ভালো বইয়ের সংকট এবং বাঙালি মুসলিমের বুদ্ধিবৃত্তিক অপুষ্টি ও মানবিক গুণে বেড়ে উঠায় ব্যর্থতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 মানব যেভাবে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়

মানব জীবনের মূল সাফল্যটি শুধু সুস্থ দেহ নিয়ে বাঁচায় নয়, বরং সেটি সভ্য ও পরিশুদ্ধ মানব রূপে বাঁচায় ও বেড়ে উঠায়। কিন্তু সভ্য ও পরিশুদ্ধ মানব রূপে বেড়ে উঠার কাজটি পানাহারে হয় না। মানবিক পরিচয় লাভের জন্য অতি অপরিহার্য হলো পরিশুদ্ধ জ্ঞান। যার মধ্যে সে জ্ঞান নাই সে ব্যক্তি দেখতে মানবের মত হলেও আসলে পশুবৎ। এমন কি পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হতে পারে। তখন বিপন্ন হয় মানবিক গুণে বেড়ে উঠা। তখন পুরাপুরি ব্যর্থ হয় মহান আল্লাহতায়ালার মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যটি। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা এমন মানুষকে শুধু পশুই বলেন নাই, বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছেন। তাদের ব্যাপারে পবিত্র কুর’আনের মহান রাব্বুল আলামীনের বয়ানটি হলো: “উলায়েকা কা’আল আনয়াম, বালহুম আদাল।” অর্থ: তারাই হলো পশুবৎ বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। মহান আল্লাহতায়ালার এ উক্তিটি যে কতটা নিখূঁত ও নির্ভূল সে প্রমাণ কি কম? সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণহত্যা ও ইথনিক ক্লিনজিং –এরূপ মানববিধ্বংসী মতবাদ ও কর্মকান্ডগুলি পশুদের সৃষ্ট নয়, সেগুলি তো মানবসৃষ্ট। যুদ্ধ বাধিয়ে স্বজাতির কোটি কোটি প্রাণীকে হত্যা করা পশু সংস্কৃতি নয়, সেটিও মানব সংস্কৃতি। পশুরা ক্ষুধা না লাগলে শিকার ধরে না। কিন্তু এই মানবরূপী পশুরা গণহত্যা করে, ভরাপেট চুরি-ডাকাতি করে এবং হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে লুট করে।  

যে রাষ্ট্রে ওহীর জ্ঞানের চর্চা নেই সে রাষ্ট্রে মানব রূপে বেড়ে উঠার চেয়ে পশুর চেয়ে নিকৃষ্টতর হওয়ার আয়োজনটাই বেশী। তখন সে রাষ্ট্র জঙ্গলের চেয়েও নিরাপত্তাহীন এবং সন্ত্রাসপূর্ণ হয়। বাংলাদেশের মত দেশে এজন্যই যত মানুষ বনজঙ্গলে মারা যায় তারা চেয়ে হাজার গুণ বেশী মারা যায় রাজপথে ও লোকালয়ে। বনজঙ্গলের চেয়েও জনগণ বেশী লুন্ঠনের শিকার হয় নিজ গৃহে ও সরকারি অফিস-আদালতে। সবচেয়ে বড় লুন্ঠনকারী, সবচেয়ে নৃশংস অপরাধী এবং সর্বাধিক গুম-খুন-নির্যাতনের সংঘটক হলো দুর্বৃত্ত-অধিকৃত সরকার। আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্ঠি এই মানব এভাবে পশুর ন্যায় ইতর জীবে পরিণত হোক -সেটি মহান আল্লাহতায়ালার কাম্য নয়। তিনি তো তাদের দিয়ে জান্নাত পূর্ণ করতে চান। তাই তাদেরকে মানুষ রূপে বেড়ে উঠাটি নিশ্চিত করতে মহান আল্লাহতায়ালা শুধু নানা রূপ খাদ্য ও পানীয়’র ব্যবস্থাই করেননি, বরং জ্ঞানলাভেরও ব্যবস্থা করেছেন। এজন্যই নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ করার আগে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। এবং মানুষের কাছে জ্ঞান বিতরণের মাধ্যম রূপে বেছে নিয়েছেন বই। এবং সে বইকে মানুষের কাছে পৌঁছানোর কাজে নিয়োজিত করেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা জিবরাইল (আ:) এবং শ্রেষ্ঠ রাসূলকে। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সে সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাবটি হলো পবিত্র কুর’আন। সমগ্র মানব ইতিহাসে এটাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ বই। তবে পবিত্র কুর’আনই মহান আল্লাহতায়ালার একমাত্র কিতাব নয়, কুর’আন প্রেরণের আগে তিনি তাওরাত, জব্বুর, ইঞ্জিল পাঠিয়েছেন। এই বইগুলির মাধ্যমেই মানব জাতি মহান আল্লাহতায়ালার পথনির্দেশনা পেয়েছে এবং বেড়ে উঠেছে মহামানব রূপে। খাদ্য তো পশুপাখি, গাছপালা ও কীটপতঙ্গের ন্যায় ইতর জীবেরাও পায়। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত হলো এই পবিত্র বই তথা আল কুর’আন। এ নেয়ামত ছাড়া সত্যপথ পাওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব হলো প্রকৃত মানব রূপে বেড়ে উঠা। এ জীবনে তখন বাঁচাটাই পুরাপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়। বরং ডেকে আনে জাহান্নামের আযাব।

 মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত

বই লেখা, বইয়ের প্রকাশ ও প্রচার কোন মামূলী কাজ নয়। জ্ঞানের প্রচারে বইয়ের সাহায্য নেয়া মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সূন্নত। আরবী ভাষায় সূন্নত বলতে যা বুঝায় তা হলো norm, custom, tradition, practice, convention, rule ইত্যাদী।-(আরবী অভিধান: আল -মাওয়ারীদ)। আল্লাহতায়ালার এ মহান সূন্নত পালন করেছেন নবী-রাসূল ও তাঁদের সাহাবাগণ। সে সূন্নত পালনে প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ এতটাই নিষ্ঠাবান ছিলেন যে অতি স্বল্প সময়ে তাঁরা আরবী ভাষায় গড়ে তুলেন তৎকালীন বিশ্বে সর্বাধিক বই। ফলে আরবী ভাষা পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায়। গড়ে উঠে জ্ঞানের বিশাল সমূদ্র। জ্ঞানের ভূবনে এতো দ্রুত বিপ্লব আনার নজির সমগ্র মানব ইতিহাসে নাই। অথচ নবীজী (সা:)’র আগে আরবী ভাষায় একখানি বইও ছিল না। পবিত্র কুর’আনই হলো আরবী ভাষায় প্রথম বই। কুর’আনের আগে যা ছিল তা হলো কবিতা ও কাসিদা। আরবের মানুষ সেগুলো মুখস্থ করতো, এবং নানা মজলিসে তা পাঠ করতো। কবিতাকে কাপড়ের বা চামড়ার উপর লিখে তারা কা’বার গায়ে তা লটকিয়ে দিত। আরবী ভাষায় এগুলোকে বলা হত মোয়াল্লাকা তথা ঝুলন্ত কবিতা। আরবের লোকরা মক্কা জিয়ারতে এসে সেগুলো কা’বার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাঠ করতো এবং নিজ নিজ এলাকায় ছড়িয়ে দিত।

মুসলিমদের আজকের পরাজয়ের মূল কারণ এই নয় যে, জনসংখ্যা বা সম্পদে তারা কম। এমনও নয় যে, চাল-ডাল, মাছ-মাংস ও বস্ত্র উৎপাদনে পিছিয়ে আছে। বরং পরাজয়ের মূল কারণটি হলো, তারা পরিহার করেছে মহান রাব্বুল আ’’লামীনের সূন্নত। মুসলিম হওয়ার দায়ভার শুধু রাসূল (সা:)’র সুন্নত পালন নয়, মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত পালনও। এবং মহান আল্লাহতায়ালার সে সূন্নতটি হলো মানুষের কাছে তাঁর কিতাব পৌঁছে দেয়া। এবং সে কিতাবের সাহায্যে মানুষকে জান্নাতের পথে ডাকা। সে ডাকার প্রয়োজনে তিনি যেমন লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, তেমনি সে লক্ষ্যে কিতাবও পাঠিয়েছেন। পবিত্র কুর’আনের সর্বপ্রথম আয়াতে যে নির্দেশটি দিয়েছেন সেটি হলো “ইকরা” অর্থাৎ পড়ার। নবীজী (সা:)’র উপর নির্দেশ: “ফাযাক্কির বিল কুর’আন।” অর্থ: কুর’আন দিয়ে মানুষকে সাবধান করো। অর্থাৎ মানুষকে জ্ঞানবান করো। এই হুকুম শুধু নবীজী (সা:)’র উপর নয়, কুর’আনের প্রতিটি পাঠকের উপরও। অথচ বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে কুর’আনী জ্ঞান বিস্তারের কাজটিই যথার্থ ভাবে হয়নি।

নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের থেকে আজকের মুসলিমদের পার্থক্য অনেক। তবে হযরত ইমাম হাসান বিন আলী (রা:)’র মতে মূল পার্থক্যটি হলো, সাহাবাগণ পবিত্র কুর’আনকে তাদের প্রতি মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে প্রেরীত ব্যক্তিগত বার্তা রূপে মনে করতেন। ফলে পবিত্র কুর’আনের প্রতিটি নির্দেশকে তারা শুধু গভীর মনযোগ সহকারে বুঝবার চেষ্টাই করতেন না, বরং আপ্রাণ চেষ্টা করতেন কোন একটি নির্দেশের অবাধ্যতা থেকে বাঁচার। সে কাজটি যথার্থ ভাবে করার প্রয়োজনে মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সুদান, লিবিয়া, আলজিরিয়া, মরক্কোসহ বহু দেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষাকে দাফন করে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছেন। পবিত্র কুর’আনকে তারা শুধু তেলাওয়াতই করতেন না, সেগুলো নিজ জীবনে পূর্ণাঙ্গ ভাবে পালন করাকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা মনে করতেন। সেগুলি পালনে তারা সামান্যতম গাফলতি দেখাননি। ফলে কি জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে, কি নামাজ-রোজার ক্ষেত্রে, কি জিহাদের ক্ষেত্রে, কি ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে -সর্বক্ষেত্রে তাঁরা দ্রুত এগিয়ে গেছেন। কিন্তু সে চেতনা বিলুপ্ত হয়েছে আজকের মুসলিমদের মধ্য থেকে। ফলে পবিত্র কুর’আন তার বিশুদ্ধতা নিয়ে বেঁচে থাকলেও মুসলিমদের মাঝে কুর’আনের প্রতি সাহাবাদের ন্যায় আচরণ বেঁচে নাই।

দেশের কোন শাসক, আদালত বা পুলিশের পক্ষ থেকে লেখা প্রতিটি চিঠির প্রতিটি লাইনের পাঠ উদ্ধারে ও তাঁর নির্দেশ পালনে কোন মুসলিম নাগরিক কি কখনো অনাগ্রহ বা তাচ্ছিল্য দেখায়? যারা মুর্খ তারাও সে চিঠির প্রতিটি শব্দ বুঝার জন্য শিক্ষিতদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে। কোন একটি লাইনও যাতে বুঝতে বাকি না থাকে -সে দিকে থাকে তাদের পূর্ণ খেয়াল। সে চিঠির প্রতিটি নির্দেশকে অতি গুরুত্ব দিয়ে সাথে সাথে পালনও করে। কারণ, অবাধ্যতার পরিণামটি তারা জানে। কোনরূপ অবাধ্যতার শাস্তি থেকে বাঁচতে প্রত্যেকেই চিঠির পুরা মর্ম বুঝতে চায়। অথচ পবিত্র কুর’আন হলো প্রতিটি ব্যক্তির প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর ব্যক্তিগত চিঠি। এতে রয়েছে আদেশ ও নিষেধের পূর্ণ নির্দেশনামা। অবাধ্যতা জাহান্নামে নিয়ে পৌছাবে সে হুশিয়ারীও রয়েছে এই চিঠিতে। কিন্তু এই চিঠির অর্থ উদ্ধারে ও নির্দেশগুলি পালনে কোথায় সে আগ্রহ? বাংলাদেশের মত একটি দেশে শতকরা ক’জন মুসলিম এমন আছে যারা পবিত্র কুর’আনের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত জীবনে অন্ততঃ একবার অর্থসহ পাঠ করেছে? কি বিস্ময়ের বিষয়! মহান আল্লাহতায়ালার কাছে অধিকাংশ মানুষ ফিরে যাচ্ছে তাঁদের প্রতি প্রেরীত চিঠিটি অর্থসহ একবার না পড়েই! অথচ এই পার্থিব জীবন তো একটি পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় পাশ করতে সাহায্য করতেই নাযিল হয়েছে একমাত্র টেক্সটবুক রূপে এই কুর’আন। যে ব্যক্তি এই কুর’আন বুঝলোই না, সে এ পরীক্ষায় পাশ করবে কীরূপে? আর পাশ না করলে জান্নাত পাবে কীরূপে? নবীজী (সা:)’র যুগে কি এটি ভাবা যেত? এ প্রশ্ন তো উঠবেই, “তোমাদের কাছে কি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত পয়গাম পৌঁছেনি? তখন জবাবটি কি হবে? পবিত্র কুর’আনের অর্থ উদ্ধারেই যেখানে এতো ব্যর্থতা, সে নির্দেশ পালনে সফলতা আসবে কীরূপে? অথচ মানব জীবনের সকল সফলতা এবং পরকালে জান্নাতপ্রাপ্তি নির্ভর করে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এই কিতাবের অর্থ-উদ্ধার ও সেটি পুরাপুরি পালনের উপর। মুসলিম জীবনের এটিই তো মূল এজেন্ডা। অথচ কি বিস্ময়!  জীবনের সে মূল এজেন্ডাই আজ উপেক্ষিত! এবং জীবন ভরে উঠেছে কুর’আনী হুকুমগুলির অবাধ্যতায়।

 ভয়ানক ব্যর্থতার বিষয়

“ইকরা” তথা “পড়ো” হলো পবিত্র কুর’আনের প্রথম নির্দেশ। পব্ত্রি কুর’আন শুধু নবীজী (সা:)’র উদ্দেশ্যে নয়, বরং এ কিতাব সমগ্র মানব জাতির উদ্দেশ্যে। ফলে সমগ্র মানব জাতির উদ্দেশ্যে “পাঠ করো” -এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার প্রথম নির্দেশ। অথচ পড়ার সে নির্দেশটিও মুসলিমদের দ্বারা যথার্থ ভাবে পালিত হয়নি। বই না পড়া এবং বই না লেখার কারণে জ্ঞানের রাজ্যে বেড়েছে ভয়ানক অপুষ্টি। চেতনায় জগতে বেড়েছে দূষণ। আর চেতনায় অপুষ্টি ও দূষণ নিয়ে কি কোন জাতি সুস্থতা পায়? পায় কি নিজ পায়ে দাঁড়ানোর বল? দেহের অপুষ্টিতে বিলুপ্ত হয় কাজ-কর্মের সামর্থ্য। চেতনার অপুষ্টিতে বিলুপ্ত হয় সঠিক ভাবে চিন্তা-ভাবনার সামর্থ্য। বই না পড়ার ভয়ানক বিপদ তো এখানেই। এ বিপদ থেকে মুসলিমদের বাঁচানোর জন্যই মহান আল্লাহতায়ালা জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। কারণ জ্ঞানী না হলে তো আল্লাহর ভয় আসে না। এবং আল্লাহর ভয় না থাকলে কর্মে, চরিত্রে ও আচরনে পরিশুদ্ধি আসে না। আল্লাহভীতি সৃষ্টির জন্য জ্ঞান যে কতটা অপরিহার্য সে বয়ান এসেছে পবিত্র কুর’আনে। বলা হয়েছে, “সকল বান্দাদের মাঝে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে” –(সুরা ফাতির, আয়াত ২৮)। আর জ্ঞান তো খাবারের প্লেটে আসে না। আসে বইয়ের পাতায়। কিন্তু ক’জন জ্ঞানের সে সর্বশ্রেষ্ঠ উৎস পবিত্র কুর’আন বুঝার সামর্থ্য রাখে?  মুসলিমদের বড় গুনাহ এবং সে সাথে আল্লাহর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অবাধ্যতাটি হলো, তাদের দ্বারা সে ফরজটিই যথার্থ ভাবে আদায় হয়নি। আর প্রতিটি অবাধ্যতাই তো কুফরি। এবং অবাধ্যরা কি কখনো দুনিয়ায় ও আখেরাতে পুরস্কার পায়? মহান আল্লাহতায়ালার আযাবের জন্য কি এরূপ অবাধ্যতাই যথেষ্ঠ নয়?

বই লেখা এবং বই পড়ার ক্ষেত্রে এমনকি কাফিরদের থেকেও মুসলিমগণ পিছিয়ে পড়েছে। একটি দেশে কি পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হয় তা থেকেই বুঝা যায় সে দেশের মানুষ কতটা খায়। এবং বুঝা যায় তাদের দেহে পুষ্টির মান। তেমনি বই লেখা, বইয়ের গুণাগুণ, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ও বইয়ের বিক্রয় থেকেই ধারণা করা যায়, সে দেশের মানুষ কতটা বই পড়ে। এবং কি ধরণের বই পড়ে। তখন বুঝা যায়, কীরূপ তাদের জ্ঞান, চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তির মান। সাড়ে ছয় কোটি ব্রিটিশ জনগণ প্রতি বছর যে পরিমান বই লেখে বা প্রকাশ করে, বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মুসলিম তার অর্ধেক পরিমাণ বইও লেখে না এবং প্রকাশ করে না। এ শতাব্দীর শুরুতে জাতিসংঘের ইউ.এন.ডি.পি’র এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, গ্রীসের মত একটি মাত্র দেশে প্রতি বছর যে পরিমান বই প্রকাশিত হয় ২২টি আরব দেশেও সে পরিমান বই লেখা হয় না। কারণ এসব স্বৈরাচার কবলিত দেশগুলিতে জ্ঞানচর্চার উপর রয়েছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। একখানি বই দূরে থাক, একটি পৃষ্টা ছাপাতে হলেও সরকারের অনুমতি লাগে। স্বৈরাচার-অধিকৃত এ আরব দেশগুলিতে প্রতিটি ব্যক্তিকে হতে হয় সরকারের আজ্ঞাবহ গোলাম। স্বাধীন ভাবে কথা বলা ও লেখালেখি করা এদেশগুলিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ হাত-পা বাঁধা ব্যক্তি যেমন নড়াচড়া করতে পারেনা, তেমনি পরাধীন ব্যক্তি পারে না জ্ঞানের প্রকাশ ঘটাতে। তাই মুসলিম দেশগুলিতে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানবিস্তারের পথে মূল শত্রু হলো স্বৈরাচারি শাসকগণ। তাদের কারণেই বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে মুসলিমদের এতো ব্যর্থতা।

ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তি ও লেখালেখির কাজটি হলো পবিত্র ইবাদত। এরূপ ইবাদতের মাধ্যমেই মানুষ তার প্রভুর জ্ঞানবান, যোগ্যবান ও দায়িত্ববান খলিফা হয়। এবং একাত্ম হয় তাঁর প্রভুর মিশন ও ভিশনের সাথে। এ কাজে রয়েছে জিহাদের মর্যাদা। সে জিহাদের মাধ্যমেই কোটি কোটি মানুষের মনের ভূবনে ইসলাম বিজয়ী হয়। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিম দেশে –বিশেষ করে আরব দেশগুলিতে সে কাজ পুরাপুরি সরকারী নিয়ন্ত্রণে। তাছাড়া সরকারি উদ্যোগে যা লেখা হয় বা পড়ানো হয় -তার কত ভাগ ইসলামী বই? বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে যেসব বই লেখা হয় বা পড়ানো হয় সেগুলির শতকরা ৫ ভাগও ইসলামি নয়। অধিকাংশই হলো কাফির, ফাসেক ও পথভ্রষ্টদের লেখা বই। এসব বই ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণের জীবনে শুধু পথভ্রষ্টতাই বাড়াতে পারে, ঈমানদারী নয়। খাদ্যের নামে বিষপানে স্বাস্থ্য বাঁচে না। তেমনি জ্ঞানার্জনের নামে পথভ্রষ্ট কাফিরদের বই পাঠে ঈমান বাঁচে না। তাই মুসলিমদের খাদ্যপানীয় যেমন কাফিরদের থেকে ভিন্ন, তেমনি ভিন্ন হলো তাদের জ্ঞানের সামগ্রী। হারাম খাদ্য গ্রহণে আল্লাহর বিরুদ্ধে যেমন বিদ্রোহ হয়, তেমনি বিদ্রোহ হয় কাফেরের লেখা বই থেকে নির্দেশনা গ্রহণেও। কাফির বা ইসলামে বিশ্বাসহীন লোকদের থেকে চাল-ডাল ও ইট-সিমেন্ট কেনা যায়। তাদের নির্মিত গাড়িতে বা বিমানেও চড়া যায়। অংক, বিজ্ঞান, কৃষি বা চিকিৎসা শাস্ত্রও শেখা যায়। কিন্তু তাদের থেকে হিদায়েত বা জীবনে চলার পথে পথনির্দেশনা নেয়া যায় না। হিদায়েত দানের দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহর। এতবড় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আল্লাহপাক অন্যের উপর ছেড়ে দেননি। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা সেটি সুস্পষ্ট করেছেন এভাবে, “ইন্না আলায়নাল হুদা।” অর্থ: পথ দেখানোর দায়িত্ব আমার। -(সুরা লাইল, আয়াত ১২)।

পথ দেখানোর কাজটি সঠিক ভাবে সমাধা করার জন্যই নাযিল হয়েছে পবিত্র কুর’আন, এবং সে কুর’আনী পথকে মানুষের কাছে তুলে ধরাই ছিল নবীজী(সা:)’র মূল মিশন। মুসলিমের দায়িত্ব হলো নবীজী (সা:)’র সে সূন্নতের পূর্ণ অনুসরণ। অথচ মুসলিমদের জীবনে এখানেই ঘটেছে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ভয়ানক ব্যর্থতা। তারা পথ চলছে কুর’আনী রোডম্যাপ না বুঝেই। ফলে ব্যর্থ হচ্ছে হিদায়েত পেতে। এ ব্যর্থতার বিপদ দুর্ভিক্ষে মারা যাওয়ার চেয়েও ভয়ানক। কারণ খাদ্যাভাবে মারা যাওয়ার কারণে কেউ জাহান্নাম যায় না। কিন্তু জ্ঞানের অভাবে চেতনায় যে দূষণ এবং পথ চলায় যে ভ্রষ্টতা আসে –তা নিয়ে মারা গেলে জাহান্নাম অনিবার্য হয়। অথচ মুসলিম বিশ্বে সে ভ্রষ্টতাই দিন দিন ব্যাপক ভাবে বেড়ে চলেছে। পবিত্র কুর’আন পরিণত হয়েছে নিছক তেলাওয়াতের কিতাবে; এবং হিদায়েত নেয়া শুরু হয়েছে কাফিরদের থেকে। ফলে মুসলিম দেশে মুজাহিদ না বেড়ে বরং বেড়েছে সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, লিবারেলিস্ট বা সোসালিস্টদের সংখ্যা। ভক্ত বেড়েছে ডারউইন, কার্ল মার্কস, মাও সে তুং, লেনিন, রবীন্দ্রনাথ -এমনকি আগ্রাসী শত্রু রাষ্ট্রের।

কোনটি খাদ্য আর কোনটি অখাদ্য -সেটি সনাক্ত করার জন্যও ন্যূনতম জ্ঞান লাগে। শিশুর সেটি থাকে না বলেই সে বিষ্ঠা বা বর্জ্য মুখে তুলে নেয়। সব খাদ্যই যেমন সুখাদ্য নয়, তেমনি সকল বই ভাল বই নয়। আল্লাহতায়ালা যেমন বইকে হিদায়েত দানের মাধ্যম রূপে বেছে নিয়েছেন, তেমনি শয়তান এবং তারা অনুসারীরা এটিকে বেছে নিয়েছে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার হাতিয়ার রূপে। বইপাঠের নামে শয়তানের সৃষ্ঠ আবর্জনা পাঠ হলে বিবেকের মৃত্যু বা ভ্রষ্টতা অনিবার্য। বিবেকের এমন মৃত্যু ও ভ্রষ্টতা নিয়ে পবিত্র কুর’আনের গুরুত্ব অনুধাবনও তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। কথা হলো, বাংলাদেশে লেখক, বুদ্ধিজীবী ও কবি-সাহিত্যিকের নামে বিষ-ব্যবসায়ীদের সংখ্যা কি কম? মুসলিমের দায়িত্ব শুধু বিষাক্ত সাপগুলো চেনা নয়, বরং গুরুতর দায়িত্ব হলো এসব বিষ-ব্যবসায়ীদের চেনা। এরাই শয়তানের একনিষ্ঠ সৈনিক এবং মুসলিমদের শত্রু। এরূপ অসংখ্য বিষ-ব্যবসায়ীদের মাঝে বিবেক বাঁচাতে হলে কোনটি ভাল বই -সেটি চেনার মত কাণ্ডজ্ঞানও থাকতে হবে।

ক্ষুদার্ত মানুষ ক্ষুধা মেটাতে অপুষ্টিকর বা দূষিত খাদ্যও মুখে তুলে। তেমনি জ্ঞানের রাজ্যে ক্ষুধা মিটাতে বহু বুভুক্ষ মুসলিম বই পড়ার নামে প্রচুর আবর্জনা গিলছে। ফলে বাড়ছে নৈতিক মহামারি। ফলে অসম্ভব হয়ে পড়েছে তাদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। অজ্ঞতা নিয়ে যেখানে সুস্থ মানুষ রূপে বেড়ে উঠাই অসম্ভব, সেখানে সত্যিকার মুসলিম হওয়া যায় কি করে? তখন তো বাড়ে দুর্বৃত্তি, বাড়ে সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে ভ্রষ্টতা। বাংলাদেশের মত শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশ দুর্বৃত্তিতে বার বার বিশ্বে প্রথম স্থানটি অধিকার করছে তো সে কারণেই। অথচ এটি কি কোন মুসলিমের কাজ হতে পারে? মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায় বাঙালি মুসলিমের যে কতটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে -সেটি কি এরপরও বুঝতে বাকি  থাকে?

 সাহিত্যের নামে দুর্বৃত্তি ও নাশকতা                                                  

মারনাস্ত্র যদি চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী ও নানারূপ দুর্বৃত্তদের হাতে পড়ে তবে সে দেশে শান্তি বিপন্ন হয়। তেমনি বই যখন শয়তানের হাতিয়ারে পরিণত হয় তখন সত্য পথ খুঁজে পাওয়া সে দেশে অতি কঠিন হয়ে পড়ে। শয়তান মুসলিমদের সরাসরি আল্লাহকে অস্বীকার করতে বলে না, বরং কৌশল নেয় তাদের মন থেকে আল্লাহর স্মরণকে ভূলিয়ে দিতে। এ কাজে মিথ্যাই শয়তানের মূল অস্ত্র। এবং শয়তান মিথ্যার প্রসার বাড়ায় ধর্মের নামে। আদিম যুগে মহান আল্লাহতায়ালাকে ভূলিয়ে দেয়ার কাজে শয়তান ধর্মের নামে মানুষের সামনে অসংখ্য দেব­-দেবীর হাজির করতো। আধুনিক যুগে সে অভিন্ন লক্ষ্যে শয়তানের প্রধান হাতিয়ারগুলি হলো বই, নাচ-গান, অশ্লীল সিনেমা, ভিডিও, খেলাধুলা ইত্যাদি।

চোর-ডাকাতেরা মানুষের অর্থ লুট করে। আর দুর্বৃত্ত সাহিত্যিকেরা শুধু পাঠকের অর্থই লুট করে না, তাদের জীবন থেকে মহামূল্যবান সময়ও চুরি করে। এখানেই কবি-সাহিত্যিকের দুর্বৃত্তি। চোরডাকাতদের চেয়েও তাদের নাশকতা ভয়ংকর। কারণ চোর-ডাকাত শুধু অর্থ চুরি করে; কিন্তু এরা চুরি করে মহামূল্যান সময় এবং নাশকতা ঘটায় চেতনার ভূমিতে। চোর ডাকাত সত্যচ্যুৎ করে না এবং জাহান্নামমুখীও করেনা, অথচ সে কাজটি এই দুর্বৃত্ত সাহিত্যিকগণ করে। জাহিলী যুগে আরবের বুকে ইমরুল কায়েসের মত প্রতিভাবান অনেক কবি ছিল। গৃহে, জনপদে, হাটে-বাজারে তাদের রচিত কবিতা পাঠের বড় বড় জলসা বসতো। কিন্তু তাতে লাভ হয়েছে কতটুকু? সে আমলের কবিতায় প্রকাশ পেত লাগামহীন কল্পনা, যৌনতা, অশ্লীলতা, পাশবিকতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও গোত্রীয় অহংকার। সাহিত্য ব্যবহৃত হতো বিনোদনের মাধ্যম রূপে। কিন্তু তাতে কি কোন উন্নত বিবেকবোধ, রুচিবোধ, মূল্যবোধ ও সভ্যতা গড়ে উঠেছে? মুক্তি মিলেছে কি মুর্তিপূজার ন্যায় আদিম অজ্ঞতা থেকে? বরং সমগ্র আরব ডুবেছিল অবিচার, মিথ্যাচার, ব্যভিচার, জুয়া, মদ্যপান, রাহাজানি, শিশুহত্যা, দাসপ্রথা, গোত্রীয় বিবাদ ও যুদ্ধবিগ্রহে। এসব কবিতায় ছিল যৌনতা, ভোগলিপ্সা ও গোত্রীয় অহংকারে উত্তেজনা সৃষ্টির সামর্থ্য। কিন্তু ছিল না উন্নত চিন্তা ও চরিত্র গড়ার সামর্থ্য। এরূপ কয়েক শত ইমরুল কায়েস যদি কোন দেশে জন্ম নেয়, তবুও কি তাতে লাভ হয়? এতে বরং বিনোদনে অপচয় হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের কোটি কোটি ঘন্টা। শয়তান তো সেটিই চায়।

আগাছার বৃদ্ধিতে ফসল বাড়ে না। তেমনি বইয়ের নামে আবর্জনা রচিত হলে তাতে দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধি আসে না। বই যেমন হিদায়েতের বাহন, তেমনি পথভ্রষ্টতারও বাহন। বাংলাদেশের ন্যায় যে দেশ দুর্বৃত্তিতে বার বার বিশ্বরেকর্ড গড়ে, প্লাবন আসে চুরিডাকাতি-ভোটডাকাতি ও গুম-খুন-সন্ত্রাসের রাজনীতিতে, হাজার হাজার কোটি টাকা যে দেশের ব্যাংক থেকে লুট হয়ে যায়, ঘুষ ছাড়া যে দেশের অফিস-আদালতে কাজ হয় না, সে দেশে হিদায়েতের কাজে বইপত্র যে কাজ দেয়নি -সেটি বুঝে উঠা কি এতোই কঠিন? বই রচনার লক্ষ্য যখন বিনোদন বাড়ানো এবং সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্য -সে সাহিত্য থেকে কি পথনির্দেশনা বা হিদায়াত লাভ সম্ভব? এমন সাহিত্যে যে শুধু বিপুল পরিমান কাগজ-কালির অপচয় হয় –শুধু তাই নয়, সেগুলি লিখতে ও পড়তে অসংখ্য মানুষের কোটি কোটি ঘন্টাও বিনষ্ট হয়। এসবই মানব জাতির অতিশয় খরচের খাত। শয়তান তো সাহিত্য চর্চার নামে সে খরচই বাড়াতে চায়।

বাংলায় রবীন্দ্রনাথের ন্যায় নোবেল বিজয়ী কবির জন্ম হয়েছে। শরৎচন্দ্র, বঙ্গিমচন্দ্র, সুনীল গাঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ুন আহমেদের ন্যায় বহু উপন্যাসিকও জন্ম নিয়েছে। তাদের সাহিত্য চর্চা যেমন প্রচুর, সে সাহিত্যের পাঠকও প্রচুর। এদের নিয়ে বাঙালির অহংকারও অনেক। আধুনিক এ যুগকে তারা চিত্রিত করে বাঙালির রেনেসাঁ যুগ বলে। এসব সাহিত্যে প্রচুর সাহিত্যরস আছে। বিনোদনের উপকরণও আছে। কিন্তু তাতে কি কোন দিক নির্দেশনা আছে? এ সাহিত্য উন্নত মানুষ রূপে বেড়ে উঠার জন্য জোগায় কি নৈতিক পুষ্টি? কেউ চলার খাতিরে পথ চলে না, বলার খাতিরে বলে না এবং খাওয়ার খাতিরে খায় না। সব কিছুর মাঝেই সুনির্দ্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। যে পথটি সুনির্দ্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌছায় না -সে পথে দৌঁড়িয়ে লাভ কি? খাদ্যকে শুধু মুখরোচক হলে চলে না, পুষ্টিও জোগাতে হয়। তেমনি সাহিত্যের কাজ শুধু বিনোদন বাড়ানো নয়, পাঠকের চেতনায় জ্ঞানের পুষ্টিও বাড়াতে হয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের এসব দিকপালদের কারণে বাঙালির মানবিক গুণ কতটা বেড়েছে? বেড়েছে কি নৈতিক মান? অথচ যতই বেড়েছে এরূপ সাহিত্যিকের সংখ্যা, ততই বেড়ে চলেছে বাঙালি মুসলিমের বেইজ্জতি। বাংলা সাহিত্যের এ রমরমার যুগেই অর্জিত হয়েছে বাঙালির হাজারো বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক অপমান। সেটি যেমন আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ভিক্ষার তলাহীন ঝুড়ির খেতাব, তেমনি বিশ্বের দরবারে ৫ বার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের। এসবই ঘটেছে চেতনা রাজ্যে চরম অপুষ্টির কারণে। কারণ চেতনার অপুষ্টিতেই তো মানুষ অতি দুর্বৃত্ত হয়।

পরীক্ষায় বসে বিনোদন?

মানুষের আয়ু সামান্য। এবং সামান্য সময়ের এই জীবনে পুরো সময়টা জুড়ে পরীক্ষা। সে পরীক্ষায় পাশের উপর নির্ভর করে পরকালের অনন্ত-অসীম জীবনের সুখ-শান্তির বিষয়। পবিত্র কুর’আনে বলা হয়েছে,“তিনিই (আল্লাহতায়ালা) মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন এজন্য যে তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে আমলে কে শ্রেষ্ঠতম।” –(সুরা মূলক, আয়াত ২)। অর্থাৎ দুনিয়ার এ জীবনটি পরীক্ষাগার। কোন শিশুও তার স্কুলের পরীক্ষার হলে বসে অন্যমনস্ক হয় না, নষ্ট করে না পরীক্ষার সামান্যতম সময়। তাই প্রশ্ন হলো, এ পার্থিব জীবনে মহান আল্লাহর যে অতি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা সেখানে বসে কি অর্থহীন আলোচনা, সাহিত্য পাঠ ও বিনোদন চলে? সুরা মুদাচ্ছিরের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা জাহান্নামে পৌঁছবে তাদেরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হবে তোমরা কীরূপে জাহান্নামে পৌঁছলে, তারা বলবে, আমরা অর্থহীন কথার আসরে বসে সময় নষ্ট করতাম। অথচ সাহিত্যের খাতিরে যারা সাহিত্য চর্চা করে তারা তো সে কাজটিই করে। জাহান্নামে নেয়ার কাজে এরাই হলো শয়তানের সহযোগী। এ পার্থিব জীবনে পরীক্ষায় পাশের ভাবনা এবং আখেরাতে জান্নাতলাভের বিষয়টি যাদের সাহিত্যে অনুপস্থিত –পাঠকের চেতনায় তাদের নাশকতাটি তো ভয়ংকর। হিরোইন যেমন মানুষকে ভাবনাশুণ্য করে এবং অবসন্ন করে মন ও চেতনা, এসব সাহিত্যিকেরাও তেমনি মানুষের চেতনা থেকে আখেরাতকে ভুলিয়ে দেয়। তাদের সাহিত্য এখানে আফিম বা হিরোহিনের কাজ দেয়। এভাবে কেড়ে নেয় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য। মানুষকে এভাবে ভূলিয়ে রাখাই হলো শয়তানের সনাতন কৌশল। এ বিষয়ে পবিত্র কুর’আনের ঘোষণা,“শয়তান তাদের কার্যবলী তাদের নিকট শোভন করেছে এবং তাদেরকে সৎপথ চলা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে, ফলে তারা সৎপথ পায় না। -(সুরা নামল, আয়াত ২৪)।

মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মানুষের যে দুটি দোষ অতি অপছন্দের তা হলো মিথ্যা কথন এবং অপ্রয়োজনীয় আলোচনা। জান্নাতবাসীদের মাঝে এ দুটি দুষ্ট খাসলতকেই মহান আল্লাহতায়ালা অসম্ভব করে দিবেন। তাই তিনি পবিত্র কুর’আনে বলেছেন, “তারা সেখানে (জান্নাতে) অপ্রয়োজনীয় আলোচনা এবং মিথ্যা কথা শুনতে পাবে না”। -(সুরা নাবা, আয়াত ৩৫)। অর্থাৎ জান্নাতে সবকিছু্ই হবে অর্থবহ। আর আল্লাহতায়ালার কাছে যা জান্নাতে অপছন্দনীয় তা দুনিয়ায় পছন্দনীয় হয় কি করে? মুমিনের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে সুরা মু’মিনুনের তিন নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং তারা হচ্ছে এমন যারা অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে নিজেদের দূরে রাখে।” মু’মিনের দায়িত্ব তো জান্নাতের সংস্কৃতিকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা দেয়া। জান্নাত প্রাপ্তির জন্যও মু’মিনকে তাই সর্বপ্রকার অপ্রয়োজনীয় কথা পরিহার করতে হয়। মুসলিম শরিফের হাদীস: নবীজী (সা:) বলেছেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহতায়ালা তিনটি বিষয় খুবই পছন্দ করেন এবং তিনটি বিষয় খুবই অপছন্দ করেন। যে তিনটি বিষয় পছন্দ করেন তা হলো: এক). তোমরা একমাত্র আল্লাহকেই ইবাদত করবে। দুই), ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করবে না, তিন). আল্লাহর রশি তথা কুর’আনকে তোমরা সবাই এক সাথে আঁকড়ে ধরবে এবং পরস্পরে বিভক্ত হবে না। আর যে তিনটি বিষয় অপছন্দ করেন তা হলো, এক). অপ্রয়োজনীয় কথা বলবে না, দুই).লাগাতর প্রশ্ন করবে না, তিন).সম্পদের অপচয় করবে না।

মুসলিমগণ যখন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতাটির জন্ম দিয়েছিল তখন কল্পানার জগতে লাগামহীন কেচ্ছা­-কাহিনীর জাল বুনে বিশাল বিশাল উপন্যাস লেখা হয়নি। সে সভ্যতার নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের ন্যায় কবিতা, উপন্যাস বা ছোটগল্পের লেখকের প্রয়োজন পড়েনি। বরং গড়েছিল এমন অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষ যারা নিজেরাই শুধু জান্নাতের পথ পাননি, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকেও সে পথ দেখিয়েছিলেন। তাদের সে মেহনতের বলেই জান্নাতের পথের সন্ধান পেয়েছিল বাংলা, বিহার, আসামসহ হাজার হাজার মাইল দূরের অসংখ্য মানুষ। কিন্তু শয়তানের অনুসারীদের হাতে যখন কাগজ, কলম ও কালি যায় তখন তারা মিথ্যা ও অপ্রয়োজনীয় কাহিনীর বিশাল জাল বুনতে থাকে। সেটি তখন সাহিত্যে পরিণত হয়। আর সে জালে আটকা পড়ে দেশের সাধারণ মানুষ। বিনষ্ট হয় তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের হাজার হাজার কোটি ঘন্টা সময়।

মানুষের শ্রেষ্ঠ যোগ্যতা কবিতা, গল্প বা উপন্যাস লেখা নয়। বৈজ্ঞানিক আবিস্কারও নয়। বরং সেটি হলো মিথ্যার ভিড় থেকে সত্য আবিস্কার করা এবং জীবনের প্রতি পদে সে সত্য অনুসরণের সামর্থ্য অর্জন করা। লেখনি যখন সে সত্য খোঁজার কাজে বাহন হয় তখন সে লেখনির বদৌলতে শুধু সুন্দর মনের মানুষই গড়ে উঠে না, উন্নত সভ্যতাও গড়ে উঠে। এমন লেখকের চিন্তা-ভাবনার ািবসাথে তার কলমের কালির মর্যাদাও বিশাল। জিহাদের ময়দানে মুজাহিদের তরবারি শয়তানের বাহিনীকে দৈহিক ভাবে নির্মূল করে। সে জিহাদের পাশাপাশি আরেকটি অবিরাম জিহাদ চলে মানুষের চেতনার মানচিত্রে। সে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে শয়তানি শক্তিকে পরাজিত করে জ্ঞানীর কলমের কালি। অথচ বাংলাদেশের মত বহুদেশেই সে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদটি হয়নি। বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানটি এখানে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে বহুকাল যাবত অধিকৃত। বাংলা সাহিত্যের ময়দানে রবীন্দ্রনাথ ও হুমায়ুন আহমদদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি তাদের কারণে বাঙালির চেতনায় আবর্জনার উৎপাদনও বেড়েছে। তাদের সাহিত্যের বিশাল স্তুপ সত্যকে প্রকাশ না করে বরং সত্যকে গোপন করে দিয়েছে –যেমন আগাছার ভিড় অসম্ভব করে ফসলের চারার বেড়ে উঠাকে। ফলে রবীন্দ্রনাথ ও হুমায়ন আহম্মদের লেখনীর গভীরে যারা ডুবেছে তাদের পক্ষে সত্য খুঁঝে পাওয়াও কঠিন হয়েছে। এরূপ অপসাহিত্যের ছড়াছড়িই বিপুল সংখ্যক মানুষের চেতনায় পচন এনেছে এবং দেশকে বিশ্বমাঝে দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।

 শত্রুপক্ষের হাতিয়ার

মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ঘরবাড়ি, অর্থ বা সোনা-রূপা নয়। বরং তার সময়। মৃত্যুর ঘন্টা বেজে উঠলে হিমালয় সমান স্বর্ণ দিয়ে এক মিনিট সময়ও কেনা যায় না। আর পার্থিব জীবনটি হলো পরীক্ষার হল। সে সত্যটি মহান আল্লাহপাক পবিত্র কুর’আনে বহু বার উল্লেখ করেছেন। পরীক্ষার হলে প্রতিটি মুহুর্তের হিসাব হয়। প্রতি মুহুর্তের প্রতিটি কর্মের উপর নজরদারি এখানে মহান আল্লাহতায়ালার। নজরদারির সে কাজে প্রতিটি মানুষের ঘাড়ে তিনি ফিরিশতা বসিয়ে রেখেছেন। পরীক্ষার হলে বসে কি তাই খেলা বা নাটক দেখা যায়? পড়া যায় কি বিনোদনমূলক উপন্যাস? বিনোদান প্রদান যখন সাহিত্যিকের মূল লক্ষ্য হয় তখন সে সাহিত্যে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের কোন কল্যাণটি হয়? এমন রবীন্দ্রনাথ বা হুমায়ুন আহম্মদ শত শত জন্ম নিলেও কি বাংলার মানুষের কোন কল্যাণ হতো? বরং তাদের সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের জীবন থেকে মহামূল্যবান আরো বহু কোটি ঘন্টা লুন্ঠিত হয়। এতে মানুষ দরিদ্র হয়। লুন্ঠিত ব্যক্তির যেমন মাথার উপর ঘর বাঁধার পুঁজি থাকে না, তেমনি যে যুবকের হাজার হাজার ঘন্টা লুন্ঠিত হয় বিনোদন-মূলক সাহিত্য পাঠে তার জীবনে কি কুর’আন-হাদীস পাঠের জন্য সময় বাকি থাকে? এটিই তো মানব জীবনের বড় লুট। লুন্ঠিত এ যুবকের দুরাবস্থা দেখে তখন আনন্দ বাড়ে শয়তানের। বাংলাদেশে শয়তানী শক্তির এজন্যই তো এতো বিজয়-উৎসব। আর এতে দিন দিন পরাজয় ও দুর্দশা বাড়ছে ইসলামের পক্ষের শক্তির। সাহিত্য পরিণত হয়েছে শয়তানের হাতে নাশকতার শক্তিশালী হাতিয়ারে। 

মুসলিমগণ যখন বিশ্বশক্তি রূপে আবির্ভূত হয়েছিল তখন তাঁরা খেলা দেখে বা বিনোদন মূলক সাহিত্য পড়ে সময় নষ্ট করেননি। তারা যেমন প্রচুর লিখেছেন, তেমনি প্রচুর পড়েছেনও। কিন্তু তাদের সে লেখা বা পড়ার মূল লক্ষ্যটি ছিল সিরাতাল মোস্তাকীমের পথে নিজেদের ও অন্যদের পথচলাটি সুনিশ্চিত করা। ফলে তাদের হাতে ব্যাপক ভাবে বেড়েছে কুর’আন-হাদীসের জ্ঞান। বেড়ে উঠেছে বিশাল তাফসির ও ফিকাহ শাস্ত্র। সৃষ্টি হয়েছে, দর্শন, ভূগোল ও ইতিহাস-বিজ্ঞান। ক্ষতিকর আগাছা শুধু ফসলের জমিতেই জন্মে না, মনের ভূমিতেও জন্মায়। বিনোদনমূলক সাহিত্য তেমনি আগাছা। গানবাজনার আসরে বসে মানুষ যেমন নামাজের কথা ভূলে যায়, তেমনি এ সাহিত্য-রসে মগ্ন হয়ে মানুষ ভূলে যায় মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তার উপর অর্পিত খেলাফতের দায়ভারের কথা। ভূলে যায় যে, সে বসে আছে প্রশ্নপত্র হাতে পরীক্ষার হলে। শয়তান তো সেটিই চায়। আর সে দায়ভার ভূলিয়ে দেয়ার কাজে শয়তানের খলিফা রূপে কাজ করে সাহিত্যিকগণ।

সত্যের বীজ যত শক্তিশালীই হোক তা পাথরের উপর গজায় না। আগাছার জঙ্গলে জন্মালেও তা বেড়ে উঠে না। তাই যে মনে রবীন্দ্র-সাহিত্য বা হুমায়ুনের সাহিত্যের আসক্তি -সে মনে পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞান আহরণের আগ্রহ থাকে না। কারণ সাহিত্যের মাদকতা মদের মাদকতার চেয়ে কম নয়। ইসলামের জাগরণ রোধে সেক্যুলার শক্তির অন্যতম স্ট্রাটেজী তাই এমন সেক্যুলার সাহিত্যের জোয়ার। লক্ষ্য, পাঠককে বিনোদনে মত্ত রাখা। বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও সংস্কৃতির উপর সেক্যুলার পক্ষটি তাদের দখলদারী প্রতিষ্ঠা করেছে অনেক আগেই। এখন অধিকার জমাতে চায় জনগণের মনের ভূবনে। এবং সেটি সাহিত্যের মাধ্যমে। তাই রাষ্ট্রীয় খরচে বাড়ানো হচ্ছে রবীন্দ্র চর্চা। বাংলাদেশের মুসলিমদের সামনে তাই বড়ই দুর্দিন। তাদের চেতনার ভূমিতে ইসলামের শত্রুপক্ষ দখলদারী জমিয়েছে ফাঁকা মাঠে। বলা যায়, কোন রকম যুদ্ধ না লড়েই। কারণ তাদের প্রতিরোধে ইসলামের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিক তেমন নাই।

 শ্রেষ্ঠ অলংকার

মাছি চরিত্রের মানুষ মাত্রই আবর্জনা খোঁঝে। এটাই তাদের চরিত্র ও সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ঠ। এ সংস্কৃতির কারণে পতিতাপল্লী, ফ্যাশানের নামে অশ্লীলতা, গানবাজনা, নাচের ঘর, মদ্যশালাগুলিই শুধু সমাজে স্বীকৃতি পায় না, বরং মার্কস, লেনিন, মাও, গান্ধি, রবীন্দ্রনাথ, মুজিবের ন্যায় ব্যক্তিগণও পূজণীয় হয়ে উঠে। কিন্তু ঈমানদার মানুষের সংস্কৃতিটাই ভিন্ন। ঈমানগণ শুধু ভাল খাবারের সন্ধানই করে না, ভাল বইয়েরও সন্ধান করে। মানুষ রূপে কে কতটা বিবেকবান ও রুচিশীল সেটি কারো প্রাসাদ, ধনদৌলত বা পোষাক-পরিচ্ছদ থেকে ধরা পড়ে না। সেটি ধরা পড়ে কাদের তারা অনুকরণীয় আদর্শ রূপে গ্রহণ করে তাদের দেখে। আরো ধরা পড়ে তাদের ভাণ্ডারে ভাল বইয়ের তথা জ্ঞানের সংগ্রহ থেকে। সেক্যুলারিস্টদের কাছে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহবাদের আদর্শ অনুকরণীয় নয়। অথচ তারাই ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তাদের ভাণ্ডারে কুর’আন, হাদীস ও তাফসির গ্রন্থ্যেরও কোন স্থান নাই। সাহাবায়ে কেরাম যে কারণে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন তার কারণ, তাঁদের নেতা ছিলেন নবীজী (সা:)’র মত মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। এবং তাঁদের হাতে ছিল পবিত্র কুর’আনের মত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব। তাঁরা জীবনে সকল নির্দেশনা ও দর্শন পেতেন এই সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব ও মহান নেতা থেকে। অথচ আজ বাঙালি মুসলিমদের হাতে উঠেছে কার্ল মার্কস, রবীন্দ্রনাথ বা অন্যান্য ব্যক্তির রচিত বই। এবং অনুসরণীয় নেতা রূপে গৃহিত হয়েছে শেখ মুজিবের ন্যায় স্বৈরাচারী, মিথ্যাচারী ও গণতন্ত্র হত্যাকারী ব্যক্তি। ফলে উপরে না উঠে তারা ইতিহাস গড়ছে দ্রুত নীচে নামায়।

মুসলিমদের গৌরব কালে তাদের মাঝে ভাল বইয়ের তালাশ ও ভাল বই লেখার আগ্রহ যেমন প্রচণ্ড ছিল, তেমনি প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল তা থেকে শিক্ষা লাভে। সে তীব্র আগ্রহের কারণে গৌরব যুগের মুসলিমগণ পবিত্র কুর’আনের একটি আয়াত শোনার জন্য বহুশত মাইল দূর থেকে নবীজী (সা:)’র কাছে এবং নবীজী(সা:)’র পর তাঁর সাহাবাদের কাছে ছুটে আসতেন। কুর’আনের সে আয়াতগুলো শুধু শুনতেনই না, সেগুলো এতবার পড়তেন যে তাতে তাদের সেগুলো মুখস্থ হয়ে যেত। এভাবে হাজার হাজার মানুষ সমগ্র কুর’আন মুখস্থ করতেন। সে সাথে মনের মূলে বদ্ধমূল করতেন নবীজী (সা:)’র হাদীস। জীবনের প্রতি পদে সেগুলো তারা মেনে চলতেন। সেটি ছিল যেমন তাদের ব্যক্তিগত জীবনে, তেমনি রাষ্ট্রীয় জীবনে।

 প্রথম ফরজটিই পালিত হয়নি

আজকের মুসলিম নর-নারী ভাল প্রসাধনী, ভাল শাড়ি, ভাল গাড়ি বা ভাল গহনার জন্য শহরের শপিং সেন্টারগুলো তন্য তন্য করে খোঁঝে। এমন কি বিদেশেও পাড়ি দেয়। শহরের কোথায় সেগুলি পাওয়া -সে খবরও আজ ঘরে ঘরে। কিন্তু কোথায় ভাল বই পাওয়া যায় এবং কোন বইগুলি ভাল -সে খবর ক’জনের? ফলে আজ স্বচ্ছল মুসলিমদের ঘরে শাড়ী, গহনা বা আসবাবপত্রের স্তুপ গড়ে উঠলেও লাইব্রেরি গড়ে উঠছে না। অথচ গৃহের সবচেয়ে মূল্যবান অলংকার হলো ভাল বই। সে বইগুলিই মনের পুষ্টি জোগায় এবং জ্ঞানবান ভাল মানুষ হতে সাহায্য করে। ঘরে ভাল খাবার থাকলে সে ঘরের শিশুরা দৈহিক পুষ্টি পায়। ফলে ভাল স্বাস্থ্য পায়। তেমনি ঘরে ভাল বই থাকলে সে ঘরের সন্তানেরা ভাল জ্ঞানী হয়। তাছাড়া একমাত্র জ্ঞানবান মানুষের পক্ষেই মুসলিম হওয়া সম্ভব –যা ঘোষিত হয়েছে পবিত্র কুর’আনে। অজ্ঞতায় সেটি অসম্ভব। অজ্ঞতা একমাত্র চিন্তায় দূষণ ও ভ্রষ্টতাই বাড়াতে পারে। অজ্ঞ মানুষের ঘাড়ে শয়তান বাসা বাঁধে এবং তাকে জাহান্নামের পথে পরিচালিত করে। তাই জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁচাটি অনাহার থেকে বাঁচা নয়, বরং জ্ঞানের অভাব ও দুষ্ট চিন্তা থেকে বাঁচা। কিন্তু বাঙালি মুসলিমদের মাঝে সেরূপ বাঁচায় আয়োজন কই?  

যে গৃহে ভাল বই নাই এবং ভাল বইয়ের পাঠকও নাই -বুঝতে হবে সে গৃহে ভাল মানুষ গড়ে উঠার সম্ভাবনাও নাই। এমন গৃহে শয়তানের দুর্বৃত্ত সেপাহীরাই প্রবল ভাবে বেড়ে উঠে। এ দুর্বৃত্তগণই দেশের শত্রু এবং ইসলামের শত্রুতে পরিণত হয়। চলমান শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়ে প্রমাণ করেছে দুর্বৃত্ত মানুষ উৎপাদনের কাজটি স্রেফ কোন দল, মহল্লা বা অফিসে সীমিত নয়। এটি শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে এবং ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছ। কারণ সেটি না হলে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বমাঝে ৫ বার প্রথম হওয়া যায়না।

একটি দেশ কতটা সভ্য, ভদ্র ও উন্নত এবং কতটা ইসলামী –সে পরিচয়টি জানতে সে দেশের মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, কলকারখানা ও রাস্তাঘাট গণনার প্রয়োজন নেই। সেটি সঠিক ভাবে জানা যায় সেদেশে কতটা ভাল বই বিক্রি হয় এবং সেসব ভাল বইয়ের পাঠক কতজন -তা থেকে। কিন্তু সে বিচারে বাংলাদেশ যে কত নীচে –সেটি বুঝে উঠা কি এতোই কঠিন? কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়গুলো ক’জন বুঝে? এবং ক’জন এ নিয়ে ভাবে? ভাববার ও বুঝবার সামর্থ্যই বা ক’জনের? এ এক ভয়াবহ অসভ্য অবস্থা। এমন দেশে কি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা পায়? বরং গুম-খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাসের জোয়ার আসবে, ভোটডাকাত শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রূপে সম্মানিত হবে -সেটিই কি অতি স্বাভাবিক নয়? এরূপ দুরাবস্থার কারণ, মুসলিম জীবনে জ্ঞানার্জনের যে ইবাদতটি মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম ফরজ করেছিলেন -সেটাই পালিত হয়নি। শুরুর কাজটি শুরুতেই প্রচণ্ড অবহেলার শিকার হয়েছে। ভিত না গড়ে প্রাসাদ গড়ার মত অবস্থা। এরূপ জ্ঞানহীন বেহাল অবস্থা নিয়ে কি এ দুনিয়ায় বা আখেরাতে কোন কল্যাণ আশা করা যায়? এটি তো সর্বময় অকল্যাণের পথ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *