একাত্তরের গণহত্যা (তিন)

যে কাহিনী শুনতে নেই (০৭)

সংগ্রহে: কায় কাউস

================

কাপ্তাই হত্যাকান্ড

০১.                                                                                                               

“… ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে আমি যখন ঘুমানোর চেষ্টা করছি, তখন আমার টেলিফোন বেজে ওঠে। এত রাতে টেলিফোন বেজে ওঠা মোটেও স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু আমরা একটা অস্বাভাবিক সময় পার করছিলাম। তাই যেকোনো কিছুই প্রত্যাশিত ছিল। আমার অফিসের ব্যক্তিগত সহকারী মুজিবুল হক ফোনটি করেছিল। তখন তার কাজ ছিল কাপ্তাইয়ের একমাত্র টেলিফোন এক্সচেঞ্জটিতে বসে সমস্ত কলের নজরদারি করা। উত্তেজিত কন্ঠে সে আমাকে বলল, ‘চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে এইমাত্র খবর এসেছে যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং ইয়াহিয়া খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকায় ভীষণ লড়াই চলছে।’

চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান খবরটি প্রচার করেছেন। ভীত হয়ে আমি জানতে চাইলাম ব্যাপারটা ক্যাপ্টেন হারুনকে জানানো হয়েছে কি না। মুজিবুল জানাল, বুথে যে বাঙালি সুবেদার ছিল, সে খবরটি জানাতে ছুটে গেছে।

 … ওদিকে খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন হারুন চৌধুরী ছুটে যান ইপিআর শিবিরে। তিনি তখন সেকেন্ড ইন কমান্ড। মেজর পীর মোহাম্মদ কোনো কিছু আঁচ করতে পারার আগেই হারুন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। তবে কেউ হতাহত হয়নি। এনসিওদের অস্ত্র সংবরণ করিয়ে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে একটি বিশাল কক্ষে আটকে রাখা হয়। 

 … অল্পক্ষণের মধ্যেই মেজর পীর মোহাম্মদের বাড়িটি ইপিআর জওয়ানরা ঘিরে ফেলে এবং তিনি গৃহবন্দী হন। বিদ্রোহ সম্পন্ন হয়ে যায় এবং কাপ্তাইয়ে আমাদের জন্য পিছু ফেরার কোনো উপায় ছিল না। আর আমরা তখনো জানি না, ঢাকায় কী হচ্ছে। সবকিছুই হচ্ছিল জনাব হান্নানের কাছ থেকে পাওয়া একটিমাত্র টেলিফোন-বার্তার মাধ্যমে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করলাম, আমরা ভীষণ বিপদের মধ্যে আছি।

 … ২৬শে মার্চ রাত দুইটার (২৫ মার্চ দিবাগত) কয়েক মিনিট পর আরেকটা ফোন এল। এক্সচেঞ্জ থেকে অপারেটর আমাকে জানাল যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। আসলে তাৎক্ষণিক বিপদটা কেটে গেছে। কিন্তু আমরা অনেক বড় ও প্রলম্বিত বিপদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম, যে ধরণের বিপদের মোকাবিলা জীবনে আমরা অনেকে কখনো করিনি।

 … আমার বাসা থেকে ইপিআরের ক্যাম্প ১০০ মিটারের মতো। ৫০-৬০ জন লোকের ছোটখাটো ভিড় চোখে পড়ল। দেখলাম, ইপিআরের অবাঙালি জওয়ানদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের পিছমোড়া করে রাখা হয়েছে। তারা অসহায়ের মতো প্রাণভিক্ষা চাইছিল। আমাদের মতো তাদেরও জীবন মূল্যবান। হঠাৎ কেউ একজন আমার হাত থেকে টর্চলাইটটি নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। এর পরই আবার হইচই। ইপিআরের একজন অবাঙালি দৌড়ে পালিয়ে ঝোপের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিল। তাকে ধরে নিয়ে আসা হলো ক্যাপ্টেনের কাছে। ক্যাপ্টেন হারুন তার রিভলবারটি বের করে ওর বুকে ঠেকিয়ে গুলি করতে উদ্যত হলেন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লোকটি ক্যাপ্টেনের পা জড়িয়ে ধরল। এ যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পেলেও কয়েক দিন পরই সে মৃত্যুবরণ করে।

পাকিস্তানি সৈনিকদের হত্যা করা সহজ ছিল না। কয়েক শ প্রাণঘাতী ৩০৩ বুলেট ছুড়তে হয়েছিল ব্যাংক ভবনের প্রথম তলায়। এখানে নিরস্ত্র, অনাহারী পাকিস্তানি এনসিওদের ইন্টার্নির জন্য রাখা হতো। গোলাগুলিতে ভবনের চেহারাটা জলবসন্ত রোগীর মতো হয়ে গিয়েছিল। তারপরও সেনারা আত্মসমর্পণ করেনি। তারা জানত যে আত্মসমর্পণ করতে বাইরে এলেই দরজার সামনে তাদের হত্যা করা হবে। শেষ পর্যন্ত দুজন লোক সাহস করে টিনের চালের ছাদে গিয়ে ওঠে। তাদের একজন ছিল মোল্লা নামের এক বদমাশ লোক। তারা দুতিনটা টিন তুলে ফেলে ভেতরে গুলি চালায়। অবশ্য অনাহারে লোকগুলো এমনিতেই কয়েক দিন পর মারা যেত। কয়েকজন বুদ্ধিমান লোক দ্রুত ভবনের ওপর নতুনভাবে আস্তর করে দিল, যেন বোঝা না যায় গুলি চালানো ও হত্যাকান্ড হয়েছে। আর পাকিস্তানি সেনারা যে আসবে এবং শহরে যাকেই পাবে, তার ওপর প্রতিশোধ নেবে, সেটাও সবার জানা ছিল। ১৭টি মৃতদেহ সেতুর পেছনে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়। নিকটবর্তী কুষ্ঠ হাসপাতাল থেকে মরণাপন্ন কুষ্ঠ রোগীদের এনে এখানে রাখা হতো।

ইপিআর ক্যাম্পে জড়ো হওয়া স্থানীয় লোকজন অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। এরকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে কী করতে হয়, সে বিষয়ে কারোরই কোনো ধারণা ছিল না। রাতের অন্ধকার থাকতেই ইপিআরের লোকজন তাদের অস্ত্র ও ব্যাগ নিয়ে ট্রাকে চেপে কাপ্তাই ত্যাগ করে। পরে আমি মেজর রফিকের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, তিনি চট্টগ্রাম থেকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হারুনকে তার বাহিনী নিয়ে যোগদান করার জন্য। আর তাই ক্যাপ্টেন হারুন দ্রুত কাপ্তাই থেকে চলে যান। চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে তিনি বন্দী পাকিস্তানি জওয়ানদের স্থানীয় পুলিশ ও জঙ্গি লোকজনের তত্ত্বাবধানে রেখে যান। যাওয়ার আগে তিনি কাপ্তাইয়ের নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেননি আর কখনোই কাপ্তাইয়ে ফিরে আসেননি। 

 … ২৯ মার্চ ইপিআরের দুজন জওয়ানকে নিয়ে স্থানীয় কিছু লোক পীর মোহাম্মদের বাড়ির সামনে জড়ো হয় তাকে হত্যা করার জন্য। … আমরা ইপিআরের জওয়ানদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে মেজরকে হত্যার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। কেননা, পশ্চিম পাকিস্তানেও আমাদের প্রায় ৩০ হাজার সৈনিক রয়েছে। এখানে বন্দী পাকিস্তানি সেনাদের যদি আমরা হত্যা করি, তাহলে পাকিস্তানিরাও প্রতিশোধ নেবে। এর জবাবে আমাদের বলা হলো, ‘হাইকমান্ড থেকে মেজরকে হত্যার নির্দেশ এসেছে। এর বেশি কিছু আমরা জানি না। আমরা বন্দীদের নিয়ে যেতেও পারি না। আমরা তাদের নিয়ে কী করব?’

মেজর পীর মোহাম্মদ অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তিনি জানতেন যে তার সেনারা বিদ্রোহ করতে পারে। এটাও বুঝেছিলেন যে তার সহকর্মীরা নিহত হয়েছে। দেশে সেনা অভিযানের এবং যুদ্ধাবস্থার খবরও নিশ্চয়ই বেতারের মাধ্যমে তিনি পেয়েছিলেন। 

জওয়ানরা যখন বাড়ি ঘিরে ফেলেছে, তখন তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে এক ট্রাংকবোঝাই অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ। তিনি বললেন যে, তিনি শহীদ হতে প্রস্তুত ছিলেন। তার বদলে তিনি আত্মসমর্পণ করতে চান। তার এই আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলো। দুই হাত ওপরে তুলে পিছু ফিরে দাঁড়াতেই প্রথম গুলিটা ছোড়া হলো। দ্বিতীয় গুলিতে তিনি সিঁড়িতে রক্তের ধারার ওপর পতিত হলেন। মিসের পীর মোহাম্মদ ভেতর থেকে তাদের দত্তক নেয়া বাঙালি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। এক মুহুর্ত থমকে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো স্বামীকে দেখলেন। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন হত্যাকারীদের দিকে। তাদের রাঙামাটি নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি লঞ্চ আগেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। সেটাতেই তারা গিয়ে উঠলেন। এরপর আমি আর তাদের কোনো খবরই জানতে পারিনি। মৃত্যুর আগে পীর মোহাম্মদ হয়তো তার হত্যাকারীদের ওপর গুলি চালাতে পারতেন। তবে নিজের স্ত্রী-কন্যার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি তা করেননি।

 … পরের দুই সপ্তাহ ছিল ভয়াবহ। যেখানেই অবাঙালিদের দেখা মিলছিল, সেখানেই তাদের ঘিরে ধরে হত্যা করা হচ্ছিল। ইপিআর ও পুলিশের কিছু লোক এই হত্যাকান্ড চালাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্থানীয় কিছু লোক। এদের মধ্যে দুজন রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে হত্যাযজ্ঞে নেমেছিল। এদের একজন হলেন আবদুল জব্বার। তিনি অবশ্য পরে ভারতে মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হন তার অপকর্মের জন্য। অপরজন শুক্কুর আলী ছিলেন কাপ্তাই বাজারের মাংস বিক্রেতা। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর তিনি কাপ্তাইয়ের বড় রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন। কাপ্তাই বন থেকে টিক কাঠ বিক্রি করে প্রচুর অর্থেরও মালিক হন। যারা এই হত্যাকান্ডের পরিণতি সম্পর্কে বুঝতে পেরেছিল, তারা পার করছিল একটা আতঙ্কজনক সময়। তবে পাকিস্তানি সেনাদের মতো এই হত্যাকারীরাও ছিল নির্লিপ্ত।

মৃত্যুর আগে গাজী উদ্দিন খান পাঠান নামের এক ঠিকাদার আর্তচিৎকার করে বলেছিল, ‘ওরা আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। আমার যা কিছু ছিল, সবই ওদের দিয়েছি। আর এখন ওরা আমাকে মেরে ফেলছে।’ হত্যাকান্ড চলছিল। আবাসিক কলোনীর নারী ও শিশুরা হত্যাকান্ড দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। আমরা যেন নরকের অধিবাসী হয়ে গিয়েছিলাম। 

একদিন এক অবাঙালি শুধু কোমরে একটা কাপড় জড়ানো অবস্থায় কোথা থেকে যেন উদয় হলো। ও কিছু বলতে পারার আগেই কয়েকজন লোক ‘গুপ্তচর গুপ্তচর’ বলে চিৎকার করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি কোনোমতে তাকে মারা পড়ার হাত থেকে বাঁচালাম। তার কাছে জানতে চাইলাম, সে কে। কিন্তু সে কোনো কথা বলতে পারছিল না। হাতে একটা খালি পাত্র ছিল। বুঝতে পারলাম, সে বেশ কয়েক দিন ধরে কিছু খায়নি। তাই খাবারের জন্য ভিক্ষা করতে বেরিয়েছে। খেয়াল করলাম, তার দাঁতগুলো খুব পরিষ্কার। মনে হলো, সমাজের উঁচু তলারই মানুষ। কোনোমতে প্রাণে বেঁচেছে। এক তরুণ তাকে নদীর ওপারে অবাঙালি শিবিরে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু অত দূর হেঁটে যাওয়ার শক্তি তার অবশিষ্ট ছিল না। আবার যাওয়ার পথেই কোনো বীরপুরুষ হয়তো তাকে শেষ করে দিত। তারপরও তাকে যেতে দেওয়া হলো। আমি ভেবেছিলাম, সে শিবিরে পৌঁছালেও বাঁচতে পারবে না।

দু’তিনদিন পর ওই লোকটাকে আবার আমাদের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। তার শরীরের চামড়া আরও বেশি করে হাড্ডীর সঙ্গে লেগে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম না কী করব। পাকিস্তানি সেনারা যখন আসবে, তখন সে নিশ্চয়ই আমাকে দেখিয়ে দেবে। কেননা, আমাকে রাইফেল নিয়ে চলাফেরা করতে দেখেছে। আমি কাঁধ থেকে রাইফেলটা নামিয়ে তার বুক বরাবর তাক করলাম। লোকটা দুই হাত ওপরে তুলতেও পারছিল না। বিড়বিড় করে কী বলতে চাচ্ছিল, ‘চালাও গুলি, আমি আর পারছি না। আমার সব গেছে। এখন আমাকেও শেষ করে দাও।’ অথবা হয়তো প্রাণভিক্ষা চাইছিল। 

আমি একটু থমকে গেলাম। ভাবলাম যে কয়েক দিন আগেই জাভেদকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলাম, আর এখন নিজের নিরাপত্তার জন্য আরেকজনকে হত্যা করতে যাচ্ছি! শেষ পর্যন্ত রাইফেলটা নামিয়ে নিলাম। একটা বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেললাম। সন্ধ্যার সময় ফিরে এসে ভাবলাম, লোকটাকে কিছু খাবার দেব, যেন সে অনাহারে না মরে। কিন্তু তাকে আর খুঁজে পেলাম না। ধারণা করলাম, শান্তিতে মরার জন্য হয়তো কাছের কোনো জঙ্গলে চলে গেছে। লোকটাকে বাঁচাতে পারলাম না বলে খুব খারাপ লেগেছিল। তবে চার দশক পর এটা মনে করে ভালো লাগে যে তাকে আমি গুলি করিনি। যদি আজও সে বেঁচে থাকে, তাহলে হয়তো আমাকে মনে করবে – অন্তত ঘৃণার সঙ্গে নয়।

 … দিনে ও রাতে বাস বোঝাই করে ইপিআরের সদস্যদের সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। অবাঙালি ইপিআরের সদস্যরা তাদের বাঙালি সহকর্মীদের হাতে নিহত হয়। অনেককে হাত-পা বেঁধে খাদের পানিতে ফেলে দেওয়া হয় বলেও শুনতে পাই। রাতে যখন তারা বাস-ট্রাকে চেপে চট্টগ্রামে রওনা হতো, তখন যে আওয়াজ হতো, তা ছিল রীতিমতো রোমহর্ষক। 

 … যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। প্রতিটি মুহুর্তেই পাকিস্তানি সেনাদের আগমন আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। আমাদের কোনো ধরণের শক্তি আর অবশিষ্ট ছিল না।অবাঙালিদের হত্যা করার পর আমাদের নৈতিক শক্তিও ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেককেই আমরা ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। আমাদের কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও ছিল না।

 … এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা ও আশপাশের অবাঙালিরা প্রায় সবাই ইপিআরের লোকজন ও তাদের সহযোগীদের কব্জায় চলে আসে। এরপর তাদের হত্যা করা হয়। এটা যেন সেই উগ্র জাতীয়তাবাদের আরেক পিঠ, যেখানে নির্মমতা ও অন্ধত্ব মিশ্রিত হয়ে আছে। হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যাওয়া পুরুষ, নারী ও শিশুদের নিয়ে বড় ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমে তাদের কিছু পুরোনো ঘরে রাখা হয়। আর অভিজাত পরিবারের সদস্যদের ঠাঁই মেলে বিদেশিদের থাকার ছোট ছোট বাংলোয়। ১৩ এপ্রিল তৃতীয়বারের মতো আমরা যখন জায়গা বদল করি, তখন এরকম একটি বাংলোয় উঠি। 

আমাদের কেউ কেউ অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এই ভেবে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এলে কী ভয়ংকর প্রতিশোধ গ্র্হণের ঘটনা ঘটতে পারে। তাতে অবশ্য পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্থানীয় সহযোগীদের নিয়ে হত্যাকারীরা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। এরা বেশির ভাগই কাপ্তাইয়ের বাইরে থাকত। আর তাই আমরাসহ যারা কাপ্তাইয়ে থাকি, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের তেমন কোনো চিন্তা ছিল না। এর মধ্যে ঠিক করা হয়, নিহত ব্যক্তিদের স্ত্রী ও সন্তানদের দূরে সরিয়ে রাখা হবে। এ জন্য লেকের মধ্যে ছোট্ট একটা দ্বীপে কয়েক বস্তা আটাসহ তাদের ফেলে আসা হবে, যেন পাকিস্তানি সেনারা এসে স্বগোত্রীয় বিধবা ও নিগৃহীত নারী ও শিশুদের দেখতে না পায়। আমি জানি না, এই নিষ্ঠুর পরিকল্পনা কে বা কারা করেছিল। তবে একাধিকবার চিন্তাভাবনার পর এটা বাদ দেওয়া হয়। ফলে একটা বিরাট অপরাধ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অনেক বছর আগে ছাত্রাবস্থায় আমি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাসের ভিত্তিতে তৈরি করা “ফর হুম দ্য বেল টোলস” ছবি দেখেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, বাস্তব জীবনে আমি সেই চলচ্চিত্রটাই যেন দেখছি। এবার ঘন্টা আমাদের জন্যই বাজছিল।

 … এক বছর পর বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে সরকারি সফরে আমি আবার কাপ্তাই যাই, তখন নিহত অবাঙালিদের পরিবারের নারী-শিশুদের সেখানে দেখতে পাই। তাদের জন্য কেউই আর কিছু করেনি। অনেক তরুণী এমন জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়, যা কোনো মেয়ে স্বেচ্ছায় বেছে নেবে না। আমরা যখন কোলাহলপূর্ণ পাঠান কলোনি অতিক্রম করছিলাম, তখন বিদ্যুৎ বোর্ডের প্রধান ডব্লিউ চৌধুরী বলছিলেন, ‘যারা এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে, খোদাতা’আলা তাদের শাস্তি দেবেন।’ ওই দিন সকালেই মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হত্যাকারীদের নেতা নিজেকে বড় একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করে এবং বলে যে যুদ্ধে তার সহায়-সম্পত্তি ও হাজার হাজার টাকা খোয়া গেছে। সে সরকারের কাছে ক্ষতিপুরণও দাবি করে। তবে আমি জানতাম, সে খুব সাধারণ একজন মানুষ, তার তেমন কিছুই ছিল না। শুধু কাপ্তাই বাজারে একটা মাংসের দোকান ছিল।

 … গোটা পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে আমি বিরাট একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলি। তাই যন্ত্রচালিত একটি দেশি নৌকায় করে ৮ এপ্রিল রাঙামাটির দিকে রওনা দিই । … তবলছড়ী ঘাটে নেমে আমি সরাসরি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও আমার বন্ধু এম ই শরিফের বাসভবনে গেলাম। … শরিফ বলল, আগরতলা জেলা প্রশাসনের অনুরোধে তৌফিক ইমাম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানীতে যান আলোচনার জন্য। সেখানে দুই দিন থেকে আগের সন্ধ্যায় ফিরে এসেছেন। … জানতে পারলাম, মিসেস ইমাম সন্তানসম্ভাবা, সময়ও অনেক এগিয়ে এসেছে। তাই তারা দু-তিন দিনের মধ্যে আগরতলায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।

শফিক আমাকে যা বলেছিল, ইমাম সাহেবও আমাকে সেই একই কথা বললেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের সেনারা পরাজিত হয়েছে ও পিছু হটেছে। আর তাই প্রতিরোধ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তার পরই গোটা প্রদেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আমি তাকে আমাদের এলাকা কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনায় নির্বিচারে অবাঙালি নিধন ও আমাদের উদ্বেগের কথা জানালাম। এভাবে অবাঙালি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে প্রশাসন কেন নিষ্ক্রিয় ছিল, তা-ও জানতে চাইলাম। এর জবাবটা দিলেন আলী সাহেব। তিনি বললেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে এটা করা হয়েছে। তারা আগরতলা থেকে এই নির্দেশ দিয়েছিল।’ 

 … আমরা নিশ্চিত ছিলাম, ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী কাপ্তাই আক্রমণ করবে। তারপরও আরেকটা দিন নিরাপদে কেটে গেল। আমাকে কাপ্তাই ছাড়তেই হচ্ছিল। কেননা, আমার মতো পেশার মানুষকে পাকিস্তানিরা ১ নম্বর শত্রু বলে চিহ্নিত করে। আবার আমার সুইডিশ ইনস্টিটিউটের কিছু ছাত্র সক্রিয়ভাবে আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েছিল। ইনস্টিটিউটের বাস ও গাড়ি ব্যবহার হচ্ছিল বিদ্রোহীদের চলাচলের জন্য। শহরের প্রবেশমুখে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে ইনস্টিটিউটের লরি নিয়ে যাওয়া হয়।

ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তবে সবচেয়ে খারাপ কাজ হয়েছিল, অবাঙালি নিধনে ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণ ব্যবহার করা। হত্যা করার পর তাদের মৃতদেহগুলো ইনস্টিটিউটের খেলার মাঠ সংলগ্ন জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হয়। দুটি বাস ভর্তি করে অবাঙালিদের চন্দ্রঘোনা থেকে এনে নামানো হয় এবং একজন একজন করে হত্যা করা হয়। কয়েক শ মিটার দূরে আমি অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হত্যাকান্ড দেখে অদূরে স্টাফ কোয়ার্টার ভবন থেকে নারী-শিশুদের আর্তচিৎকার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। দুই দিন পর মৃতদেহগুলোয় পচন ধরায় বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ডি-৮ বুলডোজার এনে মাটি ও বালুর সঙ্গে মরদেহগুলোকে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মৃত্যুর আগে অনেকেই তাদের টুপি-তসবিহ ও কোরআন শরিফ একটা বাক্সে রেখে দেয়। ভালো মুসলমান হিসেবে তারাও আমাদের মতো আল্লাহর দয়া চেয়েছিল। তাদের সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হয়নি। 

 … শরীরে শাড়ি প্যাঁচানো এক নারীকে একাকী হেঁটে আসতে দেখলাম। সে যেন সম্পূর্ণ উদভ্রান্ত হয়ে গেছে। মিসেস হামুদুর রহমান নিশ্চয়ই স্রষ্টাকে দুষছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দেরিতে পাঠানোর জন্য। তার স্বামী ও দুই ছেলেকে ইপিআর স্থানীয়দের সহযোগিতায় হত্যা করেছিল। হামুদুর ছিলেন একজন বাঙালি। এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে। মিসেস হামুদুর হত্যাকারীদের কাছে এই বলে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন, যেন দুই ছেলের একজনকে রেহাই দেওয়া হয় পরিবারকে দেখাশোনা করার জন্য। তাতেও কাজ হয়নি। হামুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি তার পকেট ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দপ্তরে গোপনে খবর পাঠাতেন। আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধির স্তর এরকমই ছিল ! পরিবারটি তাদের এমন একজন মানুষকে হারাল, যার কোনো ধারণাই ছিল না যে আশপাশে কী হচ্ছে। সেই সঙ্গে হারাল দুই ভাইকে। বিধবা মাকে নিয়ে অল্প বয়সী মেয়েটি বেঁচে রইল, যে কিনা চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গাইত। বেঁচে রইল শোক করার জন্য॥”

— ফারুক আজিজ খান (প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব, মুজিবনগর) / বসন্ত ১৯৭১ : মুজিবনগর সরকারের কেন্দ্র থেকে দেখা মুক্তিযুদ্ধ ॥ [ প্রথমা প্রকাশন – মার্চ, ২০১৫ । পৃ: ৩৮-৬৮ ]

০২.

“… ২৬-৩০শে এপ্রিল, ১৯৭১। কর্নফুলী পেপার ও রেয়ন মিলস, চন্দ্রঘোনা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা। ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ড অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েদের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। উদ্ধার করার পর তারা অবর্ণনীয় ধর্ষণ ও বর্বরতার কাহিনী বর্ণনা করে। হতাহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। 

 ২৭-৩০শে এপ্রিল, ১৯৭১। রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের একত্রিত করে নির্যাতন ও হত্যা করাহয়।পাঁচশ লোক প্রাণ হারায়॥”

 তথ্যসূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র / সম্পা : বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ॥ [ আগামী প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ । পৃ: ১৪৩ ]

 

০৩.

“…পয়ষট্টিতম সাক্ষীর বিবরণ: 

৩৫ বছরের ওয়াজিহুন্নিসার স্বামী কেন্দ্রীয় শুল্ক বিভাগে চাকরি করতেন। তার পোস্টিং ছিল চন্দ্রঘোনায়। ওয়াজিহুন্নিসা তাদের শহরে ১৯৭১ সালের মার্চে সংঘটিত অবাঙালি হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন:

“১৯৭১ সালে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের এলাকায় বাড়িতে এসে অবাঙালিদের আশ্বস্ত করে যে, অস্ত্র সমর্পণ করা হলে তাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। আমার ভদ্রলোক স্বামী তাদের নির্দেশ মেনেনেন এবং তার অস্ত্র সমর্পণকরেন। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আওয়ামী লীগের ভ্রাম্যমাণ সশস্ত্র লোকেরা অবাঙালিদের আতঙ্কিত করে তোলে এবং তাদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। তারা পালানোর সব ক’টি রাস্তা বন্ধ করে দেয়।

২৬ মার্চ আওয়ামী লীগের একটি সশস্ত্র গ্রুপ আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে এবং আমার স্বামীকে তাদের কার্যালয়ে যাবার নির্দেশ দেয়। আমি জানতাম যে, এটা হচ্ছে একটি ছুঁতা এবং তারা আমার স্বামীর রক্তের জন্য পিপাসার্ত।

২৭ মার্চ আরেকদল সশস্ত্র লোক আমাদের বাড়ি আক্রমণ করে। তারা আমাকে এবং আমার স্বামীর তিন ভাইকে জানায় যে, রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক আমাদেরকে নিরাপত্তা প্রদানে তার কার্যালয়ে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা যাত্রা শুরু করলে সশস্ত্র লোকেরা আমাকে বন্দুকের ডগার মুখে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়। তারা আমার দেবরদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। বিকালে একদল উন্মত্ত বাঙালি জনতা আমাদের এলাকায় হামলা চালায় এবং অবাঙালিদের বাড়িঘর লুট করে। আমাদের পুরুষদের অপহরণ করা হয়। একদল লোক আমার বাড়ি ভাঙচুর করে এবং সিলিং ফ্যান ও ওয়ার্ডড্রপ ছাড়া সবকিছু লুট করে। তারা অবাঙালি মহিলা ও শিশুদেরকে গরু-ছাগলের মতো তাড়িয়ে একটি বিশাল ভবনে নিয়ে যায়। আমাদেরকে সেখানে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়। ১৫ দিন আমরা অনাহারে ছিলাম। আমরা আল্লাহর সহায়তা কামনা করি। ১৩ এপ্রিল আমাদের আটককারীরা জানতে পারে যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা চন্দ্রঘোনার দিকে এগিয়ে আসছে। বিদ্রোহীরা আমাদেরকে লাইনে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়। আমরা জানতাম যে, তারা আমাদের ওপর গুলি চালাবে। আমাদের কয়েকজন পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। তাতে বিশৃঙ্খ লা দেখা দেয়। হঠাৎ একটি গোলা এসে পতিত হয় এবং আমাদেরকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে কয়েক গজ দূরে গোলাটি বিস্ফোরিত হয়। আমরা দূরে তাকিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি কোম্পানিকে সবুজ ও অর্ধ চন্দ্রাকৃতির নিশান উড়িয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে দেখলাম।আমাদের আটককারীরা ভীত হয়ে পড়ে এবং ইঁদুরের মতো পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের পানি ও খাবার দেয়। তারা চন্দ্রঘোনায় আরেকটি শিবিরে আটক ২শ’ অবাঙালি মহিলা ও শিশুকে মুক্ত করে।আমরা জানতে পারি যে, বিদ্রোহীরা চন্দ্রঘোনা থেকে যেসব অবাঙালিকে অপহরণ করেছিল তাদেরকে হত্যা করে লাশ কর্ণফুলি নদীতে ফেলে দিয়েছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদেরকে চট্টগ্রামে একটি ত্রাণ শিবিরে ঠাঁই দেয়। ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম দখল করে নেয়ার পর তারা অবাঙালি হত্যাকাণ্ড এবং তাদের ধ্বংস সাধনে মেতে উঠে। শীতকালে আমার ছোট মেয়ে ঠাণ্ডায় আক্রাত্ত হয়। কোনো হাসপাতাল বিহারীর সন্তানকে চিকিৎসা প্রদানে সম্মত হয়নি। সে আমার কোলে মৃত্যুবরণ করে। কয়েকদিন পর আমাকে রেডক্রসের একটি শিবিরে তোলা হয়। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি করাচিতে প্রত্যাবাসন করি।”

চট্টগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে যে, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বাঙালি বিদ্রোহীরা কর্ণফুলি পেপার ও রেয়ন মিল লুট করে এবং অবাঙালি স্টাফ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। খুব কমসংখ্যক লোক পালাতে সক্ষম হয়। পিতা অথবা স্বামীকে হত্যা করার পর শত শত অবাঙালি যুবতীকে অপহরণ কর হয়। বাঙালি বিদ্রোহীরা অপহৃত অবাঙালি যুবতীদের ধর্ষণ করার পর হত্যা করে। হিসেব করে দেখা গেছে যে, ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে চন্দ্রঘোনায় ৫ হাজারের বেশি অবাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। এ সংখ্যা পাকিস্তান সরকারের হিসেব থেকে অনেক বেশি। পাকিস্তান সরকার আগস্টে পূর্ব পাকিস্তান সংকটের ওপর প্রকাশিত শ্বেতপত্রে চন্দ্রঘোনায় অবাঙালিদের মৃত্যুর সংখ্যা ৩ হাজার উল্লেখ করা হয়েছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বিদ্রোহী সৈন্যরা কর্ণফুলি পেপার মিলের যাবতীয় নগদ অর্থ লুট করে এবং বিপুল পরিমাণ মুক্তিপণ পরিশোধ করায় কয়েকজন সিনিয়র স্টাফ সদস্যকে রেহাই দেয়।

রাঙ্গামাটি হলো নৈসর্গিক দৃশ্য সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি মনোরম শহর। চট্টগ্রাম থেকে ৪৫ মাইল দূরে কর্ণফুলি নদীর তীরে এ শহর অবস্থিত । ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহের অগ্নিশিখা এ শহরকে গ্রাস করে এবং এখানে শত শত অবাঙালিকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা রাঙ্গামাটিতে বসবসকারী সকল অবাঙালিকে আটক করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানোর আগে তাদের হত্যা করে। একসময় রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউজে দুর-দূরান্তের পর্যটকরা ভিড় করতো। বিদ্রোহীরা এ সার্কিট হাউজকে তাদের অপারেশনাল ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। এখান থেকে বিদ্রোহীরা চন্দ্রঘোনা ও রাঙ্গামাটিতে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতো।

ছিষট্টিতম সাক্ষীর বিবরণ: 

৩৪ বছরের আবিদ হোসেন কর্ণফুলি পেপার মিলে চাকরি করতেন।মিলের আশপাশে কোনো স্টাফ কোয়ার্টার না পাওয়ায় তিনি রাঙ্গামাটিতে একটি বাড়িতে বাস করতেন। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি স্ত্রীসহ করাচিতে প্রত্যাবাসন করেন। আবিদ হোসেন তার সাক্ষ্যে বলেছেন:

১৮ মার্চ কর্ণফুলি পেপার মিলে প্রথম বড় ধরনের হামলার সূত্রপাত হয়।সেদিন আওয়ামী লীগের জঙ্গি সমর্থকরা অবাঙালি স্টাফ ও তাদের পরিবারকে হত্যা এবং মিল দখল করার জন্য বাঙালি শ্রমিকদের উত্তেজিত করে। পরিণতি আঁচ করতে পেরে আমি আমার বাড়িতে ছুটে যাই এবং আমি আমার স্ত্রীসহ একজন ধার্মিক ও বিশ্বস্ত বাঙালি বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেই।

১৯৭১ সালে পুরো মার্চ জুড়ে আওয়ামী লীগের লোকজন অবাঙালিদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে এবং হত্যার জন্য বহু অবাঙালিকে অপহরণ করে। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বাঙালি বিদ্রোহীরা সকল অবাঙালিকে আটক করে এবং স্কুল ভবনগুলোতে তাদের জড়ো করে। সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানোর আগে আটককৃতদের গুলি করে হত্যা করা হয়। সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের হটিয়ে দেয়ার পর আমি চট্টগ্রামে এক বন্ধুর বাড়িতে স্থানাস্তরিত হই। রাঙ্গামাটিতে এসে আমি কদাচিৎ অবাঙালিদের দেখতে পাই। রাঙ্গামাটিতে আওয়ামী লীগের সহিংসতা থেকে কয়েকজন পালাতে সক্ষম হয়। এসব লোক ১৯৭১ সালের এপ্রিলে চাকমা উপজাতীয় বস্তিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পর তাদেরকে ফের রাঙ্গামাটিতে ফিরিয়ে আনা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিদ্রোহীরা রাতের অন্ধকারে ট্রাক বোঝাই লাশ কর্ণফুলি নদীতে নিক্ষেপ করতো। বহু লাশ বঙ্গোপসাগরে ভেসে যায়। বিদেশি জাহাজের ক্রু ও যাত্রীরা সাগরে ভাসমান অসংখ্য লাশ দেখেছে॥”

— ব্লাড এন্ড টীয়ার্স / কুতুবউদ্দিন আজিজ (মূল: Blood and Tears । অনু: সুশান্ত সাহা) ॥ [ ইউপিপি – ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ৭৯-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *