অধ্যায় পঁচিশ: পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষ নেয়া ও জালেমের সমর্থন প্রসঙ্গ

গদির চেয়ে দেশ বড়

অনেকের যুক্তি, একাত্তরে পাকিস্তানের সমর্থনটি ছিল জালেমের সমর্থন। অতএব হারাম। তাদের কথা, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনী যেহেতু জালেম, দেশটিকে তাই বাঁচিয়ে রাখা যায় না। ফলে তারা সর্বশক্তি বিনিয়োগ করে পাকিস্তানের বিনাশে। এ যুক্তিতে ইসলামের শত্রুশক্তি বা কাফের শক্তির সাথে জোট বাঁধাটাও তাদের কাছে আদৌ দোষের মনে হয়নি। ফলে তারা ভারতকে ডেকে আনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। ভারত যে কাশ্মীরে তার অধিকৃতি বহাল রাখতে হাজার হাজার কাশ্মীরীদের হত্যা করছে, ও হাজার হাজার মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করছে -সে ভারতীয় জুলুম তাদের বিচারে আসেনি।

সাদ্দাম হোসেন অতি জালেম -এ যুক্তি দেখিয়ে একই ভাবে ইরাকের মার্কিন তাঁবেদার পক্ষটি নিজ দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে অনিবার্য করে তোলে। এভাবে ত্বরান্বিত করে দেশটির সর্বাত্মক ধ্বংস। জালেম হটানোর এমন মার্কিনী যুদ্ধে ইতিমধ্যেই দেশটির ৬ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। পঙ্গু হয়েছে ১০ লাখেরও বেশী। উদ্বাস্তুর বেশে দেশে-বিদেশে ঘুরছে প্রায় ৩০ লাখ ইরাকী। ফালুজা,রামাদি, তিকরিতের মত ইরাকের বহু শহর মাটিতে মিশে গেছে। এখনও সে নাশকতার কাজ পুরাদমে চলছে।

কোন ঘরেই বিষাক্ত সাপের প্রবেশ অস্বাভাবিক নয়। তবে আহাম্মকি হলো সে সাপের কারণে ঘরে আগুন দেয়া। ধৈর্য ধরলে সে সাপটি নিজেই সরে যেতে পারে। না সরলে সে সাপটিকে মারায় উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে ঘরের বিনাশ কি কোন সুস্থ মানুষের কাম্য হতে পারে? তাছাড়া স্বৈরাচারী জালেম শাসক চেপে বসেছে তো খোদ বাংলাদেশেও। তাই বলে কি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হবে? অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নেয়াকে যদি জালেমের পক্ষ নেয়া হয় তবে ভারতীয় অধিকৃতি ও বাকশালী স্বৈরাচারি মুজিবের পক্ষ নেয়াকে কি বলা যাবে?

বিষয়টি অভিন্ন দেশ থেকে জালেম শাসকের অপসারণের বেলায়ও। লড়াই তো দুর্বৃত্ত শাসকের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে নয়। দেশের বিরুদ্ধে লড়াই তো শত্রুর। তাই দেশপ্রেমিকদের লক্ষ্য,জালেম শাসককে হটানো, দেশের বিনাশ নয়। দল, নেতা বা গদির চেয়ে দেশ বড়। তাই স্রেফ ক্ষমতা দখলের স্বার্থে দেশ ধ্বংস করা যেতে পারে না। অথচ মুজিব সে লক্ষ্যে ১৯৭১য়ে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে অনিবার্য করেছে। নিজ দেশের মাটিতে ডেকে এনেছে ভারতের ন্যায় চিহ্নিত শত্রু শক্তিকে। মুজিবকে অবশ্যই এ অপরাধে আসামীর কাঠগড়ায় উঠতে হবে। ইসলামে মানুষ হত্যা দূরে থাক অনর্থক গাছের ডাল ভাঙ্গা বা পাতা ছেঁড়াও জুলুম। তবে মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ হলো একটি মুসলিম দেশের ভূগোলকে খণ্ডিত করা। ইসলামে এমন বিভক্তিকে বলা হয়েছে ফিতনা। এরূপ ফিতনায় শুধু মানব হত্যাই হয় না। মানব হত্যার সাথে সাথে গুরুতর ক্ষতিটি হয় মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা নিয়ে। তখন বাধা প্রাপ্ত হয় ইসলাম পালন ও ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা। বিপন্ন হয় কোটি কোটি মুসলিমের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা। যে ক্ষতির শিকা্র আজ ইরাক ও ফিলিস্তিনের মানুষ। বহু ক্ষেত্রেই সে বিপদটি আসে শত শত এমন হাজার হাজার বছরের জন্য।

আজ রোহিঙ্গাদের উপর যেরূপ হত্যা, ধর্ষণ ও ঘরবাড়ী থেকে উদ্বাস্তু হওয়ার মহা বিপর্যয় নেমে এসেছে তার কারণ তাদের পাশে কোন শক্তিশালী মুসলিম দেশ নেই্। এ সহজ সত্যটি বুঝতে হবে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি এই পাকিস্তানী ২৩ বছরে রোহিঙ্গাদের এমন বিপদ চাপিয়ে দিতে মায়ানমার কখোনই সাহস করেনি। তাদের জীবনে দুর্দশা শুরু হয়েছে তখন, যখন অতি দুর্বল এক বাংলাদেশ তাদের প্রতিবেশী রূপে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ তো তার নিজ সীমান্তে কাঁটাতারে ঝুলা নিজের নাগরিকদের ভারতীয়দের গুলিতে লাশ হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে না। মায়ানমারেরর বিমান বার বার বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করছে, ভারত সীমান্ত থেকে গরুবাছুর ও মানুষ ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারপরও কিছু করার সাহস পায় না। ফলে রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে আর কি করবে?

১৯৪৭য়ের বাংলার শেরেবাংলা, সহরোয়ার্দী, নাজিমূদ্দীনের ন্যায় নেতাগণ স্বৈরাচারি-বাকশালী মুজিবের চেয়ে অনেক বেশী দেশপ্রেমিক ছিলনে। তারা ক্ষুদ্র দেশ হওয়ার সে বিপদ বুঝতেন। ফলে তারা সেদিন অবাঙালীদের সাথে মিলে অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছেন। আর মুসলিম হওয়ার অর্থ তো নিজ ভাষা, নিজ ভূগোলের ক্ষুদ্রতা্র উর্ধ্বে উঠার সামর্থ্য।যার সে সামর্থ্য নাই সে নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করে কি করে? সে সামর্থ্য শেরেবাংলা, সহরোয়ার্দী, নাজিমূদ্দীনের ছিল। ফলে তারা সেদিন বিশ্বে সব চেয়ে বড় মুসলিম দেশ গড়তে পেরেছিলেন। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের তেমন কোন উল্লেখ নাই।

অথচ মুজিবের ছিল ভাঙ্গার সামর্থ, গড়ার নয়। ছিল ভারতে চর ও গোলাম হওয়ার সামর্থ্য। আর তাই নিয়েই বাকশালীদের গর্ব। যেন বাংলাদেশের ইতিহাসের শুরু ১৯৭১ বা বড়জোর ১৯৫২ সা্ল থেকে। এটি কি অস্বীকারের উপায় আছে যে, একাত্তরের শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে সৃষ্ট ফিতনার বিজয়ের কারণেই আজ বাংলাদেশে পূর্ণ ইসলাম পালন কঠিন হয়েছে। কঠিন হয়েছে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে এগুনোও। বরং বাড়িয়েছে ভারতের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকৃতি। এবং বেগবান হয়েছে জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজ।

দুর্বৃত্ত খুনিদের হাতে প্রতি দেশেই বহু মানুষ খুন হয়। বহু মহিলা ধর্ষিতাও হয়। কিন্তু এ জন্য কোন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়না। তাতে দেশও ধ্বংস হয় না। এরূপ হত্যা,ধর্ষণ ও জুলুম থেকে দেশবাসীকে বাঁচানোর দায়িত্ব দেশের প্রশাসন ও আদালতের। সংসদ, মিডিয়া বা রাজনৈতিক জনসভায় তা নিয়ে তুমুল আলোচনা হতে পারে। আন্দোলনও হতে পারে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়কে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে সে অভিযোগেরও নিস্পত্তি হওয়া উচিত ছিল দেশের আদালতে। সেটিই সভ্য সমাজের নীতি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পথে যায়নি। তারা বেছে নিয়েছে প্রকাণ্ড যু্‌দ্ধের পথ। এবং সে যুদ্ধকে দেশভাঙ্গার কাজে সফল করতে দেশের ভিতরে ডেকে আনে ভারতের ন্যায় একটি চিহ্নিত শত্রুদেশকে ।

 

ইয়াহিয়ার এজেন্ডা ও ইসলামপন্থীদের এজেন্ডা

২৫শে মার্চের পূর্বে ১লা মার্চ থেকেই ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীগণ প্রকাশ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। তাই একাত্তরে জুলুমের শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই। সেটি ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের নিজস্ব আশা-আকাঙ্খা, নিরাপত্তা ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচার বিরুদ্ধে। শক্তিশালী মুসলিম দেশ ও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের যে স্বপ্ন নিয়ে ইসলামপন্থীগণ এগুচ্ছিল আওয়ামী লীগের হামলা ছিল সেটির বিরুদ্ধে। আগ্রাসী শক্তির হাত থাকে এক ইঞ্চি ভূগোল বাঁচাতে প্রতিটি দেশের জনগণই প্রাণপণে যুদ্ধ লড়ে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের নানা দেশে ৭ কোটিরও বেশী মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তো সে ভূগোল বাঁচানোর যুদ্ধে। বৃহৎ ভূগোলের গুরুত্ব যে শুধু যে ইউরোপীয়রা বুঝে তা নয়। মুসলিম দেশের ভূগোল বাঁচানোর প্রতিটি যুদ্ধই ইসলামে জিহাদ। যারা সে জিহাদে মারা যায় ইসলাম তাদেরকে মৃত বলা হারাম। বলতে হয় শহীদ। আল্লাহতায়ালার কাছে তারা এতোই প্রিয় যে মৃত্যুর পরও তিনি তাদেরকে খোরাক দিয়ে থাকেন। উমাইয়া,আব্বাসীয় ও উসমানিয়া আমলে বহু জালেম ব্যক্তি খলিফা হয়েছেন। কিন্তু তাদের কারণে জিহাদের ন্যায় ফরয ইবাদত থেমে থাকেনি। যেমন বন্ধ থাকেনি নামায-রোযা, হজ-যাকাত। মুসলিমগণ জিহাদ করেছেন। শহীদও হয়েছেন।

কোন দেশের সব মানুষই কি একই রূপ চেতনার অধিকারি হয়? প্রতি দেশেই ভিন্ন ভিন্ন চেতনার মানুষেরা বিভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে বাস করে। স্বৈরাচারী জেনারেল ইয়াহিয়ার এজেন্ডাকে তাই ইসলামপন্থীদের উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। সে সময় ইসলামপন্থীদের এজেন্ডা ছিল মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ সংরক্ষণ। সে লক্ষ পূরণে তারা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতার সংরক্ষণ। অথচ মুজিব বা তার দল আওয়ামী লীগ ইসলামে এতোটাই অঙ্গীকারশূন্য ছিল যে,পাকিস্তানের খণ্ডিতকরণ বা দেশটির বিনাশ তাদের কাছে অন্যায় বা জুলুম মনে হয়নি। বরং চিহ্নিত শত্রুর সাথে কোয়ালিশন গড়ে দেশটির বিনাশে লেগে যায়। তাতে সফলও হয়েছিল। সে সফলতা প্রচণ্ড উৎসব বয়ে এনেছিল দিল্লির শাসক মহলে। ভারতীয় লুণ্ঠনে সৃষ্ট তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি, ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এবং সে দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হলে কি হবে, আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের সবচেয়ে অহংকারটি ছিল পাকিস্তানকে খণ্ডিত করা নিয়ে। ফলে বাংলাদেশের জনগণের মুখে তারা হাসি ফুটাতে না পারলেও দিল্লির শাসক মহলে আনন্দের প্লাবন সৃষ্টি করতে পেরেছিল। ১৬ই ডিসেম্বর প্রকৃত অর্থেই তাই ভারতীয়দের উৎসবের দিন। ভারতীয়দের সাথে নিয়ে সে উৎসবটি জায়েজ করতেই বাঙালী জাতীয়তবাদীগণ অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নেয়াকে অপরাধ মনে করে।

গ্রন্থপঞ্জি

  • Sisson, Richard and Leo Rose (1990): War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California; Berkeley.
  • W. Chowdhury, 1974:  The Last Days of United Pakistan, C. Hurst & Company, London.

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *