পত্রিকা কেন পড়ি এবং পত্রিকায় কেন লিখি?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

পত্রিকায় প্রকাশ পায় জাতীয় পরিচয়

পত্রিকায় লেখা এবং পত্রিকার পাঠকদের দেখে একটি জাতির চেতনা, চরিত্র ও সভ্যতার মান নিয়ে একটি নির্ভুল ধারণা পাওয়া যায়। এরূপ বিচারে জটিল হিসাব নিকাশের প্রয়োজন পড়েনা। যেমন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের পরিচয় মেলে সে কি খায় বা পান করে -তা দেখে। ভেজাল খাদ্যে ও খাদ্যের আকালে আর যাই হোক সুস্বাস্থ্য আশা করা যায় না। অখাদ্য, কুখাদ্য ও দুঃর্ভিক্ষ কখনোই স্বাস্থ্য আনে না, বরং আনে রোগব্যাধি ও মহামারি। আর একটি দেশের মানুষ কি খায়, কি পান করে, কিসে তাদের রুচি -সে পরিচয় মেলে দোকানে পণ্যের আয়োজন দেখে। বিষয়টি তেমন পত্রিকার বেলায়ও। মানব মনের পুষ্টি বা অপুষ্টির সন্ধান দেয় পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো। যারা দেশ চালায় এবং দেশবাসীর চিন্তা-চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে তারা তো হাজির হয় পত্রিকার পাতায়। চেতনার সমৃদ্ধিতে পত্রিকা যেমন জ্ঞানের বাণী ছড়াতে পারে, তেমনি চেতনাকে বিষাক্ত করার কাজে ছড়াতে পারে দুষিত চিন্তার ভয়ানক বিষও।

পত্রিকার মাধ্যমেই জনগণের চেতনা ও চরিত্র কথা বলে। বস্তুত জাতির চেতনা, চরিত্র ও কর্মের প্রতিচ্ছবি নিয়েই হলো পত্র-পত্রিকা। ফলে যে জাতি চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, হাইজ্যাক, মাস্তানি, দুর্নীতি এবং আন্তর্জাতিক ভিক্ষাবৃত্তির মধ্য দিয়ে সংবাদ গড়ে -সে জাতির পরিচয় পেতে বিশ্বের অন্য গোলার্ধে বসেও অসুবিধা হয় না। পত্রিকার পৃষ্টায় শুধু সরকারের নয়, জনগণের প্রায়োরিটিও ধরা পড়ে। খবরের পাশা-পাশি খবরের প্রেক্ষাপট ও তার নায়কদেরও জানা যায়। শুধু র্কম নয়, কর্মের পিছনে যে ভাবনা কাজ করে -পত্রিকা সেটিকেও প্রকাশ করে। পত্রিকার পৃষ্টাগুলো হলো চিন্তা-ভাবনার জায়গা। এক সময় এ কাজ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে সীমিত ছিল, পত্রিকার বদৌলতে তা এখন জনসম্মুখে। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান এখন আর শুধু এ্যাকাডেমিক বিষয় নয়, সেটি এখন জনগণের বিষয়। পত্রিকার পৃষ্টাতে দেশের চিন্তাশীল মানুষেরা কথা বলে। তারা তুলে ধরে কিসে দেশের কল্যাণ ও অকল্যাণ -সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। বিচার-বিশ্লেষণ পেশ করে সরকারি ও বেসরকারী কর্মসুচীর। সাবধান করে চলতি ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে এবং সামনে কি ধরনের বিপদ ঘটতে পারে -সেগুলি নিয়ে। কিসে মঙ্গল এবং কিসে অমঙ্গল –সে কথাগুলোও তুলে ধরে। জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কাদের কি ভাবনা, কাদের কি কর্মসুচি -সেটির সাথে এভাবেই পরিচয় ঘটে। সভ্য ও চিন্তাশীল মানুষের জন্য পত্রিকা পাঠ এজন্যই গুরুত্বপুর্ণ। শেখা ও শেখোনার কাজে স্কুল-কলেজের যে ভূমিকা, পত্রিকার ভূমিকা তা থেকে কম নয়। পত্রিকায় যারা লেখে তারা যেমন আমৃত্যু শিক্ষক, তেমনি যারা পত্রিকা পড়ে তারা হলো আমৃত্যু ছাত্র। 

 

পত্রিকার নাশকতা

পত্রিকার কল্যাণ যেমন বিশাল, তেমনি নাশকতার ক্ষমতাও কম নয়। সমাজের কল্যাণ নিয়ে সবাই ভাবে না, সবার কাছে সেটি প্রায়োরিটিও নয়। অনেকেই ভাবে শুধু তার নিজের স্বার্থ নিয়ে। হেরোইন ব্যবসায়ীর ন্যায় নেশাগ্রস্ত করার লোকও সমাজে প্রচুর। মানুষ বেশী বেশী নেশাগ্রস্ত হলে তাদের লাভ; তাতে তাদের খরিদদার বাড়ে। সুযোগ সন্ধানীরা জাতিকে যেমন বিভ্রান্ত করে, তেমনি সুযোগ পেলে যুদ্ধের দিকেও ধাবিত করে। কারণ যুদ্ধ বাড়লে তাদের  ব্যবসাও বাড়ে। বিপদের কারণ হলো, পত্রিকাগুলো এরূপ দুর্বৃত্তদের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। তখন বিপদটি আরো ভয়ানক। পানির পাইপ লাইনের ন্যায় কুচিন্তার বিষা্ক্ত ভাইরাসগুলোকে পত্র-পত্রিকা তখন জনগণের মগজে পৌঁছে দেয়। পত্রিকা তখন দুর্বৃত্তায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ, ধর্মবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষের ন্যায় বিষাক্ত বিশ্বাসগুলো তো এভাবেই বাজারে খরিদার পায়। তাছাড়া কোন দেশেই এমন দুর্বৃত্ত  মানুষের অভাব নাই যাদের আগ্রহ যুদ্ধ, রক্তাত্ব সংঘাত, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ ও লুটপাট নিয়ে। কারণ সেগুলো তাদের সম্ভোগ ও উল্লাস বাড়ায়। বাংলাদেশে নৃশংস দুর্বৃত্তদের তেমন একটি উল্লাস দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। একাত্তরের যুদ্ধে এসব দুর্বৃত্তগণ পেয়েছিল বহু লক্ষ অবাঙালীর ঘরবাড়ী ও ব্যবসা-বানিজ্যের উপর দখলদারি প্রতিষ্ঠার সুযোগ। তারা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। তারা সুযোগ পেয়েছিল অবাঙালী মহিলাদের উপর অবাধ ধর্ষণের। এদের কারণে ঢাকার মহম্মদপুর, মীরপুরের ন্যায় দেশে সকল বিহারী বসতিগুলো পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্তদের অভয়পুরিতে। বাংলাদেশের বুকে এগুলি ভয়ংকর পাপীদের বসতি।

মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বড় প্রাণনাশের ঘটনাগুলো হিংস্র জীবজন্তু বা জীবাণূর কারণে হয়নি। সেগুলো হয়েছে বিষাক্ত চিন্তা-চেতনার নাশকতায়। বলা হয় দুটি বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের প্রাণনাশ হয়। বহু লক্ষ ঘরবাড়ী এবং বহু হাজার নগরবন্দর মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। সে নাশকতার কারণ, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদের ভয়ানক ধারণাগুলো। এবং সে প্রাণনাশী ধারণাগুলোকে প্রচার দিয়েছিল পত্র-পত্রিকা। পত্রিকার কারণেই সে নৃশংস নাশকতার সাথে জনগণের সংশ্লিষ্টতা বেড়েছিল। পত্রিকাগুলো যথার্থ ভূমিকা নিলে এমন একটি বিশাল গণহত্যা থেকে বিশ্ববাসীকে বাঁচানো যেত।

রোগের মহামারি থেকে জনগণকে বাঁচাতে হলে জনগণের মনে সে রোগ সন্মদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হয়। তেমনি প্রাণনাশী ধ্যানধারণার বিরুদ্ধেও সচেতন সৃষ্টি করতে হয়। পবিত্র কোর’আনে তাই দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে শয়তানের পরিচয়টি তুলে ধরতে। দুর্বৃত্ত শক্তির লক্ষ্য, অভিসন্ধি ও কর্মসুচীর বিচার-বিশ্লেষণ এবং সেগুলো মানুষের তূলে ধরা তাই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। সে সূন্নত পালিত না হলে বিপন্ন হয় মানবতা। নেমে আসে গণহত্য। এবং সে বিশ্লেষণ হতে হয় এসব দুর্বৃত্ত শক্তির পক্ষ থেকে যুদ্ধে শুরু হওয়ার পুর্বেই। সে কাজটি যথার্থ ভাবে করতে পারে পত্রিকা। কম্যুনিজম যে ব্যর্থ মতবাদ, সেটি আজ প্রমাণিত। অথচ এ সিদ্ধান্তে পৌঁছবার পুর্বেই মানবজাতির অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। রাশিয়া ও চীনসহ বিশ্বের বহু দেশে বহু লক্ষ মানুষের তাতে প্রাণনাশ হয়েছে। একমাত্র কম্বোডিয়াতেই সে দেশের সিকি ভাগ মানুষ কম্যুনিস্টদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এদের হাতে আফগানিস্তানে নিহতদের সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ। রাশিয়ার কম্যুনিষ্ট বিপ্লবে যত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে বহুদেশের জনসংখ্যাও তত নয়। এ বিশাল ক্ষয়ক্ষতির কারণ, যথার্থ পর্যালোচনার পুর্বেই মতবাদটির পক্ষে যুদ্ধ করা হয়েছে।

 

পত্রিকার সামর্থ্য

ঔষধ বিষের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। তাই মানব দেহে প্রয়োগের পুর্বে অন্য জীবের দেহে ঔষধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল ছাপা হয় জার্নাল ও পত্র-পত্রিকায়। যে কোন দেশে এটিই সভ্য রীতি। সেরূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয় উন্নয়নের বিভিন্ন মডেল ও মতবাদের ক্ষেত্রেও। অথচ কার্ল মার্কস মানবজাতির রোগ নিরাময়ে যে কম্যুনিজম আবিস্কার করলেন -তা সরাসরি প্রয়োগ করা হলো রাশিয়া ও চীনের বহু কোটি মানুষের উপর। সংশ্লিষ্ট দেশের পত্র-পত্রিকা এনিয়ে জনগণকে পর্যাপ্ত জ্ঞান দান করেনি। বিপদ কি হতে পারে –সেটিও বলেনি। বরং উস্কানী দিয়েছে দলীয় লিফলেটের ন্যায়। অথচ সবচেয়ে পুঁজিবাদী ও সর্বাধিক শ্রমিক-অধ্যুষিত দেশ হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেন কম্যুনিজমের সে প্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ফলে প্রাণে বেঁচে যায় ব্রিটেনের লক্ষ লক্ষ মানুষ। এবং সেটি সম্ভব হয়েছিল দেশটির  দায়িত্বশীল পত্র-পত্রিকার কারণে। পত্রিকা সেদিন সংযোগ গড়েছিল জনগণের সাথে দেশটির প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের। জনগণের সামনে কম্যুনিজমের বিপদকে সেদিন পত্রিকার কলামিস্টগণ সফল ভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। ফলে জনগণ পেয়েছিল গভীর চিন্তাভাবনা ও বিচার বিশ্লেষণের সুযোগ। এতে জনগণ নিতে পেরেছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। 

পত্রিকার কাজ শুধু খবর ছাপা নয়, বরং খবরের কারণগুলোও অনুসন্ধান করা। নানা পথ ও মতের কথাও সঠিক ভাবে তুলে ধরা। মানবতাধ্বংসী মতবাদগুলোর নাশকতাও জনসম্মুখে প্রকাশ করা। প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে সবচেয়ে বড় আদালতটি হলো জনগণের। এ আদালতে রায় দেয় খোদ জনগণ। সে আদালতের এজলাসে উঠে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, সামরিক, প্রশাসনিক ইত্যাদি নানা বিষয়ে নানা সমস্যা ও সঙ্কটের কথা। সে সাথে উঠে নানারূপ সমাধানের কথাও। আলোচিত হয় উন্নয়নের নানারূপ মডেল ও মতবাদ। এ আদালতে উকিল হলো পত্রিকার কলামিস্টগণ। দেশের কল্যাণ তো তখনই হয় যখন এ আদালত সঠিক ভাবে কাজ করে। সেজন্য জরুরি হলো, পত্রিকার পৃষ্ঠায় সমস্যা ও সঙ্কটের কথাগুলো যেমন অতি বিষদ ভাবে তূলে ধরা হবে, তেমনি তুলে ধরা হবে নানারূপ সমাধানের কথাও। এখানে জালিয়াতি বা ফাঁকি হলে জনগণ ব্যর্থ হয় সঠিক রায় দিতে। পত্রিকার কলামিস্টদেরকে তাই কোর্ট-কাচারির উকিলদের চেয়ে অধিক যোগ্যবান, অধিক জ্ঞানী ও অধিক নিরপেক্ষ হতে হায়। কারণ, এ আদালতে দায়িত্বপালনে তারা ব্যর্থ হলে সমগ্র জাতি ব্যর্থ হয়। তখন বিজয়ী হয় অপরাধীরা। বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে সবচেয়ে ব্যর্থ খাতটি হলো জনগণের এ আদালত। কারণ, এ আদালতের উকিলগণ তাদের বক্তব্য পেশ করে নিজ নিজ দলের আজ্ঞাবহ ক্যাডার রূপে, নিরপেক্ষ ও সৎ উকিল হিসাবে নয়। পত্রিকার পাতায় জ্ঞানদানের সে কাজটি হয় না। বরং বেশী বেশী হয় জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজ।  ফলে জনগণ দারুন ভাবে ব্যর্থ হয় সঠিক রায় দিতে। ফলে দুর্বৃত্তগণ যেমন ভোট পায়, তেমনি গণতন্ত্র হত্যাকারি ফ্যাসিস্ট দুর্বৃত্তও দেশের বন্ধু ও জাতির পিতার খেতাব পায়। এবং ভোটচোরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা পায়।

পত্র-পত্রিকা যেমন দুষ্ট চিন্তার বিপদ থেকে বাঁচায়, তেমনি বাঁচায় দুর্বৃত্তদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ও দূর্নীতি থেকেও। এর জন্যই দেশে খাদ্য সংকট শুরু হওয়ার সাথে সাথে দায়িত্বশীল পত্র-পত্রিকায় খাদ্য সংকটের কারণগুলোও প্রকাশিত হয়। তখন সে দুর্ভিক্ষের প্রতিরোধে সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়াও শুরু হয়। তেমনি পত্রিকার কারণে দূর্নীতির নায়কদের দুর্বৃত্তিও জনগণের সামনে গোপন থাকে না। দেশের পুলিশ বিভাগ যেসব দুর্নীতির গোপন বিষয়গুরো জনগণের সামনে তুলে ধরতে  ব্যর্থ হয়, সেগুলো প্রকাশ করে পত্রিকা। পত্র-পত্রিকা এভাবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই দেশে যতই বাড়ে পত্রিকার মান, ততই কমে দুর্ভিক্ষ ও দুর্নীতির তান্ডব। কিন্তু যে দেশের পত্র-পত্রিকার মালিকানা দুর্বৃত্তদের হাতে, সেদেশে পত্র-পত্রিকা দুর্বৃত্তির অংশীদারে পরিণত হয়।   

 

জ্ঞানদানে পত্রিকা

জ্ঞানদান, চিন্তার লেনদেন ও সমাজ উন্নয়নে পত্র-পত্রিকা হলো অতি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। স্বাধীন পত্রিকা ছাড়া গণতন্ত্র চলে না। জনগণকে শিক্ষিত করার কাজটিও তখন যথার্থ ভাবে হয় না। পত্রিকা শুধু জনগণকেই নয়, নেতাদেরও আলোকিত করে। গণতান্ত্রিক দেশে নেতারা পত্রিকা থেকে যেমন এজেন্ডা খুঁজে পায়, তেমনি নির্দেশনাও পায়। জ্ঞানের এ বাহন বিজ্ঞান, দর্শন ও প্রজ্ঞার বাণীকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। স্কুল-কলেজের জ্ঞানলাভ সার্টিফিকেট লাভে শেষ হয়, কিন্তু পত্রিকার জ্ঞানদান চলে আমৃত্যু। পত্রিকায় থাকে জ্ঞানের বহুমুখীতা। জ্ঞানদানকে বিশেষ একটি শাখায় কেন্দ্রীভূত না করে পাঠককে হাজির করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সে সবের প্রত্যন্ত গভীরে। স্কুল-কলেজে না গিয়ে শুধু পত্রিকা পড়ে একজন ব্যক্তি সুশিক্ষিত হতে পারে। পত্রিকা ছাড়া সামরিক বিজয় সম্ভব; হালাকু, চেঙ্গিজের বিজয় পত্রিকা ছাড়াই হয়েছে। কিন্তু তাতে যা গড়ে উঠেনি তা হলো চেতনা সমৃদ্ধ একটি সভ্য জাতি। বাড়েনি সুস্থ্য চেতনা, বাড়েনি রাষ্ট্রের পরিচালনায় জনগণের সংশ্লিষ্টতা। প্রতিষ্ঠা পায়নি সরকারের স্বচ্ছতা বা জবাবদিহীতা। এগুলো হলো শক্তিশালী মিডিয়ার দান। পত্রিকা ছাড়া শিক্ষিত ও সচেতন জাতি গড়া অসম্ভব। স্বাক্ষরতা বাড়লেও বহু দেশে সভ্য ও সুশীল সমাজ গড়ে উঠেনি স্বাধীন পত্রিকার অভাবে। শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন রেকর্ড গড়েছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে গণতান্ত্রিক সমাজের জন্ম দিতে। জনগণের আয় বাড়ালেও কেড়ে নিয়েছে স্বাধীনতা। জনগণকে বাঁচতে হয় মৌলিক অধিকার ছাড়াই। চিড়িয়াখানায় হিংস্র পশুকে যেমন খাঁচায় রাখা হয়, সেরূপ চীন পরিণত হয়েছে বন্দী মানুষের বিশাল চিড়িয়াখানায়। দেশটিতে গুরুত্ব পেয়েছে জনগণের উপর শাসকশক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। নিয়ন্ত্রণকে তীব্রতর করতে ১০ লাখ উইঘুর মুসলিমদের নিজ ঘর থেকে উঠিয়ে কনস্রেটশন ক্যাম্পে তুলেছে। পত্র-পত্রিকা যেহেতু স্বাধীন চেতনার পরিচর্যা দেয়, সে গুলোকে চীনে গড়েই উঠতে দেয়া হয়নি। পত্রিকার নামে যা গড়ে উঠেছে তা হলো দলীয় প্রচারপত্র তথা লিফলেট। এগুলোর কাজ হয়েছে, প্রোপান্ডায় আড়ষ্ট করে বিবেকের মৃত্যু ঘটানো। ধনি হলেও চীনারা তাই সভ্য হতে পারিনি।  

 

 

সূন্নত নবীজী(সা:)র

বাংলাতে যেটি পত্রিকা, আরবীতে তাকেই বলা হয় রেসালাহ। রেসালাহ, রাসুল ও মুরাসালাহ একই শব্দ থেকে উদ্ভুদ। রাসুলগণ বাণী প্রচার করতেন মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। লক্ষ্য ছিল ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি। নবীকরীমের (সা:) সুন্নতকে অনুসরণ করে সে অভিন্ন চেতনাতে বের হয় রেসালাহ। এটি হলো সত্যকে ঘরে ঘরে পৌঁছানোর আধুনিকতম কৌশল। শুধু ইসলামেই নয়, সব দেশে, সব ধর্মে ও সব মতাদর্শের প্রচারকগণই আদর্শ প্রচারে পত্রিকাকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তাছাড়া মানুষের সত্ত্বাটি শুধু দৈহিক নয়, আত্মিকও। দৈহিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিয়মিত পানাহার অপরিহার্য। কিন্তু দেহের সুস্থ্যতা সার্বিক সুস্থ্যতা দেয় না। নৈতিক দিক দিয়ে সে ব্যক্তি চরম অসুস্থ্যও হতে পারে। এমন কি হিংস্র পশুর চেয়েও হিংস্রতর হতে পারে। পশু গণহত্যা করে না, ধর্ষণও করে না। জনবসতিকে নিশ্চিহ্নও করে না। কিন্তু মানুষ এসবই করে। এবং করে দৈহিক অসুস্থ্যতার কারণে নয়, বরং নৈতিক অসুস্থ্যতার কারণে। বাংলাদেশে শিশুরা ধর্ষিতা হচ্ছে, পুলিশ নারীদের বস্ত্রহরণ ও ধর্ষণ করছে, সন্ত্রাসীরা মানুষ খুন করছে এবং অফিস-আদালতে ঘুষের নামে মানুষের পকেট লুন্ঠন হচ্ছে। ভোটডাকাতি নেমেছ সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। এসব তারাই করছে যারা শারীরিক ভাবে সুস্থ্য। কিন্তু দারুন ভাবে রুগ্ন আত্মার পুষ্টিতে।

দেহের অপুষ্টিতে কোন দেশ বিপর্যয়ে পড়ে না। এ জন্য কেউ জাহান্নামেও যাবে না। অথচ আত্মার অপুষ্টিতে দেশে চুরুডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের প্লাবন আসে। তখন মানুষ চলে পাপের পথে তথা জাহান্নামের পথে। আত্মার পুষ্টি জোগায় শিক্ষা। আর শিক্ষার সবচেয়ে বিশাল ও শক্তিশালী মাধ্যম হলো মিডিয়া। তাই যে দেশে মিডিয়া শক্তিশালী ও দায়িত্ববান -সে দেশের মানুষ পায় জ্ঞানসমৃদ্ধ সুস্থ্য বিবেক। আর বিবেক পুষ্টি পেলে তখন বৃদ্ধি পায় দুর্বৃত্তকে ঘৃণা সামর্থ্য। কিন্তু যে দেশে স্বৈরাচারি দুর্বৃত্তগণ মাননীয় বলে আখ্যায়ীত হয় এবং গণতন্ত্রহত্যাকারি পায় জাতির পিতার সন্মান, বুঝতে হবে সে দেশে বিবেকে পুষ্টি বৃদ্ধির কাজটি আদৌ হয়নি। বরং ব্যাপক ভাবে হয়েছে বিবেক হত্যার কাজ। এমন দেশে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা থাকলেও সেগুলোর কাজ হয় দুর্বৃত্তি ও মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। আজকের বাংলাদেশ তো তারই উদাহরণ।

 

পত্রিকাপাঠ কেন অপরিহার্য?

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা সীমিত, সেখানে থাকে না সকল বয়সের নারী-পুরুষের প্রবেশাধিকার। কিন্তু পত্র-পত্রিকার পাঠক তথা ছাত্র সকল দেশবাসী। ফলে যারা দেশবাসীকে শিক্ষিত করতে চায় তার পত্রিকাকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে। জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যম তো জ্ঞান। এবং ক্ষমতাশূণ্য রাখার হাতিয়ার হলো অজ্ঞতা। তাই যারা জনগণকে অজ্ঞ, বিভ্রান্ত ও ক্ষমতাহীন রাখতে চায়, তারা পত্রিকাকে নিছক প্রচারের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে। কেড়ে নেয়ে স্বাধীনতা এবং গোলামে পরিণত করে পত্রিকার কলামিস্টদের। মানসিক পুষ্টি বৃদ্ধি কল্পে বাংলাদেশের মত দুর্নীতি কবলিত দেশে তেমন কিছুই হয়নি। দেশে ধর্মবাণী যা কিছু শোনানো হয় -তা মসজিদের চার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে সামান্যই বাইরে বের হয়। নদীতে প্লাবন আসলে সে পানিতে খালবিলেও সয়লাব আসে। তেমনি জ্ঞানচর্চায় মসজিদ-মাদ্রাসাতে প্লাবন আসলে চারদিকেও তার প্রভাব পড়তো। দেশজুড়ে অজ্ঞতার জোয়ার দেখে বোঝা যায়, জ্ঞানের প্লাবন মসজিদ-মাদ্রাসাতেও আসেনি।

অনাহারে দেহ বাঁচে না। তেমনি সুচিন্তার অভাবে বাঁচে না বিবেক। বাংলাদেশে বিবেকশূণ্যতার কারণ, সুচিন্তার অভাব। বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেরূপ বিবেকশূণ্যতা থেকে বাঁচাতে পবিত্র কোর’আনে “আফালাতাফাক্কারুন” (অর্থ: তোমরা কেন চিন্তা করোনা), “আফালা’ত্বা’কিলুন” (অর্থ: তোমরা কেন বুদ্ধিকে কাজে লাগাওনা), “আফালাতাদাব্বারুন” (তোমরা কেন গভীর ভাবনায় মনোনিবেশ করোনা) বার বার বলে বস্তুত চিন্তাতেই অভ্যস্ত হতে বলা হয়েছে। মানুষ তখনই চিন্তা করে যখন সে কিছু শুনে, পড়ে বা দেখে। প্রতিদিন পাঠকের সামনে চিন্তার নানারূপ উপকরণ নিয়ে হাজির হয় পত্রিকা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভাবতে পত্রিকা এভাবেই বিবেককে নাড়া দেয়। তাই যে ব্যক্তি যত পত্রিকা পড়ে সে তত চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল হয়। এজন্যই চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল লোকের পত্রিকা ছাড়া চলে না। জনগণের উন্মুক্ত পার্লামেন্ট হলো পত্রিকা। পত্রিকা পাঠ না করার অর্থ সে পার্লামেন্ট থেকেই দূরে থাকা। ফলে যারা দেশ ও জাতিকে নিয়ে ভাবে এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে কিছু করতে আগ্রহী –তারা কি পত্রিকা পাঠ থেকে দূরে থাকতে পারে?

 

যে ব্যর্থতা ইসলামপন্থিদের

পায়ে হেঁটে ঘরে ঘরে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে যাওয়া ছাড়া এক কালে সত্যপ্রচারের অন্য কোন মাধ্যমই ছিল না। সে যুগে রাসুলগণ নিজেরা সে কাজ করেছেন অতিশয় কষ্ট সয়ে সয়ে। অথচ যান্ত্রিক অগ্রগতির বদৌলতে সত্য প্রচারে পত্রিকা আজ অতি শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, শয়তানী শক্তি এ মাধ্যমটিকে যতটা নিখুঁতভাবে ব্যবহার করছে ইসলামের পক্ষের শক্তি তা পারেনি। প্রচারের জোরে আজ অতিশয় অসত্য ও ব্যর্থ মতবাদগুলোও কোটি কোটি মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভূল ও সবচেয়ে সফল জীবন-বিধান হয়েও ইসলাম আজ সর্বত্র পরাজিত। এমনকি ক্রমান্বয়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে মুসলিমদের আপন সন্তানেরা।

কিন্তু এমনটি কেন হচ্ছে? দেশে খাদ্যের মওজুদ থাকলেই সবার বাঁচাটা নিশ্চিত হয় না। প্রত্যেকের মুখে প্রত্যহ খাদ্য পৌঁছানোর একটি সুনিশ্চিত ব্যবস্থা থাকাটি জরুরী। খাদ্য বন্টনে সুষ্ঠ নিয়মনীতি না থাকলে দুর্ভিক্ষই অনিবার্য হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার বহু লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। তবে সেটি খাদ্যের ঘাটতির কমতির কারণে ততটা নয়, যতটা বিলিবন্টনে চরম অব্যবস্থার কারণে। একই কারণে একই সুষ্ঠ ব্যবস্থা অতি অপরিহার্য মনের খাদ্য বন্টনেও। মনের খাদ্যের দুর্ভিক্ষে যে সর্বনাশটি ঘটে সেটি ভয়ানক। এতে ঘটে চেতনার মড়ক। মানুষ তখন বেঁচে থাকে শুধু দেহ নিয়ে, সুস্থ্য বিবেক নিয়ে নয়। ফলে পরিণত হয় বিবেকহীন পশুতে। ইসলামী চেতনা নিয়ে মুসলিমদের বেড়ে না উঠার কারণ মূলত এই মৃত বিবেক।

পবিত্র কোর’আন হলো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব। পবিত্র এ কিতাবের প্রতিটি বাণী মহান আল্লাহতায়ালার। পৃথিবী পৃষ্ঠে জ্ঞানের এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ ভান্ডার। কিন্তু এ বিশাল জ্ঞানভান্ডার থেকে জ্ঞানের সে কথাগুলো বিশ্ববাসীর কাছে দূরে থাক -এমন কি মুসলিমদের কাছেও আমরা পৌঁছাতে পারিনি। শুধু ব্যবসায়ীক স্বার্থকে সামনে রেখে কোকাকোলার মত পণ্যকে উৎপাদকেরা হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গে, প্রশান্তমহাসাগরের দ্বীপে বা সাহারার মরুপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু প্রায় ১৫০ কোটি মুসলিম ইসলামের বাণীকে সেভাবে পৌঁছাতে পারিনি। অথচ এটি ছিল তাদের উপর দ্বীনি দায়িত্ব। খাদ্য না পেলে মানুষ অখাদ্য খাবে -সেটিই স্বাভাবিক। ইসলামের বদলে এজন্যই কোটি কোটি মানুষ রসনা মিটাচ্ছে কম্যুনিজম, সমাজতন্ত্র, নাস্তিক্যবাদ ও অশ্লিল সাহিত্য দিয়ে। রোগাগ্রস্ততায় সুস্বাদু খাদ্যেও রুচি লোপ পায়। তেমনি চেতনার রোগে লোপ পায় জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ। এ রোগের প্রকোপ এখন এতোই তীব্র যে, বিবেককে সুস্থ্যতা দেবে এমন বস্তুতে হাত লাগাতেই এরা ভয় পায়। ফলে জ্ঞানসমৃদ্ধ পত্রিকা বা পুস্তক পাঠের বদলে চটুল সাহিত্য বা হালকা কিছু পড়াই এদের আচারে পরিণত হয়েছে। রোগভোগ ও মৃত্যুর উচ্চহার দেখেই যেমন বোঝা যায়, দেশে চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই। তেমনি ব্যাপক বিবেকহীনতা দেখে বোঝা যায় সচেতনতা সৃষ্টিরও কোন সুব্যবস্থা নেই। শত্রুপক্ষ তাদের চলার গতি রকেট যোগে বাড়ালেও দেশে দেশে ইসলামি পক্ষ চলছে পদব্রজে। বস্তুতঃ পত্রিকার মত আধুনিকতম ও অতি শক্তিশালী মাধ্যমকে তারা সুচারু ভাবে ব্যবহারই করতেই শেখিনি।

পত্রিকার গুরুত্ব আরেকটি কারণে। পত্রিকার মাধ্যমেই দর্শন কথা বলে। এখানে চলে বুদ্ধিবৃত্তির লড়াই। সংলাপ হয় তত্ত্ব ও তথ্যের। এখানে সরব থাকে নানা পক্ষ ও নানা মত। বুদ্ধিবৃত্তির এটি উম্মুক্ত আদালত। প্রতিটি পাঠক এখানে বিচারক। গণতান্ত্রিক দেশে তাদের রায়েই চলে দেশ।  বুদ্ধিবৃত্তির এ আদালতে যাদের পত্রিকা নেই তারা বোবা। ফলে এ আদালতে বোবাদের পরাজয় অনিবার্য। এটি বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। এ লড়াইয়ে ইসলামের পক্ষের শক্তি কি কখনোই নীরব দর্শক হতে পারে? সত্যের পক্ষ নিয়ে ময়দানে নামাই তো ঈমানদারী। এ লড়ায়ে অংশ নেওয়া নিছক ইবাদত নয়, পবিত্রতম জিহাদ। এ কাজে ব্যয়ীত কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে মর্যাদায় কম নয়। শহীদের রক্ত বিজয় আনে রণাঙ্গণে। আর কলমের কালি ইসলামকে বিজয়ী করে লক্ষ লক্ষ মানুষের চেতনার ভূমিতে। পত্রিকা পাঠ এবং পত্রিকায় লেখালেখী এজন্যই এতো গুরুত্বপূর্ণ। যারা মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে ভালবাসে এবং চায় তাঁর দ্বীনকে বিশ্বমাঝে বিজয়ী করতে -তাদের কাছে এ কাজ এজন্যই এতো প্রিয়। ১ম সংস্করণ ০৭/০৯/২০০৩; ২য় সংস্করণ ০৬/০১/২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *