বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের পাকিস্তান-বিদ্বেষ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

অবজ্ঞা জিন্নাহর প্রতি                                                                          

বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের চেতনার মূল উপাদান যেমন গভীর ভারত প্রেম, তেমনি গভীর হলো পাকিস্তান-বিদ্বেষ। পাকিস্তান কেন সৃষ্টি হলো তা নিয়েই তাদের ক্ষোভ। তাদের চরম ক্রোধ ও পরম অবজ্ঞা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি। তারা নিজেরা ইসলাম পালন ও প্রতিষ্ঠায় অঙ্গিকারহীন হলে কি হবে, জনার জিন্নাহর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, তিনি ইসলাম পালনে নিষ্ঠাবান ছিলেন না। অতএব তাদের যুক্তি, জিন্নাহর গড়া দেশকে কি কখনো সমর্থন করা যায়? সে দেশকে ইসলামী বলা যায়?

কিন্তু কথা হলো, আদালতে মামলা লড়তে কেউ কি উকিলের ধর্মজ্ঞানের খোঁজ নেয়? বরং তাঁরা তো উকিলের উকালতির যোগ্যতা দেখেন। দেখেন, তিনি তাঁর মামলাটি জিতিয়ে দিতে পারবেন কিনা। ১৯৪৭’য়ে ভারতীয় মুসলিমদের সামনে তক্ষনাৎ লক্ষ্যটি খেলাফত প্রতিষ্ঠা ছিল না, শরিয়তের প্রতিষ্ঠাও ছিল না। বরং ছিল এমন একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যেখানে তারা স্বাধীন ভাবে বাঁচবার সুযোগ পাবে। সুযোগ পাবে ভবিষ্যতে সে দেশটিকে ইসলামের দুর্গ রূপে গড়ে তোলার। সে সময় প্রয়োজন ছিল ভারতীয় মুসলিমদের ঐক্য; সে সাথে প্রয়োজন ছিল এমন একজন নেতার যিনি সে ঐক্য গড়ে তোলার যোগ্যতা রাখেন। আরো প্রয়োজন ছিল, স্বাধীন পাকিস্তানের সে কেসটি ব্রিটিশ শাসকদের দরবারে বুদ্ধিমত্তার সাথে পেশ করার। ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়াটি বেওকুফি। প্রথমে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, তারপর সেটির ইসলামীকরণ। তথন শরিয়ত বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবী তুললে সেটির বিরুদ্ধে প্রবল বিরোধীতা আসতো ভারতীয় হিন্দুদের পক্ষ থেকে নয়, বরং ব্রিটিশের পক্ষ থেকে। যে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ উসমানিয়া খেলাফতকে ধ্বংস করলো তাদের শাসনাধীনে থেকে খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবী তুললে সেটি কি তারা মেনে নিত? তখন বরং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রকল্পই নর্দমায় গিয়ে পড়তো।

ব্রিটিশের আদালতে ভারতের মুসলমানদের মামলাটি কে সুন্দর ভাবে পেশ করতে পারবে সে প্রশ্নটি সেদিন অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তখন মুসলিম লীগ ছিল বহু ভাগে বিভক্ত। মুসলিম নেতাদের মাঝে তখন প্রতিটি প্রদেশে চলছিল প্রচণ্ড বিবাদ। বাংলায় ফজলুল হকের মত নেতা নিছক ক্ষমতার লোভে জোট বেঁধেছিলেনে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভার মত প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী শক্তির সাথে, গড়েছিলেন শ্যামা-হক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা। সবচেয়ে বেশী মুসলিমের বাস ছিল বাংলায়। কিন্তু তাঁরা সমগ্র ভারতের মুসলিমদের কি নেতৃত্ব দিবে, তারা নিজেরাই লিপ্ত ছিল প্রচণ্ড কলহবিবাদে। ভারতের ইতিহাসে তখন ক্রান্তিলগ্ন। আগামী বহু শত বছরের জন্য তখন ভারতের নতুন ভৌগলিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্মিত হতে যাচ্ছে। কোন জাতিকে এমন  মুহুর্তের জন্য শত শত বছর অপেক্ষা করতে হয়। ব্রিটিশেরা তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা ভারতের শাসনভার ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। যদি ভারত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতে যায় তবে মহা বিপর্যয় নেমে আসবে ভারতের মুসলিমদের উপর। সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে তারা তখন যা ইচ্ছে তাই করার সুযোগ পাবে। এমনটি হলে মুসলিমদের জন্য তখন শুধু মনিব বদল ঘটবে, স্বাধীনতা আসবে না। বাংলার মুসলিমগণ হিন্দু-মানস ও হিন্দু জমিদারদের নির্মম অত্যাচার ও শোষণ দেখেছে নিজ চোখে এবং নিজ ঘরের আঙিনায়। সেটির বিরুদ্ধে তবুও ব্রিটিশ আদালতে অভিযোগ তোলা যেত। কিন্তু সমগ্র ভারতের শাসন যদি হিন্দুদের হাতে যায় তখন দুর্বিসহ এক মহাবিপর্যয় নেমে আসবে ভারতীয় মুসলিমদের জীবনে। তাই হিন্দুদের হাতে রাষ্ট্রের শাসনভার গেলে তার পরিনতি যে ভয়াবহ হবে তা নিয়ে বাঙালী মুসলিমদের মনে সামান্যতম সংশয়ও ছিল না। বাংলার মুসলিমদের মাঝে শিক্ষার হার তখন শতকরা ৭ ভাগও ছিল না। কিন্তু সে নিরক্ষরতা সত্বেও হিন্দু শাসনের ভয়ানক ভবিষ্যৎ আলামত টের পেতে ভূল করেনি। তাই গান্ধি বা নেহেরুকে তারা বন্ধু রূপে গ্রহণ করেননি। এ ছিল তৎকালীন বাঙালী মুসলিমদের প্রজ্ঞা।

অথচ আজ? বাংলাদেশে আজ  বহু শত প্রফেসর, বহু বিচারপতি, বহু হাজার আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী। ১৯৪৭’য়ে এরূপ শিক্ষিতজনের সংখ্যা আজকের তুলনায় শত ভাগের এক ভাগও ছিল না। কিন্তু আজকের এ ডিগ্রিধারিরা যে কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছেন- বাংলার নিরক্ষর গ্রামীন জনগণ ১৯৪৭ সালে তার চেয়ে অধিক কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন। কাণ্ডজ্ঞান আসে বিবেকের সুস্থ্যতা, চিন্তাভাবনার সামর্থ্য, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও নৈতিক সততা থেকে। সার্টিফিকেট থেকে নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়েও নবীজী (সাঃ)র সাহাবাগণ ছিলেন মুসলিম ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। বিশ্ববিদ্যালয়ের কুশিক্ষা বরং মনের সে মহৎগুলো ধ্বংসও করে দিতে পারে। বাংলাদেশের আজকের শিক্ষাব্যবস্থা তো সে ধ্বংস প্রক্রিয়াকেই প্রকট ভাবে বাড়িয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশ তো মূলত তথাকথিত এ শিক্ষিতদেরই নিজ হাতের সৃষ্টি। এরূপ অপরাধীদের কারণেই গণতন্ত্র হত্যাকারী এক গুরুতর অপরাধী এবং বাকশালী ফাসিস্ট জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধুর খেতাব পেয়েছে। তাদের কাছে ভোটডাকাতও মাননীয় গণ্য হয়। ভারতের বহু হাজার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ভারতীয়দেরকে গরুপূজা ও গোমুত্র সেবন থেকে বাঁচাতে পারিনি তেমনি বাঙালী সেক্যুলারিস্টদেরও বাঁচাতে পারিনি স্বৈরাচারপূজা থেকে।

১৯৪৭ সালে বাংলার নিরক্ষর মানুষগুলো সেদিন তারা ভাষা ও আঞ্চলিক ক্ষুদ্রতার বন্ধনে বন্দী হয়নি। বরং সে বন্ধনের উর্ধ্বে উঠে এক অবাঙালী জিন্নাহকে নিজেদের নেতা রূপে গ্রহণ করেছিলেন, কোন ভারতীয় সেবাদাসকে নয়। গণতন্ত্রের হত্যাকারি কোন ফাসিষ্ট নেতাকেও নয়। এ এক অপূর্ব বিচক্ষণতা। মানবিক গুণের এ হলো এক বিশাল নিদর্শন। এ ছিল প্যান-ইসলামীক ঈমানী চেতনার প্রকাশ। নইলে সেদিন পাকিস্তানই প্রতিষ্ঠা পেত না। জনাব জিন্নাহ ছিলেন সর্বভারতে অন্যতম সেরা আইনজীবী। তাঁর ছিল মুসলিম স্বার্থের প্রতি অটুট অঙ্গিকার। সে অঙ্গিকারটি যখন তিনি কংগ্রেস করতেন তখনও দেখিয়েছেন। মুসলিম স্বার্থের সুরক্ষায় তিনিই ১৪ দফা পেশ করেছিলেন। দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালের দৃষ্টিতে জিন্নাহর সে গুণটি ধরা পড়েছিল বলেই তিনি তাঁকে ভারতের বিপর্যস্ত মুসলিমদের নেতৃত্বের দায়ভার নিতে অনুরোধ করেছিলেন। এ বিষয়টি হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ)ও বুঝতেন। তিনিও কংগ্রেসপন্থি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বিরোধীতার মুখে জিন্নাহর প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্য ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। সে সময় তাঁর মত সুন্দর করে ও বলিষ্ঠ ভাবে আর কে মুসলিমদের দাবীটি উত্থান করতে পেরেছিলেন? মুসলিমদের মনের কথা তার মুখ দিয়ে ধ্বনিত হতো। অখণ্ড ভারতপন্থী সেক্যুলারিস্টরা জিন্নাহর বিরোধীতা করবে –সেটিই ছিল স্বাভাবিক। কারণ সেটিই ছিল তাদের রাজনীতির মূল বিষয়।

ভারতের মদদপুষ্ট বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ জিন্নাহকে ঘৃনা করবে –সেটি তো তাদের রাজনীতির এজেন্ডা। তাদের ঘৃনা তো মুসলিমদের শক্তিবৃদ্ধি ও ইসলামের জাগরণের বিরুদ্ধেও। তাদের এজেন্ডা ও আনন্দ তো মুসলিমদের ইসলামশূণ্য করা নিয়ে। এজন্যই তারা অতি সহজে ভারতীয় হিন্দুদের মিত্র হতে পারে। কিন্তু যারা ভারতীয় মুসলিমদের স্বাধীনতা ও কল্যাণ দেখতে চান -তারা কি জিন্নাহর অবদানকে অস্বীকার করতে পারেন? তার নেতৃত্বেই গড়ে উঠে ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি ভারতের সূন্নী-শিয়া, দেওবন্দী-বেরেলভী, বাঙালী-বিহারী, পাঞ্জাবী-পাঠান, সিন্ধি-বেলুচ তথা নানা ফেরকা ও নানা ভাষার মুসলমানদের একত্রিত করতে পেরেছিলেন। এটি ছিল এক বিশাল কাজ। একাজটি অন্য আর কার হাতে হয়েছে? কার হাতেই বা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল? বহু নেতা ও বহু আলেম এমন মহান কাজে উদ্যোগ নেয়া দূরে থাক, আগ্রহ পর্যন্ত দেখাননি। বরং ব্যস্ত থেকেছেন নিজেদের দল, দরবার, মাদ্রাসা ও হুজরা নিয়ে। সমগ্র ভারতের মুসলিমদের একতাবদ্ধ করা দূরে থাক, অধিকাংশ নেতা বা আলেমগণ তো নিজ ফেরকা¸ নিজ মজহাব বা নিজ প্রদেশের মুসলিমদের একতাবদ্ধ করার ক্ষেত্রেও তেমন যোগ্যতাই দেখাতে পারেননি। বরং ফেরকা ও মজহাবের নামে বাড়িয়েছেন বিভক্তি ও বিভেদ। অথচ বিভক্তি ও বিভেদ গড়া হারাম।

 

খাঁচার জীবন ও স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য

খাঁচার পাখি বাসা বাঁধার চিন্তা করে না। খাবার খোঁজার চিন্তাও করে না। খাঁচার বন্দীদশায় সে সামর্থ্য থাকে না। ফলে সে ভাবনাও থাকে না। কিন্তু খাঁচার বাইরের স্বাধীন পাখিকে সে ভাবনা প্রতি মূহুর্তে করতে হয়। মুসলিম রাষ্ট্র গড়ে শুধু এজন্য নয় যে, সেখানে সে ঘর বাঁধবে, সন্তান পালন করবে ও ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। বরং তাঁর দায়-ভারটি আরো বিশাল। সেটি ইসলামী রাষ্ট্র গড়া এবং সে রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দেয়া। ঈমানদার হওয়ার এটিই তো মূল দায়ভার। এ দায়ভার পালন করতে গিয়েই মুসলিমগণ নিজ মাতৃভূমি থেকে হিজরত করে মদিনায় গিয়েছিলেন। এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে নিজ অর্থ, নিজ শ্রম, নিজ মেধা ও নিজ রক্তের বিনিয়োগ ঘটিয়েছিলেন। নবীজী (সাঃ)র আমলে শতকরা প্রায় ৬০ ভাগের বেশী সাহাবী শহীদ হয়েছেন সে দায়ভার পালনে। খাঁচার বন্দিদশা সিংহকে যেমন শিকার ধরার দায়ভার থেকে দূরে রাখে, তেমনি অমুসলিম দেশের বন্দিদশী মুসলিমকে ভুলিয়ে দেয় শরিয়ত প্রতিষ্ঠার দায়ভার। কেড়ে নেয় ইসলামী সমাজ ও সভ্যতার নির্মাণের সামর্থ্য। তাই কোন অমুসলিমের দেশে ও অমুসলিমদের শাসনাধীনে শরিয়ত বা ইসলামী সভ্যতার প্রতিষ্ঠা ঘটেছে -ইতিহাসে তার নজির নেই। তাই ব্রিটিশ ভারতের মুসলিমগণ সে ঔপনিবেশিক পরাধীনতার দিনে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্টা দূরে থাক, তার স্বপ্নও দেখতে পারিনি। সে স্বপ্ন যেমন হোসেন আহম্মদ মাদানীর ন্যায় দেওবন্দি আলেমগণ দেখতে পারিনি, তেমনি মাওলানা মওদূদীও দেখতে পারিনি। তাবলিগ জামায়াতের মাওলানা ইলিয়াসও দেখতে পারেননি। তারা বড় জোর মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, বই লেখা, পত্রিকা প্রকাশ করা বা ওয়াজ-নসিহতের আয়োজন করতে পারতেন। কিন্তু এভাবে কি পূর্ণ ইসলাম পালন হয়? ইসলামের মিশন বা নবীজী (সাঃ)র সূন্নত শুধু এগুলো নয়।

খাঁচার পরাধীনতার সবচেয়ে বড় কুফল হল, স্বাধীন জীবনের সে সাধই কেড়ে নেয়। কেড়ে নেয় লড়বার আগ্রহ। আনে স্থবিরতা। খাঁচার বাঘকে তাই ছেড়ে দিলেও সে খাঁচা ছেড়ে সহজে বেড়িয়ে আসতে চায় না। তাই যখন উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশের খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার দিন ঘনিয়ে এলো তখনও দেওবন্দী ওলামাদের অনেকে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে মেনে নিতে পারিনি। তারা শুধু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার বিরোধীতাই করেনি, বরং হিন্দুদের অধীনে আরেক খাঁচায় ঢুকাটিকেই শ্রেয়তর মনে করলো। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বড় ফায়দাটি হল, ১৯৪৭’য়ের ১৪ই আগষ্টের পর দেশটির বিশাল মূসলিম জনগোষ্ঠির স্বপ্নই পাল্টে গেল। ফলে যেসব দেওবন্দী আলেম বা জামায়াতে ইসলামীর যে সব নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানে হিজরত করলেন তারা তখন স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন ইসলামী রাষ্ট্র নির্মানের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এ হলো প্রথম এবং সবচেযে বড় সুফল। দীর্ঘ গোলামী জীবনের পার এল এক মহা সুযোগ। জামায়াতে ইসলামের নেতারা তখন ব্রিটিশ শাসনাধীন গোলামী জীবনের দলীয় গঠনতন্ত্র তাড়াতাড়ি পাল্টিয়ে ফেললেন। সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশ নেয়ার এবং পাকিস্তানকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার। অপর দিকে ভারতের জামায়াত বা জমিয়তে উলামা হিন্দের অবস্থা? তারা এখনও কিছু মাদ্রাসা-মসজিদ গড়া, বই লেখা, ওয়াজ মহফিল করা নিয়ে ব্যস্ত। এর বাইরে স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য তাদের অতি সামান্যই। নবীজী (সা:)’র পূর্ণ ইসলাম –যাতে ছিল ইসলামী রাষ্ট্র, জিহাদ, শরিয়ত, হুদুদ, শুরা ও মুসলিম ঐক্য, সেটির পালন দূরে থাক তা নিয়ে তারা ভাবতেও পারেন না।  

                                                   

স্বাধীন মুসলিম ও পরাধীন মুসলিম

কোনটি খাঁচার পাখি আর কোনটি বনের মুক্ত পাখি সেটি বুঝতে বেশী বিদ্যাবুদ্ধি লাগে না। তেমনি কে স্বাধীন মুসলিম আর কে পরাধীন মুসলিম -সেটিও বুঝতেও বেশী বেগ পেতে হয় না। উভয়ের মাঝের ভিন্নতাটি দেহের নয়, পোষাক-পরিচ্ছদ বা খাদ্যের নয়, বরং চেতনার এবং সামর্থ্যর। পাকিস্তান নিয়ে মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদী মহল ও তার দোসররা বড় চিন্তিত। অথচ তাদের সে চিন্তা ২০ কোটি ভারতীয় মুসলিমদের নিয়ে নেই। ১৬ কোটি বাংলাদেশীদের নিয়েও নাই। খাঁচার জীবকে নিয়ে কি কেউ চিন্তা করে? যত ভয় তো বনের মূক্ত বাঘকে নিয়ে। ফলে ইসলামের শত্রু পক্ষের চিন্তার কারণ, পাকিস্তানে জিহাদী চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠা বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিয়ে। তাদের সামর্থ্য তারা দেখেছে আফগানিস্তানের জিহাদে। আফগান মোজাহিদদের সাথে নিয়ে তারাই সোভিয়েত রাশিয়াকে পরাস্ত করে ছেড়েছে। তারাই গড়ে তুলেছিল সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জিহাদ। সে লড়াইয়ে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে অন্যান্য দেশের মুসলমানদের। তারই ফলে হাজার হাজার মুসলিম ছুটে এসেছে সূদুর আল-জিরিয়া, সৌদি আরব, মিশর, লিবিয়া, জর্দান, সিরিয়া থেকে। এটি ছিল এমন এক নিরেট জিহাদ যা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। জিহাদটি ছিল সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন কম্যুনিষ্ট কাফের কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত মুসলিমদের।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ক’জন ভারতীয় মুসলিম সে জিহাদে যোগ দিয়েছে? ক’জন বাংলাদেশী মুসলিম যোগ দিয়েছে? অথচ ভারত ও বাংলাদেশ আলজিরিয়া, মিশর বা সৌদি আরবের ন্যায় আফগানিস্তান থেকে দূরের দেশ নয়। কিন্তু ভারত থেকে কেউ যায়নি। বাংলাদেশ থেকেও তেমনটি যায়নি। খাঁচায় বন্দী মানুষ সামনে মানুষ খুন হতে দেখেও তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করে না। কারণ সে সামর্থ্য তাঁর থাকে না। ফলে কোন সাধারণ ভারতীয় মুসলিম দূরে থাক সেদেশের কোন বিখ্যাত আলেমের মাঝেও সে জিহাদী চেতনা জাগেনি। অথচ বহু হাজার সাধারণ পাকিস্তানীরা সে জিহাদে শহিদ হয়েছেন। শহিদ হয়েছেন এমনকি সেদেশের প্রেসিডেন্ট জেয়াউল হক। তাদের সে রক্ত ও কোরবানীর বরকতেই দুনিয়ার মানচিত্র থেকে সোভিয়েত রাশিয়া বিলুপ্ত হয়েছে। জন্ম নিয়েছে ১৫টি স্বাধীন দেশ। অথচ এর আগেও সোভিয়েত রাশিয়া হাঙ্গেরী ও চেকোস্লাভাকিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। দেশ দুটিকে দখলও করেছিল। কিন্তু সে সময় সোভিয়েত রাশিয়ার গায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও একটি আঁচড়ও কি কাটতে পেরেছে? কারণ সেখানে বহু মিত্র দেশ থাকলেও তাদের পাশে পাকিস্তান ছিল না।

 

কেন এতো পাকিস্তান বিদ্বেষ?

যাদের চেতনায় ইসলাম বিদ্বেষ, তাদের চেতনায় অনিবার্য কারণেই পাকিস্তান-বিদ্বেষ এসে যায়। তাদের কাছে পাকিস্তানের অপরাধ, দেশটি তার জনগণকে দিয়েছে কোর’আন চর্চা ও ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠার অবাধ সুযোগ। সে সুযোগ অধিকাংশ মুসলিম দেশেই নাই্। এমন কি সৌদি আরবেও নাই। সে দেশটির মাদ্রাসাগুলোতে যে ইসলামের চর্চা হয় সেখানে নামায-রোযা, হজ-যাকাতের পাশাপাশি জিহাদ আছে। শরিয়তের প্রতিষ্ঠার তাগিদও আছে। আর সে ইসলামী জ্ঞান চর্চায় যোগ দিচ্ছে বিশ্বের নানা দেশের যুবক। এখানেই মার্কিনীদের ভয়। তারা চায়, মুসলিমদের ইসলাম চর্চায় নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত, বিয়ে-শাদী ও বিবি তালাকের মসলা থাকবে -সেটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ও জিহাদ থাকবে এবং খেলাফতের প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার থাকবে -সেটি হতে পারে না। ভারতে ব্রিটিশ শাসকরা তাদের দীর্ঘ শাসনামলে ইসলাম চর্চাকে এর বাইরে যেতে দেয়নি। মুসলিমদের স্বাধীন কোরআন চর্চার অধিকার তারা কখনোই দেয়নি। সে নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের। তাই তারা পাকিস্তানসহ সকল মুসলিম দেশের স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার সিলেবাসে সংশোধন আনতে চাপ দিচ্ছে।

ইসলামের শত্রুশক্তি জানে, জিহাদ থাকলে আগ্রাসী দেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধও থাকবে। জিহাদ শুরু হবে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়েও। শরিয়ত হলো সেক্যুলার আইন-আদালতের বিরুদ্ধে কোর’আনী বিধান। এটি একটি বিকল্প মূল্যবোধ। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য তাদের আইন-আদালত ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কোন বিকল্প বিধান ও মূল্যবোধ মেনে নিতে রাজী নয়। আফগানিস্তানে মার্কিনী হামলার মূল কারণ তো সেটাই। তারা পৃথিবীকে একটি গ্লোবাল ভিলেজ মনে করে। চায়, সে গ্লোবাল ভিলেজে অভিন্ন পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও আাইনের প্রতিষ্ঠা। তাদের ব্যাভিচারী ও মদ্যপায়ী নাগরিকগণ কোন মুসলিম দেশে বেড়াতে গিয়ে শরিয়তি আইনের মুখে পড়ুক -সেটি তারা মেনে নিতে রাজী নয়। মার্কিনীরা এজন্যই যে কোন দেশে ইসলামী শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরোধী। তাদের অবস্থান ও যুদ্ধ তাই মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। আর মার্কিনীরা যা পাকিস্তান ও অন্যান্য মুসলিম দেশে চায়, ভারত সেটিই বাস্তবায়ন করছে তার খাঁচায় অন্তরীণ ভারতীয় মুসলিমদের উপর। ফলে ভারতীয় মুসলিমদের ইসলাম চর্চায় নামায-রোযা আছে, হজ্ব-যাকাত এবং তাবলিগ জামায়াতও আছে। কিন্তু তাদের মাঝে শরিয়তের প্রতিষ্ঠার কোন ভাবনা নেই। জিহাদও নেই। ফলে তারা বাঁচছে এ এক অপূর্ণাঙ্গ ইসলাম নিয়ে। ভারত সরকার ইসলামের সে মডেলই আওয়ামী লীগারদের দিয়ে বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করাতে চায়। বাংলাদেশের রাজপথে তাই শরিয়ত প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে জনগণ সড়কে না নামলে কি হবে, লাগাতর বেড়ে চলেছে তাবলিগ জামায়াতের ইজতেমায় লোকের সমাগম। এটি ঠিক, পাকিস্তান আজও একটি ইসলামী রাষ্ট্র রূপে প্রতিষ্ঠা পায়নি। তবে যা  প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেটিও কি বাংলাদেশে বা ভারতে কি ভাবা যায়? অন্য কোন মুসলিম দেশও কি এতটা এগিয়েছে। ভারতে মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণে সহজে অনুমতি মেলে না। ফলে দিল্লি, মোম্বাইয়ের ন্যায় অনেক শহরে মানুষ জুম্মার নামায পড়ছে রাজপথে দাঁড়িয়ে। গরু কোরবানী নিষিদ্ধ করা হয়েছে বহু প্রদেশে। অনেক শহরে মাইকে আযানও দেওয়ার অনুমতিও নেই। এই হলো ভারতীয় মুসলিমদের স্বাধীনতা। 

পাকিস্তান প্রতিষ্টার কয়েক বছরের পর সমগ্র উলামা একত্রিত হয়ে ২২ দফা ইসলামী মূল নীতি অনুমোদন করে। আজও সেটি পাকিস্তানে শাসনতন্ত্রের মৌলিক অংশ যা ধাপে ধাপে শরিয়তের প্রতিষ্ঠাকে সরকারের উপর বাধ্যতামূলক করে রেখেছে। এবং অসম্ভব করে রখেছে শরিয়তের বিরুদ্ধে কোন আইন প্রণয়ন। ফলে পাকিস্তানে শরিয়ত পরিপূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলে কি হবে, সে সম্ভাবনা এখনও বিলুপ্ত হয়নি। প্রবর্তিত হয়েছে ব্লাফফেমী আইন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে লিখলে বা বললে প্রাণদণ্ড হয়। অথচ ভারতে সেটি ভাবাও যায় না। শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে স্বপ্নও দেখা যায় না।

ইমারত গড়তে হলে প্রথমে ভূমি চাই। পাকিস্তান মুসলিমদের জন্য সেই ভূমিটা দিয়েছে। তাই যতদিন পাকিস্তানে থাকবে, সে সম্ভাবনাও থাকবে। অথচ বাংলাদেশে আজ শরিয়ত দূরে থাক, গঠনতন্ত্রে বিসমিল্লাহ রাখাই অসম্ভব হচ্ছে। অসম্ভব হয়েছে জিহাদের উপর বই প্রকাশ করা। জিহাদকে বলা হচ্ছে সন্ত্রাস। ইসলামী সংগঠনগুলোকে জিহাদী সংগঠন বলে নেতা-কর্মীদের জেলে ঢুকানো হচ্ছে। ইসলামপন্থীদের দমনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ ভারতীয়দের চেয়েও ভারতীয়। তারা ব্যস্ত তাদের ভারতীয় মনিবদের খুশি করা নিয়ে। কারণ, ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতকে খুশি করাটিকে তারা অপরিহার্য মনে করে। তাই ভারতে হিজাব, ইসলামী সংগঠন বা ইসলাম চর্চার বিরুদ্ধে যা হচ্ছে, বাংলাদেশে হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশী।

বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের চেতনায় যে প্রচণ্ড পাকিস্তান বিদ্বেষ -তার কারণ মূলত ইসলাম ভীতি। তেমন এক প্রচণ্ড ইসলাম ভীতির কারণে শুধু পাকিস্তান নয়, তাদের ঘৃণা ও বিদ্বেষের টার্গেট বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশই যেখানে ইসলামের পতাকা নিয়ে জনগণ জেগে উঠেছে। যে ভয় নিয়ে ভারতের হিন্দুগণ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিল -তা থেকে বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণ এক কদমও দূরে সরেনি। এরাই হলো ঘরের শত্রু। এরা বেঁচে আছে হিন্দু এজেন্ডা নিয়ে। বাংলাদেশী মুসলিমদের জন্য বিপদের মূল কারণ, দেশটি ইসলামের এ চিহ্নিত শত্রুদের হাতেই অধিকৃত।  ২৮/০১/২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *