মানবসৃষ্টি নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার প্রকল্প ও বাঙালি মুসলিমের গাদ্দারী ও ব্যর্থতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

একটি জনগোষ্ঠির ব্যর্থতার শুরুটি চাষবাদ, ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প ও অর্থনীতি থেকে শুরু হয় না। বরং শুরু হয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে। তেমনি উত্থান ও গৌরবময় জীবনের শুরুও হয় শিক্ষা থেকে। তাই সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা প্রথম মানব হযরত আদম (আ:)কে সৃষ্টি করে শুধু তাঁর পানাহারের ব্যবস্থাই করেননি,  সে সাথে ব্যবস্থা করেন তাঁকে জ্ঞানদানেরও। সে জ্ঞানের কারণেই তিনি ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর বিবেচিত হন। এবং ফিরেশতাদের হুকুম দেয়া হয় তাঁকে সিজদা করার জন্য। এভাবেই সেদিন তিনি বুঝিয়ে দেন, মানুষের মর্যাদা তার দেহের গুণে নয়, বরং জ্ঞানের কারণে। এবং অজ্ঞতাই যে মানবের পতন, ব্যর্থতা ও বিপর্যয়ের কারণ -সেটিও সেদিন জানিয়ে দেন।  

একটি জাতির নানারূপ ব্যর্থতা ও বিপর্যয় দেখে নিশ্চিত বলা যায়, সে জাতির জনগণের জ্ঞানার্জনের কাজটি সঠিক ভাবে হয়নি। মানব সন্তানের মৌলিক অধিকার শুধু পানাহার, বাসস্থান ও চিকিৎসা নয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হলো জ্ঞানলাভ। তাই কাউকে অনাহারে রাখা যেমন ভয়ানক অপরাধ, সেরূপ ভয়ানক অপরাধ হলো কাউকে অজ্ঞ বা জাহেল রাখাও। অথচ বাংলাদেশে সে অপরাধটি সংঘটিত হচ্ছে কোটি কোটি মানব সন্তানের বিরুদ্ধে। অবিরাম গণহত্যা হচ্ছে কোটি মানুষের বিবেকের ভূমিতে। অথচ সে অপরাধ নিয়ে কোন ভাবনা নাই।

মানব যে মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি -সে বিশেষ ঘোষণাটি তিনি সুরা তিন’য়ে দিয়েছেন ৪ বার কসম হওয়ার পর। তিনি চান তাঁর সে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তার সে বিশেষ মর্যাদাটি বহাল রাখুক। এবং মানব সন্তানদের সে বিশেষ মর্যাদার আসনটি শুধু উত্তম পানাহারের কারণে সম্ভব নয়। জরুরি হলো, তাদেরকে অবিরাম ভাবে সুশিক্ষিত করা। এজন্যই নবীজী (সা:)’র মাধ্যমে ইসলামের মিশনটি নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয়নি। শুরু হয়েছে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করার মধ্য দিয়ে। এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার অতি গুরুত্বপূর্ণ সূন্নত। এ সূন্নতের মধ্যে রয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ পয়গাম।

মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠার জন্য জ্ঞানের বিকল্প নাই। এজন্যই মানবের সুস্বাস্থ্যের জন্য তিনি যেমন নানারূপ মাছ-গোশতো, ফলমূল, ও পানীয়ের ব্যবস্থা করেছেন, তেমনি দিয়েছেন জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল কুর’আন। মানব জাতির জন্য এটিই হলো তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ দান। এ পৃথিবী পৃষ্টে যা কিছু -সেগুলি সবই এ পৃথিবী পৃষ্ঠে সৃষ্টি হয়েছে। একমাত্র এই পবিত্র কুর’আন এসেছে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। এবং একমাত্র এই কুর’আনই মানুষকে জান্নাতে পৌঁছায়। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালাকে অস্বীকার করা যেমন গুরুতর অপরাধ; তেমনি অপরাধ হলো কুর’আনের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখানো। অথচ সে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বাঙালির ঘরে ঘরে। বাঙালির বেড়ে উঠার চেষ্টা এই কুর’আনকে বাদ দিয়েই। সেটি বুঝা যায় বাঙালি স্কুল-কলেজে কি পড়ে তা দেখে।

বাঙালি মুসলিমগণ চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার সে মহান সূন্নতকে ধরে রাখতে। তাদের সকল ব্যর্থতার মূলে হলো এ ব্যর্থতা। তারা ইতিহাস গড়েছে অশিক্ষা ও কুশিক্ষায়। এবং ইতিহাস গড়েছে দ্রুত নীচে নামায়। যে পবিত্র কুর’আন হলো জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভান্ডার এবং যে কিতাব হলো মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান -তার সাথে বাঙালি মুসলিমের গাদ্দারীর নমুনা হলো, বাংলাদেশের  একজন ছাত্র বা ছাত্রী তার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে পবিত্র কুর‌’আন’য়ের একটি আয়াত বুঝার সামর্থ্য অর্জন না করেই। অথচ মুসলিমের উপর নামাজ-রোজার ন্যায় ফরজ হলো কুর‌’আন থেকে জ্ঞানার্জন। সেটি ফরজ শুধু আলেম, ইমাম বা মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর নয়, প্রতিটি নারী-পুরুষের উপর। নামাজ-রোজা পালন না করে কেউ যেমন মুসলিম হতে পারে না, তেমনি মুসলিম হতে পারে না কুর’আনী জ্ঞানার্জন না করে। ইসলামের গৌরব যুগে মুসলিমগণ এ বিষয়টি বুঝতে ভূল করেনি। ফলে সে ফরজটিকে তারা ফরজ রূপেই পালন করতেন। তাই কুর’আন বুঝার ফরজ পালন করতে গিয়ে মিশর, সিরিয়া, ইরাক, সূদান, লিবিয়া, আজজিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, মৌরতানিয়ার ন্যায় বহু দেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষাকে কবরে পাঠিয়ে পবিত্র কুর’আনের ভাষাকে আপন করে নিয়েছে।

অথচ বাঙালি মুসলিমগণ কুর’আন চর্চা বলতে বুঝে অর্থ না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াত; কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জন নয়। তাই কুর’আনের খতম নিয়ে তারা ব্যস্ত, কুর’আন বুঝা নিয়ে নয়। পবিত্র কুর’আনের সাথে এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে পারে? কুর’আনের প্রতি এরূপ অবমাননা নিয়ে কেউ কি মুসলিম থাকে? তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে, মহান আল্লাহতায়ালা প্রতিটি আমলের ওজন দেখেন, সংখ্যা নয়। তাই কুর’আনের একটি আয়াত বুঝার যে ওজন, তা কি সে আয়াতটি হাজার বার না বুঝে পড়লে হাছিল হয়? বুঝতে হবে, মহান আল্লাহতায়ালা কুর’আনের জ্ঞানার্জন ফরজ করেছেন, না বুঝে তেলাওয়াত নয়।   

বাঙালি মুসলিমগণ একটি বিষয় বিশ্ববাসীর সামনে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সেটি হলো, অশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত রূপে বাঁচার পরিনাম কতটা ভয়াবহ। এবং দেখিয়ে দিয়েছে কোন পথ ধরলে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হওয়া যায়। মানব জাতির ইতিহাসে এটি অতি শিক্ষনীয় বিষয়। চলমান শতাব্দীর শুরুর বছরগুলিতে বাংলাদেশ সে অপমানের শিরোপা ৫বার অর্জন করেছে। এবং আজ বাঁচছে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারির নৃশংস অসভ্যতা নিয়ে। কিন্তু যারা অশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত জাহেল, তাদের জন্য আরো বিপদ হলো, চরম ব্যর্থতা ও অপমান নিয়েও তাদের কোন লজ্জা-শরম হয়না। এবং তা থেকে মুক্তির কোন আগ্রহ জাগে না। বরং গর্ব করে নিজেদের সফল চুরিডাকাতি ও দুর্বৃত্তি নিয়ে। তাই বাংলাদেশে জনগণের ভোটের উপর সফল ডাকাতির পর বিশাল বিজয়-উৎসব হয়। যেন নিরেট ডাকাতপাড়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশের শাসক মহলে।    

মানুষ যেভাবে বাঁচে সেটিই হলো তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হলো মানুষের বাইরের রূপ। সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় ব্যক্তির ভিতরের অর্থাৎ রূপ তার নিজের শিক্ষা, ঈমান, তাকওয়া ও চেতনার মান। তাই সুশিক্ষিত, সভ্য ও ঈমানদার মানুষেরা যে চেতনা এবং জীবন-যাপনের যে প্রক্রিয়া নিয়ে বাঁচে, সেভাবে অশিক্ষিত, অসভ্য ও বেঈমান মানুষেরা বাঁচেনা। ফলে একই রূপ হয় উভয় জনগোষ্ঠির রাজনীতি, বু্দ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতি। অশিক্ষিত, অসভ্য ও বেঈমান মানুষের ধর্ম যেমন অধর্ম, তেমনি তাদের সংস্কৃতি হলো অপসংস্কৃতি। দেশ জুড়ে গুম, খুন, ঘুষ, ধর্ষণ, মিথ্যাচার,  বিনাবিচারে হত্যা, অপহরণ, চুরিডাকাতি,   ভোটডাকাতির ও ব্যাংক-ডাকাতির মধ্য প্রকাশ পায় একটি অপরাধী জনগোষ্ঠির অপসংস্কৃতি। বাংলাদেশে চলছে সে অপসংস্কৃতির প্লাবন। যে অপসংস্কৃতির সাথে মিশ্রন ঘটেছে একুশের স্তম্ভপূজা, মুজিবের ছবিপূজা ও মুর্তিপূজার ন্যায় নিরেট হিন্দুত্ববাদ। তাই সেটি কখনোই কোন ঈমানদারের সংস্কৃতি হতে পারে না।

জ্ঞানই হলো বিবেকের খাদ্য। জ্ঞানের অভাবে বিবেকের মৃত্যু ঘটে। মুসলিমদের জন্য সে বিশুদ্ধ জ্ঞানের উৎস হলো পবিত্র কুর’আন। অপর দিকে অপসংস্কৃতি ব্যক্তিকে পাপের পথে চলতে প্রশিক্ষণ দেয় এবং অভ্যস্থ করে পাপাচারে। অপসংস্কৃতির ধারকগণ এ লক্ষে নাচগান, বর্ষবরণ, বসন্তবরণ ও পূজা-পার্বনের ন্যায় ইন্সটিটিউট গড়ে তোলে। জনগণকে জাহান্নামের নিতে অজ্ঞতা ও অপসংস্কৃতি একত্রে কাজ করে। অজ্ঞতার ইসলামী পরিভাষা হলো জাহিলিয়াত। শয়তান শুধু মানুষের মধ্যে অজ্ঞতাই বাড়ায় না, অপসংস্কৃতিরও প্লাবন আনে। বরং অপসংস্কৃতির মাঝে জনগণের জাহিলিয়াতের পরিচয় মেলে।

বাংলাদেশে শয়তানের অনুসারিদের বিজয়টি বিশাল। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কুর‌’আন-হাদীস চর্চাকে নিষিদ্ধ করে এরা যেমন দেশে অজ্ঞতা তথা জাহিলিয়াতের প্লাবন এনেছে, তেমনি এনেছে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির প্লাবন। তাই স্তম্ভপূজা, মুর্তিপূজা ও ছবিপূজা আজ আর শুধু মন্দিরে হচ্ছে না, মন্দিরের বাইরেও নেমে এসেছে। অজ্ঞতা ও অপসংস্কৃতির এ জোয়ারের মুখে মুসলিম রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

বাঙালি মুসলিমরা তাই এক ভয়নাক বিপদের মুখে। বাঙালি মুসলিমদের উপব চাপানো হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। তাই মুসলিমদের জিহাদ শুধু অজ্ঞতার বিরুদ্ধে নয়, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধেও। কিন্তু বাংলাদেশে সে জিহাদটিও হচ্ছে না। সে জিহাদটি না থাকার অর্থ, অজ্ঞতা ও অপসংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ। বাঙালি মুসলিম বাঁচছে সে আত্মসমর্পণ নিয়ে। এরূপ আত্মসমর্পণ নিয়ে কি কখনো সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায়? সেটি যে করা যায় না, তারও প্রমাণ হলো আজকের বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *