বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মূল রোগটি কোথায়?

মূল রোগটি দর্শনে

শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়নে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি ছাত্র, শিক্ষক বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানর সংখ্যা নয়। বছরে কত দিন বা কত ঘন্টা ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হয় -সেটিও নয়। পিএইচডি বা সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কতজন বের হলো সেটিও মাপকাঠি নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো, কতজন জ্ঞানবান ও চরিত্রবান মানুষ সৃষ্টি হলো, জাতির মেরুদন্ড কতটা মজবুত হলো, মানবিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক দিক দিয়ে জাতি কতটা সামনে এগুলো –সে বিষয়গুলি। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা বাড়লে নিছক ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাওয়াতে দেশের কল্যান বাড়ে না। শিক্ষালয়েই নির্মিত হয় দেশবাসীর চরিত্র এবং জাতির মেরুদন্ড। এখানে থেকেই জাতি পায় বেঁচে থাকার শক্তি। নির্মিত হয় জাতির মন, মনন ও সংস্কৃতি। নিছক ক্ষেতে-খামারে ও কল-কারখানায় উৎপাদন বাড়ালে জাতি বাঁচে না, সে লক্ষ্যে জ্ঞানদানের আয়োজনও বাড়াতে হয়। বিবেক বা আত্মার পুষ্টির জন্য এটি অপরিহার্য। নইলে দেহ নিয়ে বেঁচে থাকাটি সম্ভব হলেও অসম্ভব হয় বিবেক নিয়ে বাঁচাটি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিপুল ভাবে বেড়েছে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু থানা পর্যায়েই নয়, ইউনিয়নেও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বহু জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাই সরকারি ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত। অথচ আজ থেকে শত বছর আগে সমগ্র দেশে একখানি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। অধিকাংশ জেলায় ছিল না কলেজ। আজ বিপুল হারে বেড়েছে ছাত্র-শিক্ষকের সংখ্যাও। কিন্তু বেড়েছে কি সেগুলিও যা শিক্ষা-বিস্তারের সাথে সাথে বেড়ে উঠা উচিত? মজবুত হয়েছে কি জাতির মেরুদন্ড? বেড়েছে কি সততা ও নৈতিকতা? বেড়েছে কি স্বনির্ভরতা ও আবিস্কারের সামর্থ্য? বেড়েছে কি আত্মমর্যাদা? দূর্নীতির বিস্তারে বনজঙ্গলে বসবাসকারি বহু আদিবাসি থেকেও যে বাংলাদেশ যে নীচে নেমেছে -সেটি কি গোপন বিষয়? ৭০ বছর আগেও নির্বাচনে ভোট দেয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, কিন্তু আজ সে ভোট ডাকাতি হয়ে যায় আগের রাতেই। এসব ভোটডাকাত দুর্বৃত্তগণ যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারি -তা নিয়েও কি সন্দেহ আছে? অতএব এতো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে লাভ হলো কি?

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা অনেক। তবে বড় সমস্যা শিক্ষাখাতে অর্থাভাব নয়। বিদ্যালয় বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কমতিও নয়। বরং মূল সমস্যা এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, দর্শন ও শিক্ষা-পদ্ধতিতে। যা শেখানো হয় ও যারা শেখায়, সমস্যা সেখানে। ১৪ শত বছর আগে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সভ্যতাটি যখন নির্মিত হয়েছিল তখন বাংলাদেশে আজ একটি জেলায় যত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আছে তার সিকি ভাগও ছিল না। যত বই-পুস্তক ও শিক্ষাসামগ্রী নিয়ে আজ বিদ্যাবিতরণের আয়োজন, সেটিও ছিল না।  অথচ সেদিন দারিদ্র্য ও অপ্রতুল অবকাঠামো নিয়ে মানবতায়-সমৃদ্ধ অতি বিস্ময়কর সভ্যতার নির্মান সম্ভব হলেও বাংলাদেশে আজ কেন তা হচ্ছে না। এটি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। চিন্তাশীল মানুষের উচিত তা নিয়ে ভাবা এবং সঠিক উত্তর খুঁজে বের করা। আমাদের জাতীয় জীবনের এটি এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। এবং এর সাথে জড়িত আমাদের বাঁচামরা। ট্রেনের গতি বা যাত্রীদের প্রতি সেবার মান বড় কথা নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো ট্রেনটি কোন দিকে যাচ্ছে সেটি। বাংলাদেশর শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি অসৎ উদ্দেশ্যে চালু করেছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকগণ। প্রণীত হয়েছিল, ঔপনিবেশিক শাসনের একনিষ্ঠ সেবাদাস তৈরীর কাজে। এবং সেটি তারা গোপনও রাখেনি। এ শিক্ষায় শিক্ষিতরা রক্তমাংশে ভারতীয় হলেও বৃটিশের বিশ্বস্ত দাস হওয়াকে তারা অতি সন্মানজনক ভাববে -সেটিই ছিল এর মূল লক্ষ্য। ব্রিটিশ শিক্ষামন্ত্রী লর্ড মেকলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সেটিই সগর্বে ঘোষণা করেছিল। এ লক্ষ্যে তারা সফলও হয়েছিল। এমন গোলাম সৃষ্ঠির কাজে তারা যে শুধু সেক্যুলার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছিল তাই নয়, মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাই কলিকাতায় প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের প্রথম আলিয়া মাদ্রাসাটি আলেমদের প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং সেটি তাদেরই গড়া। ফলে পচনের শিকার হয়েছে উভয় পদ্ধতি।

 

শত্রুর প্রণীত শিক্ষানীতি ও শত্রু উৎপাদন

অথচ শিক্ষিত হওয়া মানেই চরিত্রবান ও বিবেকবান হওয়া। এবং সেটি না হওয়াটাই অশিক্ষা। ডিগ্রি দিয়ে সে অশিক্ষাকে কখনো ঢাকা যায় না। নিজ দেশের স্বাধীনতায় শিক্ষিতরা শ্রম দিবে, অর্থ দিবে, এমনকি প্রাণও দিবে –সেটিই তো কাঙ্খিত। এমন আত্মত্যাগে শিক্ষাব্যবস্থা দেশবাসীর সামর্থ্য জোগাবে এবং সততা ও আত্ম-ত্যাগকে দেশবাসীর আচারে পরিণত হবে – সেটিই তো কাঙ্খিত। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে সেটি হয়নি। কারণ, এ শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে ঔপনিবেশিক শত্রুর হাতে। এবং প্রণীত হয়েছে ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রু উৎপাদনে। বহু স্বদেশী মুসলিমকে তারা হত্যাও করেছে। এ শিক্ষাব্যবস্থায় যারা শিক্ষিত হয়েছে তারা নিজেদেরকে ব্রিটিশের ‘মোস্ট-অবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’ রূপে পরিচিতি দিতে কখনো লজ্জাবোধ করেনি। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের পক্ষে তারা যে শুধু কলম ধরেছে বা অফিস আদালতে কাজ করেছে তাই নয়, দেশে-বিদেশে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে এবং অস্ত্রও ধরেছে। এমনকি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে নিরপরাধ মানবহত্যায় ইরাক, ফিলিস্তিন, আফ্রিকা, ইন্দোচীনসহ নানা দেশে গেছে। এবং সে খুনিদের দলে বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও জাতীয় বীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানিকেও দেখা গেছে। এসবই ইতিহাসের অতি অপ্রিয় সত্য। সাম্রাজ্যবাদীদের দেওয়া মজুরি, পদবী ও উপঢৌকনকে এরা জীবনের  বড় অর্জন ভেবেছে।  ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি আগমনকে অভিনন্দন জানিয়ে কবিতা লিখেছেন এমন কি রবীন্দ্রনাথও। এই হলো ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষিতদের চরিত্র।

১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনমূক্ত হলেও পাকিস্তান বা পরবর্তীতে বাংলাদেশের মানুষ নিজ দেশে ও নিজ ধর্মে অঙ্গিকারহীন এসব বৃটিশ-সেবাদাসদের শাসন থেকে মুক্তি লাভ করেনি। ফলে কিছু রাস্তাঘাট, স্বুল-কলেজ ও শিল্প-করখানা নির্মিত হলেও শিক্ষার মূল লক্ষ্যে পরিবর্তন বা সংস্কার আসেনি। বার বার ভূগোল বা সরকার পরিবর্তন হলেও তাই পরিবর্তন আসেনি বাঁচবার লক্ষ্যে ও রূচীবোধে। বিদেশী স্বার্থের সেবক তৈরীর যে লক্ষ্যে এটি প্রণীত হয়েছিল এখনও সে কাজ অব্যাহত ভাবে চলছে। এদের ভিড়ে দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়াটি বরং বিপদ ডেকে আনে। সম্প্রতি বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফুয়াদকে প্রাণ দিতে হলো তো এদের হাতেই। বিদেশী কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি অঙ্গিকারে নিজ দেশ, নিজ ধর্ম ও নিজ ঐতিহ্য ছেড়ে এরা বিশ্বের যেকোন দেশে যেতে রাজি। বাংলাদেশে এজন্যই দেশপ্রেমিক নাগরিকের প্রচন্ড অভাব। অথচ এদেশের মাটিতে বিদেশীদের অভাব হয় না তাদের এনজিও বা গুপ্তচর সংস্থায় নিবেদিত-প্রাণ চর পেতে।

 

সামর্থ্য দেয় করুণা লাভে ও জান্নাতের যোগ্য হতে

কথা হলো, শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অথচ এর কোন সর্বজন-সম্মত উত্তর নেই। এ জগতে সবাই যেমন একই উদ্দেশ্যে বাঁচে না তেমনি একই উদ্দেশ্যে শিক্ষিতও হয় না। অনেকেই শিক্ষাকে বেশী বেশী জানার মাধ্যম মনে করেন। কেউ ভাবেন, শিক্ষার কাজ যুগোপযোগী নাগরিক গড়া। কেউ বলেন, এর লক্ষ্য ব্যক্তিত্বের বিকাশ। কারো মতে, এটি উপার্জন বৃদ্ধির মাধ্যম। শিক্ষা নিয়ে মানুষের এরূপ ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার কারণ ভিন্ন ভিন্ন জীবনদর্শন। তাই শিক্ষা নিয়ে মুসলমানের ভাবনা অমুসলমানদের থেকে ভিন্নতর। কারণ, অমুসলিম যে উদ্দেশ্যে বাঁচে মুসলিম সে উদ্দেশ্যে বাঁচে না। পথ ভিন্ন হলে পাথেয়ও ভিন্ন হয়। ফলে মুসলিমের হালাল-হারামের বাছবিচার শুধু পানাহারের ক্ষেত্রে নয়। একই রূপ বাছবিচার হয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও। দেহের প্রয়োজনের ন্যায় মুসলমানের মনের প্রয়োজনও অমুসলমান থেকে ভিন্ন। মুসলিম জীবনে শিক্ষার মূল লক্ষ্য, বাঁচার মূল লক্ষ্যে সফলতা দেওয়া। এবং শিক্ষা সামর্থ্য সৃষ্টি করবে মহান আল্লাহর করুণা লাভে ও গড়ে তুলবে জান্নাতের যোগ্য রূপে। বস্তুতঃ মুসলিমের বাঁচার লক্ষ্য ও শিক্ষার লক্ষ্যটি বস্তুতঃ একে অপরের পরিপূরক। প্রশ্ন হলো, বাঁচার লক্ষ্য কি? এ প্রশ্নের উত্তর অমুসলমানের কাছে যাই হোক, মুসলমানের কাছে সেটিই যা পবিত্র কোরআনে বর্ণীত হয়েছে। এবং সেটি হলোঃ “আল্লাযী খালাকাল মাউতা ওয়াল হায়াতা লি ইয়াবলুয়াকুম আইয়োকুম আহসানা আমালা” অর্থঃ  তিনি (সেই মহান আল্লাহ) যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্ঠি করেছেন এজন্য যে তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে কে উত্তম”-(সুরা মূলক, আয়াত-২)। অর্থাৎ দুনিয়ার এ জীবন হলো পরীক্ষাকেন্দ্র। এবং পরীক্ষার শেষ ঘন্টাটি যখন তখন বেজে উঠতে পারে।

যেহেতু জীবনের এ পরীক্ষায় পাশের উপর নির্ভর করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতপ্রাপ্তী, ফলে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা মানবজীবনে দ্বিতীয়টি নেই। একই কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ পরীক্ষায় পাশের প্রস্তুতি। কোন পরীক্ষাতেই জ্ঞান ছাড়া পাশ জুটে না। ফলে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ পরীক্ষাতে পাশের জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা। ইসলামে জ্ঞানচর্চা এজন্যই ফরয। এবং সেটি হয়েছে ৫ ওয়াক্ত নামায এবং মাসব্যাপী রোযা ফরয হওয়ার ১১ বছর পূর্বে। বস্তুতঃ জীবনের মূল পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য বাড়ানো ছাড়া জ্ঞানার্জনের মহত্তর কোন লক্ষ্য নেই। তবে মাথা টানলে কান-নাক যেমন এমনিতেই আসে, তেমনি আখেরাতের পাশের সামর্থ্য বাড়লে, সামর্থ্য বাড়ে বিশ্ব মাঝে বিজয়েরও। সাহাবায়ে কেরাম সেটিই প্রমাণ করে গেছেন। তাই যে জ্ঞানচর্চায় জান্নাতপ্রাপ্তি ঘটে তাতে প্রতিষ্ঠা বাড়ে দুনিয়াতেও। এমন শিক্ষায় সামর্থ্য বাড়ে নেক আমলের। নেক আমলের বর্ণনা দিতে গিয়ে নবীপাক (সাঃ) বলেছেন, পথ থেকে একটি কাঁটা ফেলে দেওয়াও নেক আমল। অর্থাৎ ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ববাসীর জন্য যা কিছু কল্যানকর, এমন প্রতিটি কর্মই হলো নেক আমল। তাই শুধু পথের কাঁটাই নয়, সাহাবায়ে কেরাম অর্থ, শ্রম ও রক্তব্যয় করেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের বুক থেকে দুর্বৃত্ত শাসকের ন্যায় বিপদজনক কাঁটা সরাতে। ফলে অন্যসব কল্যাণকর কাজ-কর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে শুধু নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ও নানারূপ নফল ইবাদতে মগ্ন হওয়াটি নবীজীর সূন্নত নয়।

 

 

সামর্থ্য বাড়ায় নেক আমলের

জ্ঞানার্জন শুধু পথের কাঁটা ফেলাতে শেখায় না, গলার, চোখের বা রাষ্ট্রের বুক থেকে কাঁটা সরানেরা সামর্থ্য দেয়। জ্ঞানের বদৌলে ব্যক্তি পায় বিস্ময়কর সৃষ্টিশীলতা। এবং বিপুল ভাবে বাড়ায় নেক আমলের সামর্থ্য। ইসলামের জ্ঞানচর্চা তাই নিছক কিতাব নির্ভর নয়, বরং নেক-আমল-নির্ভর। কর্মজগতের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটায় জ্ঞানচর্চার। তাছাড়া যথার্থ জ্ঞানলাভ না হলে ধর্মকর্মও সঠিক হয় না। সম্ভব হয় না সিরাতুল মোস্তাকিমে চলাটিও। জ্ঞানের মাধ্যমেই বাড়ে কোটি কোটি মানুষকে অতি অল্প সময়ে আলোকিত করার সামর্থ্য। সামর্থ্য দেয় বিস্ময়কর বিশ্বলোককে দেখার। সেটি যেমন চোখের দৃষ্টিতে, তেমনি মনের দৃষ্টিতে। ইসলামে এটিই হলো মারেফত।ফলে এমন জ্ঞানবান মানুষ দেখতে পায় মহান আল্লাহর অসীম কুদরতকে। মহাশূণ্যে, সাগরের গভীরে, পত্র-পল্লবে তথা সর্বত্র দেখতে পায় মহান আল্লাহর আয়াতকে। ফলে ঈমানের ভূবনে জোয়ার আসে জ্ঞানবান মোমেনের জীবনে।  ঈমান বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষিতে ফলন বাড়িয়ে সে জ্ঞানবান মানুষটি লাঘব করে ক্ষুদার্ত মানুষের যাতনা। যুদ্ধাস্ত্র বানিয়ে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা দেয় ইসলামি রাষ্ট্রের এবং বিনাশ ঘটায় দূর্বৃত্ত শাসনের। এভাবেই জ্ঞানলাভ নানাভাবে বিপুল সমৃদ্ধি আনে নেক আমলে এবং সামর্থ্য দেয় পরীক্ষাপাশে। এরূপ সামর্থ্য লাগাতর বাড়াতে নবীজী (সাঃ) এমনকি সুদূর চীনে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন। নবীজী (সাঃ)র সে নির্দেশ অতি নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিলেন সেকালের মুসলমানেরা। এজন্যই বিজ্ঞানচর্চাকে তারা দুনিয়াদার ভাবেননি, বরং উঁচু পর্যায়ের নেক-আমল ভেবে সে কাজে বিপুল অর্থ, শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করেছিলেন। ফলে কয়েক শত বছরের মধ্যে বিশ্বের নানা ভাষা থেকে বিজ্ঞানের অসংখ্য পুস্তক আরবীতে তর্জমা করেছিলেন এবং গড়ে তুলেছিলেন বিশাল জ্ঞান-ভান্ডার। ফলে স্বল্প সময়ে সম্ভব হয়েছিল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মান এবং বিশ্বশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠালাভ।

তাই বিজ্ঞানচর্চাকে দুনিয়াদারি বলা শুধু মুর্খতাই নয়, আত্মঘাতিও। এমন মুর্খতায় যে শুধু নেক আমলের কমতি দেখা দেয় তাই নয়, মুসলিম উম্মাহ ভয়ানক ভাবে শক্তিহীন হয়। ফলে পরাজিত এবং অপমানিতও হয়। আর এরূপ আত্মঘাতি কর্ম সমাজে ব্যাপ্তি পেলে বহিঃশক্তির প্রয়োজন পড়ে কি? মুসলমানদের আজকের পরাজয়ের মূল কারণ, শিক্ষার গুরুত্ব ও নেক-আমল নিয়ে বিভ্রান্তি। এ বিভ্রান্তির কারণে বিজ্ঞান চর্চাকে দুনিয়াদারি বলে সেটিকে মাদ্রাসার অভ্যন্তরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। দেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা ও তার শিক্ষকগণ আজও বেঁচে আছে এ বিশ্বাস নিয়ে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার এটি অতিশয় আত্মঘাতি দিক। আধুনিক জ্ঞানের সন্ধানে আলেমগণ সুদূর চীনে যাওয়া দূরে থাক নিজ দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও খোঁজ নেয়নি। তারা উদ্যোগী হয়নি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঁটা সরাতে। আবর্জনা সরানো হয়নি দেশের রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রশাসন থেকে। এমনকি নানারূপ দূর্নীতির আবর্জনা জমেছে খোদ মাদ্রাসাগুলির অভ্যন্তরে। ফলে দেশ যে আজ দূর্নীতির শিকার সে জন্য আলেমগণও কি কম দায়ী?

পরীক্ষাকেন্দ্রে বসে কোন পরীক্ষার্থী আমোদফুর্তিতে মত্ত হয় না। জানালায় দাঁড়িযে প্রৃকৃতির দৃশ্য দেখে না। বরং নেক কাজে যা কিছু অমনযোগী করে তা থেকে নিজেকে দূরে রাখে। পরীক্ষায় নম্বর বাড়াতে কাজে লাগায় প্রতিটি মুহুর্তকে। আনন্দ-উল্লাস বা শিল্প-সংস্কৃতির নামে মুসলমান তাই নাচগান, উলঙ্গতা, অশ্লিলতাকে প্রশ্রয় দেয় না। এগুলি জীবনের মূল মিশন থেকে বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত করে। মহাবিপদ ডেকে আনে ব্যক্তির জীবনে। এগুলি এজন্যই ইসলামে হারাম। মোমেনের জীবনে এ জন্যই সদা ব্যস্ততা নেক আমলে। খলিফা হয়েও ভৃত্তকে উটের পিঠে চড়িয়ে নিজে রশি ধরে টানা বা রাতে না ঘুমিয়ে আটার বস্তা নিজে কাঁধে গরীবের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার মত ইতিহাস নির্মিত হয়েছে এমন এক বলিষ্ঠ চেতনার কারণেই। নিজে সূদখোর, ঘুষখোর বা দুর্বৃত্ত হওয়া দূরে থাক, রাষ্ট্র ও সমাজকে দুর্বৃত্তমূক্ত করার নিয়তে সে শুধু শ্রম ও অর্থই দেয় না, জীবনও দেয়। এমন সৃষ্টিশীল চেতনা শূন্যে নির্মিত হয় না। এজন্য জ্ঞান চাই এবং জ্ঞানচর্চার উপযুক্ত কেন্দ্রও চাই। নবীজী (সাঃ) এবং সাহাবায়ে কেরাম কলেজ-বিশ্ববিদ্ব্যালয় না গড়লেও মসজিদের মেঝেতে জ্ঞানচর্চার এমন কেন্দ্র গড়েছিলেন। মুসলিম সমাজে সৃষ্টিশীল মানুষ ও আত্মত্যাগী মুজাহিদ সৃষ্টি হয় এমন প্রতিষ্ঠানের কল্যাণেই। সাম্রাজ্যবাদের দাস হওয়া দূরে থাক, তাদের আধিপত্য বিলুপ্তির কাজে তারা প্রাণপণে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। তখন দেশের প্রতিরক্ষায় সংশ্লিষ্ট হয় প্রতিটি নাগরিক। এমন দেশের স্বাধীনতা তাই বিপদগ্রস্ত হয় না কতিপয় মীরজাফরের বিশ্বাসাতকতায়। বরং স্বাধীনতা রক্ষায় তখন যুদ্ধ হয় প্রতিটি মুসলিম মহল্লায়।

 

হাতিয়ার রাষ্ট্র বিপ্লবের

আলো যেমন অন্ধকার দূর করে, শিক্ষাও তেমনি রাষ্ট্র থেকে অনাচার ও দূর্নীতি সরায়। বিদ্যালয় এভাবে রাষ্ট্রীয় বিপ্লবে ইঞ্জিনের কাজ করে। শিক্ষাব্যবস্থার সফলতা যাচায়ের সবচেয়ে বড় মাপকাঠিটি হলো, এরূপ আত্মত্যাগী চেতনা নিয়ে কতজন শিক্ষার্থী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলো -সেটি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতার বড় প্রমাণ, সে ধরণের আত্মত্যাগী মানুষের চরম স্বল্পতা। বরং ঘটেছে উল্টোটি; বেড়েছে স্বার্থপরতা। সে স্বার্থপরতার কারণে শিক্ষা নিয়ে যারা বের হচ্ছে তাদের বেশীর ভাগই দু’পায়ে খাড়া বিদেশে বা বিদেশীদের সংস্থায় নিজেদের সকল মেধা ও সামর্থ্যের বিনিয়োগে। তীব্র স্বার্থপরতা নিয়ে তারা নামছে সন্ত্রাসে। এবং লুণ্ঠনে হাত দিচ্ছে জাতীয় সম্পদে। ফলে যতই বাড়ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ততই বাড়ছে দূর্বৃত্তের সংখ্যা। যেমন আবর্জনা বাড়লে বাড়ে মশা-মাছির সংখ্যা। ফলে দেশ পরাজিত হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির উপর আধিপত্য বিস্তারে পরিচিত শত্রুদের তাই সীমান্ত-যুদ্ধ করতে হচ্ছে না। আমরা পরাজিত হচ্ছি ঘরের শত্রুদের হাতে। দেশ অধিকৃত চোর-ডাকাত ও ভোট-ডাকাতদের হাতে। বাংলাদেশ দূর্নীতিতে যেরূপ বিশ্বে ৫ বার প্রথম স্থান অধিকার করলো সেটি কি কোন রোগের মহামারি বা কোন প্রতিকূল জলবায়ু বা জলোচ্ছ্বাসের কারণে? এবং এ পরাজয় ও অপমান অশিক্ষা, রোগব্যাধী বা দারিদ্র্যের কারণে হলে সেটি আজ থেকে ১০০ বছর আগেই হওয়া উচিত। কারণ আজকের তুলনায় এগুলি তখনই অধিক মাত্রায় ছিল।

মানুষ বিশ্বাস, কর্ম ও আচারণে ভিন্ন হয় ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষার কারণে। বস্তুর ব্যক্তির শিক্ষা দৃশ্যমান হয় তার কর্ম ও আচরণের মধ্য দিয়ে। কোরআনে এজন্য বলা হয়েছে, ‘যে জানে ও জানে না -তারা উভয়ে এক নয়।’ বলা হয়েছে, ‘ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহি উলামাহ’ অর্থঃ একমাত্র জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করে। অর্থাৎ জ্ঞানীর সংখ্যা কমলে ঈমানদারের সংখ্যাও কমে যায়। আল্লাহভীরু হওয়ার জন্য জ্ঞানার্জন এজন্যই ফরয। তাই এ ফরয শুধু মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার শিক্ষকের উপর নয়, বরং প্রতি মুসলিমের উপর। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম হয়েছেন অথচ জ্ঞানার্জনে লিপ্ত হননি -এমন কোন সাহাবী খুঁজে পাওয়া যাবে না। এবং তাদের জ্ঞানার্জনের পরিধি অংক, বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, অর্থনীতি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে সীমিত ছিল না। ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠার তাগিদে গুরুত্ব পেয়েছিল অহির জ্ঞান (কোরআন) এবং হাদীসের জ্ঞানও। এ ফরয আদায় না হলে ঈমান-আমল যেমন বিশুদ্ধ হয় না, তেমনি সহজ হয় না মহান অআল্লাহর পক্ষ থেকে মাগফিরাত লাভ এবং আখেরাতে নাযাত প্রাপ্তি। জ্ঞানার্জনের ফরয এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এতে ব্যর্থ হলে ক্বাযা আদায়ের সুযোগ নেই। মুসলিম দেশের সরকারের দায়িত্ব, দেশের মুসলিম নাগরিকদের এ ফরয আদায়ের ব্যবস্থা করা। সরকারের এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কাফের দেশের সরকার থেকে একটি মুসলিম দেশের সরকারের মৌলিক পার্থক্য বস্তুতঃ এখানেই। এ দায়িত্ব পালনে অতীতের মুসলিম সরকারগুলি বড় বড় মাদ্রাসা গড়েছে। মাদ্রাসা খরচ নির্বাহের জন্য বিশাল বিশাল ওয়াক্ফ স্টেটের ব্যবস্থা করেছে।

 

বিপদ বাড়াচ্ছে আখেরাতেও

সাধারণ নাগরিক নিজ উদ্যেগে নিজের খাদ্যবস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে পারে, কিন্ত জ্ঞানার্জনের এ ফরয আদায়ে ঘরে ঘরে মাদ্রাসা খুলবে এবং সিলেবাস প্রণয়ন বা বই রচনা করবে -সেটি কি সম্ভব? নাগরিকগণ সে দায়িত্ব নিজ হাতো নিলে সরকারের কাজটি কি? এমন সরকারকে মুসলিম প্রজারা কেনই বা তারা রাজস্ব দিবে? অথচ বাংলাদেশ ১৭ কোটি মুসলমানের দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলিম জীবনে ফরয আদায়ের কোন ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। সেক্যুলার শিক্ষার পাশাপাশি দ্বীনিয়াতের কিছু পৃষ্ঠা বাড়িয়ে ইসলামি জ্ঞানার্জনের ফরয আদায় হয় না; যেমন বিষের সাথে কয়েক চামচ সরবত পানে স্বাস্থ্য বাঁচে না। এমন দুষিত শিক্ষায় পুষ্টি পায় না ঈমান। অথচ বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটিই চালু রয়েছে। ফলে এ শিক্ষায় পূর্ণ-মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাটি নিশ্চিত হচ্ছে না। বরং সেক্যুলার শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামের প্রতি অনীহা ও বহু ক্ষেত্রে ঘৃণাও সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে মুসলিম প্রজাদের দেয়া রাজস্বের অর্থ ব্যয় হচ্ছে তাদের সন্তানদের জাহান্নামের দিকে ধাবিত করার কাজে। সরকারের এ ভয়াবহ ব্যর্থতার বিরুদ্ধে কোন ঈমানদার ব্যক্তি কি চুপ থাকতে পারে? মহল্লা থেকে চোর-ডাকাত বা বাঘ-ভাল্লুক তাড়ানোর চেয়েও অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো ইসলামের প্রতি অঙ্গিকারহীন এরূপ সরকার তাড়ানো।

বিস্ময়ের বিষয় হলো, চিকিৎসার নামে বিষ পান হলে প্রতিবাদ হয়। অথচ বিদ্যাশিক্ষার নামে ব্যাপক হারে ঈমান নাশ হলেও তা নিয়ে প্রতিবাদ নেই। প্রতিরোধও নেই। ভ্যাকসিন শিশুকে বাঁচায় সংক্রামক রোগের হাতে মৃত্যু থেকে। শিশুকে দেয় রোগভোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা। তেমনি শিক্ষা যথার্থ হলে সেটি ছাত্রকে অনৈসলামিক চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণার আক্রমণ থেকে বাঁচায়। দেয় দূর্নীতির বিরুদ্ধে নৈতীক প্রতিরোধের সামর্থ্য। পাপাচারের স্রোতে না ভেসে শিক্ষিত ব্যক্তিটি তখন আত্মনিয়োগ করে পাপাচারের নির্মূলে। দেশে এমন শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়লে সে দেশ কখনোই দূর্নীতিতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে না। জাতি তখন ঈমান নিয়ে শক্ত ভাবে মাথা তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি হয়নি। বরং হচ্ছে উল্টোটি। শিক্ষার নামের ছাত্র-ছাত্রীদের চেতনায় ভ্যাকসিন লাগানো হচ্ছে যাতে ইসলামের দর্শন মগজে না ঢুকতে পারে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার এটিই সবচেয়ে ভয়ানক ব্যর্থতার দিক। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে তাগুতের তথা শয়তানের মোক্ষম হাতিয়ারে। ফলে মুসলিম জীবনে ভয়ানক বিপদ বাড়ছে শুধু পার্থিব জীবনে নয়, অনন্ত অসীম আখেরাতের জীবনেও।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *