বিবিধ ভাবনা ৮৩

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

 ১. হিন্দুত্ববাদীদের যুদ্ধ, নীরব শেখ হাসিনা ও বাঙালি মুসলিমের ঈমানী দায়

 ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। সম্প্রতি বিজেপির দুই কর্মকর্তা নবীজী (‌সা:)কে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করেছে। ভারতীয় মুসলিমগণ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। প্রতিবাদ দমনে উত্তর প্রদেশের বিজিপি দলের সরকার বুল ডোজার দিয়ে প্রতিবাদী মুসলিম নেতাদের ঘর ভাঙ্গছে। হিন্দুত্ববাদী শাসক দলের নীতির বিরুদ্ধে আরব বিশ্বসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। কুয়েতসহ কিছু দেশ ভারতীয় পণ্য বর্জন শুরু করেছে। এমুহূর্তে প্রতিটি মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব হলো ভারতের মজলুম মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো।

কিন্তু বাংলাদেশের ভোটডাকাত হাসিনা সরকার নিশ্চুপ। ইসলামের মহান নবী (সা:)’র উপর হামলা হলে কোন ঈমানদার কি নীরব থাকতে পারে? তাতে কি ঈমান থাকে? নীরব থাকাটি তো গুরুতর অপরাধ। এতে লাভ হয় শত্রুর। শেখ হাসিনা হলো বাংলাদেশের বুকে নরেন্দ্র মোদির খলিফা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ভাষায় ভারতের সাথে সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মত। তাই বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদিকে সব সময় খুশি রাখা, হাসিনা ঘর ভাঙ্গতে রাজী নয়। এজন্যই বিজেপি নেতারা নবীজী (সা:)’র বিরুদ্ধে অশ্লীল মন্তব্য করলেও শেখ হাসিনা নিন্দা করে না। এভাবে হাসিনা তার আসল রূপ দেখিয়ে দিচ্ছে।

সরকার কিছু না করলেও বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণ দায়মুক্ত হয় না। বাংলাদেশ হলো ভারতের বিশাল বাজার। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের জনগণ কি ভারতের পণ্য বর্জনের সামর্থ্য রাখে না? ভারতীয় পণ্য কেনার অর্থ ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্য করা। তাতে শত্রুর শক্তি বাড়ে। ভারতীয় পণ্য কেনা তাই গুরুতর পাপ। এ পাপ আযাব বাড়াবে শুধু আখেরাতেই নয়, এ জীবনেও। এ পাপ থেকে কি বাঙালি মুসলিম বাঁচতে চায় না?

২. শাসকের যোগ্যতা ও জনগণের দায়ভার

অফিসের পিয়ন বা রাস্তার ঝাড়ুদার হওয়ার জন্যও ন্যূনতম কিছু যোগ্যতা লাগে। তেমনি যোগ্যতা লাগে দেশের শাসক হওয়ার জন্য। শাসকের এ পদে বসেছেন খোদ নবীজী (সা:)ও মহান সাহাবাগণ। তাই মুসলিম দেশে কারা শাসক হবে সেটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে গাফলতি হলে পাপী হতে হয়। তাই মুসলিম নারী-পুরুষকে শুধু নামাজ-রোজায় যত্মবান হলে চলে না। যোগ্য ব্যক্তিকে শাসক করতে মুসলিমগণ তাদের গৌরব কালে রক্তাত্ব জিহাদ করেছে। অতএব তারা কি যোগ্য ও ঈমানদার ব্যক্তিকে ভোটও দিবে না?

গণতান্ত্রিক দেশে জনগণ হলো শাসকের নিয়োগদাতা। জনগণ এখানে বিচারকের আসনে। জনগণকেও তাই দায়িত্ববান, বিচক্ষণ, জ্ঞানী, নিরপেক্ষ ও সৎ হতে হয়। সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তিকে শাসক বানাতে হয়। শাসক নির্বাচনে জনগণকে তাই যোগ্যতার পরিচয় দিতে হয়। জনগণ ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হয় সমগ্র জাতি। তখন নির্বাচনে দুর্বৃত্তগণ নির্বাচিত হয়। এতে দেশ বসবাসের অযোগ্য হয়। তখন প্লাবন আসে গুম, খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের –যেমনটি হয়েছে আজকের বাংলাদেশে।  

 প্রশ্ন হলো, কি সে শাসকের যোগ্যতা? শাসকের সে ন্যূনতম যোগ্যতা হলো: এক). তাকে সৎ ও সত্যবাদী হতে হয়। তার জন্য দুর্বৃত্ত ও মিথ্যাবাদী হওয়া যেন অসম্ভব ব্যাপার হয়। দুই).সে হবে দেশপ্রেমিক। তিন). সে ইজ্জত দিবে জনগণের রায় ও ভোটের। চার). সে জনগণকে অধিকার দিবে রাজপথে মিটিং মিছিল করা ও কথা বলার। এসব যোগ্যতার পর আসে তার শিক্ষাগত, পেশাগত ও নেতৃত্বের যোগ্যতা। কোন সভ্য দেশেই মিথ্যাবাদী ও দুর্বৃত্ত ব্যক্তিকে শাসক বা মন্ত্রী হওয়া দূরে থাক, পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার সুযোগ থাকে না। মিথ্যুক ও তার দুর্নীতি প্রমাণিত হলে সাথে সাথে তাকে পদ হারাতে হয়।

শেখ হাসিনা প্রতি ক্ষেত্রে পুরাপুরি অযোগ্য। হাসিনা যে প্রচণ্ড রকমের মিথ্যাবাদী সেটি তিনি বার বার প্রমাণ করেছেন। সম্প্রতি হাসিনা বলেছেন, ৫ মে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে কোন গুলি চালানো হয়নি। বলেছেন, সেখানে কেউ মারা যায়নি। অথচ এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। প্রচুর প্রামাণিক দলিল রয়েছে ঐ রাতে গুলী চালানোর ও মানব হত্যার। সে ছবি ৬ মে’র পত্রিকাগুলিতে ছাপাও হয়েছে। ছবিতে রাস্তায় বহু লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এমন কি ঢাকার দৈনিক যুগান্তর রিপোর্ট দিয়েছে ঐ রাতে কত রাউন্ড গুলী চালানো হয়েছিল ও কতজন সৈনিক তাতে অংশ নিয়েছিল। ক’দিন আগে হাসিনা আরেক মিথ্যা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসেননি। আরেক বয়ানে বলেছেন, আওয়ামী লীগ কখনোই ভোট চুরি করে না। অথচ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দেশে কোন নির্বাচন হয়নি, হয়েছে ভোট ডাকাতি। এরূপ একজন প্রমাণিত মিথ্যুক দেশের প্রধানমন্ত্রী হয় কি করে?

হাসিনা দেশপ্রেমিকও নন। দেশপ্রমিক হলে কি তার শাসনামলে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হত। দেশপ্রেমিক হলে তিনি কম খরচে বিশ্বব্যাংকের লোন নিয়ে পদ্মা ব্রিজ করতেন। ১০ হাজার কোটি টাকার ব্রিজ ৩০ হাজার কোটিতে করতেন না। চীন থেকে অধিক সূদে লোন নিতেন না। দেশ প্রেমিক হলে তিস্তার পানি না নিয়ে কখনোই ভারতকে করিডোর ও বন্দরের সুবিধা দিতেন না। অপর দিকে জনগণের রায় ও ভোটকে ইজ্জত দেয়া হাসিনার রুচিতে নাই। জনগণের রায় ও ভোটকে ইজ্জত দেয়ার ইচ্ছা থাকলে তিনি কখনোই ভোটডাকাতি করতেন না। তাই হাসিনা নিজেকে প্রমাণ করেছেন জনগণের শত্রু রূপে, বন্ধু রূপে নয়।  

 ৩. ব্যর্থ দেশের বিচার বিভাগ ও ব্যর্থ পুলিশ বিভাগ

পুলিশের দায়িত্ব অপরাধীদের খুঁজে বের করা এবং তাদের আদালতে খাড়া করা। আদালতের দায়িত্ব অপরাধীদের শাস্তি দেয়া। যেদেশে বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগ ব্যর্থ হয় -সে দেশ দুর্বৃত্তদের দখলে যায়। তখন প্লাবন আসে চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি এবং নানা রূপ অবিচার ও দুর্বৃত্তির । বাংলাদেশে আজ যে গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, অপহরণের প্লাবন তার কারণ ব্যর্থ পুলিশ বিভাগ ও ব্যর্থ বিচার বিভাগ।

গত ৫ বছরে বাংলাদেশে সংঘটিত সবচেয়ে বড় অপরাধটি হলো ভোটডাকাতি। বাংলাদেশে সত্যিকার পূলিশ বিভাগ থাকলে ভোটডাকাত হাসিনাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতো এবং আদালতে তুলতো। এবং দেশের বিচারকদের ন্যায় বিচারে সামান্যতম আগ্রহ থাকলে সর্বপ্রথম এই অপরাধের বিচার করতো। অপরাধী হাসিনা ও তার সহচরদের শাস্তি দিত। অথচ সে কাজে না আদালতে রুচি দেখিয়েছে, না দেখিয়েছে পুলিশ। তারা অপরাধীদের বিচারের বাইরে রেখেছে। এটি কি কোন সভ্য দেশের রীতি?

 ৪. ডাকাত পাড়ার সংস্কৃতি

 বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ডাকাত পাড়ার সংস্কৃতি। ডাকাত পাড়ায় অতি নৃশংস ডাকাতকে শাস্তি দিয়ে তার নৃশংসতায় বাহবা দেয়া হয়। বাংলাদেশেও ভোটডাকাতের শাস্তি হয় না। বরং ভোটডাকাতকে ক্ষমতার শীর্ষে বসিয় তাকে শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলা হয়। এমন দেশে কি কখনো সভ্য সমাজ নির্মিত হয়? পৃথিবীর কোন একটি সভ্য দেশে কি চোর-ডাককাতকে শ্রদ্ধেয় বলার মত একজন নাগরিকও কি খুঁজে পাওয়া যাবে? অথচ বাংলাদেশে এমন মানুষদের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। এদেশটিতে ডাকাতকে শ্রদ্ধেয় বলে এমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আর্মির জেনারেল, আদালতের বিচারক, উকিল, বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টগণ। এখানেই বাংলাদেশের ব্যর্থতা। রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কলকারখানা নির্মাণ করে এ ব্যর্থতা ঢাকা যাবে না।

 তবে বাংলাদেশে এক দিনে এ ডাকাত পাড়ার সংস্কৃতি নির্মিত হয়নি। এটির শুরু একাত্তর থেকে। এবং আওয়ামী লীগের হাতে।বাংলার সর্বকালের ইতিহাসে নিজেদের যারা সবচেয়ে গণতন্ত্রবিরোধী, সবচেয়ে নৃশংস ও সবচেয়ে বর্বর বাঙালি রূপে পেশ করেছেন তাদেরই একজন হলেন শেখ মুজিব এবং অন্যজন হলেন শেখ হাসিনা। দুজনেই গণতন্ত্রের হত্যাকারী। দুইজনই কবরে পাঠিয়েছেন মৌলিক মানবাধিকারকে। মুজিব সব দলকে নিষিদ্ধ করে জন্ম দিয়েছেন একদলীয় বাকশালী শাসনের। দুজনই নৃশংস ফ্যাসিস্ট। দুই জনই গুম-খুন-সন্ত্রাসের মহা নায়ক। শেখ মুজিব তার নৃশংস মনের পরিচয় দিয়েছিলেন বন্দী-অবস্থায় সিরাজ শিকদারকে হত্যার পর। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তিন বলেছিলেন, কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? কোন বিবেকমান মানুষাব কাউকে হত্যার পর এমন কথা বলে না।

শেখ মুজিবের আমলে বহু হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়। মুজিবের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য দিবালকে ৬ জন ছাত্রকে খুন করা হয়। শেখ মুজিব সে খুনের বিচার করেননি। ফলে সে নৃশংস খুনের নায়কগণ শাস্তি পায়নি। নিজ দলের খুনিদের বিচার না করাই ছিল মুজিবের নীতি। কোন সভ্য ও বিবেকমান মানুষ কি অপরাধীদের এভাবে বিচার থেকে রেহাই দেয়? হাসিনা তার নৃশংস মনের পরিচয় দিয়েছেন শাপলা চত্বরে হিফাজতে ইসলামের হাজার হাজার নিরস্ত্র মুসল্লীদের উপর মেশিন গান চালিয়ে। তার বর্বর মানসটি আরো প্রকাশ খালেদা জিয়াকে পদ্মা ব্রিজ থেকে ঠুস করে ফেলে দেয়া এবং প্রফেসর ইউনুসকে পদ্মার পানিতে চুবানোর কথা বলার মধ্য দিয়ে। অপর দিকে শেখ হাসিনা জেল থেকে তার নিজ দলের সাজাপ্রাপ্ত খুনিকে বের করে আনেন। দলীয় প্রেসিডেন্টকে দিয়ে তিনি সে খুনির শাস্তি মাফ করিয়ে নেন।   

৫. সভ্য নীতিতে হাসিনা সরকারের অনাগ্রহ

যে কোন দেশে কিছু মৌলিক বিষয়ে সকল ধর্ম, সকল দল ও সকল এলাকার মানুষের মধ্যে সহমত থাকে। যেমন সকল অপরাধীরা শাস্তি পাবে, আদালতে সুবিচার প্রতিষ্ঠা পাবে, প্রতিটি নারী-পুরুষ জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা পাবে, দেশে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, জনগণ যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দিবে এবং জনগণ স্বাধীনভাবে কথা বলবে – এগুলি হলো সেসব ন্যূনতম মৌলিক বিষয় যা নিয়ে কোনো সভ্য দেশের নানা দলের নেতাকর্মীদের মাঝে কোনরূপ বিরোধ থাকে নয়।

কিন্তু শেখ হাসিনা সে সভ্য নীতিগুলি মানতে রাজি নন। কারণ, হাসিনা জানেন এগুলি মানলে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। কারণ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে তার দলের পরাজয় অনিবার্য। হাসিনার রাজনীতির মূল টার্গেট হলো, যে কোনো ভাবে ক্ষমতায় থাকা। সেজন্য প্রয়োজনে শাপলা চত্বরের ন্যায় গণহত্যায় নামতেও সে রাজী। ভোটচুরি ও ভোটডাকাতি তার কাছে মামূলি বিষয় মাত্র। নির্বাচনে পরাজয় তার কাছে অসহ্য। তাই ভোটডাকত হাসিনা পুণরায় ভোটডাকাতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সে ডাকাতি রোধে জনগণের প্রস্তুতি কই? জনগণের ভোট কি বার বার এভাবেই ডাকাতী হতে থাকবে? ১৭/০৬/২০২২

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *