বাঙালি মুসলিমের বিপন্ন মুসলিমত্ব ও স্বাধীনতা

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

ইসলাম থেকে দূরে সরানো এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংসের যে কাজগুলি ব্রিটিশ শাসকদের হাতে শুরু হয়েছিল, আজও ইসলামের বিরুদ্ধে সেই একই রূপ নাশকতার কান্ডগুলি ঘটে চলেছে বাংলাদেশের ন্যায় সেক্যুলারিস্ট শাসিত দেশগুলোতে। এখন সেগুলি সংঘটিত হচ্ছে পাশ্চাত্য শক্তির ও পাশ্চাত্যের মতবাদগুলির দেশীয় অনুসারীদের উদ্যোগে। এসব মুসলিম দেশে ইসলামে অঙ্গীকারহীন পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামদের সংখ্যাটি বিশাল। মুসলিম দেশগুলোর শাসন ক্ষমতা মূলত তাদেরই হাতে। তাছাড়া ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন বিলুপ্ত হলেও তাদের গড়া ইসলামবিরোধী সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানগুলি বিলুপ্ত হয়নি। ফলে টিকে আছে তাদের গড়া পতিতালয়, ক্লাব, ক্যাসিনো ও নাচের আড্ডা, মদের কারখানা, সেক্যুলার শিক্ষানীতি, কুফুরি আইন-আদালত, সেক্যুলার সেনাবাহিনী এবং অপরাধ-প্রবন প্রশাসনিক অবকাঠামো। ড্রেনে দূষিত পানি জমলে যেমন মশার আবাদ বাড়ে, তেমনি পাপের প্রতিষ্ঠান বেঁচে থাকলে পাপীদের উৎপাদনও বাড়তে থাকে। তাছাড়া পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামদের হাতে এ পাপের প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন আরো বিশালত্ব ও আধুনিকতা পাচেছ। এ আধুনিকতাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলির পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক সহযোগিতার নামে অবিরাম আর্থিক, কারিগরি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাহায্যও পাঠানো হচ্ছে। নিজ দেশ ডেকে নিয়ে এসব সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও দেয়। ফলে তারা ফিরে আসে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক কনভার্ট হয়ে। এরাই উৎসবভরে শাপলা চত্বরের ন্যায় দেশের ইসলামপ্রেমী জনগণের উপর গণহত্যা চালায়। খুশি ভরে ফাঁসীতেও চড়ায়।

জনগণের কর্ম, ধর্মকর্ম, চরিত্র, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির নিয়ন্ত্রণে দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনের প্রভাবটি চুড়ান্ত। জনমনে ন্যায়-অন্যায়, হারাম-হালাল, বৈধ-অবৈধের ধারণাটি আইনই নির্ধারণ করে দেয়। এমন কি সেটি প্রভাব ফেলে ধর্মপালনেও। জিহাদের ন্যায় ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতটি ব্রিটিশ শাসনামলের শুরু থেকেই নিষিদ্ধ কর্মে পরিণত করা হয়। ভারতের মুসলিম জীবনে বিপর্যয় তখন থেকেই শুরু হয় যখন বৃটিশ কাফিরগণ আদালত থেকে শরিয়তের আইনকে সরিয়ে নিজেদের কুফরি আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়। তখন জ্বিনাও আইনসিদ্ধ ঘোষিত হয়। এবং সে জ্বিনাকে দেশব্যাপী ব্যবসা রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়। সরকার দায়িত্ব নেয় জনগণের রাজস্বের অর্থে সে পাপের পাপীদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়ার। কারণ এ পাপের পাপী সরকারি কর্মকর্তাগণও।

ব্রিটিশ কাফিরদের শাসনামলে পবিত্র কুর’আনের শিক্ষা ও আহকামকে বন্দী করা হয় কিতাবে এবং মসজিদ-মাদ্রাসার দেয়াল-ঘেরা আঙ্গিনায়। মুসলিমদের জন্য তখন থেকেই সরকারী ভাবে অসম্ভব করা হয় পূর্ণ ইসলাম পালন। তখন সরকারি উদ্যোগে শুরু হয় ইসলাম থেকে দ্রুত দূরে সরানোর কাজ। সরকারি স্কুলে নিষিদ্ধ করা হয় ইসলামের উপর পাঠ। মাদ্রাসার ওয়াকফ জমি কেড়ে নিয়ে হিন্দু জমিদারদের দেয়া হয়। তখন চরম সংকটে পরে মুসলিমের শিক্ষা ও মুসলিমত্ব। মুসলিম সন্তানেরা তখন বাঁচতে শুরু করে অতি অপূর্ণাঙ্গ মুসলিম রূপে। পুর্ণাঙ্গ মুসলিম হওয়াই তখন শাস্তিযোগ্য আপরাধ পরিণত হয়। কারণ পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো কাফের শাসনের নির্মূলে জিহাদী হওয়া। ফলে শুরু হয় তাদের হত্যা করা বা দীর্ঘকালের জন্য জেলবন্দী করা।  বাংলাদেশের ন্যায় দেশগুলিতে আজও সে ব্রিটিশ কাফির শাসকদের অনৃসৃত রীতি অব্যাহত রয়েছে। পূর্ণ ইসলাম পালনে নামলেই তাকে জঙ্গী, সন্ত্রাসী, মৌলবাদী বলা হয়। কারণ, শাসক পাল্টে গেলেও দেশের রাজনৈতিক এজেন্ডা, শিক্ষা, আইন-আদালত ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি পাল্টায়নি। মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইন আজও ব্রিটিশ আমলের ন্যায় বাংলাদেশের আদালত থেকে বিলুপ্ত। সেখানে বিচার চলে কুফুরি আইন অনুযায়ী। মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহটি ব্রিটিশ কাফিরগণ শুরু করেছিল, সে বিদ্রোহটি আজও বেঁচে আছে বাংলাদেশের সংবিধানে ও আদালতে।

আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইন সরাতে বৃটিশ সরকার কখনোই দেশবাসীর রায় নেইনি। তাদের প্রতিষ্ঠিত পেনাল কোড, বিচার-পদ্ধতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সূদীব্যাংক, পতিতাপল্লী, ক্যাসিনা, মদ্যশালার ন্যায় কোন আবর্জনাই নির্বাচনের মাধ্যমে চাপানো হয়নি। সেগুলি তারা চাপিয়েছে নিজেদের স্বৈরাচারী খায়েশ অনুযায়ী। ফলে এসব আবর্জনা সরাতেই বা নির্বাচন লাগবে কেন? জাতীয় জীবন থেকে আগাছা ও আবর্জনা সরানোর দায়িত্ব তো প্রতিটি নাগরিকের। নামাজ-রোজার ন্যায় এমন অপরাধ নির্মূলের জিহাদও প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ। সে ফরজ পালন না করাটিই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা। এ জিহাদী দায়িত্ববোধের প্রেরণাতেই প্রতিটি জনপদে শুরু হতে পারে এসব আবর্জনা নির্মূলের জিহাদ। এ জিহাদের সুস্পষ্ট মিশন হতে হবে পাপের সকল প্রতিষ্ঠানের নির্মূল। সে সাথে বিলুপ্ত করতে হবে শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিক সকল আইন। ইসলামের শত্রুদের দমনে প্রণয়ন করতে হবে কঠোর ব্লাসফেমি আইন। করতে হবে শিক্ষার বিশুদ্ধকরণ। চালু করতে হবে কুর’আন-হাদীস শিক্ষা। সে সাথে বেঁধে দিতে হবে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠার শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা।

পাপাচারের প্রতিষ্ঠানগুলো যতকাল বেঁচে থাকবে, ততকালই বাড়তে থাকবে পাপীর সংখ্যা। কোভিডের ভাইরোসের ন্যায় পাপের ভাইরাসও অতি দ্রুত ছড়ায়। ৬০ বছর পূর্বে বাংলাদেশে যত চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত, ব্যাংকডাকাত, ঘুষখোর, সূদখোর, মদখোর, অর্থপাচারী, ব্যভিচারী ও দেহব্যবসায়ী ছিল –সে তুলনায় তাদের সংখ্যা এখন বহুগুণ। এ পাপাচারীরাই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের পর্যায়ে। কারণ, পাপের প্রতিষ্ঠানের নির্মূলে এ যাবত কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। বরং নানা ভাবে প্রতিপালন দেয়া হয়েছে এবং নানারূপ দুর্বৃত্তিতে সরকারি প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী সরাসরি জড়িত হয়েছে। ফলে পাপকর্ম বেড়েছে কোন রূপ বাধা-বিঘ্নতা ছাড়াই। প্রচুর বিলম্ব হয়েছে, আরো বিলম্ব হলে শুধু ইসলাম ও মুসলিমদেরই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকেও বিপন্ন করবে। কারণ বাংলাদেশ ভারত ভেঙ্গে স্বাধীন ভূ-রাজনৈতিক পরিচয় পেয়েছে তার জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির জন্য নয়, বরং জনগণের মুসলিমত্বের কারণে। ফলে দেশবাসীর মুসলিমত্ব বিনষ্ট হলে বাংলাদেশ তার স্বাধীন অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তাই হারিয়ে ফেলবে। সেটি যেমন ইসলামের দেশী শত্রুগণ বুঝে, তেমনি বিদেশী হিন্দুত্ববাদী শত্রুগণও বুঝে। তাই তারা কোয়ালিশন গড়ে এবং সর্বশক্তি দিয়ে জনগণের মুসলিমত্বের বিনাশে লেগেছে।

তাছাড়া শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়ও নয়। ইচ্ছাটি এখানে মহান আল্লাহতায়ালার –যার ঘোষণা দেয়া হয়েছে পবিত্র কুর’আনে। বান্দার কাজ হলো, মহান প্রভুর সে ইচ্ছার বাস্তবায়নে সর্বশক্তি দিয়ে ময়দানে নামা। যারা তাঁর খাতায় নিজের নামকে মুসলিম রূপে লেখাতে চায়, তাদের সামনে শরিয়তের প্রতিষ্ঠার জিহাদে নামা ছাড়া ভিন্ন পথ নাই। নইলে পরিচিতি মিলবে কাফির, জালিম ও ফাসিক  রূপে। সে হুশিয়ারীটি জানিয়ে দেয়া হয়েছে সুরা মায়েদার ৪৪,৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে। কোন মুসলিম কি এরূপ পরিচয়ের কথা ভাবতে পারে? এ পরিচয় নিয়ে কি কারো জান্নাতে স্থান মিলবে? এরূপ পরিচিত তো জাহান্নামবাসীর।

যে দেশের শতকরা ৯১ ভাগ জনগণ মুসলিম হওয়ার দাবীদার, সে দেশে শরিয়ত আজও কেন প্রতিষ্ঠিত নয় -সে হিসাব কি মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে দিতে হবে না? বাংলাদেশের একটি থানার জনসংখ্যার চেয়ে কম সংখ্যক মুসলিম নিয়ে নবী পাক (সা:) ইসলামে বিজয় এনেছিলেন। অথচ তখন আরববাসীর শতকরা ১০ ভাগ মানুষও মুসলিম ছিল না। অথচ বাংলাদেশে মুসলিম জনসংখ্যা ১৬ কোটি এবং মোট জনসংখ্যার তারা শতকরা ৯১ ভাগ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামকে বিজয়ী করার ক্ষেত্রে তারা চরম ভাবে ব্যর্থ। সে সাথে তাদের দেশের আদালতে চলছে আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সেখানে শরিয়তের কোন স্থান নাই। এটি তো গুরুতর অপরাধ। এরূপ ব্যর্থতা ও বিদ্রোহ নিয়ে তারা মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে মুখ দেখাবো কীরূপে?  মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দেওয়ার আগে এ ব্যর্থতার হিসাব কি তারা নিজেরা নিবে না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *