বিবিধ ভাবনা ৫৬

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১. দূষিত ইতিহাসের নাশকতা

দূষিত বস্তুর পানাহারে স্বাস্থ্য পতন হয়। অনেকের মৃত্যুও ঘটে। তেমনি জাতির পতন হয় দূষিত ইতিহাস পাঠে। ইতিহাসের বইয়ের মূল কাজটি হলো দেশবাসীর সামনে অতীতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি (figure of highness) ও সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধীদের পরিচয় তূলে ধরা। ইতিহাসের যাত্রাপথে কোথায় কোথায় বড় বড় ভূল হয়েছে এবং কোথায় ও কীভবে গৌরবময় কান্ডগুলি ঘটেছে -সেগুলিও তুলে ধরা। বিজয় আনতে যেমন বিপুল অর্থ, রক্ত ও শ্রমন ব্যয় হয়, তেমনি বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয় প্রতিটি পরাজয়ে। প্রতিটি মৃত মানুষই জীবিতদের জন্য অমূল্য শিক্ষা রেখে যায়। জীবিতদের মৃত্যু থেকে বাঁচাতে মৃতদের রেখে যাওয়া সে শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হয়। অনেক সময় মৃত দেহে পোষ্টমর্টেম করতে হয়। শত শত বছর ধরে চিকিৎসা শাস্ত্র সমৃদ্ধ হয়েছে তো মৃতদের রেখে যাওয়ার সে শিক্ষার বদৌলতেই। তেমনি জাতিকে বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে অপরিসীম গুরুত্ব হলো ইতিহাসের জ্ঞান। দেশের নেতা ও জনগণকে প্রতি নিয়তই নানারূপ সংকটে পড়তে হয়। সেগুলি কাটিয়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে ইতিহাস। ইতিহাসের জ্ঞানই মানবকে প্রজ্ঞাময় করে। এ কাজটি অংকশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশল বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান বা অন্য কোন বিজ্ঞান থেকে পাওয়া যায় না। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে বহু জাতির ইতিহাস বার বার তুলে ধরেছেন -তা থেকে শিক্ষা নিতে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে একই গর্তে বার বার পড়তে হয়। তাই অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান হলো ইতিহাস বিজ্ঞান।

তবে শংকার কারণ হলো, ইতিহাসের বইয়ে দূষণ ঘটলে তা থেকে লাভের চেয়ে ক্ষতির অংকই বাড়ে। এ ভয়ানক কাজটি দেশের শত্রুদের। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশে ইতিহাস দূষণের কাজটিই প্রকাণ্ড ভাবে হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে দেশবাসীর শত্রুর অভাব নাই। এবং তারা নিষ্ক্রিয়ও নয়। বাংলাদেশ এখন তাদের হাতেই অধিকৃত। যারা দেশকে গণতন্ত্রশূণ্য করলো, মৌলিক মানবিক অধিকারকে যারা কবরে পাঠালো, নৃশংস স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা দিল, গুম-খুন-ধর্ষণের জোয়ার আনলো, আইনের শাসনকে বিলুপ্ত করলো –তারা সঠিক ইতিহাস লিখতে দিবে, সেটি কি কখনো আশা করা যায়? সঠিক ইতিহাস লিখলে চোরকে চোর, খুনিকে খুনি, ফ্যাসিস্টকে ফ্যাসিস্ট বলতে হয়। তখন ইতিহাসের বইয়ে ভয়ানক দু্র্বৃত্তকে জাতির পিতা বা বন্ধু বলে মহামান্বিত করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু দেশ খুনি, চোর-ডাকাত ও ফ্যাসিস্টদের দখলে গেলে উল্টোটি ঘটে। তখন সবচেয়ে বড় ভোটডাকাতকে যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলা হয়, তেমনি ইতিহাসের বইয়ে ডাকাতদের সবচেয়ে বড় সর্দার বা গুরুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে লেখা হয়। বাংলাদেশে ইতিহাস রচনার নামে সেটিই হচ্ছে।   

রাজনীতিতে নানা পক্ষ থাকে। ইতিহাস নিয়েও নানা পক্ষের নানা কথা থাকে। কাদের কথা ইতিহাসের বইয়ে স্থান পাবে এবং স্কুল-কলেজে ও জনগণকে পড়া হবে -সেটি নির্ধারণ করে রাজনীতির বিজয়ী পক্ষ। পরাজিতরা যত সত্য কথাই বলুক কেন –সেগুলিকে ইতিহাসের বইয়ে স্থান দেয়া হয় না। বিপদ হলো ইতিহাস দূষণের মাধ্যমে অতি দুর্বৃত্ত ও অপরাধী ব্যক্তিকে পূজনীয় হিরো রুপে তুলে ধরা হয়। এবং প্রকৃত বীর সন্তানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়। ইতিহাস দূষিতকরণের উজ্জল উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। এদেশের শিক্ষালয়ে যে ইতিহাস শেখানো হয় তাতে মনে হয়, বাংলাদেশের ইতিহাসের শুরু ১৯৭১ থেকে। এবং বাঙালীর সমগ্র ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটি হলো শেখ মুজিব। সে সাথে এ ধারণাও দেয়া হয়, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও অপরাধী মানুষগুলি হলো তারা যারা মুজিব বিরোধী এবং একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধীতা করেছিল।

শেখ মুজিব যে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে একদলীয় বাকশালের জন্ম দিল, কেড়ে নিল জনগণের মতপ্রকাশ ও মিছিল-টিংয়ের স্বাধীনতা, হত্যা করলো ৩০ হাজারের বেশী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে -সে কথা ইতিহাসের বইয়ে পড়ানো হয় না। এ কথাও পড়ানো হয় না, মুজিবের ভারতসেবী লুটপাটের রাজনীতি ১৯৭৪’য়ে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ডেকে এনেছিল -যাতে বহু লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল। আজ যেমন চোর-ডাকাত, ভোট-ডাকাত ও গুম-খুনের নায়কগণ স্বৈরাচারি হাসিনার পাশে জমা হয়েছে, এরূপ দুর্বৃত্তরা হাজির হয়েছিল শেখ মুজিবের পাশে- এ সত্যটি ইতিহাসের বইয়ে স্থান পায়নি। মুজিব নিজেই তার বক্তৃতায় বাংলাদেশকে চোরের খনি রূপে আখ্যায়ীত করেছেন। কিন্তু সে চোরগণ আসমান থেকে পড়েনি। কোন জঙ্গলেও বেড়ে   উঠেনি। তারা প্রতিপালিত হয়েছে মুজিবের নিজ দল আওয়ামী লীগে। যেমন আজ যারা হাসিনার চোর-ডাকাত ও ভোটডাকাত বাহিনী সদস্য তারা বেড়ে উঠেছে আওয়ামী লীগে। আবর্জনার স্তুপে যেমন মশামাছি জন্ম নেয় ও বেড়ে উঠে, আওয়ামী লীগেও তেমনি চোরডাকাত, ভোটডাকাত, স্বৈরাচারী, গুম-খুন-ধর্ষণের নায়েকগণ বেড়ে উঠে। এটিই তো ইতিহাস। এবং সেটি বার বার প্রমাণিত হয়েছে।    

ইতিহাসের বইয়ে আরেক প্রকান্ড মিথ্যা হলো, একাত্তরে নাকি মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছিল। অথচ প্রকৃত সত্য হলো, মুক্তি বাহিনী সমগ্র বাংলাদেশ দূরে থাক একটি জেলা বা একটি মহকুমা বা একটি থানাও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন করতে পারিনি। ভারত নিজ খরচে এবং নিজ সেনাবাহিনী দিয়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে আলাদা করে দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই ভারত সেটি নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে করে দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কারণ ভারত পাকিস্তানের সৃষ্টিকে শুরু থেকেই মেনে নেয়নি। একাত্তরে তাদের প্রকল্প সফল হয়। একাজে আওয়ামী লীগের কোন নেতাকে তাই প্রাণ দিতে হয়নি। মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষণাও দিতে হয়নি। কার্যত মুক্তি বাহিনীর একজন সদস্যকে রণাঙ্গণে থাকার কোন প্রয়োজন ছিল। ভারতের বিশাল বাহিনী একাই সে কাজে যথেষ্ট ছিল।  মুক্তিবাহিনীকে সৃষ্টি করা হয়েছিল স্রেফ রাজনৈতিক প্রয়োজনে, কোন সামরিক প্রয়োজনে নয়। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান না পাওয়া আরেকটি বিশাল সত্য বিষয় হলো, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোন একটি ইসলামী দল, কোন একজন প্রখ্যাত আলেম, কোন একজন পীর পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেনি। তারা সে কাজকে হারাম বলেছে। ফলে তাদের কেই ভারতে গেছে -সে প্রমাণ নাই। পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধীতা করে এবং সেটিকে বাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভারতের পরিকল্পিত আগ্রাসন বলে নিন্দা জানিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষক। বিবৃতি দিয়েছেন সে সময়ের প্রথম সারির কবি-সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং সাংস্কৃতিক নেতা-কর্মী। ১৯৭১’য়ের এপ্রিলে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলির দিকে নজর দিলে তার প্রমাণ মিলবে। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের সে বক্তব্যের কোন উল্লেখ নাই। পাকিস্তান ভাঙ্গাটি ছিল মুজিবের ভারতপন্থী আওয়ামী লীগ, মাওলানা ভাষানীর চীনপন্থী ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টির নানা উপদল এবং আগ্রাসী ভারত সরকারের সম্মিলিত প্রজেক্ট। এটি ছিল উপমহাদেশের মুসলিমদের দুর্বল করার প্রজেক্ট। ১৯৭১’য়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয়ের পর তাদের ছত্রছায়ায় মুক্তি বাহিনীর কাজ ছিল লক্ষাধিক বিহারী হত্যা, সকল অবাঙালীর সহায়-সম্পদ ও ঘরাড়ি লুট করা। এটি ছিল বাংলার ইতিহাসে প্রথম এথনিক ক্লিন্জিং তথা বর্ণগত নির্মূল ও গণহত্যা। অবাক করার বিষয় হলো বাংলাদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ এ ভয়ানক অপরাধ নিয়ে নীরব। যেন তারা কিছু দেখেনি, কিছুই শুনে নি। সেসময় আরেক নৃশংস বর্বরতা ঘটে দেশের ইসলামপন্থী নির্মূলে। তাই হত্যা করা হয় পাকিস্তানপন্থী আলেম, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ইসলামী দলগুলোর হাজার হাজার নিরস্ত্র নেতাকর্মীদের। বিশেষ টার্গেট ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নিযামে ইসলামী, পিডিপিসহ পাকিস্তানপন্থী রাজনেতিক দলের নেতাকর্মীগণ। ভাষানী ও তার বামপন্থী সহচরগণ আজকের ন্যায় সেদিনও মুজিবের হাতে ইসলামপন্থীদের নির্মূলের বিরুদ্ধে মুখ খুলিনি। পরবর্তীতে ভাষানীপন্থী বামপন্থীগণ স্থান নিয়েছেন বিএনপি’তে। অপর দিকে মস্কোপন্থী বামপন্থীগণ আশ্রয় নিয়েছে আওয়ামী লীগ শিবিরে। এ হলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংস মেরুকরণের ইতিহাস। এ প্রবল মেরুকরণের এক পক্ষে ছিল উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদ, কম্যুনিজম, সেক্যুলারিজম ও ভারতসেবী চেতনা। অপরদিকে ছিল পাকিস্তানপন্থীদের প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্ববোধ। তাদের ছিল মুসলিম শক্তি রূপে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাধ –যা ১৯৪৭ সালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ায় সফলতা দিয়েছিল।

একাত্তরে ভারতসেবী প্রথম পক্ষ বিজয়ী হয়েছিল এবং আজও তাদেরই শাসন হয়েছিল। তাদের বিজয়ের পিছনে মূল শক্তি ছিল আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি ভারত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাত্তরের ন্যায় আজও ভারত বিজয়ী শক্তি। তাই বাংলাদেশে আজ যেখানে পৌছেছে সেটি শুধু মুজিব, হাসিন বা আওয়ামী লীগের একার কামাই নয়। একাত্তরের ন্যায় আজও এর পিছনে রয়েছে ভারত এবং ভারতসেবী সকল ইসলাম বিরোধী শক্তি। স্বেচ্ছায় বাঘের থাবায় ধরা দিলে সেখান থেকে বের হওয়া কি এতই সহজ? সহজ নয় বলেই বিনিপি নেতারাও আজ ভারতের শাসক শক্তির তোয়াজ করে। কারণ তারা জানে ভারতকে ক্ষেপিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। গেলেও ক্ষমতায় থাকা যায় না। ঢাকা, চট্রগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক প্রফেসর এবং বহু বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী যে কেন দল বেঁধে ১৯৭১’য়ের এপ্রিলে পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিবৃতি দিলেন -সেটি বুঝার সামর্থ্য কি ভারতমুখী বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের আছে? নাই। যা আছে তা হলো প্রকৃত দেশপ্রমিকদের রাজকার বলে গালী দেয়া। বেঁচে থাকলে সে গালি বেশী বেশী খেতেন মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা নবাব সলিমুল্লাহ, ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগ সন্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপক শের বাংলা ফজলুল হক, এবং পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কারণ, নিশ্চয়ই তারা মুজিবের ন্যায় ইসলামী চিন্তাশূণ্য, দেশপ্রেমশূণ্য, গণতন্ত্রশূণ্য ও ভারতেসেবী ফ্যাসিস্টের রাজনীতিকে সমর্থন করতেন না। এবং তাকে তাঁরা জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধুও বলতেন না।

২. বিজয় শয়তানের

কুর’আন বুঝা, মুসলিম ঐক্য ও শরিয়ত কায়েম নিয়ে যাদের আগ্রহ নাই, বুঝতে হবে ইসলামের মূল মিশন তারা আদৌ বুঝেনি। এবং বুঝেনি মুসলিমের দায়বদ্ধতা। জাহেল তথা অজ্ঞ থাকাই মানব জীবনে সবচেয়ে বড় পাপ। সে পাপ শুধু মুসলিম হওয়াই অসম্ভব করে না, মানবিক গুণে বেড়ে উঠাও অসম্ভব করে। এবং সে   পাপ আরো অনেক পাপের জন্ম দেয়।এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা নামায-রোযার আগে জ্ঞানার্জন ফরজ করেছিলেন। কথা হলো, অজ্ঞ থাকার সে পাপ কি নামায়-রোযা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ পাঠে দূর হয়? যারা ইসলামের বিজয় নিয়ে ভাবে, তারা ভাবে মুসলিমদের ঐক্য নিয়ে। কেউ যদি মনে করে সে বা তার দল একাই ইসলামের বিজয় আনবে এবং অন্যদের সাথে ঐক্যের দরকার নেই -বুঝতে হবে সে ব্যক্তির ঘাড়ে শয়তান চেপেছে। এছাড়া ঐক্যের পথ পরিহারের কি অন্য কোন কারণ থাকতে পারে? ব্যক্তির ঘাড়ে শয়তানের উপস্থিতি তখন দেখা যায়।

যে ব্যক্তি ঘাড় থেকে শয়তান নামাতে পারে, একমাত্র সেই অন্য মুসলিম ভাইয়ের সাথে একতা গড়ার জন্য পেরেশান হয়ে পড়ে। ভাষা, বর্ণ বা অঞ্চলের নামে গড়ে উঠা বিভেদ ও বিভক্তির দেয়ালগুলি ভাঙ্গা তখন তার মিশন হয়ে দাঁড়ায়। অথচ যারা ইসলাম থেকে দূরে সরে এবং শয়তানের অধীন হয়, তারা রাজনীতি করে ভাষা, বর্ণ ও ভূগোল-ভিত্তিক বিভক্তিকে গভীরতর করার কাজে। তারা মুসলিমদের ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে কাফেরদের অনুগত করে। আরবদের ২২ রাষ্ট্রে বিভক্তি এবয় মুসলিম উম্মাহর ৫৭টি রাষ্ট্রে বিভক্তি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শয়তান তাদের উপর কতটা বিজয়ী। মুসলিমদের বিভক্ত ও ইসলামকে পরাজিত করার সে সেক্যুলার রাজনীতিই বাংলাদেশে বিজয়ী হয়েছে।  বাংলাদেশে আজ ইসলামপন্থিদের উপর যে পরাজয় ও বিপদ -সেটি তাদের নিজ হাতের কামাই। অনৈক্যের পথে নেমে তারা শয়তানকে খুশি করেছে। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়, পাপের পথ শুধু নামায-রোযা পরিত্যাগ করা নয়, অনৈক্যের পথ ধরাও।

৩. জ্ঞানের বিকল্প জ্ঞানই

কুর’আন মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে হিদায়েতের গ্রন্থ, বিজ্ঞান শেখাতে আসেনি। তবে শুধু নিজে হিদায়েত পেলে চলে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের অঙ্গণ থেকে জাহান্নামের পথগুলিও নির্মূল করতে হয়। মুসলিমদের তাই শুধু নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত পালন করলে চলে না, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও দুর্বৃত্তদের নির্মূলেও নামতে হয়। উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণ তো এ ভাবেই সম্ভব হয়। এবং এ কাজে নামলে শয়তানী শক্তির সাথে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ শয়তান এ প্রকল্পের শুরু থেকেই বিরোধী। এবং শয়তানী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে বিজ্ঞান, শিল্প, কৃষি ও অস্ত্র নির্মাণেও বিপুল অগ্রগতি আনতে হয়। সে কাজে সর্বমুখি জ্ঞান জরুরি; কাফিরদের লেখা বইও তখন পড়তে হয়। কারণ জ্ঞানের বিকল্প জ্ঞানই।

নবীজী (সা:) শিক্ষা লাভে চীনে যেতে বলেছেন। তিনি জানতেন চীন থেকে ইসলাম শেখার কিছু নাই, তবে জানার বহু কিছুই আছে। অতীতে মুসলিমগণ তাই মসজিদের জায়নামাযে বসে কাফেরদের লেখা বই পড়েছেন। সে গৌরব কালে মুসলিমগণ কাফের লেখা বিপুল সংখ্যক বই অনুবাদ করে নিজেদের জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।

৪. নিজ হাতের কামাই

স্পেন ও পর্তুগাল জুড়ে মুসলিমদের বহুশত বছরের শাসন ছিল। কোন কোন অঞ্চলে সে শাসন ৭ শত বছর ছিল। সেখানে বহুলক্ষ মুসলিম ও বহুহাজার মসজিদ ও মাদ্রাসা ছিল। স্পেনের ইতিহাসে সে সময়টিই ছিল সমৃদ্ধ কাল। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে স্পেন প্রসিদ্ধ ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র রূপে। কিন্তু গণহত্যার মাধ্যমে তাদের নির্মূল করা হয়েছিল। এ ভয়াবহ বিপর্যয়টি ছিল তাদের নিজেদের কামাই। তা্ই এ জগতে শুধু পরহেজগার ও নেক বান্দা হলে চলে না, সাহসী ও শক্তিশালী হতে হয়। অন্যদের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হয়। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে নির্দেশটি এসেছে পবিত্র কুর’আনের সুরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতে। তাই মুসলিমগণ শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা গড়েনি, মহল্লাগুলি পরিণত হয়েছে ক্যান্টনমেন্টে। মুসলিম আর্মী ছিল সত্যিকার অর্থে জনগণের আর্মী। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ সে পথেই মুসলিমদের বিজয় এনেছিলেন।

অথচ স্পেনের মুসলিমগণ একতার পথ ছেড়ে ধরেছিল অনৈক্যের পথ। স্পেনকে জেলায় জেলায় বিভক্ত করে তারা বহু রাজ্য ও বহু রাজার জন্ম দিয়েছিল। ভাই লড়েছে ভাইয়ের বিরুদ্ধে এবং পুত্র লড়েছে পিতার বিরুদ্ধে। আজকের ২২ টুকরায় বিভক্তি আরবগণ হলো তারই নমুনা। ইসরাইল যে এখনো আরব দেশগুলোকে দখল করে নেয়নি সেটি বস্তুত ইসরাইলের করুণা। ৩০ কোটি বিভক্ত আরবের কি সামর্থ্য আছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়ার। বিভক্ত মুসলিমদের প্রতি এমন করুণা দেখানো কখনোই শত্রুদের রীতি নয়। অতীতে সে করুণা স্পেনের খৃষ্টানগণ দেখায়নি। ধাপে ধাপে ভারত দখলকালে সে করুণা ব্রিটিশগণও দেখায়নি।

৫. দেওবন্দীদের রাজনীতির নানা রূপ

দেওবন্দীদের রাজনীতিতে নানা সময়ে নানা রূপ দেখা গেছে। বাংলাদেশে তাদের সংগঠনের নাম হিফাজতে ইসলাম। এ সংগঠনের নেতাগণ বার বার সাংবাদিক সন্মেলন ডেকে ঘোষণা দিচ্ছেন তারা রাজনীতিতে নাই। বলছেন, হিফাজতে ইসলামী একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। দেওবন্দীদের ইতিহাসে এটি এক নতুন ধারা। প্রশ্ন হলো, রাজনীতি থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া কি ইসলাম সম্মত? তারা কি নবীজী (সা:)’র সূন্নত মানেন না? তারা কি জানেন না যে নবীজী (সা:) ১০ বছর রাষ্ট্র প্রধান ছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন এবং রাজনীতি করেছেন নবীজী (সা:)’র মহান সাহাবাগণ। তাছাড়া এর আগে তাদের পূর্বসুরীগণও  রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন। তবে কি তারা নবীজী (সা:)’র সূন্নত ও তাদের পূর্ববর্তী দেওবন্দী আলেমদের আদর্শকে পরিত্যাগ করে নতুন ফিতনা সৃষ্টি করছেন?

অবিভক্ত ভারতে দেওবন্দিদের মাঝে ২টি দল ছিল। মাওলানা হোসেন আহমেদ মাদানীর নেতৃত্বাধীন দলটির নাম ছিল জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। এ দলটি কংগ্রেসের অখন্ড ভারত নীতির পক্ষ নেয়। তাদের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন কংগ্রেসের নেতা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। তারা মুসলিমদের কোন পৃথক জাতি মনে করতো না। বরং হিন্দুদের সাথে নিয়ে নিজেদের অখন্ড ভারতীয় জাতির অংশ রূপে পরিচয় দিত। সিলেটে এদের অনেক অনুসারি ছিল।১৯৪৬ সালে গণভোটে এরা কংগ্রেসের সাথে মিলে সিলেটবাসীদের পাকিস্তানে যোগ দেয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলে। এরা শুরু থেকেই ছিল পাকিস্তান বিরোধী। কংগ্রেসের নীতিই ছিল তাদের নীতি। ফলে ভারত সরকার তাদের সহযোগিতা দেয়। বাংলাদেশে নির্বাচন কালে অতীতে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার চালাতে মাওলানা হোসেন আহমেদ মাদানীর পুত্র মাওলানা আসাদ মাদানী দেওবন্দ থেকে বহুবার বাংলাদেশে এসেছে। ভারতে সৃষ্ট তাবলীগ জামায়াতের জন্মদাতাও এরাই।

অপরদিকে দেওওন্দ দুই বিখ্যাত আলেম ও  তাফসির লেখক মাওলানা আশরাফ আলী থানবী ও মাওলানা শিব্বির আহমেদ উসমানীর নেতৃত্বাধীন দলটি মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নিজামে ইসলাম দলটি ছিল তাদের অনুসারীদেরই। লালবাগ মাদ্রাসা, হাট হাজারী মাদ্রাসা ও পটিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন তারাই। পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ায় থানবীপন্থি তথা নিজামে ইসলামের অনেক নেতাকর্মীকেই ১৯৭১’য়ে জেলে যেতে হয়। চট্টগ্রামের  পটিয়া মাদ্রাসার মাওলানা সিদ্দিক আহমেদ ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি ছিলেন মাওলানা শফি ও মাওলানা বাবু নগরীদেরও নেতা। পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধিতা করায় শেখ মুজিব মাওলানা সিদ্দীক আহমেদ সাহেবকে জেলে নেন। একাত্তরে অনেককে শহীদও হতে হয়। কাওমীদের আরেক বিখ্যাত নেতা ছিলেন কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত মাওলানা জনাব আতাহার আলী সাহেব। তিনি পাকিস্তানের ন্যায় মুসলিম দেশ ভাঙ্গাকে হারাম বলতেন। এ দলেরই  পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা চৌধুরী মহম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রটি ছিল তাঁর সরকারেরই অবদান। এদলেরই আরেক নেতা ছিলেন কক্সবাজারের এ্যাভোডকেট মৌলভী ফরিদ আহমেদ। তিনি পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন। একাত্তরে তাকে অতি নির্মম ভাবে শহীদ করা হয়। বাংলাদেশ হওয়ার পর ভারতপ্রেমী মাদানীভক্তদের পালে বাতাস লাগে। সে কাওমীদের এক অংশ শেখ হাসিনাকে কওমী জননীও বলছে।

৬. কুর’আন বুঝার গুরুত্ব ও সামর্থ্য

কুর’আন বুঝতে যে আগ্রহী নয়, বুঝতে হবে পবিত্র কুর’আনের মর্যাদা ও গুরুত্ব সে বুঝেনি। বান্দাহর সাথে মহান আল্লাহতায়ালা তার গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলি বলেন পবিত্র কুর’আনের মাধ্যমে। একমাত্র কুর’আনই দেখায় সিরাতুল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের পথ। এবং একমাত্র তারাই হিদায়েত পায় যারা কুর’আন বুঝে। পবিত্র কুর’আনের সুরা আল-ইমারানে বলা হয়েছে, যারা কুর’আনকে আঁকড়ে ধরলো তারাই সিরাতুল মুস্তাকীম তথা জান্নাত পেল। তবে কুর’আনকে আঁকড়ে ধরার অর্থ কুর’আনকে জড়িয়ে ধরে চুমা খাওয়া নয়। তা কুর’আন বুঝা এবং তা অনুসরণ করা।  

যারা বলে, কুর’আন পড়লে আর কোন বই পড়ার দরকার নেই, তারাও ঠিক বলে না। ডাক্তারী বই বুঝতে হলে জীববিজ্ঞান, বায়োকেমেস্ট্রী,এ্যনাটমি, ফিজিওলজিসহ বহু বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় জ্ঞান বৃদ্ধি পেলে কুর’আন বুঝার সামর্থ্যও বৃদ্ধি পায়। অতীতে আত তাবারী, আল রাযী ও আল কুরতুবীর  ন্যায় যারাই বিখ্যাত তফসির লিখেছেন তারা সে সামর্থ্য পেয়েছেন দর্শন, ইতিহাস, সমাজ-বিজ্ঞানের বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকার কারণেই। বাংলাদেশের মাদ্রাসার আলেমদের এখানেই দুর্বলতা। বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলিতে দর্শন, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞানের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি পড়ানো হয় না। তাদের জ্ঞানের ভূবনটি অতি সীমিত। ফলে তাদের দ্বারা তেমন কোন তাফসির গ্রন্থ লেখা হয়নি। ১০/০৬/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *