একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on October 14, 2024
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
আলেমের কান্ড
কচুরিপানা ও লতাপাতা ভেসে যায় প্লাবনের স্রোতে। তেমনি তীব্র প্রচারের স্রোতে ভেসে যায় বহু মানুষও। মুসলিম বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছর ধরে চলছে জাহিলিয়াতের প্রবল স্রোত। সে স্রোতে ভেসে গেছে এমন অনেকেই যারা নিজেদের ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মী বলে জাহির করে। যারা প্রকৃত ঈমানদার তারা মুসলিমদের একতা নিয়ে উৎসব করে; এবং মাতম করে বিভক্তি নিয়ে। কারণ, বিভক্তির পথ তো ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথ। গৌরবযুগের মুসলিমগণ ছিলেন প্যান-ইসলামিক একতার প্রতীক। তখন আরব, ইরানী, তুর্কী, কুর্দি, মুর, হাবশী, আফগানী ও অন্যান্য ভাষাভাষী মুসলিমগণ একতাবদ্ধ উম্মাহর জন্ম দিয়েছিল। অথচ আজ পতন যুগের মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চলের নামে বিভক্ত হয়ে। সে বিভক্তি নিয়ে তারা উৎসবও করে। মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের মাঝে একতা চান, এবং শয়তান চায় বিভক্তি। মুসলিমদের মধ্য বিভক্তি দেখে নিশ্চিত বুঝা যায়, তারা শয়তানের পথটিই বেছে নিয়েছে এবং পরিহার করেছে মহান আল্লাহতায়ালার দেখানো একতার পথ। ফলে তারা ৫০টির বেশী রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। ১৯৭১’য়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে সে বিভক্তির পথ ধরেই -সেটি পাকিস্তান ভেঙ্গে। অথচ বাংলাদেশের কিছু ইসলামপন্থী সংগঠনের নেতা-কর্মীগণ যখন ১৬ই ডিসেম্বর এলে রাস্তায় উৎসব মিছিল করে -তখন তাদের ভ্রষ্টতা ও ইসলাম থেকে বিচ্যুতি কি গোপন থাকে?
সে বিচ্যুতি ও ভ্রষ্টতা দেখা যায় এমন কি তাদের মাঝেও, যাদেরকে জনগণ আলেম রূপে চিনে। তার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। কিছুকাল আগে মাওলানা মিজানুর রহমান আযহারীর এক ওয়াজের ভিডিও সোসাল মিডিয়াতে ছড়িয়েছে। এ আলোচনার উদ্দেশ্য মাওলানা আযহারীকে হেয় করা নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুকে তুলে ধরা। বিষয়টি নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হওয়া উচিত। তিনি ওয়াজ করেছেন এবং ওয়াজের আগে মনের মাধুরি দিয়ে পরিচিত একটি গানের একটি পংক্তিও গেয়েছেন। সে পংক্তিটি হলো, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা, আমরা তোমাদের ভূলবোনা….”। এ গানটি আগে বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের গলায় শুনা যেত, এখন সে গান একজন আলেমের মুখেও শোনা গেল । তিনি দোয়া করেছেন মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের কবরগুলো যেন জান্নাতের টুকরো বানিয়ে দেয়া হয়। দোয়া করছেন, আল্লাহতায়ালা যেন তাদের কবরগুলো তাঁর নূর দিয়ে আলোকিত করে দেন। লক্ষণীয় হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এরূপ স্তুতিমূলক গান গেয়েও এই হুজুর হাসিনার আমলে দেশে থাকতে পারেননি, তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
কারো জন্য দোয়া করায় আপত্তি থাকবে কেন? বিষয়টি দোয়া নিয়ে নয়। বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রষ্টতা ও বিভ্রাট নিয়ে। সেগুলি পরিস্কার হওয়া দরকার। নইলে ভ্রষ্টতা আরো বাড়বে। নইলে এ ভ্রষ্টতা কোভিডের ন্যায় ছড়িয়ে পড়বে এবং অন্যদেরও সংক্রামিত করবে। এতোদিন এ ভ্রষ্টতার শিকার ছিল বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ। এখন তাতে জড়িত হয়ে পড়ছেন আলেমগণও। সমস্যা এখানেই। দোয়া শুধু দোয়া নয়, দোয়ার মধ্য দিয়ে একটি চেতনা কথা বলে। সে চেতনায় ধরা পড়ে ব্যক্তির ঈমান। ধরা পড়ে তিনি কোন পক্ষের লোক সেটি। এখানে আলোচ্য হলো উক্ত আলেমের চেতনার বিষয়টি। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলেছেন। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের শহীদ বলেছেন। মনে রাখতে হবে একাত্তরে দুটি পক্ষ ছিল। দুটি পক্ষে দুটি ভিন্ন চেতনা ও দুটি ভিন্ন চরিত্রের মানুষ ছিল। এ দুটি পক্ষ একাত্তরেও যেমন এক ছিল না, এখনো এক নয়। তেল ও পানি যেমন মেশে না, এরা তেমনি মেশেনি। একটি পক্ষ ছিল ইসলামের পক্ষের শক্তি। তাদের অবস্থানটি ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে। অপর পক্ষটি ছিল সেক্যুলারিস্ট জাতীয়তাবাদী পক্ষ। এরা ছিল হিন্দুত্ববাদী ভারতকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে। বুঝতে হবে, একটি পক্ষকে স্বাধীনতার পক্ষ বললে, অপর পক্ষটি পরিণত হয় পরাধীনতার পক্ষের। তখন প্রশ্ন জাগে, তবে কি ২৩ বছরের পাকিস্তানী যুগটি ছিল পরাধীনতার যুগ? পূর্ব পাকিস্তান কি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী? কলোনী হলে পূর্ব পাকিস্তানী খাজা নাযিমুদ্দীন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মহম্মদ আলী বোগরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হন কী করে? বাংলা ১৯০ বছর যাবত ছিল ব্রিটেশের কলোনী। কিন্তু কোন বাঙালি কি কখনো গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছে? কলোনীর বাসিন্দাদের সে স্বাধীনতা থাকে না।
মনে রাখতে হবে, একাত্তরে ভারত পাকিস্তানের জমিনে যে যুদ্ধটি শুরু করে -সেটি ইসলামপন্থী দলগুলির নেতাকর্মীদের কাছে কখনোই স্বাধীনতার যুদ্ধ রূপে গণ্য হয়নি, বরং গণ্য হয়েছে ভারতের দখলদারী তথা occupational war রূপে। মনে রাখতে হবে মুক্তিবাহিনী তাদের সাড়ে ৮ মাসের যুদ্ধে পুরা দেশ দূরে থাক, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলা বা মহকুমাও স্বাধীন করতে পারিনি। এমন কি একটি থানাকেও স্বাধীন করতে পারিনি। ফলে মুক্তিবাহিনী স্বাধীনতা এনেছে –সেটি অসত্য। বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে ভারতের occupational war’য়ে পাকিস্তানের পরাজয়ের পরিণতিতে। ভারতের আড়াই লাখ সৈন্যের বিশাল সেনা বাহিনী ও শক্তিশালী বিমান বাহিনী মাত্র আড়াই সপ্তাহে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মাত্র ৪৫ হাজার সৈন্যদের উপর সহজেই বিজয় অর্জন করে। মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব না থাকলেও সেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয়ে কোন অসুবিধা হতো না। প্রশ্ন হলো, একাত্তরের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজিত হলে তারা কেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো? মাওলানা আযহারীর ওয়াজ শুনলে আদৌ মনে হয় না, তিনি ইতিহাসের এ সহজ সত্য বিষয়গুলি জানেন।
বিভ্রান্তি শহীদ শব্দটি নিয়েও। শহীদ একটি পবিত্র ইসলামী পরিভাষা যার উল্লেখ এসেছে এবং সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে পবিত্র কোর’আন ও হাদীসে। শহীদ তো তারাই হয় যারা ঈমানদার এবং প্রাণ দেয় ইসলামকে বিজয়ী করতে বা মুসলিম রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা দিতে। তাগুতের বিরুদ্ধে ইসলামকে বিজয়ী করা বা মুসলিম রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা দেয়ার কাজকে বলা হয় জিহাদ। অথচ আওয়ামী লীগ কখনোই এ দাবী করেনি যে তাদের একাত্তরের যুদ্ধটি জিহাদ ছিল। তাই প্রশ্ন হলো, যুদ্ধটি জিহাদ না হলে, সে যুদ্ধে কেউ নিহত হলে সে ব্যক্তি শহীদ হয় কি করে? এ প্রশ্নের উত্তরটি পরিস্কার হতে হবে। এ নিয়ে ধোঁয়াশে ভাব থাকাটি উচিত নয়। বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের একাত্তরের চেতনাটি ছিল ইসলামশূণ্য। এখানে ইসলামী চেতনার কোন স্থান ছিল না। এ চেতনার মূল উপাদান হলো সেক্যুলারিজম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সেক্যুলারিজমকে তারা সংজ্ঞায়ীত করতে ধর্মনিরেপক্ষতা বলে। অথচ সেক্যুলারিজমের অর্থ আরো গভীর এবং এ মতবাদের অর্থ ইহজাগতিকতা যা বিলুপ্ত করতে চায় আখেরাতের ভয়। প্রশ্ন হলো, মুসলিম কি কখনো ধর্মনিরেপক্ষ হতে পারে? ইসলাম ও অনৈসলামের দ্বন্দ তো সর্বত্র ও সর্ব-মুহুর্তে। ইসলাম কবুল করার সাথে সাথে কারো পক্ষেই নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ থাকে না; তাকে সব সময় ইসলামের পক্ষ নিতে হয়। ইসলামের বিজয়ে নিজের অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ হয় কি করে?
গোত্রবাদ, জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ হলো, ভাষা, বর্ণ ও এলাকা ভিত্তিক চেতনা নিয়ে মুসলিম উম্মাহকে বিভ্ক্ত করার মতবাদ। এ মতবাদের মূল এজেন্ডা হলো মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত মুসলিম ঐক্যের চেতনাকে দাফন করা। ফলে তাদের অবস্থান তো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিপক্ষ রূপে। তাদের মূল এজেন্ডা তো মুসলিম উম্মাহর দেয়ালে ফাটল ধরানো। একাজ তো শত ভাগ হারাম। এ প্রসঙ্গে মহান নবীজী (সা:)’র হাদীস: “যারা কোন গোত্রের জন্য যুদ্ধ করলো এবং গোত্রের জন্য নিহত হলো -তারা আমার উম্মত নয়” –(সুনানে আহমেদ)। নবীজী (সা:)’র সময় জাতীয়তাবাদ ছিলনা, ছিল গোত্রবাদ। তবে জাতীয়তাবাদ ও গোত্রবাদ একই চরিত্রের আসাবিয়াত। ভাষার নামে বা অঞ্চলের নামে বিভক্তি গড়ার এ ঘৃণিত হারাম কাজটি হালাল হয় কি করে? নিরেট একটি বিচ্ছন্নতার একটি যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধই বা হয় কি করে? মুসলিমের প্রতিটি যুদ্ধকে হতে হয় ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে বা কাফির শক্তির হামলার মুখে মুসলিম ভূমিকে প্রতিরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু আওয়ামী লীগের যুদ্ধ কি কখনো ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে ছিল? ছিল কি কোন মুসলিম ভূমিকে প্রতিরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে? সে দাবী কি কখনো তারা করে? একাত্তরের যুদ্ধে অবশ্যই একটি কাফির বাহিনীর আগ্রাসন ছিল। সেটি হিন্দুত্ববাদী ভারতের। কিন্তু মুক্তিবাহিনী কি সে কাফির বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে? তারা তো বরং সে কাফির বাহিনীর সহায়ক সহযোদ্ধা ছিল। কাফির বাহিনীর সহযোদ্ধা শহীদ হয় কি করে?
অপরাধ তো প্রতিরাষ্ট্রেই হয়। নানাবিধ অপরাধ তো বাংলাদেশেও হচ্ছে? বাংলাদেশে ভোটের উপর ডাকাতি হয়েছে। শাপলা চত্ত্বরে গণহত্যা হয়েছে। গুম-খুন-সন্ত্রাসের জোয়ার এসেছে। মুজিব আমলে ৩০ হাজারের বেশী বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। সেগুলিকে বাহানা বানিয়ে কি বাংলাদেশকে খণ্ডিত বা ধ্বংস করতে হবে? কিছু লোকের হতাহতের মধ্য দিয়ে একটি জাতির এতোটা ক্ষতি হয় না যতটা ক্ষতি হয় ভূগোল খণ্ডিত করলে। ভূগোল বাড়লে শক্তি বাড়ে; ইজ্জতও বাড়ে। সাহাবাগণ ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্যে নানা দেশে অভিযান চালিয়েছেন। নবীজী রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটান্টিনোপল দখলের নসিহত করে গেছেন। আজকের মুসলিমদের পতিতদশার মূল কারণ তো খণ্ডিত ভূগোল। এক ইঞ্চি ভূগোল বাড়াতে যুদ্ধ করতে হয়; অর্থ ও রক্ত ব্যয় করতে হয়। তাই মানব হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হলো দেশের ভূগোল খণ্ডিত করা। এতে কোটি কোটি মানুষের জীবন, ইজ্জত-আবরু ও সম্পদ বিপন্ন হয়। একাত্তরের আরোপিত যুদ্ধে তো সেটি হয়েছে। আজ মুসলিম উম্মাহর যে বিপন্ন দশা তার কারণ মুসলিমদের বিভক্ত মানচিত্র। ফিলিস্তিন,কাশ্মীর, রোহিঙ্গা, উইঘুর মুসলিমদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্র নাই।
একাত্তরে আরেকটি পক্ষও বিশাল সংখ্যায় প্রাণ দিয়েছে। তাদের সংখ্যা মুক্তিবাহিনীর নিহতদের চেয়েও অধীক। তাদের কবরও রয়েছে এ বাংলাদেশে। তাদের মধ্য রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ বহু দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী। রয়েছে বহু হাজার শান্তি কমিটির সদস্য। রয়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসার বহু হাজার ছাত্র যারা সে সময়কার ইসলামী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী ছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত দ্বায়ী মাওলানা মোস্তাফা আল-মাদানী, মৌলভী ফরিদ আহম্মদ, মাওলানা আসাদুল্লাহ সিরাজী (প্রখ্যাত লেখক ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর পুত্র) ন্যায় শত শত আলেম ও ইসলামী চেতনার নেতৃবিন্দু। নিহত হয়েছেন হাজার হাজার অবাঙালি নারী, পুরুষ ও শিশু। তারা তো নিহত হয়েছে ইসলাম ও পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশের সংহতির পক্ষ নেয়াতে। তারা সেক্যুলার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষের লোক। তারা দাঁড়িয়েছিলেন হিন্দুত্ববাদী ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। একটি হিন্দু ও মুসলিম রাষ্ট্রের মাঝে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন ঈমানদার কার পক্ষ নিবে? সে কি কাফর ভারতের পক্ষে নিতে পারে? একাত্তরে এজন্যই কোন ইসলামী দল, কোন আলেম, কোন পীর, মাদ্রাসার কোন ছাত্র এবং মসজিদের কোন ইমাম পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নেয়নি। যাদের মধ্যে সামান্যতম ইসলামী চেতনা ছিল তারা একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় প্রকল্পের সাথে জড়িত ছিল না। পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রজেক্টটি ছিল একান্তই ভারতমুখী ও ইসলাম বিরোধী বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের। নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ।
এবার অতি পরিচিত আরেক জন আলেমের প্রসঙ্গে আসা যাক। তিনি মাওলানা মামুনূল হক। এখানেও আলোচনার মূল উদ্দেশ্য, সমস্যার গভীরে যাওয়া, কাউকে হেয় করা নয়। ইসলামে একতা গড়া ফরজ। ঈমানদার মাত্রই যেমন প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়া নিয়ে পেরেশান থাকে, তেমনি পেরেশান থাকে মুসলিমদের মাঝে একতা গড়া নিয়েও। মুসলিম ঐক্যের বিষয়টি ঈমানদারের অস্তিত্বের সাথে মিশ্রিত। কারণ সে জানে, একতার পক্ষে না দাঁড়ালে আযাব থেকে রক্ষা নেই। সে আযাব বেনামাজী হওয়ার আযাবের চেয়ে কম নয়। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে সে কঠোর আযাবের হুশিয়ারিটি এসেছে সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। অথচ মাওলানা মামুনূল হক বাহনা খুঁজছেন কি করে ইসলামপন্থীদের মাঝে ঐক্যকে অসম্ভব করা যায়। সে জন্য তিনি ইতিহাস ঘেঁটেছেন। তিনি বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীকে আগে একাত্তর নিয়ে মাফ চাইতে হবে। তারপরই তাদের সাথে একতা সম্ভব। যে আলেমের বক্তব্য নিয়ে এই আলোচনা -তিনি পড়াশুনা করেছেন দেওবন্দী তরিকার কাওমী মাদ্রাসায়। তাঁর পিতা মাওলানা আজিজুল হকও একজন অতি পরিচিত দেওবন্দী আলেম ছিলেন। তিনি হাদীস পড়াতেন লালবাগ মাদ্রাসায়। সে মাদ্রাসার বহু ছাত্রকে একাত্তরে রাজাকার হতে দেখা গেছে। একাত্তরে লালবাগ মাদ্রাসার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন মহম্মদ উল্লাহ হাফিজী হুজুর। তিনিও পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে ছিলেন। অথচ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এই আলেমের ক্রোধের কারণ, জামায়াত একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, তিনি কি জানেন না, একাত্তরে কাওমী মাদ্রাসার হুজুরদের ভূমিকা?
পাকিস্তান আমলে কাওমী মাদ্রাসার হুজুরদের রাজনৈতিক সংগঠনের নাম ছিল নিজামে ইসলামী পার্টি। এ পার্টির নেতা চৌধুরী মোহম্মদ আলী ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রধামন্ত্রী হয়েছিলেন। তার আমলেই রচিত হয় পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র। তখন নিজামে ইসলামী পার্টির আরেক নেতা ও প্রখ্যাত পার্লামেন্টারীয়ান কক্সবাজারের মৌলভী ফরিদ আহমেদ ছিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এবং চট্রগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসার মাওলানা সিদ্দিক আহমদ সাহেব ছিলেন নিযামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা। মাওলানা সিদ্দিক আহমদ পাকিস্তান ভাঙ্গাকে হারাম বলতেন। তাদের দলের আরেক নেতা ছিলেন কিশোরগঞ্জের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আতাহার আলী সাহেব। তিনিও পাকিস্তান ভাঙ্গাকে হারাম বলতেন। তাদের সে সব বয়ান যুদ্ধকালীন ৯ মাসে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলিতে লিপিবদ্ধ আছে। তাদের সে বক্তব্যগুলি যে কেউ ঘেঁটে দেখতে পারে।
অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর বইতে লিখেছেন, পাকিস্তান বাঁচাতে জামায়াতে ইসলামীর চেয়ে বেশী তৎপর ছিল নিজামে ইসলাম পার্টির নেতাকর্মীগণ। বিশেষ করে শান্তিবাহিনী গড়ে তোলা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতার ব্যাপারে। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার বিষয়ে তাঁরা ছিলেন বেপরোয়া ও আপোষহীন। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার মাঝে তারা ভারতীয় অধীনতা দেখতেন। এবং বিপদ দেখতেন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর। তাদের বক্তব্য যে কতটা সত্য ছিল -তা তো ভারতের বিজয়ে প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার বিপদটি বুঝতেন বলেই সে বিপদ থেকে বাঁচতে সক্রিয় ভূমিকা নেন নিজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মৌলভ ফরিদ আহমেদ। একাত্তরে দেওবন্দী কাওমী মাদ্রাসার নেতাদের এটিই যখন ভূমিকা, তখন জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের ভূমিকার বিরুদ্ধে উপরিউক্ত দেওবন্দী আলেমের এতো আক্রোশ কেন? একতা গড়ার ন্যায় ফরজ কাজে সেটি বাধাই বা হবে কেন? নানা মজহাব ও নানা ফিররকার মুসুল্লীদের নামাজের কাতারে শামিল হতে কি কোন পূর্বশর্ত থাকে? মুসলিম উম্মাহর একতা গড়তেই বা শর্ত থাকবে কেন?
চাপা দেয়া ইতিহাস
এ ধারণা ঠিক নয় যে শধু জামায়াত ইসলামী, নিজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টি, খেলাফতে রাব্বানী পার্টি, জমিয়তে ইসলামের ন্যায় কিছু সংগঠন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। বরং পক্ষ নিয়েছিল বিপুল সংখ্যক শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিককর্মী। নিম্নে তাদের নাম ও তাদের কিছু বয়ান তুলে ধরা হলো।
১৯৭১ সালের ১৭ মে তারিখ দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) একটি বিবৃতি ছাপা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, “পাকিস্তানী শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের অভাব-অভিযোগ রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যেটা প্রাপ্য সেটা না পেয়ে আমরা অসুখী। আমাদের এ অসন্তোষ আমরা প্রকাশ করেছি একই রাষ্ট্রের কাঠামোর আওতায় পূর্ব পাকিস্তাঅনের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভোট দিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা এ সহজ সরল আইন-সঙ্গত দাবীকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবীতে রূপান্তরিত করায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। বাঙালি হিন্দু বিশেষ করে কলকাতার মারোয়াড়ীদের আধিপত্য ও শোষণ এড়ানোর জন্যই আমরা বাংলার মুসলমানেরা প্রথমে ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজত্বকালে আমাদের পৃথক পূর্ব বাংলা প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেই এবং ১৯৪৭ সালে ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রদেশের মুসলিম ভাইদের সাথে যুক্ত হওয়ার সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। উক্ত সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত হওয়ার আমাদের কোন কারণ নেই। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসেবে সারা পাকিস্তানকে শাসন করার অধিকার আমাদের আছে। আর সেটা আমাদের আয়ত্তের মধ্যেই এসে গিয়েছিলো। ঠিক তখনই চরমপন্থীদের দুরাশায় পেয়ে বসলো এবং জাতীয় অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুললো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আলোচনা কালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু উল্টোটাই ঘটে গেলো এবং নেমে এলো জাতীয় দুর্যোগ। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা আশাবাদী হ্ওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত এবং বর্তমান সরকার অবস্থা অনুকূলে হওয়ার সাথে সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার ইচ্ছা আবার ঘোষণা করেছেন। এমতবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য স্থানের বন্ধু এ্যাকাডিমিশিয়ানরা আমাদের কল্যাণের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করায় আমরা কৃতজ্ঞ। তবে আমরা আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন বড় ধরণের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা ও নিন্দা করছি।”
বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে যারা ছিলনে তারা হলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, লেখক নাট্যকার শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান এম. কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. মীর ফখরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার ড. কাজী দীন মোহম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ও নাট্যকার নূরুল মোমেন, কবি আহসান হাবিব, অভিনেতা-চিত্রপরিচালক-সঙ্গীত পরিচালক খান আতাউর রহমান, গায়িকা শাহনাজ বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার ও নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখ, গায়িকা ফরিদা ইয়াসমিন, পল্লী গীতির গায়ক আব্দুল আলীম, লেখক-প্রয়োজক-চিত্রপরিচালক আব্দুল্লাহ ইউসুফ ইমাম, লেখক-প্রয়োজক-চিত্রপরিচালক ও.এ. এইচ. চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. মোহর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান মুনীর চৌধুরী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের ড. আশরাফ সিদ্দিকী, গায়ক খোন্দকার ফারুক আহমদ, গায়ক এম. এ. হাদি, গায়িকার নিনা হামীদ, গায়িকা লায়লা আন্জুমান্দ বানু, শামসুল হুদা চৌধুরী (জিয়া ক্যাবিনেটের মন্ত্রী, পরবর্তীততে এরশাদ সরকারের সংসদ স্পীকার), শিল্পী বেদার উদ্দিন আহমেদ, গায়িকা সাবিনা ইয়াসমীন, গায়িকা ফেরদৌসী রহমান, গায়ক মোস্তাফা জামান আব্বাসী, গল্পকার সরদার জয়েন উদ্দীন, লেখক ও সমালোচক সৈয়দ মুর্তজা আলী, কবি তালিম হোসেন, গল্পকার শাহেদ আলী, মাহে নও সম্পাদক কবি আব্দুস সাত্তার, নাট্যকার ফররুখর শীয়র, কবি ফররুখ আহমদ, পাকিস্তান অবজারবার (পরবর্তীতে বাংলাদেশ অবজারবার) সম্পাদক আব্দুস সালাম, মর্নিং নিউজ সম্পাদক এ.জি. এম. বদরুদ্দীন, দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) সম্পাদক আবুল কালাম সামসুদ্দীন, অভিনেতা ও চিত্র পরিচালক ফতেহ লোহানী, কবি হেমায়েত হোসেন, লেখক আকবর উদ্দীন, লেখক আকবর হোসেন, অধ্যক্ষ এ. কিউ. এম. আদম উদ্দিন, নাট্য শিল্পী আলী মনসুর, লেখক আফসার উদ্দীন আহমদ, লেখক ও সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী, কবি ও লেখক সামসুল হক, লেখক সরদার ফজলুল করিমি, গায়িকা ফাওজিয়া খান প্রমুখ ৫৫ জন নেতৃস্থানীয় শিক্ষাবিদ, কবি, শিল্পী ও বুদ্ধীজীবী।
১৯৭১ সালের ২৭ জুনে দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) আরেকটি বিবৃতি ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, “আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনায় গভীর বেদনা বোধ করছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, ভারতীয় যুদ্ধবাজ যারা মুসলিমদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসাবে পাকিস্তান সৃষ্টিকে কখনো গ্রহণ করেনি প্রধানত তাদের চক্রান্তের ফলেই এটা হয়েছে। …আমরা দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য আমাদের সেনাবাহিনীর সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশংসা করছি। … আমরা দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা বিপন্ন করার জন্য চরমপন্থীদের নিন্দা করছি। বহির্বিশ্বের চোখে পাকিস্তানের মর্যাদা হ্রাস ও পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করার অপচেষ্টা এবং অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের আমরা নিন্দা করছি…”। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলর এবং আইন বিভাগের ডীন ইউ. এন. সিদ্দিকী, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ও সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. আব্দুল করিম, সমাজ বিজ্ঞানের ডীন ড. এম. বদরুদ্দোজা, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের লেকচারার মোহম্মদ ইনামুল হক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের রিডার মোহম্মদ আনিসুজ্জামান, ইংরাজী বিভাগের সিনিয়র লেকচারার খোন্দকার রেজাউর রহমান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার সৈয়দ কামাল মোস্তাফা ও এম. এ. জিন্নাহ, ইতিহাসের সিনিয়র লেকচারার রফিউদ্দীন, রসায়ন বিভাগের প্রধান এ.কে. এম. আহমদ, সমাজ বিজ্ঞানের সিনিয়র লেকচারার রুহুল আমীন, বাণিজ্য বিভাগের প্রধান মোহম্মদ আলী ইমদাদ খান, ইতিহাসের সিনিয়র লেকচারার হোসেন মোহম্মদ ফজলে দাইয়েন, বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মোহম্মদ দিলওয়ার হোসেন, সংখ্যাতত্ত্বের সিনিয়র লেকচারার আব্দুর রশিদ, ইতিহাস বিভাগের রিডার মুকাদ্দুসুর রহমান, ইতিহাসের লেকচারার আহসানুল কবীর, অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার শাহ মুহম্মদ হুজ্জাতুল ইসলাম, ইংরাজী বিভাগের প্রধান মহম্মদ আলী, পদার্থ বিদ্যা বিভাগের রিডার এজাজ আহমদ, গণিতের লেকচারার এস. এম.হোসেন, গণিত বিভাগের রিডার জেড. এইচ. চৌধুরী, সংখ্যাতত্ত্বের লেকচারার হাতেম আলী হাওলাদার, বাংলা বিভাগের রিডার ড. মোহম্মদ আব্দুল আওয়াল, বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান হায়াত (লেখক হায়াত মাহমুদ), ইতিহাসের গবেষণা সহকারী আব্দুস সায়ীদ, অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার মোহাম্মদ মোস্তাফা, ইতিহাসের লেকচারার সুলতানা নিজাম, ইতিহাসের রিডার ড. জাকিউদ্দীন আহমদ এবং ফাইন আর্টসের লেকচারার আব্দুর রশীদ হায়দার।
জিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান বলেন, “প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রবল উৎকন্ঠার সাথে রাজনৈতিক দলসমুহকে অধিকতর স্বাধীনতা প্রদান পূর্বক দেশে পূর্ণ ও বাধাহীন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল এ সুযোগের ভূল অর্থ করে বলপ্রয়োগের ….মাধ্যমে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে জয়লাভ করে নিজেদের খেয়াল খুশীতে দেশ শাসন করার দাবী করে এবং এভাবেই অহমিকা, অধৈর্য ও ঔদ্ধত্যের ফলে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়।….আমি সাম্রাজ্যবাদী ভারতের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।” (সূত্র: একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ পৃষ্টা ৯১, বিবৃতিটি ৪ মে ১৯৭১’য়ে ছাপা হয়)।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ৮ এপ্রিল ১৯৭১’য়ে এক বিবৃতি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ভারতকে ছিনিমিনি খেলতে দিবে না। … পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের শত্রুদের কাছে সহানুভূতি কামনা করে না। জনগণ তাদের অধিকার চায় এবং কিভাবে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে সেটা হলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। … অসৎ লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতিটি পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণের ব্যাপারে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের দুরভিসন্ধি বর্তমানে ফাঁস হয়ে গেছে। … ভারতীয়রা কি মনে করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এতদূর অধঃপতন হয়েছে, তারা ভারতকে তাঁদের বন্ধু ভাববে?” –(দৈনিক সংগ্রাম, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১)।
মিথ্যার বিরুদ্ধে শুরু হোক জিহাদ
ভারত দখলে নেয়ার পর ভারতের ইতিহাস লেখার কাজটি ইংরেজগণ নিজ হাতে নেয়। লক্ষ্য ছিল মুসলিম শাসকদের চরিত্রহীন হিসাবে চিত্রিত করা। ইতিহাসের বইয়ে তারা যে বয়ান খাড়া করে তা হলো, মুসলিম শাসকগণ ভারতবাসীর কোন কল্যাণই করেনি, শুধু অকল্যাণই করেছে। হিন্দুদের মনে তারা সেটিকেই বদ্ধমূল করে। এভাবে তারা ধ্বংস করে দেয় ইতিহাসের সত্য বয়ান। বিজিপি’র হিন্দুত্ববাদীরা ব্রিটিশের সে বয়ানকেই ফেরি করে বেড়ায়। ভারত ও তার সেবাদাসগণ একই কাজ করেছে বাংলাদশের ইতিহাস রচনায়। জনগণের মগজকে তারা মিথ্যায় পরিপূর্ণ করেছে; এবং মিথ্যার প্রচারকে পরিণত করেছে এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদেরও। সে মিথ্যা প্রচারের ফল হলো, মুজিবের ন্যায় ভারতসেবী নৃশংস ফ্যাসিস্ট এবং গণতন্ত্রের খুনিকে জাতির পিতা, দেশের বন্ধু ও নেতার আসনে বসাতে সমর্থ হয়েছিল। অতীতে একই পথে ফিরাউন নিজেকে জনগণের উপর ভগবান রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। এবং হযরত মূসা (আ:)’র মত নবীও দুর্বৃত্ত রূপে চিত্রিত হয়েছিল। মিথ্যার একই রূপ নাশকতা বাংলাদেশেও চালানো হয়েছে। ফলে দেশপ্রেমিক সৎ মানুষেরা রাষ্ট্রের ও স্বাধীনতার শত্রু রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিষ যেমন প্রাণনাশ ঘটায়, মিথ্যা তেমনই ঈমাননাশ ঘটায়। দুর্বৃত্তরা তাই মিথ্যাকে প্রবল ভাবে বাঁচাতে ও বাড়াতে চায়। বাংলাদেশে সন্ত্রাস তাই শুধু রাজনীতিতে হয়নি, বরং প্রবল ভাবে হয়েছিল বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে এবং ইতিহাস রচনাতেও।
হাসিনার পতন হয়েছে। বাঙালি মুসলিমের হাজার বছরের ইতিহাসে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনো। দাবী উঠেছে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের। রাষ্ট্রীয় সংস্কারের গুরুত্বকে কখনোই অস্বীকার করা যায়না। কারণ, রাষ্ট্রই এতোকাল জনগণের চেতনাকে দূষিত করা ও দুর্বৃত্তিকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার রূপে কাজ করে। তবে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের সাথে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের চেতনার সংস্কার। এজন্য জরুরি হলো ইতিহাসের সংস্কার। কারণ অসত্য কাহিনীতে ভরপুর ইতিহাসের পাতা থেকেই জনগণের চেতনায় মিথ্যার প্রবেশ ঘটে। মিথ্যা তখন বিশাল বাজার পায়। তারই প্রমান হলো মাওলানা মিজানুর রহমান আযহারী ও মাওলানা মামুনূল হক। তবে মিথ্যায় আক্রান্ত শুধু মাওলানা আযহারী ও মাওলানা মামুনূল হক নন, বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষও। তাদের মগজে বহু অসত্য কাহিনী স্থান করে নিতে পেরেছে মিথ্যার প্লাবনে প্লাবিত ইতিহাসের বই থেকে। তাই হাসিনাকে সরানোর মধ্য দিয়ে লড়াই শেষ হয়নি। লাগাতরজিহাদ হতে হবে মিথ্যার নির্মূলেও। মিথ্যার বিরুদ্ধে এ পবিত্র জিহাদকে মহান আল্লাহতায়ালা সুরা ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে “জিহাদান কবিরা” তথা বড় জিহাদ বলেছেন। আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার রাজনৈতিক জিহাদ সফল হতে পারে একমাত্র “জিহাদান কবিরা” সফল হওয়ার পরই।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় আগ্রাসনের হুমকি: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুরক্ষা কীরূপে?
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018