অধ্যায় সাঁইত্রিশ: ভারতের স্বপ্নপূরণ ও বাঙালী মুসলিমের নতুন পরাধীনতা

ভারতের স্বপ্নপূরণ

ব্যক্তির স্বপ্নের মধ্যেই প্রকাশ পায় তার চিন্তা-চেতনা,ঈমান-আক্বীদা ও দর্শন। মুসলিম ও অমুসলিমের স্বপ্ন তাই কখনোই একই রূপ হয়না;কখনোই তা একই মোহনায় মিশে না। যখন সে স্বপ্ন কাফেরদের স্বপ্নের সাথে মিশে একাকার হয় -তখন বুঝতে হবে সেটি নিশ্চিত মুসলিমের স্বপ্ন নয়।একাত্তরের ইতিহাসকে বুঝতে হলে এ দু’টি স্বপ্নের কথা অবশ্যই বুঝতে হবে। মুসলিম মাত্রই স্বপ্ন দেখে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন পালনের অঙ্গীকার নিয়ে বাঁচায় এবং সে লক্ষ্যে প্রাণদানে। ঈমানদারের স্বপ্নের সে মানচিত্রে থাকে ইসলামী রাষ্ট্র গড়া ও সে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। থাকে,শরিয়ত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন।কারণ,শরিয়ত নিয়ে না বাঁচলে কি ইসলাম পালন হয়? ঈমানদারের প্রতিকর্মে থাকে মহান আল্লাহতায়ালার অনুগত বান্দা রূপে বাঁচা ও তাঁর মাগফেরাত লাভের স্বপ্ন।স্বপ্নের শীর্ষে থাকে,মৃত্যুর ওপারে জান্নাতে পৌছার স্বপ্ন। সে বিশাল স্বপ্নটিই হলো ঈমানদারের জীবনে মূল ভিশন;সে ভিশনটিই তার বাঁচা-মরা,যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজনীতির মূল মিশন নির্দিষ্ট করে দেয়। ফলে মু’মিন ব্যক্তির জীবনে কি সে মিশন থেকে এক ইঞ্চি সরে দাড়ানোর ফুরসত থাকে? ফলে মু’মিন ব্যক্তিকে তাই শুধু স্বপ্ন দেখলে চলে না।সে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠায় নিজ অর্থ,নিজ শ্রম,নিজ মেধা এবং নিজ প্রাণের কোরবানীও পেশ করতে হয়। এরূপ কোরবানীর মধ্যেই তার ঈমানদারী। তাই মু’মিন ব্যক্তির ঈমান শুধু তার নামায-রোযা,হজ-যাকাতে ধরা পড়ে না,ধরা পড়ে সে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার মধ্যেও। ব্যক্তির ধর্ম-কর্ম,রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ হলো সে স্বপ্ন পূরণের প্রয়াস। যার মধ্যে সে স্বপ্ন নাই,বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমানও নাই।তখন অন্যদের সেবাদাস হওয়া এমন ঈমানহীনদের জন্য সহজ হয়ে যায়।এরূপ বেঈমানগণই যুগে যুগে নিজ সামর্থ্যের পূর্ণ বিনিয়োগ করে,এমনি প্রাণ দেয় অমুসলিমদের স্বপ্ন পূরণে। ভারতের বুকে ঔপনিবেশিক শাসন ১৯০ বছর যাবত দীর্ঘায়ীত হয়েছে এবং ইরাক ও ফিলিস্তিনের ন্যায় মুসলিম ভূমি ব্রিটিশের হাতে অধিকৃত হয়েছে তো তাদের কারণেই।

তবে ঈমানদার রূপে স্বপ্ন দেখারও সামর্থ্য লাগে। মু’মিনের চেতনায় সে স্বপ্নটি জাগে কোরআনী জ্ঞান থেকে। মন ও মননে সেক্যুলারিজম,জাতীয়তাবাদ,পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের ন্যায় মতবাদের জঞ্জাল বাড়িয়ে কি মুসলিম রূপে স্বপ্ন দেখা যায়? বরং ঈমানদারের স্বপ্ন তখন সেকেলে বা সাম্প্রদায়িকতা মনে হয়।যেমন আরব কাফেরগণ গণ্য করেছিল নবীজী (সাঃ)র প্রচারিত ইসলামকে। বাঙালী মুসলিমের মনে এমন একটি চেতনার সংকট ও স্বপ্নের শূণ্যতা দেখা দেয় ১৯৭১’য়ে। তাতে সহজ হয়ে যায় ভারতের স্বপ্ন পূরণ। বরং সত্য হলো,একাত্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে বাংলাদেশ অধিকৃত হওয়ার বহু আগেই ভারত ও ভারতসেবীদের হাতে অধিকৃত হয়ে যায় বাঙালী মুসলিমের চেতনার ভূমি। তখন ভারতের পাকিস্তান ভাঙ্গার স্বপ্নটি তাদের কাছে নিজেদের স্বপ্ন রূপে গণ্য হয়। পৌত্তলিকতার বহু আচারও তখন বাঙালী সংস্কৃতি মনে হয়।ফলে একাত্তরে বাঙালী মুসলিমের ভারত গমন ও ভারতীয় অর্থ,অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে একত্রে যুদ্ধ করাও সহজ হয়ে যায়। এরাই ভারতের স্বপ্ন পূরণে একাত্তরে বহু হাজার বাঙালী আলেম ও ইসলামপন্থীর গলা কেটেছে। ২০১৩ সালের ৫ই মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের মুসল্লী হত্যাই আলেমদের বিরুদ্ধে আওয়ামী বাকশালীদের একমাত্র নৃশংসতা নয়।একাত্তরে সেটি করেছে আরো ব্যাপকতর ও নিষ্ঠুরতার সাথে। এরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,পত্র-পত্রিকা ও রেডিও-টিভিতে কোরআন-হাদীসের পাঠকেও নিয়ন্ত্রিত করেছে।সে সাথে নিষিদ্ধ করেছ শরিয়ত প্রতিষ্ঠা ও শরিয়ত পালনের রাজনীতি। বাংলাদেশের বুকে ভারতীয় স্বপ্ন পূরণের সে ধারা আজও  অব্যাহত রেখেছে।

ইতিহাসের কোন কালেই মুসলিম ও অমুসলিমের স্বপ্ন এক ছিল না।আর স্বপ্ন ভিন্ন ভিন্ন হলে রাজনীতি এক হয় কি করে? ভিন্নতর সে স্বপ্নের কারণেই মুসলিমের রাজনীতি ও অমুসলিমের রাজনীতি অতীতে কখনোই একই ধারায় মিলিত হয়নি।অভিন্ন ভাষা,অভিন্ন বর্ণ ও অভিন্ন ভূখণ্ডের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও সে বিশাল বিভাজনটি দেখা গেছে নবীজী (সাঃ)র আমলে আরবদের মাঝে। সে অমিলটির কারণে আরবের সে অভিন্ন ভূমিতে উভয় পক্ষের একত্রে বসবাস করা সম্ভব হয়নি;খোদ নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাদের তাঁদের প্রিয় জন্মভূমি মক্কা থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। এবং মক্কা বিজয়ের পর বিলুপ্ত করা হয়েছে ইসলামের ভূমিতে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের রাজনীতি। হিন্দু ও মুসলিমের দুটি ভিন্নতর স্বপ্নের কারণেই ১৯৪৭’য়ে অখণ্ড ভারত ভেঙ্গে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান –এ দুটি দেশ গড়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। বাঙালী মুসলিম ও বাঙালী হিন্দুর ভাষা ও ভূমি অভিন্ন হলেও ১৯৪৭ সালে তাদের রাজনীতি একই পথে অগ্রসর হয়নি। কিন্তু শেখ মুজিব ও তার অনুসারিগণ একাত্তরে যে স্বপ্নটি নিয়ে কাজ করেন তাতে ইসলামের কোন স্থান ছিল না,ছিল না মুসলিমের স্বপ্ন পূরণের কোন ভাবনা। বরং ছিল,উপমহাদেশের মুসলিমের ১৯৪৭’য়ের স্বপ্নকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্র। তবে মুজিবের সে স্বপ্নটি নতুন ছিল না। উপমহাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তান ভাঙ্গার সে স্বপ্নটি ভারতের হিন্দু শাসকচক্র লালন করে আসছিল ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। ভারত কখনোই তার স্বপ্নটি পাল্টায়নি,বরং শেখ মুজিব তার ১৯৪৭’য়ের স্বপ্নটি পাল্টিয়ে ভারতীয় স্বপ্ন পূরণের মূল শিখণ্ডিতে পরিণত হয়েছেন। বিচ্যুতিটি তাই মুজিবের,ভারতের নয়। তাছাড়া উলঙ্গ মানুষের যেমন বস্ত্র হারানোর ভয় থাকে না তেমনি ঈমানহীনদের জীবনে বিচ্যুতির কিছু থাকে না –তাদের সমগ্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবন-দর্শনই তো বিচ্যুতির উপর। বিচ্যুতির ভয় তো মুসলিমদের। সে বিচ্যুতিটি এসেছে শেখ মুজিব ও তার অনুসারিদের রাজনীতিতে; ফলে তাদের রাজনীতি পরিণত হয়েছে ভারতের স্বপ্ন পূরণের রাজনীতিতে।ঈমান বিলুপ্তির লক্ষণ শুধু সূদ,ঘুষ,মদ্যপান ও ইসলামের প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারহীন রাজনীতি নয়,বরং সেটি হলো অমুসলিমদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করা,তাদের ন্যায় স্বপ্ন দেখা এবং সে স্বপ্ন পূরণে অমুসলিমের সঙ্গিরূপে যুদ্ধে যোগ দেয়া। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বার বার সাবধান করা হয়েছে। (সুরা মুমতাহিনা,আয়াত ১,সুরা আল ইমরান আয়াত ২৮)।অথচ একাত্তরে সে নিষিদ্ধ কর্মটিই ঘটেছে শেখ মুজিব ও তার অনুসারিদের রাজনীতিতে।

 

বাঙালী মুসলিমের স্বপ্ন

১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পিছনে বাঙালী মুসলিমের বিশাল স্বপ্ন ছিল। সেটি যেমন সত্যিকার স্বাধীনতার,তেমনি প্যান-ইসলামীক চেতনা নিয়ে শক্তিশালী মুসলিম উম্মাহর অংশ রূপে বেড়ে উঠার। বাঙালী মুসলিমের স্বপ্ন রাজ্য জুড়ে তখন ছিল বিশ্বমুসলিম ভাতৃত্ব তথা প্যান-ইসলামিজমের জোয়ার।এর মাত্র কিছুকাল আগে বলকানের যুদ্ধে খলিফার সাহায্যে বাংলার মুসলিমগণ ঘরে ঘরে মুষ্টির চালের হাঁড়ি বসিয়েছিল। তাছাড়া বিশাল ভারতের পেটের মধ্যে বাঙালী মুসলিমের একার পক্ষে স্বাধীন ভাবে বাঁচা যে অসম্ভব -তা নিয়ে সাতচল্লিশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের কোন সংশয় ছিল না।ফলে বাঙালী মুসলিমের স্বপ্নের ভূবনে অবাঙালী মুসলিমদের থেকে বিচ্ছিন্নতার কোন স্থান ছিল না;বরং ছিল তাদের সাথে একাত্ম হয়ে একটি শক্তিশালী মুসলিম উম্মাহ গড়ার স্বপ্ন। তাছাড়া মহান আল্লাহতায়ালাও চান মুসলিমদের মাঝে সীসাঢালা ঐক্য;বিভক্তির যে কোন প্রচেষ্ঠাই হলো তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।একতাতেই শক্তি,সম্মান ও স্বাধীনতা –সেটি যে শুধু বহু বর্ণ,বহু অঞ্চল ও বহু ভাষাভাষীতে বিভক্ত ভারতীয় হিন্দুগণ বুঝেছিল -তা নয়;বুঝেছিল ভারতীয় মুসলিমগণও।ফলে প্রবল বাধা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু একাত্তরে সেসব স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।সে স্বপ্নভঙ্গটি ঘটে ভারতীয় হিন্দুদের হাতে -যারা ১৯৪৭ সালে দেশটির জন্মের বিরোধীতা করেছিল সর্বশক্তি দিয়ে।

মানব জীবনে অতি আনন্দময় উপলব্ধি যেমন নিজ নিজ স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠায়,তেমনি অতি বেদনাদায়ক হলো সে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। একাত্তরের সে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাটি যে শুধু বাঙালী মুসলিম জীবনে এসেছিল তা নয়,আহত  করেছিল সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের। কাফের শক্তির হাতে সিরিয়া বা ইরাক অধিকৃত হলো এবং অধিকৃতির পর খণ্ডিত হলো –তাতে কি কোন মুসলিম ব্যাথিত না হয়ে পারে? সে বেদনার মধ্যেই তো ঈমানদারী।যার মধ্যে সে বেদনা নাই সে কি মুসলিম? দেহ প্রাণ থাকলে সে দেহের কোথাও আঘাত হানা হলে তাতে বেদনার আর্তনাদ উঠবেই। মৃতের দেহে সেটি ঘটেনা।নবীজী মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন।প্রাণহীন দেহে যেমন ব্যাথা থাকে না,তেমনি মুসলিম দেশ খণ্ডিত হলেও ঈমানহীন ব্যক্তিদের মনে ব্যাথা জাগে না।একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী স্বাধীন হবে -তাতে তো সবার আনন্দ পাওয়ার কথা। কিন্তু একাত্তরে সেটি ঘটেনি।বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ভেঙ্গে যাওয়াতে খুশি হয় তো ইসলামের শত্রুগণ।কোন মুসলিম তাতে খুশি হবে এবং সে বিভক্তিকে সাথে সাথে স্বীকৃতি দিবে -সেটি কি ভাবা যায়? ভারতের ন্যায় একটি কাফের দেশের অর্থ,অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে বাঙালী মুসলিমগণ ভারতীয় হিন্দুদের স্বপ্ন পূরণে যুদ্ধে নামবে -সেটি ছিল নানা দেশের মুসলিমদের কাছে অবাক করার মত বিষয়। মুসলিমগণ তো রেকর্ড গড়বে একতায়;বিভক্তি থেকে বাঁচার মধ্যেই তো ঈমান।বিভক্তির পথ যে বেঈমানীর পথ –তা নিয়ে কি কোন মুসলিমের মনে সামান্যতম সন্দেহ থাকতে পারে? তাই কি কোন ঈমানদার ব্যক্তি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার কাজে কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নামতে পারে? হতে পারে কি কাফেরদের মিত্র? দুর্বৃত্তিতে কোন মুসলিম দেশের বিশ্বমাঝে ৫ বার প্রথম হওয়ার ন্যায় এটি ছিল বিস্ময়কর। মুসলিম জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বাঁচার সুনির্দিষ্ট মিশনটি তো “আ’মারু বিল মা’রুফ ওয়া নেহী আনিল মুনকার” অর্থাৎ “ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের নির্মূল”। ফলে মুসলিম মাত্রই রেকর্ড গড়বে দুর্বৃত্তির নির্মূলে,দুর্বৃত্তিতে নয়।কিন্তু যারা দুর্বৃত্তিতে রেকর্ড গড়ে তারা কতটুকু মুসলিম? বাংলাদেশে বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের নিচে নামাটি একাত্তরে বা পরবর্তী বছরগুলিতে থেমে যায়নি,বরং বেগবান হয়েছে। সে প্রমাণ তারা বার বার পেশ করেছে। সেটি যেমন দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়ে,তেমনি দেশটিকে “তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি” করার মধ্য দিয়ে। নিচে নামার এক পর্যায়ে তারা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও স্বৈরাচারী দুঃশাসনও চাপিয়ে দিয়েছে।ভারতীয়দের জীবনে একাত্তর এনেছে স্বপ্ন পূরণের উৎসব।তাদের কাছে ১৬ই ডিসেম্বর তাই মহা উৎসবের দিন। বাঙালী মুসলিমের জীবনে বড় কলংক হলো,এতো মৃত্যু,এতো নির্যাতন,এতো দুর্ভিক্ষ ও এতো অপমান সয়ে তারা উৎসব বাড়িয়েছে পৌত্তলিক ভারতীয়দের।কোন কালে কোন মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কি এরূপ কর্ম কখনো হয়েছে?

 

প্রতারণার জাল

মুজিব জানতেন,স্বাধীনতার কথা বলে কোন নির্বাচনে বা রেফারেণ্ডামে জেতা যাবে না।তাতে বিভেদ দেখা দিবে খোদ আওয়ামী লীগের মাঝে।কারণ এর আগে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা নিয়েও আওয়ামী লীগ ভেঙ্গেছিল। ফলে স্বাধীনতার কথা বললে আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীই পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধীতা করতো। ১৯৭০’য়ের নির্বাচন তাই স্বাধীনতার এজেন্ডা নিয়ে হয়নি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূল না দেখে শেখ মুজিব বাধ্য হয়েই স্বাধীনতার বদলে স্বায়ত্বশাসনের কথা বলেন।তবে সেটি তার মনের কথা ছিল না।দেরীতে হলেও ইয়াহিয়া খান বুঝেছিলেন,স্বায়ত্বশাসনের নামে শেখ মুজিব তাকে ধোকা দিয়েছেন। সেটি জানা যায় জি,ডব্লিও চৌধুরীর বই থেকে। ইয়াহিয়া খানের নিজের কথায়ঃ “Mujib has let me down. Those who warned me against him were right; I was wrong in trusting this person.”  -(Choudhury, G.W: 1974). শেখ মুজিব একান্তে ইয়াহিয়া খানকে অনেক কিছুরই ওয়াদা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ৬ দফা কোন বাইবেল নয়।আভাষ দিয়েছিলেন,নির্বাচনের পর আপোষের সুযোগ থাকবে।বলেছিলেন,পাকিস্তানের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগের নিজস্ব খসড়াটি তাকে দেখাবেন।কিন্তু একাত্তরের জানুয়ারির মাঝামাঝিতে ঢাকাতে শেখ মুজিবের সাথে যখন ইয়াহিয়া খানের বৈঠক হয়,তখন কোন ওয়াদাই তিনি পালন করেননি।সে ব্যর্থ বৈঠকটির পর ঢাকায় জি,ডব্লিও চৌধুরী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জিজ্ঞেস করেন,“আপন কি মুজিবকে তার পূর্বকৃত ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন?” অতিশয় ভগ্নচিত্তে ইয়াহিয়া খান জবাব দেন,“You and I are not politicians –it is difficult to understand their mind and ways of thinking. Let us pray and hope for the best.” -(Choudhury, G.W: 1974)।

 

 

বড় প্রতারণাটি বাংলাদেশীদের সাথে

শেখ মুজিব যে শুধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ধোকা দিয়েছেন -তা নয়।সবচেয়ে বড় ধোকাটি দিয়েছেন বাংলাদেশের জনগণকে। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের ন্যায় ভারতের হাতে এক দিনের জন্যও অধিকৃত হয়নি;এক দিনের জন্যও একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা পায়নি। এবং আজও বেঁচে আছে স্বাধীন নতুন পাকিস্তান রূপে।দেশটি বেঁচে গেছে ভারতসেবী স্বৈরাচারীদের দখলদারি থেকে।বেঁচে গেছে ভারতের হাতে তীব্র লুণ্ঠন,ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি হওয়া থেকেও। বরং বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের জন্য অতি অপ্রিয় সত্য কথাটি হলো,আজকের পাকিস্তানই হলো মুসলিম বিশ্বে একমাত্র আনবিক অস্ত্রধারী সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ।সে সাথে গণতান্ত্রিক দেশ।কিন্তু বাংলাদেশ একাত্তরের ৪৫ বছর পরও বাকশালী স্বৈরাচার থেকে বাঁচেনি।বাঁচেনি আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে।

ওয়াদা দিয়ে সেটি পালন করা সভ্য মানুষের অতি ন্যূনতম গুণ। ঈমানদার হওয়ার জন্য সেটি অপরিহার্য শর্ত। ওজু ভাঙ্গার যেমন সুনির্দিষ্ট কারণ আছে,তেমনি আছে ঈমান ভেঙ্গে যাওয়ারও। ঈমান ভেঙ্গে যায় ওয়াদা দিয়ে ওয়াদা পালন না করলে।এমন ওয়াদাভঙ্গকারি ব্যক্তিদের ইসলামে ঈমানহীন বা বেঈমান বলা হয়।সেটি অতি সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরআনের সুরা মু’মিনুনে। সুরাটির ৪ নম্বর আয়াতে মুমিনের চরিত্রের বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন,“মু’মিন ব্যক্তি তারাই যারা ওয়াদা দিলে সেটি পালন করে এবং তাদের কাছে কোন আমানত রাখলে সেটি খেয়ানত করে না।” কিন্তু ওয়াদা দিয়ে সে ওয়াদাটি ভঙ্গ করাই ছিল শেখ মুজিবের চরিত্র।পাকিস্তানের অখণ্ডতার স্বপক্ষে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক হলফ নামায় তিনি নিজ হাতে স্বাক্ষর করে ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।শুধু তাই নয়,নিজ দলের নির্বাচনি মেনিফেস্টোতেও পাকিস্তানের সংহিতর পক্ষ ওয়াদা দিয়েছেন। কিন্তু সে ওয়াদা তিনি রাখেননি।তবে শেখ মুজিবের ওয়াদাভঙ্গটি স্রেফ পাকিস্তানের সাথে ছিল না।তিনি ওয়াদাভঙ্গ করেছেন খোদ বাংলাদেশীদের সাথেও। দেশবাসীকে তিনি গণতন্ত্রের ওয়াদা দিয়ে একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার উপহার দিয়েছেন।স্বাধীনতার কথা বলে অরক্ষিত ও অধিকৃত বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন।সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশকে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত করেছেন।এমন ওয়াদা ভঙ্গকারি ব্যক্তি কি মুসলিম দেশের নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখে? মুসলিম দেশের নেতা হওয়ার অর্থ তো দেশের ইমাম হওয়া।এমন ব্যক্তিকে দেশের নেতা দূরে থাক,কোন মহল্লার নেতা করা যায়?

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রাশব্রুক্স উইলিয়ামসহ বহু বিদেশী পন্ডিতের অভিমত,বাংলাদেশের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত উন্নতি হয়েছে পাকিস্তানের ২৩ বছরে।আইয়ুব খানের শাসনামলে প্রথম ১০ বছরে উন্নয়নের হার ছিল প্রতিবছর শতকরা ৫ ভাগের বেশী,চিত্রিত হয়েছিল এশিয়ার টাইগার রূপে।প্রফেসর রাশব্রুক্স উইলিয়াম লেখেন,“East Pakistan has made more progress in the economic field in the quarter of a century since Pakistan emerged as an independent state than any other period in her long history. Leaving aside such great and successful enterprise as the Kaptai Dam, the emergence of Chittagong as a major port, the Chandraghona Paper Mill, the Fenchuganj Fertilizer complex, and the first Steel Mill  to be built anywhere in Pakistan –all the result of the central government’s initiative –there has been a notable increase in small private industry.” – (Williams, L.F. Rushbrook; 1972)।অনুবাদঃ “স্বাধীন পাকিস্তান সৃষ্টির সিকি শতাব্দির মধ্যে অর্থনৈতিক ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানে যে অগ্রগতি সাধীত হয় তা দেশটির দীর্ঘ ইতিহাসে আর কোন কালেই অর্জিত হয়নি।কাপ্তাই বাঁধ,চট্টগ্রাম বন্দরের ন্যায় বৃহৎ বন্দর,চন্দ্রঘনা পেপার মিলস,ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা,পাকিস্তানের সর্বপ্রথম স্টিল মিলসের ন্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের নেয়া সফল উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ছাড়াও বেসরকারি মালিকানায় ছোট শিল্প গড়ে উঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযো্গ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়।”

১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের মূল এজেন্ডা ছিল নির্মম শোষন।সে শোষনের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা,শিল্প,কৃষি ও প্রশাসনিক দুরাবস্থাটি ছিল করুণ। স্বাধীন পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ প্রদেশ রূপে ১৯৪৭’য়ে যাত্রা শুরু হয় সামান্য কয়েকটি ডিগ্রী কলেজ এবং ১৯২১ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত একটি মাত্র ক্ষুদ্র বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে।তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সীমিত ছিল কার্জন হলের আশপাশ নিয়ে।কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হয়।সে সাথে বিশাল দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায় রাজশাহী ও চট্টগ্রামে। সে সাথে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা পায় বৃহৎ আকারের প্রকৌশল বিদ্যালয় এবং ময়মনসিংহে স্থাপিত হয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।লক্ষণীয় হলো,সে মাপের বৃহৎ কোন বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭১’য়ের পর আজ  অবধি কোথাও প্রতিষ্ঠা পায়নি।সে সাথে প্রতি জেলায় প্রতিষ্ঠা পায় বড় বড় ডিগ্রী কলেজ। স্থাপিত হয় বিশাল আকারের অনেকগুলি মেডিক্যাল কলেজ,ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ক্যাডেট কলেজ। জেলায় জেলায় প্রতিষ্টিত হয় বিশাল বিশাল জেলা স্কুল।থানা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পাইলট স্কুল।দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় অনেকগুলি মডেল স্কুল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিগত ৪৪ বছর পরও সে মাপের কোন মেডিক্যাল কলেজ,ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ,ক্যাডেট কলেজ, জেলা স্কুল, মডেল স্কুল, পাইলট স্কুল দেশের কোথাও কি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? ১৯৪৭ সালে দেশে কোন শিল্প এলাকা ছিল না। অথচ পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠা পায় টঙ্গি,নারায়নগঞ্জ,ডেমরা,খুলনা ও চট্টগ্রামে বিশাল বিশাল শিল্প এলাকা। অথচ শেখ মুজিব সে পাকিস্তানী আমলকে কটাক্ষ করে প্রশ্ন তুলেছেন,“সোনার বাংলা শ্মশান কেন?”  সম্ভবতঃ তার কাছে সোনার বাংলা ছিল,১৯৪৭ পূর্বের পরাধীন ব্রিটিশ আমল অথবা তার নিজ আমলের তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির বাংলাদেশ!শেখ মুজিব সবাইকে ধোকা দিলেও ধোকা দেননি একমাত্র ভারতকে। ভারত যা চেয়েছে তিনি তাই দিয়েছেন। নিজের দেশে দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেলে কি হবে,ভারতের হাতে দেশের অর্থনীতির বাজার তুলে দিতে ভূলেননি।সীমান্ত বানিজ্যের নামে বিলুপ্ত করেন অর্থনৈতিক সীমান্ত।এভাবে ভারতের হাতে তুলে দেন অবাধ লুন্ঠনের অধিকার।তাতে লক্ষ লক্ষ টন খাদ্য শস্য ভারতে পাচার হয়ে যায়। বাংলাদেশের বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দিলেও বাংলাদেশের তিন বিঘা জমি ভারতের হাত থেকে মুক্ত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। এমন কি অনুমতি দিয়েছেন ফারাক্কা বাঁধের উজানে পদ্মার পানি তুলে নেয়ার।

 

বিপদ বুঝতেন বহু আওয়ামী নেতাকর্মীও

এমন কি আাওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকে পাকিস্তান ভাঙ্গার বিপদটি বুঝতেন। বুঝতেন,আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতা জনাব সোহরাওয়ার্দী। জনাব সোহরাওয়ার্দী বেড়ে উঠেছিলেন কলকাতায়। হিন্দুদের  মুসলিম বিদ্বেষ নিয়ে তার কোন অজ্ঞতা বা অস্পষ্টতা ছিল না। তিনি বুঝতেন,পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ট নাগরিক রূপে বাঙালী মুসলিমের বিশ্বব্যাপী যে মর্যাদা ও গুরুত্ব -সেটি সে দেশ থেকে বেরিয়ে আসলে থাকবে না। তখন শত শত বছরের জন্য ভারতের পদতলে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। তখন সে অধিকৃত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথও থাকবে না। তাই জনাব সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতার ধারণাকে কোন সময়ই প্রশ্রয় দেননি। অথচ বিচ্ছিন্ন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সে সুযোগ ১৯৪৭’সালেই এসেছিল। বরং যখন তিনি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী,বিচ্ছিন্নতা এড়াতে তিনিই ব্রিটিশ আমলে মুসলিম লীগের দিল্লি মিটিংয়ে লাহোর প্রস্তাবে সংশোধন এনে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান ভূক্তির প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনামলে জনাব সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল দেশে পার্লামেন্টারী ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। সে লক্ষ্যে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী শিবিরের সবাইকে নিয়ে সম্মিলিত জোট গড়ে তোলেন।

জনাব সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বাসটি প্রবল ছিল আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীরও।সোহরাওয়ার্দীর আমলে আওয়ামী লীগের দলীয় পত্রিকা ছিল দৈনিক ইত্তেফাক।পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন সম্পাদক জনাব তোফাজ্জেল হোসেন (মানিক মিয়া)’র ধারণাটি কীরূপ ছিল -সেটিও দেখা যাক। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে ষাটের দশকের শুরুতে কিছু বাঙালী অর্থনীতিবিদ পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্য দুই পৃথক অর্থনীতির কথা বলা শুরু করে।কেউ কেউ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার কথাও বলে। প্রেসেডেন্ট আইয়ুবের কানে সে সব কথা পৌঁছলে তিনি এক মিটিং বাঙালী রাজনীতিবিদ,সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রস্তাব রাখেন,“If they were serious, there is no need to quarrel, hurl accusations and hurt each other. He offered to sit with them like brothers, and in a spirit of goodwill and understanding separate. The answer was “Never! Never! We do not even dream of it.”  Tuffazul Hussain (Manik Miah) the editor of Ittefaq said: “Mr President, our differences are with your government, not against our country. I want to assure you that as long as my generation has any influence left on our people nothing will hurt the unity of Pakistan. What will happen after we are gone is what worries us above everything else. On several occasions we have been secretly offered weapons by two superpowers. But we have always replied to them that whatever our internal differences may be we will not tolerate interference from any outside power. We know that these superpowers are all the time at each other’s throats but they are agreed on dividing Pakistan into two.” –(Gauhar, A; 1993 and also mentioned in Munir,M;1979). অনুবাদঃ “যদি তারা বিষয়টি নিয়ে সত্য সত্যই সিরিয়াস হয়ে থাকে,তবে ঝগড়া বিবাদ ও একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ ও আঘাত আনার প্রয়োজন নাই।তিনি প্রস্তাব রাখেন,আসুন আমরা ভাতৃসুলভ পরিবেশে বসি।পারস্পারীক সদিচ্ছা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আসুন পৃথক হয়ে যাই। উত্তর এলো,কখনোই নয়!কখনোই নয়!আমরা তা নিয়ে কখনো কল্পনাও করি না।ইত্তেফাকের সম্পাদক জনাব তোফাজ্জেল হোসেন (মানিক মিয়া)বল্লেন,জনাব প্রেসিডেন্ট!আমাদের মতভেদটি আপনার সরকারের সাথে,আমাদের দেশের বিরুদ্ধে নয়।আপনাকে আমি নিশ্চিয়তা দিতে পারি,যতদিন (পূর্ব পাকিস্তানের) জনগণের উপর আমার প্রজন্মের লোকদের প্রভাব বাঁকি থাকবে ততদিন কোন শক্তিই পাকিস্তানের সংহতির উপর আঘাত হানতে পারবে না।সবকিছুর উর্দ্ধে আমাদের দুশ্চিন্তা হলো,আমাদের চলে যাওয়ার পর কি ঘটবে তা নিয়ে।অতীতে কয়েকবার এমন হয়েছে,দুই বৃহৎ শক্তির পক্ষ থেকে আমাদেরকে গোপনে অস্ত্র দেয়ার প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল।আমরা সব সময়ই তাদেরকে জবাব দিয়েছি,আমাদের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ যাই থাক,আমরা বাইরের কোন হস্তক্ষেপ বরদাশত করবো না।আমি জানি এই বৃহৎ শক্তিগুলি একে অপরের গলা কাটতে চায়।কিন্তু পাকিস্তানকে দুই টুকরোয় বিভক্ত করার ক্ষেত্রে তারা একমত।” জনাব মানিক মিয়া ইন্তেকাল করেছেন। লক্ষ্যণীয় হলো,তাঁর মত ব্যক্তিদের জীবিত থাকা কালে আওয়ামী লীগের উপর শেখ মুজিবের বিচ্ছিন্নতাবাদি ধারণা বিজয়ী হতে পারেনি। সেটি মুজিব ও ভারতীয় গুপ্তচরদের মাঝে স্রেফ গোপন ষড়যন্ত্রের পর্যায়েই থেকেছে।

তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া যে প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে কথা বলেছেন তা কি আওয়ামী লীগের ইসলামী চেতনাশূণ্য সেক্যুলারিস্টদের মাঝে ছিল? অথচ ১৯৭১’য়ে সে সেক্যুলারিস্টদের হাতেই হাইজ্যাক হয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি।এমন কি একাত্তরের মে’ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদকীয় লিখেছিল,“ভাঙ্গাতে বাহাদুরি নাই,গড়াতেই বাহাদুরি”।বুঝাতে চেয়েছেন,শত্রুদেশের সাহায্য নিয়ে ১১ শত মাইলের দূরত্বে বিভক্ত পাকিস্তানকে ভাঙ্গার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নাই,কোন গর্বও নাই। বরং বাহাদুরি হলো,শত্রুর রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ দেশটিকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যে। বৃহৎ শক্তিবর্গ যে ইসলাম ও মুসলিমের দুষমন সেটি মানিক মিয়া বুঝেছিলেন। এবং সেটি বুঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। কারণ,ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের অপরাধের তালিকাটি তো বিশাল।শুধু মানিক মিয়া নয়,যে কোন কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মুসলিমের কাছেই তাদের এজেন্ডাটি অজানা থাকার কথা নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সকল পশ্চিমাশক্তি একমতে পৌঁছে যে,মুসলিম শক্তির পুণরুত্থান রুখতে মুসলিম বিশ্বকে খণ্ডিত করতে হবে এবং খণ্ডিত মুসলিম বিশ্বের বুকে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা দিতে হবে।তাতে সহজ হবে মুসলিম সম্পদের অবাধ লুণ্ঠনও। আরব ভূখণ্ড সে পরিকল্পনা অনুসারে আজ ২২ টুকরোয় বিভক্ত এবং খণ্ডিত দেশগুলোর উপর বসানো হয়েছে তাদের প্রতি নতজানু পুতুল সরকার। বৃহৎ শক্তিবর্গ এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের দায়িত্ব হয়েছে এসব পুতুল সরকারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা এবং খণ্ডিত মানচিত্রকে স্থায়ীত্ব দেয়া।তাই ফিলিস্তিন,কাশ্মীর,আফগানিস্তান অধিকৃত হলে জাতিসংঘ ও তার কোন সদস্য রাষ্ট্র এগিয়ে আসে না।অথচ কুয়েতে সরকার উৎখাত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,গ্রেট ব্রিটেন,ফ্রান্সসহ সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুদ্ধ শুরু করে।ইসরাইল লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনীদের পৈতীক ভিটা থেকে উচ্ছেদ করেছে এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনীদের হত্যা করেছে –কিন্তু সে অপরাধে ইসরাইলকে কোন শাস্তিও দেয়া হয়নি। শাস্তি দুরে থাক,জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব পাশ করানোও আজ অবধি সম্ভব হয়নি।ফিলিস্তিনীদের নিজ ভূমিতে শান্তিতে বসবাস করতে না দেয়াই তাদের নীতি।রাশিয়া যখন ২০০০ সালে চেচনিয়ার মুসলিম ভূমিতে আগ্রাসন চালায় এবং রাজধানী গ্রজনীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে,তখন রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,ইংলান্ড,ফ্রান্সসহ সকল পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলি শুধু যে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে -তা নয়;নিজদেশে উষ্ণ আলিঙ্গনে অভ্যর্থনাও জানিয়েছে।চেচেন মুসলিমদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সন্ত্রাস বলা হয়েছে।অপর দিকে তারা বিপুল অর্থ ও অস্ত্র জুগিয়েছে সূদানের খৃষ্টানদের বিচ্ছিন্নতার যুদ্ধকে বিজয়ী করতে।কাশ্মীরী মুসলিমদের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানোকে তারা সন্ত্রাসের সমর্থণ বলছে,অথচ একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরের ভারতের যুদ্ধকে তারা সেভাবে নিন্দা করেনি।এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,ইংলান্ড,ফ্রান্স ও রাশিয়ার বিমানবাহিনী সম্মিলিত ভাবে ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছে সিরিয়া ও ইরাকে। সিরিয়া ও ইরাকের ন্যায় মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রভূমির উপর যত বোমা-বর্ষণ করা হয়েছে,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে গ্রেট বিট্রেন,জার্মানী, জাপান বা বিশ্বের অন্য কোন দেশের উপর তা বর্ষিত হয়নি।

 

ষড়যন্ত্রের রাজনীতি

ইরাকের বুকে শিয়া,সূন্নি ও কুর্দি জনগণ ১৪শত বছর যাবত শান্তিতে একত্রে বসবাস করেছে।ধর্মীয় ফেরকার নামে মুসলিম সভ্যতার এ লালন ভূমিকে খণ্ডিত করার চিন্তা কখনোই তাদের মাথোয় আসেনি। কিন্তু ২০০৩ সালে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে অধিকৃত হওয়ার পর সেরূপ শান্তিপূর্ণ বসবাসকে অসম্ভব করা হয়েছে।মুসলিম ভূমিতে তাদের মূল এজেন্ডা তো এটিই। মুসলিমদের মাঝে পারস্পারীক ঘৃণা ও সংঘাত বাড়াতে তারা প্রতিষ্ঠা দিয়েছে গণহত্যা ও নির্মূলের রাজনীতি।ইরাক অধিকৃত করার পর পরই মার্কিনীগণ সূন্নীদের হত্যায় ও তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংসে শিয়াদের হাতে বিপুল পরিমান অস্ত্র তুলে দেয়। অস্ত্র দেয় কুর্দিদেরও। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ এভাবে মুসলিম দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বদলে গণহত্যা বাড়িয়েছে। ইরাককে তিন টুকরায় বিভক্ত করার কাজে এখন দলিল রূপে খাড়া করছে নিজেদের সৃষ্ট সে ঘৃণা ও সংঘাতকে। তারা বিভক্ত করতে চায় সিরিয়াকেও। এভাবে মুসলিম ভূগোলকে খণ্ডিত করাই ইসলামের শত্রুশক্তির স্ট্রাটেজী। তাতে যেমন লুণ্ঠনের কাজটি সহজ হয়,তেমনি ইসরাইলের নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পায়। মুসলিম উম্মাহকে শক্তিহীন করার এর চেয়ে সফল কৌশল আর কি হতে পারে? এরাই ১৯৪৭’য়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় খুশি ছিল না। দেশটি বেঁচে থাকুক -তাতেও তারা রাজি ছিল না।তাই প্রচণ্ড খুশি হয়েছে একাত্তরে দেশটির বিভক্তিতে।কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণ বিগত ৬৮ বছর ধরে স্বাধীনতার লড়াই লড়ছে; সে স্বাধীনতা রুখতে সেখানে অবস্থান নিয়েছে ৬ লাখের বেশী ভারতীয় সৈন্য। ইতিমধ্যেই এক লাখের বেশী কাশ্মীরীকে তারা হত্যা করেছে এবং সেখানে ধর্ষিতা হয়েছে বহুহাজার কাশ্মীরী রমনী।এমন একটি আগ্রাসী দেশ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ায় আগ্রহ দেখাবে -সেটি কি কোন সুস্থ মানুষ বিশ্বাস করতে পারে? বাংলাদেশ আরেকটি অধিকৃত কাশ্মীরে পরিণত হোক –সেটিই তো ভারতের লক্ষ্য। বাংলাদেশকে সেরূপ একটি কাশ্মীরে পরিণত করায় মুজিব ও তার অনুসারিদের অবদান কি কম? ভারতীয় হিন্দুগণ কি তাই মুজিবকে ভূলতে পারে? শেখ মুজিব বাংলার মাটিতে যতই ঘৃণীত হোক,এই একটি মাত্র কারণে ভারতীয়গণ তাকে হাজার হাজার বছর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। বাংলাদেশীদের জন্য নির্মম স্বৈরাচার,ভয়ানক দুর্ভিক্ষ ও লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু উপহার দিলে কি হবে,তিনিই আনন্দ বাড়িয়েছেন ভারতীয়দের। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর এতো আনন্দ ভারতীয় হিন্দুগণ আর কোন কালেই পায়নি।

পাকিস্তান ভাঙ্গার ব্পিদটি শেখ মুজিব না বুঝলেও দলটির বহু নেতাকর্মী বুঝতেন। অনেকে এমন কি ৬ দফাকেও ক্ষতিকর ভাবতেন। তাই শেখ মুজিব যখন ৬ দফা পেশ করেন,তখন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন ১৭টি জেলার মধ্যে ১৪টি জেলার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দল ছেড়ে চলে যান।সেটি তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুর রাজ্জাক। (মেঘনা,৪ঠা ফেব্রেয়ারি,১৯৮৭)।নিজ দলের নেতাকর্মীদের মনের সে অবস্থাটি শেখ মুজিবও জানতেন। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা নিয়ে তিনি এমন কি নিজ দলের নেতাকর্মীদের সাথেও প্রকাশ্যে কথা বলেননি। তাকে এগুতে হয়েছে গোপন পথে। কায়েদে আযম মুহাম্মদ জিন্নাহর রাজনীতি থেকে মুজিবের রাজনীতির এখানেই মূল পার্থক্য।পাকিস্তান প্রস্তাবটি লাহোরের মিন্টো পার্কের মুসলিম লীগের জনসভায় পেশ করেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক। সে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিতে সেদিন গৃহীত হয়।এরপর ১৯৪০-৪৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে প্রকাশ্যে আন্দোলন হয়েছে। গণভোটও হয়েছে।“পাকিস্তান” বলতে কি বুঝায় সেটি যেমন ভারতীয় কংগ্রেসের নেতাগণ বুঝতে ভূল করেনি,তেমনি ব্রিটিশ সরকারের মাঝেও তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল না। কিন্তু মুজিব কখনো সে ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের বিষয়কে জনগণের সামনে তুলে ধরেননি।জনগণের মতামতও নেননি। অথচ সেটিকে গোপন রেখে তা নিয়ে বছরের পর বছর কাজ করেছেন ভারতীয়দের গুপ্তচরদের সাথে নিয়ে।যে কোন দেশেই এমন রাজনীতিকেই বলা হয় ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।সেটিই ছিল মুজিবের রাজনীতি।বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে বাংলাদেশে আজ  যে বিতর্ক,সেটি একাত্তরের পূর্বেই শেষ হওয়া উচিত ছিল।সেরূপ বিতর্ক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১৯৪৭’য়ের আগেই সমাপ্ত করা হয়েছিল।কিন্তু ষড়যন্ত্রের গোপন রাজনীতিতে সেটি হয় না। ফলে বিলুপ্তির বদলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিতর্ক ও সংঘাত দিন দিন আরো তীব্রতর ও রক্তাত্ব হচ্ছে।

 

বাঙালী মুসলিমের স্বপ্নভগ্ন

পাকিস্তানের সৃষ্টিতে ভারতের অন্যান্য মুসলিমের স্বপ্ন যাই হোক,বাংলার মুসলিমের স্বপ্নটি ছিল বিশাল। সমগ্র ভারতের মাঝে বাংলাই ছিল মুসলিম লীগের মূল দুর্গ। অন্যদের তুলনায় বাঙালী মুসলিমের অবদানটিও ছিল সর্বাধিক।সেটি যেমন ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম দানে,তেমনি ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট কলকাতায় রাস্তায় হিন্দু গুণ্ডাদের হাতে হাজার হাজার মুসলিমের রক্তদানে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজপথের এরূপ চুড়ান্ত রাজনৈতিক যুদ্ধটি ভারতের অন্য কোন প্রদেশে হয়নি।কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর অকাঠ্য যুক্তিতর্ক ব্যর্থ হয় তাদের উপর প্রভাব ফেলতে।অবশেষে যু্ক্তিতর্কের রাজনীতিতে হতাশ হয়ে জিন্নাহ ঘোষণা দেন,এখন লড়াই করেই আমাদের পাকিস্তান নিতে হবে। জিন্নাহর বক্তব্যটি ছিল সুস্পষ্ট।পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না পেলে উপমহাদেশের মুসলিমদের পিষ্ট হতে হবে হিন্দুদের পদতলে –তা নিয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মনে কোন সংশয় ছিল না। ইংরেজের গোলামী শেষ হওয়া মাত্রই তাদের জীবনে শুরু হবে আরেক নৃশংস গোলামী -যা সহজে শেষ হবার নয়।পরিস্থিতির এ মূল্যায়নটি শুধু জিন্নাহর একার ছিল না,ছিল অধিকাংশ ভারতীয় মুসলিমের।তাদের কাছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াইটি গণ্য হয় বাঁচামরার লড়াই রূপে।“লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” তখন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের মুখে জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়। সে লড়াইকে চুড়ান্ত পর্যায়ে নিতে কায়েদে আযম ঘোষিত ১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্টের “ডাইরেক্ট এ্যাকশন” দিবসটি মুসলিম লীগের দুর্গ বাংলায় যতটা কঠোর ভাবে পালিত হয় সেরূপ ভারতের আর কোথাও পালিত হয়নি। হিন্দু গুণ্ডাদের হাতে কলকাতার রাজপথে পাঁচ থেকে সাত হাজার বাঙালী মুসলিমের প্রাণ দানে ভারতীয় রাজনীতি প্রচণ্ড ভূমিকম্প শুরু হয়। তাতে সহসাই পাল্টে যায় ভারতের মানচিত্র;এবং প্রতিষ্ঠা পায় পাকিস্তান।

কিন্তু বাঙালী মুসলিমের ১৯৪৭’য়ের স্বপ্নটি বাঁচেনি;সেটির মৃত্যুও ঘটে বাংলার বুকেই।সেটি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে। যে পাকিস্তানকে বাঙালী মুসলিমগণ রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল,সে পাকিস্তানকেই তারা পাকিস্তানের আজন্ম শত্রু ভারতকে সাথে নিয়ে পরাজিত করে। ফলে ১৯৪৬’য়ের ১৬ই আগষ্ট যে ইতিহাস নির্মিত হয়েছিল কলকাতায়,তারই বিপরীত ইতিহাস নির্মিত হলো ঢাকায়।সেটি ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায়। পাকিস্তানের অবাঙালী সৈনিকেরা হয়তো কোনদিন ভাবতেই পারিনি পাকিস্তান বাঁচানোর যুদ্ধটি তাদের করতে হবে দেশটির জন্মভূমি বাংলার বুকে। কংগ্রেসী গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে একসময় মুজিবও কলকাতার রাজপথে ছিলেন সেটি ইয়াহিয়ারও অজানা ছিল না।সম্ভবত এ কারণেই ইয়াহিয়া খান বিশ্বাস করেছিলেন,মুজিব আর যাই হোক পাকিস্তান ভাঙ্গবে না। মুজিব যে পাকিস্তান ভাঙ্গতে চায় তা নিয়ে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দাদের কাছ ছিল তার ধারণকৃত ক্যাসেট। কিন্তু মুজিবকে ইয়াহিয়া এতটাই বিশ্বাস করেছিল যে মুজিবের বক্তব্যের সে গোপন ক্যাসেটও ইয়াহিয়ার বিশ্বাসকে হেলাতে পারিনি।এ জন্যই ১৯৭১’য়ের রণাঙ্গনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধপ্রস্তুতি ছিল না।একাত্তরের মার্চে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ১৪ হাজার সৈন্যের উপস্থিতিই সেটি প্রমাণ করে। ফলে একাত্তরে অখণ্ড পাকিস্তানের মানচিত্র তার নিজ জন্মভূমি পূর্ব পাকিস্তানেই বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু খণ্ডিত পাকিস্তানটি যে এখনও মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র রূপে পশ্চিম পাকিস্তানে বেঁচে আছে -হয়তো তাতেই পাকিস্তানের দাবী নিয়ে ১৯৪৬’য়ের ১৬ই আগষ্ট কলকাতার রাজপথে হাজার হাজার বাঙালী মুসলিমের প্রাণদানের বড় স্বার্থকতা। ফলে বলা যায়,তাদের রক্তদান পুরাপুরি বৃথা যায়নি।

 

বেঁচে থাকবে একাত্তর

বাঙালী মুসলিম ইতিহাসে উনিশ শ’ একাত্তর অবশ্যই বেঁচে থাকবে।বেঁচে থাকবে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে।জ্ঞানবান মানুষেরা শুধু বিজয় থেকেই শিক্ষা নেয় না,সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি নেয় পরাজয় থেকে।পরাজয়ের মাঝেই তারা আগামী দিনের জন্য বিজয়ের সন্ধান পায়।ইতিহাসের পাঠ এজন্যই তো মানব জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।একাত্তরে বিশাল বিজয় এসেছিল ইসলামী চেতনাশূণ্য সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের জীবনে।এবং পরাজয় এসেছিল ইসলামের পক্ষের শক্তির। সেদিন পৌত্তলিক ভারতের বিশাল বাহিনী ও তাদের আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের সামনে পাকিস্তানের একার পক্ষে দাঁড়ানোর সামর্থ্য ছিল না।আজকের মত সেদিন দেশটির হাতে আনবিক বোমাও ছিল না।তাছাড়া এমন একটি যুদ্ধের প্রস্ততি ভারত স্রেফ একাত্তরে নেয়নি,নিয়েছিল বহু বছর আগে থেকে। তাছাড়া রণাঙ্গণে ভারতীয় বাহিনী একাকী ছিল না।তাদের পাশে ছিল যেমন সোভিয়েত রাশিয়া,তেমনি ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের বিশাল ট্রোজেন হর্স বাহিনী। ফলে ঘনিয়ে আসে পাকিস্তানের পরাজয়।এবং বিজয়ী হয় শেখ মুজিব ও তার নাশকতার রাজনীতি।

পশ্চিম পাকিস্তানীরা একাত্তরের পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়েছে।তারা সেদিন বুঝেছিল,সামরিক শক্তির বিকল্প একমাত্র সামরিক শক্তিই। রাজনীতি দিয়ে সেটির মোকাবেলা করা যায় না। স্রেফ জনশক্তি,শিক্ষাউন্নয়ন,কৃষিউন্নয়ন বা শিল্পউন্নয়ন দিয়ে স্বাধীনতা বাঁচানো যায় না। এজন্য বিপুল অর্থ,শ্রম,মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ চাই। একাত্তরের সে শিক্ষাকে সামনে রেখে বিশ্বের তাবৎ শক্তির চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে তারা গড়ে তুলেছে পারমানবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার। গড়ে তুলেছে যুদ্ধ বিমান,মিজাইল ও  ট্যাংক উৎপাদনের নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রী। ফলে পাকিস্তানে আর দ্বিতীয় বার একাত্তর আসেনি। তারা বদলা নিয়েছে একাত্তরের শত্রু সোভিয়েত রাশিয়া থেকেও। দেশটিকে আফগানিস্তানের মাটিতে পরাজিত করে ইতিহাস থেকেই বিলুপ্ত করে দিয়েছে। তাতে জন্ম নিয়েছে মধ্য এশিয়ার বুকে ৬টি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। তাছাড়া এ শিক্ষাটি তো মহান নবীজী (সাঃ)’রও। নবীজী (সাঃ) জানতেন,স্রেফ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে ও কোরআনের জ্ঞান বাড়িয়ে ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা দেয়া যাবে না,তেমনি বাঁচানোও যাবে না।এবং সে পথে বিজয়ী রাখা যাবে না ইসলামকেও। তাই সমগ্র মানব ইতিহাসেও ইসলামের সর্বশেষ নবীই একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি তাঁর প্রতিটি সাহাবাকে সশস্ত্র সৈনিকে পরিণত করেছিলেন। নবীজী (সাঃ)’র কোন সাহাবী ছিল না যিনি রণাঙ্গনে প্রাণদানের প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে হাজির হননি। তাঁর সে প্রজ্ঞাময় নীতির ফলে অতি স্বল্প সময়ের মাঝে সবচেয়ে শক্তশালী বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিম উম্মাহর উদ্ভব হয়।

প্রশ্ন হলো,একাত্তর থেকে বাংলাদেশীদের শিক্ষাটি কি? সেটি কি একাত্তরের চেতনার নামে ভারতের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের দায়বদ্ধতা? সেটি কি সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক ও আদর্শিক সীমান্ত বিলুপ্তি? আত্মসমর্পণের সে দায়বদ্ধতায় মুজিব ভারতের সাথে ২৫ সালা দাসচুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন;এবং বাংলাদেশীদের গলায় পড়িয়েছিলেন গোলামীর শিকল। অথচ ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভে কারো প্রতি আত্মসমর্পণের দায়বদ্ধতা ছিল না। কারো সাথে দাসচুক্তিও স্বাক্ষর করতে হয়নি। কোন বাঘকে দীর্ঘ ২৫টি বছর খাঁচায় বন্দী রেখে ছেড়ে দিলে সে বাঘ আর খাঁচা থেকে বেরুতে চায় না।স্বাধীন ভাবে বাঁচা ও শিকার ধরায় তার আর কোন আগ্রহ থাকে না। স্বেচ্ছায় খাঁচার জীবন বেছে নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ২৫ সালা দাসচুক্তির এটিই হলো সবচেয়ে বড় নাশকতা। একাত্তরের যুদ্ধের ন্যায় ভারত এক্ষেত্রেও বিজয়ী হয়েছে। ফলে ভারতের প্রতি আত্মসমর্পণের চরিত্রগত স্বভাবটি এখন আর শুধু আওয়ামী লীগের একার নয়। সেটি এখন অন্যদেরও স্বভাবে পরিণত হয়েছে। ফলে গুজরাতের খুনি নরেন্দ্র মোদী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয় তখন তাকে শুধু আওয়ামী লীগই অভিনন্দন জানায় না,অন্যরাও জানায়। নিজ ধর্ম এবং নিজ বিশ্বাস নিয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচার খরচটি বিশাল। শুধু সরকারকে রাজস্ব দিলে,কিছু সৈন্য পাললে ও সৈন্যদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেই সে স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় না।স্রেফ দোয়া-দরুদ পাঠেও সে স্বাধীনতা বাঁচে না। অর্থদান, শ্রমদান ও মেধাদানের পাশাপাশি দেশবাসীকে সেজন্য প্রাণদানেও প্রস্তুত থাকতে হয়।এ দায়ভার প্রতিটি নাগরিকের। ইসলামে এটি পবিত্র জিহাদ।এমন জিহাদে প্রাণ দিলে মহান আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করেন। কিন্তু যে দেশে জিহাদ দূরে থাক, জিহাদ বিষয়ক বই নিষিদ্ধ করা হয় সে মুসলিম দেশের কি স্বাধীনতা বাঁচে?

একাত্তরে সাতচল্লিশের অখণ্ড পাকিস্তানের পরাজয়টি বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের জীবনে গণ্য হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন রূপে।সে অর্জন নিয়ে বাংলাদেশীদের জীবনে প্রতি বছর সবচেয়ে বড় উৎসবটি হয়। এ উৎসবে তারা একা নয়।একই দিনে বিশাল উৎসব হয় নয়াদিল্লির শাসক মহলেও। তবে ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয়ের বড় আনন্দটি মূলত ভারতীয় হিন্দুদের। মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে আর কোন কালেই পৌত্তলিক কাফেরগণ আনন্দের এতো খোরাক মুসলিম জনগণের হাতের কামাই থেকে পায়নি।তাদের এমন বিজয় অতীতে কোন মুসলিম ভূমিতেও অর্জিত হয়নি। মুজিব ও তার অনুসারিদের প্রতি এজন্যই ভারতীয় হিন্দুগণ চিরকৃতজ্ঞ। মুসলিমের চলার পথটি সবসময়ই পবিত্র কোরআনে প্রদর্শিত সিরাতুল মুস্তাকিম বেয়ে। সেটি যেমন ধর্মকর্মের ক্ষেত্রে,তেমনি রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও। সে পথটি কখনোই সমাজের কাফের-মুশরিকদের রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির সাথে মিশে না। কারণ তাদের পথ তো দোয়াল্লীন তথা বিভ্রান্তদের পথ। যখন মিশে,তখন বুঝতে হবে নিজেদের পথটি সিরাতুল মোস্তাকীম নয়। প্রশ্ন হলো,১৪শত বছরের মুসলিম ইতিহাসে আর কোন কালেই কি মুসলিমদের রাজনীতির রোডম্যাপ পৌত্তলিক এজেন্ডার সাথে এরূপ একাত্ম হয়েছে? সেরূপ গর্হিত কান্ড ইহুদীদের ইতিহাসে একবার ঘটেছিল,সেটি খন্দকের যুদ্ধকালে। মদিনার ইহুদীগণ এক আল্লাহতে বিশ্বাসী হয়েও আরবের মুর্তিপুজারি মুশরিকদের সাথে জোট বেঁধেছিল লা-শরিক আল্লাহর ইবাদতকারি মুসলিমদের নির্মূলে। অথচ তারা জানতো,মুসলিমগণ ইহুদীদের আহলে কিতাব রূপে মান্য করে। তাদের কাছে হযরত মূসা (আঃ)একজন মহান রাসূল এবং পবিত্র কোরআনে তাঁর সম্পর্কে অতি প্রশংসনীয় বর্ণনা এসেছে। ইহুদী মেয়েদের তারা নিজ ঘরে বধু হিসাবে বরণ করে। তাছাড়া মদিনার ইহুদীদের নিরাপত্তা দিতে মুসলিমগণ চুক্তিবদ্ধও ছিল। ইহুদীর ইতিহাসে অতি গভীর বিচ্যুতি ও কলংকের ঘটনা যে,তারা মুসলিমদের নির্মূলে পৌত্তলিক মুশরিকদের সাথে জোট বেঁধেছিল।

মদিনার ইহুদীদের ন্যায় মুর্তিপুজারি মুশরিকদের সাথে নিয়ে মুসলিম দেশ ভাঙ্গা,মুসলিম হত্যা ও তাদের ঘরবাড়ী লুণ্ঠনের ন্যায় গর্হিত কর্ম ঘটেছে একাত্তরে,এবং সেটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ বাংলাতে। তবে ঘটনাটি শুধু মুসলিম দেশ ভাঙ্গা এবং বাঙালী ও অবাঙালী মুসলিমদের হত্যাতেই সীমিত থাকেনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশকে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলিতে পরিণত করা হয়েছে। চাপানো হয়েছে ভারতের চরণ তলে নতুন পরাধীনতা।এ পরাধীনতায় অসম্ভব হয়েছে পরিপূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। অসম্ভব হয়েছে বাংলার মুসলিম ভূমিতে ইসলামের বিজয় সাধন। বাঙালী মুসলিমের মনে ইসলামের প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকার বাড়াতে এবং সে লক্ষ্যে সংগঠিত হতে দিতেও ভারত রাজী নয়। কারণটি সহজ। ইসলামের বিজয় ও মুসলিমের শক্তিবৃদ্ধিকে ভারত নিজের জন্য বিপদ মনে করে।ভারত তাই একাত্তরের সামরিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের পর শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। একারণেই ভারতের আগ্রাসী হাত পড়েছে বাংলাদেশের স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচীতে।

প্রশ্ন হলো,এ অধীনতা কি সহজে শেষ হবার? ১৯৪৭’য়ে স্বাধীনতার যে ট্রেনটি নতুন ভবিষ্যতের পথে সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছিল তা এখন অতি গভীর খাদে।বস্তুত এরূপ গভীর খাদে পড়াটাই একাত্তরের অর্জন।সে খাদ থেকে উত্থানের কি সহজ রাস্তা আছে? উদ্ধার পেলেও কি নিজ লক্ষ্যে চলার স্বাধীনতা মিলবে? স্বাধীনতা এখন ভারতের হাতে শৃঙ্খলিত পরাধীনতা। মুসলিমের যাতে কল্যাণ হিন্দুর তাতে অকল্যাণ;এবং মুসলিমের যাতে অকল্যাণ তাতেই হিন্দুর কল্যাণ –এমন চেতনাটি কি বঙ্কিম চ্যাটার্জির একার? সেটি তো অধিকাংশ ভারতীয় বর্ণহিন্দুর।এমন চেতনার বিজয় এখন সমগ্র ভারত জুড়ে। হিন্দুর কল্যাণ বাড়াতে ভারতে তাই ঘন ঘন মুসলিম-নিধন হয়। সে বঙ্কিমী চেতনার প্রবল পুজারী নরেন্দ্র মোদী এখান ভারতের প্রধানমন্ত্রী।এমন কি রবীন্দ্রনাথের চেতনা কি তা থেকে ভিন্নতর বা উন্নত? রবীন্দ্রনাথ তার “প্রায়শ্চিত্ত” নাটকে প্রতাপাদিত্যের মুখ দিয়ে নিজের ভাবটি প্রকাশ করেছেন এ ভাষায়,“খুন করাটা যেখানে ধর্ম,সেখানে না করাটাই পাপ।যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।” এতে তো ভয়ংকর সন্ত্রাসের সুর।এমন সহিংস চেতনা নিয়ে কি কেউ কি মুসলিমের বন্ধু হতে পারে? এমন চেতনার কারণে ভারতীয় হিন্দুগণ কোন কালেই পাকিস্তানের বন্ধু হতে পারিনি।বন্ধু হতে পারিনি ভারতীয় মুসলিমদেরও। হিন্দুদের কল্যাণ বাড়াতে পাকিস্তানের জন্মও তারা চায়নি।একাত্তরে তারা যুদ্ধ নিয়ে হাজির হয়েছিল মূলত হিন্দুস্থানের কল্যাণ নিশ্চিত করতে, সেটি কখনোই বাঙালী মুসলিমের কল্যাণ বাড়াতে নয়।এটিই হলো একাত্তরের যুদ্ধর মূল কারণ। এমন হিন্দুরা কি বাংলাদেশের বন্ধু হতে পারে? একাত্তরে ভারতীয় বাহিনী লুণ্ঠনে নেমেছিল কি সে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে? এমন সহিংস চেতনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কলকাতায় মিছিলে নেমেছিলেন।অথচ সে রবীন্দ্রনাথের গান হলো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত!ব্রিটিশের লুণ্ঠনে ছিয়াত্তেরর মনন্তর এসেছিল।আর ভারতীয় লুণ্ঠন দিয়েছিল ১৯৭৩-৭৪’য়ের ভয়ানক দুর্ভিক্ষ।বিদেশীদের অধিকৃতি এভাবেই উপহার দিয়েছে বহুলক্ষ মানুষের মৃত্যু।অথচ ২৩ বছরের পাকিস্তানী আমলে বাঙালী মুসলিমের জীবনে এমন নৃশংসতা একটি বারও ঘটেনি।১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতার এ ছিল বড় নেয়ামত। ভারতের মত আগ্রাসী দেশের আঁচল ধরে জন্মলাভের কারণে বাংলাদেশ জন্মসূত্রেই পরাধীন।ব্রিটিশের হাতে পরাধীনতায় বাংলার নদ-নদী ও জলবায়ু স্বাধীনতা হারায়নি।কিন্তু ভারতের আগ্রাসী থাবা পড়েছে সেখানেও। নির্মম হামলা হচ্ছে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর। দেশ দ্রুত পরিণত হতে যাচ্ছে মরুভূমিতে।বাঙালী মুসলিমের জীবনে তাই আজ  ভয়াবহ বিপর্যয় এবং সর্বমুখী পরাধীনতা।বিপর্যয় ও পরাধীনতার এরূপ করুণ কাহিনী নিয়ে একাত্তরের ইতিহাস শুধু বাঙালী মুসলিম ইতিহাসে নয়,সমগ্র মুসলিম ইতিহাসেও বহু হাজার বছর বেঁচে থাকবে।

 

গ্রন্থপঞ্জি

Chowdhury, G.W; The Last Days of United Pakistan, London: C. Hurst & Company, 1974.

মানুজ বসু।বাংলার ডাক,লন্ডন:১৬ই জানুয়ারি,১৯৭৭।

আব্দুর রাজ্জাক।সাক্ষাতকার, সাপ্তাহিক মেঘনা; ঢাকা: ১৯৮৭, ৪ঠা জানুয়ারি।

Gauhar, A. Ayub Khan: Pakistan’s First Military Ruler. Lahore: 1993.

Williams, L.F. Rushbrook. The East Pakistan Tragedy, London: Tom Stacy Ltd, 1972.

একে খন্দকার।১৯৭১ ভেতরে বাইরে।ঢাকা:প্রথমা প্রকাশন,২০১৪।

Munir, M. From Jinnah to Zia.Lahore: 1979.

Niazi, Lt Gen A.A. K. The Betrayal of East Pakistan. Karachi: Oxford University Press, 2002.

Raghavan, Srinath. 1971: A global history of the creation of Bangladesh. London: Harvard University Press, 2013.

Jha to Kaol. Reporting Conversion of 16 April, Subject File 277, P.N.HAksar Papers (III Instalment), MMML, 18 April 1971. (Mentioned in Raghavan, Srinath. 1971)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *