বিবিধ ভাবনা (৫০)

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১. এ কি অসভ্যতা?                            

দেহের মৃত্যুর ন্যায় বিবেকের মৃত্যুও সুস্পষ্ট দেখা যায়। বাংলাদেশী বাঙালীর বিবেকের মৃত্যুই শুধু ঘটেনি, সেখানে পচনও ধরেছে। নইলে কি এমন অসভ্যতা ঘটে? সে পচনের কারণেই যে শেখ মুজিব ও তার কন্যা হাসিনা গণতন্ত্রকে কবরে নিল, ভোট চুরি করলো, স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা দিল, এবং রাস্তায় প্রতিবাদে নামলে পেটায়, গুম করে ও লাশ করে -সে দুর্বৃত্ত মুজিবকে জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু এবং হাসিনাকে নেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে? কোন সভ্য দেশে কি এরূপ আসভ্য কান্ড ঘটে? যে দেশ দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়, বিবেকের এমন পচন একমাত্র সেখানেই দেখা যায়।

সভ্য মানুষ কখনোই দুর্বৃত্তের পক্ষ নেয় না। সভ্য মানুষ তো এভাবেই চেনা যায়। তাই প্রতিটি সভ্য দেশেই খুনি, দূর্নীতিাবাজ, বিদেশের দালাল ও গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরচারীদের মনের গভীর থেকে ঘৃণা করা হয়। তাদেরকে ইতিহাসের আবর্জনার আস্তাকুঁড়ে দাফন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যা ঘটেছে সেটি তার বিপরীত। এদেশে মুজিবের ন্যায় দুর্বৃত্ত অপরাধীকে যেমন জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু বলা হয়, তেমনি তার মু্র্তি গড়ে পায়ে ফুল দেয়া হয়।

২. এ কি বেঈমানী?

যারা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে তাদের অধিকাংশই যে খুন-খারাবী, চুরি-ডাকাতি ও ধর্ষণের অপরাধী হবে –তা নয়। তারা জাহান্নামবাসী হবে বিবেকের পরীক্ষায় ফেল করার কারণে। তারা জাহান্নামে যাবে নমরুদ-ফিরাউনদের ন্যায় স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তদের পক্ষ নেয়া ও তাদেরকে সন্মানীত করার অপরাধে। মহান আল্লাহতায়ালার দৃষ্টিতে এটি গুরুতর অপরাধ। মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে পশু রূপে সৃষ্টি না করে বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেটি এ জন্য যে, বিবেককে কাজে লাগিয়ে সে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তাদেরকে নির্মূল করে সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা দিবে। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এটি প্রতি মানুষের উপর অর্পিত দায়ভারও। দুর্বৃত্তদের পক্ষটি মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া নেয়ামতের সাথে চরম গাদ্দারী। তাতে অসম্ভব হয় সভ্য সমাজ নির্মাণ। মানুষ সেটি করে বিবেকের পচনের কারণে। সে পচনের কারণে বহু কোটি হিন্দু বাঙালী যেমন মুর্তি-গরু-সাপ-শকুনকে ভগবান মনে করে, তেমনি বাংলাদেশী বাঙালীগণ মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্র হত্যাকারী বাকশালী দুর্বৃত্তকে জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু বলে। এবং তারা প্রতিপক্ষ রূপে দাঁড়ায় ইসলামের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে ইসলামের বিজয়কে প্রতিহত করছে তো এ দুর্বৃত্তরাই। মহান আল্লাহতায়ালা কি তার পবিত্র জান্নাতকে এমন দুর্বৃত্তদের দিয়ে ভরবেন?   

যে ব্যক্তি রক্তের সূত্রে পিতা, সে যদি চুরি-ডাকাতীতে নামে বা কাউকে খুন করে তবে সে নিজের সন্তানদের থেকেও সন্মান পায় না। কারণ দুর্বৃত্তকে সন্মান করার অনুমতি কোন ধর্মই দেয় না। বরং ইসলামের বিধান হলো দুর্বৃত্তকে ঘৃণা ও নির্মূল করায়। কারণ, এরাই হলো ইসলামের এবং সে সাথে মানবতার শত্রু। পিতা যদি কাফের হয় তবে তার জন্য দোয়া করাও মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে হারাম করেছেন। তাই প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিব জাতির পিতার সন্মান পায় কি করে? বঙ্গবন্ধুই বা হয় কি করে? শরিয়ত কি তার মত দুর্বৃত্তকে সন্মান করার অনুমতি দেয়? মুজিবের দুর্বৃত্তিমূলক অপরাধের তালিকাটি তো বিশাল।  মানব খুন, গণতন্ত্র খুন, বাকশালী স্বৈরাচার, ভারতের দালালী, ইসলামী দলগুলি নিষিদ্ধকরণ, ইসলামী দলের নেতাদের হত্যা ও কারাবন্দীসহ নানাবিধ অপরাধ তার। তার সে ভয়ানক দুর্বৃত্তি আজও দুর্দান্ত প্রতাপে বেঁচে আছে তারই কন্যা স্বৈরাচারী হাসিনার মাঝে। ঈমানের পরিচয় তো দুর্বৃত্তদের ঘৃণা করার মাঝে। সন্মানিত করায় তো চরম বেঈমানী।

৩. মর্যাদার পথ ও পতনের পথ

মহামারী, রোগভোগ, অনাহার বা দুর্যোগে যে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে -তাতে দেশের বড় একটা ক্ষতি হয়না। বরং সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হয় তখন, যখন দেশের কোটি কোটি মানুষ পানাহারে বাঁচা ছাড়া বিশ্বাবাসীর কল্যাণে কিছু না দিয়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। সে মানুষগুলি এমন ফলহীন গাছের ন্যায় যে গাছটি বছরের পর মাটি থেকে প্রচুর সার ও পানি চুষে নিল বটে -কিন্তু কোন ফল দিল না। অথচ প্রতিটি মানুষকে মহা আল্লাহতায়ালা বিস্ময়কর ক্ষমতা দিয়েছে। সে যেমন ভাবতে পারে তেমনি আনেক কিছু করতেও পারে। হাজার হাজার মানুষকে দিয়েছেন বিল গেটস’য়ের ন্যায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ সৃষ্টির ক্ষমতা।

ব্যক্তির মূল্যে বৃদ্ধি ঘটে তার শিক্ষা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে। এমন কি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মানুষের মূল্য বাড়ে তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের কারণে। তাই পবিত্র কুর’আনের কথা: “ওয়ালি কুল্লি দারাজাতুন মিম্মা আমিলু।” অর্থ: মানুষের সকল মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার কর্মগুণে। তাই বড় ইবাদত হলো, নিজ জীবনে ও অন্যদের জীবনে সে ভাল কর্মের সামর্থ্য বাড়ানো। এখানেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গুরুত্ব। দেশ সম্পদশালী হয় ও ইজ্জতের মালিক হয় মূল্যবান মানুষের সংখ্যা বাড়লে। এটিই উন্নয়নের পথ। অপর দিকে একটি দেশ শক্তিহীন ও ইজ্জতহীন হয় অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও দুর্বৃত্তির কারণে। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশ শেষের পথটি বেছে নিয়েছে। এটিই পতনের পথ।

৪. ব্যর্থতা শিক্ষা খাতে

বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যর্থ খাতটি হলো শিক্ষা খাত। শুধু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়লেই জাতি শিক্ষিত হয় না। সে জন্য প্রয়োজন হলো ভাল শিক্ষকের। বাংলাদেশে কমতি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় বরং ভাল শিক্ষকের। মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষকগণ পুলিশের চেয়ে কম দুর্নীতি পরায়ন নয়। দেশের সন্ত্রাসী, খুনি, ঘুষখোর দুর্বৃত্তগণ কোন বন-জঙ্গলে গড়ে উঠেনি, তারা তৈরী হয়েছে দেশের শিক্ষাঙ্গণ থেকে। গরুর আগে গাড়ী জোড়া যায় না, তেমনি ভাল শিক্ষক ছাড়া ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া যায় না। শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভ –এ দুটিই পবিত্র ইবাদত। কোটি টাকা দান করার চেয়েও শিক্ষাদানের সওয়াব অনেক বেশী।

শিক্ষাদানকে ইবাদত রূপে গ্রহণ করার নিয়েত নিয়ে ময়দানে না নামলে সে শিক্ষক দূর্নীতিতে নামে। শিক্ষাঙ্গণ তখন পরিণত হয় দূর্নীতির আখড়ায়। বাংলাদেশে শিক্ষাঙ্গণে সেটিই হচ্ছে। পরিণত হয়েছে দুর্বৃত্ত উৎপাদনের কারখানায়। দেহ শক্তিশালী হয় খাদ্যের গুণে। এবং চরিত্র  সুন্দর হয় কুরআনী জ্ঞানের গুণে। তাই ফরজ হলো কুরআনী জ্ঞান-অর্জন। ক্ষুধা লোপ পেলে মৃত্যু ঘটে। তেমনি কুর’আনী জ্ঞান অর্জনে আগ্রহ কমলে পতন আসে চরিত্রে। অথচ কুর’আনী জ্ঞানদানের ন্যায় শ্রেষ্ঠ কর্মটি গুরুত্ব পায়নি বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে। শিক্ষার ব্যর্থতার এটিই মূল কারণ।

নবীজী (সা:)’র আমলে বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, কিন্তু ছিল মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। নবীজী (সা:) ছিলেন প্রধান শিক্ষক। তখন ক্লাস বসতো গাছের তলায়, পথের ধারে, কারো বৈঠক ঘরে। বসতো মসজিদের জায়নামাযে। সে শিক্ষাঙ্গণ থেকে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব সৃষ্টি হয়েছে। ভাল মানুষ না গড়ে স্রেফ রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে দেশে শান্তি আসে না। তাতে সভ্য সমাজও নির্মিত হয় না। সভ্য সমাজ নির্মাণে চাই সভ্য মানুষ। সে কাজে চাই যোগ্যতর শিক্ষাব্যবস্থা। অথচ বাংলাদেশে সেটিই হচ্ছেনা।

৫. চাই বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিক

সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে ডাকাত পড়েছে। ডাকাত বাহিনীতে ডাকাতের সংখ্যাটি বিশাল। এ ডাকাতদের সাথে যোগ দিয়েছে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসন। ফলে চুরিডাকাতি হয়ে যাচ্ছে দেশের সম্পদ। লুন্ঠিত হচ্ছে দেশবাসীর ইজ্জত-আবরু ও বাঁচার অধিকার। এবং তাদের হাতে কবরে গেছে গণতন্ত্র। নিজ ঘরে ডাকাতের হামলা হলে সব কাজ ছেড়ে প্রধান কাজ হয় ডাকাত ধরা। ডাকাতকে ঘরে বসিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে লাভ হয়না। তেমনি দেশ ডাকাতদের দখলে গেলে মূল কাজ হয় ডাকাতদের নির্মূল। তখন সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সে কাজ না হলে রাষ্ট্রে সভ্য ও ন্যায় কাজ করাও অসম্ভব হয়।এমনকি কুর’আন শিক্ষার ন্যায় পবিত্র কর্ম করতে গিয়েও জেলে যেতে হয়। বাংলাদেশে তো সেটিই হচ্ছে।

এ বিশাল ডাকাত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইটি বিশাল। এ লড়াই ইজ্জত ও অধিকার নিয়ে বাঁচার। এ লড়াইয়ে  জিততে হলে ঘরে ঘরে লড়াকু সৈনিক চাই। সে জন্য চাই বিপুল সংখ্যক বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিক। কারণ মূল লড়াইটি হবে চেতনার ভূমিতে। ডাকাতগণ দখল জমিয়েছে চেতনার ভূমিতেও। তাতে দুর্বৃত্তগণও পূজনীয় হয়।  ফলে সৈনিক জুটছে না তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ময়দানে। চেতনায় বিপ্লব আসলে জোয়ার আসবে রাজপথে। তখন ঘৃনার আগুন জ্বলবে রাজপথে।  তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ নেমে আসবে রাজপথে। তাই সব বিপ্লবের শুরু হয় জ্ঞানের বিপ্লব দিয়ে।  

বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিকেরাই মানবকে ভাল মানুষকে ভালবাসতে এবং দুর্বৃত্তকে ঘৃণা করতে শেখায়। সে সামর্থ্য কখনোই ভাত-মাছে বাড়ে না। এ সামর্থ্যটি বাড়ার কারণেই সভ্য মানুষের জীবনে বিপ্লব আসে। সে তখন রাজপথের সৈনিকে পরিণত হয়। এবং সে সামর্থ্য বিলুপ্ত হলে বিজয় ঘটে দুর্বৃত্তদের। দুর্বৃত্তগণ তাই শুধু রাষ্ট্রের উপর দখলদারী নিয়ে খুশি হয়, তারা দখল জমায় জনগণের চেতনার ভূমিতেও। সমাজ তখন অসভ্যতায় ভরে উঠে। প্রতিটি মহল্লা ও প্রতিষ্ঠান তখন দুর্বৃত্তে ভরে উঠে। বাংলাদেশের মূল রোগ এখানেই। তাই বিপ্লবের কাজ চেতনার ভূমিতে শুরু করতে হবে।

৬. অপমান ও কলংকের  পথ

সে দেশের চেয়ে অধিক অপমানিত ও অসন্মানিত দেশ আর কোনটি যে দেশর প্রধানমন্ত্রী একজন প্রমানিত চোর? এবং সে দেশের জনগণের চেয়ে অযোগ্য ও অপদার্থ জনগণ আর কারা যারা চোরের শাসন বিনা যুদ্ধে মেনে নেয়? অথচ চুরি করা যেমন অন্যায়, তেমনি আন্যায় হলো চুরিকে মেনে নেয়াও। এবং পবিত্র ইবাদত হলো দুর্বৃত্ত নির্মূলের জিহাদ। সভ্য সমাজ নির্মাণের এ ছাড়া ভিন্ন রাস্তা নাই। অথচ বাংলাদেশে সে জিহাদের বদলে চোরকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে সন্মানিত করা হয়। বাংলাদেশের সমগ্র ইতিহাসে এর চেয়ে অধিক কলংকের ইতিহাস কি আর আছে? ২৬/০৫/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *