রাজনীতি যখন অপরাধের হাতিয়ার

একাকার অপরাধজগত ও রাজনীতি

ব্যক্তির ঈমান, বিবেক বা চেতনা দেখা যায় না। কিন্তু দেখা না গেলেও অজানা থাকে না। দেহের ত্রুটিকে পোষাকে ঢেকে রাখা গেলেও মনের রোগ লুকানো যায় না। সেটি দ্রুত প্রকাশ পায় ব্যক্তির কথা, কর্ম ও আচরনে। ধরা পড়ে ন্যায়কে ভালবাসা এবং অন্যায়কে ঘৃনা করার সামর্থের মধ্য দিয়ে। আল্লাহর আইনে মানুষ গুরুতর অপরাধি হয় ও জাহান্নামের যোগ্য হয় -শুধু মুর্তি পুজার কারণে নয়। আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের এটাই একমাত্র গুরুতর অপরাধ নয়। বরং সবচেয় বড় অপরাধটি ঘটে আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা তাদেরকে কাফের,জালেম ও ফাসেক বলে অভিহিত করে। সে অবাধ্যতার ঘটতে পারে “আমিরু বিল মারুফ ওয়া নেহী আনিল মুনকার” অর্থ “ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করো এবং অন্যায়কে প্রতিহত করো” এ কোরআনী হুকুমের অমান্য করার মধ্য দিয়েও। মু’মিন শাসক তাই ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধে আপোষহীন হয়। ন্যায়-অন্যায়ের সে সংজ্ঞাটি আসে শরিয়ত থেকে। জনগণ ও সরকারের ঈমানদারি হলো সে শরিয়তের পূর্ণ প্রতিষ্ঠায়। একাজে নিষ্ঠা না থাকলে বুঝতে হবে,ভয়ানক রোগ আছে ঈমানদারিতে। বার বার হজ-ওমরাহ বা নামায-রোযার মধ্য দিয়ে মুসলিম সাজা যায়, কিন্তু প্রকৃত মুসলিম হওয়া যায় না। মুসলিম হওয়ার অর্থ তো, সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের অনুগত হওয়া। এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠাবান হওয়া। সে দায়ভার যেমন জনগণের, তেমনি সরকারের। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে ভয়ানক বিদ্রোহ  ও গুরুতর অপরাধটি ঘটছে মূলতঃ এক্ষেত্রটিতে।

জঘন্য খুনি বা অপরাধী হওয়ার জন্য জরুরী নয় যে তাকে নিজ হাতে কাউকে খুন করতে হবে বা কোন অপরাধে জড়িত হতে হবে। স্বৈরাচারি ফিরাউন, হিটলার, শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনা কাউকে নিজ হাতে কাউকে খুন করেছেন -সে প্রমাণ নেই। কিন্তু হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের শাসন আমলে। এরূপ শাসকগণের চরিত্র হলো, তারা শুধু শিরক, ব্যাভিচার, সূদ-ঘুষ ও নাস্তিকতাতেই বৃদ্ধি আনে না, দ্রুত প্রতিষ্ঠা বাড়ায় ভয়ানক অন্যায়েরও। তারা অসম্ভব করেন ন্যায় বিচারকে। বাংলাদেশে অহরহ সেটিই ঘটছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কোন খুনের মামলা দ্রুত করার জন্য হুকুম দিয়েছেন সে প্রমান নেই, কিন্তু নাটোরের চাঞ্চল্যকর গামা হত্যা মামলায় ২০ ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ক্ষমা করে দিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার ফাঁসির আসামি বিপ্লবকে। ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক হত্যা মামলার ফাঁসির আসামি উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আহসান হাবীব ওরফে টিটুকেও। 

অপরাধ বিচাররোধের

ডাকাত পাড়ায় কখনোই ডাকাতের বিচার বসে না। বরং ডাকাতির নৃশংসতা ডাকাতদের মাঝে প্রশংসিত হয়। সেখানে বরং নিরীহ মানুষের পকেটে হাত দেয়া হয়। তেমনি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সদস্যদের অপরাধ –তা যত ভয়ানকই হোক, তার নিয়ে বিচার বসেনা। অপরদিকে হাজার হাজার মামলা রুজু করে জেলে পাঠানো হয় হাজার হাজার বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অপরাধীদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার মামলা করেছিল। সেগুলোও আদালতের মুখ দেখেনি, বরং ঢালাও ভাবে সেগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। পুলিশ ও আদালত নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করলে নিজদলীয় অপরাধীদের বিপদ। তাই অপরাধীদের দলীয় শাসন মজবুত করতে হলে অপরিহার্য হয় পুলিশ প্রশাসন  ও আদালতের গলায় রশি পড়ানো। এভাবে রুখতে হয় ন্যায়বিচারের। শেখ হাসীনা সেটি করেছেন তার পিতার দেখানো পথ ধরে। তিনি দেশের ৬৪টি জেলায় নিজ দলের প্রশাসক বসিয়েছেন যাতে তার দলের লোকেরা নিরাপত্তা পায়। তাই দেশে হাজার হাজার মানুষ খুণ হলে কিভাবে তাতে আওয়ামী লীগের কোন নেতার শাস্তি হয়নি। মুজিব আমলেও হয়নি। অথচ বহু স্থানে আাওয়ামী লীগ কর্মীরা বিরোধী দলীয় কর্মি ও নেতার খুণ ও গুম করার  সাথে জড়িত। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কর্মীরা দিনের বেলায় অস্ত্র হাতে বিরোধীদের ধাওয়া করেছে। বহু ক্ষেত্রে হামলাকারিদের ছবিও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ।অথচ তাদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ তাদের পাড়ায় বা গৃহে একবারও তদন্তে যায়নি।

শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতার বাইরে ছিলেন তখনও ন্যায় বিচারকে প্রতিহত করেছেন নানা ভাবে । আশির দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন ছাত্রকে ছাত্রলীগ কর্মীরা নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল। আদালতে তাদের বিচার হয়েছিল এবং শাস্তিও হয়েছিল। কিন্তু সে খুনের বিচার এবং খুনিদের সে শাস্তি তাঁর ভাল লাগেনি। এরশাদের সাথে যখন তাঁর প্রথম বৈঠক বসে তখন জিদ ধরেন, আলোচনার আগে শাস্তিপ্রাপ্তি খুনের আসামীদের মুক্তি দিতে হবে,নইলে কোন বৈঠক হবে না। তিনি যে ন্যায় বিচারের কতটা বিরোধী এবং খুনিদের মুক্ত করতে কতটা বদ্ধপরিকর -এ হলো তার নমুনা। দুর্বৃত্ত এরশাদেরও ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচারের প্রতি আগ্রহ ছিল না। তাঁর আগ্রহ ছিল শুধু নিজের গদীর দীর্ঘায়ু। তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন গণতন্ত্র হত্যার ন্যায় জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করে। এমন অপরাধি কি খুনীর শাস্তিতে আপোষহীন হতে পারে? ফলে স্বৈরাচারি এরশাদ সেদিন শেখ হাসিনার দাবী মেনে নিয়ে খুনিদের মুক্তি দিয়েছিল। সে বিবরণ লিখেছেন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর  রহমান খান তাঁর স্মৃতিচারণ বইয়ে।

অপরাধীগণ শুধু ডাকাত পাড়ায় সীমাবদ্ধ থাকলে সমগ্র দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়না। কিন্তু তা দেশময় ছড়িয়ে পড়লে বিপন্ন হয় শান্তি-শৃঙ্খলা। আর সেটি ঘটে অপরাধীরা ক্ষমতায় গেলে। তখন দারোয়ান থেকে কর্তাব্যক্তি পর্যন্ত সমগ্র প্রশাসনই অপরাধী হয়ে উঠে। বাংলাদেশে সেটিই ঘটেছে। ফলে ডাকাতদের এখন আর দল গড়ে রাতের আঁধারে হাওর-বাওর, গ্রাম-গঞ্জ ঘুরে ডাকাতি করার ঝুকি নিতে হয় না। বরং তাতে থাকে গ্রামবাসীর প্রতিরোধে প্রাণনাশের সম্ভাবনা। তারা এখন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সদস্য হয়ে দিন দুপুরে টেণ্ডার দখল করতে পারে। বনদখল, সরকারি জমি দখল, নদীদখল এবং চাঁদাবাজি করেও বিপুল অর্থ করতে পারে। এমন ডাকাতিতে যেমন অর্থলাভ প্রচুর, তেমনি সম্ভাবনা নেই প্রতিপক্ষের সামান্যতম প্রতিরোধের। বরং জুটে পুলিশ, র‌্যাব, সরকারি প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের সার্বিক সমর্থন। সে সাথে বাড়ে রাজনৈতিক নেতা হওয়ার গৌরব। ফলে অপরাধী কাছে প্রবল আকর্ষন বাড়ছে এমন রাজনৈতিক পেশার। একারণেই পেশাদার অরাজনৈতিক ডাকাতদের সংখ্যা যেমন দিন দিন কমছে, তেমনি দ্রুত বেড়ে চলেছে রাজনৈতিক ডাকাতদের সংখ্যা। আর এভাবেই বাড়ছে দেশজুড়ে অপরাধীদের দখলদারি। অপরাধ জগৎ আর রাজনীতির জগৎ যেন একাকার হয়ে গেছে। ফলে সরকারি দলের কর্মীরা কোনরূপ ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকুরি না করেই বাড়ি-গাড়ি ও বিপুল অর্থের মালিক হচ্ছে।

 

লক্ষ্য পিতার রেকর্ড ভাঙ্গা

দৈনিক “আমার দেশ” য়ের পরিসংখ্যানঃ ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর তিন বছরে দেশে ১২ হাজারেরও বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সে অনুযায়ী প্রতিদিন প্রায় ১১ জন করে খুন হয়েছেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫৯২ জন এবং আহত হয়েছেন ৪০ হাজার ১৯০ জন। চলতি বছর ইউপি নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। তবে পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ১০ হাজার ৬শ’ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৪২১৯ জন ও ২০১০ সালে ৪৩১৫ জন। খুনসহ ডাকাতি, দুর্ধর্ষ চুরি, অপহরণ, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, মাদক কেনাবেচাসহ ৫ লাখেরও বেশি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১ লাখ ৫৭ হাজার ১০৮টি, ২০১০ সালে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩৪টি ও চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ১ লাখ ৩৭ হাজার অপরাধের ঘটনা ঘটে। গত তিন বছরে শুধু রাজধানী ঢাকায় ৫ হাজার ৫৭৬টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী, সরকারের ২ বছর ১১ মাসে ৪ সাংবাদিক নিহত, ২৮০ সাংবাদিক আহত, ৮৮ জন লাঞ্ছিত ও ৯৫ জন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। পেশা গত দায়িত্ব পালনকালে ৪০ সাংবাদিকের ওপর হামলা, দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ ৩ জনকে গ্রেফতার, ১ জন অপহৃত ও ২৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। 

দেশে যেভাবে হত্যা-গুম-সন্ত্রাস ও দূর্নীতি বাড়ছে তাতে মনে হয় শেখ হাসিনা গোঁ ধরেছেন তিনি তাঁর পিতার রেকর্ড ভাঙ্গবেনই। বাংলাদেশের অতীতের অন্যদলীয় যে কোন সরকার এ প্রতিযোগিতায় তার ধারে কাছেও আসতে পারবে না। তাঁর পিতার আমলে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজারের মত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। গ্রেফতার হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ। হাজার হাজার মানুষকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। তবে যে হারে অপরাধ কাণ্ড চলছে তাতে শেখ হাসিনা আর দুই বছর ক্ষমতায় থাকলে নিজ পিতাকে অতিক্রম করে অপরাধ কর্মে রেকর্ড অতিক্রম করতে পারবেন। তবে অপরাধ জগতের একটি ক্ষেত্রে তিনি তাঁর পিতার রেকর্ডকে ইতিমধ্যে অতিক্রম করেছেন। সেটি শেয়ার বাজারের বিনাশ। তার পিতা শিয়ার বাজার বলতে কিছু গড়ে উঠতে দেননি। আর তিনি তার শাসনামলে দুইবার মড়ক লাগিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে যখন প্রথম বার ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখনও শেয়ার বাজারকে রশাতলে নিয়েছিলেন।

আদর্শঃ মুজিবের অপরাধের রাজনীতি                                                  
গণতান্ত্রিক শাসকের মূল কথা, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে সংসদ। সে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ সরকার গঠন করবে। কিন্তু দেশের প্রশাসন ও আদালত কাজ করবে নিরপেক্ষ ভাবে। স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রের এখানেই পার্থক্য। প্রশাসন ও আদালত -এ দুটি প্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে মৃত্যু ঘটে গণতন্ত্রের।  তখন প্রতিষ্ঠিত হয় দলীয় স্বৈরাচার। নির্বাচন তখন অর্থহীন হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের অপরাধ শুধু এ নয় যে, দলটির শাসনামলে দেশে হত্যা, গুম, সন্ত্রাস, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছিল। বরং গুরুতর অপরাধটি ঘটেছে গণতন্ত্র হত্যার মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র হত্যায় প্রতিপক্ষের নির্মূল সহজতর হয়। সহজতর হয় মানুষ হত্যা। স্বৈরাচারী শাসন অপরাধকর্মে যতটা আজাদী দেয়, গণতন্ত্র তা দেয় না। গণতন্ত্রে সরকারের দায়বদ্ধতা বাড়ে জনগণের কাছে। এমন ধরণের দায়বদ্ধতা নিয়ে শেখ মুজিবের কোন কালেই কোন আগ্রহ ছিল না। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ মুজিব ও তার দলের অপরাধ বহু, তবে গুরুতর অপরাধ এই গণতন্ত্র হত্যা। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে যা ঘটেনি, পাকিস্তান আমলে যা ভাবা যায়নি, সেটিই ঘটেছে মুজিবামলে। পাকিস্তান আমলে মুজিব বহুবার জেলে গেছেন, কিন্তু কোনবারই তাঁকে ডাণ্ডাবেড়ি পড়ানো হয়নি। পুলিশী রিমাণ্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়নি। কোন বারই তাকে লাশ হয়ে ফিরতে হয়নি। অথচ তাঁর উপর আগরতলা ষড়যন্ত্রের ন্যায় গুরুতর অভিযোগ ছিল। কিন্তু তার আমলে লাশ হয়ে ফিরেছেন শুধু মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরি ও বামপন্থি সিরাজ শিকদারই নয়, বহু বহু হাজার রাজনৈতিক কর্মি।

ফ্যাসীবাদকে বুঝতে হলে বুঝতে হয় হিটলারকে। তেমনি আওয়ামী লীগের আজকের রাজনীতি বুঝতে হলে বুঝতে হবে শেখ মুজিবকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ যা হচ্ছে তা মূলত মুজিবী আদর্শেরই বাস্তবায়ন। শেখ মুজিব নিজেকে গনতন্ত্রি বলে দাবী করতেন। কিন্তু সে গণতন্ত্রে অন্যদের প্রচার, দলগঠন ও  সভাসমিতি করার অধিকার ছিল না। তাদের উপর তিনি যে শুধু সরকারি পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছেন তা নয়, সরকারি বাহিনীর সাথে একযোগে কাজ করে দলীয় গুণ্ডা বাহিনীও। পুলিশের সাথে তারাও অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে রাজপথে নেমেছে। জনগণের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন একদলীয় বাকশালী সরকার গঠনের মাধ্যমে। তাঁর গণতন্ত্রে অন্যদের স্বাধীন ভাবে কথা বলা, লেখালেখি করা বা পত্রিকা বের করার অনুমতিও ছিল না। বন্ধ করেছিলেন সকল বিরোধী মতের পত্রিকা। সে গণতন্ত্রে  স্বাধীন আদালত ও প্রশাসন বলে কিছু ছিল না। প্রশাসন দখল করতে তিনি প্রতি জেলায় নিজ-দলীয় ব্যক্তিদের গভর্নর রূপে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আদালত ও প্রশাসনকে ব্যবহার করেছেন দলীয় এজেণ্ডা বাস্তবায়নে। আদালত থেকে বিরোধী দলীয় নেতাদের জামিন পাওয়ার পথ বন্ধ করেছিলেন। তাঁর আমলে হাজার হাজার মানুষ বিনা বিচারে বছরের পর জেলে থেকেছেন, এবং আদালত অনেককে নিছক পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষ নেয়ায় দীর্ঘ কারাবাসের শাস্তি শুনিয়েছে। ইসলামের পক্ষ নেয়াও অপরাধ গণ্য হয়েছে।আর প্রকাশ্য রাজপথে ঘুরেছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের চিহ্নিত খুনিরা। আজও  আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আদর্শ ও গর্ব শেখ মুজিবের সে বাকশালী স্বৈরাচার নিয়েই। হিটলারের প্রতি শ্রদ্ধার অর্থ তার ফ্যাসীবাদের প্রতি শ্রদ্ধা, তখন হিটলারের ভক্তদের রাজনীতি পরিনত হয় অন্যদের উপর নির্যাতন ও নির্মূলের হাতিয়ার রূপে। নিষ্ঠুর অপরাধীদের হাতে তখন অধিকৃত হয় পুলিশ, প্রশাসন,আদালত ও মিডিয়া। তখন লক্ষ লক্ষ্ ইহুদীর নির্মূল এবং বিরোধী রাজনীতি নিষিদ্ধকরণও তখন উৎসবযোগ্য গণ্য হয়। ফলে শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে বাকশালী স্বৈরাচার,অপরাধীদের শাসন ও বিরোধী কর্মীদের উপর নির্যাতন ও হত্যা নেমে না আসলে সেটি মুজিবী আদর্শ হয় কি করে? মুজিবের ভক্ত হওয়ার জন্য মুজিবের ন্যায় শুধু পোষাক পড়ল চলে না, বিরোধীদের নির্মূলে ও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে তার ন্যায় অপরাধীও হতে হয়। বাংলাদেশে আজ যে মুজিবী আদর্শের অনুসারিদের শাসন -তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে?

মুজিবী আদর্শের অনুসরণ বাড়বে অথচ অপরাধ বাড়বে না তা কি হয়?  সুন্দর মোড়কে মেকী জিনিষও মানুষের কাছে সহজে গছানো যায়। মুজিবের ন্যায় একজন অপরাধীর গায়ে “জাতির পিতা” ও “বঙ্গবন্ধু”র মোড়ক লাগানো হয়েছে সে একই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূরণে। এটে আওয়ামী লীগের দলীয় স্ট্রাটেজী যা তারা বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ে চাপাতে সমর্থ হয়েছে। শেখ মুজিবকে “জাতির পিতা” ও “বঙ্গবন্ধু” করে তারা মুজিবের স্বৈরাচারি আদর্শকেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে সমর্থ হয়েছে। হিটলারকে নেতা রূপে কবুল করার কারণে তার নিষ্ঠুরতাও তাই কোটি কোটি জার্মানীর সমর্থণ পেয়েছিল। একই কারণে মুজিবের বাকশালী স্বৈরাচার যত অমানবিকই হোক বাংলাদেশে সেটিও অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ফলে নির্বাচনে তাদের বিপুল বিজয়ও ঘটে। এবং সেটি তাঁকে “জাতির পিতা” ও “বঙ্গবন্ধু”র খেতাব দিয়ে জনগণের সামনে পেশ করার কারণে।

 

মূল লড়াইটি চেতনার মানচিত্রে

বাংলাদেশের বিপদ শুধু অপরাধীদের শাসন নয়, বরং বড় বিপদটি হলো বিপুল সংখ্যক মানুষের চেতনায় সে অপরাধীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। চেতনার এ এক ভয়ানক অসুস্থতা। এমন অসুস্থ্যতার কারণেই একজন মানুষ মানবতার ভয়ানক শত্রু ও প্রতিষ্ঠিত অপরাধীকেও “বন্ধু” বলতে পারে,এবং পুত্র না হয়েও তাকে “পিতা” বলে ভক্তি দেখাতে পারে। মুর্তিপুজা, লিঙ্গপুজা, গরুপুজা ও স্বর্পপুজা যত সনাতন অজ্ঞতা বা পাপাচারই হোক, দক্ষিণ এশিয়ার বুকে সে অজ্ঞতা বা পাপাচার নিয়ে কোটি কোটি মানুষ বেঁচে আছে –তা তো সে কারণেই। কোন ব্যক্তি যখন গরু,স্বর্প, মুর্তি ও লিঙ্গকে পুজা করে -তখন কি বুঝতে বাঁকি সে মানুষটির বিবেক বা চেতনা কতটা অসুস্থ্য? এমন গুরুতর অসুস্থ্যতা নিয়ে কি সে মানুষটি মহান আল্লাহতায়ার অস্তিত্বে বিশ্বাসী হতে পারে? সে কি ন্যায় ও সত্যের পক্ষ নিতে পারে? ইসলাম যত শ্রেষ্ঠই হোক তা কি এমন বিবেকশূণ্যদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়? পবিত্র কোরআনে এমন অসুস্থ্য বিবেকের মানুষদের মহান আল্লাহতায়ালা গবাদী পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছেন। গরুও আরেক গরুকে এবং স্বর্প আরেক  স্বর্পকে বা মুর্তিকে পুঁজা করে না। মানুষের বিবেক ও চেতনার মান পশু থেকেও যে কতটা নীচে নামতে পারে এ হলো তার নমুনা। হিটলারের মত অপরাধীরো ভোট পায় এবং ফিরাউনেরা ভগবান রূপে গণ্য হয়তো সে অসুস্থ্যতার কারণেই। মুজিবের ন্যায় স্বৈরাচারি অপরাধীকে যে মানুষটি “বন্ধু” ও “পিতা” বলে সম্মান দেখায়,এবং তাঁর আদর্শের প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিতে নামে,তখন কি বুঝতে থাকে তার বিবেকের অসুস্থ্যতা কত প্রকট? এমন মানুষ যাত্রী ভর্তি বাসে আগুণ দিবে বা লগি বৈঠা নিয়ে রাজপথে মুসল্লিদের হত্যায় নামবে তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে?

হিটলারের মৃত্যু হয়েছে,সে সাথে ফ্যাসবাদও জার্মানীতে কবরস্থ হয়েছে। হিটলারের ন্যায় অপরাধী সে দেশে আর সম্মান পায় না, বরং ঘরে ঘরে ধিকৃত হয়। এর ফলে বিদায় নিয়েছে তার অনুসারিদের শাসনও। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি ঘটেনি। শেখ মুজিব বিদায় নিলেও তার স্বৈরাচারি দর্শন ও রাজনীতি আজও  বেঁচে আছে। বরং তাঁর অনুসারিদের হাতেই দেশ আজ  অধিকৃত। এর ফলে বেঁচে আছে আওয়ামী অপরাধীদের শাসনও। দেশের মূল পরাধীনতা তো এখানেই। ফলে দেশকে যারা অপরাধমূক্ত এবং সে সাথে পরাধীনতামূক্ত দেখতে চায় তাদের সামনে লড়াই শুধু রাজনৈতীক নয়, বরং মূল লড়াইটি আদর্শিক। লড়াইটি হতে হবে চেতনার মানচিত্রে। জনগণের মগজে বাড়াতে হবে মুজিবের বাকশালী স্বৈরাচারকে ঘৃনা করার সামর্থ্য। তখন আওয়ামী অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনগণ পাবে ইম্যুউনিটি বা প্রতিরোধের ক্ষমতা। “বঙ্গবন্ধু” বা “জাতির পিতা” বলে গণতন্ত্রের দুষমনকে সম্মান দেখালে চেতনায় সে মূক্তি ঘটে না, বরং ভয়ানক ভাবে বাড়ে অপরাধীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও অধীনতা।মানুষের কথার মধ্য দিয়ে তার ঈমান কথা বলে। আল্লাহর উপর ঈমান এ অনুমতি দেয় না, যে ব্যক্তি ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে সকল ইসলামী দলকে নিষিদ্ধ করলো,কোরআনের শিক্ষাকে সংকুচিত করলো এবং মানবিক অধিকারকে সংকুচিত করলো তাকে সে “দেশের বন্ধু” বা “জাতির পিতা” রূপে মেনে নিবে।  সে তো বরং এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়াইকে জিহাদ রূপে গণ্য করবে। ইসলামের জিহাদ শুধু কাফেরদের বিরুদ্ধে নয়, বরং সর্বপ্রকার অপরাধীদের বিরুদ্ধেও। কোরআনে বর্নিত “ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের উৎখ্যাত” হলো সে জিহাদের মূল কথা। মুসলমান হওয়ার এ এক অনিবার্য দায়বদ্ধতা। ১৬ কোটি মুসলমানের দেশে সে জিহাদ যে হয়নি তার প্রমাণ হলো অপরাধীদের এ শাসন। তাই এ ব্যর্থতা নিছক কোন ব্যক্তি বা দলের নয়, সেটি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলমানের।  ০৬/০১/২০১২

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *