বিচারের নামে নগ্ন প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্র

লক্ষ্য রাজনৈতিক শত্রুনিধন

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে না থাকলে প্রতিপক্ষ নির্মূলে আওয়ামী লীগের কৌশল হয় অস্ত্র হাতে দলীয় কর্মীদের রাস্তায় নামানো। এ দলীয় সংস্কৃতি যে শুধু বাংলাদেশ আমলের তা নয়,পাকিস্তান আমলেও ছিল। পাকিস্তান আমল  আওয়ামী গুণ্ডাদের হামলায় বহু নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষ লাশ হয়েছেন। প্রমান,১৯৭০য়ের ১৮ই জানুয়ারিতে পল্টনে জামায়াতে ইসলামির জনসভা। বহু জনসভা পণ্ড হয়েছে এবং বহু মানুষ আহত হয়েছে ভাষানী ন্যাপ, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলের। লাশ হয়েছে এমনি সংসদের ডিপুটি স্পীকার শাহেদ আলী। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর তাদের শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাই বাড়েনি,প্রবল ভাবে বেড়েছে সন্ত্রাসের ক্ষমতাও। ফলে বেড়েছে খুনের সংখ্যাও। একমাত্র মুজিব আমলেই খুন হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। পিতার সে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে শেখ হাসীনা শুধু দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠাই করেননি, বরং বহুগুণে বৃদ্ধিও ঘটিয়েছেন। আর কোন কারণে না হোক, অন্ততঃ এ কারণে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন।

দলটির সশস্ত্র ক্যাডারদের হাতে সন্ত্রাসের ঘটনা এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। তাদের হাতে এ যাবত বহু নিরীহ মানুষ লাশ হয়েছে,বহু বিরোধী দলীয় কর্মী গুম হয়েছে,বহুনারী ধর্ষিতা হয়েছে,এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাম্পাসে ধর্ষণে সেঞ্চুরিও হয়েছে। দলটির হাতে ক্ষমতা গেলে সমগ্র প্রশাসন তখন লাঠিয়ালে পরিনত  হয়। তাতে বাড়ে বিরোধী পক্ষের কোমর ভাঙ্গার সামর্থ। দলীয় লাঠিয়াল দিয়ে কিছু লোককে হত্যা বা পঙ্গু করা যায়। কিন্তু তাতে পুরা দলকে নির্মূল করা যায় না,আন্দোলনকেও হত্যা করা যায় না। সে জন্য চাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। চাই রাষ্ট্রের বিশাল পুলিশ বাহিনী। পুলিশের সাথে চাই আদালতের লাঠিও। একমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পেয়েই শেখ মুজিব সকল বিরোধী দলকে রাতারাতি বিলু্প্ত করতে পেরেছিলেন। এবং দ্রুত নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই মুজিবী চেতনা। হাসীনা সে চেতনা নিয়েও ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছেন। ফ্রিডম পার্টি ও হিযবুত তাহরিরকে ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত করেছেন, এখন হাত দিয়েছেন জামায়াতের নির্মূলে। এর পর নিশ্চয়ই হাত পড়বে বিএনপির উপর। মুজিবের বাকশালী চেতনা এভাবেই প্রতিষ্ঠা পাবে বাংলাদেশে। তাছাড়া যাকে তারা সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বলে বছরের প্রতিদিন ও প্রতিঘণ্টা মাতামাতি করে তাঁকে এবং তাঁর আরধ্য চেতনাকে আবর্জনার স্তুপে ফেলবেই বা কেমনে? বাংলাদেশের জন্য মহা বিপদের কারণ এখানেই।

 

সেয়ানা পিতার চেয়েও

তবে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তিনি তাঁর পিতার চেয়েও সেয়ানা। মুজিব আমলে অন্ততঃ পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ন্যায় আর্মি অফিসারদের বিরুদ্ধে নির্মম হত্যাকাণ্ড হয়নি। আর্মী অফিসারদের লাশ হয়ে ড্রেনে পড়ে থাকতে হয়নি। অফিসারদের স্ত্রীদের ধর্ষিতাও হয়নি। পাকিস্তান থেকে ফেরা অফিসারদের রাজাকার বলে সেনাচাকুরি থেকে বরখাস্তও করা হয়নি। ইসলামী মৌলবাদের লেবেল এটে কাউকে বহিস্কারও করা হয়নি। শেখ মুজিব সেনা বাহিনীকে পৃথক রেখে আলাদা রক্ষিবাহিনী বানিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা পুরা আর্মিকেই রক্ষিবাহিনী বানিয়ে ফেলেছেন। এক সিরাজ সিকদারকে হত্যার পর শেখ মুজিব কোথায় সিরাজ সিকদার বলে উল্লাস করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনার কর্মিবাহিনীতো পুরা যাত্রীভর্তি বাসে আগুণ দিয়ে আরোহীদের হত্যা করে উল্লাস করে। নির্যাতনের হাতিয়ার এখন আর শুধু দলীয় ক্যাডার বা রক্ষিবাহিনীর সেপাইরা নয়, বরং সমগ্র থানা-পুলিশ,র‌্যাব, কোর্ট, প্রশাসন ও শত শত সরকারি উকিল। এক বিশাল রাষ্ট্রীয় শিল্পে পরিনত হয়েছে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা খাড়া করা ও তাদেরকে রিমাণ্ডে নিয়ে নৃশংস নির্যাতন করা। বিচার বিভাগের অন্যতম গুরু দায়িত্ব হয়েছে,থানা-পুলিশের হাত থেকে আওয়ামী লীগের কর্মীদের রক্ষা করা এবং গ্রেফতাকৃতদের উপর থেকে সকল প্রকার মামলা তুলে নিয়ে সত্বর মুক্তি দেয়া।

 

বিচারের নামে প্রহসন

আওয়ামী জোট সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের নামে বিচার শুরু করেছে। বিচারের নামে বাংলাদেশের মাটিতে যে কতটা অবিচার হতে পারে তা হলো যুদ্ধাপরাধীর এ বিচার। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, বিচারের কাজ সম্প্রতি শুরু হলেও অভিযুক্তদের উপর নিদারুন শাস্তি শুরু হয়ে গেছে প্রায় দুই বছর আগে থেকেই। বিচার নিছক বাহানা, মূল লক্ষ্য যে রাজনৈতিক বিপক্ষ নেতাদের রাজনীতির অঙ্গন থেকে সরিয়ে দেয়া সেটি বুঝতে কি বেশী বিদ্যাবুদ্ধি লাগে? বিচারের নামে বাংলাদেশে যে কত কুৎসিত অভিনয় হতে পারে এবং সরকার যে কতটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হতে পারে সেটিই এখন বিশ্ববাসী দেখছে। যে কোন আবিস্কারে মেধা লাগে। যে কোন খেলায় কৃতিত্ব দেখাতে প্রতিভা লাগে। কিন্তু কুৎসিত অভিনয়ে সে প্রতিভা লাগে না। বাংলাদেশের সরকার আজ সে কুৎসিত পথেই পা বাড়িয়েছে। বিদেশী পত্রপত্রিকায় এনিয়ে লেখালেখিও শুরু হয়ে গেছে। এ্যামনেস্টি ইন্টারনেশনালসহ বিশ্বের বহু মানবাধিকার সংস্থা ইতিমধ্যে তাদের গভীর অসন্তোষও জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিনামা আইনজ্ঞরা এ বিচার নিয়ে প্রচণ্ড আপত্তি তুলেছে। কিন্তু তা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ভ্রুক্ষেপও নাই। অন্যদের সহিংস নির্মূল যাদের রাজনীতির মূলনীতি তাদের মাঝে কি কোন মূল্যবোধ,নীতিবোধ ও সুবিচার থাকে? যাত্রী ভর্তি বাসে পেট্রোল ঢেলে আগুণ দেয়া, বিনা বিচারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হতা করা বা সরকারি সম্পদ লুণ্ঠন করা রাজনীতিতে গুরুত্ব পায় তো এমন নীতিহীনতার কারণেই। ডাকাত পাড়ায় এজন্যই কোন বিচার বসে না। বরং কোথায় নতুন ডাকাতি করা যায় তা নিয়ে বসে ষড়যন্ত্রের আসর।। তাই আওয়ামী লীগের মূল ব্যস্ততা জামায়াতে ইসলামী বা বিএনপির কাকে কিভাবে হাজতে তোলা যায় বা নির্মূল করা যায় তা নিয়ে। দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে পাঁচবার প্রথম হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ললাটে ইতিমধ্যেই বিশাল অপমান জুটেছে। এবার আরেক অপমান জুটতে যাচ্ছে বিচারের নামে প্রহসনমূলক প্রকাণ্ড নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে। যে দুর্বৃত্তির জোয়ারে রাজনীতি ও প্রশাসন ইতিমধ্যে ডুবে গেছে সেটি এখন ডুবাতে যাচ্ছে আদালতকেও।

 

বিশ্বাসঘাতকতা যেখানে দলীয় সংস্কৃতি

যে কোন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো ন্যায় বিচারের প্রতিষ্ঠা। জনগণ সরকার থেকে ভাত-কাপড় বা ঘরবাড়ি চায় না। জনগণ সে দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেয়। কিন্তু আদালত বসানোর সামর্থ জনগণের থাকে না। প্রতিদেশে সে সামর্থ থাকে একমাত্র সরকারের। কিন্তু সে দায়িত্ব পালনে আওয়ামী লীগ সরকারের কোন রুচি নাই, আগ্রহও নাই। দেশে প্রতিদিন বহু মানুষ খুন হচ্ছে। দুর্বৃত্তদের হাতে দখল হয়ে যাচ্ছে সরকারি জমি, সরকারি টেণ্ডার,রাস্তার গাছ,বনভূমি,নদীর তীর,সমুদ্রসৈকত। কিন্তু সেসব দুর্বৃত্তদের ক’জনকে ধরেছে সরকার? ক’জনকে এপর্যন্ত শাস্তি দিয়েছে? বরং আওয়ামী সরকারের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ন্যায় বিচারের পথকে সম্ভাব্য সকল ভাবে প্রতিহত করা। শেখ মুজিব গণতন্ত্রের কথা বলে ভোট নিয়েছিলেন,কিন্তু সরকার হাতে পাওয়ার পর গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়েছিলেন;প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বাকশালী স্বৈরতন্ত্র। উচ্চকণ্ঠে বাকস্বাধীনতার কথা বলতেন,তবে সেটি নিছক নিজের জন্য। জনগণের জন্য নয়। তাঁর ভাণ্ডারে বিরোধী দলের জন্য গণতন্ত্র ছিল না,বাকস্বাধীনতাও ছিল না। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেই শুধু নয়,বিরোধী পত্রিকাগুলোকেও তিনি নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে কাউকে কথা বলার অধিকার যেমন দেননি,তেমনি লেখার অধিকারও দেয়নি। এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর স্বৈরাচারি শাসন ব্রিটিশ আমলে যেমন ছিল না,পাকিস্তান আমলেও ছিল না। পাকিস্তান আমলকে উপনিবেশিক শত্রু শাসন রূপে চিত্রিত করা হয়। অথ সে আমলে আওয়ামী লীগই শুধু ষোলকলায় বেড়ে উঠেনি,বেড়ে উঠেছিল তাদের দলীয় পত্রিকা ইত্তেফাকও। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগের ছাড়াও বহু দল ছিল,বহু পত্রিকাও ছিল। কিন্তু সবই কেড়ে নিয়েছিল মুজিব। বাংলার ইতিহাসে এ এক বর্বরতার যুগ। কিন্তু আজ  সে বর্বরতার নায়কই আওয়ামী মহলের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। ফলে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের কথা তারা শিখবে কোত্থেকে? এই যাদের বিবেকের মান তাদের থেকে কি ন্যায় বিচার আশা করা যায়? ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের কথা শেখ মুজিবও বলতেন। অথচ কারারুদ্ধ সিরাজ সিকদারকে হত্যা করে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তিনি খোশ মেজাজে বলেছেন কোথায় আজ  সিরাজ সিকদার? কথা হলো মানুষ খুনের পর এমন দম্ভোক্তি ডাকাত পাড়ায় শোভা পেলেও পার্লামেন্টেও কি শোভা পায়? মুজিবামলে তাঁর দল, সরকার ও সংসদ যে কতটা বীভৎস ডাকাত পাড়ায় পরিণত হয়েছিল এ হলো তার প্রমাণ। তাঁর আমলে জেলের মধ্যে প্রাণ হারাতে হয়েছে প্রখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরিকে।

নিজ প্রতিশ্রুতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা শুধু শেখ মুজিবের একার নীতি নয়,সেটি আজও  আওয়ামী লীগের দলীয় নীতি। দলটির বর্তমান বিশ্বাসঘাতকতা শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার সাথেই নয়,ন্যায় বিচারের সাথেও। মুখে আইনের শাসনের কথা বললেও তারা আইনের শাসনকে অসম্ভব করে তুলেছে। সেটি তারা প্রমাণ করেছে, বিচারবহির্ভূত শত শত নাগরিকের হত্যার মধ্য দিয়ে। কথা হলো, বিচার বর্হিভূত হত্যা কি কোন সভ্য দেশে সরকারের হাতে ঘটে? সেটি তো সন্ত্রাসী ডাকাতদের কাজ। ন্যায় বিচার কখনই অভিযুক্ত মানুষের দলীয় পরিচয় দেখে না। বর্ণ,গোত্র,পরিবার বা ভাষাগত পরিচয়টিও দেখে না। দেখে তার অপরাধকে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে সে বিচারে অভিযুক্তদের দলীয় পরিচয়টি বড় করে দেখা হয়। আওয়ামী লীগ সেটি প্রমাণ করেছে বহু হত্যা মামলায় অভিযুক্ত নিজদলীয় আসামীদের মূক্ত করার মধ্য দিয়ে। প্রমাণ করেছে ফেনীর জয়নাল হাজারী,ঢাকার ডাক্তার ইকবাল, নোয়াখালির আবু তাহের এবং নারায়নগঞ্জের শামীম উসমানের মত শত শত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিয়ে। প্রশ্ন হলো,যারা র‌্যাব,পুলিশ ও নিজ দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে শত শত নাগরিককে বিচার ছাড়াই হত্যা করাতে পারে,তারা কি ন্যায় বিচারে আগ্রহী হয়? বরং তারা যে বিচারের নামে বিরোধী দলীয় কর্মীদের বছরের পর বছর বিনা বিচারে গ্রেফতার করে রাখবে,পুলিশী রিমাণ্ডে দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালাবে এবং ন্যায়বিচারকে নানা ভাবে বাধাগ্রস্ত করবে –সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? বাংলাদেশে এখন তো সেটিই হচ্ছে।

 

আদালত যেখানে রাজনীতির হাতিয়ার

স্বৈরাচারি সরকারের হাতিয়ার শুধু দলীয় কর্মী,দেশের পুলিশ ও প্রশাসনই নয়, নির্যাতনের আরেক হাতিয়ার হলো আদালত। সরকার তার রাজনৈতিক শত্রুদের শুধু রাস্তাতে বা বদ্ধ ভূমিতেই হত্যা করে না, ফাঁসীতে ঝুলিয়েও হত্যা করে। সরকার যখন স্বৈরাচারি বা ফাসিস্ট হয় তখন তেমন ঘটনা ঘটে আরো ব্যাপক ভাবে। তখন শুধু জনগণই ক্ষমতা হারায় না,ক্ষমতা হারায় আদালতের বিচারকগণও। রাজনৈতিক প্রয়োজনটাই তখন বড় হয়ে দেখা দেয়, ন্যায় বিচার নয়। এমনই এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জার্মানীতে বহু লক্ষ ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়। তখন সে হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোন বিচার হয়নি। বিচারকদের ন্যায়বিচার মুখি হতেও দেয়া হয়নি। অথচ বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা কোন সভ্য দেশের রীতি নয়। এটি তো পশুদের রীতি। কিন্তু বাংলাদেশে সেটিই এখন সরকারি রীতি। সরকারে হাতে এখানে গ্যাস চেম্বার নেই, কিন্তু আছে র‌্যাব ও পুলিশ। আছে বিশাল দলীয় ক্যাডার বাহিনী। একই লক্ষ্যে মুজিব আমলে ছিল বিশাল রক্ষিবাহিনী। সে সময় হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে রক্ষিবাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। মুজিব সরকার তাদেরকে অপরাধী বলতো। কিন্তু সে অপরাধ প্রমাণ করতে কোনদিন একমুহুর্তের জন্যও কোথাও বিচার বসেনি। আদালতে না পাঠিয়ে তাদেরকে বধ্যভূমিতে রক্ষিবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হত। এটিই ছিল মুজিবী নীতি।

আওয়ামী লীগ ভোট নেয় জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলে,অথচ সর্বত্র কায়েম করে দলীয় নেতা বা নেত্রীর সার্বভৌমত্ব। মুজিব আমলে সে সার্বভৌমত্ব ছিল একমাত্র শেখ মুজিবের। আর এখন সেটি শেখ হাসিনার। নিজস্বার্থের হেফাজতে এসব স্বৈরাচারিরা শুধু বিচারকদেরই নিয়োগ দেয় না,ঠিক করে দেয় ন্যায় বিচারের সংজ্ঞাও। তাদের দৃষ্টিতে ন্যায় বিচার তো তাই,যা তাদের মনঃপুত,এবং যা হেফাজত করে তাদের দলীয় স্বার্থ। তাদের বিচারে প্রচণ্ড অবিচার রূপে চিত্রিত হয় নিজ দলীয় খুনি ও ডাকাতদের জেলে রাখা বা তাদের বিচার করা। তেমন এক চেতনা নিয়েই শেখ হাসিনা শুধু তাঁর নিজের ও নিজ দলীর কর্মীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির মামলাই তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করেননি,নিজ দলীয় খুনিদেরও জেল থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন। বিচারমন্ত্রলায় এবং স্বরাষ্টমন্ত্রনালয়ের উপর বেঁধে দেয়া বড় দায়িত্বটি হলো বিরোধী দলীয় কর্মীদের সায়েস্তা করা। ফলে দেশে খুন, সন্ত্রাস, লুটতরাজ বাড়লে কি হবে, জেলগুলো ভরা হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে। কয়েক লক্ষ মামলা দেশের আদালতগুলোতে বিচারের অপেক্ষায় ঝুলছে,কিন্তু বিচার বসেছে একাত্তরে কারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তা নিয়ে। কারণটি বুঝা সহজ। খুনি, সন্ত্রাসী, ধর্ষণকারি ও চোর-ডাকাত জনগণের শত্রু হলে কি হবে, তারা আওয়ামী লীগের শত্রু নয়। ফলে তাদের নিয়ে দ্রুত বিচারের আগ্রহও তাদের নেই। একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল মুজিবামলেও। সে সময়ও অপরাধীদের দিক থেকে নজর ফিরিয়ে নজর দেয়া হয়েছিল রাজনৈতিক শত্রুদের নির্মূলে। ফলে রাস্তাঘাট নগর-বন্দর ও গ্রামগঞ্জ দখলে গিয়েছিল দুর্বৃত্তদের হাতে। আদালত সে সময় স্রেফ পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার অপরাধে যাবত জীবন কারাবাসের সাজা শুনিয়েছিল। কিন্তু যারা অবাঙালী ও পাকিস্তানপন্থিদের হত্যা ও তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাঠ, ও কলকারখানা জবর দখল করেছিল তাদের বিচার করেনি। বরং এ ভয়ংকর অপরাধীদের পুরস্কৃত করেছিল লুটকরা সম্পদ ও ঘরবাড়ির উপর অন্যায় দখলদারিকে আইনগত বৈধতা দিয়ে। শুধু তাই নয়, মুজিব সরকার অধ্যাপক গোলাম আযম, মা্ওলানা আব্দুর রহিম, জনাব খাজা খয়েরউদ্দীনসহ বহুনেতার নাগরিকত্বও কেড়ে নিয়েছিল। অথচ নাগরিকত্ব কেড়ে নিলে সে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে রাষ্ট্রহীন হয়। নাগরিকত্ব কোন সরকারের দান নয়, বাংলাদেশের ১৬ কোটি নাগরিক তাদের নাগরিকত্ব পেয়েছে কোন সরকারের করুণার কারণে নয়। বরং সেটি পেয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা মাফিক বাংলাদেশে জন্ম নেয়ার কারণে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ মহান আল্লাহতায়ালার পরিকল্পনা এবং তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ে খুশি নয়। যেমন তারা খুশি নয় তাঁর শরিয়তি আইনের অস্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে। তারা তো চায় নিজেদের দলীয় ইচ্ছার প্রতিষ্ঠা নিয়ে। নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীদেরকে রাজনীতির অধিকার দেয়া দূরে থাক, তাদেরকে তারা বাংলাদেশে বেঁচে থাকার অধিকার দিতে রাজীও নয়। দেশের সুপ্রিম কোর্ট জনাব গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিয়েছিল। আওয়ামী ঘরানার উকিল সে সময় অভিযোগ এনেছিল, জনাব গোলাম আযম যুদ্ধাপরাধী এবং সে কারণে তাকে নাগরিকত্ব দেয়া যাবে না।। কিন্তু আদালতে সে অভিযোগ সেদিন টিকেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ আদালতের সে রায়ে খুশি হয়নি। তাই তারা আবার তাঁকে আদালতে তুলেছিল। এবার তারা আদালতকেই নতুন ভাবে সাঁজিয়েছে। অথচ সভ্য দেশের রীতি ভিন্ন। কোন নাগরিক অপরাধ করলে সেখানে আদালতে তার শাস্তি হয়,কিন্তু তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় না। এমন কি যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে তাদেরও নয়।আওয়ামী লীগ নিজেও সেটি অন্যদের বিরুদ্ধে করছে না। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে হাজার হাজার চাকমা ভারতের মদদে যুদ্ধ করেছিল তাদের কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলাও হয়নি। অথচ চাকমা বিদ্রোহীদের হাতে মৃত্যু ঘটেছে বহু শত সামরিক ও অসামরিক নাগরিকের। আওয়ামী লীগের বিচারে কারা দলের শত্রু সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। কে দেশের শত্রু সেটির গুরুত্ব তাদের কাছে নাই। শেখ হাসিনা জানে, বিদ্রোহী চাকমাগণ বাংলাদেশের শত্রু হলেও আওয়ামী লীগের নয়। ফলে তাদের সাথে সন্ধি করতে তাদের আপত্তি নাই। জামায়াতের নেতাকর্মীগণ বাংলাদেশকে মেনে নিলে কি হবে,তারা তো আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শত্রু। এটিই জামায়াতের মূল অপরাধ। তাই বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর নির্মূল করাটা তাদের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াতের নির্মূলটা যে তাদের কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ সেটি বুঝা যায় তাদের নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের রাজপথের শ্লোগানে এবং পত্রপত্রিকায় তাদের লিখনীতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে এ অবধি যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দাবী কখনই ন্যায়-বিচার নয় বরং ফাঁসীর। বিচারে রায়টি কীরূপ হবে সে সিদ্ধান্তু নেয়ার দায়িত্ব যেন তাদের। আদালতের কাছে তাদের একমাত্র দাবী, রাজপথের সে ফাঁসীর দাবিটি আদালতের রায়েও ঘোষিত হোক এবং সত্বর কার্যকর করা হোক। তাদের আরো দাবী, আদালত সেটি নিশ্চিত করতে না পারলে গ্রেফতারকৃত নেতাদের তাদের হাতে তুলে দেয়া হোক। বিচার তখন তারা নিজেরাই করবে।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের মন যে কতটা বিষপূর্ণ ও প্রতিহিংসাপূর্ণ সম্প্রতি সেটির প্রকাশ ঘটেছে দলটির এক সংসদ সদস্য ও কলাম লেখক নুরুল ইসলামের লেখনীতে। ২১শে জানুয়ারীর যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচার নিয়ে আদালতের কাছে দাবী জানিয়েছেন, “বিচারের নামে মাফ নয়,ফাঁসীর বিচার চাই”। ভদ্রলোকের যুক্তি,ফাঁসী না হলে বুঝতে হবে সঠিক বিচার হয়নি, তাঁকে মাফ করে দেয়া হয়েছে। সঠিক বিচার নিয়ে এ হলো ভদ্রলোকের ধারণা। যেদেশে এভাবে বিচার বসে রাজপথে, উদ্যানে এবং পত্র-পত্রিকার রাজনৈতিক কলামে সে দেশে বিচারকগণ কি ন্যায় বিচার করতে পারেন? ন্যায়বিচারে কি তাদের রুচি থাকে? বিচারকগণ অতিমানব বা মহামানব নন। অন্যদের ন্যায় তাদেরও আবেগ আছে,স্বার্থপরতা আছে,রাজনৈতিক বিশ্বাসও আচ্ছে। সে সাথে নিজের ও নিজ পরিবারের নিরাপত্তার চিন্তাও আছে। আবেগ ও গুজবের স্রোতে শুধু সাধারণ মানুষই ভাসে না,তারাও ভাসেন। তাই বিচারাধীন মামলা নিয়ে কোন সভ্যদেশের রাজপথে,পত্রিকায় বা উদ্যানে কেউ নিজের রায় শুনায় না। এটি আইন-বিরুদ্ধ কাজ। অথচ সে আইনবিরুদ্ধ কাজটিই বাংলাদেশে রীতি। রায় শুনানো হয় রাজপথে,জনসভায় ও পত্রিকার পাতায়। রাজপথের রায় তখন আদালতে প্রবেশ করে। বিচারকগণ তখন চাপের মুখে থাকে। আওয়ামী লীগ ন্যায় বিচারকে অসম্ভব করছে মূলত এভাবেও।

 

মেঠো আদালত থেকে আদালত

মাঠে ময়দানে গরু-ছাগল বা আলু-পটল বিক্রির বাজার বসানো যায়, কিন্তু আদালত বসানো যায় না। কারণ আদালতের কাজ গরু-ছাগল বা আলুপটলের ক্রেতা-বিক্রেতার হাক-ডাকের বিষয় নয়। আদালতে বিচার বসে দিনের পর দিন ধরে। সেখানে হাকডাক বা শ্লোগানের দাম নাই। নিরপেক্ষ ভাবে সবকিছুর সেখানে গভীর বিবেচনা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে বিচার হলো ময়দানে গরু-ছাগল ও আলু-পটল বিক্রির বাজার। তাই তারা আদালত বসিয়েছিল ঢাকার সহরোয়ার্দী উদ্যানে। কোন সভ্য দেশে এমন আদালত বসানোর নজির নেই। কিন্তু বাংলাদেশ সে নজির স্থাপন করেছে। কোন আবিস্কারে নয়, অনাসৃষ্টিতে মানবতাশূন্য মগজ যে কতটা উর্বর এ হলো তার নজির। এমন লোকদের কাছে শাপ-শকুন ও মাটির মূর্তিও দেবতার মর্যাদা পায়। স্বৈরাচারি খুণিও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালীর মর্যাদা পায়। বাংলাদেশে সরকার,বুদ্ধিবৃত্তি ও আদালত যে কাদের হাতে জিম্মি সেটি কি এর পরও বুঝতে বাঁকি থাকে? ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সহরোয়ার্দী উদ্যানে যে আদালত বসিয়েছিল সে আদালতের একজন উকিল এখন বর্তমান যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারক। সহরোয়ার্দি উদ্দানের গণআদালতে মহা উল্লাসে যারা অধ্যাপক গোলাম আযমসহ বহুব্যক্তির ফাঁসীর রায় শুনিয়েছিলেন,তিনি তাদেরই একজন।। ফলে লক্ষ্য পরিস্কার। যে লক্ষ্য নিয়ে সোহরোয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত বসেছিল সে লক্ষ্য নিয়েই এখন ঢাকার পুরোনো হাইকোর্ট বিল্ডিংয়ে ট্রাইবুনাল বসেছে। সেদিন তারা রায় শুনিয়েছিলেন, কিন্তু সে রায় কার্যকর করতে পারেননি। কারণ তাদের হাতে তখন রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু এখন মাঠের সে ঘাদানিকগণ দেশের ক্ষমতা হাতে পেয়েছে। ফলে ফন্দি এঁটেছে, গণআদালতের সে ফাঁসীর রায় ট্রাইবুনালের হাত দিয়ে কার্যকর করে ছাড়বেন। আওয়ামী সংসদ সদস্য জনাব নুরুল ইসলাম তার প্রবন্ধে যুক্তি দেখিয়েছেন, জামায়াত নেতারা একাত্তরে স্বাধীন বা্ংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে এদেশে বসবাসের অধিকার হারিয়েছে। বুঝাতে

প্রশ্ন হলো, জনাব নুরুল ইসলামের এরূপ কথার মধ্যে কি মানবতার নামগন্ধ আছে? স্বাধীনতা আন্দোলন কালে প্রতিদেশেই প্রচুর বিরোধ থাকে। একই দেশ, একই আলোবাতাস ও একই জলবায়ুতে বসবাস করেও সবাই একই ভাবে দেশের মানচিত্রকে গড়তে চায় না। স্বাধীনতার স্বপ্নও সবাই একই ভাবে দেখে না। তার অর্থ এই নয় যে তারা দেশের শত্রু। বাংলার বুকে প্রথম স্বাধীনতা এসেছিল ১৯৪৭য়ে। তখন বাংলার মুসলমানদের কাছে স্বাধীনতা ছিল পাকিস্তানভূক্তির মধ্যে। আর হিন্দুরা সে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিল। সে আন্দোলন কালে বহু হাজার মুসলমান হিন্দু গুণ্ডাদের হাতে মারাও গিয়েছিল। মুসলমানের রক্তে কলকাতার রাস্তায় স্রোত বয়েছিল। আগুণ দেয়া হয়েছিল মুসলিম মহল্লায়। ধর্ষিতা হয়েছিল মুসলিম নারী। কিন্তু ১৯৪৭য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লক্ষ লক্ষ হিন্দু পাকিস্তানে থেকে যায়। পাকিস্তানের বিরোধীতাকারী কংগ্রেসী নেতাদের কি সেদিন আসামীর কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল? বিলুপ্ত হয়েছিল কি তাদের পাকিস্তানে বসবাসের অধিকার? তাদের কাউকে কি সেদিন ফাঁসীতে ঝুলানো হয়েছিল? বরং ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও মনরঞ্জন ধরের ন্যায় কংগ্রেসী নেতারা সেদিন পাকিস্তানের সংসদে বসেছেন। ভোগ করেছেন পুরা নাগরিক অধিকার।

 

বিচারের মান কি আন্তর্জাতিক?

প্রশ্ন হলো, যুদ্ধাপরধীদের বিচারে গঠিত ট্রাইবুনালটির মান কি আন্তর্জাতিক? ট্রাইবুনালের সকল বিচারকই বাংলাদেশী। উকিলগণও বাংলাদেশী।কোর্টের কেরানী, পেশকার এবং আর্দালীরাও বাংলাদেশী। বিচার বসেছে ঢাকার একটি কোর্ট বিল্ডিংয়ে। এ আদালতে আসামীর পক্ষে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার যোগ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে সে অধিকার দেয়া হয়নি। ফলে কোন বিচারে এটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল? আন্তর্জাতিক তো তখনই হয় যখন তারা সাথে একাধিক জাতির নাগরিক যুক্ত হয়। আদালতের নামকরণেই যাদের এত অবিচার তারা কিসের সুবিচার করবে? তাছাড়া বিচার প্রক্রিয়াও কি আন্তর্জাতিক মানের? সভ্যদেশে আদালত শুধু বাদীকেই বিচার লাভের অধিকার দেয় না, আসামীকেও ন্যায় বিচার লাভের অধিকার নেয়। নইলে অসম্ভব হয় ন্যায়-বিচার। আসামীর অধিকারটি হলো, পুলিশ তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ করলো, তদন্তের নামে কি রিপোর্ট দাখিল করলো সেটি জানার। সেটি না জানলে আসামী আদালতে তার জবাবী ব্ক্তব্য রাখবে কি করে? কিন্তু আদালত সে অধিকার মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে দেয়নি। তার উকিল কোর্টে আরজি পেশ করেও পুলিশের তদন্ত রিপোর্টের কপি পাননি। এটি কি ন্যায় বিচারের নীতি? তাছাড়া বিশ্বের প্রতি আদালতে আপিলের সুযোগ থাকে, কিন্তু এ আদালতে সে সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে বুঝা যায়, এখানে লক্ষ্য ন্যায়-বিচার নয়, বরং অন্যকিছু।

আদালতের বিচারকদের যোগ্যতা ও ন্যায়-বিচার নিয়ে আসামীর সন্দেহ বা অভিযোগ থাকলে তার স্থলে অন্য বিচারক লাভের অধিকারটি বিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু তা স্বীকৃতি পায়নি এ আদালতে। বিচারকের অদক্ষতায় বা পক্ষপাতিত্বে বড় ক্ষতিটি হয় আসামীর।সে ভূলে তার প্রাণও যেতে পারে,বা আজীবন কারাবাসও হতে পারে। তাতে সরকারের কোন ক্ষতি হয় না। ফলে বিচারকের যোগ্যতা নিয়ে আসামীর সন্দেহ দূর করাটি আদালতের দায়িত্ব। সেটি সরকারের দায়িত্বও। কিন্তু সে অধিকার এখানে আসামীদের দেয়া হয়নি। দাবী উঠেছিল,ঘাতক দালাল নির্মূলের রাজনীতির সাথে সক্রিয় ভাবে যারা জড়িত এমন ব্যক্তিদের বিচারকের পদ থেকে সরানো হোক। দেশে আদালত থাকতে গণআদালত কোন সভ্য সমাজের রীতি নয়। গণআদালত বসানোর অর্থ,আইনকে নিজ হাতে তুলে নেয়া। কোন সভ্যদেশের সরকারই এভাবে আদালতের কাজকে নিজ হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কাউকে দেয় না। দেশের সংবিধান ও আইন-আদালতের বিরুদ্ধে এটি শুধু অবমাননাই নয়,সুস্পষ্ট বিদ্রোহ। তাই এটি শাস্তিযোগ্য মহা অপরাধ। অথচ গণআদালতের আয়োজকগণ সেটিই করেছিল। এমন বিদ্রোহের সাথে জড়িত ব্যক্তির বিচার-বিবেচনার সামর্থ ও নৈতিক সুস্থ্যতা নিয়ে সন্দেহ জাগাটাই বরং স্বাভাবিক। অথচ সে বিদ্রোহের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদেরই একজনকে এ ট্রাইবুনালের বিচারক করা হয়েছে। আদালতে এমন বিচারকের অংশগ্রহনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আপত্তি উঠলেও আদালত তা শুনেনি। অথচ বিচারকের বিচারবোধ ও নৈতিক সুস্থ্যতা নিয়ে বিচারপ্রার্থির পক্ষ থেকে আপত্তি উঠার প্রেক্ষিতে তাকে সরিয়ে অন্য বিচারক দেয়া যেত। দেশে বিচারকের অভাব ছিল না। কিন্তু ইচ্ছা করেই সেটি করা হয়নি। এখানে অভাব বিচারকের নয় বরং নিরপেক্ষ বিচারবোধের।

 

আলামত আমূল বিপ্লবের

আওয়ামী লীগ নিজ দলের জোয়ার দেখেছে, ভাটাও দেখেছে। কিন্তু কোন শিক্ষাই নেয়নি। পঁচাত্তরে শেখ মুজিব মারা গেলেও আওয়ামী লীগ বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু এবার টান পড়ছে আওয়ামী লীগের নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। কারণ,দেশে এখন ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে। এ বিপর্যয়ের মূল কারণ শুধু শেখ হাসিনা নয়, বরং খোদ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ বেঁচে থাকলে শেখ হাসিনারা নানা নামে বার বার ক্ষমতায় আসবে। মানুষ সেটি বুঝতে শেখেছে। আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের জন্য দেশধ্বংসি সুনামী। দেশের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থের প্রতি এদলের নেতাদের অধিক অঙ্গিকার। ভারতের চাইতেও তারা বেশী ভারতীয়। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষিদের হাতে বাংলাদেশী যুবক নৃশংস অত্যাচারের শিকার হলে ভারতীয় পত্রিকায় তা নিয়ে প্রতিবাদ উঠেছে। ইংরেজী দৈনিক “হিন্দু” এ নিয়ে ভারত সরকারকে মাফ চেতে বলেছে। কিন্তু মুখে তালা লাগিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের মুখে এ নিয়ে কোন নিন্দাধ্বনি নেই। জমিদারের জঘন্য অপরাধ স্বচোখে দেখেও গোলাম তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে না। কারণ সে সাহস তার থাকে না। তেমনি অবস্থা শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের।

চাল-ডাল-চিনিসহ সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের দাম এখন আকাশচুম্বি। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুবক এখন বেকার। ভেঙ্গে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা। বিধ্বস্ত হয়েছে শেয়ার বাজার। হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠিত হয়েছে শেয়ার বাজার থেকে। দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসীদের হাতে মানুষ খুণ হচ্ছে পথে ঘাটে। পানি-বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। দেশের পানি সম্পদের উপরে হাত পড়েছে প্রতিবেশী দস্যু রাষ্ট্রের। দেশের সমস্যা এখন গোলাম আযম নয়,নিজামী বা মোজাহিদও নয়। তাদের ফাঁসী দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং বাড়বে। দেশের মূল সমস্যা এখন শেখ হাসিনা ও তার দলীয় দুর্বৃত্তরা। আওয়ামী লীগ এখন দলের নাম নয়, বরং এক ভয়ানক মহামারির নাম। মুজিব মারা গেলেও এ ভয়ানক রোগটি রেখে গেছেন। সে মহামারিতে মুজিব আমলে বহু লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। এখন সেটিই প্রবল প্রতাপে জেঁকে বসেছে।

 

দেশ বিস্ফোরণের দিকে

অবিচার ও দুঃশাসন যে কোন দেশেই বিস্ফরোন ঘটায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিপ্লব আজ সে উদাহরণই তুলে ধরছে। আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই তার দুঃশাসনের মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে ঘৃনার পেট্রোল ছড়িয়েছে। সর্বক্ষেত্রে মন্দা দেখা দিলেও প্রচণ্ড উৎপাদন বেড়েছে ঘৃনার। ফলে দেশ এখন বিস্ফোরণ-উম্মুখ। সরকার যে সেটি বুঝে না তা নয়। বরং হাসিনা ও তার সরকার প্রচণ্ড নার্ভাস। বিস্ফোরণমুখি এ অবস্থা থেকে বাঁচতেই বিচারের নামে তিনি জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে হঠাতে চাচ্ছেন। সামরিক অভ্যুর্থানের কিসসাও শুনাচ্ছেন। শেখ হাসিনা জানেন, একমাত্র ভারত ছাড়া তাঁর বন্ধু নাই। তাই সামরিক অভ্যুর্থানের কিসসা শুনিয়ে তিনি ভারতীয়দের দেশের অভ্যন্তরে ডাকবার পথ তৈরী করছেন। এসবই নিছক নিজের গদী বাঁচানোর স্বার্থে। কখনো ভাবছেন, বিরোধী জামায়াত নেতাদের নির্মূল করতে পারলে তাঁর গদী বাঁচবে। অথচ তারা সমগ্র বাংলাদেশ নয়। দিন দিন বিক্ষুব্ধ হচ্ছে সমগ্র জনগণ। বিচারের নামে যদি অবিচার হলে সরকার পতনের আন্দোলনই তীব্রতর হয়।

শহীদের রক্ত জাতীয় জীবনে ঈমান শূণ্যতা দূরে করে। যেদেশে ইসলামের পক্ষে শহীদ নেই সে দেশের মানুষের মাঝে ঈমানের বলও নাই। মদিনার ন্যায় একটি গ্রাম থেকে যত শহীদ তৈরি হয়েছিল ১৬ কোটির বাংলাদেশ থেকে বিগত বহু শত বছরেও তা সৃষ্টি হয়নি। ফলে জেঁকে বসেছে অপরাধীদের শাসন। বাংলাদেশে শহীদদের এখন বড় প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ সে সুযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের জন্য খুবই কল্যাণ করছে। এতে ত্বরিৎ মরণ আসবে ইসলামের দুষমনদের। শয়তানী শক্তির অত্যাচারে যেটি নিশ্চিত হয় সেটি আল্লাহতায়ালার সাহায্য লাভ। তখন ফিরাশতারা জমিনে নেমে আসে। কোরআনে সে বিবরণ অনেক। মহান আল্লাহর সে প্রতিশ্রুতি সর্বকালের সংগ্রামী মুসলমানদের জন্য। সে সাহায্য লাভে আল্লাহতায়ালা রাসূল হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না,বরং প্রয়োজনটি প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার। তাঁর রাস্তায় জিহাদে আত্মনিয়োগ করার। ফিরাউনের অত্যাচারের ফলে বনি ইসরাইলীদের বাঁচাতে সাগর বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আসমান থেকে নেমে এসেছিল মান্না ও সালওয়া। আওয়ামী লীগ যে ইসলামের বিপক্ষ শক্তি তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? এ দলটিই কি সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থার বানী বিলুপ্ত করেনি? যার ভিতরে সামান্যতম ঈমান আছে সে কি এমন কুকর্ম করতে পারে? এরূপ কুকর্ম তো তাদের,যারা আল্লাহর অবাধ্য। তাই ইসলামপন্থিদের হারাবার ভয় নেই। বরং রয়েছে বিজয়ের বিশাল সম্ভাবনা। বিপদে পড়েছে বরং খোদ আওয়ামী লীগ। তারা দিশেহারা। বিশ্ব জুড়ে এখন ইসলামী বিপ্লবের জোয়ার। ইতিমধ্যেই তুরস্ক, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, সূদান, আলজিরিয়ার ন্যায় বহু দেশে স্বৈরাচারি দুর্গের পতন ঘটেছে। বিজয়ীর বেশে এখন জনগণ। শেখ হাসিনা হোসনী মোবারকের চেয়ে শক্তিশালী নয়। বাংলাদেশের ইসলামী জনতাও মিশরের চেয়ে সংখ্যায় কম নয়। ইতিমধ্যেই ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কুকীর্তিগুলোর বিবরণ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মিডিয়াতে লাগাতর প্রকাশ পাচ্ছে। সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে শেখ হাসিনার পরিচয় হিন্দু ভারতের পদলেহী সেবাদাসী রূপে। তাঁর সরকার এখন দেশে-বিদেশে এক ঘরে। অনুরূপ অবস্থা হয়েছিল তাঁর পিতা শেখ মুজিবেরও। সংবিধান থেকে আল্লাহর আস্থার বানীটি বিলুপ্ত করে শেখ হাসিনা সুস্পষ্ট ভাবেই শয়তানের থলিতে আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্গার মন্ডপে গিয়ে দুর্গাকে “মা দুর্গা” এবং “দুর্গা এবার গজে চড়ে এসেছে” বলে নিজের ভ্রষ্টতা ও শয়তানের পক্ষে তাঁর নিজের অবস্থানটি সুস্পষ্ট করেছেন। ফলে শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে আল্লাহর সাহায্য আসবে না। অথচ সাহায্য তো একমাত্র আল্লাহ থেকেই আসে। যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, “ওয়া মা নাসরু ইল্লা মিন ইন্দিল্লাহ” অর্থঃ “এবং কোন সাহায্যই নাই একমাত্র আল্লাহর সাহায্য ছাড়া”। -(সুরা আনফাল আয়াত ১০)।

দেশে যারা শেখ হাসিনার একমাত্র বন্ধু তারা হলো গণধিকৃত নাস্তিক বামপন্থিরা। এরা আজন্মের মেরুদণ্ডহীন পরগাছা। এক কালে এরা রাশিয়া ও চীনের লেজুড়বৃত্তি করতো, এখন আওয়ামী লীগের পদধুলি নিয়ে ভারতের লেজুড়বৃত্তি করছে। শয়তানের ঝাঁকের কই রূপে তারা ঝাঁকে মিশে গেছে। অপর দিকে বাংলাদেশ আজ  আর একাত্তরের ন্যায় ভারতমুখি বাংলাদেশ নয়। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে অতি বিক্ষুব্ধ এক প্রতিরোধী জনগন। শত শত বই লিখে বা হাজার হাজার বক্তৃতা দিয়ে আওয়ামী লীগের যে কুকর্মগুলো তুলে ধরা যেত না, জনগণ এখন সেটি স্বচোখে দেখছে। ফলে জনগণ উপচে পড়ছে বিরোধী দলগুলোর সভাসমিতি ও রোডমার্চে। বাংলাদেশের জন্য এ এক চরম মুহুর্ত। তাছাড়া ভারতও তার নিজের দুর্বৃত্ত চেহারাটাকে সীমান্তে কাঁটাতারর বেড়া,লাগাতর বাংলাদেশী হত্যা,পদ্মা-তিস্তা-সুরমা-কুশিয়ারা পানি ডাকাতির মধ্য দিয়ে প্রকট ভাবে তুলে ধরেছে। জনগণকে আরো বিক্ষুব্ধ করেছে সামরিক ক্যুর ছুতা ধরে বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ যত অস্থিরতাই থাক এটি এক চরম আশাপ্রদ দিক। কথা হলো শীত যখন এসেছে বসন্ত কি আর দূরে থাকতে পারে? ২৬/০১/১২

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *