অপরাধী সরকার, জিম্মি জনগণ এবং বিপন্ন সভ্য রাষ্ট্রনির্মাণ প্রকল্প

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

 ঈমানদারের রাজনীতি ও বেঈমানের রাজনীতি

ইসলামে রাজনীতি হলো সর্বোচ্চ ইবাদত। এটি হলো মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও সভ্যতর রাষ্ট্র গড়ার বিরামহীন জিহাদ। এ রাজনীতি হলো ইসলামকে বিজয়ী করার লড়াই। কোটি কোটি মানুষের নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের ফলে ব্যক্তি-জীবনে ইসলামের কিছু খুঁটি প্রতিষ্ঠা পেলেও তাতে রাষ্ট্রের বুকে ইসলামের কাঙ্খিত ইমারতটি নির্মিত হয় না। তাতে ইসলামের চুড়ান্ত বিজয় আসে না। ফলে তাতে প্রতিষ্ঠা পায় না মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভোমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। ফলে প্রতিষ্ঠা পায় না অন্য ধর্মগুলি উপর ইসলামকে বিজয়ী করার মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা –যা পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত হয়েছে “লি’ইউয হিরাহু আলাদ্বীনি কুল্লিহি” এই পবিত্র বয়ানে। তাই মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে হলে রাজনীতি নামা ছাড়া বিকল্প নাই। রাজনীতি নিয়ে বাঁচার অর্থই জিহাদ নিয়ে বাঁচা। এ জিহাদ যেমন নিরস্ত্র বুদ্ধিবৃত্তিক হতে পারে, তেমনি সশস্ত্রও হতে পারে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে উভয় প্রকার জিহাদই ছিল। যে ব্যক্তি রাজনীতিতে নাই, বুঝতে হবে সে ব্যক্তি ইসলামকে বিজয়ী করায় আগ্রহী নয়। আগ্রহী নয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করায়। এরূপ চরিত্র মুনাফিকের, ঈমানদারের নয়।

রাজার নামে ঘরে বসে স্রেফ জপ করলে কি রাজা খুশি হন? রাজার আইনকে প্রতিষ্ঠা দিতে হয় এবং নির্মুল করতে হয় রাজার শত্রু বিদ্রোহীদের। রাজার সৈনিক রূপে যুদ্ধে নামাই সৈনিক জীবনের মূল দায়ভার। তেমনি ঈমানদার হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিক হয়ে যাওয়া। শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালনে সৈনিকের দায়িত্ব পালিত হয়না। সৈনিক রূপে তাকে যুদ্ধ নামতে হয় রাজনীতির জিহাদেও। সে জিহাদে তখন বিনিয়োগ হয় ঈমানদারের মেধা, সময়, অর্থ, শ্রম ও রক্তের। একমাত্র এ রাজনীতিই শাহাদতের তথা বিনা হিসাবে জান্নাতের রাস্তা খুলে দেয়। সে পবিত্র রাজনীতির পথ ধরেই নবীজী (সা:) ১০ বছর যাবত রাষ্ট্রপ্রধানের পদে অসীন ছিলেন এবং মুসলিমগণ প্রতিষ্ঠা দেন সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার। অপর দিকে যে রাজনীতিতে বিজয় আসে ভোটডাকাত দুর্বৃত্তদের এবং প্লাবন আসে গুম-খুন-ধর্ষন-চুরিডাকাতি-ভোটডাকাতির -সেটিই হলো বেঈমানে অসভ্য রাজনীতি। এ রাজনীতি হারাম। এই অসভ্য রাজনীতিই হলো পৃথিবী পৃষ্ঠে সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ কর্ম।

কয়েক হাজার চোর-ডাকাত, খুনি ও ধর্ষকের অপরাধে কোন দেশেরই এতো বড় ক্ষতি হয় না -যা হয় অসভ্য রাজনীতিতে। সে অসভ্যতায় সমগ্র রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনসহ সকল প্রকার অপরাধের হাতিয়ারে পরিণত হয়। এমন রাজনীতিতে দুর্নীতে বিশ্বে প্রথম হওয়াও অতি সহজ হয়ে যায়। বাংলাদেশ সে পর্যায়ে এ শতাব্দীর শুরুতে পর পর ৫ বার পৌঁছেছে। সমগ্র আধুনিক ইতিহাসে এরূপ কদর্য খেতাবটি একমাত্র বাংলাদেশই ৫ বার অর্জন করেছে। অসভ্য রাজনীতির আরো আলামত হলো, এতে বিলুপ্ত হয় অপ্রিয় সত্যগুলি অনুধাবনের নৈতিক সামর্থ্য। এবং বিলুপ্ত হয় এমন কি নৃশংস দুর্বৃত্তিকে নিন্দার করার সামর্থ্য। ডাকাতগণ যেমন ডাকাতির সাফল্য নিয়ে উৎসব করে, অসভ্য রাজনীতির নায়কগণও তেমনি উৎসব করে তাদের নিজ হাত অর্জিত কদর্যতা নিয়ে। এজন্যই আওয়ামী বাকশালীদের কাছে বাংলাদেশের স্বর্ণযুগটি হলো শেখ মুজিবের শাসনামল। এবং তাদের কাছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হলো গণতন্ত্রের খুনি, ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠাতা এবং বহু হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর খুনি শেখ মুজিব।

 

বিবেক হ্ত্যার রাজনীতি, অসভ্যতার তান্ডব ও জিম্মি জনগণ

অসভ্য রাজনীতির প্রতিষ্ঠায় জরুরি হলো জনগণের ঈমানহত্যা ও বিবেকহত্যা। এটিই শয়তানের পথ। কারণ, সভ্য ও ভদ্র মানুষেরা কখনোই সে অসভ্য রাজনীতিতে যোগ দেয়না। বেঈমানেরা তাই রাজনীতিতে হাজির হয় বিবেকধ্বংসী ও ঈমানধ্বংসী নাশকতা নিয়ে। সে নাশকতার কাজে তাদের প্রিয় হাতিয়ারটি হলো মিথ্যাচার ও জাহিলিয়াত। ইসলামের মূল জিহাদটি মূলত মিথ্যাচার ও জাহিলিয়াতের নির্মূলে। মিথ্যাচার ও জাহিলিয়াতের গর্ভে জন্ম নেয় সকল পাপ, সকল অধর্ম এবং সকল নৃশংস অসভ্যতা। দেশে মিথ্যাচার ও জাহিলিয়াতের প্লাবন এলে মারা যায় মানুষের বিবেক, মূল্যবোধ ও ঈমান-আক্বিদা। তখন গভীর সংকট দেখা যায় শুধু ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠায় নয়, বরং বিপন্ন হয় বিবেকবান মানব রূপে বেড়ে উঠাটি। তখন দেশে অসংখ্য মানুষ পথে-ঘাটে চলাফেরা করে, অফিসে বসে ও ব্যবসা করে স্রেফ দেহ নিয়ে, সুস্থ বিবেক ও ঈমান নিয়ে নয়।

দৈহিক রোগ কখনোই গোপন থাকে না, নানাবিধ সিম্পটম নিয়ে উপস্থিতি জানিয়ে দেয়। তেমনি গোপন থাকে না নৈতিক ও ঈমানের রোগ। বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয় বস্তুত মৃত বিবেক এবং রুগ্ন ঈমানের কারণে। সুস্থ বিবেক ও ঈমান নিয়ে এরূপ গর্হিত পর্যায়ে পৌঁছা অসম্ভব। মৃত বিবেক ও রুগ্ন ঈমানের মানুষদের সংখ্যাটি অধিক হওয়ার কারণেই বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মানুষ খুন, নারী ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, টেন্ডার দখল, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলদখল, রাস্তার গাছকাটা, নদীদখল, বনদখল, ব্যাংক লুট, শেয়ার মার্কেট লুন্ঠন ও জমিদখলের রাজত্ব। সরকার এদের নির্মূল নিয়ে ভাবে না, বরং প্রতিপালন দেয়। কারণ সরকার এদের কাছে দায়বদ্ধ। কারণ, এরাই হলো শাসক দলের স্বেচ্ছা-সৈনিক। সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে এদের সাহায্য নিয়ে। এসব সন্ত্রাসীরাই বিরোধী দলের মিটিং-মিছিল ও নির্বাচনী প্রচার অসম্ভব করে। শাসক দলের পক্ষে এরাই দেশ জুড়ে ভোটডাকাতি কর –যেমনটি করেছে ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে। দেশের প্রশাসন, পুলিশ, আইন-আদালত, মিডিয়া এবং সমগ্র দেশবাসী এদের কাছে জিম্মি।

আগুন না থামালে তা দ্রুত ছড়ায়। একই পরিণতি অসভ্য রাজনীতিরও। তখন সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে এমন কি সেনাবাহিনীতেও। বাংলাদেশে সে অতি অসভ্য কাণ্ডটি দেখা গেছে ২০১১ সালে ২৫-২৬ ফেব্রেয়ারিতে। সৈনিকদের সন্ত্রাসে সেদিন ঢাকার পিলখানাতে ৫৭ জন সামরিক অফিসারসহ ৭৪ জন নিহত হয়। অসভ্য রাজনীতিতে এমন কি সাধারণ মানুষও অসভ্য সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়। কারণ তারা আস্থা হারায় সরকার, পুলিশ ও আদালতের উপর। ফলে আইনকে তারা নিজ হাতে নেয়। তখন নিছক সন্দেহের বশে যত্র তত্র নিরীহ মানুষদের পিটিয়ে হত্যা করে। এরই নমুনা, ২০১২ সালে ঢাকার গাবতলির আমিনবাজারে ৬ জন নিরীহ ছাত্রকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। বুয়েটের একটি হোস্টেলে ২০১৯ সালের অক্টোবরে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় আবরার ফাহাদ নামের একজন নিরীহ ছাত্রকে। কোন ট্রেন দুর্ঘটনা হলে পাশের গ্রামের মানুষদের ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় মৃত ও আহত নারী-পুরুষদে ঘড়ি, গহনা ও অর্থ হাতড়িয়ে নিতে। এরূপ বিবেকহীনতা সভ্য দেশে হয়না, কিন্তু বাংলাদেশে বার বার হয়। পত্রিকাতে সে খবরগুলি ছাপাও হয়। সভ্যদেশে সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও দুর্বৃত্তি দেখা দিলে গভীর গবেষণা ও চিন্তাভাবনা শুরু হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সে চিন্তাভাবনা নাই। মুমূর্ষ রোগীর চিকিৎসায় যেমন আগ্রহ থাকে না, তেমনি সামর্থ্যও থাকেনা। সেরূপ একটি অবস্থা বাংলাদেশেরও।  

বাংলাদেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, আইন-আদালত ও প্রশাসন অধিকৃত হয়ে আছে বিবেকহীন নিরেট স্বার্থশিকারীদের হাতে। দেশজুড়ে জোয়ার চুরি-ডাকাতি, সরকারি তহবিল তছরুফ, ঘুষ, ধোকাবাজি ও নানারূপ দুর্বৃত্তির। বিচার ব্যবস্থা ব্যর্থ হচ্ছে দুর্বৃত্তদের শাস্তি দিতে। রাজনীতি ও প্রশাসনে নাই দুর্বৃত্ত নির্মূলের এজেন্ডা। শিক্ষাব্যবস্থায় নাই বিবেকবান মানুষ গড়ার আয়োজন। আলেমগণ রাজনীতি থেকে দূরে থাকাটি দ্বীনদারি মনে করেন। নবীজী (রা:) যে ১০ বছর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, বহুবার অস্ত্র হাতে জিহাদ করলেন –আলেমগণ সে সূন্নতের ধার-কাছে নাই। তাদের চাই ওয়াজে পয়সা, ইমামতীতে পয়সা ও দোয়াতেও পয়সা। অথচ এগুলি সবই ইবাদত। ইবাদতে অর্থ নেয়া কি নবীজী (সা:)’র সূন্নত? ব্যর্থতা তাই সর্বত্র জুড়ে। অথচ সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে আবর্জনা নির্মূলে আপোষ চলে না। তেমনি আপোষ চলে না অপরাধীদের নির্মূলে। যে কোন সভ্য রাষ্ট্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো এই দুর্বৃত্তি নির্মূল। ইসলামে এটি জিহাদ। সড়ক, ব্রিজ, ইমারাত ও কারখানার কমতির কারণে কোন দেশই অসভ্য হয় না। জনগণ জান্নাতমুখীও হয়না। ইসলামের গৌরবকালে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বিপুল ভাবে বেড়েছে; কিন্তু শাসকের জন্য কোন প্রাসাদ নির্মিত হয়নি। ফলে বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ গুণ বৃহ্ৎ রাষ্ট্রের খলিফাগণ শাসক রূপে নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের পূর্বের গৃহখানি ছেড়ে কোন প্রাসাদে গিয়ে উঠেননি। পরিবর্তন আসেনি তাদের পোষাকে। রাজা-বাদশাহদের ন্যায় তারা কোন মুকুটও পড়েননি। চাকরকে উটের পিঠে চড়িয়ে নিজে রশি ধরে টেনেছেন। আগের পুরনো তালি দেয়া পিরহান পরিধান করে খলিফার দায়িত্ব পালন করেছেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে এটি অনন্য। এজন্যই তারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। ফেরেশতাদের মজলিসে মহান আল্লাহতায়ালা তাদের নিয়ে গর্ব করেন। অথচ আজকের মুসলিমগণ সে পথে নাই। তারা বরং আনন্দ ও উৎসব বাড়াচ্ছে শয়তানের আসরে।  বাংলাদেশের ন্যায় দরিদ্র দেশে বহু প্রাসাদ নির্মিত হয়েছে। পোষাক-পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জায় প্রচুর জাঁকজমকও এসেছে। নির্মিত হয়েছে বহু সড়ক, ফ্লাইওভার ও ব্রিজ। কিন্তু দুর্বৃত্তি নির্মূল হয়নি। প্রতিষ্ঠা পায়নি সুবিচার। বিলুপ্ত হয়নি জুলুম। মুসলিম পরিচয়টি স্রেফ নামেই রয়ে গেছে। অথচ অপরাধীদের নির্মূলের কাজটি না করাই তো বড় অপরাধ। এ কাজে অনিহা তো নিরেট বেঈমানী। রোজ হাশরের বিচার দিনে যে অপরাধী রূপে কাঠগড়ায় খাড়া হতে হবে সে হুশ ক’জনের?

 

অপরাধী সরকার এবং প্লাবন দুর্বৃত্তির

যে কোন সভ্য সরকারের মূল কাজটি রাস্তাঘাট, ব্রিজ বা কলকারখানা নির্মাণ নয়। বরং সেটি হলো সভ্য মানুষ ও সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণ। এজন্য জরুরি হলো দুর্বৃত্তির নির্মূল (নেহী আনিল মুনকার) এবং সুবিচারের প্রতিষ্ঠা (আ’মিরু বিল মারুফ)। সভ্য ও ভদ্র ভাবে বেড়ে উঠাই এটিই হলো পূর্ব শর্ত। সেজন্য এটিই হলো মুসলিম জীবনের মিশন। একাজের জন্যই মুসলিমগণ সর্বশ্রেষ্ঠ মানব –যা বলা হয়েছে সুরা আল-ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে।  কিন্তু বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টোটি। অপরাধ নির্মূল না করে দিন দিন সেটিকে প্রকটতর করা হচ্ছে। ফলে দেশ সভ্য বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়ছে। অপরদিকে জনগণের নৈতিকতা ও মূল্যবোধে অবক্ষয়ও কি কম? এক্ষেত্রে সংকট এতোটাই গুরুতর যে, বিপুল সংখ্যক জনগণ শুধু চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের ভোটই দেয় না, বরং তাদের পক্ষে মিছিল করে, লাঠি ধরে এবং তাদের বিজয়ে উৎসবও করে। অপরাধীদের নির্মূলে সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি হলো দেশের বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগের। অথচ বাংলাদেশে সে কাজে তারা ব্যবহৃত হচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের নাই এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক অঙ্গিকার। বরং সরকারের কাজ হয়েছে, এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় স্বার্থে লাঠিয়াল রূপে ব্যবহার করা। পুলিশ এবং বিচার বিভাগ নিয়ে সরকার নেমেছে নিজেদের রাজনৈতিক শত্রু নির্মূলে। ফলে দেশ, জনগণ ও মানবতার শত্রুদের নির্মূলে নজর দেয়ার সময় সরকারের নাই। সরকারের প্রায়োরিটি যে কোন ভাবে নিজ শাসন ক্ষমতাকে দীর্ঘায়ীত করা। পুলিশের কাজ হয়েছে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা। আদালতের কাজ হয়েছে সরকারবিরোধীদের ফাঁসিতে ঝুলানো ও জেল দেয়া। ফলে বিনা বাধায় বিপুল ভাবে বাড়ছে দুর্বৃত্তদের উৎপাদন। অপর দিকে সরকারের এই ব্যর্থতাগুলো যারাই তাদের কথায় ও লেখনীতে তুলে ধরছে তাদের চিত্রিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী রূপে।  

হাসিনার ন্যায় ফ্যাসিবাদী ভোটডাকাতগণ ঠিকই জানে, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও সেনাবাহিনীর দায়িত্বে চরিত্রবান লোক বসালে অসম্ভব হয় দলীয় স্বার্থে তাদেরকে লাঠিয়াল রূপে ব্যবহার করা। ভাল মানুষ মানেই দুর্বৃত্তদের শত্রু। তাদের বসালে ঘনিয়ে আসে তাদের নিজেদের বিপদ। ফলে এ তিনটি বিভাগে পরিকল্পিত ভাবে নিয়োগ দেয়া হয় দলীয় ক্যাডারদের। একাজে নিয়োগ পেতে যোগ্যতা ও চরিত্র লাগে না, লাগে সরকার-বিরোধীদের রাজপথে পেটানো এবং নির্বাচন কালে সরকারী দলকে বিজয়ী করার সামর্থ্য। এজন্যই সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়েছিল একটি অপরাধী পরিবারের সদস্য আজিজ আহমেদকে। অপরদিকে দেশের প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে খুনের সাজাপ্রাপ্ত নিজ দলের খুনিদের বাঁচানো। সেটি দেখা গেছে, সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের খুনের অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ভাইকে ক্ষমা করে জেল থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে। অপরদিকে আইনমন্ত্রী তুলে নিচ্ছে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হাজার হাজার মামলা। তেমনটি দেখা গেছে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার পর পরই। গদিতে বসেই তিনি তাঁর নিজের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী সরকারের দায়েরকৃত সকল মামলাকে খারিজ করে দেন। সেগুলির বিচার নিয়ে পুলিশ ও আদালতকে শেখ হাসিনা সামনে এগুতে দেননি। যেন অপরাধ শুধু বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দ্বারাই হয়! শেখ হাসিনা ও তাঁর দলীয় নেতাকর্মীগণ যেন ফেরেশতা এবং আইনের উর্দ্ধে। অথচ সভ্য দেশগুলিতে কেউই বিচারের উর্দ্ধে নয়। বিচার না করে আদালতে নথিভূক্ত মামলাকে খারিজ করার অধিকার কোন সভ্য দেশেই ক্ষমতাসীন সরকারেরই থাকে না। এগুলি তো গুরুতর আইনবিরোধী অপরাধ। অথচ বাংলাদেশে সে সভ্য নীতি চলতে দেয়া হয়না। কার বিচার হবে এবং কার বিচার হবে না –সে সিদ্ধান্তটি নেয় সরকার। আদালতের বিচারকগণ এক্ষেত্রে সরকারের চাকর-বাকর। ফলে সরকার পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রের বুকে সবচেয়ে অপরাধী প্রতিষ্ঠানে।  

 

স্বৈর-সরকার: উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা

যে কোন উন্নয়ন-কাজে পুঁজি চাই। গাছ মাটি ছাড়া জন্মায় না, তেমনি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নও পুঁজি ছাড়া গড়ে উঠে না। তবে সে পুঁজি স্রেফ অর্থ-সম্পদ ও ভূমি-সম্পদ নয়। অর্থ ও ভূমির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মানব-সম্পদ। অর্থনীতির ভাষায় একেই বলা হয় সোসাল ক্যাপিটাল বা সামাজিক পুঁজি। সামাজিক পুঁজি গড়ে উঠে নাগরিকদের সততা, কর্মে নিষ্ঠা, নীতিজ্ঞান, বিবেকবোধ ও দায়বোধ থেকে। ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া যায়না। তেমনি মানব-উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন আসে না। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। অথচ বাংলাদেশে সে কাজটিই হয়নি। কারণ, রাষ্ট্র যখন দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হয় তখন অসম্ভব হয় জনগণের নৈতিক সামর্থে তথা সামাজিক পুঁজিতে সমৃদ্ধি আনা। কারণ স্বৈর-সরকার চায় তার শাসন বাঁচাতে জনগণ সহায়তা দিক। চরিত্রবান মানুষ দিয়ে ডাকাত দল গড়া যায় না। তেমনি সভ্য মানুষদের দিয়ে স্বৈর-শাসন চালানো যায় না।স্বৈরশাসকগণ সেটি বুঝে; সেজন্যই তারা সভ্য মানুষদের দুশমন। তারা চায় মানুষ চরিত্রহীন, নীতিহীন ও অসভ্য হোক, তাতে তাদের সমর্থক ও সৈনিকের সংখ্যা বাড়ে। ফলে স্বৈর শাসনে বিশাল ধ্বস আসে সোসাল ক্যাপিটালে। আসে দুর্বৃত্তির জোয়ার। চোর-ডাকাতে তখন দেশ ভরে উঠে। বাংলাদেশ যে কারণ দুর্বৃত্তিতে ৫ বার প্রথম হলো তার কারণ বাংলার জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতি নয়, বরং তার মূলে হলো দুর্বৃত্ত শাসন। এমন দেশে শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ দূরে থাক, অর্থ নিয়ে রাস্তায় নামতেই মানুষ ভয় পায়। এজন্যই গণতান্ত্রিক সরকারের তূলনায় স্বৈরাচার-কবলিত দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আসেনা।

বর্তমান সময়ে উন্নয়নের পথে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বাধাটি হলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন। শেখ মুজিবের আমলে উন্নয়নের বড় বাধা ছিল খোদ শেখ মুজিব। ফলে তার আমলে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এসেছিল। প্রায় ১৫ লাখ অনাহারে মারা যায়। তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছিল ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি রূপে। যে কোন দেশেই চোর-ডাকাত ও খুনীগণ গুরুতর অপরাধী। কিন্তু তাদের চেয়েও বড় অপরাধী হলো স্বৈর-শাসকগণ। সাধারণ চোর-ডাকাত সারা জীবনে বড় জোর কয়েক শত মানুষের ঘরে চুরিডাকাতি করে। কিন্তু ডাকাতির সে অর্থ দিয়ে কোন ডাকাতই দেশ বা বিদেশে প্রাসাদ গড়তে পারে না। কিন্তু স্বৈরশাসকেরা নানা ভাবে প্রতিদিন চুরিডাকাতি করে দেশের কোটি নাগরিকের ঘরে। ভোটডাকাতির মাধ্যমে এমন কি পুরা রাষ্ট্রকেও ডাকাতি করে নেয়। প্রশাসন হাতে থাকায় তারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করতে পারে এবং একাধিক প্রাসাদও গড়তে পারে। অপর দিকে সাধারণ একজন খুনি জীবনে ক’জনকে খুন করতে পারে? বড় জোর কয়েক জন। অথচ স্বৈরশাসকদের হাতে সংঘটিত হয় বড় বড় গণহত্যা। শেখ মুজিব একাই প্রায় তিরিশ হাজার মানুষকে খুন করেছেন রক্ষিবাহিনী দিয়ে। সিরাজ শিকদারকে খুন করে পরের দিন সংসদের দাঁড়িয়ে “কোথায় আজ সিরাজ শিকদার” বলে মস্কারা করেছেন। এ ছিল মুজিবের অপরাধী মানস। শেখ হাসিনার আমলে শাপলা চত্বরে হতাহত হয়েছে বহুশত মানুষ। বহু মানুষ গুম, খুন ও ফাঁসির শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে কোন সাধারণ খুনি কি সারা জীবনে এতো মানুষকে খুন করতে পেরেছে? তাই যে কোন দেশের স্বৈর-শাসকই হলো সেদেশের সবচেয়ে বড় অপরাধী। সে দেশের সকল  চোর, সকল ডাকাত ও সকল খুনির অপরাধ একত্রে করলেও স্বৈরাচারি শাসকের অপরাধের সমান নয়। দেশের উন্নয়নের বদলে তারা চায় স্রেফ তাদের নিজেদের উন্নয়ন।

এশিয়া ও আফ্রিকার বহুদেশই প্রাকৃতিক সম্পদে অতি সমৃদ্ধ। কিন্তু এই দেশগুলিতে শিল্প-বিপ্লব আসেনি। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবও আসেনি। এশিয়া-আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ এখনো দান-খয়রাত নির্ভর। অথচ বিপ্লব এসেছে প্রাকৃতিক সম্পদে দরিদ্র ইংল্যান্ড, জার্মান, জাপান, সিঙ্গাপুর ও কোরিয়ার মত দেশগুলিতে। এসব দেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের মূল কারণ, দেশগুলির উন্নত সোসাল ক্যাপিটাল তথা সমৃদ্ধ মানব সম্পদ। এদেশের গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক সরকারগুলো প্রথমে হাত দিয়েছে মানব-উন্নয়নে। ফলে গড়ে উঠেছে সামাজিক সম্পদ। ফলে এসব দেশে একজন শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির শ্রমিকদের চেয়ে অনেকগুণ বেশী। ফলে এসব দেশের শিল্পখাতে বিনিয়োগে এমন কি তেল সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলি থেকেও পুঁজি ছুটে আসে। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির পিছিয়ে থাকার কারণ, দেশগুলি অধিকৃত হয়ে আছে স্বৈরশাসকদের হাতে। শেখ হাসিনার ন্যায় এসব স্বৈর-শাসকদের এজেন্ডা মানব-উন্নয়ন নয়, বরং নিজেদের স্বৈর-শাসনকে বাঁচিয়ে রাখা।

 

মুজিবের মিথ্যাচার অপরাধের রাজনীতি

শেখ মুজিবের মিথ্যাচার যেমন অনেক, তেমনি তাঁর অপরাধও অনেক। শেখ মুজিব ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। অথচ ইসলামে ঐক্য গড়া ফরজ এবং ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চলের নামে বিভক্তি গড়া হারাম। শেখ মুজিব বিভক্তি গড়ার পথকে বেছে নেন এবং সেটি ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে।  মানুষের মূল্যায়নে যখন ঈমান-আমলের বদলে তাঁর ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চল গুরুত্ব পায় – সেটিকে বলা হয় আসাবিয়াত। ইসলামে আসাবিয়াত হারাম। নবীজী (সা:)’র হাদীস: “সে আমাদের কেউ নয় যে গোত্রের জন্য যুদ্ধ করে এবং সে আমাদের কেউ নয় যে গোত্রের জন্য মারা যায়।” –(আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নম্বর ৫১২১)। বিখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা সুয়ুতীর মতে হাদীসটি সহিহ। এ হাদীসটির অর্থ দাঁড়ায়, গোত্রবাদী চেতনা কখনোই হালাল হতে পারে না, এটি হারাম। উপরুক্ত হাদীসটিতে গোত্রবাদী চেতনা নিয়ে লড়াই করা ও মারা যাওয়ার বিষয়টি বর্ণিত হলেও একই রায় প্রযোজ্য হবে জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী চেতনা নিয়ে যুদ্ধ করা ও মারা যাওয়ার ব্যাপারেও। কারণ মতবাদের দিক দিয়ে গোত্রবাদ, জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ একই গোত্রের হারাম মতবাদ। তাই কোন ঈমানদার যেমন গোত্রবাদী হতে পারে না, তেমনি জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদীও হতে পারে না। অথচ মুজিবের রাজনীতির ভিত্তি ছিল এই হারাম মতবাদ।

তাছাড়া বাংলার বুকে বাঙালী জাতিয়তাবাদের জন্মের একটি ইতিহাস আছে। এর উত্থান হয় মুসলিমদের ক্ষতি সাধনে। এ মতবাদের জন্ম মুজিবের হাতে হয়নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম ১৯০৫ সালে বাঙালি হিন্দুদের হাতে। এর আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ কোন রাজনৈতিক মতবাদ ছিল না। তখন সুবা বাংলা বলতে বুঝাতো বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে এক বিশাল প্রদেশ। তখন বাংলা ছিল বিশ্বমাঝে অতি সম্পদশালী দেশ। হিন্দুরা বাঙালি বলতে হিন্দুদের বুঝাতো, মুসলিমদের নয়। এজন্যই শরৎচন্দ্র চ্যাটার্জি তার উপন্যাসের লিখেছেন, “আমাদের গ্রামে বাঙালি ও মুসলিমদের মাঝে ফুটবল খেলা।” হিন্দুদের মাঝে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। সেটি হলো, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীক যে নতুন প্রদেশ গড়া হয় সেটিকে বিলুপ্ত করা। লক্ষ্য এখানে মুসলিমদের স্বার্থহানী। কারণ, নতুন প্রদেশ গড়ার ফলে পূর্ব বাংলার মুসলিমগণ লাভবান হচ্ছিল। প্রাদেশিক রাজধানী রূপে ঢাকার বুকে তখন প্রশাসনিক সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট বিল্ডিং ও রাস্তাঘাট নির্মাণসহ বেশ কিছু অবকাঠামো গড়া গচ্ছিল। ঢাকার এ উন্নয়ন কলকাতা কেন্দ্রীক হিন্দুবাবুদের কাছে অসহ্য ছিল। বাঙালি হিন্দু জমিদারগণ তখন তাদের সম্পদ জমা করতো কলকতায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বলবান করতেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তাঁর “আমার সোনার বাংলা” গানটি। ১৯১১ সালে এ আন্দোলন বিজয়ী হয়; ইংরেজ রাজা পঞ্চম জর্জ তার ভারত সফর কালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে দেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেন পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে।

প্রতি সমাজে সব সময়ই কিছু রোগাগ্রস্ত মানুষ থাকে। তবে ভয়ানক বিপর্যয় তখন শুরু হয় যখন সে রোগ মহামারি রূপে সর্বস্তরে ছড়ায়। বাংলাদেশে সে ধ্বংসাত্মক মহামারিটা ঘটে জনগণের চেতনার রাজ্যে। এতে বাঙালি মুসলিমের চেতনায় মারা পড়ে ১৯৪৭’য়ের প্যান-ইসলামিজম। তখন পাকিস্তানের অবাঙালি মুসলিমগণ ভাইয়ের বদলে শত্রুতে পরিণত হয়। অতি দ্রুত দেশ অধিকৃত হয় অসুস্থ বিবেকের মানুষদের হাতে। শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের অপরাধ শুধু গণতন্ত্র হত্যা ও বাকশালী স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠা নয়; বরং সবচেয়ে বড় অপরাধটি হলো বিবেকহত্যার রাজনীতি। মানুষের বিবেক অনাহারে মারা যায না। রোগজীবাণু বা বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়েও মারা যায় না। মারা যায় মগজে দূষিত তথা মিথ্যা ধ্যান-ধারণা বাসা বাঁধাতে। মানবতার সবচেয়ে বড় দূষমণটি হিংস্র পশু বা রোগ-জীবাণু নয়, বরং সেটি হলো মিথ্যা ধ্যান-ধারণা। মিথ্যা বয়ানই শয়তানের হাতিয়ার। মিথ্যা সংক্রামক এবং সত্যের চেয়েও অধিক প্রভাবশালী। এজন্যই পৌত্তলিকতার ন্যায় সনাতন মিথ্যাও কোটি কোটি অনুসারী পায় এবং বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ইসলামের শাশ্বত সত্য বাণীকে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। যারা মিথ্যাবাদী তারাই শয়তানের সৈনিক। তারা শত্রু মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীনের। সকল নবী-রাসূলদের মূল যুদ্ধটি ছিল মিথ্যা ও মিথ্যুকদের বিরুদ্ধে। মিথ্যাবাদীরাই সত্যের মূল শত্রু। তারাই মানুষকে জাহান্নামের দিকে নেয় এবং পৃথিবীর বুকে মহান আল্লাহতায়ালার আযাব নামিয়ে আনে। মিথ্যাবাদীদের পরিণাম মানব ইতিহাসের কোথাও ভাল হয়নি। তাদের ভয়াবহ পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে তাই পবিত্র কুর’আনেতাই বলা হয়েছে, “ফাসিরু ফিল আরদে, ফানজুর কাইফা কানা আকিবাতুল মোকাজ্জাবীন।”  অর্থ: অতঃপর পৃথিবী পৃষ্ঠে ভ্রমন করো এবং দেখ মিথ্যাবাদীদের কি পরিনাম হয়েছিল। মহান আল্লাহর আযাব নামিয়ে আনার জন্য তাই মুর্তিপূজারী বা নাস্তিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। সে জন্য মিথ্যাবাদী ও মিথ্যাচর্চাই যথেষ্ঠ। ঈমানদারদের মূল জিহাদটি তাই মিথ্যার বিরুদ্ধে। লড়াই এখানে কুর’আনী সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার।

শেখ মুজিবের রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি মুসলিম জীবনে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। মুজিবের বড় অপরাধটি এখানেই। সে কাজে মুজিব বিজয়ীও হয়েছেন। সে কাজে সাহায্য পেয়েছেন ভারতীয় পৌত্তলিকদের। মুজিবের মিথ্যা কোন একক মিথ্যা নয়। তিনি ছিলেন বহুবিধ মিথ্যার জনক। একাত্তরে তিরিশ লাখের মৃত্যু, দুই লাখ নারীর ধর্ষণ, ভারত বাংলাদেশের বন্ধু, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ, পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাংলা ভাষা ও বাঙালির শত্রু, বাকশালই গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের কল্যাণ জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্রে –এসবই হলো শেখ মুজিবের বহুল প্রচারিত মিথ্যা। তবে সবচেয়ে বড় মিথ্যাটি উচ্চারিত হয়েছিল মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে। ইসলামের প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন অঙ্গীকার ও সে লক্ষ্যে কুর’বানীই হলো মানবের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। সে গুণের বলেই মানব সন্তান নিজেকে মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার মাগফিরাত-প্রাপ্তি ও জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলে। অথচ ইসলামের প্রতি তেমন অঙ্গীকার শেখ মুজিবের কাছে অপরাধ ও সাম্প্রদায়িকতা গণ্য হয়েছে। তেমন একটি হিংস্র ইসলামবিরোধী চেতনা নিয়ে তিনি মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও নেমেছিলেন। মুজিবের যুদ্ধ ছিল শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধের অংশ রূপেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগড়াকে তিনিই সর্বপ্রথম বাংলার মাটিতে আইন করে নিষিদ্ধ করেন। এরূপ নিষেধাঙ্গা পাকিস্তান আমলে ছিল না, এমনকি ব্রিটিশ আমলেও ছিল না। অথচ ব্রিটিশদের হাতে অধিকৃত হওয়ার বাংলার আদালতে বিচার হতো শরিয়তী আইনে।   

পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শিক্ষাবোর্ড, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামে কুর’আনের আয়াত ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের কাছে মহান আল্লাহতায়ালার নাম ও কুর’আনের সে আয়াতগুলি সহ্য হয়নি। সেসব স্থান থেকে কুর’আনের সে আয়াতগুলি তিনি বিলুপ্ত করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে দ্বীনিয়াত নামক একটি বই স্কুলে পড়ানো হতো, যা থেকে ছাত্র-ছাত্রীগণ ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলি শিখতে পারতো। শেখ মুজিব সে বইটিও নিষিদ্ধ করেন। এভাবে ইসলামের সাথে পরিচয় লাভ অসম্ভব করে তুলেন। ইসলামের বিরুদ্ধে এর চেয়ে গুরুতর অপরাধ আর কি হতে পারে? কোন মুসলিম দেশের সরকারের মূল দায়িত্বটা হলো জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে উপযোগী করে গড়ে তোলা। এ জন্যই জরুরি হলো মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাকে নিশ্চিত করা। স্কুল-কলেজে কুর’আন শিক্ষা এজন্যই এতো অপরিহার্য। নইলে মুসলিম সন্তানদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাই অসম্ভব হয়। এজন্যই মুসলিমগণ শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে না, ইসলামী রাষ্ট্রও গড়ে। সে কাজটি না হলে মুসলিম সন্তানেরা জাহান্নামের যাত্রী রূপে বেড়ে উঠে। অথচ শেখ মুজিব সেটিই ত্বরান্বিত করেছিলেন। এটিই হলো মুজিবের সবচেয়ে বড় অপরাধ। এজন্যই ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের কাছে শেখ মুজিব ও তার অনুসারীগণ এতো আপন।

বিষ দেহ হত্যা করে, মিথ্যা হত্যা করে বিবেককে। তাই বিষ প্রয়োগের ন্যায় গুরুতর অপরাধ হলো মানবের মাঝে মিথ্যার প্রচার দেয়া। অথচ মিথ্যাকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দেয়াই ছিল শেখ মুজিবের রাজনীতি। তাই তার নির্দেশনায় একাত্তরে ৩০ লাখ নিহতের মিথ্যাটি বাংলাদেশে জাতীয় মিথ্যায় পরিণত হয়েছে। এরূপ একটি বিকট মিথ্যার প্রতিষ্ঠা দিয়ে শেখ মুজিব বাঙালি মুসলিমের বিবেককে হত্যা করেছেন। বিবেকের মৃত্যু হলে সে মৃত বিবেকের কাছে ফিরাউনও খোদা মনে হয়। তখন মুর্তি, গরু-ছাগল, সাপ-শকুন, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী এমনকি পুরুষের লিঙ্গও পূজা পায়। বাঙালির বিবেকে মড়ক লাগাতে সক্ষম হওয়ায় মুজিবের ন্যায় গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট, হিন্দুত্ববাদের সেবক, ইসলামের শত্রু ও বহু হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর খুনিও জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মুজিব সফলতা তাই বিশাল।

হিরোইন ব্যবসায়ীরা চায় মানুষ অধিক সংখ্যায় নেশাগ্রস্ত হোক। কারণ তাতে হিরোইনের কাটতে বাড়ে। তেমনি স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তরাও চায় মানুষ অধিক হারে বিবেকহীন হোক। তখন তাদের দুঃশাসনও শ্রেষ্ঠ শাসন রূপে নন্দিত হয়। স্বৈরাচারীদের রাজনীতিতে মিথ্যাচর্চা এবং মিথ্যাচর্চার পথ ধরে জনগণের বিবেকহত্যা এজন্যই এতোটা প্রায়োরিটি পায়। মুজিবের স্বৈরাচারী দুঃশাসন যা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে তা আওয়ামী বাকশালীদের কাছে শ্রেষ্ঠ শাসন রূপে গণ্য হয় তো বিবেকহীনতার কারণেই। কোন দেশ কখনোই খরা, প্লাবন, রোগ-ভোগ বা যুদ্ধ-বিগ্রহে তলাহীন হয় না। বাংলাদেশে খরা, প্লাবন ও রোগের মহামারি বহুবার এসেছে। কিন্তু তাতে দেশ কোনকালেই ভিক্ষার ঝুলি হয়নি, বিশ্বজোড়া অপমানও জুটেনি -যেমনটি মুজিবামলে হয়েছে। বহুদেশ বছরের পর বছর যুদ্ধ করেও তলাহীন হয়না। সেটি হলে প্রকাণ্ড দুটি ব্শ্বিযুদ্ধের পর ইউরোপে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হতো এবং বহুলক্ষ মানুষ সে দুর্ভিক্ষে মারা যেত। কিন্ত সেটি হয়নি। বরং দেশ তলাহীন হয় বিবেকহীনতায়। তখন শুধু দেশের ট্রেজারি, ব্যাংক-বীমা, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও শেয়ার মার্কেটই চুরিডাকাতির শিকার হয়না, বরং ডাকাতির শিকার হয় সমগ্র দেশ।

 

অপরাধী রাষ্ট্র ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র

নর্দমার বিষাক্ত কীটগুলো যতদিন নর্দমার মধ্যেই কিলবিল করে ততদিন বিপদ দেখা দেয় না। কিন্তু ড্রেন উপচিয়ে সেগুলো যখন গৃহে প্রবেশ করে তখন মহামারি শুরু হয়। তেমনি বিবেকহীন মানুষগুলো ডাকাতপাড়া, পতিতাপল্লী, বন-জঙ্গল বা কারাগারে সীমিত থাকলে তাতে দেশ জুড়ে দুর্নীতির প্লাবন আসে না। কিন্তু দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী, সেনা বাহিনী, মিডিয়া ও আইন-আদালত যখন তাদের হাতে অধিকৃত হয়, তখন দেশ দ্রুত বিশ্বরেকর্ড গড়ে দুর্বৃত্তিতে। তখন খোদ রাষ্ট্র পরিণত হয় সবচেয়ে বড় অপরাধী সংগঠনে। হিটলারের একার অপরাধ জার্মানীর সকল অপরাধীর সম্মিলিত অপরাধের চেয়েও অধিক। কারণ, হিটলার দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, আদালত ও সেনাবাহিনীকে তার অপরাধের হাতিয়ারে পরিণত । এবং সমগ্র দেশকে পরিণত করেছিল অপরাধের বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে। ফলে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা তাতে সহজ হয়ে যায়। সমগ্র রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও উপায়-উপকরণ পরিণত হয়েছিল নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার হাতিয়ারে। ফলে সমগ্র রাষ্ট্র পরিণত হয়ে অপরাধী সংগঠনে। স্বৈর-শাসনের এটিই সবচেয়ে বড় ভয়াবহতা। দুর্বৃত্ত শাসকেরা এভাবেই জাহান্নামের রাস্তা গড়ে সমগ্র রাষ্ট্র জুড়ে -এমনকি সেটিকে বর্ধিত করে প্রতিবেশী দেশেও। নমরুদ-ফিরাউন, হালাকু-চেঙ্গিজসহ সকল কাফির শাসকদের সেটিই তো মূল অপরাধ।

অপর দিকে হযরত মুহম্মদ (সা:)’য়ের একার নেক-আমল বহুশত কোটি মানুষের নেক আমলের চেয়েও অধিক। কারণ, তিনি রাষ্ট্রকে পরিণত করেন পৃথিবী পৃষ্ঠের সর্বশ্রেষ্ঠ জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় জনগণকে জান্নাতে নেয়ার বাহনে। তিনি জান্নাতমুখি সিরাতাল মুস্তাকিম গড়েছিলেন রাষ্ট্রের সমগ্র অঙ্গণ জুড়ে। তিনি প্রতিষ্ঠা দেন ইসলামী রাষ্ট্রের এবং ভিত গড়েন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার। জনগণকে একমাত্র তখনই কল্যাণ দেয়া যায় যখন অকল্যাণের সকল পথগুলো নির্মূল করা হয় এবং উম্মুক্ত করতে হয় ভাল কাজের সকল দরজা। চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত, খুনি-ধর্ষক, সন্ত্রাসী ও প্রতারকদের স্বাধীনতা দিয়ে জনগণের জানমাল, ইজ্জত ও স্বাধীনতা সুরক্ষা দেয়া যায়না। পতিতাপল্লী, মদের দোকান, সন্ত্রাসী রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি, সূদ-ঘুষ, ড্রাগের ব্যবসা ও অশ্লীল নাচগানের আসর খুলে রেখে জনগণকে সভ্য ও ভদ্র বানানো অসম্ভব। সমাজে সেগুলি বেঁচে থাকলে জনগণ অসভ্য ও দুর্বৃত্ত হবেই। বাংলাদেশ তারই উদাহরণ। মশার আবাদ অবাধে বাড়তে দিয়ে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা যায় না। সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণে এজন্যই অসভ্যতার আখড়াগুলি সর্বপ্রথম নির্মূল করতে হয়। এটিই নবীজী (সা:)’র মহান সূন্নত। পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত এটিই হলো “নেহী আনিল মুনকার”য়ের বিধান। রাষ্ট্রের বুক থেকে নবীজী (সা:) নির্মূল করেছিলেন জাহান্নামের প্রতিটি পথ এবং বিলুপ্ত করেছিলন দুর্বৃত্ত মানুষদের বেড়ে উঠার প্রতি ঘাঁটি। জনগণকে শিক্ষিত করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ টেক্স্টবুক দিয়ে। সেটি ছিল পবিত্র কুর’আন। ফলে সেদিন জনগণের মাঝে প্রতিযোগিতা লেগেছিল জান্নাতের যোগ্য মানুষ রূপে বেড়ে উঠা নিয়ে। সে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার ফলেই মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষগুলো গড়ে উঠেছিলেন নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত সেই রাষ্ট্রে। এবং সেরূপ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই হলো নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। নবীজী (সা:)’র সে নেক আমলের বরকতেই বহুশত কোটি মানুষ বিগত ১৪ শত ধরে জান্নাতের পথ পেয়েছে। তেমনি বহুশত কোটি মানুষ জান্নাতের পথ পাবে অনাগত ভবিষ্যতেও। হযরত মুহম্মদ (সা:) তো এ জন্যই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। এত বড় জনকল্যাণমূলক কাজ অন্য কোন নবী বা রাসূলের দ্বারা হয়নি। ফলে নবীজী (সা:)’র এই মহান অবদানটি হলো মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাদকায়ে জারিয়া। অপর দিকে শেখ মুজিবের ন্যায় সকল ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী শাসকগণ রাজনীতিকে পরিণত করে গুনাহে জারিয়াতে। রাষ্ট্রকে পরিণত করে জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার বাহনে। মুজিবের আমলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পরিণত হয় দক্ষিণ এশিয়ার বুকে সবচেয়ে বড় অপরাধী সংগঠনে। সে রাষ্ট্রের অপরাধনামটি বিশাল। গণতন্ত্র হত্যা, আলেমদের উপর জেল-জুলুম-হত্যা, স্কুলে দ্বীনিয়াত নিষিদ্ধকরণ, ইসলামপন্থীদের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, বাকশালী স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন পত্র-পত্রিকা নিষিদ্ধকরণ, রক্ষি বাহিনী দিয়ে হাজার হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী হত্যা, ভারতসেবা, হিন্দুত্বতোষণ ইত্যাদি বহুবিধ অপরাধের হোতা ছিল মুজিব আমলের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি।  

মুসলিম হওয়ার অর্থ, নবীজী (সা:)’র আদর্শকে পূর্ণ ভাবে গ্রহণ করা। তাঁর সে মহান মিশনকে নিজ জীবনের মিশন বানিয়ে নেয়া। যারা নবীজী (সা:)’র অনুসারী তারাই মূলত মহান আল্লাহতায়ালার অনুসারি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুর’আনের আয়াত, “যে রাসূলকে অনুসরণ করলো সেই আল্লাহকে অনুসরণ করলো।” –(সুরা নিসা, আয়াত ৮০)। এবং যে ব্যক্তি অবাধ্য রাসূলের, সে অবাধ্য আল্লাহর। এমন অবাধ্যরাই মূলত কাফের বা বেঈমান। ঈমানদারদের কাজের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন: “তোমরাই হলে সর্বশ্রেষ্ট উম্মত, তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। তোমরা নির্দেশ দিবে ন্যায় কর্মের এবং নির্মূল করবে দুর্বৃত্তিকে। এবং বিশ্বাস করবে আল্লাহকে।” –(সুরা ইমরান, আয়াত ১১০)। তাই শ্রেষ্ঠতম উম্মত হওয়ার পথটি নিছক নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে সীমিত নয়। বরং সেটি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলে জিহাদী মিশন নিয়ে বাঁচায়। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত মূলত সেরূপ বাঁচাতে ঈমানী শক্তি জোগায়। তাই নিছক রাজনীতির লক্ষ্যে মুসলিম রাজনীতি করে না। জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, সেক্যুলারিজম ও অন্য কোন মতবাদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও রাজনীতি করে না। বরং মু’মিনের রাজনীতি হলো দুর্বৃত্তমুক্ত এক পবিত্র সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের জিহাদ। এ রাজনীতিতে নিহত হলে তাই শাহাদত প্রাপ্তি ঘটে এবং বীনা বিচারে জান্নাত জুটে। এরূপ বিশাল পুরস্কার অন্য কোন নেক কর্মে নাই।

 

ভ্রষ্টতা ও দুর্বৃত্তি যখন মিশন

মানুষ মাত্রই যে কোন একটি মিশন নিয়ে বাঁচে। সেটি হতে পারে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের অথবা বিদ্রোহের। চোর-ডাকাত, ধর্ষক, খুনিদের জীবনেও মিশন থাকে -সেটি মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের তথা ভয়ানক অপরাধের। এ অপরাধই ব্যক্তিকে জাহান্নামে নেয়। এটিই শয়তানের পথ। মু’মিনের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত মিশনটি হলো: “আমারু বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার” অর্থ: “ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও দুর্বৃত্তির নির্মূল।” মুসলিম সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি স্রেফ এ মিশন নিয়ে বাঁচার কারণে। এ মিশন থেকে দূরে সরার অর্থ সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত হওয়া এবং শয়তানের পথকে বেছে নেয়া। এমন পথভ্রষ্ট ব্যক্তি শয়তানের সৈনিকে পরিণত হয়। দেশে এমন পথভ্রষ্ট ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়লে প্লাবন আসে দুর্বৃত্তির। তাই যে কোন রাষ্ট্র বা সমাজে সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্তি হলো সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে কাউকে দূরে সরানো। সেটি যেমন ব্যক্তির দ্বারা হতে পারে, তেমনি রাষ্ট্রের দ্বারাও হতে পারে। পথভ্রষ্ট করার কাজে রাষ্ট্র জড়িত হলে তখন সে বিদ্রোহের সাথে সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িত হয়। তখন রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ লোক-লস্কর সে অপরাধে নিয়োজিত হয়। রেডিও-টিভি ও পত্র-পত্রিকা তখন শয়তানের কণ্ঠে পরিণত হয়। দেশ তখন দুর্বৃত্তির পথে দ্রুত এগোয়, এমনকি দুর্বৃত্তিতে দ্রুত বিশ্বরেকর্ডও গড়ে। দূর্বৃত্তিতে বাংলাদেশের বিশ্বে ৫ বার প্রথম হওয়ার কারণটি এ নয় যে, দুর্বৃত্তরা দেশের মাঠ-ঘাট, গ্রাম-গঞ্জ ও বন-জঙ্গল দখলে নিয়েছে। বরং তাদের দখলে গেছে দেশের রাজনীতি, পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, আইন-আদালত, রেডিও-টিভি ও বুদ্ধিবৃত্তি। জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে নেমেছে কখনো সামরিক বাহিনী, কখনো বা রাজনৈতিক দল। সন্ত্রাসের অর্থ রাজনৈতিক লক্ষ্য হাছিলে অস্ত্রের ব্যবহার। সেনাবাহিনী সাংবিধানিক ভাবে একমাত্র দেশের প্রতিরক্ষার স্বার্থে অস্ত্রের বৈধ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু সে অস্ত্র যখন ব্যবহার হয় জনগণকে সন্ত্রস্ত্র করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে নেয়ায় -তখন সেটি জনগণের বিরুদ্ধে নিরেট সন্ত্রাস। ফলে প্রতিটি সামরিক অভ্যুত্থানই হলো সন্ত্রাস। বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী সে সন্ত্রাস করেছে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে। তেমন রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় গিয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী, রক্ষিবাহিনী ও RAB কে জনগণকে সন্ত্রস্ত্র করে এবং দেশের উপর দখল নেয় তখন সেটিও নিরেট সন্ত্রাস। প্রতিটি দেশে এরূপ সন্ত্রাসী হলো স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিবাদীগণ। এ বিচারে শেখ মুজিব যেমন সন্ত্রাসী, তেমনি সন্ত্রাসী হলো শেখ হাসিনা। 

নামাজের সময় হলে প্রতিটি মুসলিমকে নামাজ পড়তে হয়। এবং রোজার মাস এলে রোজা রাখতে হয। নইলে সে কাফির  হয়। ইবাদতের এ অঙ্গণে কোন আপোষ নেই। তেমনি কোন মুসলিম যখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পায় তখন তার দায়িত্ব হয় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূল। সে মিশন নিয়ে কাজ না করলে কি মুসলিম বলা যায়? অথচ শেখ মুজিব ও তাঁর দল করেছে উল্টোটি। গাজী গোলাম মোস্তাফার (মুজিবামলে ঢাকা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশ রেডক্রসের সভাপতি ছিলেন এবং রিলিফের মাল লুণ্ঠনে তার দুর্নীতি বিশ্বময় প্রচার পেয়েছিল) ন্যায় বহু লক্ষ দুর্নীতিপরায়ন অপরাধীর জন্য তিনি রাস্তা অবাধ খুলে দিয়েছেন। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ দূরে থাক, ইসলামের নামে সংগঠিত হওয়াকেও মুজিব আইন করে নিষিদ্ধ করেছিলেন। এটি ছিল আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে তিনি রক্ষিবাহিনী গড়েছিলেন, এবং তাদের হাতে তিনি অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। আর এখন সে মুজিবী নীতির অনুসরণ করছেন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ও বাকশালীরা অনুসারীরা। তবে পার্থক্য হলো,এখন মুজিবের সে রক্ষিবাহিনীটি নেই। তবে রক্ষিবাহিনী কাজটি করছে সশস্ত্র দলীয় ক্যাডারগণ –সেটি যেমন পুলিশ ও RAB’য়ের পোষাকে তেমনি সাদা পোষাকে।

ধর্ম পালনে কোন জবরদস্তি নেই। ইচ্ছা করলে কেই কাফির  হতে পারে, মুনাফিকও হতে পারে। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীদেরও ছিল। কিন্তু অন্যদের ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের মিশন থেকে রুখার অধিকার তাঁর ছিল না। অথচ সে কাজটিই করেছেন শেখ মুজিব। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পেয়ে সে গর্হিত কাজে তিনি বল প্রয়োগ করেছেন। তার যুদ্ধ ছিল মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। শরিয়তী বিধানে এটি শাস্তি যোগ্য গুরুতর অপরাধ। মুসলিম রাষ্ট্রে এমন অপরাধ সরকার প্রধানের দ্বারা হলে তখন দ্রুত নীচে নামে সমগ্র দেশ। মুজিবের সে ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশের অর্জনটি তাই অতি অপমানকর। দেশটির হাজারো বছরের ইতিহাসে এমন ব্যর্থতার নজির নেই। অতীতে শায়েস্তাখানের বাংলাদেশ রেকর্ড গড়েছিল শান্তি ও সমৃদ্ধিতে। অথচ মুজিব দেশটিকে তলাহীন ঝুড়িতে পরিণত করেন। শুধু অর্থনীতিতে নয়, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও। চোর-ডাকাত বাংলাদেশের মাটিতে আজকের ন্যায় শত বছর আগেও ছিল। তাদের হাতে প্রতিবছর বহু শত বাড়ি লুটপাটও হয়েছে। কিন্তু তাতে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ার অপমান জুটেনি। কারণ রাষ্ট্র তখন অপরাধী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। কিন্তু শেখ মুজিব সন্ত্রাস, লুটপাট, দুর্নীতি, নির্যাতন ও  হত্যার ফ্যাসিবাদী রাজনীতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেন। ফলে বৃদ্ধি পায় শেখ মুজিবের অপরাধের সামর্থ্য। একারণেই তাঁর একার অপরাধ বাংলাদেশের সকল অপরাধীদের অপরাধের চেয়েও অধিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজকের অপরাধীরা অগ্রসর হয়েছে বস্তুত তাঁর ঐতিহ্য ধরেই। মুজিবের পথ ধরেই অগ্রসর হচ্ছেন শেখ হাসিনাও। আজকের ব্যর্থতাও মূলত মুজিব আমলের ব্যর্থতারই ধারাবাহিকতা। তাছাড়া মুজিবের পথ ধরে বহু কোটি বাঙালী আগামীতেও মিথ্যবাদী হবে, ফ্যাসিবাদী হবে ও গুম-খুন-সন্ত্রাসে প্লাবন আনবে। এভাবেই তারা জাহান্নামের পথ ধরবে। এটিই হলো শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার গুনাহে জারিয়ার রাজনীতি। কথা হলো, মিথ্যা, দুর্বৃত্তি ও ফ্যাসিবাদের এরূপ জয়জয়াকার নিয়ে কি কোন জাতি সভ্যরূপে গড়ে উঠতে পারে? একবার নয়, হাজার বার নির্বাচন হলেও কি এ সমস্যার সমাধান হবে? বিবেকহীনতা ও নীতিহীনতার সমাধান তো নির্বাচন নয়। 

 

তান্ডব অসভ্যতার ও অরণ্যের অরাজকতা

শিকার ধরার পর নিহতের লাশটি কোন পশুই ড্রেনে ফেলে না। ধর্ষণে পশুরা সেঞ্চুরিও করে না। এক লাশের বদলে বিপক্ষের দশ লাশ ফেলে না। যাত্রীভর্তি বাসে আগুন দেয় না। পশুরা শিকার ধরে শুধু বেঁচে থাকার স্বার্থে, ক্ষুধা মিটে গেলে অন্য শিকার ধরে না। তাই জঙ্গলে লাশ পড়ে থাকে না। কিন্তু যুদ্ধ ছাড়াই বাংলাদেশে লাশের ছড়াছড়ি। শেখ মুজিব একাই তার শাসানামলে বহু হাজার লাশ ফেলেছিলেন। শেখ মুজিব বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের কথাবলা, লেখালেখী ও রাজনীতির স্বাধীনতা যেমন দিতে চাননি, তেমনি দিতে চাননি বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। শেখ হাসিনা নিজেও লাশ ফেলার রাজনীতি করছেন জোরেশোরে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন এক লাশের বদলে দশ লাশ ফেলার। গণহত্যা চালিয়েছে শাপলা চত্বরে। শত শত লাশ ফেলেছে জাসদ ও তার গণবাহিনী। শ্রেণী শত্রু নির্মূল ও সর্বহারার রাজনীতির নামে বহু হাজার লাশ ফেলছে মার্কসবাদী সন্ত্রাসীরা। পিলখানায় ৫৭ জন অফিসারসহ ৭৪ জনকে লাশ বানিয়েছে সেপাইরা। বার বার লাশ পড়ছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে। বার বার সেটি হচ্ছে রাজনৈতিক মিছিলে। বহু মানুষ মারা যাচ্ছে বাসের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাস পূর্ণ হচ্ছে এরূপ গ্লানিকর ব্যর্থতা দিয়ে। কিন্তু দেশের পত্র-পত্রিকায়, টিভি আলোচনায়, নাটকে ও সিনেমায় বা পাঠ্যপুস্তকে এ ব্যর্থতার কোন আলোচনা নেই। বিস্ময়ের বিষয় হলো, এসব ব্যর্থতা চেপে রেখে দেশকে যারা তলাহীন ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত করলো, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বানালো এবং প্রতিষ্ঠা দিল নৃশংস ফ্যাসিবাদ -তাদেরকে বাংলার ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ রূপে চিত্রিত করা হচ্ছে।

সমাজে যখন দুর্বৃত্ত বা পাপাচারীরা বিজয়ী হয় তখন তাদের দুর্বৃত্তি ও পাপাচারের নিন্দা হয় না, বরং প্রশংসিত হয়। ডাকাতপাড়ায় এজন্যই ডাকাতি কর্মের নিন্দা হয় না। পতিতাপল্লীতে তেমনি নিন্দিত হয় না অশ্লিলতা, দেহব্যবসা ও ব্যভিচার। বরং পাপাচার-কবলিত সমাজে পাপাচারের নেতা-নেত্রীগণ বরং বীর বা বীরাঙ্গনা রূপে চিত্রিত হয়। নমরুদ, ফেরাউন, আবু জেহেল ও আবু লাহাবের মত দুর্বৃত্তগণ তো সে কারণেই নিজ নিজ দুর্বৃত্তকবলিত সমাজে নেতা রূপে সম্মান পেয়েছে। একই কারণে বাংলাদেশে নেতৃত্বের আসন পেয়েছে ইসলামবিরোধী দুর্বৃত্ত নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীগণ। শুধু রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানই তাদের দখলে যায়নি, দখলে গেছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও স্কুল-কলেজের শ্রেণীকক্ষ গুলোও। ইতিহাসের পাঠ্য বইগুলোতে তাই দুর্বৃত্ত নেতাদের কুকীর্তিগুলোকে গৌরবময় করে দেখানো হয়। 

জঙ্গলে কেউ নিহত হলে সে খুনের বিচার হয় না এবং খুনির শাস্তিও হয় না। কারণ জঙ্গলে আদালত নাই। সেখানে বিচারক, উকিল এবং পুলিশও নেই। এক পশু আরেক পশুকে ধরিয়ে দেয় না, সাক্ষিও দেয় না। একই রূপ অরণ্যের অরাজকতা নেমে এসেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে বহুশত আদালত আছে। বহু হাজার পুলিশ, বহু হাজার উকিল এবং বহুশত বিচারকও আছে। তাদের পালতে রাজস্বের বিশাল অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু দায়িত্ব পালনে তাদের সামর্থ্যটি কোথায়? সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে প্রকাশ, দেশে প্রতিদিন এগারো জন খুন হয়। কিন্তু দেশের আদালতগুলোর কয়েকশত বিচারক সবাই মিলে দিনে একজন খুনিরও কি শাস্তি দিতে পারছে? বিচার হচ্ছে রাজনৈতিক প্রয়োজনে। খুনি, চোর-ডাকাত ও সন্ত্রাসীগণ জনগণের শত্রু, কিন্তু তারা সরকারের শত্রু নয়। ফলে তাদের বিচার নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। পুলিশ এবং আদালত ব্যস্ত সরকার বিরোধীদের দমনে। প্রকৃত খুনিরা তাই অভয় অরণ্য পেয়েছে বাংলাদেশকে। পিলখানা হত্যাকান্ডের খুনিদের গ্রেফতারে সরকার ঘটনার দিন কোন উদ্যোগই নেয়নি। ফলে দিন-দুপুরে রাজধানীর মধ্য দিয়ে শত শত খুনি অনায়াসে পালিয়ে যেতে পেরেছে, যেন তারা খেলা দেখে ফিরছে। দুষ্টের নির্মূল, ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ আছে এমন কোন দায়িত্বশীল সরকার কি অপরাধীদের গ্রেফতারে এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারে? পাশেই ক্যান্টনমেন্ট, সেনাবাহিনীকে বললেও তারা সমগ্র পিলখানা ঘিরে ফিলতে পারতো। সরকার নিজের গদিরক্ষায় সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়, কিন্তু ৫৭ জন সেনা অফিসারদের বাঁচানোর জন্য সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়নি। এটিকে স্রেফ সরকারের দায়িত্বহীনতা বললে ভূল হবে, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

অথচ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ে সরকারের কোন আলসেমী নেই। নানা বাহানায় বিপুল সংখ্যায় তাদের জেলে তোলা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলাও দায়ের হচ্ছে। সরকারের বিশেষ আক্রোশ ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে। একাত্তরে অস্ত্র ধরেছে, কাউকে খুন করেছে বা ধর্ষণ করেছে সে প্রমাণ পুলিশের কাছে নাই -এমন ব্যক্তিদের ধরে সরকার কাঠগড়ায় তুলছে। তাদের বিচারে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আদালত গড়ছে এবং বিচারক ও উকিলদের নিয়োগ দিচ্ছে। পুলিশ, প্রশাসন ও বিচারকগণের ব্যস্ততা সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ত্বরিৎ শাস্তি দেয়া নিয়ে। অথচ আজ যারা রাস্তায় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে নামছে, দিন-দুপুরে মানুষ খুন করছে, যাদের ছবি পত্রিকায় ছাপাও হচ্ছে, তাদের গ্রেফতার নিয়ে সরকারের কোন আগ্রহই নেই। সরকারের প্রায়োরিটি কোথায় সেটি বুঝতে কি এরপরও কিছু বাকি থাকে?

ডাকাতদের দস্যুতায় অনেকের ক্ষয়ক্ষতি হলেও তাতে জাতি বিপাকে পড়ে না। কিন্তু জাতি সংকটে পড়ে যদি রাষ্ট্র ছিনতাই হয় দুর্বৃত্তদের হাতে। বাংলাদেশ সেরূপ ছিনতাইকারীদের মুখে বার বার পড়ছে। এসব ছিনতাইকারীগণ কখনো বা সেনাবাহিনীর, কখনো বা রাজনৈতিক বাহিনীর লোক। কখনো বা ছিনতাই হয়েছে ভোটের মাধ্যমে, কখনো বা হয়েছে অস্ত্রের মাধ্যমে। যেমন বাকশালী মুজিব রাষ্ট্র দখলে নিয়েছিল ভোটের মাধ্যমে। অপরদিকে স্বৈরাচারী এরশাদ এসেছিল অস্ত্র হাতে নিয়ে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছে রাতে ভোট ডাকাতি করে। কিন্তু মানবাধিকার দলন, দুর্নীতি ও গণতন্ত্র হত্যায় এদের সকলের অপরাধই তো সমান। শেখ মুজিব কেড়ে নিয়েছিলেন বাকস্বাধীনতা এবং হত্যা করেছিলেন গণতন্ত্র। অথচ মানুষের ন্যূনতম মানবাধিকার শুরুই হয় কথা বলার অধিকার থেকে। সে অধিকারটুকু কেড়ে নেয়ার অর্থ হলো মানুষকে মানবতাশূণ্য করা। তিনি লুণ্ঠন করেছিলেন সভাসমিতি ও পত্রিকা প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাকশাল। একই অপরাধ করেছিল এরশাদ। মুজিবের বাকশালী দর্শন এবং এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারী দর্শনে কোন পার্থক্য নাই বলেই ২০০৮ সালে মুজিববাদী ও এরশাদপন্থীরা আবার একাকার হয়ে গেছে। জাসদ ও জাসদের গণবাহিনীর সন্ত্রাসও ভিন্ন ছিল না মুজিব এবং এরশাদের সন্ত্রাস থেকে। পিলখানায় যেরূপ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার চেয়েও ভয়ানক হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল কর্নেল তাহের, হাসানূল হক ইনু, আব্দুর রব, সিরাজুল আলম খান –এসব জাসদ নেতারা। সেপাহীদের বিল্পবের নামে পরিকল্পনা ছিল সেনাবাহিনী নির্মূলের। বহু অফিসারকে তারা হত্যাও করেছিল। গণবাহিনী গঠন করে হত্যা করেছিল বহু হাজার মানুষকে। এতবড় অপরাধের পরও তাদেরকের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং এরশাদের আমলে জাসদ গৃহপালীত বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। এরা সবাই একই ঝাঁকের কৈই; ফলে ঝাঁকের কৈই ঝাঁকে মিশতে অসুবিধা হয়না। তাদের সবার অপরাধ জনগণের বিরুদ্ধে।

 

বেড়েছে মাছিচরিত্রের মানুষ

কোন স্থান কতটা অস্বাস্থ্যকর সেটি পরিমাপের সবচেয়ে সহজ উপায়টি হলো, সেখানে মলমূত্র ফেললে কত দ্রুত কতটা মাছি উড়ে এসে বসে –সেটি দেখে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে আবর্জনা ফেললেও তাতে মাছি বসে না। কারণ, পরিচ্ছন্ন পরিবেশে মশা-মাছি জন্ম নেয়ার সুযোগ পায়না। সেখানে মশামাছি বেড়ে উঠার স্থানগুলো বেছে বেছে পূর্বেই নির্মূল করা হয়। মানুষের ভদ্র ও স্বাস্থ্যসম্পন্ন রুচি এভাবেই ধরা পড়ে। অথচ সেগুলি পরিচর্যা পায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। তেমনি দুর্বৃত্তকবলিত সমাজে বিপুল ভাবে বেড়ে উঠে দুর্বৃত্তরা, তারা দ্রুত সারিবদ্ধ হয় দুর্বৃত্ত নেতাদের পিছনে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিণত হয় তাদের অধিকৃত প্রতিষ্ঠানে। অথচ উন্নত সমাজে কঠিন হয়ে পড়ে দুর্বৃত্তদের বেড়ে উঠা। নির্মূল করা হয় দুর্বৃত্তদের প্রতিষ্ঠান। ফলে উন্নত সমাজে দুর্বৃত্ত স্বৈরাচারীগণ ভোট পায় না। যে দেশে সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, কম্যুনিস্ট, স্বৈরাচারীগণ ডাক দিলে হাজার হাজার মানুষ ময়দানে হাজির হয়, সেদেশের মানুষের চেতনা যে কতটা ঈমানশূণ্য ও অসুস্থ -সেটি বুঝতে কি বাকি থাকে? সাহাবাদের আমলের ইসলামী রাষ্ট্রে আবু জেহল ও আবু লাহাবের অনুসারী দুর্বৃত্তগণ বাজার পায়নি। বস্তুত একটি রাষ্ট্র কত্টা মানবতাশূণ্য ও দুর্বৃত্তকবলিত সেটি বুঝার জন্য পতিতাপল্লী, মদের দোকান, জোয়ার আড্ডা ও ডাকাত পাড়ার খরিদদারদের দিকে তাকানোর দরকার পড়ে না। প্রেসিডেন্ট ভবন, প্রধানমন্ত্রী ভবন বা মন্ত্রীপাড়ার দিকে নজর দিলেও সেটি সুস্পষ্ট বুঝা যায়। বুঝা যায় প্রশাসনের দিকে তাকালে। সেটি আরো বুঝা যায় নির্বাচনে দুর্বৃত্ত প্রার্থীগণ কতটা ভোট পায় -তা দেখে। দেহের তাপমাত্রা মাপার জন্য যেমন থার্মোমিটার, তেমনি একটি দেশের মানুষ মানবিক বা নৈতিক পরিচয়ে কতটা পিছিয়ে আছে সেটি মাপার মাপকাঠি হলো দুর্নীতি। যে দেশ দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয় সে দেশের জনগণের নৈতিকতার দুরবস্থা বুঝতে কি অন্ধেরও অসুবিধা হয়? বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের অসুস্থ নৈতিক পরিচয়টি একবার নয়, পর পর পাঁচবার বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে। এবং এখনো জানিয়ে দিচ্ছে নৃশংস স্বৈরাচার, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, বিচার বহির্ভুত হত্যার প্লাবন এনে। 

বাংলাদেশের মূল সমস্যা ভূমি, ভুগোল বা জলবায়ু নয়, বরং মাছি চরিত্রের মানুষ। এদের সংখ্যাটি বিপুল। দিন দিন সে সংখ্যা আরো দ্রুত বাড়ছে। আবর্জনার দিকে ছুটে যাওয়া থেকে মাছিকে রুখা যায় না, তেমনি মাছি চরিত্রের মানুষদের রুখা যায় না দুর্বৃত্তি, লোভ-লালসা ও স্বার্থশিকার থেকে। এরশাদের মত প্রমাণিত স্বৈরাচারী, দন্ডিত অপরাধী এবং চরিত্রহীন ব্যক্তি যেভাবে ৫ সিট নির্বাচিত হয় তাতে কি বুঝতে বাকি  থাকে বাংলাদেশের মুল সমস্যাটি কোথায়? একজন প্রমাণিত ভোটডাকাত যখন সভা-সমিতিতে মাননীয় ও শ্রদ্ধেয় রূপে সম্মান পায় তখন কি বুঝতে বাকি থাকে মানুষের নৈতিকতা কতটা শূণ্যের কোঠায়? প্রশ্ন হলো, আজ  যদি মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কোন রাসূল কুর’আনের শরিয়তী বিধান নিয়ে বাংলাদেশে হাজির হতেন তবে ক’জন তাঁকে সমর্থন করতো? ক’জন তাঁর দলকে বিজয়ী করতো? ক’জন শরিয়তের পক্ষ নিত? আজ কোন নবী-রাসূল নেই, কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার সে কুর’আনী শরিয়ত তো রয়ে গেছে। সে শরিয়তী বিধানের প্রতিষ্ঠাকে ক’জন সমর্থন করছে? দেশের আদালতে তো বিজয়ী হয়ে আছে ব্রিটিশ কাফিরদের প্রবর্তিত কুফরি বিধান। মুসলিম রূপে বাংলাদেশীদের এ কি বিশাল ব্যর্থতা নয়? সে ব্যর্থতা নিয়েই বা হুশ ক’জনের? এ বিশাল ব্যর্থতা নিয়ে কেউ কি পরকালে সফলতা পাবে? করুণাময় মহান আল্লাহ তাঁর অনুগত ঈমানদার বান্দার ভূলত্রুটি মাফ করে দেন। কিন্তু যারা তার বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী –তাদেরকে তিনি মাফ করেন নাা। কারণ বিদ্রোহ কোন ভূল নয়, এটি ইচ্ছাকৃত গুরুতর অপরাধ। ফলে বিদ্রোহীদের শাস্তি দেয়াই তাঁর শাশ্বত সূন্নত। বেঈমানের সে বিদ্রোহটি সুস্পষ্ট ধরা পড়ে তার ইসলামবিরোধী রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দুর্বৃত্তির মাঝে।

বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা, টিভি, গল্প-উপন্যাস ও স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে ভুয়সী প্রশংসা করা হয় একাত্তরের চেতনার ধারকদের। সে চেতানধারীদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান রূপে জাহির করা হয়। কিন্তু সে বিশেষ চেতনাধারি ব্যক্তিবর্গ কারা? কি তাদের চরিত্র? তাদের কর্ম ও চরিত্র কি এখনো অপরিচিত? বাংলাদেশের ইতিহাসে কে প্রথম গণতন্ত্র হত্যাকারি? কে বাকশালী স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠাতা? কে ভারতের সাথে ২৫ সালা দাসচুক্তি করে? কার আমলে আসে চুরি-ডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও দুর্বৃত্তির জোয়ার? কার আমলে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ নেমে আসে যাতে বহু লক্ষ মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যায়? ৭ই নভেম্বরে সিপাহী বিপ্লবের নামে যারা সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা শুরু করেছিল তারাই বা কারা? রক্ষিবাহিনী, গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টির নামে হাজার হাজার মানুষকে নৃশংস ভাবে কারা হত্যা করেছে? স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে কারা গৃহপালিত বিরোধী দল সেজে গণতন্ত্রের সাথে মস্করা করেছে? কারা জেনারেল এরশাদ ও জেনারেল মঈনকে সমর্থন করেছে? কারা ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে গণহত্যা ঘটালো? ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে কারা দেশ জুড়ে ভোট ডাকাতি করলো? এরা কি রাজাকার ছিল? এ অপরাধীরাই কি একাত্তরের চেতনাধারী নয়? অপরাধীদের অনুসরণ করাও গুরুতর অপরাধ। অপরাধীগণ শুধু নিজেরা জাহান্নামে যায় না, যারা তাদের অনুসরণ করে তাদেরও জাহান্নামে নেয়। সে ভয়ানক বিপদ থেকে বাঁচার জন্যই কারা অপরাধী এবং কি তাদের অপরাধ –সেগুলির পাঠ দেয়াই প্রতিটি সভ্য দেশের রীতি। জনগণকে সাবধান করতেই মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে নমরুদ-ফিরাউন ও আদ-সামুদের ন্যায় বহু জালেমের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। অথচ বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে গণতন্ত্র, ইসলাম ও জনগণের শত্রুদের ইতিহাস আলোচিত হয়নি। বরং ইতিহাসের বইয়ে ভয়ানক অপরাধীদের বরেণ্য নায়ক রূপে চিত্রিত করা হয়।

প্রশ্ন হলো, দেশ-বিদেশের ভূগোল, জলবায়ু, জীবজন্তু বা কীটপতঙ্গের জীবনী পড়ানোর চেয়ে এ অপরাধী বাঙালি জীবদের প্রকৃত ইতিহাস পড়ানো কি বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়? হিংস্র পশুকে পশু, সাপকে সাপ, বিষকে বিষ রূপে না চিনলে বাঁচাটি নিরাপদ হয় না। তেমনি জাতির দুর্বৃত্তদের না চিনলে জাতিরও কল্যাণ হয় না। হিটলার, হালাকু, চেঙ্গিজ ও মীরজাফরদেরকে মহামানব রূপে চিত্রিত করা শুরু হলে সে জাতির সাধারণ মানুষও তাদেরকে অনুকরণীয় মডেল চরিত্র রূপে গ্রহণ করে। ছাত্ররা তখন তাদের মত হওয়াকে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন ভাবে। দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার পক্ষ থেকে বিষাক্ত সাপকে ভগবানের আসনে বসিয়ে কীর্তন গাওয়া শুরু হলে সাধারণ মানুষ তখন সে সাপকে পূজা দেয়া শুরু করে। বাংলাদেশে সে কাজটি প্রচণ্ড ভাবে হয়েছে। তেমন একটি প্রেক্ষাপটেই গণতন্ত্র-হত্যাকারী এক স্বৈরাচারী জাতির পিতা রূপে গৃহীত হয়েছে। এবং বিপুল ভোট পায় তাঁর অনুসারীরা। সমগ্র পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হওয়ার যে অপমানটি বাংলাদেশের জুটেছে, সেটি ভূমি বা জলবায়ুর কারণে নয়। বরং সে জন্য দায়ী দেশবাসীর রুগ্ন চেতনা, চরিত্র ও মূল্যবোধ। সে রুগ্নতাটি এসেছে রুগ্ন চরিত্রের মানুষদের মডেল চরিত্র রূপে গ্রহণ করার কারণে। একাত্তরের চেতনাধারীরা এভাবে বিশ্বমঞ্চের মাঝে অপমানের মালা পড়িয়ে দিয়েছে।   

 

রোগ সর্বস্তরে এবং বিবস্ত্র বিশ্বের দরবারে

দৈহিক রোগ ব্যাথা, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা, পঙ্গুত্ব ইত্যাদি নানা সিম্পটম নিয়ে হাজির হয়। জাতির রোগ ধরা পড়ে নীতিহীনতা, বিবেকহীনতা, অপরাধ-প্রবনতা, মিথ্যাচার, স্বৈরাচার, সন্ত্রাস ও নানারূপ দুর্বৃত্তির মধ্যে। বাঙালির জীবনে সে রুগ্নতা আজ  ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারসহ ৭৪ জনকে যেভাবে ঢাকার পিলখানায় খুন করা হলো সেটি নিজেই কোন রোগ নয়, বরং সেটি বিবেক নিয়ে বেড়ে উঠতে না দেয়ার ন্যায় ভয়ানক নৈতিক অসুস্থতার লক্ষণ। অফিসারগণ কি অপরাধ করেছিল যে তাদেরকে খুন করে এবং দেহকে বিকৃত করে লাশগুলোকে পায়খানার নর্দমাতে ফেলতে হবে? বিগত দুই বিশ্বযুদ্ধে বহু কোটি মানুষেরই মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কোন রণাঙ্গণেই এত অফিসারকে একদিনে প্রাণ দিতে হয়নি। কোন শত্রু অফিসারকে লাশ হয়ে পায়খানার ড্রেনেও যেতে হয়নি। শত্রু বাহিনীর অফিসারের লাশের সাথে এমন অবমাননা হিটলারের সৈন্যরাও করেনি। বস্তুত পিলখানায় সেদিন শুধু লাশকে ড্রেনে ফেলা হয়নি, ড্রেনে ফেলা হয়েছে মানবতাকে। আর সেটি কোন দুর্বৃত্ত ডাকাতদের হাতে নয়। বরং তাদের হাতে যারা প্রতিদিন দেশবাসীর রাজস্বের অর্থে প্রশিক্ষণ পেয়েছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে। খুন, রাহাজানি বা সন্ত্রাসের ন্যায় জঘন্য অপরাধ কোন ভদ্র লোকালয়ে হলে বিপদগ্রস্তদের সাহায্যে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে। মানুষ খুন, ছিনতাই বা ধর্ষণ গরু-ছাগলের সামনে হলে তাদের ঘাস-পাতা খাওয়ায় তাতে ছেদ পড়ে না। উদ্ধারে তারা এগিয়েও আসে না। তেমনি একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন ঢাকায়। রাজধানীর কেন্দ্রে বহু ঘন্টা ধরে খুন, ধর্ষণ ও লুটতরাজ চললেও কোন নিরাপত্তা বাহিনীই সেদিন এগিয়ে আসেনি। অথচ যে কোন সভ্য দেশে কয়েক মিনিটের মধ্য উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছে যায়। অথচ সেদিন কেউ যায়নি। সরকারও কোন উদ্যোগ নেয়নি। বরং খুনিদের সাথে সরকার নিস্ফল আলোচনায় বসেছে। এই হলো বাংলাদেশের সরকারের পরিচয়! সরকার সেদিন তার অযোগ্যতা ও দায়িত্বহীনতা আড়াল করতে পারিনি। দায়িত্ব পালনে সরকারের অবহেলাই বড় অপরাধ। এমন একটি অপরাধী সরকার থেকে জনগণ কি আশা করতে পারে? 

লক্ষণীয় হলো, এমন বিবেকহীনতা যে শুধু পিলখানায় ঘটেছে তা নয়। এমন অপরাধ যে কিছু সেপাই, কিছু দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী এবং কিছু রাজনৈতিক ক্যাডারদের হাতে ঘটছে তাও নয়। বরং একই রূপ বিবেকহীনতা বিরাজ করছে তাদের মাঝেও যাদের হাতে অধিকৃত দেশের প্রেসিডেন্ট ভবন, প্রধানমন্ত্রী ভবন ও সংসদ ভবন। তাদের হাতে যে শুধু মানুষ হত্যা হয়েছে বা হচ্ছে -তাই নয়; পদদলিত হয়েছে এবং হচ্ছে ন্যূনতম মানবিক অধিকারও। এক্ষেত্রে ইতিহাসের সাক্ষ্যটি বড়ই করুণ এবং শিক্ষাপ্রদ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি রূপে যাকে প্রতিষ্ঠিত দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে তাঁরই হাতে সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবেচেয়ে জঘন্য অপরাধ। তাঁর হাতে নিহত হয়েছে গণতন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাকশালী নৃশংস স্বৈরাচার। জনগণের সামনে নেতাগণই হলো আদর্শ, তাদের কাছ থেকে কর্মীগণ পায় রাজনীতির দর্শন, রীতিনীতি ও সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক রাজনীতির রীতিনীতি ও সংস্কৃতি তাই কোন স্বৈরাচারী নেতা থেকে শেখা যায় না। খোদ দলীয় নেতাটি যখন বিরোধীদলের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেন, তখন তার দলের কর্মীগণ তো বিরোধীদের বেঁচে থাকাটিই অসম্ভব করে। বাংলাদেশে তো সেটাই ঘটছে। মুজিব-অনুসারীদের হাতে একারণেই ঢাকার রাস্তায় দাড়ি-টুপিধারিদের লগি-বৈঠা নিয়ে পিটিয়ে হত্যার মত ঘটনা ঘটেছে।

খুনিদের পক্ষ নেয়ার রুচি ভদ্রলোকের থাকে না, সেরূপ রুচি তো খুনিদের। যে কোন সভ্য দেশে সভ্য মানুষ মাত্রই খুনিদের শাস্তি চায়। এজন্যই জনগণের রাজস্বের বিপুল অর্থব্যয়ে আদালত বসে। সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব আদালতের বিচারকে দ্রুত, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ করা। কিন্তু সেরূপ রুচি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের যেমন নাই, প্রধানমন্ত্রীরও নাই। প্রধানমন্ত্রী নিজেই ভোট ডাকাত। দেশে বিচার থাকলে তার স্থান প্রধানমন্ত্রীর অফিসে নয়, জেলখানায় হত। খুনের মামলায় শাস্তিপ্রাপ্ত বহু অপরাধীর শাস্তি প্রেসিডেন্ট মাফ করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা তো এক লাশের বদলে দশটি লাশ ফেলতে বলেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজাপ্রাপ্ত খুনীর শাস্তি মাফ করতে বাধ্য করেছিলেন স্বৈরাচারী এরশাদকে। কারণ সাজাপ্রাপ্ত খুনিরা ছিল তার ছাত্রলীগের কর্মী। আশির দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ইটের উপর মাথা রেখে ইট দিয়ে মাথা থেথলিয়ে হত্যা করেছিল ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুইজন কর্মীকে। আদালতে সে অপরাধ প্রমানিত হয়েছিল এবং খুনিদের শাস্তিও হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার কাছে খুনিদের সে শাস্তি পছন্দ হয়নি। কারণ খুনিগণ তার অনুসারী। খুনিদের প্রতি শেখ হাসিনার দরদের সে ইতিহাস এবং তাদের মুক্তি নিয়ে তাঁর আপোষহীন আব্দারের কাহিনী লিখেছেন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান তাঁর আত্মকথামূলক বইতে। খুনিদের মাফ না করলে প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে আলোচনায় বসবেন নাসেটিই ছিল শেখ হাসিনার পূর্বশর্ত।

আওয়ামী বাকশালীদের সে বিবেকহীনতা শুধু শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার একার নয়। সে বিবেকহীনতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী। তারই ফল হলো, হরতাল সফল করতে আগুন দেয়া হয়েছে যাত্রীভর্তি বাসে। নিরীহ মানুষকে এভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররা বার বার লাশ হচ্ছে। মানুষ খুন হচ্ছে রাজপথে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামী নিরস্ত্র মিছিলকারীদের ১২ জনকে হত্যা করে তাদের লাশের উপর আওয়ামী বাকশালীদের নাচানাচির চিত্রও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। একই রূপ নৃশংস বিবেকহীনতা একাত্তরে দেখা গেছে বিহারীদের বিরুদ্ধে। হাজার হাজার বিহারীকে হত্যা করা হয়েছে, প্রায় ৬ লাখ বিহারীর ঘরবাড়ি, দোকানপাঠ ও ব্যবসাবাণিজ্যকে জবর-দখল করা হয়েছে। সে বর্বরতার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্য থেকে যেমন প্রতিবাদ উঠেনি, তেমনি প্রতিবাদ উঠেনি বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকেও। অথচ যে কোন সভ্যদেশে সেরূপ প্রতিবাদ উঠাটি কাঙ্খিত ছিল। একাত্তরের যুদ্ধের তান্ডব ১৬ই ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। কিন্তু শেষ হয়নি একাত্তরের চেতনাধারীদের নৃশংস তান্ডব। নর্দমার পাশে বস্তিতে বাস করে সে চেতনার স্বাক্ষর বিগত ৫০ বছরেরও বেশী কাল ধরে বিহারীরা বহন করছে। তবে রোগের ভাইরাস শুধু রুগ্নব্যক্তির দেহে সীমিত থাকে না, সেটি দ্রুত অন্যদের দেহেও প্রবেশ করে। রোগ তো এভাবেই দেশ জুড়ে ভয়ানক মহামারি ঘটায়। সেটি ঘটে নৈতিক বা চারিত্রিক রোগের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের নৈতিক সংকটটি তাই শুধু পেশাদার চোর-ডাকাত, খুনি ও সন্ত্রাসীদের মাঝে সীমিত নয়, তাতে প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক দেশবাসী। ফলে ডাকাতগণ ভোটডাকাতীর ন্যায় গুরুতর অপরাধও সমগ্র দেশজুড়ে এক রাত্রে সংঘটিত করতে পারে। তখন সহজ হয় দুর্নীতিতে বিশ্বে একবার বা দুই বার নয়, পাঁচবার প্রথম হওয়া। এমন দেশ কি বিশ্ববাসীর কাছে ইজ্জত পায়? ইজ্জত পাবে কি আগামী প্রজন্মের কাছে? তাঁরাও নাক সিটকিয়ে সেদিন বলবে, এতো খারাপ ছিল আমাদের পূর্ব পুরুষ? ১ম সংস্করন ০৭/০৪/২০১২; ২য় সংস্করণ ১৯/১২/২০২১; ৩য় সংস্করণ ২৭/০৬/২০২২।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *