সংস্কৃতির সংকট ও সুস্থ্য সংস্কৃতির নির্মাণ প্রসঙ্গ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

সংস্কৃতির পরিচয়

সংস্কৃতি বলতে আমরা কি বুঝি? সংস্কৃতির সুস্থ্যতা বা কদর্যতাই বা কি? সুস্থ্য সমাজ, রাষ্ট ও ব্যক্তি গঠনে সংস্কৃতির গুরুত্বই বা কতটুকু? সুস্থ্য সংস্কৃতিই বা কি ভাবে নির্মিত হয়? সভ্যতার নির্মানে সংস্কৃতির গুরুত্বই বা কি? সাংস্কৃতিক সুস্থ্যতা নিয়ে যারা বেড়ে উঠতে চায় এবং নির্মান করতে চায় সভ্যতর সমাজ ও রাষ্ট্র, এমন প্রতিটি ব্যক্তির কাছে এ প্রশ্নগুলো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। রোগ কিসে হয়, স্বাস্থ্যই্ বা কি করে বৃদ্ধি পায় – এটুকু না জানলে নিজ দেহের উপর পদে পদে অবিচার হয়। স্বাস্থ্যজ্ঞান এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো সংস্কৃতির জ্ঞানও। সে জ্ঞান সুস্থ্যতা আনে রুচিবোধে। রুচির প্রকাশ ঘটে তখন পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, আনন্দ-উল্লাস তথা বাঁচার প্রতিটি আয়োজনে। তাই জ্ঞানার্জনের লক্ষ্য নিছক তথ্যদান হলে চলে না, সুস্থ্য-সংস্কৃতির নির্মাণ ও পরিচর্যায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হয়। জ্ঞানবান ব্যক্তির সংস্কৃতিবান হওয়ার সম্ভাবনতা তো এভাবেই বাড়ে।

সংস্কৃতির সংজ্ঞা নিয়ে নানা মনিষীর নানা মত। এ ভিন্নতা এসেছে জীবনে বাঁচার লক্ষ্য নিয়ে ধারণাগত ভিন্নতা থেকে। আমাদের বসবাসের পৃথিবীটা এক হলেও বাঁচবার লক্ষ্য সবার এক নয়। এক নয় চেতনার মানচিত্র। ফলে ভিন্ন হয় জীবনের স্বপ্নগুলোও। সে সাথে এজেন্ডাগুলোও। এ থেকেই ভিন্নতা সৃষ্টি হয় বাঁচার পথ ও পাথেয়তে। তখন পার্থক্য সৃষ্টি হয় সংস্কৃতি ও রাজনীতিতেও। মুসলিম থেকে একজন অমুসলিমের পার্থক্য এজন্যই বিশাল। সে পার্থক্য নিছক খাদ্য-পানীয়’তে নয়, বরং জীবনের সর্বত্র জুড়ে। জীবন ও জগতকে যেমন আমরা সবাই একভাবে দেখি না, তেমনি দেখি না সংস্কৃতির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেও। সংস্কৃতি এজন্যই সংজ্ঞায়ীত হয়েছে নানা ভাবে।

বাঁচার মধ্যে উচ্চতর বিবর্তন বা জীবনকে নিরন্তর রুচিশীল করার যে লাগাতর প্রক্রিয়া -সেটিই হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতি থেকে ব্যক্তি পায় কিভাবে সমাজে বাঁচতে হবে সে আদব বা শিক্ষা। একটি দেশের জলবায়ু, আবোহাওয়া ও ভৌগলিক প্রকৃতি নির্ধারণ করে সেখানে কি ধরণের উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল বাঁচবে। তেমনি একটি দেশের সংস্কৃতিও নির্ধারণ করে সেখানে কি ধরণের মানুষ বেড়ে উঠবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন নির্ধারণ করে জীবকুলের জৈবিক ভাবে বেড়ে উঠাটি, তেমনি সংস্কৃতিও নির্ধারণ করে নৈতিক বা মানসিক ভাবে বেড়ে উঠাটি। তাই এক অভিন্ন ভৌগোলিক পরিমন্ডল একই ধরণের গাছপালা ও পশুপাশির জীবনধারনের নিশ্চয়তা দিলেও তা একই ধরণের মানুষ গড়ে উঠার নিশ্চয়তা দেয়না। বাংলাদেশ তার উংকৃষ্ট উদাহরণ। জলবায়ু বা আবোহাওয়ার দিক দিয়ে পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য নেই। কিন্তু মানুষের জীবনবোধ, রুচিবোধ ও বাঁচবার উদ্দেশ্যে এতই পার্থক্য যে এক অখন্ড ভূখন্ডে বসবাসও তাদের জন্য অসম্ভব হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক ভাবে তাদেরকে পৃথক হতে হয়েছে।

মাছ যেমন পানিতে বেড়ে উঠে, মানুষও তেমনি বেড়ে উঠে নিজ নিজ সংস্কৃতির মাঝে। পানাহার কি হবে, কীরূপ হবে পোষাক-পরিচ্ছদ, কি ভাবে পরিচালিত হবে বিবাহ-শাদী ও ঘরসংসার, উপাস্য কে এবং কি ভাবে হবে তাঁর ইবাদত, প্রতিবেশীর  সাথে আচরণই বা কীরূপ হবে, কি ভাবে একজনকে স্বাগত বা বিদায় জানাবে -এরূপ অসংখ্য বিষয় একজন শিশু বিদ্যালয় থেকে শেখে না। শেখে আবহমান সংস্কৃতি থেকে। এজন্যই শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রামীন-শহুরে সবার জন্যই ভাল-মন্দ একটি সংস্কৃতি থাকে। তাই সহজ ভাষায় বলা যায়, মানুষ যেভাবে বাঁচে বা আচরণ করে -সেটাই তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির প্রসংঙ্গ এজন্যই মানব ইতিহাসে এতো গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই যারা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ চায় তারা শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব নিয়ে ভাবে না, ভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়েও। চায় নতুন সংস্কৃতির নির্মাণ। পুরোন পথ ছেড়ে মানুষ নতুন পথে অগ্রসর হোক সেটিও চায়। দেশের ধর্ম ও আদর্শ পাল্টে গেলে এজন্য সংস্কৃতিও পাল্টে যায়। এমন একটি প্রয়োজনেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে আবু লাহাব ও আবু জেহেলদের ন্যায় দুর্বৃত্ত নেতাদেরই শুধু নির্মূল করতে হয়নি, নির্মূল  করতে হয়েছিল তাদের অসুস্থ্য সংস্কৃতিকেও। শুরু করতে হয়েছিল সংস্কৃতির নতুন ধারা। তবে প্রতিটি সংস্কৃতিই নির্মিত হয় জীবন ও জগত নিয়ে জনগণের নিজস্ব ধারণা থেকে। তাই এক ভাষা ও একই ভূগোলে বাস করলেও ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে মানুষ বিভিন্ন বিপরীতমুখী সংস্কৃতির অনুসারি হয়। মুসলিমগণ সংস্কৃতির সে ধারণাটি পেয়েছে ইসলাম থেকে। শুধু ইহকালের নয়, পরকালের কল্যান-চিন্তার প্রভাব এ সংস্কৃতির নির্মাণে প্রবল। অপর দিকে পাশ্চাত্যে যেটি কাজ করেছে সেটি হলো নিছক ইহজাগতিকতা -যা সংজ্ঞায়ীত হয়েছে সেক্যুলারিজম রূপে। পরকালের ভাবনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। বরং প্রাধান্য পেয়েছে প্রবল বস্তুবাদী চেতনা। ফলে স্বেচ্ছাচারী-প্রবণতার প্রবল প্রভাব পড়েছে তাদের জীবন-উপভোগের পথ ও পাথেয়গুলোর উপর। বিলুপ্ত হয়েছে হারাম-হালাল এবং শ্লিল-অশ্লিলের সীমারেখা। ফলে সংস্কৃতি পূর্ণ হয়েছে ব্যাপক পাপাচারে। বাঁচার লক্ষ্য হয় বেশী বেশী আনন্দ ও উল্লাসের খোঁজে। আনন্দ খোঁজে নিজ ঘর ও দেশ ছেড়ে দেশে দেশে। এদের প্রয়োজন মেটাতেই বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছে সেক্সটুরিজম। ব্যাপকতর হয়েছে মদ, ড্রাগ, জুয়া, অবাধ সেক্স, উলঙ্গতার ন্যায় সকল আদিম পাপচার। এসব ভোগবাদীরা পানাহারের ন্যায় এ পাপাচার গুলোকেও অপরিহার্য ভাবে। চিত্রিত হয় তাদের নাগরিক অধিকার রূপে। এদের আনন্দের খোরাক জোগাতে এমন কি মুসলিম বিশ্বের কোণে কোণে গড়ে উঠেছে মদের দোকান, ক্লাব-ক্যাসিনো ও পতিতাপল্লী। যা কিছু আনন্দ দেয় তাদের কাছে তাই সিদ্ধ বা জায়েজ। শিষ্ট-অশিষ্ট, শ্লিল-অশ্লিল, জায়েজ-নাজায়েজ এসবের ধার তারা ধারে না। নিছক জৈবিক তাড়না মিটাতে পর্ণোগ্রাফি, চাইল্ড সেক্স ও হোমসেক্সুয়ালিটির জন্ম দিয়েছে এরাই। জগত জুড়ে এভাবেই বেড়েছে নৈতিক অসুস্থ্যতা। অথচ এদের কাছে এগুলিও সংস্কৃতি।

 

কেন সুস্থ্য সংস্কৃতি?

সভ্য মানুষ রূপে বাঁচা এবং উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণে সুস্থ্য সংস্কৃতির বিকল্প নেই। পানাহারে দেহ বাঁচে। এবং সংস্কৃতি শেখায় সভ্য হতে। তাই শুধু পানাহার ও ঘরাবাড়ীতে জৌলুস বাড়ালে চলে না, সভ্য ভাবে বাঁচতে সুস্থ্য সংস্কৃতিও নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু কীরূপে সে সুস্থ্য সংস্কৃতি? কি সে সংস্কৃতি নির্মাণের নীতিমালা? ক্ষুধা মেটাতে সবাই সব কিছু খায় না। খাদ্যের বেলায় কোনটি সিদ্ধ আর কোনটি অসিদ্ধ -তা নির্ধারীত হয় ধর্মীয় অনুশাসন থেকে। তেমনি নৈতিক দিক দিয়েও সব কিছু সিদ্ধ নয়। তবে কোনটি নৈতিক আর কোনটি অনৈতিক -সেটির নির্ধারনেও নির্ভূল মানদন্ড চাই। বিপুল ভোগ-সামগ্রীতেও জীবন যে সুখের হয় না -তার বড় প্রমাণ আজকের পাশ্চাত্য। এজন্যই মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হল সঠিক হিদায়েত বা দিকনির্দেশনা। খাদ্য-পানীয় তো পশুও পায়। তবে পশু যেটি পায় না সেটি হলো উত্তরোত্তর পরিশুদ্ধির বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য। পায় না সিরাতুল মুস্তাকীমের হিদায়েত। তাই পশুর দ্বারা সভ্যতর সমাজ নির্মিত হয়না।

তবে মানুষও যে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট হতে পারে ইতিহাসে সে প্রমানও প্রচুর। এবং সেটি হিদায়াত থেকে বঞ্চিত থাকা বা দূরে থাকার কারণে। যার জীবনে হেদায়াত নাই সে ব্যক্তি সম্পদশালীই হলেও দুর্ভাগা। অভাব সেখানে ন্যায়-অন্যায় বোধের ও সঠিক জীবন-নির্দেশনার। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কিতাব অবতীর্ন হয়েছে এবং নবী-রাসূলগণ এসেছেন তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে প্রয়োজনটি মেটাতে। ইসলাম তাই শুধু বিশুদ্ধ ধর্মই নয়, এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। ব্যক্তির পরিশুদ্ধি ও উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণে ইসলামই হলো একমাত্র রোডম্যাপ। যারা সে রোডম্যাপ পায়, তারাই পায় সভ্য রূপে বেড়ে উঠার সঠিক নির্দেশনা। তারা তখন নিজেদেরকে যোগ্যতর রূপে গড়ে তোলে জান্নাতের জন্য। এক্ষেত্রে ইসলামের অবদানের তূলনা হয় না। ইসলামের কারণেই নির্মিত হয়েছিল সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। মুসলিমগণ পেয়েছিল সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রূপে বেড়ে উঠার সংস্কৃতি। মানুষ তখন ফেরেশতাদের চেয়েও উপরে উঠেছিল। মুসলিমগণ আজ যে কারণে নিচে নামছে তার কারণ তাদের সংখ্যা বা সম্পদের কমতি নয়, বরং সেটি হয়েছে পূর্ণ ভাবে ইসলাম অনুসরণ না করার কারণে। তারা পরিণত হয়েছে পথহারা পথিকে। অপর দিকে পাশ্চাত্যবাসী আল্লাহতায়ালার সে নিয়ামতকেই অস্বীকার করেছে। ফলে অঢেল সম্পদও বাঁচাতে পারিনি বিভ্রান্তি থেকে। বাড়াতে পারিনি মনের শান্তি। বরং শান্তির খোঁজে আসক্ত হয়েছে মদ, হিরোইন, কোকেন বা গাঁজার ন্যায় মাদক দ্রব্যে। কোটি কোটি মানুষ ভূগছে মানসিক রোগে। আনন্দ খুঁজতে সমকামীয়তা, মদ্যপান এবং ব্যাভিচারের ন্যায় আদিম পাপাচারগুলিকেও বৈধতা দিয়েছে। গাধা যে দিকে যায়, গাধার পিঠের অন্ধ-আরোহীও সেদিকেই যায়। গাধাকে পথ দেখানোর সামর্থ্য অন্ধব্যক্তির থাকে না। একই অবস্থা নৈতীক-কম্পাসহীন পাশ্চাত্যের। তাদেরকে চালিত করছে জৈবিক তাড়না। যুগে যুগে এভাবেই নির্মিত হয়েছে অসুস্থ্য সংস্কৃতি। সংস্কৃতি পরিণত হয়েছে জনগণকে পথভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট ও দুর্বৃত্ত করার হাতিয়ারে। অভাব এখানে হিদায়েতের।  

 

 

দুষ্ট সংস্কৃতির তান্ডব

কোভিড, কলেরা, যক্ষা ও এইডস’য়ের ন্যায় সংস্কৃতিও প্রচন্ড ভাবে আগ্রাসী ও সংক্রামক। রাজনৈতিক শক্তির ন্যায় সংস্কৃতিও গ্রাস করে অপর দেশের সংস্কৃতি। রাজনৈতিক আগ্রাসনে লুন্ঠিত হয় পরাজিত জাতির সম্পদ। কিন্তু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে লুন্ঠিত হয় নৈতিক ও মানবিক সম্পদ। নষ্ট হয় চরিত্র। বিনষ্ট হয় আদর্শিক পরিমন্ডল বা আবোহাওয়া। তখন পরাজিত মানুষের পক্ষে নিজের মত করে বেড়ে উঠাটিও অসম্ভব হয়। অথচ নৈতিক সম্পদ একটি জাতির অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ কলকারখানা বা ক্ষেতখামারে গড়ে উঠে না। বরং গড়ে উঠে জাতির চেতনালোকে। সে সংস্কৃতির নির্মাণে কাজ করে ধর্ম বা আদর্শ এবং কাজ করে সে ধর্ম বা আদর্শের পতাকাবাহি অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী। যে কোন জীবন্ত ও সুস্থ্য জাতির জীবনে এ প্রচেষ্টা ক্রীয়াশীল থাকা শুধু কাঙ্খিতই নয়, অপরিহার্য। এবং সে প্রক্রিয়া কতটা সফল এবং কতটা কার্যকর -সংস্কৃতি সেটারই পরিমাপ দেয়। খনির অপরিশোধিত স্বর্ণখন্ড আর অলংকারের স্বর্ণ এক নয়, উভয়ের মাঝে যে পার্থক্য তার পশ্চাতে থাকে দীর্ঘ পরিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। তেমনি সভ্য মানুষ আর অসভ্য মানুষও এক নয়। এক নয় উভয়ের মাঝে আচার-আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ এবং বাঁচবার রুচিবোধও। এ পার্থকের মূলে থাকে একটি বিশুদ্ধ করণ প্রক্রিয়া। সংস্কারের এ ক্রীয়াশীল দীর্ঘ প্রক্রিয়াই হলো সংস্কৃতি। একটি জাতির সভ্যতর হওয়ার পিছনে এটিই হলো মূল।

কলকারখানার কাজ পণ্যসামগ্রীতে মূল্য সংযোজন ঘটানো। ফলে বাজারে তার কদর বাড়ে, মূল্যও বাড়ে। কিন্ত এ কলকারখানায় ব্যক্তির মূল্য বাড়ে না। বরং ব্যাক্তির জীবনে মূল্য সংযোজন ঘটায় একটি নির্ভূল ধর্ম বা আদর্শ এবং সে ধর্ম ও আদর্শের শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ। তাই জাতিকে সভ্যতার করার কাজে বিশুদ্ধ আদর্শ ও সে আদর্শের বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব অনেক বেশী। মহান আল্লাহতায়ালাও তাই বিজ্ঞান শেখাতে নবীরাসূল পাঠাননি। পাঠিয়েছেন মানুষের জীবন মূল্যমান বাড়ানোর একটি সঠিক প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে। যাতে মানুষ তাঁর সকল সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি রূপে বেড়ে উঠতে পারে। জীবনের সে মূল্যমানই ব্যক্তির আমলের ওজন বাড়ায়।

আরবীতে সংস্কৃতিকে বলা হয় তাহযীব। এ শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি গভীর দর্শন। সংস্কৃতির এটি এক দর্শনগত সংজ্ঞা দেয়। তাহযীবের অর্থ পরিশুদ্ধি করণ। অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো চির-ক্রিয়াশীল এক পরিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। পরিশুদ্ধির মাধ্যমে মানব জীবনে নিত্য মূল্য সংযোজনই এর মূল কাজ। বিভিন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসকারি মানুষের মাঝে যে গুণগত বিশাল তারতম্য সৃষ্টি হয় সেটি এ প্রক্রিয়ার সফলতা ও বিফলতার কারণে। মুসলিমদের দায়িত্ব হলো, এমন প্রক্রিয়ার নির্মাণে আত্মনিয়োগ করা। নইলে অসম্ভব হয় তার নিজের এবং সে সাথে আগামী প্রজন্মের পক্ষে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের থেকে আজকের মুসলিমদের যে বিশাল পার্থক্য তার মূল কারণ, ইসলামের সে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াটি মুসলিম দেশগুলিতে আজ আর সঠিক ভাবে কাজ করছে না। বরং শিকার এক সাংস্কৃতিক দুষ্ট প্রক্রিয়ার।  

 

সুস্থ্য সংস্কৃতির নির্মাণ প্রসঙ্গ

প্রশ্ন হলো কি সে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া? কি সে উপাদান যার ভিত্তিতে একটি জাতি অন্য একটি জাতি থেকে ভিন্নতর সংস্কৃতির জন্ম দেয় বা জীবনবোধে ভিন্নতর হয়? বলা হয়, মুসলিমগণ সংস্কৃতিতে অমুসলিমদের থেকে ভিন্নতর। কিন্তু কি সে ভিন্নতা? কেন সে ভিন্নতা? বিষয়টি বুঝতে হলে বুঝতে হবে, সংস্কৃতি হাওয়ায় নির্মিত হয় না। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সংস্কারের মূল প্রেরণা আসে ধর্ম বা আদর্শ থেকে। মুসলিম জীবনে সে ধর্ম বা আদর্শ হলো ইসলাম। ভাল-মন্দ, ন্যয়-অন্যায় নির্ণয়ে ইসলামই হলো মানদন্ড। সে মানদন্ডের ভিত্তিতেই একজন মুসলিম তাঁর বাঁচতে উচ্চতর রুচিবোধ পায়। তাঁর কর্মে ও বাঁচবার প্রক্রিয়ায় আসে গভীর পরিশুদ্ধি। ভমি, ভাষা, জলবায়ু বা গাত্রবর্ণ এমন একটি রুচিবোধ, চেতনাবোধ ও মানদন্ড দিতে পারে না। মানুষ উদ্ভিদ নয় যে ভূমি বা জলবায়ু থেকে তার বাঁচবার উপকরণ সংগ্রহ করবে। ব্যক্তির জৈবিক সত্ত্বার চেয়ে নৈতিক সত্ত্বাই মূল। এজন্যই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ্র সৃষ্টি। তার নৈতিক শিকড় পুষ্টিপায় আদর্শ থেকে, ভূমি বা জলবায়ু থেকে নয়। ফলে ভাষা, জলবায়ু, ভুগোল ও বর্ণ এক হওয়া সত্বেও বিভিন্ন ধর্ম ও আদর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম হয়। অভিন্ন আরব ভূমিতে একারণেই বিভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। বহুবিধ অনৈসলামিক সংস্কৃতির পাশে সেখানে জন্ম হয়েছে ইসলামি সংস্কৃতির।

সংস্কৃতির নির্মাণে ইসলাম বিপ্লব আনে ব্যক্তির বিশ্বাস, কর্ম, আচরণ ও রুচিবোধে। সে কাজে রাষ্ট্রের প্রতি প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা ও সামাজিক সংগঠন পরিণত হয় সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রীতে। চেতনা রাজ্যে বিপ্লব আনে কোর’আনী জ্ঞান। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র জুড়ে প্রতিষ্টিত হয় আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত পথে ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কারের প্রক্রিয়া। বিলুপ্ত করা হয় চেতনায় অপসংস্কৃতির দূষিতকরণ প্রক্রিয়া। একই ভাবে ভাবা, একই পথে চলা, একই উদ্দেশ্য বাঁচার প্রেরণা তখন মানুষে মাঝে গড়ে তোলে। সংস্কৃতি তখন সাধারণ মানুষের মাঝে সিমেন্টের কাজ করে। ভেদাভেদ ভূলে জনগণ তখন ঐক্যবদ্ধ উম্মাহতে পরিণত হয়। এরূপ এক সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার কারণেই হানাহানীর পরিবর্তে সেকালে মুসলিম সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সৌহার্দ-সম্পৃতি ও ইষ্পাত-দৃঢ় ভাতৃত্ব। ইর্ষা, ঘৃণা ও হানাহানীর স্থলে সংস্কৃতি রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল পরস্পরে সালাম তথা দোয়ার রীতি। এভাবেই সেদিন জন্ম নিয়েছিল শ্রেষ্ঠতম মানব সৃষ্টির সংস্কৃতি।

ইসলামকে বাদ দিয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠে সেটি আর যাই হোক মুসলিম সংস্কৃতি নয়। মুসলিম থেকে যেমন ইসলামকে পুথক করা যায় না, তেমনি তাকে পৃথক করা যায় না ইসলামি সংস্কৃতি থেকেও। সংস্কৃতি হলো ব্যক্তির ঈমান, দর্শন ও চেতনার প্রকাশ। ঈমান, দর্শন ও চেতনা দেখা যায় না, সেগুলো দৃশ্যময় হয় সংস্কৃতির মাধ্যমে। রোগের যেমন লক্ষণ থাকে, স্বাস্থ্যেরও তেমনি বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে। মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী -উভয়েরই সনাক্তকরণের কিছু লক্ষণও থাকে। আল্লাহতায়ালাতে যে অবিশ্বাসী তার জীবনের লাগাম থাকে জৈবিক প্রবৃত্তির হাতে। ফলে তার পোষাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও আমোদ-ফুর্তির মাঝে অশ্লিলতার প্রকাশ তাই স্বাভাবিক। কারো গায়ে অমুসলিম লেখা না থাকলেও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সেটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।

মুসলিমের প্রতিটি কর্ম ও চাওয়া-পাওয়ার উপর থাকে আল্লাহভীতির লাগাম। কি আনন্দ-উল্লাস, কি দুঃখ-বিষাদ –মুমিনের সব কিছুর উপর থাকে মহান আল্লাহতায়ালার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। মুসলিমের শোকপ্রকাশ ও উৎসবের প্রক্রিয়া এজন্যই অমুসলিম থেকে ভিন্নতর। শোকে-দুঃখে সে বলে ‘‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হি রা’জীযুন।’’ অর্থ: নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহতেই আমরা ফিরে যাবো। এটি পরিণত হয় তাঁর বাঁচবার মূল দর্শনে। কিন্তু অমুসলিমের মধ্যে সেটি থাকে না। বাংলাদেশে মুসলিম এবং অমুসলিম হাজার বছর পাশাপাশী বসবাস করলেও এজন্যই তাদের উভয়ের আনন্দ-উল্লাস বা উৎসব কখনই একই মোহনাতে মিলিত হয়নি। পানি ও তেলের ন্যায় আলাদাই রয়ে গেছে। বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে কারো স্মরণে দাড়িয়ে নীরবতা, বেদীমূলে বা ছবিতে মাল্যদানের যে সংস্কৃতি -সেটি অমুসলিমদের। সে সংস্কৃতি কোন কালেই মুসলিমদের ছিল না। মুসলিমগণ বরং মৃত ব্যক্তির মাগফেরাতে কল্পে দোয়া-দরুদের মজলিস বসিয়েছে। কবর জেয়ারত করেছে বা  গরীব মিসকিনদের মাঝে দান খয়রাত করেছে। এটিই হলো ইসলামি সংস্কৃতি। মৃতদের স্মরণে মুর্তি বা স্তম্ভ নির্মাণ, মুর্তি বা ছবিতে মাল্যদান এবং দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের যে সংস্কৃতি –তার প্রবক্তা ইসলামে অঙ্গিকারহীন সেকুলারিস্টগণ। কোন ঈমানদার নন। মুসলিমদের কাছে সংস্কৃতি যেমন বিনোদন নয়, তেমন আনন্দ-উল্লাসও নয়, এটি ঈমান নিয়ে বাঁচার প্রচেষ্টা। এটি তাই এবাদত।

 

নাশকতা অপসংস্কৃতির

পাশ্চাত্য বিপুল ভ্যালুএ্যাড তথা মূল্য-সংযোজন ঘটিয়েছে বিভিন্ন ধাতু বা পণ্য সামগ্রীতে। কিন্তু মূল্য-সংযোজনে ব্যর্থ হয়েছে মানব জীবনে। বরং ভয়ানক অবমূল্যায়নই ঘটিয়েছে। ফলে পাশ্চাত্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ বেড়ে উঠছে চরিত্রহীন লম্পট ও নৃশংস খুনী রূপে। ফলে নিত্য নতুন গাড়ীর মডেলের ন্যায় যোগ হচ্ছে গণহত্যার নতুন নতুন মডেল। লাম্পট্যও শিল্প রূপে উঠেছে। পশু তার শিকার ধরার আদিম কৌশলে কোন বিপ্লব আনেনি। বহু হাজার বছর আগে হিংস্র পশুরা যেভাবে শিকার ধরতো এখনো সে ভাবেই ধরে। অথচ মানুষ তার নৃশংসতাকে শিল্প রূপে গড়ে তুলেছে এবং সেটিকে বীভৎসতর করেছে। সে নৃশংসতায় যোগ হয়েছে পারমানবিক বোমা, ক্লাস্টার বোমা, মিজাইল, ড্রোন ইত্যাদি ভয়ংকর মারণাস্ত্র। পররাজ্য দখল, শোষণ প্রক্রিয়া, গণহত্যা, বর্ণগত নির্মূলে যোগ হয়েছে নতুন আধুনিকতা।

বস্তুত লাগাতর নীচে নামার পথটিই হলো অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতিতে মৃত্যু ঘটে বিবেকের। মানুষ তখন পশুর চেয়েও হিংস্র জীবে পরিণত হয়। পশু শিকার ধরে নিছক প্রাণ বাঁচাতে, এবং তা নিয়ে উৎসব করে না। কিন্তু মানবরূপী পশুগুলো অপরের ব্যাথা-বেদনা নিয়ে উৎসব করে। পরদেশ দখল, গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, নগর-বন্দর ধুলিস্যাৎ করণও তখন অহংকারে পরিণত হয়। ঔপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং দাসব্যবসা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে তো এরূপ অপসংস্কৃতির জোয়ার আসাতে। বিগত দুটি বিশ্ব যুদ্ধে তারা প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তো তেমনি এক উৎসব ভরে। অপসংস্কৃতির জোয়ারের বড় ক্ষতিটি হলো তাতে  মারা পড়ে নৃশংস জালেম ও তার জুলুমবাজীকে ঘৃনা করার সামর্থ্য। ফলে বসনিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, কাশ্মির, আরাকানে গণহত্যা হলেও সে বর্বরতার নিন্দা জাতিসংঘে হয় না, থামানোরও চেষ্টা হয়না। বরং জাতিসংঘ যাদের হাতে জিম্মি তাদের ইতিহাস তো নিরীহ নারী-পুরুষের মাথায় আনবিক বোমা, ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম এবং ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপের।

 

যে রায় ইতিহাসের

মানুষ গড়ার শিল্পে বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র যে ভয়ানক ভাবে ব্যর্থ হয়েছে –ইতিহাসের রায় তো সেটাই। কোন প্রকান্ড মহামারিতেও মানব জাতির এতটা ক্ষতি হয়নি যা হয়েছে মানবের নিজ হাতে। বিপদের আরো কারণ, মাহামারির ন্যায় মানবতা-বিধ্বংসী এ অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটছে সমগ্র বিশ্বজুড়ে। ফলে মানব জাতির আজকের সংকট শুধু বৃহৎ শক্তিবর্গের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য নিয়ে নয়, বরং সেটি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন নিয়ে। এতে ব্যাপক ভাবে মারা পড়ছে বিশ্বে জুড়ে মানবতা, নীতি-নৈতিকতা ও বিবেক। বাড়ছে নৃশংসতা, নগ্নতা, অশ্লিলতা, লাম্পট্য ও এইডস। কোটি কোটি মানুষ এতে মানবতা শূণ্য হচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যাটি তাই নিছক রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক। সংকট এখানে মানব রূপে বেড়ে উঠায়। ব্যর্থ হয়েছে চেতনা ও চরিত্রের পরিশুদ্ধ করণের প্রক্রিয়া। ফলে পৃথিবীর কোনে কোনে বাড়ছে ধ্বংসের আয়োজন। বাড়ছে দানবীয় পশু শক্তির প্রয়োগ। সমস্যাটি শুধু একটি দেশের নয়, বরং আন্তর্জাতিক। বরং এ সংকটটি সমগ্র মানব সভ্যতার। এ সংকটের সমাধান স্রেফ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তির উন্নয়নে নয়, বরং সুস্থ্য সংস্কৃতির নির্মাণে। এবং মানবকে মানব রূপে বেড়ে উঠার সুযোগ করে দেয়ায়। তবে এ সংস্কৃতির নির্মাণে জরুরি হলো মানব জাতির ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া। কারণ, সে ইতিহাসে যেমন আছে ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস তেমনি রয়েছে সফলতার ইতিহাসও। এবং সে সফতার ইতিহাস যে একমাত্র ইসলামে –ইতিহাসের এ রায় নিয়েও কি সন্দেহ আছে? ১ম সংস্করণ ০৮/০৪/২০০৭; ২য় সংস্করণ ০৪/০১/২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *