বিবিধ ভাবনা ৬৯

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১. দুর্নীতি নির্মূলের পথ

কোন চোর বা ডাকাত যদি বলে, সমাজ থেকে সে অপরাধ দুর করবে –তবে তার চেয়ে বড় মশকরা আর কি হতে পারে? বাংলাদেশে সে কৌতুকও হয়। চোর-ডাকাতদের ন্যায় অপরাধীগণ শুধু অপরাধই বাড়াতে জানে, অপরাধের নির্মূল নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে তাই সবচেয়ে বড় কৌতুক হলো, ভোট ডাকাতি করে যে শেখ হাসিনা দেশকে হাইজ্যাক করলো -সে নাকি দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করবে। বরং দেশ জুড়ে দুর্নীতির জোয়ার আজ যেরূপ প্রবলতর হচ্ছে -তার কারণ তো হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাতের শাসন।

দেশকে তো তারাই দুর্নীতি মুক্ত করতে পারে যারা নিজেদের প্রথমে দুর্নীতিমুক্ত করে। দুর্নীতিবাজগণ সব সময়ই নিজেদের আশে পাশে বন্ধু বা সহকারি রূপে দুর্নীতিবাজদের বেছে নেয়। তাদের নিজেদের মনে থাকে সুনীতির ধারকদের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা। কারণ তারা জানে, তাদের বিরুদ্ধে সৎ ও সুনীতির ধারকদের ঘৃণাটিও অতি প্রবল। রাজনীতির ময়দানে তারা তাদের ঘোরতোর শত্রু। সৎ মানুষদের কাছে রাখলে যখন তখন তাদের দুর্নীতির গোপন বিষয় অন্যদের কাছে বলে বিপদ ঘটাতে পারে। এজন্যই সৎ মানুষদের নিজেদের আশে পাশে রাখাকে তারা নিজেদের জন্য বিপদ মনে করে। ফলে চোর-ডাকাত দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে তার অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিবগণ চোর-ডাকাত হয়। শাসক খুনি হলে, আশে পাশেও সে খুনিদের রাখে। কথায় বলে ঝাঁকের মাছ ঝাঁকে চলে। সেটি অতি সত্য দুর্নীতি পরায়ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও।

তাই দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হলে সে নির্মূলের কাজটি উপর থেকে শুরু করতে হয়। সরকারের সর্বোচ্চ আসনে সবচেয়ে বড় চোর বা ডাকাতকে বসিয়ে গ্রামের ছিঁছকে চোরকে জেলে পাঠিয়ে দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয় না। বিষয়টি গাছের বিশাল কান্ডকে অক্ষত রেখে ছোট ডালা পালা কাটার ন্যায়। চোর-ডাকাতগণও তাদের আশে-পাশের সহচরদের মাঝে কিছু দান খয়রত করে। কিন্তু তাতে দেশের কল্যাণ হয়। সে দানখয়রাতের মাঝে রাজনীতি থাকে। এখানে লক্ষ্য, দুর্নীতিবাজ শাসকের পক্ষে চাটুকর বৃদ্ধি। এ চাটুকরগণ চোরডাকাত ও ভোটডাকাত সরকারের পক্ষে রাজপথে জিন্দাবাদ বলে। এবং চোরডাকাতকে ফেরেশতা বলে প্রচার করে। বাংলাদেশে সেটিই হচ্ছে। 

 

২. সংকট জনগণের স্তরে

সম্প্রতি বিশিষ্ঠ লেখক ও গবেষক ডাক্তার পিনাকী ভট্রাচার্যের একটি কঠোর মন্তব্য যথেষ্ট ভাইরাল হয়েছে। পিনাকী ভট্রাচার্য বলেছেন, “আওয়ামী লীগ দুনিয়ার সব চাইতে স্মার্ট পলিটিক্যাল পার্টি, এরা “গু”কেও হালুয়া বলে ওদের সাপোর্টারদের খাওয়ায়ে দিতে পারে।” এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর গভীর উদ্বেগ ও অতিশয় বেদনার কথা। আসলে বিষয়টি তা নয়। রোগটি আরো গভীরে। সারাতে হলে সেই গভীরে হাত দিতে হবে।

আসলে আওয়ামী লীগ স্মার্ট নয়। বরং বুদ্ধিবিবেচনাহীন আবাল হলো বাংলাদেশের জনগণ। অন্যরা জনগণের সে আবাল-অর্বাচীন অবস্থা থেকে ফায়দা নেয়না, কিন্তু আওয়ামী লীগ পুরাদমে নেয়। এ অপ্রিয় সত্য কথাটি বলতেই হবে। নইলে সত্য লুকানোর গুনাহ হবে। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে এক শ্রেণীর মানুষকে গরুছাগলের চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালার নিজের কথাটি হলো, “উলাইয়েকা কা’আল আনয়াম, বাল হুম আদাল।” অর্থ হলো: তারাই গবাদী পশুর ন্যায়, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। মানুষ যে কতটা নীচে নামতে পারে -তা নিয়ে মহাজ্ঞানী মহান স্রষ্টার এই হলো নিজস্ব বয়ান। তাছাড়া বাঙালীর মানুষ রূপে বেড়ে উঠার ব্যর্থতা নিয়ে দারুন অভিযোগ ছিল রবীন্দ্রনাথেরও। তিনি লিখেছিলেন, হে বিধাতা সাত কোটি প্রানীরে রেখছো বাঙালী করে, মানুষ করোনি। ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টার ন্যাশনালের জরিপে বাংলাদেশ এ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের সকল দেশগুলির মাঝে দুর্নীতি পর পর ৫ বার প্রথম হয়েছে। এটি ভয়ানক চারিত্রিক অসুস্থ্যতার কথা। কিন্তু তা নিয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী কথা বলে না। কথা বলে না রাজনীতিকগণও। যেন কিছুই হয়নি। অথচ এটি তো যে কোন সভ্য মানুষের মগজে ঝাঁকুনি দেয়ার কথা। বাঙালীর এ ব্যর্থতা রবীন্দ্রনাথের মগজে ঝাঁকুনি দিয়েছিল বলেই তিনি বিধাতার কাছে উপরুক্ত ফরিয়াদ তুলেছিলেন।   

ক্যান্সারের ন্যায় চারিত্রিক বা চেতনার রোগের সিম্পটমগুলোও গোপন থাকে না। সে সিম্পটমের কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। হংকং’য়ের জনসংখ্যা ৮০ লাখ। চীনের স্বৈরাচারী সরকার সেখানে এতো দিন চলে আসা গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি কেড়ে নিয়েছে। প্রতিবাদে ২০ লাখ নারী-পুরুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। অর্থাৎ প্রতি ৪ জনের একজন রাস্তায় নেমে এসেছে। হাজার হাজার মানুষ কারাবন্দী হয়েছে। এ হলো মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি ভালবাসা ও চেতনার মান। ঢাকা শহরের জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। গণতন্ত্র বাংলাদেশেও কেড়ে নেয়া হয়েছে। নির্বাচন না হয়ে ভোট ডাকাতি হয়ে গেছে। কিন্তু ২০ লাখ দূরে থাক, ২০ হাজার মানুষও রাস্তায় নামেনি। মানুষ যখন তার মানবিক চেতনা হারিয়ে ফেলে তখন সে গণতন্ত্র নিয়ে ভাবে না।

বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগণ যে কতটা আবাল – ইতিহাস থেকে তার কিছু প্রমাণ দেয়া যাক। শেখ মুজিব ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৮ আনা সের চাউল ও সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়েছিল। ওয়াদা দিয়েছিল গণতন্ত্রের। কিন্তু খাইয়েছিল ৮ টাকা সের চাউল। গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার উপহার দিয়েছিল। শেখ মুজিব নিজেকে আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট করার ব্যবস্থা করেছিল। এক দেশ, এক নেতার বাকশালী তত্ত্ব বাজারে ছেড়েছিল। তিরিশ হাজারের বেশী বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল। ইসলামপন্থীদের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। সোনার বাংলার বদলে দুর্ভিক্ষের বাংলায় পরিণত করেছিল। বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল দুর্ভিক্ষ ডেকে এনে। স্বাধীনতার বদলে দিয়েছিল ভারতের গোলামী। শেখ মুজিব ভারতের সাথে মিলে আগরতলা ষড়যন্ত্র করেছিল। এ ষড়যন্ত্রের সত্যতা এখন আওয়ামী লীগের নেতাগণও স্বীকার করে। ভারতীয় পণ্যের বাজার নিশ্চিত করতে দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করেছিল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিলকে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল। মুজিবের ইতিহাসটিই তাই বিশ্বাসঘাতকতা ও জাতি-বিরোধী গুরুতর অপরাধের।  কিন্তু সে শেখ মুজিবকে আবাল বাঙালীগণ জাতির বাপ ও বঙ্গবন্ধু বলে? এমনটি কি কোন সভ্য দেশে ঘটে? সভ্য দেশে এরূপ অপরাধীদের তো ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে ফেলে। কখনোই বাপ বলে না। এরূপ আবাল জনগণকে হালুয়ার নামে বিশুদ্ধ “গু” খাইয়ে দিতে কি স্মার্ট হওয়া লাগে?

হাসিনা ২০১৮ সালে ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতা হাইজ্যাক করলো। এটি কি ভারত, পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলংকার ন্যায় অন্য কোন প্রতিবেশী দেশে সম্ভব? সম্ভব নয়। কারণ ঐসব দেশের লোক এতো আবাল নয়। তাই ভোট ডাকাতির কথা সেসব দেশে কোন চোর বা ডাকাত ভাবতেই পারে না। সভ্য মানুষেরা ডাকাত দেখলে দল বেঁধে হাতের কাছে যা পায় তা দিয়ে হামলা করে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি ঘটে না। বরং ঘটে উল্টোটি। ডাকাত সর্দারনীর গলায় বিজয়ের মালা পড়িয়ে তাকে সন্মানিত করা হয়। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণই নয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আদালতের বিচারক, সংসদের সদস্য, সরকারের সচিব, মিডিয়া কর্মী, বু্দ্বিজীবী ও উকিলগণ যে কতটা আবাল সেটি বুঝা যায় যখন তারা একজন ভোটডাকাতকে সভা-সমিতির বক্তৃতায় বা লেখনীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে। অথচ সভ্য মানুষ তো বাঁচে দুর্বৃত্তদের প্রতি প্রবল ঘৃণা নিয়ে। এটুকু বিলুপ্ত হলে কি সভ্যতা, মানবতা ও নৈতিকতা বাঁচে?      

 

৩. ডাকাতের উপর ভরসা

এক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা জনগণকে তার উপর ভরসা করতে বলেছে। অথচ এক্ষেত্রে তার নিজের আচরণটি লক্ষণীয়। হাসিনা নিজে কিন্তু জনগণের ভোটের উপর কখনোই ভরসা করেনি। জনগণের ভোটের উপর ভরসা না করে রাতে ভোট ডাকাতি করে গদিতে বসেছে। কথা হলো, ডাকাতের উপর ভরসা করা কি কোন বু্দ্ধিমানের কাজ হতে পারে? এটি তো আবাল বেওকুপদের কাজ। কোন বুদ্ধিমান সভ্য ও সাহসী মানুষ কি কখনো ডাকাতের উপর ভরসা করে? তারা তো হাতের কাছে যা পায় তা দিয়ে ডাকাত তাড়াতে রাস্তায় নামে। হাসিনা যে ভাবে ক্ষমতায় এলো সেটি কি কোন সভ্য দেশে সম্ভব? হাসিনা বাংলাদেশীদের জন্য যা বাড়িয়েছে তা উন্নয়ন নয়, বরং সীমাহীন দুর্নীতি ও বিশ্বজুড়া অপমান।

 

৪. পরকালের ভয় থেকেই চারিত্রিক বিপ্লব

মিথ্যাচার, চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ ও ব্যাভিচারের ন্যায় নানারূপ পাপের পথে নামার মূল কারণটি হলো পরকালের ভয় না থাকা। সে রায়টি অন্য কারো নয়, সেটি মহাজ্ঞানী মহাপ্রভু মহান আল্লাহতায়ালার। বিষয়টি তিনি সুস্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন সুরা মুদাছছেরের ৫৩ নম্বর আয়াতে। কোন মানুষের মনে যদি এ ধারণা বাসা বাঁধে, সামান্য কিছু বছরের এ পার্থিব জীবনটি পাপ থেকে পবিত্র রাখলে অনন্ত অসীম কালের জন্য জাহান্নামের আগুনে দগ্ধিভুত হওয়া থেকে বাঁচা যাবে -তবে সে ব্যক্তি কখনোই গুনাহর পথে পা রাখে না।

এক ফোটা পানির সাথে মহা সমুদ্রের বিশাল পানির তুলনা করা যায়। কারণ দু’টোই সসীম। কিন্তু ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বছরেও যে অনন্ত পরকালীন জীবন শেষ হওয়ার নয়, সে জীবনের সাথে কি ৭০ বা ৮০ বছরের জীবনের তুলনা হয়? তাই সামান্য ক্ষণের জন্য পাপে নেমে কেন সীমাহীন কালের জন্য জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে? এটি তো গুরুতর ভাবনার বিষয়। এ ভাবনাটুকুই হলো তাকওয়া। প্রকৃত ঈমানদার প্রতি মুহুর্ত বাঁচে এ ভাবনা নিয়ে। এ ভাবনা ঈমানদারের জীবনে প্রতি  মুহুর্তে পুলিশের কাজ করে। এমন ব্যক্তিগণ তাদের সমগ্র সামর্থ্য বেশী বেশী নেক আমলে ব্যয় করে। এমন ব্যক্তিরাই ফেরেশতায় পরিণত হয়।

কিন্তু যার মনে জাহান্নামের ভয় নাই, পাপের পথে চলায় তার কোন নৈতিক বাধাই থাকে না। পাপের মধ্যে তখন তার জন্য আনন্দ-উৎসবের কারণ হয়। অথচ সামান্য পাপও ঈমানদারকে বেদনা দেয়। সে তাওবা করে সে পাপ থেকে বাঁচার। অথচ সে বোধ বেঈমানের থাকে না। তাই চোর-ডাকাত, ভোট-ডাকাত ও গুম-খুনের রাজনীতির নায়কদের দেখে নিশ্চিত বলা যায় এরা বেঈমান। এদের মনে আখেরাতের কোন ভয় নাই। ভয় থাকলে পাপ তাদের আনন্দ দিত না। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশে চলছে এ বেঈমানদেরই রাজত্ব।

পবিত্র কুরআনের বিশাল ভাগ ব্যয় হয়েছে বস্তুত আখেরাতের ভয়কে তীব্রতর করতে। বিশেষ করে মক্কায় নাযিলকৃত সুরা গুলিতে। তাই যারা নিজের মনে আখেরাতে ভয় সৃষ্টি করতে চায় তারা মনযোগী হয় বেশী বেশী কুর’আন বুঝতে। কিন্তু যারা না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াত করে -তাদের মনে সে ভয় জাগে না। অথচ বাংলাদেশে না বুঝে কুর’আনের কাজটিই বেশী বেশী হচ্ছে। ফলে পবিত্র কুর’আন যে চারিত্রিক বিপ্লব আনে সেরূপ বিপ্লব বাংলাদেশে ঘটছে না।

 

৫. জীবনটাই পরীক্ষাময়

মানুষের মাঝে সম্পদ, সন্তান, বিদ্যা-বুদ্ধি ও স্বাস্থ্যের ন্যায় মহান আল্লাহতায়ালার নানা রূপ নিয়ামতের যে ভিন্ন ভিন্ন বন্টন তা নিয়ে যে ক্ষোভ –তা থেকেই জন্ম নেয় হিংসা-বিদ্বেষ। এটি মহান আল্লাহতায়ালার প্রজ্ঞা ও নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তাই এটি বিশাল পাপ। এটি বস্তুত বেঈমানীর লক্ষণ। এ বন্টন নিয়ে রাজী থাকা এবং সন্তুষ্টির যে প্রকাশ –সেটিই হলো শুকরিয়া। সেটিই প্রকৃত ঈমানদারী ও তাকওয়া।

এ পার্থিব জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত জুড়েই হলো পরীক্ষা। জীবনের প্রতিটি নিয়ামত ও বিপদ-আপদ বিনা উদ্দেশ্যে আসে না, আসে পরীক্ষা নিতে। সকল মানুষের ঈমানের ও যোগ্যতার মান যেমন সমান নয়, তেমনি এক নয় পরীক্ষাপত্রও। তাই প্রত্যেকের হাতে ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষাপত্র। কাউকে পরীক্ষা নেন সম্পদ, সন্তান ও স্বাস্থ্য দিয়ে। আবার কারো জীবনে পরীক্ষা আসে সেগুলি সীমিত করে বা না দিয়ে। জান্নাত পেতে হলে এ পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে। ঈমানদারী তো এ পরীক্ষায় পাশ করার সার্বক্ষণিক চেতনা নিয়ে বাঁচা। প্রকৃত প্রজ্ঞা হলো, প্রতি মুহুর্তে সে পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য বাড়ানো। সেটি কুর’আনী জ্ঞান, সঠিক দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে। এ কাজটি দেশের মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটিই যথার্থ ভাবে হচ্ছে না।      

                                                                                                                         ৬. উন্নয়নের সঠিক ও বেঠিক মাপকাঠি

দেশে কতগুলি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও বিল্ডিং হলো -সেটি উন্নয়নের সঠিক মাপকাঠি নয়। বরং সঠিক মাপকাঠিটি হলো, দেশে কতজন নর-নারী প্রতারক, চোর-ডাকাত, সন্ত্রাসী, খুনি ও ব্যাভিচারী না হয়ে সৎ, চরিত্রবান ও সৃষ্টিশীল মানুষ রূপে বেড়ে উঠলো -সেটি। এ মাপকাঠিতে বাংলাদেশের উন্নয়নের মান বিশ্বের দরবারে অতি নীচে। এ দিক দিয়ে সবচেয়ে দুরাবস্থা দেশের শাসক চক্রের। তারাই নীচের নামার দৌড়ে প্রথম সারীতে।

মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে এ প্রশ্ন কখনোই তোলা হবে না, দেশে কতগুলি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কলকারখানা, রাস্তাঘাট ও বিল্ডিং গড়া হয়েছিল এবং সে গড়ার কাজে কার কি ভূমিকা ছিল। বরং যে প্রশ্নের জবাব দিতে প্রত্যেককেই কাঠগড়ায় অবশ্যই দাঁড়াতে হবে তা হলো, পাপচার থেকে জীবন কতটা পবিত্র ছিল এবং নেক আমলের ভান্ডার কতটা সমৃদ্ধ ছিল? বিপদের কারণ হলো, মুসলিমের জীবন থেকে আখেরাতের সে মাপকাঠিগুলোই ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ, সেক্যুলারিজমে আখেরাতকে গুরুত্ব দেয়াটি নীতি বিরুদ্ধ।  আখেরাতের ভাবনা গণ্য হয় পশ্চাতপদতা রূপে। উন্নয়নের এমন সব মাপকাঠি খাড়া করা হয়েছে যা উন্নয়ন নিয়ে শুধু বিভ্রান্তিই বাড়িয়েছে। এবং আখেরাতে যা গুরুত্বহীন সেগুলিকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

মহাসড়কে গাড়ি চালনার সময় গন্তব্যস্থলকে সব সময় স্মরণে রাখতে হয়্ সেটি স্মরণে না থাকলে গাড়ি চালনাই ভিন্ন পথে হয়। তেমনি জীবন চালনায় সব সময় স্মরণে রাখতে হয় আখেরাতকে। এবং প্রস্তুত রাখতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে যে প্রশ্নগুলির সম্মুখীন হতে হবে -সেগুলির জবাব নিয়ে। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির কাজ হয়েছে শুধু আখেরাতকেই ভূলিয়ে দেয়া নয়, বরং বিচার দিনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলিকেও ভূলিয়ে দেয়া। যাতে মানুষ সে ভয়ানক দিনটির জন্য নিজেকে প্রস্তুত না করতে পারে। শয়তান তো সেটিই চায়।    

 

৭. বাঁচা ও মরার এজেন্ডা

মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাঁচা-মরার এজেন্ডা। এটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে এখানে ভূল হলে সমগ্র বাঁচাটিই ব্যর্থ হয়। অথচ মানব এই এজেন্ডা নির্ধারণেই সবচেয়ে বেশী ভূল করে। সে ভূল থেকে বাঁচাতে সে এজেন্ডাটি বেঁধে দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালা। কুর’আনে সে এজেন্ডার কথাটি বলা হয়েছে এভাবে: “ক্বুল ই্ন্নাস সালাতি ওয়া নুসুকু ওয়া মাহইয়া’আ ওয়া মামাতি লিল্লাহে রাব্বিল আলামীন।” অর্থ: “বলো (হে মুহম্মদ) আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার বাঁচা ও আমার মৃত্যু বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।”। তাই মুসলিম বাঁচে, লড়াই করে ও প্রাণ দেয় কোন নেতা বা দলের স্বপ্ন পূরণে নয় বরং একমাত্র মহান আল্লাহর ইচ্ছা পূরণে। একমাত্র এরূপ বাঁচাতেই প্রকৃত ঈমানদারী। যে বিশ্বাসটি মহান আল্লাহতায়ালার ঈমানদারের চেতনায় সর্ব সময়ের জন্য বদ্ধমূল করতে চান সেটি হলো: “ইন্না লিল্লাহি ও ইন্না ইলাইহি রাজিয়ুন।” অর্থ: “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহতেই আমাদের ফিরে যাওয়া।” মুমিনের বাঁচা ও মরার পিছনে এটিই তো মূল দর্শন। এই দর্শনই জীবনে সঠিক পথ দেখায়।

বাঁচা ও মরার এ কুর’আনী পথটিকেই বলা হয় সিরাতুল মুস্তাকীম। পথটি অন্য রূপ হলে সেটি জাহান্নামের অন্তহীন আযাবকে অনিবার্য করে। সেটিই হলো শয়তানের পথ। রাষ্ট্র দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হলে যা অসম্ভব হয় তা হলো, আল্লাহর লক্ষ্যে বাঁচা ও প্রাণ দেয়া। তখন নিষিদ্ধ হয় জীবনে জিহাদ নিয়ে বাঁচা। জিহাদ তো মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত ইসলামী বিধানকে বিজয়ী করার চেতনা নিয়ে বাঁচা ও প্রাণ দেয়া। ইসলামের শত্রুগণ সেরূপ জিহাদ নিয়ে বাঁচাকে সন্ত্রাস বলে। এভাবেই বাঁধা দেয় জান্নাতের পথে চলায়। শয়তানী শক্তির হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ার এটিই হলো সবচেয়ে বড় বিপদ। ২৫/০৭/২০২১

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *