পতনের পথ ও বিজয়ের পথ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

কীভাবে শুরু হলো পতনযাত্রা?

মুসলিমদের পতনের পথে যাত্রা বহুশত বছর পূর্বে শুরু হলেও এখনো শেষ হয়নি। পতনমুখী এ জাতির উত্থান নিয়ে যারা চিন্তিত তাদের প্রশ্ন, উত্থানের কাজ কোথা থেকে শুরু করতে হবে? এ নিয়েও নানা জন নানা মতে বিভক্ত। অন্য নানা বিষযের ন্যায় এ বিষয়েও নির্ভূল নির্দেশনা মেলে মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত ও নবীজীর (সা:) সূন্নত থেকে। সে সূন্নতের অনুসরণ শিল্প, কৃষি বা বিজ্ঞানের উন্নতি দিয়ে নয়; সেটি অজ্ঞতার দূরীকরণ ও জ্ঞানের উন্নয়ন দিয়ে। এবং সে জ্ঞানটি হলো কোর’আনের জ্ঞান। ব্যক্তি ও জাতির উন্নয়নে নির্ভূল ও অতীতে সফল-প্রমাণিত রোড ম্যাপ হলো পবিত্র কোর’আন। সে রোড ম্যাপের যে স্থান থেকে মহান নবীজী (সা:) তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন আমাদেরও জাতি গঠনের কাজ সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। আর সে নির্দেশনা হলো ’ইকরা’ তথা ’পড়’। “ইকরা” একটি প্রতিকী শব্দ। পড়া বা অধ্যয়ন যেহেতু জ্ঞানার্জনের চাবি, পবিত্র কোর’আনের প্রথম শব্দ রূপে এ শব্দটি তাই বুঝিয়েছে জ্ঞানার্জনের অপরিসীম গুরুত্বের কথা। জ্ঞান দেয় মনের আলো। মনের সে আলো দেয় নানা পথের ভিড়ে সত্য পথটি চিনে নেয়ার সামর্থ্য। মানুষ তখন পায় হিদায়াত। অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রাতের পৃথিবীকে, অজ্ঞতাও তেমনি আচ্ছন্ন করে মনের ভুবনকে। অজ্ঞতা তখন অসম্ভব করে সত্য পথটি চেনা এবং সে পথে পথচলা। তখন জীবনে আসে ভয়ানক বিচ্যুতি। অন্ধকার শিকারের সুযোগ করে দেয় হিংস্র পশুদের, মনের অন্ধকার তেমনি সুযোগ করে দেয় মনুষ্যরূপী শয়তানদের।

শিকারী পশুর ন্যায় শয়তানেরাও এমন একটি অন্ধকার অবস্থার অপেক্ষায় থাকে। সেরূপ একটি অবস্থা সৃষ্টির জন্যই তারা কোর’আনী জ্ঞানের পরমতম শত্রু। শিকার ধরার কাজে তারা ওঁত পেতে থাকে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ন্যায় জীবনের প্রতিটির ক্ষেত্র জুড়ে। শয়তানের ফাঁদগুলো চিনে জীবন বাঁচানোর জন্য চাই জ্ঞান; এবং কোর’আনী জ্ঞান চাই ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, শিষ্ঠ-অশিষ্ঠের পার্থক্য বুঝবার জন্যও। পবিত্র কোর’আনের অপর নাম ফুরকান; ফুরকান হলো সেই মানদন্ড যা দেয় ন্যায় ও অন্যায় এবং সত্য ও অসত্যের মাঝে বাছবিচারের সামর্থ্য। ফলে যার মধ্যে পবিত্র কোর’আনের জ্ঞান নাই, তার কাছে অন্যায়ও ন্যায় এবং অসত্যও সত্য মনে হয়। জাহান্নামের পথও তখন সঠিক মনে হয়। মনের অন্ধকার নিয় বাঁচার এটিই তো ভয়াবহতা। মহান আল্লাহতয়ালা ঈমানদারদের রক্ষা করেন সে বিপদ থেকে; তিনি দেখান আলোর পথ। পবিত্র কোর’আনে পাকে সুরা বাকারায় বলা হয়েছে, ‘‘আল্লাহু ওয়ালী উল্লাযীনা আ’মানু ইয়ুখরিজুহুম মিনায যুলুমাতি ইলান্নূর।’’ অর্থ: ‘‘আল্লাহপাক ঈমানদারের বন্ধু। তিনি তাকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে আসেন।’’ যে আলোর কথা এখানে বলা হয়েছে সেটি সেই মনের আলো‌ তথা জ্ঞান। এ জ্ঞান থেকেই জুটে হেদায়াত বা সত্য পথপ্রাপ্তী। মহান আল্লাহতায়ালার উপর ঈমান আনার প্রতিদানে এটিই হলো বান্দাহর প্রতি মহান আল্লাহর সর্বোত্তম পুরস্কার। ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি বা চেহারা-সুরত নয়। অপরদিকে ঈমানশূণ্যদের বন্ধু হলো শয়তান। শয়তান তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। সে পথে সে জাহান্নামে নেয়। ফলে অজ্ঞতা তাই শয়তানের বড় হাতিয়ার। ফলে যেখানে জাহিলিয়াত বা অজ্ঞতা বেড়েছে সেখানেই বেড়েছে ইসলামবিরোধী শয়তানদের আধিপত্য। এই অজ্ঞতার পথ ধরেই মুসলিম বিশ্ব জুড়ে এসেছে আল্লাহর দ্বীনের পরাজয়; এসেছে শরিয়তের বিলুপ্তি। এসেছে শত্রু শক্তির বিজয়।

পবিত্র কোর’আনের জ্ঞানে জ্ঞানবান হওয়াই হলো মহান আল্লাহতায়ালার নিয়ামত প্রাপ্তির সবচেয়ে বড় আলামত। এবং অজ্ঞতা হলো অভিশপ্ত জীবনের আলামত। নামে মুসলিম হলেও দূর্বৃত্তময় জীবন দেখে তাই নিশ্চিত বলা যায়, সত্যিকার ঈমান ও আল্লাহর নেয়ামতের কোনটিই এমন ব্যক্তির জুটেনি। আজকের মুসলিমদের সেটিই প্রকৃত চিত্র। অথচ আল্লাহর সে নিয়ামতের কারণেই অন্যায়, অসত্য ও অসুন্দরকে মরুর নিরক্ষর মুসলিমরা আজ থেকে ১৪ শত বছর পূর্বে সনাক্ত করতে পেরেছিলেন। ফলে শয়তানের বিছানো ফাঁদ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পেরেছিলেন। সে দুর্বৃত্তি থেকে বাঁচাটিই ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা। অথচ আজ সে সফলতা মুসলিম নামধারি পন্ডিতজনদের জুটছে না। জুটছে না পাশ্চাত্যের এমনকি নবেল-বিজয়ী জ্ঞানীদেরও। ফলে মুসলিম নামধারী শিক্ষিতরা বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশকে দূর্নীতিতে যেমন বিশ্বের শীর্ষে নিয়ে গেছে, তেমনি পাশ্চাত্যের শিক্ষিতরাও ব্যভিচার, ফ্রি-সেক্স, হোমোসেক্সুয়ালিটি, জুয়া ও মদপানের মত আদিম পাপাচারকেও সভ্য আচার রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

কোর’আনের জ্ঞানার্জন এতোই জরুরি যে, এ ছাড়া ব্যক্তির জীবনে অন্য ফরজগুলোও যথাযত পালিত হয় না। ইসলাম খৃষ্টান ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের ন্যায় নয় যে গীর্জার যাযক বা মন্দিরের ঠাকুরকে দিয়ে ইবাদত-বন্দেগী করিয়ে নেওয়া যাবে। ইবাদতের দায়িত্ব ব্যক্তির নিজের, কাউকে দিয়ে এ দায়িত্ব পালন হওয়ার নয়। তাই ইসলামের খলিফাকেও প্রজার ন্যায় একইভাবে নামায, রোযা ও অন্য ইবাদত করতে হয়েছে। আর অজ্ঞতা নিয়ে ইবাদত হয় না, ইবাদতের সামর্থ্য অর্জনে জ্ঞানার্জন তাই অপরিহার্য। জ্ঞানার্জন এজন্যই ইসলামে বাধ্যতামূলক। জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য শুধু পড়া, লেখা বা হিসাব নিকাশের সামর্থ্য বৃদ্ধি নয়; বরং সেটি হলো মনের অন্ধকার দূর করা। ব্যক্তির দেখবার ও ভাববার সামর্থ্যে সমৃদ্ধি আনা। মনের অন্ধকার নিয়ে মহান আল্লাহতায়ার বিশাল বিশাল কুদরতকে দেখা যায় না, দেখা যায় না তাঁর মহান সৃষ্টি-রহস্যকেও। জাহেল ব্যক্তি এজন্যই আল্লাহতায়ালার অসীম সৃষ্টি জগতের মাঝে বসেও তাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ইসলাম মানুষের মনের এ অন্ধকার দূর করতে চায়। তাই জ্ঞানার্জন ইসলামে নিজেই কোন লক্ষ্য নয়, বরং এটি লক্ষ্যে পৌঁছবার মাধ্যম মাত্র। আর সে লক্ষ্যটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন। আর যে ব্যক্তি তাঁকে সন্তুষ্ট করে, সেই তো জান্নাত পায়। এজন্য এটি মু’মিনের জীবন লক্ষ্য। চালক যেমন তার গাড়ীকে চালনার পূর্বে গন্তব্যের লক্ষ্য ও সে লক্ষ্যে পৌঁছবার রোড-ম্যাপকে জেনে নেয়, তেমনি একজন মুসলিমকেও জান্নাতে পৌঁছবার সঠিক রোড-ম্যাপকে জানতে চায়। আর সে রোড-ম্যাপের সঠিক জ্ঞানলাভই মুসলিমের জ্ঞানার্জনের মূল উদ্দেশ্য। রোড-ম্যাপের এ প্রাথমিক জ্ঞানলাভটুকু সঠিক না হলে জীবনে বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি আসবে এবং পরকালে জাহান্নামে নিবে -সেটিই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের বৈপ্লবিক অগ্রগতির পরও অসংখ্য মানব যে আজ সীমাহীন বিভ্রান্তির শিকার তার মূল কারণ তো কোর’আনী রোডম্যাপ নিয়ে অজ্ঞতা।

 

জ্ঞানের ইসলামী সংজ্ঞা

ইসলামে জ্ঞানের নিজস্ব সংজ্ঞা রয়েছে। জ্ঞানের অর্থ এই নয়, তাতে শুধু উপার্জনের সামর্থ্য বাড়বে বা কলাকৌশলে দক্ষতা দিবে। জ্ঞানের মোদ্দা কথা হলো, তাতে ভয় সৃষ্টি হয় আল্লাহতায়ালার। সাহায্য করে সত্য ও মিথ্যাকে চিনতে। এবং চেনায় জান্নাতের ও জাহান্নামের পথ। যে জ্ঞান ব্যক্তির মনে আল্লাহর ভয় সৃষ্টিতে ব্যর্থ -সে জ্ঞান জ্ঞানই নয়। এটি কোন কারিগরী দক্ষতা বা ট্রেড স্কিল হতে পারে তবে -সেটি যথার্থ জ্ঞান বা ইলম নয়। অনেক পশুপাখি বা জীবজন্তুরও বহু দক্ষতা থাকে যা মানুষেরও নেই। কুকুর যেভাবে লুকানো মাদক দ্রব্য বা অপরাধীকে সনাক্ত করে তা মানুষ বা মানুষের তৈরী আধুনিক যন্ত্রের নেই। কিন্তু এর জন্য কুকুরকে জ্ঞানী বলা হয় না। আল্লাহতায়ালা কোর’আন মজিদে বলেছেন, একমাত্র জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করে। এ থেকে এটিই বুঝা যায় আল্লাহপাক জ্ঞান বলতে কি বুঝাতে চান। যার মধ্যে আল্লাহতায়ালার ভয় নেই তার মধ্যে ইলমও নেই। আল্লাহপাক কোরআন মজীদে আরো বলেছেন, “নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টি ও রাত-দিনের ঘুর্ণায়নের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে আয়াত তথা নিদর্শন।” অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার বিশাল গ্রন্থ হলো এ বিশ্ব চরাচর; এ গ্রন্থের প্রতিটি ছত্রে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আয়াত বা নিদর্শন। এবং জ্ঞানী একমাত্র তারাই যারা স্রষ্টার সে গ্রন্থ পাঠের সামর্থ্য রাখে। নানা ভাষার গ্রন্থ পাঠের যাদের সামর্থ্য রয়েছে অথচ আল্লাহতায়ালার এ বিশাল গ্রন্থ পাঠের যোগত্য নেই -তাদেরকে আর যাই হোক জ্ঞানী বলা যায় না। ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞানী তিনিই যার রয়েছে বিশ্ব-চরাচরে ছড়ানো ছিটানো আল্লাহর নিদর্শন থেকে শিক্ষা নেওয়ার সামর্থ্য। এ জ্ঞানটুকু না থাকলে সিরাতুল মোস্তাকীমে চলতে মহান আল্লাহতায়ালার আয়াতগুলো বিশ্বচরাচরের নানা প্রান্ত থেকে যে সিগনাল দেয় -তা বুঝতে সে ব্যর্থ হয়। নবীজীর (সা:) আমলে মুসলিমদের মাঝে স্বাক্ষরতার হার তেমন ছিল না। তবে আল্লাহতায়ালার জ্ঞান-সমৃদ্ধ গ্রন্থ থেকে পাঠ লাভের সামর্থ্যটি আজকের শিক্ষিতদের চেয়ে বেশী ছিল। ফলে সেদিন যেরূপ বিপুল সংখ্যক উঁচু মাপের জ্ঞানীর সৃষ্টি হয়েছিল -তা মানব ইতিহাসের কোন কালেই হয়নি।

আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “জ্ঞানী আর অজ্ঞ ব্যক্তি কখনই এক নয়।” -(সুরা যুমার, আয়াত ৯)। অন্যত্র বলেছেন, “আল্লাহতায়ালা যে ব্যক্তির কল্যান চান তার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দেন।” -(সুরা মুযাদিলা, আয়াত ১১)। অর্থাৎ মানুষের জন্য জ্ঞানের চেয়ে কল্যানকর কিছু নেই। তাই নিছক সম্পদের অন্বেষণে জীবনের সামর্থ্য বিনিয়োগে মানবতা নেই, এটি পশু থেকেও নীচুতে পৌছে দেয়। পশুর পেট পূর্ণ হলে সে আর খাদ্য তালাশ করে না। কিন্তু মানুষ সম্পদের পাহাড়ে বসেও আরো চায়। জ্ঞানার্জন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, মহান আল্লাহতায়ালা তার অনুগত বান্দাদেরকে তাঁর কাছে দোওয়া চাওয়ার ভাষাও শিখিয়ে দিয়েছেন। যেমন: “হে রব, আমার জ্ঞানে বৃদ্ধি করে দাও।” -(সুরা ত্বা হা, আয়াত ১১৪)। আল্লাহতায়ালার শেখানো দোয়ার ভাষা থেকে এটিও সুস্পষ্ঠ যে, জ্ঞান থাকাটাই বড় কথা নয়, উত্তরোত্তর সে জ্ঞানের বৃদ্ধি হওয়া চাই। একটি জাতিকে বিজয়ী জাতি হিসাবে টিকে থাকার জন্য এমন অবিরাম শিক্ষা শুধু জরুরি নয়, অপরিহার্যও। জ্ঞানের বৃদ্ধি যে দিন থেমে যায়, ব্যক্তির মন ও মননের পচনও সেদিন থেকে শুরু হয়। এটি অনেকটা দেহের খাদ্য গ্রহণের মত। খাদ্য গ্রহণ বন্ধ হলে ব্যক্তির জীবনে যেটি অনিবার্যরূপে আবির্ভূত হয় সেটি মৃত্যু। নবীপাক (সা:) এই জন্যই বলেছেন, আফসোস সে ব্যক্তির জন্য যার জীবনে একটি দিন অতিবাহিত হলো অথচ তার ইলমে বৃদ্ধিই ঘটলো না। বলেছেন, ”উতলুবুল ইলম মিনাল মাহদে ইলাল লাহাদ।” অর্থ: “কবর থেকে দোলনা পর্যন্ত জ্ঞান লাভ কর।” অর্থাৎ জ্ঞানার্জন  শিশুর জন্য যেরূপ জরুরি তেমন জরুরি হলো বৃদ্ধের জন্যও। অর্থাৎ দেহে যতদিন প্রাণ আছে, খাদ্য-পানীয় সংগ্রহের যতদিন সামর্থ আছে, জ্ঞানার্জনও ততদিন চালিয়ে যেতে হবে। এ হাদীসটি নিছিক নসিহত নয়; এসেছে নির্দেশের ভাষায়। কথা হলো, নবীজীর (সা:) উম্মতরূপে পরিচয় দিতে যে মুসলিমগণ এতো উচ্চকন্ঠ তাদের মধ্যে এ নির্দেশ পালনে আগ্রহ কতটুকু? আর থাকলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদতার রেকর্ড গড়ে কি করে? হযরত আলী (রা:) বলেছেন, “সম্পদ মানুষকে পাহারাদার বানায় কিন্তু জ্ঞান মানুষকে পাহারা দেয়।” ফলে বিচ্যুতি, বিপদ তথা জাহান্নামের রাস্তা থেকে বাঁচানোর কাজে জ্ঞানহীদের জীবনে কোন পাহারাদার থাকে না। ফলে শয়তানের ছোবলে পড়ে এবং বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি তাদের জীবনে নিত্য সহচর হয়। প্রকৃত মুসলিমের শিক্ষা তাই স্বল্পকালীন নয়, বরং আমৃত্যু। যতদিন পানাহার চলে, ততদিন জ্ঞানার্জনও চলে।

হযরত আলী (রা:) আরো বলেছেন, সম্পদ  চুরি হয়, কিন্তু জ্ঞান চুরি হয় না। কোন ডাকাত সেটি ছিনিয়ে নিতে পারে না। জ্ঞান কাউকে দিলে কমে না, বরং বৃদ্ধি পায়। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা আজ থেকে ১৪শত বছর পূর্বে বিদ্যাশিক্ষাকে সার্বজনীন ও ধর্মীয়ভাবে বাধ্যতামূলক করেছিল। ফলে মাত্র কয়েক শতাব্দিতে তারা জ্ঞানবিজ্ঞানে অভূতপূর্ব বিপ্লব আনে। যে আরবী ভাষায় কোর’আনের পূর্বে কোন গ্রন্থ ছিল না সে আরবী ভাষায় জ্ঞানের এক এক বিশাল ভান্ডার গড়ে তোলে।। রাসূলে পাক (সা:) বলেছেন, “একমাত্র দুই ব্যক্তিকে নিয়ে হিংসা করা যায়: এর মধ্যে এক ব্যক্তি হলেন তিনি যাকে আল্লাহতায়ালা জ্ঞানদান করেছেন এবং তিনি জ্ঞানের আলোকে জীবন পরিচালনা করেন এবং তা অন্যদের শেখান।” -(সহিহ বুখারী ও মুসলীম)। হাদীস পাাকে আরো বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে পথে বের হন, আল্লাহতায়ালা তাঁর জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।” -(সহীহ মুসলিম)।  তিরমিযী শরিফে বলা হয়েছে, নবীপাক (সা:) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনে ঘর থেকে বের হয় সে ব্যক্তি ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে অবস্থান করে। আরো বলা হয়েছে, “জ্ঞানীর ঘুম একজন অজ্ঞ এবাদতকারীর নফল নামাযের চেয়ে উত্তম। যিনি ইলম শিক্ষা দেন তার জন্য আল্লাহতায়ালা রহমত নাযিল করেন। ফেরেশতাকুল, জমিন ও আসমানের বাসিন্দা, এমনকি পিপিলিকা এবং মাছও তাদের জন্য দোয়া করতে থাকে।” -(তিরমিযী শরিফ)। কোন নফল ইবাদতকারীর জন্য সেটি ঘটে না।

 

বিজয়ের একমাত্র পথ

ইসলামের গৌরবকালে মুসলিমদের বিস্ময়কর সফলতার মূল কারণ, এই কোরআনী জ্ঞান। বিশ্বের কোন জ্ঞানই তার সমকক্ষ হওয়া দুরে থাক, তুলনীয়ও হতে পারে না। মানুষের সামর্থ্য অতি সামান্য। যতবড় জ্ঞানী বা বিজ্ঞানীই হোক না কেন সে নিজেই জানে না আগামী কাল বাঁচবে কি বাঁচবে না। তার দৃষ্টি পাতলা কাগজের দেয়ালও ভেদ করতে পারে না। অপর দিকে কোর’আন এসেছে সেই মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা থেকে যার কাছে আসমান জমিনের দৃশ্য অদৃশ্য কোন কিছুই অজানা নয়। সেই মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা মানুষের বোধশক্তির উপযোগী করে পাঠিয়েছেন পবিত্র আল-কোর’আন। এটি মানুষের সামর্থ্য বাড়াতে পারে বিস্ময়কর ভাবে। মগজকে যদি হার্ডডিস্ক বলা যায় তবে কোর’আনকে হলো সেটির জন্য সর্বোত্তম সফটওয়ার। কম্পিউটার শক্তিশালী হলেও সফটওয়ার ছাড়া কিছু করার সাধ্য নেই। অথচ সফটওয়ারের কারণে যাদুকেও হার মানায়। অবশ্য এজন্য সফটওয়ারকেও হার্ডডিস্কের উপযোগী হতে হয়। এজন্যই সফটওয়ারের আবিস্কারককে হার্ডডিস্কে বিশেষজ্ঞ হতে হয়। আর মহান স্রষ্টা আাল্লাহতায়ালার চেয়ে মানুষের মগজের সে খবর আর কে বেশী রাখেন? ফলে মগজকে সৃষ্টিশীল করার কাজে পবিত্র কোর’আনের চেয়ে নির্ভূল সফটওয়ার আর কি হতে পারে? মুসলিমগণ অতি অল্প সময়ে উন্নয়নের যে রেকর্ড গড়েছিল সেটিতো এ সফটওয়ার সঠিক প্রয়োগের কারণেই। অথচ নিজ ক্ষুদ্রতা নিয়ে মানুষ যখনই কিছু করতে ­­চেষ্টা করেছে তখন শুধূ ব্যর্থতাই বাড়িয়েছে। এমন কি সত্য-অসত্য, ন্যায়-অন্যায় ও শ্লিল-অশ্লিলের তারতম্যও নির্ণয় করতে পারেনি। বুঝতে পারেনি উলঙ্গতা, ফ্রিসেক্স, পর্ণোগ্রাফি, হোমোসেক্সৃয়ালিটি, মদ্যপান মানব জাতির জন্য কত বীভৎস ও ক্ষতিকর। এরূপ অজ্ঞতার প্রমাণ মানবসৃষ্ট নানা মতবাদের মাঝে। কম্যুনিজম, জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ ও ফ্যাসীবাদের মত ভ্রান্ত মতবাদের পিছে প্রাণনাশ হয়েছে কোটি কোটি মানুষের। মানব জাতির এ এক করুণ ব্যর্থতা। খরচের অংক তারা বিস্ময়কর ভাবে বাড়িয়েছে। একমাত্র দুটি বিশ্বযুদ্ধেই সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যা করেছে।

ফলে বিজ্ঞানের বিশাল অগ্রগতিতেও বিপদমুক্তি ঘটেনি মানুষের। বরং এককালে যে হিংস্রতা নিয়ে বনের হিংস্র পশুগুলো হামলা করতো তার চেয়েও অধিক হিংস্রতা নিয়ে হামলা করছে মনুষ্যরূপী পশুরা। ফিলিস্তিন, বসনিয়া, চেচনিয়া, কসভো, কাশ্মির, আফগানিস্তান, ইরাক, মায়ানমার, চীন এবং সিরিয়ায় মানুষরূপী যে দানবেরা হিংস্রতা দেখাচ্ছে বা দেখিয়েছে তা কি পশুর চেয়ে কম হিংস্র? আর এ ব্যর্থতার মূল কারণ, শান্তির লক্ষ্যে মানুষের মগজের উপযোগী যে সফটওয়ার আল্লাহতায়ালা দিয়েছিলেন মানুষ সেটিকে কাজে লাগায়নি। ফলে বেড়েছে নানারূপ বিপর্যয় ও অশান্তি। অথচ আরবের মরুবাসী জনগণ এটির প্রয়োগ করে শান্তি, সমৃদ্ধি ও মানবতার উৎকর্ষে বিস্ময়কর রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে শিক্ষার নামে যা হয়েছে তাতে কুশিক্ষাই বেড়েছে। ফলে দেশে স্কুল বেড়েছে, বিপুল সংখ্যায় বেড়েছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ও, কিন্তু আলোকিত মানুষ বাড়েনি। বরং বেড়েছে দুর্বৃত্তদের সংখ্যা; এবং দেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্ব রেকর্ড করেছে। অথচ ইসলাম জ্ঞানদান পদ্ধতিকে পরিপূর্ণ মানুষ তৈরীর হাতিয়ার বানায়। ইসলামী পরিভাষায় এরূপ পরিপূর্ণ মানুষই হলো ইনসানে কামেল। সে ইনসানে কামেল যেমন খানকার দরবেশ নন, তেমনি পীর সাহেবও নন।

 

 ফিরতে হবে কোর’আনের প্রেসক্রিপশনে

একজন বিজ্ঞানীর জ্ঞান একটি বিশেষ বিষয়ে বিস্ময়কর হলেও ধর্ম বিষয়ে তার অজ্ঞতা হাজার বছর পূর্বের আদিম মানুষের চেয়ে আদৌ কম নয়। অপরদিকে মাদ্রাসার ছাত্র বেড়ে উঠছে বিজ্ঞানের বহু মৌল বিষয়ের উপর সীমাহীন অজ্ঞতা নিয়ে। জ্ঞানার্জনের এ পদ্ধতি মানুষকে অতি অপূর্ণাঙ্গ করে গড়ে তুলছে। কিন্তু ইসলাম মানুষকে চায় পূর্ণাঙ্গ তথা কামেল করতে। আজকের আলেমদের ন্যায় পূর্বকালের আলেমগণ এতটা অপূর্ণাঙ্গ ছিলেন না। তারা যেমন শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন, তেমনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা, জেনারেল এবং রাজনীতিবিদ। তাদের জীবনে সমন্বয় ঘটেছিল বহুমুখী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার। মসজিদের নামাযে যেমন আওয়াল-ওয়াক্তে হাজির হতেন, যুদ্ধের ময়দানেও তেমনি ফ্রন্ট লাইনে থাকতেন। অথচ আজকের আলেমদের ক’জন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আছেন, এবং তাদের বিরুদ্ধে একটি ঢিল ছুঁড়েছেন?  বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে ইসলামকে বিজয়ী করতে ক’জন ভূমিকা রাখছেন? তাদের এ ব্যর্থতার কারণ ইলমের ক্ষেত্রে তাদের অপূর্ণাঙ্গতা। তাদের ইলম তাদের জীবনে ইঞ্জিনের কাজ করেনি ইসলামী পরিভাষায় এমন অপূর্ণাঙ্গ মানুষদের বলা হয় “ইনসানে নাকেছ”। অথচ এ অপূর্ণাঙ্গতা দূরীকরণে নবীজী (সা:) কোরআন-হাদিসের বাইরেও জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত করেছেন। এমনকি নিজেও শিখেছেন অন্যদের থেকে। খন্দকের যুদ্ধে পরীখা নির্মাণের কৌশল শিখেছিলেন ইরানী সাহাবা সালমান ফারসী থেকে। মুসলিম বিজ্ঞানীরা সেকালে গ্রীক ভাষা শিখে এরিস্টোটল, প্লেটোসহ বহু গ্রীক বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের গ্রন্থকে তাঁরা আরবী ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। অনেকে ভারতের ভাষা শিখে হিন্দু পন্ডিতদের বহু বই-পুস্তক তরজমা করেছিলেন। অথচ আজ তেমনটি হচ্ছে না। কারণ, যে জ্ঞান জাতিকে সামনে টেনে নেয় সেটির চর্চাই লোপ পেয়েছে। ক’জন আলেম আজ সেরূপ জ্ঞানার্জনে সচেষ্ট?

জ্ঞানার্জনের একটি মাত্র মাধ্যম হলো বই পড়ে শেখা। এছাড়া আরো বহু মাধ্যম রয়েছে। যেমন দেখে শেখা, শুনে শেখা এবং নিজ হাতে কাজ করতে করতে শেখা। তবে জ্ঞানার্জনের অতি কার্যকর মাধ্যম হলো ছাত্রদের ভাবতে বা চিন্তায় অভ্যস্থ করা। চিন্তার সামর্থ্য জ্ঞানের বৃদ্ধিতে জেনারেটরের কাজ করে। পাঠ্যপুস্তক বা শ্রেণীকক্ষের যে বক্তৃতা ছাত্রকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে না -তা কি জ্ঞানার্জনে সহায়ক? এতে সার্টিফিকেট লাভ হলেও তাতে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়ে না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজই হলো ছাত্রের মনে জ্ঞানের নেশা সহজতর ধরিয়ে দেওয়া যা তাকে আজীবন জ্ঞানপিপাসু করবে। কিন্তু মুসলিম দেশের আজকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা পারিনি। ফলে বাড়েনি জ্ঞানের প্রতি সত্যিকার আগ্রহ। এমন জ্ঞানবিমুখী চেতনাই জাতির পতন ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট।

উড়তে হলে পাখীর দুটো ডানাই যেমন সবল ও সুস্থ থাকা অপরিহার্য, তেমনি সুস্থ ও উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণে অপরিহার্য হলো কোর’আন ও বিজ্ঞান -এ দুটো শাখাতেই ভারসাম্যমূলক অগ্রগতি। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোতে তা হয়নি। ধর্মবিবর্জিত যে শিক্ষার কারণে পাশ্চাত্য-সমাজ আজ বিপর্যয়ের মুখে, সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় মুসলিমগণও সেদিকেই ধাবিত হচ্ছি। ফলে বিপর্যয় মুসলিমদেরও ধাওয়া করছে। ফলে বাড়ছে পতনের পথে গতি। ধ্বংসমুখী এই মুসলিম উম্মাহর উদ্ধারে ও উত্থানে সামনে একটিই মাত্র পথ। আর সেটি হলো, ফিরে যেতে হবে ১৪ শত বছর পূর্বের সেই কোর’আনী প্রেসক্রিপশনে। এটা জরুরি শুধু মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার জন্যই নয়, ধ্বংসমুখী পতন-যাত্রা থেকে বাঁচতেও। বিজয়ের পথে এটিই একমাত্র পরীক্ষিত পথ। ১ম সংস্করণ ২৭/০৫/২০০৭; ২য় সংস্করণ ১৭/০৩/২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *