একাত্তরের আত্মঘাতী লিগ্যাসি
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on October 8, 2024
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
লিগ্যাসি একাত্তরের
একাত্তরের ঘটনাবলী একাত্তরে শেষ হয়নি; বরং নানারূপ বয়ান ও নানারূপ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাঙালি মুসলিম মননে একাত্তর এখনো প্রবল ভাবে বেঁচে আছে। একাত্তর যেমন বাঙালি মুসলিমের রাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে, তেমনি পাল্টে দিয়েছে চেতনার মানচিত্রও। একাত্তরে এমন বহু কিছুই সংঘটিত হয়েছে -যা শত শত বছর পরও আলোচিত হবে। বহু শত বছর পরও একাত্তর নতুন প্রজন্মের মনে বহু প্রশ্ন, বহু বিতর্ক ও বহু বিস্ময়েরও জন্ম দিবে। কারণ, একাত্তর জন্ম দিয়েছে এমন কিছু অপ্রত্যাশিত ও অমীমাংসিত বিষয়ের -যা ইসলামের মূল শিক্ষা, মুল দর্শন ও মুসলিম ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে তা বার বার আঘাত হানবে ঈমানদার মুসলিমের চেতনার ভূমিতে -বিশেষ করে যারা মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও ইজ্জত নিয়ে ভাবে। এ নিয়ে সন্দেহ নাই যে, একাত্তরের যুদ্ধে প্রকৃত বিজয় পেয়েছে ভারত। কারণ, যে এজেন্ডাকে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীগণ ১৯৪৭ থেকেই তাদের হৃদয়ে লালন করে আসছিল এবং যাকে সফল করতে বিপুল অর্থ, অস্ত্র ও মেধা বিনিয়োগ করেছিল তা প্রকাণ্ড ভাবে সফল হয়েছে। ভারত আজ যে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বশক্তি -তা তো দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্র থেকে ১৯৪৭’য়ের অখণ্ড পাকিস্তান বিলুপ্ত হওয়ার কারণেই। অথচ অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে দেশটি চীন ও ভারতের পর পারমাণবিক অস্ত্রধারী ৪০ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রের মর্যাদা পেত।
ভারতের আরো বড় বিজয় হলো, সে তার নিজের আগ্রাসী যুদ্ধকে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের লেবাস পড়িয়ে বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করতে পেরেছে। এভাবে নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি রূপ পেশ করেছে। অথচ ভারতের বিজয়ের পর স্বাধীনতা পেয়েছিল শুধু মাত্র ভারতসেবী আওয়ামী ফ্যাসিস্ট; এবং জনগণ হারিয়েছিল ভোটের অধিকার এবং মৌলিক মানবিক অধিকার। ভারতের সহায়তায় গণতন্ত্র কবরস্থ হয় এবং প্রতিষ্ঠা পায় ফ্যাসিস্ট মুজিব ও হাসিনার ভোটডাকাতি। একাত্তরের যুদ্ধের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হলো প্রায় ৭ লক্ষ বিহারী -যারা ১৯৪৭’য়ের পর ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পূর্ব পাকিস্তানে বসতি গড়েছিল। এ যুদ্ধের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের ফলে বিহারীদের সবাই তাদের ঘরবাড়ী, দোকান-পাট ও চাকুরি হারিয়েছে। প্রায় দেড় লাখ বিহারী নারী, পুরুষ ও শিশু নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে এবং বহু হাজার বিহারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। যারা বেঁচে আছে তাদের বাসস্থান এখন বস্তিতে। ভারতসেবী বাংলাদেশী ফ্যাসিস্টদের বড় সাফল্য হলো, বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংসতম এ বর্বরতাকে তারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে পেরেছে। অপর দিকে প্রচার দেয়া হয়েছে একাত্তরে ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যার কাহিনী। মিথ্যুক ও প্রতারক মুজিবের মুখ থেকে উচ্চারিত এই বিশাল মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে ইচ্ছা করেই একাত্তরের নিহতদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়নি। তাদের নাম ইচ্ছা করেই বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ ধরণের বহু মিথ্যাচারও একাত্তরের লিগ্যাসি।
বাঙালি মুসলিমদের পক্ষ থেকে একাত্তরে যারা ভারতীয় সৈনিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে তাদের কেউই ইসলামের দর্শন, শরিয়তী বিধান এবং মুসলিম জীবনের প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি ও মূল্যবোধ মেনে কাজ করেনি। তারা বরং অনুসরণ করেছে এবং বরণ করে নিয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের রাজনৈতিক বয়ান এবং মেনে নিয়েছে তাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামরিক নেতৃত্বকে। একাত্তরের যুদ্ধজয়ে কতটা বাঙালি মুসলিমগণ লাভবান হয়েছে এবং কতটা লাভবান হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারত -সে হিসাব নিকাশ যুগ যুগ ধরে হতেই থাকবে। পলাশীর যুদ্ধের ঘটনা যেমন ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়নি, হারিয়ে যাবে না একাত্তরের যুদ্ধের ইতিহাসও। পলাশীর যুদ্ধে যেমন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর শত্রু ইংরেজ কাফির শক্তি ছিল এবং তাদের আজ্ঞাবহ মীর জাফর ছিল, তেমনি কাফির শক্তি ছিল একাত্তরেও এবং ছিল তাদের অনুগত মীর জাফরও। ফলে শত শত বছর পরও বিচার বসবে সেসব মীর জাফরদের অপরাধ নিয়ে।
স্বাধীনতার খরচ এবং বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা
প্রশ্ন হলো, একাত্তরে অর্জিত হয়েছে কি বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা? স্বাধীনতা ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচার খরচটি বিশাল। সে খরচ কি বাঙালি মুসলিমগণ একাত্তরে পরিশোধ করেছে? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলা দূরে থাক, একটি মহকুমা বা থানাও কি মুক্তিবাহিনী তার সাড়ে ৮ মাসের একক যুদ্ধে নিজ শক্তিতে স্বাধীন করতে পেরেছে? সে কাজটি তো শেষের আড়াই সপ্তাহে করে দিয়েছে আড়াই লাখ সৈন্যের বিশাল ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ভারতীয় বিমানবাহিনী। তখন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সৈন্যের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৫ হাজার। প্রশ্ন হলো, যারা স্বাধীনতা নিজ শক্তিতে আনতে পারে না, তারা কি স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে পারে? পরাধীনতা নিয়ে বাঁচাই তো তখন নিয়তি হয়। একাত্তরের অর্জন তো সে পরাধীনতা। সে পরাধীনতার প্রমাণ, বাংলাদেশীরা হারিয়েছিল ভোটের অধিকার। এবং হারিয়েছিল স্বাধীন ভাবে কথা বলার অধিকার। ভারতকে দিতে হয়েছে ভূগোলের পেট চিড়ে করিডোর, সড়ক পথ, রেল পথ ও বন্দরের সুবিধা। দিতে হয়েছে পদ্মা, তিস্তাসহ ৫৪টি নদীর পানি। মনিব যা চায়, দাসকে তাই দিতে হয়। এই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। অথচ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – এই ২৪ বছরের পাকিস্তানী আমলে পূর্ব পাকিস্তানীদের এর কোন কিছুই ভারতকে দিতে হয়নি। সেগুলি নেয়ার সাহসও ভারতের ছিল না। অথচ বাঙালি কাপালিকগণ সে পাকিস্তানী আমলকে বলে বাংলাদেশীদের পরাধীনতা।
স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য যেমন লোকবল চাই, তেমনি চাই অর্থবল, সামরিক বল ও নৈতিক বল। সে সামর্থ্য ক্ষুদ্র, বিভক্ত ও দরিদ্র জনগণের থাকে না। তাই যে স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার সামর্থ্য ২৪ কোটি পাকিস্তানের আছে তা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির গোত্রীয় রাষ্ট্র সৌদি আরব, কাতার কুয়েত, আমিরাত, ওমানের নাই। স্বাধীন ভাবে বাঁচার সে সামর্থ্য বাড়াতেই মুসলিম লীগের বাঙালি নেতৃবৃন্দ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিলেন -যেমন ইউরোপীয়ানরা যোগ দিয়েছে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে। বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ গড়ার মধ্যে স্বাধীন ভাবে বাঁচার সম্ভাবনা দেখলে ১৯৪৭’য়ের সে প্রজ্ঞাবান নেতাগণ সেদিনই স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণ করতেন। কিন্তু সেরূপ বিচ্ছন্নতার মাঝে তারা স্বাধীনতা হারানোর বিপদ দেখেছিলেন। হায়দারাবাদ ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সে বিপদ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
একতা ফরজ, বিভক্তি হারাম
পাকিস্তানের শক্তি শুধু তার পারমাণবিক বোমা বা ২৪ কোটি জনগণের বল নয়, বরং সেটির কারণ, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি, বালুচ, কাশ্মীরী ও উর্দু ভাষী মোহাজির– এ ৬টি ভিন্ন ভাষার ও ভিন্ন আঞ্চলিকতার মানুষের একত্রে এক ভূগোলে বসবাসের রাজনৈতিক, নৈতিক ও আদর্শিক বল। অথচ এ দেশটি ভেঙ্গে ৪টি বাংলাদেশ হতে পারতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। কারণ এদেশটির বুকে একত্রে বেঁচে আছে ইংরেজ, আইরিশ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, স্পানিশ, চীনা, ভারতীয়, আরব, পাকিস্তানী বংশদ্ভুদ প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ। নানা ভাষার এ বিচিত্র জনগণ দেশটির সামরিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় কাতার, কুয়েত ও আরব আমিরাতের জনগণের দশ ভাগের এক ভাগও নয়। কিন্তু বিশ্বমাঝে ভারতের যে শক্তি ও ইজ্জত সেটি কি কাতারী, কুয়েতী ও আমিরাতীদের আছে? নাই। ভারতের সে শক্তির পিছনে রয়েছে নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মানুষের মাঝের ঐক্য। এজন্যই সর্বজ্ঞানী আল্লাহতায়ালা একতাকে ফরজ করেছেন এবং বিভক্তিকে হারাম করেছেন। বাঙালি ফ্যাসিস্ট, বাঙালি বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্টগণ একাত্তরে হারাম পথটিই বেছে নেয়।
মানব ইতিহাসে যারাই বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছে তাদের সবাইকেই একতার পথ বেছে নিতে হয়েছে। এবং যারা বিভক্তির পথ ধরেছে তারাই পরাজিত ও অপমানিত হয়েছে। মুসলিমগণ একমাত্র তখনই বিশ্বশক্তির ইজ্জত পেয়েছে যখন আরব, তুর্কি, কুর্দি, ইরানী, মুর, হাবসী –এরূপ নানা ভাষাভাষীর জনগণ একত্রে এক রাষ্ট্রের পতাকাতলে বসবাস করেছে। কবি শেখ সাদী একটি অমূল্য কথা বলেছিলেন, “হর গুলই এক বু দারদ’ অর্থ: প্রতিটি ফুলেরই একটি বিশেষ গন্ধ আছে। ফলে ফুলের বাগান গড়তে হলে এক জাতের ও এক রংয়ের ফুল দিয়ে সেটি হয় না। সে জন্য চাই নানা জাতের ও নানা রংয়ের ফুল। মহান আল্লাহতায়ালা চান মুসলিমগণ শক্তি, স্বাধীনতা ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচুক। এজন্যই তিনি বিভক্তি গড়াকে হারাম করে দিয়েছেন এবং একতাকে ফরজ করেছেন। পবিত্র কুর’আনে সুরা আল ইমরানের ১০৩ নম্বরে ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ দিয়েছেন:
وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًۭا وَلَا تَفَرَّقُوا۟ ۚ وَٱذْكُرُوا۟ نِعْمَتَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَآءًۭ فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِۦٓ إِخْوَٰنًۭا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍۢ مِّنَ ٱلنَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمْ ءَايَـٰتِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
অর্থ: “এবং তোমরা শক্ত করে আঁকড়ে ধরো আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ কুর’আনকে) এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না; এবং স্মরণ করো আল্লাহর নিয়ামতকে যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের হৃদয়ের মাঝে বন্ধন গড়লেন এবং তাঁর রহমতের বরকতে তোমরা পরস্পরে ভাই হয়ে গেলে। এবং তোমরা তো ছিলে আগুনপূর্ণ গর্তের কিনারে এবং তিনি তোমাদের সে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তার আয়াতকে বয়ান করে থাকেন -যাতে তোমরা হিদায়েত পাও।”
পবিত্র কুর’আনে যখনই কোন নির্দেশ আসে তখন সে নির্দেশ পালন করা ফরজ হয়ে যায়; অমান্য করলে কাফির হতে হয়। পবিত্র কুর’আনে মাহে রমজানের রোজার হুকুম এসেছে মাত্র একবার। তাতেই মাহে রমজানের এক মাস রোজা প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ হয়ে গেছে। যে কেউ সে হুকুম অমান্য করলে -সে আর মুসলিম থাকে না, কাফির হয়ে যায়। ইবলিসও আল্লাহকে বিশ্বাস করে। সে আল্লাহতায়ালার ইবাদতও করতো। কিন্তু একটি মাত্র হুকুম অমান্য করাতে সে অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়। তাই মহান আল্লাহতায়ালার যে কোন হুকুমকে অমান্য করা শয়তানের সূন্নত -যা অসম্ভব করে মুসলিম হওয়া। সুরা আল ইমরানের উপরিউক্ত আয়াতটি হলো আয়াতে মোহকামাত। আয়াতে মোহকামাত বলতে বুঝায় সে সব আয়াতগুলিকে যাতে থাকে মহান আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট অলংঘনীয় হুকুম -যা মানা ফরজ। উপরিউক্ত আয়াতে এসেছে একতাবদ্ধ হওয়ার হুকুম। একতার ভিত্তি হলো পবিত্র কুর’আন। অর্থাৎ সবাইকে একতাবদ্ধ ভাবে অনুসরণ করতে হবে কুর’আনের বিধানকে। ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতা কখনোই বিভক্তি গড়ার কারণ হতে পারে না।
একতাকে মহান আল্লাহতায়লা তাঁর নিজের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত নিয়ামত বলেছেন -যা এক মুসলিমকে অন্য মুসলিমের ভাইয়ে পরিণত করে। এভাবেই জন্ম নেয় মুসলিম উম্মাহ। অপর দিকে বিভক্তি হলো তার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ -যা পরস্পরের মাঝে যুদ্ধ আনে এবং জাহান্নামে কিনারে পৌঁছে দেয়। আরবের বিভক্ত জনগণ যে ভাবে জাহান্নামের পথ থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তুলেছিল, তার মূলে ছিল, তারা একতাবদ্ধ ভাবে অনুসরণ করেছিলেন কুর’আনী শিক্ষাকে এবং নিজেদের বাঁচিয়েছিলেন বিভক্তি থেকে।
তবে কুর’আনের অনুসরণ এবং একতা গড়া তো তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা প্রৃকৃত ঈমানদার; সেটি অসম্ভব ও অভাবনীয় বেঈমানদের জন্য। ঈমানদার তো সেই যে মহান আল্লাহতায়ালাকে শুধু বিশ্বাসই করে না, তাঁর প্রতিটি হুকুম পালনে অতি দৃঢ় ও আপোষহীন। মু’মিনদের বৈশিষ্ঠ শুধু এ নয়, তারা নামাজী ও রোজাদার। বরং এটিও বৈশিষ্ঠ যে, তাদের অদম্য তাড়নাটি ঐক্যবদ্ধ থাকায় এবং বিভক্তি থেকে বাঁচায়। ঈমানদার ব্যক্তি সর্বাবস্থায় একতার রাস্তা খোঁজে। নামাজশূণ্যতা যেমন বেঈমানীর লক্ষণ, তেমনি বেঈমানীর লক্ষণ হলো বিভক্তি নিয়ে বাঁচা। তাই যে ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি দেখে উৎফুল্ল হয় এবং তা নিয়ে উৎসব করে -সে ব্যক্তি নামাজী, রোজাদার বা হাজী হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত ঈমানদার নয়। নামাজী, রোজাদার ও হাজী তো বহু ঘুষখোর, সূদখোর ও প্রতারকও হতে পারে। কোন সমাজে বিভক্তি ও হানাহানী দেখে বুঝা যায় সে সমাজের মানুষ ইসলাম থেকে দূরে সরেছে এবং তাদের ঈমান হয় অসুস্থ অথবা মৃত। ঈমান অসুস্থ হয় এবং মারা যায় কুর’আনী জ্ঞানের শূণ্যতায় এবং সেক্যুলারিজম, বস্তুবাদ, জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদের ন্যায় বিষাক্ত মতবাদের দূষণে।
মুসলিম ঐক্য কখনোই ঈমানশূণ্যতায় বাঁচে না। এবং সে ঐক্য কখনোই কুর’আনী জ্ঞানের পুষ্টি ছাড়া বেড়ে উঠে না। তাই সেক্যুলারিজমের তান্ডবে যেখানেই মুসলিমগণ কুর’আন থেকে দূরে সরেছে, সেখানেই বেড়েছে যেমন ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারহীনতা তেমনি বিভক্তি ও হানাহানি। তখন খন্ডিত হয়েছে মুসলিম দেশের ভুগোল। সে অভিন্ন কারণে ঐক্যের চেতনা বাঁচেনি সেক্যুলার বাঙালি মুসলিমদের মাঝেও। চেতনার সে মৃত্যুর কারণেই ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যায়। সে জ্ঞানশূণ্যতা ও ঈমানশূণ্যতার কারণে আওয়ামী বাকশালীদের মাঝে পাকিস্তান ভাঙ্গা নিয়ে আজও এতো উৎসব। যে সত্যিকার ঈমানদার, কোন মুসলিমের ঘর ভাঙ্গা দেখেও সে দুঃখ পায়। অথচ মুসলিমের রাষ্ট্র তো বিশাল ব্যাপার। সেটি তো কোটি কোটি মানুষের ঘর। শুধু পাকিস্তান কেন, কোন একটি মুসলিম দেশ ভেঙ্গে গেল, সেটি দেখে কেউ যদি হৃদয়ে বেদনা অনুভব না করে -তবে তার বেঈমান হওয়ার জন্য আর কোন দলিলের প্রয়োজন আছে কি? ইন্দোনেশিয়া ভেঙ্গে পূর্ব তিমুর বেরিয়ে যাওয়াতে বা সূদান ভেঙ্গে যাওয়াতে বিশ্বের প্রতিটি ঈমানদার দুঃখ পেয়েছে। তেমনি বিশ্বের সকল দেশের মুসলিমগণ দুঃখ পেয়েছে ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে। তবে একমাত্র বাঙালি ফ্যাসিবাদী, বাঙালি বামপন্থী ও বাঙালি সেক্যুলারিস্ট কাপালিকগণ ছাড়া। তাদের বাহাদুরিটা দেশভাঙ্গাতে, দেশ বাঁচাতে নয় । তাদের আগ্রহ নাই মুসলিম দেশের প্রতিরক্ষা, স্বাধীনতা ও গৌরব বৃদ্ধিতে। সংঘাতের জন্ম দেয়াতেই তাদের অহংকার। সে কাজটি তারা প্রবল ভাবে করতে পেরেছিল একাত্তরে। এমন কাজে কাফের শত্রুদের বিপুল সমর্থণ যেমন তারা একাত্তরে পেয়েছে, তেমনি আজও পাচ্ছে। তাদের রাজনীতির মূলনীতি হলো জনগণের মাঝে বিভক্তির সূত্রগুলোকে আবিষ্কার করা,এবং সেগুলিকে নানাভাবে প্রবলতর করা। এমন একটি আত্মঘাতী প্রবণতাই হলো একাত্তরের লিগ্যাসি।
বেঁচে থাকবে যে কদর্য ইতিহাস
বাঙালি জাতীয়তবাদী ফ্যাসিস্ট, বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্টদের ইতিহাস আরেকটি বিশেষ কারণে যুগ যুগ বেঁচে থাকবে। বিশেষ করে দক্ষিন এশিয়ার মুসলিম ইতিহাসে। সে ইতিহাসটি হলো মুসলিম ঐতিহ্যের সাথে গাদ্দারির। পৌত্তলিক কাফিরদের থেকে মুসলিমদের ভিন্নতা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ইবাদতের অঙ্গণে নয়, সে ভিন্নতা অতি প্রবল ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধ-বিগ্রহের অঙ্গণেও। পৌত্তলিক কাফিরগণ যে উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে ও রাষ্ট্র গড়ে মুসলিমগণ সে উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে না এবং রাষ্ট্রও গড়েনা। এটি মুসলিম ইতিহাসে সর্বজন স্বীকৃত ও সম্পূর্ণ মীমাংসিত বিষয়। এজন্যই মুসলিম ইতিহাসের প্রতিটি ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ে মুসলিমদের অবস্থান সব সময়ই কাফিরদের প্রতিপক্ষ রূপে ছিল। কাফিরদের প্রতিপক্ষ রূপে মুসলিমগণ যেমন বদর, ওহুদ ও খন্দকে যুদ্ধ করেছে, তেমনি যুদ্ধ করেছে ১৯৪৭’য়েও। তেমনি যুদ্ধ করেছে ১৯৭১’য়েও। কিন্তু সে মীমাংসিত মুসলিম নীতি ভেঙ্গেছে মুসলিম নামধারী বাঙালি জাতীয়তবাদী ফ্যাসিস্ট, বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্টগণ। তারা গিয়ে উঠে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের কোলে।
ইসলাম থেকে দূরে সরলে মানুষ যে কতটা অপরাধী হতে পারে এবং মুসলিম উম্মাহর কতটা ক্ষতি করতে পারে -মুজিবের ন্যায় ভারতের একনিষ্ঠ সেবকের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, বাঙালি বামপন্থী ও বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ একাত্তরে তার প্রমাণ রেখেছে। তারা ১৯৭১’য়ের যুদ্ধে যোগ দেয় হিন্দুত্ববাদী কাফিরদের বিজয়ী করতে। ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা লড়াই করেছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ পাকিস্তান ভাঙ্গায়। সেদিন সমগ্র বিশ্বের মুসলিমগণ বিস্ময়ের সাথে তাদের সে কদর্য কর্ম দেখেছে। সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে সেটি এতোই কদর্য লেগেছিল যে ভারত-সৃষ্ট সে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভূটান ও ভারতের ন্যায় কাফির দেশ এগিয়ে আসলেও কোন মুসলিম দেশ এগিয়ে আসেনি। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের সাথে সে কুৎসিত গাদ্দারি নিয়ে শত শত বছর পরও আলোচনা হবে। প্রশ্ন উঠবে, পৌত্তলিক কাফিরদের সাথে এতো বন্ধুত্ব? মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এমন গাদ্দারি? একাত্তরের যুদ্ধ জয়ের পর দীর্ঘকাল এরাই ভারতীয় দখলদারীকে বাংলাদেশের বুকে বলবৎ রাখে। সে দখলদারী থেকে মুক্তি মিললো ২০২৪’য়ের ৬ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তদানের মাধ্যমে।
বিজয় কবিরা গুনাহর রাজনীতির
ইসলামে বিভক্তি গড়া যেমন হারাম, তেমনি সে বিভক্তিকে বাঁচিয়ে রাখাও হারাম। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এ হলো অতি ঘৃণ্য কবিরা গুনাহ। মুসলিম উম্মাহ আজ শক্তিহীন তো এ কবিরা গুনাহর কারণে। এ বিভক্তি বিজয় বাড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইসরাইলের ন্যায় শত্রু শক্তির। কয়েক লক্ষ মুসলিম শহীদ হলে বা কয়েক হাজার মসজিদ বিধ্বস্ত হলেও মুসলিমদের এতো ক্ষতি হয়না, যতটা ক্ষতি হয় কোন মুসলিম দেশ ভেঙ্গে গেলে। তখন মুসলিম ভূমিতে গোলামী, গণহত্যা ও ধ্বংস প্রক্রিয়া যুগ যুগ ধরে নিত্য সহচর হয়। মুসলিম উম্মাহ আজ সেটি বুঝছে উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ার পর। বাঙালি মুসলিমগণ সেটি বুঝছে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওযার পর। গাজায় মুসলিম গণহত্যা অবিরাম চলছে; ৪২ হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার পরও সে গণহত্যা থামাবার কেউ নেই। আরাকানে মুসলিম হত্যা এবং বাংলাদেশের সীমান্তে বাংলাদেশীরা নিয়মিত লাশ হলেও সেটিও থামাবার কেউ নেই।
এ বিপদ থেকে বাঁচাতে নবীজী (সা:) বলেছেন, কিছুক্ষণের জন্য দেশের সীমান্ত পাহারা দেয়া সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। অথচ মুসলিম নামধারী বাঙালি কাপালিকদের কাছে নবীজী (সা:)’র এ পবিত্র হাদীস গুরুত্ব পায়নি। তারা বরং ভেসে গেছে জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদ, বাম রাজনীতি ও সেক্যুলারিজমের জোয়ারে। সীমান্ত পাহারা দেয়ার বদলে তারা পৌত্তলিকদের সাথে গলা মিলিয়ে মুসলিম দেশকেও খণ্ডিত করেছে। এবং বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ তুলে দিয়েছে ভারতের হাতে। পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত “লা তাফাররাকু” –তোমরা বিভক্ত হয়োনা এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে এ হলো তাদের সুস্পষ্ট বিদ্রোহ। অথচ বাঙালি সেক্যুলার রাজনীতির মূল সুরটি হলো বিভক্তির। বাংলাদেশের সমাজ জুড়ে সুদ, ঘুষ ও বেশ্যাবৃত্তির ন্যায় কবিরা গুনাহ যেমন ব্যবসা রূপে বেঁচে আছে, তেমনি দেশের রাজনীতি জুড়ে বেঁচে আছে কবিরা গুনাহর রাজনীতি। অথচ মুসলিম হওয়ার অর্থ হলো যেমন ইবাদতে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের অনুগত হওয়া, তেমনি রাজনীতিতে “তা’ছিমু বি হাবলিল্লাহি জামিয়াও” তথা আল্লাহতায়ালার রশিকে আঁকড়ে ধরার নীতিকে অনুসরণ করা। একমাত্র তখনই রাজনীতিতে ঐক্যের সুরটি প্রবলতর হয়।
অথচ কবিরা গুনাহর রাজনীতির এজেন্ডা শুধু মুসলিম দেশকে বিভক্ত করা নয়, বরং মুসলিম জনগণকে বিভক্ত রাখাও। তাই একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙার মধ্য দিয়ে ইসলামের শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্র একদিনের জন্যও থেমে যায়নি। তারা তো চায়, বাংলাদেশীদের চিরকালের জন্য বিভক্ত রাখতে। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ইসলামের উত্থান রুখার এটিই শক্তিশালী কৌশল। আওয়ামী বাকশালীদের পক্ষে ভারতের বড় অংকের পুজি বিনিয়োগের কারণও হলো এটি। প্রতিপক্ষ নির্মূলের রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এমন বিভক্তিকে তীব্রতর করা। এ ছাড়া তাদের সামনে ভিন্ন কোন পথও নাই। কারণ এ বিভক্তি না বাঁচালে তাদের রাজনীতি বাঁচবে না। সে বিভক্তিকে তীব্রতর করার স্বার্থেই তারা ইসলামপন্থীদের চরিত্র হননে নামে। তাদেরকে স্বাধীনতার শত্রু রূপে চিত্রিত করে। অথচ ইসলামপন্থীগণ কখনোই স্বাধীনতার বিরোধী ছিল না, তারা ছিল বিচ্ছিন্নতার বিরোধী। বরং বিচ্ছিন্নতার মাঝে তারা বাঙালি মুসলিমের পরাধীনতা ভেবেছিল। এবং সেটি সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাই স্বাধীনতা আনতে আবার বক্তাক্ত যুদ্ধ করতে হলে এবং ভারতের এজেন্ট হাসিনা তাড়াতে হলো। ০৮/১০/২০২৪
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- ভারতীয় আগ্রাসনের হুমকি: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুরক্ষা কীরূপে?
- ভারতীয় ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
- সম্প্রতি বাংলাদেশে যা দেখলাম
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018