বিবিধ ভাবনা (১৯)

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১.

শাবাশ টিভি চ্যানেল আল-জাজিরা। চ্যানেলটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল কল্যাণকর কাজ করেছে। বাংলাদেশীরা নিজেরা যা করতে পারিনি, আল-জাজিরা তা করে দিয়েছে। দেশী মিডিয়া যেখানে দুর্বৃত্ত হাসিনার সরকারকে ফেরেশতা বানানো নিয়ে ব্যস্ত, আল-জাজিরা সেখানে প্রমাণ করেছে হাসিনার সরকার কত বড় অপরাধী। দেশের সম্পদের উপর ডাকাতি করে সরকারি দলের দুর্বৃত্তরা বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। প্রমাণ পেশ করেছে, হাসিনা কীরূপে খুনি, সন্ত্রাসী ও ডাকাতদের প্রতিপালন দিয়ে থাকে। আল-জাজিরা যদি কোন বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল হতো – ইতিমধ্যে এটি বন্ধ করে দেয়া হতো এবং সাংবাদিকদের রিমান্ডে নিয়ে তাদের উপর অত্যাচার করা হতো। হয়তো বা হত্যাও করা হতো।

আল-জাজিরা গুরুতর অপরাধের অভিযোগ এনেছে শেখ হাসিনা, সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ও প্রেসিডন্ট
আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে। জবাব না দিয়ে সরকার দুর্বৃত্তদের শাহবাগে নামিয়েছে আল-জাজিরার বিরুদ্ধে কুৎসা গাইতে। দুর্বৃত্তরা কখনোই বিচার চায় না। তারা চায়, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেয়া হোক। সরকারের সামান্য দায়িত্বজ্ঞান থাকলে আল-জাজিরার বিরুদ্ধে কুৎসা না রটিয়ে প্রমাণ পেশ করতো যে তারা অপরাধী নয়। ডক্যুমেন্টারী যারা করেছে তাদের বদনাম না রটিয়ে তারা যে অভিযোগগুলো এনেছে -সেগুলো তদন্ত করে জনগণের সামনে প্রকাশ করতো।  

২.
মহল্লায় নেকড়ে ঢুকলে বা ঘরে চোর-ডাকাত ঢুকলে নিষ্ক্রীয় থাকাটি অপরাধ। তেমনি অপরাধ হলো, দেশ দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হলে নিষ্ক্রীয় থাকাটি। এতে গাদ্দারী হয় দেশের সাথে এবং চরম বেঈমানী হয় মহান আল্লাহতায়ালার সাথে। মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে শুধু পানাহার ও রুজি-রোযগারের জন্য সৃষ্টি করেননি, কিছু দায়িত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মুসলিম জীবনের মূল মিশনটি হলো: আমিরু বিল মারুফ (ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা) এবং নেহী আনিল মুনকার (অন্যায়ের নির্মূল)। একাজের জন্যই বিশ্বমাঝে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। তাই প্রতিটি মুসলিমের উপর ঈমানী দায়ভার হলো এ মিশন নিয়ে বাঁচা। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিম সে মিশন নিয়ে বাঁচলে কি দেশ দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হতো? বাঙালী মুসলিমের বিশাল ব্যর্থতা তাই মুসলিম রূপে বাঁচায়।

৩.

চোখের সামনে খুন হলেও গরুছাগল মনের আনন্দে ঘাস খায়। তেমনি বিবেকশূণ্য ও ঈমানশূণ্য মানুষেরা চোখের সামনে অন্যায় ও দুর্বৃত্তি দেখেও নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রীয় থাকে। এরূপ পশু চরিত্রের মানুষের কারণেই দেশ অসভ্যতায় ভরে উঠে। তখন দেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে রেকর্ড গড়ে –যেমন বাংলাদেশ অতীতে ৫ বার প্রথম হয়েছে। যাদের হৃদয়ে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান ও দেশপ্রেম আছে, সকল সামর্থ্য নিয়ে তারা দুর্বৃত্তদের নির্মূলে ময়দান নামবে –সেটিই তো কাঙ্খিত। এটি পবিত্র জিহাদ। ঘরে আগুণ লাগলে বা ডাকাত পড়লে সে সময়টা বিরোধের নয়, তখন জরুরি একতা। বাংলাদেশ এখন ডাকাত-অধিকৃত। তাই এ মুহুর্তে সকল বিরোধী দল ও ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে রাজপথে নামা জরুরি। নইলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।

৪.
কে ভাল মানুষ এবং কে বদ মানুষ  -সেটি সুস্পষ্ট দেখা যায়। ভাল মানুষেরা দুর্বৃত্তদের ঘৃণা করে। বদ লোকেরা দুর্বৃত্তদের সন্মান করে, পারলে মাথায় তোলে এবং নিজের ভোট, মেধা ও অর্থ দিয়ে তার দুর্বৃত্তির ভাগী হয়। বাংলাদেশে ভাল মানুষের অভাব অতি তীব্র। সেটি বুঝা যায় মুজিবের প্রতি সন্মান ও হাসিনার পাশে অসংখ্য মানুষ দেখে।

বাংলাদেশে চোর-ডাকাত, খুনি, সন্ত্রাসী ও নানারূপ অপরাধীর সংখ্যাটি বিশাল। তবে শেখ মুজিব একা যে অপরাধগুলো করেছে তা বাংলাদেশের সকল অপরাধীগণও করতে পারিনি। দেশের সকল চোর-ডাকাত, খুনি ও সন্ত্রাসীগণ মিলে কখনোই জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনতাই করে বাকশালী স্বৈরাচার চাপায়নি। তারা ৩০ হাজারের বেশী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকেও হত্যা করেনি। দেশটিকে ভারতের গোলামও করেনি। দুর্নীতির জোয়ার এনে দেশে দুর্ভিক্ষ ও লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে মৃত্যুও ডেকে আনেনি। কিন্তু সে ভয়ানক অপরাধগুলো করেছে শেখ মুজিব।

বিস্ময়ের বিষয় হলো, সে অপরাধী মুজিবকে জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু বলা হয়। তেমনি ভয়ানক অপরাধী হলো শেখ হাসিনা। দেশের সকল চোর-ডাকাত, খুনি ও সন্ত্রাসী মিলে দেশের জনগণের ভোটের উপর ডাকাতি করতে পারিনি। তারা সবাই মিলে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটও করতে পারিনি। তারা জনগণের মৌলিক নাগরিক অধিকারও কেড়ে নেয়নি। কিন্তু সে ভয়ানক অপরাধটি করেছে শেখ মুজিবের ন্যায় শেখ হাসিনাও। অথচ এ ভয়ানক অপরাধীকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলার লোক কি দেশে কম? বিশ্বের কোন সভ্য দেশে এরূপ অপরাধীদের কি কখনো সন্মান দেয়া হয়? তারা তো স্থান পায় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

৫.
নিজের বসত ঘর ডাকাতেরা দখলে নিলে সে ঘরে আর বসবাস করা যায় না। তেমনি দেশ যখন দুর্বৃত্তদের দখলে যায়, তখন সে দেশও বসবাসের অযোগ্য হয়। তখন সে দেশে অসম্ভব হয় সভ্য সমাজ নির্মাণ। সভ্য সমাজের অর্থ বাড়ীঘর, রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কলকারখানা নয়; সে জন্য জরুরি হলো সভ্য মানুষ। ডাকাতদের পাড়াতেও বড় বড় ইমারত ও রাস্তাঘাট নির্মিত হতে পারে। কিন্তু তাতে সভ্য সমাজ নির্মিত হয় না, সেটি ডাকাত পাড়াই থেকে যায়।  সভ্য সমাজ নির্মাণের কাজটি শুরু করতে হয় দুর্বৃত্ত নির্মূলের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ আজ অধিকৃত দুর্বৃত্তদের হাতে। এবং এ দুর্বৃত্তরা অসম্ভব করে রেখেছে সভ্য সমাজ নির্মাণের কাজ।

৬.
পবিত্র কোর’আনে মুসলিমের গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো: “আশাদ্দু আলাল কুফফার ওয়া রুহামাও বায়নাহুম।” অর্থ: “এরা কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরে দয়াশীল।” –(সুরা ফাতাহ)। এটিই মুসলিম সংস্কৃতি। তাই মুসলিম হতে হলে তাকে কাফেরদেরকে সঠিক ভাবে চিনতে হয়, তেমনি তার প্রতি কঠোরও হতে। সে সাথে মু’মিনদেরকে চিনতে হয় এবং তাদের প্রতি দয়াশীলও হতে হয়। কাফেরগণ যেমন মহান আল্লাহতায়ালার শত্রু; তেমনি মুসলিমদেরও শত্রু। আল্লাহতায়ালার শত্রুকে ভালবাসাটি নিজেই এক বড় অপরাধ; এতে খুশি হয় শয়তান। এরূপ অপরাধ রহমত নয়, আযাব নামিয়ে আনে।

পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা কাফেরদের পরিচয়টি যেমন বার বার অতি সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছেন, তেমনি মু’মিনের পরিচয়ও তুলে ধরেছেন -যাতে মানুষ তাদের চিনতে ভূল না করে। পবিত্র কোর’আনে কাফেরদের এমন একটি রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরেছেন -যা কখনোই গোপন থাকার নয়। তাদের কথা, কর্ম ও বুদ্ধিবৃত্তিতে সেটি প্রকাশ পাবেই। সেটি হলো, তারা বিরোধী শরিয়তী আইনের। রাজনীতির ময়দানে তাদের যুদ্ধটি তাই মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। বিদ্রোহ এখানে তাঁর আইন ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। সাহাবাগণ তাই আল্লাহতায়ালার এ শত্রুদের নির্মূল করেছেন। অথচ বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে শরিয়তের শত্রুরা জাতির পিতা, দেশের বন্ধু, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খেতাব পায়! এমন আচরণ কি মহান আল্লাহতায়ালার রহমত বয়ে আনে?

৭.
আল-জাজিরার ডক্যুমেন্টারীর পর ভোটডাকাত শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশবিদেশে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিস্ময়ের বিষয়, এ ভোটডাকাত বলে কী? দেশবাসীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র করেছে শেখ হাসিনা নিজে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ডাকাতি করে নিয়েছে জনগণের ভোট।

৮.
কে সভ্য আর কে সভ্য –সেটি পরিমাপের সঠিক মাপকাঠি আছে। সভ্য মানুষ কখনোই বসত ঘরে মলমুত্র ও আবর্জনা রাখে না; নিজের ঘরকে সব সময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। তেমনি সভ্য জাতি কখনোই দেশকে চোরডাকাত, ভোটডাকাত ও দুর্বৃত্তের দখলে যেতে দেয় না। সে সম্ভাবনা দেখা দিলে সে যুদ্ধ শুরু করে। সভ্য মানুষ কখনোই দুর্বৃত্তকে পিতা, নেতা, বন্ধু ও মাননীয় বলে না। সেরূপ আচরণ নিতান্তই অসভ্যদের।

৯.
জনগণকে সভ্য করার কাজটি মহান আল্লাহতায়ালা যেখান থেকে শুরু করেছিলেন সেখান থেকেই শুরু করতে হয়। সেটি হলো কোর’আন শিক্ষা দিয়ে। না বুঝে তেলাওয়াতে সভ্য হওয়ার সে কাজটি হয় না। সে ব্যর্থতার উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। যারা বাংলাদেশের কল্যাণ চায় তাদের মূল কাজটি হতে হবে জনগণকে সভ্যতর করার কাজ। জনগণ সভ্যতর হলে অসভ্যদের নির্মূলে সে তখন নিজ গরজে যুদ্ধে নামবে।

১০.
গণতন্ত্র তখনই সফল হয় যখন জনগণ সমাজের নানাবিধ অপরাধীদের চেনার যোগ্যতা রাখে। কোনটি ন্যায় এবং কোনটি অন্যায় –সেটি বুঝে। এবং দুর্বৃত্তকে ঘৃনা ও সৎ ব্যক্তিকে ভালবাসার যোগ্যতা রাখে। নইলে নির্বাচন বার বার হলেও তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তখন জনগণের ভোটে শেখ মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের শত্রু এক বাকশালী ফ্যাসিস্ট, ভারতের এজেন্ট ও খুনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়। যে দেশে মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের শত্রু এক ফ্যাসিস্টকে জাতির পিতা বলা হয়, সে দেশে গণতন্ত্র বাঁচে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *