্রস্ততা আছে। সে নেশাগ্রস্ততার কারণেই তারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইসলামের বিরুদ্ধে। সে আত্মপচনের মূলে ছিল আখেরাতের ভয়শূণ্য পৌত্তলিকতা। বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের ঝোঁকও আজ রাবিন্দ্রীক পৌত্তলিকতার দিকেই। তাই মুর্তি এখন আর শুধু হিন্দুদের মন্দিরে শোভা পায় না, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও প্রতিষ্ঠানগুলিও ভরে উঠছে মুজিবসহ অন্যান্যদের মুর্তিতে। এসবই একাত্তরের চেতনা।

 

সাহিত্যের শক্তি এবং বাঙালি চেতনায় মহামারি

মানুষের দর্শনের মডেল ও চেতনার নির্মাণে সাহিত্যের শক্তি ও ভূমিকাটি বিশাল। কারণ সাহিত্যই দর্শনের বাহক। পানির পাইপ যেমন ঘরে ঘরে পানি পৌঁছায়, সাহিত্য তেমনি জনগণের চেতনায় দর্শন পৌঁছায়। সাহিত্য এভাবেই জনগণের চিন্তা, চরিত্র ও আচরণ পাল্টায়। তাই একটি দেশের মানুষ কি লেখে এবং কি পড়ে -তা থেকে জনগণের চেতনা, চরিত্র ও সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। তাই যারা কুর’আন-হাদীস অধ্যয়ন করে এবং যারা রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গল্প ও গান পাঠ করে তাদের চেতনা কখনোই এক হয়না। তৎকালীন আরবের জনগণের বিবেক বিষাক্ত করা ও হত্যা করার কাজে কাজ করেছিল ইমরুল কায়েস ও তার সমগোত্রীয় কবিগণ। বাংলাদেশে সে অভিন্ন কাজটি করছে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সমগোত্রীয় সাহিত্যিকেরা।

বাংলাদেশ এ চলতি শতাব্দীর শুরুতে বিশ্ব মাঝে দুর্বৃত্তিতে পর পর ৫ বার প্রথম হয়েছিল। বিশ্বজুড়া এই কলংকের ইতিহাসের জন্য বাংলাদেশের আলো-বাতাস, জল-বায়ু, ভূ-গোল ও ভাত-মাছ দায়ী নয়। এতোটা নীচে নামতে হলে বিপুল সংখ্যক জনগণের চেতনা, চরিত্র বা বিবেকের অঙ্গণ মারাত্মক ভাবে অসুস্থ বা মৃত হতে হয়। দুর্বৃত্তি, বজ্জাতি ও চরিত্রহীনতা স্রেফ পতিতালয়, জুয়ার আড্ডা, চোরের গৃহ ও ডাকাতপাড়ার সীমিত থাকলেও সেরূপ রেকর্ড নির্মিত না। এজন্য সামরিক-বেসামরিক অফিস পাড়া, আদালত, পুলিশ দফতর, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলির মাঝেও সে দুর্বৃত্তি ও বজ্জাতির ব্যাপক চাষাবাদ লাগে। লাগে দেশবাসীর বিবেকে ভূমিতে প্রচণ্ড মহামারি। বাংলাদেশে তো সেটিই হয়েছে। এমন দেশেই গুম, খুন, অপহরণ, চুরিডাকাতি ও ধর্ষণের জোয়ার আসে। তখন সেঞ্চুরির উৎসব হয় ধর্ষণে। দেশ জুড়ে ভোটডাকাতি হয়। এবং নির্মিত হয় ফ্যাসিবাদের নৃশংস রেকর্ড। বিপুল সংখ্যক নর-নারীর বিবেক হত্যার সে নৃশংস নাশকতাটি ঘটে বিষাক্ত দর্শন চর্চায়। বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে সে নাশকতা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের নীচে নামা এখনো থেমে যায়নি; বরং দিন দিন আরো বেগবান হচ্ছে।

আরবদের সৌভাগ্য হলো, জাহেলিয়াত যুগের আত্মপচন থেকে তারা যে শুধু রক্ষা পেয়েছিল তা নয়, সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতারও জন্ম দিয়েছিল। তারা দ্রুত বিশ্বশক্তিতেও পরিণত হয়েছিল। নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে তারা এতোটাই উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে, অন্য কোন জাতি সে স্তরে কোন কালেই পৌঁছতে পারিনি। আজও পারছে না। কীরূপে তারা সে পচন থেকে রক্ষা পেল, কিভাবে তারা এতোটা উচ্চতায় উঠলো এবং বাঙালি মুসলিমেরাই বা কেন এতো দ্রুত নীচে নামছে -সেটিই হলো সমাজ বিজ্ঞানের অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সেটি জানতে হলে সে আমলের সমাজ বিজ্ঞানের ইতিহাস জানতে হবে। পতিত আরবদের এতো দ্রুত উপরে উঠার যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস –তার মাঝেই নিহীত রয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কারণ, অসংখ্য শয্যাশায়ী কান্সারের রোগী যে ঔষধে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে -সে ঔষধের দ্রুত খোঁজ নেয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কি হতে পারে? আরবগণ জেগে উঠে প্রমাণ করেছে, সমাজে দুর্বৃত্তি ও আত্মপচন যতই গভীর হোক না কেন তা থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভেরও পরিক্ষিত সফল উপায় আছে। মানবজাতির জন্য সে শিক্ষাটিই হলো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা। আকাশে উড়া, চাঁদে নামা, জটিল কম্পিউটার ও আনবিক বোমার তৈরীর বিদ্যা না শিখিয়ে তারা শিখিয়ে গেছে আত্মপচনের চুড়ান্ত পর্যায় থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রূপে বেড়ে উঠার বিদ্যা। দেখিয়ে গেছে জান্নাতের যোগ্য হওয়ার পথ। এর চেয়ে উপকারি বিদ্যা মানব জাতির জন্য আর কি হতে পারে? দেহে যে রোগ আছে শুধু এটুকু জেনে লাভ কী? লাভ তো রোগের চিকিৎসাটি জানায়। পরিতাপের বিষয়, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার অঙ্গণে এটিই হলো সবচেয়ে অবহেলিত ও ব্যর্থ খাত। সেকালের মুসলিমগণ যেক্ষেত্রে বিস্ময়কর সফলতা দেখালো, বাঙালি মুসলিমগণ সেখানেই দেখাচ্ছে চরম ব্যর্থতা।

গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশে বিশ্বে দ্বিতীয়, মৎস্য উৎপাদনে চতুর্থ, পাঠ উৎপাদনে শীর্ষে। কিন্তু দেশে চোরডাকাত, ভোটডাকাত, খুনি, ধর্ষক ও ফ্যাসিবাদীদের উৎপাদন বিপুল সংখ্যায় হওয়ায় অন্য সব অর্জন ম্লান হয়ে গেছে। বিপুল হারে দুর্বৃত্তদের সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ দ্রুত বাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফলে হাজার হাজার বাঙালি বাংলাদেশ ছাড়ছে এবং রাজনৈতিক আশ্রয় চাচ্ছে এমন কি রোহিঙ্গা মুসলিমের পরিচয় দিয়ে। গভীর সংকটের আরো কারণ, এরূপ ভয়ানক বিপর্যের মাঝেও বাঙালি মুসলিমের আগ্রহ নেই রোগের কারণ ও তার চিকিৎসা নিয়ে। জনগণ খুশি যে দেশে কৃষিপণ্য, শিল্পপণ্য, মৎস্য চাষ, গরুমহিষের আবাদ এবং মনুষ্যজীবের রপ্তানি বেড়েছে। কিন্তু তা দিয়ে কি আত্মপচন থেকে বাঁচা যায়? আত্মপচনের কারণটি অর্থাভাব, খাদ্যাভাব, দেহের অপুষ্টি বা রোগব্যাধী নয়। বরং সেটি চেতনার অঙ্গণে প্রচণ্ড অপুষ্টি ও অসুস্থতা। মনের সে অপুষ্টি ও অসুস্থতার কারণ হলো জ্ঞানশূণ্যতা। এবং সে জ্ঞানশূণ্যতাটি মূলত পবিত্র ওহীর জ্ঞানের।

দেহ বল পায় পুষ্টিকর খাদ্য থেকে এবং বিবেক পুষ্টি পায় সত্য জ্ঞান ও সঠিক দর্শন থেকে। নিরেট সত্য ও সঠিক দর্শনের উৎস্য তো মহান আল্লাহতায়ালার নাযিলকৃত গ্রন্থ। সে গ্রন্থটি হলো পবিত্র কুর’আন। চেতনার রোগ সারাতে ও বিবেককে সবল করতে সে নাযিলকৃত সত্যের সামর্থ্যটি বিশাল। সেটি প্রমাণিত হয়েছে আজ থেকে সাড়ে ১৪ শত বছর আগে। মুসলিম মন তখন প্রবল পুষ্টি পেয়েছিল পবিত্র কুর’আন থেকে। তাতে দূর হয়েছিল আরব মনের অসুস্থতা। ফলে এককালের অসভ্য আরবগণ অতিদ্রুত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবে পরিণত হতে পেরেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাঙালি মনের সে অসুস্থতা সারাতে বাংলাদেশে সত্যজ্ঞান ও দর্শনের উৎস্যটি কি? সেটি কি পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান? সেটি কি সেক্যুলার বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস? সেটি কি তথাকথিত মুক্তমনা নাস্তিকদের দর্শন? সেক্যুলার বাঙালিরা তো ভেবেছে এগুলিই তাদের শান্তি ও প্রগতির পথ দেখাবে। এজন্যই তারা সিলেবাসে কুর’আন শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করেছে। এবং বাধ্যতামূলক করেছে সেক্যুলার সাহিত্য ও দর্শন থেকে শিক্ষা লাভ। কিন্তু তাদের ধারণা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা –সেটি প্রমাণ করতে কি আরো নীচে নামতে হবে? আরো কত হাজার বাঙালিকে পরদেশে পাড়ি দিতে সমুদ্রে ভাসতে হবে? আরো কত হাজার নারীকে ধর্ষণ ও সে ধর্ষণের ইতর উৎসব দেখতে হবে? শাপলা চত্বরের গণহত্যাই বা আর কত বার সহ্য করবে? কতবার দেখতে হবে ভোট-ডাকাতির অসভ্য নির্বাচন? এবং কত কাল সইবে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের বর্বর শাসন?

 

সেক্যুলার রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক নষ্টামি

বাংলাদেশে আজ যে ভয়ানক আত্মপচন তার মূল কারণ: চেতনায় ও বুদ্ধিবৃত্তিতে দূষিত ধ্যান-ধারণার  ভয়ানক বিষক্রিয়া। সেটির উৎস: সেক্যুলার রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং কু-সাহিত্য। পানির পাইপের ন্যায় কু-সাহিত্যের মাধ্যমে নর-নারীর চেতনায় লাগাতর বিষপান ঘটে। বাংলাদেশে সে কাজটি প্রচণ্ড ভাবে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বিগত শত বছরে বাঙালির ভাত-মাছ-ডাল-শাক-সবজি তথা খাদ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। বাংলার গাছপালা, আলোবাতাস বা জলবায়ুতেও তেমন পরিবর্তন আসেনি। ফলে বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য এরূপ কোন একটিকে দোষ দেয়া যায় না।  বিগত শত বছরে বাংলার বুকে বিশাল পরিবর্তন এসেছে মূলত দুটি ক্ষেত্রে। এক). বাংলার মুসলিম গৃহে শত বছর আগে রবীন্দ্র সাহিত্য ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা ছিল না। নাচগানও ছিল না। নাচগান সীমিত ছিল হিন্দু ও পতিতাপল্লীর বেশ্যাদের গৃহে। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নাচগান এখন নেমে এসেছে সাধারণ মানুষের গৃহে। সমগ্র দেশজুড়ে হাজার হাজার এনজিও গড়ে উঠেছে যাদের কাজ হয়েছে সেগুলি শেখানো। দুই). শত বছর আগে বাংলার রাজনীতিতে সেক্যুলারিস্টদের স্থান ছিল না। মুসলিমদের রাজনীতিতে তখন ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি প্রবল অঙ্গীকার ছিল। রাজনীতির প্রথম সারির নেতাদের মাঝে অনেক আলেম ছিলেন। আবুর কাসেম ফজলুল হক, তমিজুদ্দীন খান, ফরিদ আহমেদের মত নেতারা আলেম না হলেও নামের আগে মৌলভী লাগাতে গর্ববোধ করতেন। রাজপথের মিছিল বা জনসভায় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে জনগণের কন্ঠে “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর” ধ্বনি উঠতো। এভাবে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ পরিণত হতো যিকরের জলসায়। বাংলার মাটিতে সেদিন গড়ে উঠেছিল খেলাফত আন্দোলন ও  পাকিস্তান আন্দোলনের ন্যায় দুটি বিশাল গণআন্দোলন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠন মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল এই বাংলাতেই। অথচ আজ  দেশ অধিকৃত হয়ে আছে ধর্মচ্যুৎ ও ইসলামচ্যুৎ উগ্র সেক্যুলারিস্টদের হাতে। তাদের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে। ফলে বিলুপ্ত হয়েছে “আল্লাহু আকবর” এবং সে স্থান দখলে নিয়েছে “জয় বাংলা”। কুর’আনে তাফসির বন্ধ করা, জিহাদবিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করা, ইসলামপন্থীদের ফাঁসিতে ঝুলানো, মুসল্লীদের হত্যাকরা এবং তাদের লাশকে ময়লার গাড়িতে তুলে গায়েব করাই এখন সেক্যুলারিস্টদের সংস্কৃতি। তাদের নেতৃত্বে দেশে যা শুরু হয়েছে তা মূলত পৌত্তলিক সাহিত্য, সেক্যুলার রাজনীতি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নষ্টামির ভয়ানক বিষক্রিয়া। বাঙালি মুসলিমের আজকের আত্মপচনের মূল কারণ হলো এগুলি।

দেশে আজ স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্র-পত্রিকার সংখ্যা বিপুল। কিন্তু তাতে সত্য জ্ঞান ও সত্য-দর্শনের আবাদ বাড়েনি; বরং বেড়েছে ঈমানবিনাশী বিষপানের মহা আয়োজন। জনগণের চিন্তা-চেতনা, চরিত্র, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে শুরু হয়েছে তারই বিষক্রিয়া। ইসলামের পূর্বে আরবী সাহিত্যে বিষপানের যে আয়োজনটি ছিল, সে তুলনায় বাংলা ভাষায় সে আয়োজনটি বিশাল। বাংলা ভাষায় পৌত্তলিক কাফেরদের যে বিশাল সাহিত্য-ভাণ্ডার তা বিশ্বের আর কোন ভাষাতে নেই। এ কাজে রবীন্দ্রনাথের তো নবেল প্রাইজও মিলেছে। তবে এই ভাণ্ডার শুধু রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্ট নয়, বরং গড়ে উঠেছে শত শত পৌত্তলিক বাঙালি সাহিত্যিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্য গড়ে উঠেছে মূলত হিন্দুদের দ্বারা। এবং সেটি হিন্দুদের গোড়া হিন্দু রূপে গড়ে তোলার প্রয়োজনে। বাংলা ভাষার শতকরা ৮৫ ভাগের বেশী বইয়ের লেখক তারাই। ফলে বেদ, পুরান, গীতা, উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারতের চরিত্রগুলি তাই বাংলা সাহিত্যে অতি সরব ও সোচ্চার। শুধু বঙ্কিম সাহিত্যে নয়, রবীন্দ্র সাহিত্যেও হিন্দু ধর্ম, হিন্দু একতা ও হিন্দুরাজের চেতনাটি প্রকট।

বাঘ, ভালুক, সিংহের ন্যায় হিংস্র পশুতে পরিপূর্ণ জঙ্গলের পাশে বসবাস করার বিপদটি অতি ভয়ানক। বিপদটি এখানে যখন তখন নিজের এবং নিজ পরিবারের সদস্যদের প্রাণ হারানোর। তেমনি ভয়ানক বিপদের কারণ পৌত্তলিক কাফেরদের মাঝে ও মাতৃভাষায় রচিত বিশাল পৌত্তলিক সাহিত্যের মাঝে আজীবন অবগাহন করে বাঁচায়। বিপদটি এখানে বিবেক ও ঈমান হারানোর। আদিম পৌত্তলিক অজ্ঞতা দেয় চেতনায় ঈমান-বিনাশী দূষণ। তখন বিপদ ঘটে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায় ব্যর্থতায়। সে বিপদটির বাঙালি মুসলিমের জীবনে ষোল আনা দেখা গেছে। ফলে শুধু মুসলিম বিশ্বে নয়, সমগ্র বিশ্ব মাঝে বাঙালি মুসলিমগণ দুর্বৃত্তিতে ৫ বার প্রথম হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাঙালি মুসলিমগণই হলো ইসরাইলের পর সমগ্র বিশ্বে হিন্দুত্ববাদি ভারতের সবচেয়ে পরম মিত্র। ১৯৭১’য়ে যুদ্ধ করেছে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সমগ্র ইতিহাসে বিশ্বের অন্য কোন মুসলিম জনগোষ্ঠিই পৌত্তলিকদের বিজয়ী করতে এমন যুদ্ধ কোন কালেই করেনি।

রাজনীতি, অর্থনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অঙ্গণে হিন্দু আধিপত্যের অধীনে বাঁচার আসন্ন বিপদ টের পেয়ে সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বাঙালি মুসলিম নেতাগণ ১৯৪৭ সালেই হিন্দুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং অবাঙালি মুসলিমদের সাথে মিলে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল। এবং সে সাথে উপমহাদেশের অবাঙালি মুসলিমদের ন্যায় উর্দুকে বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টির ভাষার রূপে গ্রহন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সে মুসলিম-হিতৈষী উদ্যোগ রবীন্দ্রপ্রেমী, হিন্দুপ্রমী এবং ইসলামচ্যুৎ সেক্যুলারিস্টদের ভাল লাগেনি। ফলে সে উদ্যোগের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধে নামে এবং ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়। তখন থেকেই বাঙালি মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক অপুষ্টি এবং চেতনা রাজ্যে দূষণের শুরু। আজও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। এভাবেই এপক্ষটি ১৯৪৭ সালের পরাজয়ের বদলা নিয়ে নেয়। অবশেষে বাংলার বুকে মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রজেক্টের বিলুপ্তি ঘটায়। সে বিজয় নিয়ে আজও চলছে ওপারের হিন্দুত্ববাদীদের সাথে মিলে এপারের ভারতসেবী বাঙালিদের যৌথ মহোৎসব। ইসলামপন্থীদের বাঁচতে হচ্ছে পরাজয়ের যাতনা নিয়ে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃস্টির সময় বাংলা ভাষায় মুসলিমদের রচিত যে কয়খানি বই বাজারে পাওয়া যেত তা আঙ্গুলে গুনা যেত। সেগুলি ছিল নেয়ামূল কুর’আন, বেহেশতি জিওর, মোকসুদুল মু’মিনুন, বিষাদ সিন্ধু, আনোয়ারা উপন্যাস  –এধরনের কিছু বই। তখনও পবিত্র কুর’আনের কোন তাফসির বাংলাতে পাওয়া যেত না। হাদীস গ্রন্থের কোন বাংলা তরজমা তখনও বের হয়নি। মাদ্রাসার পাঠ্য বই ছিল উর্দু ভাষায়। স্কুলে ইসলাম শেখানোর জন্য কোন বই ছিল না। এই ছিল বাঙালি মুসলিম চেতনায় বুদ্ধিবৃত্তিক পুষ্টি জোগানোর সম্ভার। এতে ইসলামের জ্ঞানের অপুষ্টি শুরু হবে এবং তাতে ঈমান মারা যাবে –সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?  আর ঈমান মারা গেলে কি চরিত্র নির্মিত হয়? তখন দেশ দুর্বৃত্তি বিশ্বরেকর্ড গড়বে -সেটিই তো কাঙ্খিত। বাংলাদেশ তো বার বার সেটিই প্রমান করেছে।

ঈমান, আক্বীদা ও সুস্থ ধ্যান-ধারণা নিয়ে বাঁচতে হলে চেতনার সুস্বাস্থ্য অপরিহার্য। চেতনার ভূমিতে লাগাতর বিষ ঢাললে সেটির বিনাশ ঘটে। অথচ পৌত্তলিক সাহিত্য পাঠের ফলে তো সেটিই ঘটে। তাই ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলিমগণ সুলতানী আমল, মোগল আমল ও ব্রিটিশ আমলে বাংলা ভাষায় রচিত হিন্দুদের সৃষ্ট পৌত্তলিক বিষ ভাণ্ডারকে সতর্কতার সাথে পরিহার করেছে। তারা বরং চেতনায় পুষ্টি জুগিয়েছে উর্দু ও ফার্সি ভাষা থেকে। কিন্তু ১৯৭১’য়ের ডিসেম্বরে যুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয় লাভের পর রাজনৈতিক আধিপত্যের সাথে প্রতিষ্ঠা পায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য। গভীর সংযোগ গড়া হয় পৌত্তলিক বিষ ভান্ডারের সাথে। এবং জ্ঞানচর্চার অঙ্গণে সংযোগ ছিন্ন করা হয় পবিত্র কুর’আনের সাথেও। রেডিও-টিভিতেও কুর’আন তেলাওয়াত বদ্ধ করা হয়। সব কিছুই করা হয় হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পকে সফল করার তাগিদে। বাঙালি মুসলিমের চেতনায় তখন বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় ঢুকানো হয় পৌত্তলিকদের রচিত সাহিত্য, গান ও সিনেমা। দমন করা হয় ইসলামপন্থীদের বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতিকে। পৌত্তলিক চেতনায় সমৃদ্ধ বরীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয়া হয়। অথচ সে লক্ষে এ গানটি লেখা হয়নি।

 

 বিবেকে বিষক্রিয়া

শিক্ষা ও সাহিত্যের নামে বিষপান হলে বিবেকে বিষক্রিয়া অনিবার্য হয়। তখন জনগণের ঈমান, বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেকের অঙ্গণে মহামারি ও বিপর্যয় দেখা দেয়। বাংলাদেশের মত দেশে চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও দুর্বৃত্তির প্লাবন দেখে নিশ্চিত বলা যায় বিবেকের অঙ্গণে বিষক্রিয়া কতটা তীব্র ও ভয়াবহ। মুসলিম শিশুদের মুসলিম রূপে গড়ে তোলার কাজটি বিশাল। একাজ শুধু পিতামাতা ও মসজিদ-মাদ্রাসার দ্বারা হওয়ার নয়। বরং প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি দায়িত্বশীল ব্যক্তির। সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা-ব্যবস্থা, টিভি, পত্রপত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থার। ছাত্রদের শুধু বিষপান থেকে বাঁচালেই চলে না, তাদের চেতনায় কুর’আনী জ্ঞানের পুষ্টিও জোগাতে হয়। পানাহার জোগানোর ন্যায় একাজটিও লাগাতর হতে হয়। রাষ্ট্রের ঘাড়ে এটিই সবচেয়ে বড় দায়ভার। রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কলকারখান না গড়লে জনগণ কাফির হয়না, ফলে জাহান্নামের যাত্রী হয় না। কিন্তু জাহান্নামের যাত্রী হয়, যদি কুর’আনী জ্ঞানের পুষ্টি জোগানোর কাজটি না হয়। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠের দেশের সরকারের পক্ষ থেকে সে দায়িত্ব পালিত হয়নি। বরং সে কাজে হচ্ছে প্রচণ্ড অবহেলা। একটি মুসলিম দেশের সরকারের এটিই হলো সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ। ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধটি এতোই প্রবল যে, মুসলিম শিশুকে মুসলিম রূপে গড়ে তোলার কাজটি সরকারি মহলে পশ্চাদপদতা ও সাম্প্রদায়িকতা গণ্য হয়। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে হিন্দুতোষন নীতিকে সাম্প্রদায়িক বলা হয় না। বরং স্কুল-কলেজে পৌত্তলিক হিন্দুদের লেখা সাহিত্য পড়ানোর কাজটি সরকার বাধ্যতামূলক করেছে। পরিকল্পিত ভাবেই সরকার ছাত্র-ছাত্রীদের কুর’আন বুঝার সামর্থ্য বাড়াতে উদ্যোগ নেয়নি। অথচ সে সামর্থ্য অর্জনটি প্রতিটি মুসলিম নরনারীর উপর ফরজ। সরকারের এরূপ ইসলামবিরোধী শিক্ষানীতির কারণে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, আইনবিদ, হিসাববিদ ও অন্যান্য পেশাধারি বিপুল সংখ্যায় তৈরী হলেও সত্যিকার মুসলিম তৈরী হচ্ছে খুব কমই। মুষ্টিমেয় যারা ইসলামী চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠছে -তারা সেটি করছে নিজ উদ্যোগে।

কুর’আনী জ্ঞানের শূণ্যতায় কি ঈমান বাঁচে? বাঁচে কি চরিত্র? ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ঈমাননাশ ও চরিত্রনাশের মহামারি ছেয়ে গেছে দেশ জুড়ে। ফলে জাহেলী যুগের আরবদের চেয়েও ভয়াবহ দুর্বৃত্তি নেমে এসেছে বাংলাদেশের উপর। ইসলামপূর্ব যুগে আরবের জাহেল কাফেরগণ দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে শিরোপা পেয়েছে -সে প্রমাণ ইতিহাসে নেই। লুন্ঠনে লুন্ঠনে দেশের বুকে তারা দুর্ভিক্ষ ডেকে এনেছে বা মহিলাদের মাছধরা জাল পড়তে বাধ্য করেছে -সে প্রমাণও নেই। বরং জাহিলিয়াতের যুগেও মেহমানদারিতে আরবদের সুনাম ছিল; হাতেম তায়ীর মত অতি দয়ালু ব্যক্তিও তাদের মাঝে সেদিন জন্ম নিয়েছেন। তারা কখনোই বিদেশে অপরিচিতদের ঘরে নিজেদের কন্যা, বোন বা স্ত্রীদের রপ্তানি করেনি। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের নীচে নামার ইতিহাসটি বিশাল। তারা প্রমাণ করেছে, অর্থ পেলে তারা নিজেদের মহিলাদেরও রপ্তানী করতে রাজী। এ কর্ম বাঙালি মুসলিমগণ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে নজির স্থাপন করেছে। অথচ মহিলাদের একাকী বিমান যোগে হজ্জে পাঠানোরও অনুমতি নাই। বিস্ময়ের বিষয় হলো, বিদেশীদের ঘরে নারী রপ্তানি পরিণত হয়েছে অর্থনীতির অংশ। সত্যিকার ঈমান থাকলে কি এমনটি কখনো ঘটতো? দেশের আলেমগণও এ নিয়ে নিশ্চুপ। যেন এটি কোন ঈমান-আক্বীদার বিষয় নয়। প্রশ্ন হলো, এমন নীরব ও নিষ্ক্রিয় আলেমদের দিয়ে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কি কল্যাণ কি হবে?

 রবীন্দ্র সাহিত্যে অবগাহন করে মানবিক গুণে বেড়ে উঠার কাজটি হয় না -সে প্রমাণ অনেক। সেটি প্রমাণ করেছে রবীন্দ্রপ্রেমী শেখ হাসিনা। সেটি বর্বরতার আরেক বীভৎস ইতিহাস। সেটি ঘটে যখন রোহিঙ্গা মুসলিমগণ বাংলাদেশে প্রথম আসতে শুরু করে। শেখ হাসিনা তখন প্রাণ বাঁচাতে আসা ও সমুদ্রে ভাসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের বঙ্গীয় উপকূলে উঠতে দেয়নি। তার সে বর্বরতাটি বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। এমন কি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল মিষ্টার বান কি মুনও তাকে এরূপ নিষ্ঠুর আচরন পরিহারে আহবান জানিয়েছিলেন। রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় হতে বলেছিলেন। কিন্তু বিবেকহীন নিষ্ঠুরতাই যার রাজনীতির মূলমন্ত্র, তার কাছে কি মানবতা বা কারো সুপরামর্শ গুরুত্ব পায়? অবশ্য পরবর্তীতে হাসিনা আন্তর্জাতিক চাপে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। এখন রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিয়ে বহু বাংলাদেশী মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও নানা দেশে চাকুরির সন্ধানে নেমেছে। মালয়েশিয়ার সরকারের দাবী, সমূদ্রে ভাসা উদ্বাস্তুদের শতকরা ৭০ ভাই বাংলাদেশী। এ প্রবন্ধের লেখক নিজে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় এমন বাংলাদেশীদের দেখেছেন যারা নিজেরাই লেখককে বলেছে, রোহিঙ্গা পরিচয় দিয়ে তারা তুরস্কের সরকার থেকে নিয়মিত ভাতা নিচ্ছে এবং সে সাথে কারখানায় কাজও করছে। অপর দিকে বিহারীদের সাথে কৃত নিষ্ঠুরতা কি কম? স্রেফ অবাঙালি হওয়ার কারণে প্রায় ৬ লক্ষ বিহারীকে তাদের ঘরবাড়ি ও দোকান-পাট থেকে নামিয়ে সেগুলির দখল করে নিয়েছে বাঙালিরা। অথচ বাঙালিগণ বিপুল সংখ্যায় এখনো যাচ্ছে পাকিস্তানে। ১৯৭১’য়ের পর ১০ লাখের বেশী বাঙালি আশ্রয় নিয়েছে এবং নানারূপ পেশায় নিয়োজিত রয়েছে পাকিস্তানে।

কিছু নাগরিকের আত্মপচন, চুরিডাকাতি ও খুনখারাবীতে দেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে না। বিশ্ব রেকর্ড গড়তে আত্মপচনটি মহামারি আকারে হওয়া লাগে। সে সাথে লাগে বিবেকধ্বংসী জীবাণুর বিশাল ডোজ। সে বিশাল ডোজটি আসছে বাংলা ভাষায় রচিত বিনোদনমূলক সেক্যুলার সাহিত্য ও হিন্দুত্ববাদী সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার থেকে। রবীন্দ্রসাহিত্য নিজেই এক্ষেত্রে বিশাল। ফলে দেশ জুড়ে ছেয়ে গেছে বিবেক হত্যার মহামারি। এজন্যই দেশজুড়ে ভোট ডাকাতি, ব্যাংক ডাকাতি, শেয়ার মার্কেট লুট বা শাপলা চত্বরের ন্যায় নৃশংস গণহত্যা মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাকাত পাড়ায় চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণ ও সন্ত্রাস নিয়ে কখনো বিচার বসে না। তা নিয়ে কারো লজ্জাবোধও হয় না। বরং অপরাধ কর্মে যার অধিক সামর্থ্য, তাকে নিয়ে গর্ব করা হয়। এমন কি তার বর্বরতা নিয়ে উৎসবেরও আয়োজন হয়। জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণে সেঞ্চুরির উৎসব এবং বাংলা নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণে মহিলাদের কাপড় খুলে শ্লীলতাহানির উৎসবের পিছনে তো তেমনি এক অসুস্থ চেতনা কাজ করেছে। ধর্ষকদের কাছে প্রতিটি সফল ধর্ষণ এবং ডাকাতদের কাছে প্রতিটি সফল ডাকাতিতেই তো উৎসব। তাই যে দুর্বৃত্ত-পাড়ায় ধর্ষণ হয় বা ডাকাতি হয় সেখানে তা নিয়ে উৎসবও হয়। ২০১৮ সালে দেশ জুড়ে ভোটডাকাতিতে সফল হওয়াতে ডাকাত সর্দারনী হাসিনা ও তাঁর সহকর্মীদের উৎসব কি কম? প্রতিদিন উৎসব লেগে আছে বাংলাদেশের মন্ত্রীপাড়ায়, সরকারি দলের অফিসে, দলীয়কর্মীদের ঘরে ঘরে এবং সরকারি প্রশাসনে। শেখ হাসিনাকে মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী বলে তাঁর ভোটডাকাতির বিজয়উৎসবে শামিল হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রফেসর, বহু সচিব, বহু উকিল, বহু বুদ্ধিজীবী, বহু লেখক ইত্যাদি বহু  প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। কোন সভ্য দেশে কি কখনো কোন ডাকাতকে এভাবে শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় বলা হয়। এটি তো নিরেট ডাকাতপাড়ার সংস্কৃতি। বাঙালির আত্মপচনের এর চেয়ে বড় আলামত আর কি হতে পারে?

 

 রবীন্দ্র সাহিত্যে বিষভান্ডার

রবীন্দ্র সাহিত্যে হিন্দুত্ববাদীদের জন্য অনুপ্রেরণার প্রচুর উপকরণ থাকলেও বাঙালি মুসলিমদের জন্য তা হলো এক বিশাল বিষভান্ডার। রবীন্দ্রনাথ যে কতটা গভীর ভাবে মুসলিমবিদ্বেষী ছিলেন সেটি কোন গোপন বিষয় নয়, নানা ভাবে তার প্রকাশ ঘটেছে। সে চেতনাটির প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯০৫ সালে। বিহার, বাংলা, উড়িষ্যা এবং আসাম নিয়ে তখন বৃহত্তর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি প্রদেশ ছিল। ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে বিশাল এ প্রদেশের উপর প্রশাসনিক নজরদারী রাখা তখন কঠিন পড়ে। তাই নিজেদের প্রশাসনিক স্বার্থে তারা প্রদেশটিকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে গঠন করে একটি নতুন প্রদেশ। এ নতুন প্রদেশের রাজধানি হয় ঢাকা। এ সিদ্ধান্তের পিছনে ব্রিটিশদের মনে কোনরূপ মুসলিমপ্রীতি কাজ করেনি, বরং কাজ করেছে বাংলার উপর প্রশাসনিক সুবিধার বিষয়টি। কিন্তু হিন্দুরা বিষয়টিকে হিন্দু স্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর রূপে গণ্য করে। রবীন্দ্রনাথ শামিল হন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী হিন্দুদের আন্দোলনে। অখণ্ড বাংলার প্রেমকে বলবান করতে লেখেন “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” গান।  

সে সময় ভারতীয় কংগ্রেস শুরু করে স্বদেশী আন্দোলন। সে আন্দোলনে প্রয়োজন ছিল একজন জাতীয় হিন্দু নেতার মডেল। সে প্রয়োজন তারা ইতিহাস থেকে তুলে আনেন শিবাজীর ন্যায় ভারতের বুকে মুসলিম শাসনের কট্টোর বিরোধী ও সন্ত্রাসী শিবাজীকে। কংগ্রেসি নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক শিবাজীকে ভারতীয় হিন্দু-জাতীয়তাবাদের জনক রূপে খাড়া করেন। তখন রাজনীতির ময়দানে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গোড়াপত্তন। শিবাজীকে ভারতীয় হিন্দুদের জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ১৯০৪ সালে চালু করা হয় শিবাজী উৎসব। এর আগে ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় “গো-রক্ষিণী সভা”। এ সব আয়োজনের মাধ্যমে হিন্দু মুসলিমের মধ্যে তৈরি হয় সাম্প্রদায়িক হানাহানির পরিবেশ। ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৭ সালে এর জন্য তিলককে গ্রেফতার করে। রবীন্দ্রনাথের সাম্প্রদায়িক চেতনা তখন আর গোপন থাকেনি। ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জনক তিলককে মুক্ত করতে তিনি তখন রাস্তায় নেমে পড়েন। তাকে মুক্ত করার জন্য অর্থ সংগ্রহে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতেও তিনি  দ্বিধা করেননি। শুধু অর্থ ভিক্ষা নয়, তিলকের আবিষ্কৃত শিবাজীর পথকেই ভারতীয় হিন্দুদের মুক্তির পথ রূপে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি নিজে মেতে উঠেছিলেন শিবাজী বন্দনায়।

 রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি ছিলেন না; তাঁর একটি রাজনৈতিক দর্শনও ছিল। ভারতীয় রাজনীতিতে তখন হিন্দুত্ববাদ নিয়ে একটি প্রবল রাজনৈতিক পক্ষ ছিল। সে পক্ষটিই  হিন্দু মহাসভা, আর.এস.এস ও জনসংঘের পথ ধরে আজকের বিজেপি’তে পরিণত হয়েছে। এ পক্ষটির সাথে রবীন্দ্রনাথের গভীর একাত্মতাও ছিল।  সে রাজনৈতিক দর্শনের প্রবল প্রকাশ ঘটেছে তার লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও গানে। “শিবাজী উৎসব” কবিতাটি হলো রবীন্দ্রনাথের তেমনি এক রাজনৈতিক দর্শনের কবিতা। সে কবিতায় প্রকাশ পায় উগ্র হিন্দুত্ববাদ। রবীন্দ্রনাথের আদর্শিক ও রাজনৈতিক চেতনাকে বুঝবার জন্য তাঁর রচিত এই একটি মাত্র কবিতাটিই যথেষ্ট; অন্য কোন গবেষণার প্রয়োজন নেই। এ কবিতাটিতে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনার পাশাপাশি তার পূজনীয় বীরের ছবি। বাঙালি হলেও রবীন্দ্রনাথ ভাবনাটি বাংলার আলো-বাতাস ও ভূগোল দিয়ে সীমিত ছিল না। তিনি ভাবতেন অখণ্ড ভারত নিয়ে। অখণ্ড ভারতের সে মানচিত্রে মুসলিমদের জন্য কোন স্থান ছিল না। রবীন্দ্রনাথের পিতা ও পিতামহ ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী হলেও রবীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখতেন একজন গোঁড়া হিন্দু রূপে। তার স্বপ্নটি ছিল সমগ্র ভারতজুড়ে হিন্দু ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার। সে হিন্দু ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে যিনি বীর রূপে যিনি গণ্য হয়েছেন তিনি কোন বাঙালি নন, তিনি হলেন সূদুর মহারাষ্ট্রের অবাঙালি শিবাজী। “শিবাজী-উৎসব” কবিতাটিতে প্রকাশ পেয়েছে শিবাজীর সে রাজনৈতিক মিশনের সাথে রবীন্দ্রনাথের একাত্মতা। শিবাজীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন:

মারাঠার কোন শৈলে অরণ্যের অন্ধকারে ব’সে,

হে রাজা শিবাজী,

তব ভাল উদ্ভাসিয়া এ ভাবনা তড়িৎপ্রভাবৎ

এসেছিল নামি-

“এক ধর্মরাজ্য পাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত

বেধে দিব আমি।”

“খণ্ড চ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত” ভারতকে আবার এক অখণ্ড হিন্দু ধর্মরাজ্য রূপে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন শিবাজী দেখেছিল সেটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের নিজের স্বপ্ন। সে অভিন্ন স্বপ্ন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর শিবাজীর চেতনা একাকার হয়ে গেছে। এখানেই রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়েছেন শিবাজীর ন্যায় ইসলাম ও মুসলিমের প্রতিপক্ষ রূপে। ভারত জুড়ে তখন মোগলদের শাসন। হিন্দু ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিবাজী বেছে নেয় মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসের পথ। শিবাজীর  মুসলিম শাসনবিরোধী সে বিদ্রোহ ও সন্ত্রাস কয়েক শত বছর পূর্বে হলেও রবীন্দ্রনাথের মনে তা নিয়ে উৎসব মুখর হয়ে উঠে। “শিবাজী-উৎসব” কবিতায় তো সেটিরই প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্র সাহিত্যে এভাবেই মুসলিম বিরোধী নাশকতার শুরু। রবীন্দ্রনাথের মাঝে এ নিয়ে প্রচণ্ড দুঃখবোধ ছিল যে, বাঙালিগণ সে সময় শিবাজীকে চিনতে পারিনি এবং তার স্বপ্ন ও সন্ত্রাসের সাথে একাত্ম হতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতাটিতে বাঙালি বলতে যাদের বুঝিয়েছেন সেখান বাংলাভাষী মুসলিমদের কোন স্থান ছিল না। বাঙালি বলতে তিনি একমাত্র হিন্দুদেরই বুঝিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র তার লেখায় “আমাদের পাড়ায় বাঙালি ও মুসলিমদের খেলা” যে বাঙালিদের বুঝিয়েছিলেন সে বাঙালিদের মাঝেও বাঙালি মুসলিমদের জন্য কোন স্থান ছিল না।

 

 বাঙালি মুসলিমের বিষপান

রবীন্দ্রনাথ হিন্দুত্ববাদী ছিলেন। হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্রমোদীর কাছে এজন্যই রবীন্দ্রনাথ অতি পূজনীয় গুরুদেব। মিলটি এখানে অভিন্ন হিন্দুত্ববাদী চেতনার। অখণ্ড ভারত জুড়ে শিবাজীর ন্যায় রবীন্দ্রনাথও মোদীর মনে হিন্দুধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠায় প্রচণ্ড আগ্রহ জাগবে  -তাতেই বা বিস্ময়ের কি? হিন্দু মন্দির গড়বে, হিন্দু ধর্মরাজ্য গড়বে -সেটিই তো স্বাভাবিক। বাঙালি ও মুসলিমদের মাঝে চেতনার পরিচয়ে যে বিভাজন রেখা টানবেন –তাতেই বা অপরাধ কি? মানুষে মানুষে বিভাজন তো গড়ে উঠে ধর্ম, সংস্কৃতি ও চেতনার সে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে। সে ভিন্ন পরিচয় নিয়ে বাঙালি হিন্দু  ও মুসলিমগণ যে সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন ধারার এবং তাদের মাঝে মিলন যে অসম্ভব –সেটি রবীন্দ্রভক্ত বাঙালি মুসলিমগণ না বুঝলেও রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় উগ্র হিন্দুত্বের সে সর্বভারতীয় ধারায় মিশে গেছেন। যে কোন মিশনারীর ন্যায় রবীন্দ্রনাথও চাইতেন অন্যরাও তার সে হিন্দুত্বের ধারায় মিশে যাক। হিন্দুত্বের সে ধারাটিতে রয়েছে ভারতের বুকে মুসলিম প্রভাবের বিলুপ্তির প্রবল ব্যগ্রতা। রয়েছে হিন্দু ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠায় আপোষহীনতা। এমন রবীন্দ্রনাথের ন্যায় এমন এক উগ্র হিন্দুর সাহিত্যকে আপন রূপে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে এখানেই মুসলিমদের মূল সমস্যা। হিন্দু-ধর্ম-রাজ্যের এমন এক উগ্র ধ্বজাধারীকে কোন মুসলিম কি তাঁর নিজ চেতনার প্রতিনিধি রূপে গ্রহণ করতে পারে? হতে পারে কি তাঁর চেতনার সাথে একাত্ম? তার লেখা গান ও  কবিতাই বা একজন মুসলিম গায় কি করে? এটি তো বিষপান। তার জন্ম দিনে উৎসবই বা করে কি করে? ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রভক্ত বাঙালিদের এখানেই বড় গাদ্দারী। এ গাদ্দারগণই মুসলিম চেতনার গোড়ায় লাগাতর বিষ ঢালছে।

 

 স্বপ্নটি হিন্দু ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার

শিবাজী মারা গেছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার দর্শন ও রাজনৈতিক অভিলাষটি মারা পড়েনি। ভারতে সে চেতনাটি বেঁচে আছে শিবসেনা, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল ও ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজিপি) ন্যায় বিভিন্ন উগ্র হিন্দুবাদি দলগুলোর মাঝে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও যে ভূগোলের স্বপ্নটি দেখতেন সেটি অবিভক্ত বাংলার নয়। সেটি অখণ্ড হিন্দু ধর্মরাজ্য ভারতের। নিজের  জীবদ্দশাতে রবীন্দ্রনাত সে হিন্দু ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারটি দেখতে পেয়েছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলকের রাজনীতিতে। তিলক তার কাছে গণ্য হয়েছিল শিবাজী’র মিশনকে এগিয়ে নেয়ার রাজনীতিতে আদর্শ নেতা রূপে। শিবাজী সে মিশনকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই তিলক নিজ রাজ্য মহারাষ্ট্রে শিবাজী উৎসবের শুরু করেন। সে উৎসবের সাথে একাত্মতার ঘোষণা দিতে বাঙালি কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ বানার্জি ছুটে যান মুম্বাইয়ে। মারাঠীদের ন্যায় কলকাতার বাঙালি হিন্দুদের উদ্যোগে শিবাজী উৎসব শুরু হয় বাঙলার বুকেও।

শিবাজী তার হিন্দু ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধটি শুরু করে মোগল সম্রাট আরোঙ্গজেবের সময়। কিন্তু সে প্রচেষ্ঠা ব্যর্থ হয়। বাংলার মানুষই শুধু নয়, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরাও শিবাজীর সে আন্দলনে সারা দেয়নি। শিবাজীর মিশনটিকে চিনতে বাঙালির সে ব্যর্থতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে প্রচণ্ড আফসোস ছিল। কিন্তু এবারে তার মনে গভীর আনন্দ।এবং মনের সে বিপুল আনন্দ নিয়েই রবীন্দ্রনাথের শিবাজী উৎসব কবিতা। সেটি একারণে যে, বাঙালিরা শিবাজীকে চিনতে পেরেছে এবং তার দর্শন নিয়ে মারাঠীদের সাথে মিলে উৎসব শুরু হয়েছে। তবে বাঙালিদের থেকে রবীন্দ্রনাথের চাওয়াটি আরেকটু গভীর। তিনি চান, বাঙালিগণ আবির্ভূত হোক হিন্দু ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার সৈনিক রূপে। রবীন্দ্রনাথ এখানে আবির্ভূত হয়েছেন স্রেফ কবি হিসাবে নয়, বরং হিন্দু ধর্মরাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রাজনৈতিক নেতা রূপে। তাই তিনি লিখেছেন,

“মারাঠার প্রান্ত হতে একদিন তুমি ধর্মরাজ,

ডেকেছিলে যবে

রাজা ব’লে জানি নাই, মানি নাই, পাই নাই লাজ

হে ভৈরব রবে।

তোমারে চিনেছি আজি, চিনেছি চিনেছি হে রাজন,

তুমি মহারাজ।

তব রাজকর লয়ে আট কোটি বঙ্গের নন্দন

দাঁড়াইবে আজ।”

 

বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে হিন্দু ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনটি রবীন্দ্রনাথের মনে যে কীরূপ উম্মাদনা সৃষ্টি করে সেটিই প্রকাশ পায় শিবাজী-উৎসব কবিতায়। মনের মাধুরি মিশিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
“সেদিন শুনিনি কথা
আজি মোরা তোমার আদেশ
শির পাতি লব,
কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে
ভারতে মিলিবে সর্বশেষ ধ্যান-মন্ত্র তব।
ধ্বজা ধরি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন
দরিদ্রের বল,
এক ধর্ম রাজ্য হবে এ ভারতে
এ মহাবচন করব সম্বল।
মারাঠির সাথে আজি,হে বাঙালি
এক কণ্ঠে বল ‘জয়তু শিবাজী।
মারাঠির সাথে আজি,হে বাঙ্গালি,
এক সঙ্গে চলো মহোৎসবে সাজি।
আজি এক সভা তলে
ভারতের পশ্চিম পুরব দক্ষিণ ও বামে
একত্রে করুক ভোগ এক সাথে একটি গৌরব
এক পুণ্য নামে।—

শিবাজীর মিশন থেকে আর দূরে থাকা নয়, রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে এবার ঘোষিত হলো শিবাজী’র উগ্র হিন্দুত্বের দর্শন ও আন্দোলেনের সাথে “কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে” পূর্ণ একাত্মতার ঘোষণা। সে  সময় তিলক ও অন্যান্য হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতাগণ শুরু করেন হিন্দুদের গো-দেবতা বাঁচানোর লড়াই। হিন্দুদের এ লড়াইয়ে আক্রমণের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মুসলিমগণ। কারণ, মুসলিমরা গরু জবাই করে গরুর গোশতো খায় অথচ গরু হিন্দুদের উপাস্য। গো-দেবতা হত্যা বন্ধ ও হত্যার প্রতিশোধ নিতে গড়ে তোলা হলো গরু রক্ষা সমিতি। এতে গরুর নিরাপত্তা বাড়লেও ভারত জুড়ে নিরাপত্তা হারালো মুসলিমের জানমাল ও ইজ্জত-আবরু। অথচ তাদের গো-দেবতার ভক্ষক শুধু মুসলিম ছিল না, ছিল খৃষ্টানগণও। অর্থাৎ খৃষ্টান ইংরেজগণ। কিন্তু হিন্দু নেতাদের দ্বারা খৃষ্টান বা ইংরেজগণ দেবতার ভক্ষক রূপে চিত্রিত হয়নি, ফলে তাদের বিরুদ্ধে উগ্রবাদি হিন্দুদের কোনরূপ অভিযোগ বা  উচ্চবাচ্য ছিল না। ফল দাঁড়ালো,এ আন্দোলনের ফলে হিন্দু ও মুসলিমনগণ একে অপরের শত্রু রূপে চিহ্নিত হলো। শুরু হলো সংখ্যালঘিষ্ট মুসলিমদের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা  ও প্রতিশোধের স্পৃহা। শুরু হলো ভারত জুড়ে মুসলিম নির্মূলের দাঙ্গা।

 

মুসলিম বিদ্বেষী রবীন্দ্রনাথ

মুসলিম বিদ্বেষী ও উগ্র হিন্দুত্বের চেতনাটি শুধু শিবাজী-উৎসব কবিতায় সীমিত নয়। সেটির প্রকাশ পেয়েছে তার “বিচার”,“মাসী”,“বন্দীবীর”,“হোলীখেলা” কবিতায় এবং “সমস্যা পুরাণ”,“দুরাশা”,“রীতিমত নভেল” ও “কাবুলিওয়ালা” গল্পে। মুসলিমদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ধারণাটি কীরূপ ছিল সেটি প্রকাশ পায় “রীতিমত নভেল” নামক একটি ছোটগল্পে। তিনি লিখেছেন: “আল্লাহো আকবর শব্দে বনভূমি প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। একদিকে তিন লক্ষ যবন সেনা, অন্য দিকে তিন সহস্র আর্য সৈন্য। … পাঠক, বলিতে পার … কাহার বজ্র মন্ত্রে ‘হর হর বোম বোম’ শব্দে তিন লক্ষ ম্লেচ্ছ কণ্ঠের ‘আল্লাহো আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হয়ে গেলো। ইনিই সেই ললিত সিংহ। কাঞ্চীর সেনাপতি। ভারত-ইতিহাসের ধ্রুব নক্ষত্র।” রবীন্দ্রনাথের ‘দুরাশা’ গল্পের কাহিনীটি আরো উৎকট মুসলিম বিদ্বেষে পূর্ণ। এখানে তিনি দেখিয়েছেন, একজন মুসলিম নারীর হিন্দু ধর্ম তথা ব্রাহ্মণদের প্রতি কি দুর্নিবার আকর্ষণ এবং এই মুসলিম নারীর ব্রাহ্মণ হওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্ঠার চিত্র। রবীন্দ্রনাথে শেষ জীবনে যে মুসলমানির গল্পটি লিখিয়েছিলেন সে গল্পের নায়ক ছিলেন হবি খাঁ। হবি খাঁ’র মধ্যে তিনি উদারতার একটি চিত্র তূল ধরেছেন। তবে সে উদারতার কারণ রূপে দেখিয়েছেন, হবি খাঁ’র মা ছিল হিন্দু অভিজাত রাজপুতিনী। এভাবে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, মুসলিম একক ভাবে মহৎ হতে পারেনা। মহৎ হতে হলে হিন্দু রক্তের মিশ্রন থাকতে হবে। এখানে প্রমাণ মনে রবীন্দ্রনাথের নিরেট বর্ণবাদী মনের।

মুসলিম সমাজের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির নিখুঁত পরিচয়টি পাওয়া যায় ‘কণ্ঠরোধ’ (ভারতী, বৈশাখ-১৩০৫) নামক প্রবন্ধে। সিডিশন বিল পাস হওয়ার পূর্বদিনে কলকাতা টাউন হলে এই প্রবন্ধটি তিনি পাঠ করেন। এই প্রবন্ধে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী যবন, ম্লেচ্ছদের একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন,“কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলিম কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্র খন্ড হস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, উপদ্রবের লক্ষ্যটা বিশেষরূপে ইংরেজদেরই প্রতি। তাহাদের শাস্তিও যথেষ্ট হইয়াছিল। প্রবাদ আছে, ইটটি মারিলেই পাটকেলটি খাইতে হয়; কিন্তু মূঢ়গণ (মুসলিম) ইটটি মারিয়া পাটকেলের অপেক্ষা অনেক শক্ত শক্ত জিনিস খাইয়াছিল। অপরাধ করিল, দণ্ড পাইল; কিন্তু ব্যাপারটি কি আজ পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝা গেল না। এই নিম্নশ্রেণীর মুসলিমগণ সংবাদপত্র পড়েও না, সংবাদপত্রে লেখেও না। একটা ছোট বড়ো কাণ্ড হইয়া গেল অথচ এই মূঢ় (মুসলিম) নির্বাক প্রজা সম্প্রদায়ের মনের কথা কিছুই বোঝা গেল না। ব্যাপারটি রহস্যাবৃত রহিল বলিয়াই সাধারণের নিকট তাহার একটা অযথা এবং কৃত্রিম গৌরব জন্মিল। কৌতূহলী কল্পনা হ্যারিসন রোডের প্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া তুরস্কের অর্ধচন্দ্র শিখরী রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত সম্ভব ও অসম্ভব অনুমানকে শাখা পল্লবায়িত করিয়া চলিল। ব্যাপারটি রহস্যাবৃত রহিল বলিয়াই আতঙ্ক চকিত ইংরেজি কাগজে কেহ বলিল, ইহা কংগ্রেসের সহিত যোগবদ্ধ রাষ্ট্র বিপ্লবের সূচনা; কেহ বলিল মুসলিমদের বস্তিগুলো একেবারে উড়াইয়া পুড়াইয়া দেয়া যাক, কেহ বলিল এমন নিদারুণ বিপৎপাতের সময় তুহিনাবৃত শৈলশিখরের উপর বড়লাট সাহেবের এতটা সুশীতল হইয়া বসিয়া থাকা উচিত হয় না।” এরূপ মুসলিম বিদ্বেষ ও মুসলিম ভীতি নিয়েই হলো নির্ভেজাল রবীন্দ্র চেতনা। মুসলিম এবং ইসলামের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের মগজ যে কতটা বিষপূর্ণ ছিল সেটি বুঝতে কি এরপরও কিছু বাকি  থাকে? রবীন্দ্রনাথের মন যে কতটা ইংরেজ প্রেমে পূর্ণ –উপরুক্ত নিবন্ধে সেটিরও প্রমাণ মেলে। মুসলিমগণ কলকাতার রাস্তায় লাঠি হাতে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছে –রবীন্দ্রনাথের কাছে সেটিই অপরাধ গণ্য হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অতি পুলকিত যে, পুলিশ মুসলিমদের দমনে নির্যাতনে নেমেছে। এবং পুলিশের নির্যাতন তার কাছে উচিত পাওনা গণ্য হয়েছে।

 গুরু মুসলিম নিধনের

রবীন্দ্রনাথের পরিবারের জমিদারী ছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনার শাহজাদপুর, রাজশাহীর পতিসর প্রভৃতি অঞ্চলে। আর এই অঞ্চলগুলি ছিল মুসলিম প্রধান। মুসলিম প্রজাগণই তার রাজস্ব জোগাতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যর্থ হন সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাদের সাথে মনের সংযোগ গড়তে। তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়েও তিনি কোনদিন মাথা ঘামাননি। প্রজাদের জোগানো অর্থ দিয়ে মুসলিম প্রধান কুষ্টিয়া, পাবনা বা রাজশাহীতে তিনি একটি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন –তার প্রমাণ নাই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন হিন্দুপ্রধান পশ্চিম বাংলার বোলপুরে। উল্টো তার সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের বিরুদ্ধে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনভাব। উৎকট মুসলিম বিরোধী সংলাপ দেখা যায় তার নাটকে। নাটকের নট-নটিরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে যা বলে তা তাদের নিজেদের কথা নয়। নিজেদের ইচ্ছায় কিছু বলার অধিকার তাদের থাকে না। তারা তো তাই বলে যা নাট্যকার তাদের মুখ দিয়ে বলাতে চায়। ফলে নাটকের সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় নাট্যকারের মনের চিত্রটি। মুসলিম বিরোধী রবীন্দ্রমনের সে কুৎসিত চিত্রটি প্রকাশ পেয়েছে তার রচিত ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে। প্রতাপাদিত্যের মুখ দিয়ে তিনি উচ্চারন করান,“খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ। যে মুসলিম আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।” সাহিত্যের নামে এ ছিল মুসলিম নিধনে রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে খোলাখোলি উস্কানি। এই হলো রবীন্দ্রমানস! সম্প্রতি (জানুয়ারী, ২০২২ সালে) উত্তরখন্ডে ধর্মসংঘের সম্মেলনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীগণ যেরূপ মুসলিম নির্মূলের ডাকা দিল, সেটিই তো রবীন্দ্র চেতনা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে তেমন মুসলিম নির্মূলের কথা ব্যক্ত করেছেন শত বছর আগে।

ভারতের বুকে মুসলিম শাসন আমলে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। এ কথাটি বলেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সাবেক প্রফেসর ড. তপন রায় চৌধুরী। একই শহরে ও একই গ্রামে হিন্দু মুসলিম পাশাপাশি শত শত বছর শান্তিপূণ ভাবে বসবাস করেছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু এক ধর্মের লোক অন্যধর্মের মানুষের ঘরে বা দোকানে আগুন দিয়েছে সে ঘটনা ঘটেনি। এমনকি হিন্দুদের রচিত ইতিহাসের বইয়েও তার উল্লেখ নাই। উল্লেখ নেই ইংরেজদের রচিত ইতিহাসের বইয়েও। দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য চাই শহর শহরে এবং গ্রামে গ্রামে ঘৃণাপূর্ণ হিংস্র মনের মানুষ। চাই সরকারের সমর্থন। এমন কি ভারতের বহু হিন্দু রাজনীতিকের অভিমত, সরকারের সমর্থন না থাকলে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না। দাঙ্গাপাগল মানুষ সৃষ্টির জন্য চাই বিষপূর্ণ সাহিত্য। আর মুসলিম শাসনামলে সেরূপ সাহিত্যই সৃষ্টি হয়নি। সে বিষপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে এবং রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ন্যায় অসংখ্য মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু সাহিত্যিকদের দ্বারা। রাজনীতির অঙ্গনে দাঁড়িয়ে শিবসেনা নেতা বাল ঠ্যাকারে বা বিজিপি নেতা এল.কে আদবানী, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ ও যোগী আদিত্যনাথ যেরূপ মুসলিম বিরোধী উক্তি উচ্চারন করেন, তার চেয়েও বিষপূর্ণ লিখনি লিখেছেন তারা। ফলে মুসলিম নিধনের লক্ষ্যে দাঙ্গাগুলির শুরু গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে হয়নি, সেটি হয়েছে বাংলায়। এবং সেটি ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের আগেই। কলকাতার রাজপথে ১৯৪৬ সালের আগষ্টে কলকাতায় হিন্দু গুন্ডারা যেভাবে মুসলিম হত্যা করে সেরূপ হত্যাকাণ্ড আজও ভারতের অন্য কোন শহরে ঘটেনি। একদিনেই ৫ হাজারের বেশী মুসলিমকে হত্যা করা হয়। কোন কোন বর্ণনা মতে মৃতদের সংখ্যা ৭ হাজারের অধিক। নিহতদের অধিকাংশই ছিল নোয়াখালির দরিদ্র মুসলিম যারা কলকাতা বন্দরে শ্রমিকের কাজ করতো। গুজরাত, মোম্বাই বা মিরাটের কোথাও একদিনে এতো মুসলিমকে হত্যা করা হয়নি।

কলকাতার সে দাঙ্গার কিছু নিজ চোখে-দেখা ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বাঙালি প্রফেসর ড. তপন রায় চৌধুরী তার “বাঙাল নামা” বইতে। প্রফেসর ড.তপন রায়চৌধুরি লিখেছেন, “নিজের চোখে দেখা ঘটনার বিবরণে ফিরে যাই। হস্টেলের বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম রাস্তার ওপারে আগুন জ্বলছে। বুঝলাম ব্যাপারটা আমার চেনা মহাপুরুষদেরই মহান কীর্তি। হস্টেলের ছাদে উঠে দেখলাম, আগুন শুধু আমাদের পাড়ায় না, যতদূর চোখ যায় সর্বত্র আকাশ লালে লাল। তিন দিন তিন রাত কলকাতার পথে ঘাটে পিশাচনৃত্য চলে। … দাঙ্গার প্রথম ধাক্কা থামবার পর বিপজ্জনক এলাকায় যেসব বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন ছিলেন, তাঁদের খোঁজ নিতে বের হই। প্রথমেই গেলাম মুন্নুজন হলে। ..নিরঙ্কুশ হিন্দু পাড়ার মধ্যে ওদের হস্টেল। তবে ভদ্র বাঙালি পাড়া। সুতরাং প্রথমটায় কিছু দুশ্চিন্তা করিনি। কিন্তু দাঙ্গা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালির রুচি-সংস্কৃতির যেসব নমুনা দেখলাম, তাতে সন্দেহ হল যে, মুন্নুজান হলবাসিনী আমার বন্ধুদের গিয়ে আর জীবিত দেখবো না। …হোস্টেলের কাছে পৌঁছে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে ভয়ে আমার বাক্যরোধ হল। বাড়ীটার সামনে রাস্তায় কিছু ভাঙা স্যুটকেস আর পোড়া বইপত্র ছড়ানো। বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। ফুটপথে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন – একটু আগে পুলিশের গাড়ি এসে মেয়েদের নিয়ে গেছে।…শুনলাম ১৬ই আগষ্ট বেলা এগারোটা নাগাদ একদল সশস্ত্র লোক হঠাৎ হুড়মুড় করে হস্টেলে ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা অশ্রাব্য গালিগালাজ করে যার মূল বক্তব্য, মুসলিম স্ত্রীলোক আর রাস্তার গণিকার মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। …হামলাকারিরা অধিকাংশই ছিলেন ভদ্রশ্রেণীর মানুষ এবং তাঁদের কেউ কেউ ওঁদের বিশেষ পরিচিত, পাড়ার দাদা। ” –(তপন রায়চৌধুরী, বাঙাল নামা, ২০০৭)।

তপন রায়চৌধুরী আরো লিখেছেন,“খুনজখম বলাৎকারের কাহিনী চারি দিক থেকে আসতে থাকে। …বীভৎস সব কাহিনী রটিয়ে কিছু লোক এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পায়। তার চেয়েও অবাক হলাম যখন দেখলাম কয়েকজন তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত লোক মুসলিমদের উপর নানা অত্যাচারের সত্যি বা কল্পিত কাহিনি বলে বা শুনে বিশেষ আনন্দ পাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে দু-তিনজন রীতিমত বিখ্যাত লোক। প্রয়াত এক পন্ডিত ব্যক্তি, যাঁর নাম শুনলে অনেক নিষ্ঠাবান হিন্দু এখনো যুক্তকরে প্রণাম জানায়, তাঁকে এবং সমবেত অধ্যাপকদের কাছে নিকাশিপাড়ার মুসলিম বস্তি পোড়ানোর কাহিনি বলা হচ্ছিল। যিনি বলছিলেন তিনি প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিশ্বাসযোগ্য লোক। বেড়া আগুন দিয়ে বস্তিবাসীদের পুড়িয়ে মারা হয়। একজনও নাকি পালাতে পারিনি। ছেলেটি বলছিল, কয়েকটি শিশুকে আগুনের বেড়া টপকে তাদের মায়েরা আক্রমণকারীদের হাতে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যাতে ওদের প্রাণগুলি বাঁচে। বাচ্চাগুলিকে নির্দ্বিধায় আবার আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। আমরা শুনেছিলাম, এই কুকীর্তির নায়ক কিছু বিহারী কালোয়ার। তার ভয়াবহ বর্ণনাটি শুনে সুশোভনবাবু মন্তব্য করেন,“এর মধ্যে নিশ্চয়ই বাঙালি ছেলেরা ছিল না?” শুনে সেই পন্ডিতপ্রবর গর্জে উঠলেন, “কেন, বাঙালি ছেলেদের গায়ে কি পুরুষের রক্ত নেই?” –(তপন রায়চৌধুরী, বাঙাল নামা, ২০০৭)। এই হলো বাঙালি হিন্দু বাবুদের কাণ্ড। ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী তখন তার তত্ত্বাবধানে গুজরাতে মুসলিম নির্মূলের যে বীভৎস গণহত্যাটি চলে তা থেকে কলকাতার মুসলিম নির্মূলের এ গণহত্যাটি কি কম নির্মম? “খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ। যে মুসলিম আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।” কি ভয়ংকর কথা! রবীন্দ্রনাথের এরূপ বিষপূণ্য সাহিত্যই যে মুসলিম নিধনের জন্য হিন্দুদেরকে অতি হিংস্র ভাবে প্রস্তুত করেছিল –এ হলো সে হিংস্রতারই বহিঃপ্রকাশ। আর এই ভয়ংকর মুসলিম বিদ্বেষী রবীন্দ্রনাথের গান আজ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। চেতনার দিক দিয়ে বাঙালি মুসলিম য়ে কতটা মৃত তা বুঝতে এরপরও কি কিছু বাকি থাকে? বাংলাদেশের শতকরা ৯১ ভাগই মুসলিম। আর সে মুসলিমদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের এমন বয়ান!  এ পৃথিবী পৃষ্ঠে এমন কি কোন রাষ্ট্র আছে যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে এমন এক ব্যক্তির রচিত গান গাইতে হয় যার ধর্মই হলো সে জনগোষ্ঠির বিনাশ? এবং বিনাশ না করাই তার কাছে অধর্ম!

 

উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি শিবিরে বিজয় উৎসব

মুসলিম নিধন ও হিন্দু ধর্মরাজ্য নির্মাণের লক্ষ্যে শিবাজী মারাঠায় যে সন্ত্রাস শুরু করেছিল, রবীন্দ্রনাথ তো সেটিই চাইতেন বাংলার বুকে। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে শুরু হওয়া হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার মূল দায়ভার যে রবীন্দ্রনাথ ও বংকীম চন্দ্রের ন্যায় সাহিত্যিকদের –সেটি কি অস্বীকারের উপায় আছে? সাহিত্যকে তারা ব্যবহার করেছেন হিন্দুদের মনে ঘৃণার আগুন জ্বালাতে। মুসলিম বিরোধী যে সন্ত্রাস ও দাঙ্গা বাংলার বুকে শুরু হয়েছিল সেটিই ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। শিবসেনা নেতা বাল ঠ্যাকারে বা বিজিপি নেতা নরেন্দ্র মোদিদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমেরা তো এজন্যই এতো প্রিয়। এরাই হলো ভারতীয় উগ্র হিন্দুদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গুরু। এবং তার স্বীকৃতি মেলে বঙ্কিমের “বন্দেমাতরম” গান এবং রবীন্দ্রনাথের “জনগণমন -অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা” গানকে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রূপে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। ফলে মুসলিম নির্মূলের লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে ভারতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি রূপে প্রতিষ্ঠা পাবে -তা নিয়েও কি তাই সন্দেহ থাকে? সংস্কৃতি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তো সাহিত্যের। বাংলাদেশের বুকে এমন রবীন্দ্র চেতনার চাষাবাদ বিপুল ভাবে বাড়াতে নরেন্দ্র মোদির সরকার সিরাজগঞ্জে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে অর্থ জোগাবে –তাতে আর বিস্ময়ের কি আছে? এটি তো সামান্য বিনিয়োগ, কিন্তু লাভটি তো বিশাল। এটি তো ১৭ কোটি বাংলাদেশী মানুষের চেতনার মানচিত্র জয়ের।

রবীন্দ্র নাথ আজ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রূপে তার গান গাওয়া দেখে বা তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দেখে তিনি নিজেই যে বিস্ময়ে বিশাল অট্টহাসি দিতেন -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? বাঙালি মুসলিমের আত্মপচন যে সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে সেটি দেখেও হয়তো তিনি প্রচুর পুলক পেতেন! কারণ ইসলামের শত্রুগণও কি মুসলিমদের এতো পচন অতীতে কখনো দেখেছে? বিগত ১৪ শত বছরের অধিক কালের মুসলিম ইতিহাসে কোন মুসলিম জনগোষ্ঠি কি কোন পৌত্তলিকের গানকে মনের মাধুরী মিষিয়ে এভাবে গেয়েছে? পৌত্তলিকদের ন্যায় তারা কি কখনো মঙ্গলপ্রদীপ হাতে মিছিলে নেমেছে? মুর্তি ও স্তম্ভ গড়ে কি তার পদতলে ফুল দিয়েছে? রবীন্দ্রনাথ ও তার অনুসারীদের এখানেই বিশাল সফলতা। এসবই একাত্তরের অর্জন।

অজ্ঞান মানুষের মুখে বিষ ঢালা সহজ। আর বিষঢালার সে কাজটি করছে ভারতীয় আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে পালিত বিপুল সংখ্যক বাঙালি চাকর-বাকরেরা। বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রশাসন ও মিডিয়া জগতে এসব চাকর-বাকরেরাই তো বিজয়ী শক্তি। বাঙালি মুসলিমের অজ্ঞানতার কারণ ইসলামী চেতনাশূণ্যতা –যা জন্ম নিয়েছে কুর’আনী জ্ঞানের অভাবে। এমন অবচেতন চেতনার কারণে বাঙালি মুসলিমের চেতনায় বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে বিষকে বিষ, কাফির কে কাফির  এবং শত্রুকে শত্রু রূপে সনাক্ত করার সামর্থ্যটি। ফলে পৌত্তলিক চেতনাসিক্ত রবীন্দ্রসাহিত্যে অবগাহন বা তার “শিবাজী-উৎসব’ কবিতা ও “আমার সোনার বাংলা” গানটি রবীন্দ্রভক্ত উগ্র হিন্দুগণ এখন আর একাকী গায় না, তাদের সাথে গাইছে বাঙালি মুসলিমগণও। পুরাপুরি হিন্দু না বানাতে না পারলেও ইসলাম থেকে এরূপ দূরে সরানোর আনন্দ কি শত্রু মহলে কম? বাংলাদেশের মত একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মুসল্লি হত্যায়, আলেমদের জেলে তুলতে, ইসলামী দলের নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলাতে এবং মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা রুখতে তাই কোন অমুসলিমকে অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নামতে হচ্ছে না। তাদের অনুগত সেপাহীগণ সেটি নিজেরাই সফল ভাবে করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, মিডিয়া, বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতিতে তাদের বিশাল বিনিয়োগ তাই ব্যর্থ হয়নি। বরং বিশাল বিজয় দিয়েছে। ইসলামের শত্রুদের ঘরে ঘরে এজন্যই তো বিরামহীন বিজয় উৎসব। ১ম সংস্করণ ৩১/০৫/২০১৫; ২য় সংস্করণ ০৬/১২/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *