শেখ হাসিনার চিরায়ত মিথ্যাচার: চোরের মায়ের বড় গলা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

গতকাল ২৮ মার্চ ঢাকায় RAB’য়ের ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে RAB কর্মকর্তাদের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কড়া নিন্দা করেছেন। তিনি মার্কিন সিদ্ধান্তের ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে তার বিস্ময়কর দারুন কথাটি হলো, তিন দাবী করেছেন সমগ্র বিশ্বের মাঝে বাংলাদেশই হলো একমাত্র দেশ যে দেশে সরকারি প্রশাসনের কেউ কোন অপরাধ করলে তার বিচার করা হয় এবং অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হয়। হাসিনার সে বক্তব্যটি প্রকাশিত হয়েছে ডেইলী স্টারের আজকের সংখ্যায়।

শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় আঙ্গুল তুলেছেন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই নয়, বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, আইনের শাসন ও সুষ্ঠ বিচারব্যবস্থা যেন একমাত্র বাংলাদেশেই বেঁচে আছে। এবং অন্য কোথাও সেটি বেঁচে নাই। অথচ কে না জানে, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা কবরে শায়ীত বহু আগে থেকে। তাই দেশ জুড়ে ভোট ডাকাতি হলেও তার বিচার হয়না। বিচারকগণ সে রায়ই দেয় যা সরকার চায়। সেরূপ রায় না দেয়াতে সরকারের এক কালের আজ্ঞাবাহী ঘনিষ্ঠ সহচর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে লাথি খেয়ে দেশ ছাড়া হতে হয়েছে –যা তিনি লিখেছেন তার নিজের লেখা বইতে।    

শেখ হাসিনার উপরুক্ত দাবীটি হলো তার শত শত মিথ্যাচারের ন্যায় আরেক বিরাট মিথ্যাচার। “চোরের মায়ের বড় গলা” -সেটি তিনি আবার প্রমাণ করলেন। তার সরকার যে চলছে মিথ্যচারের উপর -এ হলো তারই প্রমাণ। বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বি জি বি ও RAB’য়ের‌ কর্মচারীরা যে ভুরিভুরি গুরুতর অপরাধ করছে -সে প্রমাণ কি কম? তাদের হাতে নৃশংস গনহত্যা, শত শত নিরাপরাধ মানুষের উপর রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন এবং গুমের ঘটনা ঘটেছে। জেল-হাজতে থাকা অবস্থায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নির্যাতনের শিকার যে শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীগণ হচ্ছেন তা নয়, নির্যাতিত হচ্ছেন বহু নিরীহ আলেম, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। তাদের অপরাধ, তারা সরকারের সমালোচক।

বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ও নৃশংস অপরাধী সংগঠন কোন বেসরকারি চোর-ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের দল নয়। সেটি হলো সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি। কিন্তু দেশের আদালতে কখনোই সে সব সরকারি অপরাধীদের বিচার হয়না। এর কারণ, এসব ভয়ানক অপরাধীগণ দেশ ও দেশবাসীর শত্রু হলেও সরকারের শত্রু নয়। বরং তারা সুরক্ষা দেয় হাসিনার অবৈধ ভোটডাকাত সরকারকে। তাই তাদের শাস্তি না দেয়াই সরকারের নীতি। তাই শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় যা বলেছেন সেটি হলো প্রকৃত সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে রাতের অন্ধকারে RAB, বিজিবি ও সেনা বাহিনীর বহু হাজার সদস্য শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা ও আহত করলো। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা পরিবহনের গাড়িতে তুলে শহীদদের লাশগুলো গুম করা হলো। লাশগুলোকে পরিবার-পরিজনের কাছে ফেরত দেয়া হলো না। এটি রাষ্ট্রের হাতে সংগঠিত গুরুতর অপরাধ। বাংলার ইতিহাসে এরূপ নৃশংস পূর্বে কখনোই ঘটেনি।  কিন্তু সে অপরাধে কি একজনকেও শাস্তি দেওয়া হয়েছে? সে রক্তাত্ব ঘটনার কি কোন তদন্ত হয়েছে? কাউকে কি আদালতে তোলা হয়েছে? হয়নি।

রাজধানীর পিলখানাতে বহু ঘন্টা ধরে ৫৭ জন সেনাবাহিনীর সদস্যসহ বহু বেসামরিক ব্যক্তিকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হলো। লাশগুলোকে ড্রেন ফেলা হলো। দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এরূপ নৃশংস অপরাধ বিশ্বের আর কোন দেশেই ঘটেনি। কিন্তু সেটি ঘটেছে হাসিনার শাসনামলে। প্রশ্ন হলো, সে হত্যাকান্ড থামাতেই বা সরকার কি করেছে? সেনা বাহিনীকে নির্দেশ দিলে তারা এ হত্যাকান্ডা থামাতে পারতো। কিন্তু সেটি হতে দেয়া হয়নি। বরং অপরাধীদের বিরানী খাওয়ানো হয়েছে। সুষ্ঠ তদন্ত না হওয়ায় যারা ছিল এ অপরাধের মূল সংগঠক তারা পর্দার আড়ালেই থেকে গেল। তাদের কারোই কোন শাস্তি হলো না।  

বিশাল অংকের বিদেশী মূদ্রার রিজার্ভ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদেশে ডাকাতি হয়ে গেল। সে বিশাল অপরাধটিও কোন কৃষক, শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষের কাজ ছিল না, সেটির সাথে জড়িত ছিল সরকারি লোকজন। তাদের কি আদালতে তোলা হয়েছে? কারো কি কোন শাস্তি হয়েছে? লুট হয়ে গেল শেয়ার মার্কেট এবং বহু সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক। সে অপরাধের সাথে জড়িত ছিল প্রশাসনের লোকজন। তাদেরও কি আদালতে তোলা হয়েছে? একজনেরও কি শাস্তি হয়েছে। অপরাধী শাস্তি না দেয়াই যে সরকারের নীতি সেটি বুঝতে এরপরও কি কিছু বাকি থাকে?

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী সরকারি বাহিনীর হাতে ৬ শতের বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছে।‌ নিখোঁজ মানুষদের আপনজনেরা এখনো দুঃসহ বেদনা নিয়ে প্রতিটি প্রহর গুণছে। সরকার কি তাদেরকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছে? যারা নিখোঁজ হয়েছে তারা বিরোধী দলের। তারা স্বাধীন ভাবে কথা বলুক, আন্দোলন করুক ও বেঁচে থাকুক – সরকার সেটি চায়না। তাই সরকার নিজেই এই গুমের সাথে জড়িত। কারণ বিরোধীরা গুম বা খুন হলে লাভবান হয় সরকার। তাদের ঝামেলা কমে।

যে কোনো সভ্য সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের ভোটের অধিকারকে সুরক্ষা দেয়া। অথচ শেখ হাসিনার সরকার জনগণের ভোটের সুরক্ষা না দিয়ে তার উপর ডাকাতি করেছে। সরকারের ইচ্ছা নেই জনগণের ভোটকে ইজ্জত দেয়ার। তাই ২০১৮ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর দিনের ভোট রাতে ডাকাতি হয়ে যায়। যে কোন সভ্য দেশে ভোট ডাকাতিও ডাকাতির ন্যায় গুরুতর অপরাধ। সে ভোটডাকাতির সাথে জড়িত ছিল সরকারি কর্মচারীরা। কিন্তু সরকার কি সে অপরাধে প্রশাসনের কোন কর্মচারীকে আদালতে তুলেছে? কাউকে কি শাস্তি দিয়েছে? সত্য তো এটাই, কারোই আদালতে তোলা হয়নি এবং কারো কোন শাস্তিও হয়নি।

তাই হাসিনা কোন মুখে বলেন, সমগ্র দুনিয়ায় বাংলাদেশই হলো একমাত্র দেশ যে দেশে সরকারী কর্মচারী অপরাধ করলে তার শাস্তি হয়? এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কি হতে পারে? সে মিথ্যচারের আরেক নমুনা, ২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির নির্বাচনকে শেখ হাসিনা সুষ্ঠু নির্বাচন বলেন। ভোটডাকাতির সে নির্বাচনের মধ্যেই তিনি আজ ক্ষমতায়। সে ডাকাতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন খোদ শেখ হাসিনা। তাই অপরাধীর শাস্তি দেয়া সরকারের নীতি হলে সর্বপ্রথম শাস্তি হওয়া উচিত ছিল শেখ হাসিনা।

বরং বাস্তবতা হলো, সরকারকে বাঁচাতে কোন বিরোধী দলীয় নেতা কর্মীকে ঘুম বা খুন করলে তাকে পুরস্কৃত করাই হলো সরকারের নীতি। এবং এরূপ গুম ও খুনের সাথে জড়িত যেহেতু সেনাবাহিনী, পুলিশ ও RAB -এই তিনটি সংগঠনের লোকেরা, তারা শেখ হাসিনার প্রিয়ভাজন। শাস্তির বদলে তাই তাদেরকে সরকারি ভাবে পুরস্কৃত করা হয়। প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা কি তার এই নিরেট মিথ্যাকে কোন বিবেকমান মানুষকে গেলাতে পারবেন? ২৯/০৩/২০২২।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *