বাংদেশের রাজনীতিতে রক্তপাত ও নাশকতা

রক্তপাত কোনদেশেই সৌহার্দ, সম্পৃতি ও একতা গড়ে না। শান্তিও আনে না। যা গড়ে তা হলো পরস্পরের মাঝে গভীর ঘৃনা, বিভক্তি ও সে সাথে নতুন নতুন রক্তপাতের প্রেক্ষাপট। রক্তের স্মৃতি সহজে মুছে না, বরং সেটি বেঁচে থাকে যুগ যুগ ধরে। এবং গভীরতর করে ঘৃনা। রক্তের স্মৃতি ধরেই জাহেলী যুগের আরবগণ একই যুদ্ধ চালিয়ে যেত শত শত বছর ধরে। রাজনীতিতে রক্তাক্ষয়ী পথ তাই প্রজ্ঞাবান নেতাগণ এড়িয়ে চলেন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়তে তাই কোন রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ লড়তে হয়নি। অথচ মুজিব জেনেশুনেই ভয়ানক রক্তপাতের পথ বেছে নেয়। তবে তাতে মুজিবের স্বার্থ যাই থাক, ভারতে স্বার্থ ছিল বিরাট। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই ভারতের লক্ষ্য ছিল, নানা ভাষার ও নানা অঞ্চলের মুসলমানদের মাঝে তীব্রতর ঘৃনা ও বিভেদ সৃষ্টি হোক। আর সে ঘৃনায় ভেঙ্গে যাক উপমহাদেশের মুসলমানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল পাকিস্তান। এ লক্ষ্যে মুজিবের উপরের অর্পিত দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতীয় বাহিনীর ঢুকার উপযোগী প্রেক্ষাপট তৈরী করা। তবে মুসলমানদের মাঝে ঘৃণা ও বিভক্তিকে তীব্রতর ও স্থায়ী করার স্বার্থে মুজিব ও তার সমর্থকগণ শুধু পাকিস্তান ভাঙ্গা নিয়েই খুশি ছিল না। তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় নিরস্ত্র পাকিস্তানপন্থিদের হত্যা, তাদের উপর নির্মম নির্যাতন, তাদের সম্পদ লুট, বাড়ী দখল ও তাদের বিরুদ্ধে লাগাতর ঘৃনা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আরো বিষাক্ত ও বীভৎস করা।

একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হলেও তাই ঘৃণার আগুন ইচ্ছা করেই থামতে দেওয়া হয়নি। বরং সে ঘৃনাকে তীব্রতর করা হয়েছে শুধু একাত্তরের পাকিস্তানপন্থিদের বিরুদ্ধেই নয়, আজকের ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধেও। মুজিবের সে সিদ্ধান্তের কারণেই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে প্রায় অধিকাংশ পৃষ্ঠাই রক্তাত্ব। অসংখ্য মানুষ এতে নিহত হয়েছে, বহু নারী ধর্ষিতা হয়েছে এবং লুন্ঠিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ ঘর-বাড়ী ও দোকানপাট। সে ঘৃনার আগুন শুধু বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষের জীবনই কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে মুজিরেব নিজের জীবনও। বাঁচেনি তাঁর নিজের পরিবার। জীবন কেড়ে নিয়েছে জিয়াউর রহমানসহ আরো অনেকের। আজ সে আগুনেই অবিরাম পেট্রোল ঢালা হচ্ছে। ফলে মৃত্যুও অবিরাম হানা দিচ্ছে বাংলাদেশের আনাচে কাঁনাচে। ফলে দেশ দ্রুত এগিয়ে চলেছে আরেক ভয়াবহ বিভক্তি ও রক্তক্ষরণের দিকে।  

রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ মাধ্যম হলো নির্বাচন। পাকিস্তানে সত্তরের নির্বাচন হয়েছিল তেমনি একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। অথচ যাদের লক্ষ্যই ছিল, পাকিস্তানের বিনাশ তাদের কাছে কি এমন নির্বাচনের কোন গুরুত্ব থাকে? তাই সত্তরের নির্বাচন মুজিবের কাছে ছিল বাহানা মাত্র। নির্বাচনকে তিনি মোক্ষম অস্ত্র রূপে ব্যাবহার করেন পাকিস্তানপন্থি ও ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে মনে বিষ ছড়ানোর কাজে। পাকিস্তানের বিনাশে মুজিবের লড়াইয়ের শুরু একাত্তর থেকে নয়, শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সাল থেকে –সেটি ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারিতে পাকিস্তানের জেল থেকে ফেরার পর সোহরোওয়ার্দী ময়দানের জনসভায় দম্ভভরে তিনি বলেছিলেন। সে জন্য ভারতের সাথে তাঁর আগরতলা ষড়যন্ত্র চুক্তি হয়েছিল বহু আগেই। সে কাঙ্খিত লক্ষে পৌছবার জন্য প্রয়োজন ছিল জনসমর্থন। প্রয়োজন ছিল, পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থিদের বিরুদ্ধে মানুষের মগজকে এতটা ঘৃণাপূর্ণ করা যেন বিনা দ্বিধায় তারা তাদেরকে হত্যা করতে পারে এবং লুণ্ঠন করতে পারে তাদের সহায়-সম্পদ। কোন পরিবারকে শিশুসন্তান ও মহিলাসহ বসতবাড়ি থেকে গাছতলায় নামানোর মত কুৎসিত মানসিকতা সবার থাকে না। এমন নৃশংসতা এমনকি নিষ্ঠুর চোর-ডাকাতদেরও থাকে না। তারাও হাতের কাছে যা পায় তা নিয়েই ভেগে যায়, বসতঘর বা দোকানপাটের উপর দখলদারি নেয়না। কিন্তু মুজিবের সমর্থকদের নিষ্ঠুরতা ছিল বহুগুণ বীভৎস ও বর্বর। তাদের সংখ্যা দুয়েক হাজার ছিল না, ছিল বহু লক্ষ। তারা বহু লক্ষ বিহারী ও পাকিস্তানপন্থিদের রাস্তায় নামিয়ে তাদের ঘরবাড়ীর উপর দখল নিয়েছে। কবজা করে নিয়েছে তাদের ব্যবসাবাণিজ্য। তারই ফলশ্রুতিতে বহু লক্ষ বিহারী বাংলাদেশের বহু শহরে আজও বস্তিতে বাস করে। আর শেখ মুজিব তাদের পুরস্কৃত করেছেন সে অপরাধের আইনি বৈধতা দিয়ে। ফল দাঁড়ালো, বাংলাদেশের হাজারো বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক দস্যুবৃত্তির ইতিহাস সৃষ্টি হলো, অথচ তা নিয়ে বাংলাদেশের আদালতে কোন বিচারই বসলো না, কারো শাস্তিও হলো না। বাংলাদেশ যে পরবর্তীতে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বের প্রায় দুই শতটি দেশকে পিছনে ফেলে বার বার শিরোপা পেয়েছে তার প্রস্তুতির কাজটি মূলতঃ সে সময়েই হয়েছে। যারা সে সময় বিহারী বা পাকিস্তানপন্থিদের সম্পদে হাত দিয়েছে তারাই পরবর্তীতে দেশের সম্পদে হাত দিচ্ছে।  

শেখ মুজিবকে  জনসমর্থণ পেতেও বেগ পেতে হয়নি। সত্তরের নির্বাচনে তিনি ২০টাকা মণ দরে চাউল খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সোনার বাংলার। যে দেশের মানুষের ঘরে শত শত বছর ধরে টিন নেই, ঘরে দরজা নেই, দু’বেলা খাবার নেই, সেদেশের মানুষ এমন প্রতিশ্রুতি পেলে মুজিবকে ভোট দিবে না সেটি কি ভাবা যায়? পরবর্তীতে এ সব প্রতিশ্রুতিই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিশ টাকা মন চাউলের পরিবর্তে শেখ মুজিবের উপহার ছিল দূর্ভিক্ষ। দেশ পরিণত হয়েছিল তলাহীন ভিক্ষার ঝুলিতে। মহিলারা কাপড়ের অভাবে মাছধরা জাল পড়তে বাধ্য হয়েছিল। দুর্বৃত্ত ও ধোকাবাজদের কাছে নির্বাচন যে কতটা মারাত্মক হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত হতে পারে সত্তরের নির্বাচনে সেটিই প্রমাণিত হয়েছিল। নির্বাচন শেষে পাকিস্তানের সংবিধান তৈরী বা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া -এসব নিয়ে শেখ মুজিবের কোন মাথা-ব্যাথা ছিল না। বরং প্রবল আগ্রহ ছিল এবং সে সাথে পরিকল্পিত স্ট্রাটেজীও ছিল, কি করে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ডেকে আনার উপযোগী প্রেক্ষাপট তৈরী করা যায়। তাকে সে মোক্ষম সুযোগটিই দেয় নির্বাচন। শেখ মুজিব নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল নিছক পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলার জন্য। সে লক্ষ্যে তিনি সফলও হয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানকে বলেছিলেন, আমি মুসলিম লীগ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অংশ নিয়েছি। আমি কি করে পাকিস্তান ভাঙ্গতে পারি। টোপ ফেলেছিলেন, বিজয়ী হলে ইয়াহিয়া খানকে প্রেসিডেন্ট বানাবেন। আর ইয়াহিয়া খান তাকে বিশ্বাস করেছিলেন। আর মৃত্যুর আগে তিনি বলে গেছেন, মুজিব কে বিশ্বাস করেই তিনি বড় ভূল করেছেন। এসব কথা আজ আর কোন গোপন বিষয় নয়। বাংলাদেশীদের ন্যায় সাধারণ পাকিস্তানীরাও সেটি জানে। ফলে বাংলাদেশীদের কাছে মুজিব যেরূপেই চিত্রিত হোন না কেন, পাকিস্তানীদের কাছে মুজিব চিত্রিত হয়েছেন একজন বিশ্বাসভঙ্গকারী গাদ্দার রূপে। এমনকি ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানদের কাছেও মুজিব কোন ভাল পরিচয় পাননি। কারণ, একটি মুসলিম দেশ বিভক্ত হোক সেটি কোন মুসলমান চায় না। আজকের বিপর্যস্ত ইরাক ও সুদান খন্ডিত হোক – সেটি কি কোন মুসলমান কামনা করে? ফলে সেদিন পাকিস্তানের বিভক্তিও তারা চায়নি। ভারতের ন্যায় একটি কাফের রাষ্ট্রের হাতে ৯০ হাজার মুসলমান বন্দী হোক সেটিও কোন মুসলমানের কাছে আনন্দদায়ক ছিল না। ফলে ভারতের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি বিশ্বের মুসলমানেরা সুনজরে দেখেনি। ফলে শেখ মুজিব ঘৃনীত হয়েছেন সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। সেদিন তিনি চিত্রিত হয়েছিলেন হিন্দুপ্রধান ভারতের এজেন্ট রূপে। এজন্যই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশরূপে স্বীকৃতি দিতে মুসলিম দেশগুলো ইতস্ততঃ করেছে। বরং তাদের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা গিয়ে পড়ে পরাজিত পাকিস্তানের প্রতি। সত্তরের দশকের প্রথম দিকে ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমা বিশ্বকে শায়েস্তা করতে আরব দেশগুলোর চাপে ওপেক হঠাৎ তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে সৌদিআরব, ইরান, কুয়েত, দুবাই, বাহরাইন, কাতারের মত দেশে সৃষ্টি হয় বিপুল অর্থভান্ডার। শুরু হয় ব্যপক উন্নয়ন কাজ এবং সৃষ্টি হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ। আরব দেশগুলো তখন গভীর সহানুভুতি নিয়ে চাকুরীর দোয়ার বিশেষ ভাবে খুলে দেয় সামরিক ভাবে পরাজিত ও মানসিক ভাবে আহত পাকিস্তানীদের জন্য। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানী তখন সেখানে গিয়ে হাজির হয়। অথচ মুজিবের নেতৃত্বে ভারতের একটি তাঁবেদার সরকারের কারণে সে শ্রম-বাজারে ঢুকা অসম্ভব হয় বাংলাদেশীদের জন্য। বাংলাদেশীদের জন্য দরজা খোলা দূরে থাক, আরবদেশগুলো তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতিই দেয়নি। একাত্তরের যুদ্ধ শুধু দেশে নয় বিদেশেও কীরূপ বিদ্বেষ ও ঘৃণা বাড়িয়েছিল এ হলো তার নমুনা। অপর দিকে একাত্তরের যুদ্ধ শেষে সাহায্য দেয়া শুরু হয়ে পাকিস্তানে। পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশটির অখন্ডতা বাঁচাতে প্রত্যক্ষ্ ভাবে সাহায্য করতে না পারলেও যুদ্ধ শেষে আর্থিক ভাবে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ফলে যুদ্ধে পাকিস্তানের যা ক্ষতি হয়েছিল তার চেয়ে বহুগুণ বেশী পেয়েছিল বন্ধু রাষ্ট্রগুলো থেকে। অপরদিকে ভারত সাহায্য না করে মনযোগী হয় বাংলাদেশে যা কিছু সম্পদ ছিল তা ত্বড়িৎ লুন্ঠনে। সীমান্ত বাণিজ্যের নামে শুরু হয় বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে অর্থনৈতিক ফুটো সৃষ্টির কাজ। এভাবে দেশটির তলা ধ্বসিয়ে দেয়। ফলে অসম্ভব হয়ে পড়ে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত রিলিফের মালামাল ধরে রাখাও। এরূপ অবস্থা দেখে হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে “তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি” আখ্যা দিয়েছিলেন। এ খেতাবে বাংলাদেশ তখন পরিচিতি পায় বিশ্ব জুড়ে। এভাবেই নেমে আসে ভয়ানক দুর্ভীক্ষ। ফলে ১৯৪৭য়ে যে বিশাল বৈষম্য নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যাত্রা শুরু হয়েছিল তা পাকিস্তানের ২৩ বছরে অনেকটা কমে আসলেও মুজিব শাসনে দুই দেশের মধ্যে সেটি আবার দ্রুত বেড়ে যায়। মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ তখন দ্রুত ধাবিত হয় দূর্ভীক্ষ ও “তলাহীন ভিক্ষার ঝুড়ি” হতে, আর পাকিস্তান ধাবিত হয় বিশ্বের সপ্তম আণবিক শক্তি হতে।  

বাংলাদেশ আজ বিভক্ত শুধু রাজনৈতিক ভাবেই নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আদর্শিক ভাবেও। এক শিবিরে অবস্থান নিয়েছে ভারত-ভক্ত ইসলাম-বিরোধী পক্ষ, অপর শিবিরে তাদের বিরোধীরা। দুই পক্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলী যে ভিন্ন তাই নয়, ভিন্ন তাদের নেতা, বীর, কবি-সাহিত্যিক ও গর্বের বিষয়গুলোও। সে ভিন্নতা প্রকাশ পায় তাদের রাজনৈতিক শ্লোগানেই শুধু নয়, বরং তাদের ছেলেমেয়েদের নামকরণ, পোশাকপরিচ্ছদ ও রীতি-নীতির মধ্যেও। একপক্ষ ভালবাসে তাদের সন্তানদের নাম হোক এবং সে সাথে মহান আদর্শ হোক আবু বকর, ওমর, আলী, ওসমান, হাসান, হোসেন, খালেদ, খাদিজা, ফাতিমা ও সুমাইয়া। অপর পক্ষের অতি পছন্দীয় নাম হলো জয়, পুতুল, আকাশ, বাতাস, সাগর, সমুদ্র ইত্যাদী। একদলের কাছে বীর হলো সূর্য সেন, প্রীতিলতা ও ক্ষুদিরাম, আর অনুপ্রেরণার উৎস লালন ফকির ও রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য। অপর পক্ষটি অনুপ্রেরণা পায় পবিত্র কোরআন-হাদীস ও ইসলামী দর্শন থেকে। সাধারণতঃ এমন গভীর বিভক্তি গড়ে উঠে যুদ্ধরত দু’টি জাতির মাঝে। আর যুদ্ধ না থাকলে, এমন বিভক্তি যুদ্ধকেই অনিবার্য করে তুলে। অথচ বাংলাদেশে এমন বিভক্তি পাকিস্তান আমলে ছিল না। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলেও ছিল না। বাংলায় মুসলিম জাগরণ এসেছিল উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে, হিন্দুদের মাঝে নবজাগরণে শুরুর প্রায় দুই দশক পরেই। সে জাগরণের মূল সূর ছিল ঐক্য। সে ঐক্যই বাংলার রাজনীতিতে তাদের বিজয় এনে দিয়েছিল, এবং সেটি প্রতিপত্তিশালী হিন্দুদের বিরুদ্ধে। সে ঐক্যে ঈর্ষান্বীত হয়েছিল এমন কি হিন্দুরাও। বাংলায় প্রথম সংসদীয় নির্বাচন হয় ১৯৩৭ সালে। এরপর হয় ১৯৪৬ সালে। দুই নির্বাচনেই মুসলমানগণই বিজয়ী হয়। তখন বাংলার জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৪৫ জন ছিল হিন্দু। শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য ও ধনসম্পদে তারা ছিল মুসলমানদের থেকে বহুগুণ এগিয়ে। কোলকাতার প্রায় ৭০ ভাগ বাসিন্দাই ছিল তারা। কিন্তু এরপরও মুসলমানগণ ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এক যুগের বেশী কাল ধরে অখন্ড বাংলার রাজধানী কোলকাতায় প্রধানমন্ত্রীর আসনে কোন হিন্দুকে বসতে দেয়নি। অথচ আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯০জন মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও দেশটি পরিণত হয়েছে ভারতের আজ্ঞাবহ এক তাঁবেদার রাষ্ট্রে। তখন বাংলার মুসলমানদের দুইটি প্রধান দল ছিল। একটি ছিল মুসলিম লীগ এবং অপরটি ছিল শেরে বাংলার নেতৃত্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টি। তাদের মাঝে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মুসলমানদের কল্যাণের মাঝে ঐক্যও ছিল। কংগ্রেস ছিল মূলতঃ হিন্দুদের দল, যদিও তাতে কিছু সেকুলার মুসলমানও ছিল। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ ও কৃষক-প্রজা পার্টি মিলে প্রথমে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে, পরবর্তীতে মুসলিম লীগের পতাকা তলে একীভূত হয়ে যায়। নেতাগণ তখন একতার গুরুত্ব বুঝেছিলেন, এবং বুঝেছিলেন বিভক্তির কুফলগুলোও। শুধু বাংলার মুসলমান নয়, একতার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন উপমহাদেশের মুসলমানগনও। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মূলতঃ সে একতার বলেই। আজকের মত এত বিভক্তি এবং হিন্দু সম্প্রসারণবাদীদের প্রতি এত আনুগত্য থাকলে বাংলাদেশ সেদিন আরেক কাশ্মির হতো। মুসলমানদের সে ঐক্য দেখে হিন্দুরা টের পায়, বাংলার উপর তাদের আধিপত্যের দিন শেষ। সে হতাশা থেকেই আধিপত্যবাদী হিন্দুগণ অখন্ড বাংলাকে খন্ডিত করার দাবী তোলে। দাবী তোলে হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম বাংলাকে ভারতভূক্ত করার।  

পাকিস্তান আমলেও অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। দেশে তখনও বহু দল ছিল। তাদের মাঝেও নানা বিরোধ এবং বিতন্ডা ছিল। কিন্তু সে বিরোধ সত্ত্বেও বিভিন্ন দলের সদস্যরা পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে একসাথে বসেছে। নানা বিষয়ে তখন গোলটেবিল বৈঠকও হয়েছে। নেতারা একে অপরের মুখ দেখেনি বা মাসের পর মাস লাগাতর সংসদ-বর্জন করেছে, এমন ইতিহাস তখন নির্মিত হয়নি। কিন্তু সে ইতিহাস লাগাতর নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশে। দেশটিতে রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই হলো, বিভক্তি ও বিবাদকে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী করা। বিভক্তির রাজনীতি শুধু দেশই ভাঙ্গে না, বিভক্ত করে জনগণকেও। তখন বাড়ে ঘৃণা, বাড়ে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জজবা। ঘৃণার বশে তখন আগুন ধরে রক্তে। এটাই হলো একাত্তরের চেতনা। ইসলামী চেতনায় একতা গড়া ফরজ। এটা ইবাদত। আর একাত্তরের চেতনায় জরুরী হলো বিভেদ ও বিভক্তি। ১৯৭১ য়ের ১৬ই ডিসেম্বরে অখন্ড পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু ঘৃনা বেঁচে আছে। তাই বেঁচে আছে সে ঘৃনা নিয়ে প্রতিপক্ষ হত্যার নেশাও। তাই যে ঘৃনা নিয়ে তখন আওয়ামী ক্যাডার, মুক্তি বাহিনী সদস্য, মুজিব বাহিনী, সেনা-সদস্যগণ পাক-সেনা ও পাকিস্তান-পন্থিদের হত্যায় নেমেছিল সে ঘৃনা নিয়েই পরে তারা একে অপরকে হত্যা করেছে। তাদের এখনকার গবেষণা, সে ঘৃনাকে কি করে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখা যায় তা নিয়ে। ফলে বাংলাদেশের বিপর্যয় বাড়াতে বিদেশী শত্রুকে একটি তীরও ছুড়তে হচ্ছে না।  

অথচ স্বাধীনতা আন্দোলন যে কোন দেশেই জনগণের মাঝে প্রবল একতার জন্ম দেয়। সে একতার বলেই ক্ষুদ্র দেশ প্রবল শত্রুর কবল থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। স্বাধীনতা এমনকি পশু-পাখিরাও পছন্দ করে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন একতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং একাত্তরের লড়াই থেকেই বিভক্তির শুরু। ফলে শুরু দেশটির দূর্বলতারও। প্রায় ১২০০ মাইলে বিভক্ত দূর্বল পাকিস্তানকে খন্ডিত করতে বিশাল ভারতীয় বাহিনীর প্রয়োজন পড়েছিল। অথচ আফগানিস্তানে রাশিয়া বা ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করতে অন্য দেশের যুদ্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি। একাত্তর নিয়ে বাংলাদেশে যে বিভাজন গড়ে উঠেছিল সে বিভাজনই আজ দিন দিন গভীরতর হচ্ছে। ফলে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে আরেক সংঘাতের দিকে। বিবদমান দু’পক্ষের দর্শন ও শ্লোগান দিন দিন আরো উগ্রমূ্র্তি ধারণ করছে। শেখ মুজিবকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বলে একাত্তরের পূর্বে বা পরে কেউ দাবী করতো না। কিন্তু এখন সে দাবী উচ্চকন্ঠে করছে। এবং ভারতকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু। ভারত না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না সে কথাও তারা নিঃসংকোচে বলে। তারা দাবী করে, একাত্তরের ভূমিকার জন্য প্রতিটি বাংলাদেশীর দায়িত্ব হলো ভারতের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা। একথাগুলো সত্তরের দশকেও কেউ বলেনি, কিন্তু এখন অনেকেই বলছে। তারা বলে, টিঁপাই মুখ বাঁধ দেওয়া হলে মেঘনায় পানির প্লাবন বইবে। বেরুবাড়িকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার সময় অন্ততঃ তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশের হাতে দেওয়ার দাবী তুলেছিল, এখন সেটিও আর মুখে আনে না। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এরাই বরং ভারতকে ট্রানজিট দিতে চায়। ভারতের প্রতি শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন একটি ধারণা নিছক একাত্তরে নয়, সেটির জন্ম হয়েছিল বহু পূর্ব থেকেই। তবে একাত্তরের পূর্বে শেখ মুজিব নিজেও সে কথাগুলো প্রকাশ্যে বলার সাহস পাননি। আর এখন সে কথাগুলোই জনসম্মুখে জোরেশোরে বলা হয়ে। এখন ভারতের প্রতি আত্মসমর্পণ ও আনুগত্যের নীতিই হলো তাদের রাজনীতির মূল সূর। একাত্তরের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটাই হলো সবচেয়ে বড় গুণগত পরিবর্তন। তবে আওয়ামী লীগের ন্যায় ভারতমুখী দলগুলোর নেতারা তাদের মনের সব কথা শুরুতে খুলে বলে না, বরং সেটি প্রকাশ করে আস্তে আস্তে। তাই ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে তারা মিথ্যা বললেও এখন আর তা বলে না। বরং তা নিয়ে এখন গর্ব করে।  

মানুষের ভাগ্যবদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারতপন্থি জোটের আসল কাজ এখন মানুষের ঈমান বদল। তাদের লক্ষ্য, সাংস্কৃতিক কনভার্শন। কারণ তারা বুঝে, মানুষের মন ও রাজনীতি শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় না, নিয়ন্ত্রিত হয় তার সাংস্কৃতিক অভ্যাস থেকেও। যার আসক্তি নাচগান ও স্বেচ্ছাচারি জীবন-উপভোগে, তার রাজনীতিতে ইসলাম ও মুসলমানের কল্যাণ-চিন্তা গুরুত্ব পায় না। সে বরং এ দেশ ভারত হলেই খুশি। কারণ সে সুযোগ সেদেশেই বেশী। তাই ভারতীয় হিন্দুদের স্ট্রাটেজী মুসলমানদের হিন্দু করা নয়, বরং সেকুলার সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ করা। এভাবে ডি-ইসলামাইজড করা। সংস্কৃতি চর্চার নামে ভারতভক্তরা বাংলাদেশে সেটিই ব্যাপকতর করছে। এমন কনভার্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশীদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং কর্মসূচীকে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা ভারতের পছন্দসই করতে চায়। এ পথে বড় বাঁধা হলো ইসলাম। ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে যে কারণে পাকিস্তানে সৃষ্টি হয়েছিল এবং পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম বাংলার সাথে ভারতে না গিয়ে পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিল সেটি ভাষা, গায়ের রং বা ভূগোল ছিল না, সেটি ছিল ইসলাম। এখন সে ইসলামকেই তারা জনগণের চেতনা থেকে সরাতে চায়। রাজনীতিতে ইসলামের অনুসরণকে বলছে সাম্প্রদায়িকতা। বলছে অনাকাঙ্খিত। ফলে তাদের ধারণা, ইসলামী চেতনা বিলুপ্ত হলে বা দূর্বল হলে সবল হবে ভারতের সাথে সম্পর্ক। এজন্যই তারা বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে শত শত মাঠকর্মী নামিয়েছে, পত্র-পত্রিকা ও টিভি চালু করেছে ইসলামী চেতনার বিনাশে। তারা ভেবেছে, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ধর্মমতের ন্যায় ইসলাম একটি ধর্মমাত্র। তাই ভাবছে, অন্যদের ন্যায় মুসলমানগণও ভারতে লীন হয়ে যাবে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি এটিই ছিল কংগ্রেসী নেতা ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের নসিহত। মুসলমানগণ যে অন্যদের ন্যায় হিন্দুদের সাথে মিশে যায়নি সেটিকেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় অপরাধ মনে করতো। আজ সে একই নসিহত নিয়ে ময়দানে নেমেছে একাত্তরের চেতনার পক্ষটি। ভারতীয় হিন্দুদের ন্যায় তাদের মুখেও আজ রবীন্দ্র সঙ্গীত, হাতে মঙ্গলঘট এবং রাজনীতিতে ভারতের প্রতি আনুগত্য।  

মানুষের ব্যক্তিত্বের ন্যায় তার রাজনীতির বিষয়টিও গোপন থাকে না। ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির কথা, কর্ম ও আচরণে। তেমনি রাজনীতি প্রকাশ পায় তার নীতি, কর্মসূচী ও মিত্রদের দেখে। তাই মুজিবের রাজনৈতিক গোপন মতলবটি অনেকের কাছে অজানা থাকলেও বহু লোক সেটি শুরু থেকেই জানতো। প্রায অর্ধশত বছর পর আওয়ামী লীগের নেতাগণ আজ আগরতলা ষড়যন্ত্রের সাথে শেখ মুজিবের সংশ্লিষ্ঠতাকে একশভাগ সত্য বলছেন। কিন্তু সেটি শুরু থেকেই সত্য জানতেন বহু মানুষ। মুজিবের ফ্যাসীবাদী চরিত্রও তাদের কাছে অজানা ছিল না। তারা সেটি দেখেছে ১৯৭০ সালে নির্বাচনকালে অন্যদলের নির্বাচনী সভা পন্ড করার মধ্যে, তেমনি দেখেছে তার আগে ও পরে। এমন একজন ফ্যাসীবাদী বিদেশী চর যে দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের রক্ষক হবে সেটি অসংখ্য মানুষ বিশ্বাস করেনি। যারা বিশ্বাস করেননি তারাই পরে শতভাগ সঠিক প্রমাণিত হয়েছেন। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন ইসলামপন্থিগণ। ১৯৭০ এর নির্বাচনে হারলেও তাঁরা জিতেছেন সত্যবিচার ও দেশের শত্রু-মিত্র চেনায়। মুজিবের ন্যায় বিদেশীর তাঁবেদার, মানবাধিকারের শত্রু এবং মিথ্যাবাদীর ভন্ডামী ধরতে তাঁরা আদৌ ভূল করেননি। আর সে প্রজ্ঞার কারণেই স্বাধীনতার নামে তারা ভারতের ন্যায় আগ্রাসী শক্তির কোলে গিয়ে উঠেনি। জোয়ারে ভাসার ন্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্রোতে তারা ভেসে যাননি। আগামী দিনের ইতিহাসে ইসলামপন্থি ও পাকিস্তানপন্থি নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবীগন অন্ততঃ সে প্রজ্ঞার জন্য যুগ যুগ ধরে প্রশংসিত হবেন। তবে এমন প্রজ্ঞা তাদের মাঝেই স্বাভাবিক যারা কোরআনী জ্ঞানের সাথে পরিচিত। কারণ, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভূল করে না” এমন তত্ত্বকথায় তাদের বিশ্বাস নেই। পবিত্র কোরআনে মহাজ্ঞানী আল্লাহতায়ালা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিচারবোধের যে মূল্যায়ন করেছেন সেটি আদৌ সুখদায়ক নয়। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর রায় হলো, ‘আকছারাহুম কা’ফিরুন’ (তাদের অধিকাংশই কাফির), ‘আকছারাহুম ফাসিকুন’ (অর্থঃ তাদের অধিকাংশই দুর্বৃত্ত), ‘আকছারাহুম গাফিলুন’ (তাদের অধিকাংশই গাফেল), ‘আকছারাহুম লা’ইয়াশকুরুন’ (তাদের অধিকাংশই শোকর আদায় করে না), ‘আকছারাহুম লা’ইয়ালামুন’ (তাদের অধিকাংশই জানে না)। একটি সেকুলার সমাজের এই হলো অধিকাংশের অবস্থা। অধিকাংশ মানুষের ভোটে বিজয়ী হওয়া এজন্যই খুনি, ব্যভিচারী ও অতিশয় দুর্বৃত্তদের জন্যও অসম্ভব নয়। বিপুল ভোটে বিজয়ী দুর্বৃত্তকে তাই দেশ-ধ্বংস, ঈমান-ধ্বংস, অর্থনীতি-ধ্বংস, স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌত্বের বিনাশ, বাকশাল-প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক অধিকারের বিলোপ –এমন কার্যক্রমের অধিকার দেওয়া যায় না। কারণ, এমন কাজ যেমন ইসলাম-বিরুদ্ধ তেমনি মানবতা-বিরুদ্ধও। এমন কুকর্ম নির্বাচনে জায়েজ হয় না। একাত্তরে পাকিস্তানপন্থিগণ এজন্যই মুজিবের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল।  

সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে তাই কে ভাল আর কে জঘন্য দুর্বৃত্ত সে বিচার হয় না। শেখ মুজিবই তার একমাত্র উদাহরণ নয়। নির্বাচনের মাধ্যমেই হিটলারের ন্যায় মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য স্বৈরাচারির উদ্ভব ঘটেছিল। বেড়ে উঠেছে ফ্যাসীবাদ। মানব হত্যাকে দ্রুততর ও সহজতর করতে সে গ্যাস চেম্বার নির্মাণ করেছিল। এজন্যই বিশ্বের কোন আদালতে ভোটের জোরে বিচার-আচার হয় না। ভোটে বিজয়ী হওয়ার কারণেই মুজিব ও তার দল দেশকে একটি যুদ্ধ উপহার দিবে, দেশকে ভারতের গোলাম রাষ্ট্রে পরিণত করবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিবে -মুজিবকে সে অধিকার দিতে বিপুল সংখ্যক মানুষ রাজী ছিল না। বিপুল ভোটে বিজয়ী হিটলারকে সরাতে বিশ্ববাসীর জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। মুজিব তেমনি একটি যুদ্ধ অনিবার্য করে তুলে পাকিস্তানেও। যারা মুজিবের ভারতপ্রীতি এবং তার ফ্যাসীবাদী চরিত্রের সাথে পরিচিত ছিল তাঁরা একাত্তরে তাঁকে বিশ্বাস করেনি, আজও করছে না। ফলে একাত্তর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু হয় গভীর বিভক্তি। ইউরোপের সৌভাগ্য যে হিটলারের নাৎসী দল ও তার ফ্যাসীবাদ কবরস্থ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে আওয়ামী লীগ ও তারা মুজিবী ফ্যাসীবাদ এখনও বেঁচে আছে। তারা ক্ষমতাসীনও হচ্ছে। ফলে প্রবল ভাবে বাড়ছে আত্মঘাতী বিভক্তিও।  

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *