বাংলাদেশে ডি-ইসলামাইজেশন

ডি-ইসলামাইজেশনের অর্থ, ইসলাম থেকে মুসলমানদের দূরে সরানো। সেটি হয় দুই ভাবে| এক, অন্যধর্মে দীক্ষা বা ধর্মান্তরের মাধ্যমে। দুই, ইসলামের মুল লক্ষ্যে অনাগ্রহ বা দায়িত্বপালনে নিষ্ক্রীয় করে। বাংলাদেশে এবং সে সাথে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের ভয়ানক ক্ষতিটি হয়েছে শেষোক্ত পথে। বিগত হাজার বছরে খুব কম সংখ্যক মুসলমানই খৃষ্টান, বৌদ্ধ, পৌত্তলিক বা কাফের হয়েছে। কিন্তু ইসলামের প্রকৃত অনুসরণে প্রচন্ড নিষ্ক্রীয় হয়ে গেছে অধিকাংশ মুসলমান। ফলে বিগত কয়েক শত বছরে মুসলমানদের সংখ্যা বহুগুণ বাড়লেও শক্তি বাড়েনি। বরং উপর্যুপরি পরাজয় ও বিপর্যয় বেড়েছে। আইন-আদালত থেকে নির্বাসিত হয়েছে আল্লাহর আইন। প্রকৃত অবস্থা হল, নবীজী ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম যে ইসলাম অনুসরণ করতেন সে ইসলামই বেশী অপরিচিত বা বিদেশী হয়ে গেছে খোদ মুসলিম ভূমিতে। সনাতন ইসলামের বদলে বরং মুসলিম সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে সূদ, ঘুষ, মদ্যপান, পতিতাবৃত্তি, নাচগান, বেপর্দা, কবরপুজা ইত্যাদির ন্যায় কুফুরি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উপাদানগুলো।

মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু আরবীতে নাম রাখা নয়। বরং সেটি হল আল্লাহর সাথে তাঁর প্রদর্শিত পথ তথা সিরাতুল মোস্তাকীমে আজীবন চলায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া এবং সে চুক্তিটি অলংঘ্যনীয়। চুক্তিটি ভঙ্গ করা বা আল্লাহর প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুতির অর্থ কাফের বা মোনাফিক হয়ে যাওয়া। এমন বিচ্যুতির অনিবার্য পরিণাম জাহান্নাম। ফলে এ বিচ্যুতি থেকে বাঁচাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁচা। সমগ্র মানব জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বিতীয়টি নেই। অঢেল সম্পদ, প্রাসাদতূল্য ঘরবাড়ী, সন্তান-সন্ততি, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি –কোনটিই অনন্ত অসীম পরকালীন জীবনে সামান্যতম কল্যাণ দিবে না। প্রকৃত কল্যাণ দিবে এ পথভ্রষ্টতা থেকে কতটা বাঁচা হলো সেটি। পথভ্রষ্টতার বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ঈমানদারকে প্রতিদিন পাঁচবার নামাযে ডেকে সেটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। নামাযের প্রতি রাকাতের শুরুতে যে দোয়াটি পাঠ না করলে নামাযই হয় না সেটি সম্পদ, সন্তান-সন্ততি বা রাজ্যলাভের জন্য নয়, বরং সেটি হল সিরাতুল মোস্তাকিম প্রাপ্তীর আন্তরিক আকুতি। প্রতিটি ঈমানদারকে বলতে হয়, “ইয়্যা কানাবুদু ওয়া ইয়্যা কানাস্তায়ীন। এহদিনাস সিরাতুল মোস্তাকিম।” অর্থঃ (হে আল্লাহ! আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার থেকেই সাহায্য চাই। আমাদেরকে সহজ সরল পথ তথা সিরাতুল মোস্তাকিম দেখান।” মানব জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন দোয়া নেই। চাওয়াও নাই। এ দোয়াটিতে চাওয়া হয় সবচেয়ে বড় চাওয়াটি। দোয়াটি ছোট, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ। এ দোয়ার মধ্যে প্রকাশ পায় ঈমানদারের জীবনের মূল মিশন। দোয়াটি শিখিয়েছেন মহাজ্ঞানী ও মহা করুণাময় মহান আল্লাহ নিজে। 

মানুষের অযোগ্যতার কথা মহান আল্লাহর চেয়ে আর কে বেশী জানে? অধিকাংশ মানুষের সবচেয়ে বড় ভূলটি হয় কোনটিতে মঙ্গল আর কোনটিতে অমঙ্গল সেটি চিনতে। এমন অযোগ্যতার কারণেই মানুষ অন্তহীন আখেরাতের কল্যাণ ভূলে দুনিয়ার কল্যাণ অর্জনে মৌলবী ডেকে দোয়ার মজলিস বসায়। দোয়ার মধ্যে ধরা পড়ে প্রাণের মূল আকুতি ও প্রায়োরিটি। আল্লাহর কাছে চাওয়ায় ব্যক্তি মনের আসল কথাটি লুকায় না। ভিতরের সেকুলারিজম তথা ইহজাগতিকতা তখন দোয়ার মধ্যে সুস্পষ্ট হয়। ভাল চাকুরি, ভাল বেতন, অধিক সন্তান-সন্ততি ও ব্যবসায় উন্নতির ন্যায় পার্থিব চাওয়া-পাওয়াটাই তখন চাওয়ার মূল বিষয়ে পরিণত হয়। গুরুত্ব হারায় সিরাতুল মোস্তাকিমের আকুতি। এমন ব্যক্তিরাই স্বার্থ উদ্ধারে সিরাতুল মোস্তাকিম ছেড়ে সিরাতুশ শয়তানের পথ ধরে। ডি-ইসলামাইজেশন ঢুকেছে এভাবে মোনাজাতে। সিরাতুল মোস্তাকিমের প্রতি আগ্রহ হ্রাস পাওয়ার কারণে সেটি অর্জনে অন্যকে ডেকে তাই দোয়ার আসর বসানো হয় না। অথচ মুসলিম দেশে পরিবার, সমাজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজসহ সকল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাজ হল আল্লাহর পথে চলার সামর্থ বাড়ানো। জীবনকে পরকালমুখী করা এবং পরকালের জবাবদেহীতাকে তীব্রতর করা। এটিই হল ইসলামাইজেশন। অপরদিকে শয়তানী প্রতিষ্ঠানের কাজ হল, সে পথ থেকে বিচ্যুতি বাড়ানো। সে বিচ্যুতিকরণ প্রক্রিয়াই হল ডি-ইসলামাইজেশন। এটি ইসলামের মুল চেতনা, লক্ষ্য ও মিশন থেকে মুসলমানদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ। মুসলমানের ঈমান ও আমল বন-জঙ্গলে গড়ে উঠে না। এজন্য অপরিহার্য হল উপযোগী পরিবেশ। মুসলমানদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এবং সে রাষ্ট্রের শিক্ষা-সংস্কৃতি, মসজিদ-মাদ্রাসা, মিডিয়া ও বইপত্র মূলতঃ সে পরিবেশই সৃষ্ঠি করে। অপরদিকে ডি-ইসলামাইজেশন বাড়াতে কাজ করে অসংখ্য শয়তানী প্রতিষ্ঠান। সেগুলোর মাঝে প্রধান হলো, সেকুলার রাষ্ট্র ও তার বিচার-ব্যবস্থা ও প্রশাসন, সেকুলার শিক্ষা-ব্যবস্থা, সেকুলার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন, সেকুলার সাহিত্য, নাচ-গানের আসর, পতিতালয়, মদ্যপান ও জুয়ার আসর, সূদী ব্যাংক, ইত্যাদি। 

আল্লাহর পথে পথচলায় সফলতা অর্জন করতে হলে পুরা পথটাই চলতে হয়। হাজারো মাইলের যাত্রাপথে যদি এক মাইল পথও বাঁকি থাকে তবে তাতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছা যায় না। পথে যেমন নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আসে, তেমনি ধুসর মরুভূমি, দুর্গম পাহাড়, নদ-নদী, অশান্ত সমূদ্রও আসে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হলে বাঁধাবিঘ্নতা যত বিশলই হোক, তা দেখে দমে গেলে চলে না। ধৈর্য ধরে ও কষ্ট সয়ে সবটাই চলতে হয়। সফলতা তো আসে এভাবেই। নইলে ব্যর্থতা অনিবার্য। একই রূপ অবস্থা আল্লাহর পথে পথ-চলায়। এ পথে শুধু নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাতই আসে না, আসে সংগ্রাম ও প্রতিরোধ। আসে রক্তাত্ব লড়াই ও জিহাদ। আসে আর্থিক ও দৈহিক ক্ষয়ক্ষতি। আসে মৃত্যু। তবে বাধাবিঘ্নতা ও ক্ষয়ক্ষতি যত বিশালই হোক, আল্লাহর নির্দেশিত সিরাতুল মোস্তাকিমে চলা পথে থামার সুযোগ নেই। বিচ্যূত হওয়ারও সুযোগ নেই। বিচ্যুত ও পথভ্রষ্ট ব্যক্তিকে আল্লাহপাক অভিশপ্ত দোয়াল্লীন বলেছেন। তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নামের কঠিন আযাব। অপর দিকে পৌঁছার আগে নিজ ইচ্ছায় থেমে গেলে ব্যর্থ হয় পূর্বের সকল মেহনত। প্রকৃত মুসলমানের কাছে সেটিও তাই অভাবনীয়। পথ চলা শেষ হতে পারে একমাত্র শাহাদতে, রোগ-ভোগে অথবা মৃত্যুতে। কথা হল, বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের মাঝে ক’জন এধাপ গুলো অতিক্রম করে আল্লাহর রাস্তায় পুরা পথটা চলেছেন? কতজন নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাতের গন্ডি ডিঙ্গিয়ে আরো সামনে এগিয়েছেন? অথচ সাহাবাগণ চলেছেন পুরাটা পথ। সে পথচলায় শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। 

যেদেশে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান, সেদেশে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে ইসলামিকরণ বা ইসলামাইজেশন তীব্রতর হবে সেটিই কাঙ্খিত। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি হয়নি। বাংলাদেশের মুসলমানদের বড় ব্যর্থতা এখানেই। তারা নিজেদেরকে মুসলিম রূপে পরিচয় দিচ্ছে নিজ দেশ ও সমাজের ইসলামিকরণ না করেই। ব্যক্তির জীবনে ইসলাম গুরুত্ব পেলে জগত ও জীবন নিয়ে সমগ্র ধারণাই পাল্টে যায়। পাল্টে যায় জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পাল্টে যায় তার নৈতিক চরিত্র, আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য-পানীয়, কর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। একজন কাফের থেকে জীবনের এসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে কতটা পার্থক্য সৃষ্টি হল তা থেকেই নির্ণীত হয় মুসলমান হওয়ার পরিমাপ। নবীজী (সাঃ)র আমলে সে পার্থক্যটি ছিল প্রচন্ড। কাফেরদের থেকে সাহাবাদের পার্থক্য শুধু নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাতের ক্ষেত্রে ছিল না। আল্লাহ, রাসূল, পরকাল, দোযখ-বেহেশত ও হাশর দিনের বিশ্বাস নিয়েও নয়। সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল জীবনের স্বপ্ন, লক্ষ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে। যে ব্যক্তি পূর্ব দিকে যায় সে কি পশ্চিমে যাওয়া ব্যক্তির সাথে কি একই ট্রেনে উঠতে পারে? পারে না। তেমনি মুসলমানও পারে না কাফের বা সেকুলার ব্যক্তির সাথে একই লক্ষ্যে রাজনীতি করতে। পারে না যুদ্ধবিগ্রহেও অংশ নিতে। কারণ জীবনের ভিশন, মিশন ও লক্ষ্যের ন্যায় কখনই এক হতে পারে না উভয়ের রাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহ। হাদীসে আছে, দুনিয়ার এ জীবনে যাদের সাথে জীবন কাটবে পরকালেও তাদের সাথেই হবে তাদের আবাসস্থল। অর্থাৎ এ দুনিয়ায় যাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহ কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে, পরকালেও তাদেরকে কাফেরদের সাথে জাহান্নামে যেতে হবে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে কি সেটিই বেশী হয়নি? মুসলমানের রাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহ হল আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করার হাতিয়ার। অপরদিকে কাফেরগণ এ একই অস্ত্র ব্যবহার করে ইসলামের নির্মূলে। সমাজে ও রাষ্ট্রে ইসলামীকরণ কতটা বাড়লো সেটি ধরা পড়ে কাফের রাষ্ট্র থেকে মুসলমানদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আচরণগত পার্থক্য কতটা বাড়লো তা থেকে। অপর দিকে ইসলাম থেকে দূরে সরাটি যতই বিশাল হয় ততই বিলুপ্ত হয় সে পার্থক্য। কাফের ভারতের রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও অর্থনীতি থেকে বাংলাদেশের পার্থক্য এজন্যই সামান্য। এরূপ অভিন্নতার কারণে একাত্তরে ভারতীয় কাফেরদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ লড়তে বাংলাদেশী সেকুলারদের কোন আপত্তি হয়নি।    

দৈর্ঘ্য-প্রস্থ যেমন পরিমাপ করা যায় তেমনি পরিমাপ করা যায় দেশে বা সমাজে অনৈসলামের মাত্রাও। আর সেটি হল দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইন-আদালত ও শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামের বিধিবিধান, মূল্যবোধ ও শিক্ষা কতটা বিজয়ী তার উপর। আর এসব ক্ষেত্রজুড়ে বাংলাদেশে যে ধ্যানধারণা ও মূল্যবোধ বিজয়ী সেটি ইসলাম নয়। বাংলাদেশের সেকুলারগণ এ বিজয়ী চেতনাকে বলছে একাত্তরের চেতনা। ব্যক্তির জীবন-চেতনাই তাকে স্বপ্ন দেখায় এবং সে স্বপ্ন থেকেই নিজের জীবনকে সে অনুযায়ী গড়ে তোলার প্রেরণা এবং সে পথনির্দেশনা পায়। তাই সেজন্যই জীবনের সফলতা নিয়ে একজন মুসলমানের স্বপ্ন এবং কাফেরের স্বপ্ন এক নয়। এক নয় স্বপ্নের জগত। এক নয় সফলতা ও বিফলতার মাপকাঠিও। এজন্যই আজকের ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে একজন মুসলিম ও একজন কাফের বা সেকুলারের ভাবনা এক নয়। একাত্তরের চেতনাধারীরা এজন্যই হিন্দু ভারতের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সাথে যেভাবে একাত্ম হতে পারে সেটি অন্য ভাষার বা অন্যদেশের মুসলমানদের সাথে তেমনটি পারে না। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে মসজিদ ও মাদ্রাসার সংখ্যা বিপুল হারে বাড়লেও দেশে ইসলামিকরণ বাড়েনি, বরং দিন দিন সেটি কমছে। আর সেটি ধরা পড়ছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভিশন, মিশন ও রাজনীতিতে। ভিশন হল সেই স্বপ্ন যা একজন ব্যক্তি তার নিজের ভবিষ্যৎকে নিয়ে দেখে। অনৈসলামিকরণের ফলে অনিবার্য রূপে যেটি ঘটে সেটি হল, মুসলিম ও অমুসলিমের স্বপ্নের মানচিত্রের যে বিভাজনের সীমারেখা সেটির বিলুপ্তি। ইসলামি শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল, চেতনার সে ভিন্ন মানচিত্রকে মজবুত করা। সেটি ধ্বসে গেলে মুসলমানের পৃথক রাজনৈতিক ভূগোলও বাঁচে না। সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থা সে চেতনার পৃথক মানচিত্রকেই ধ্বসিয়ে দেয়। বাংলাদেশে সেটিই ঘটেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশটির হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও নাস্তিকগণ যে স্বপ্ন দেখে, সেই অভিন্ন স্বপ্ন দেখে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানগণও। 

খরস্রোতা নদীর স্রোতের ন্যায় সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক স্রোতও অতি প্রবল। সে স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচতে হলে যেটি প্রয়োজন তা হল, ঈমানের বল। আর সে বল আসে কোরআন থেকে। এজন্যই কোরআনের জ্ঞানার্জন প্রতিটি নরনারীর উপর ফরয। আর বাংলাদেশে সে কোরআন চর্চাই বাড়েনি। ফলে পালিত হয়নি সে ফরয। কোরআন চর্চার নামে দেশে যে কাজটি হয় সেটি হল কোরআন পাঠ বা তেলাওয়াত, কোরআন বুঝা নয়। অনেক আলেম একথাও বলেন, “কোরআনা বুঝা সাধারণ মানুষের কাজ নয়, একাজ আলেমদের।” ভাবটা এমন, সাধারণ মুসলমানের কাজ তেলাওয়াতের ন্যায় নফল কাজে ব্যস্ত হওয়া, কোরআন বুঝার ন্যায় ফরয কাজে নয়। এভাবে রুদ্ধ করা হয়েছে ইসলামি জ্ঞানের প্রসারের কাজ এবং মুসলিম সমাজে হিন্দুধর্মের অনুকরণে একশ্রেণীর পরগাছা ব্রাক্ষ্মণ শ্রেণী গড়ে তোলা হয়েছে। আর সাধারণ মুসলমানদেরকে খুঁটিনাটি মসলা-মাসায়েলসহ ইসলামি জ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে তথাকথিত আলেমদের উপর নির্ভরশীল করা হয়েছে। আর এভাবে বন্ধ করা হয়েছে সমাজের ইসলামিকরণের কাজ। অথচ আলেম হওয়া প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ। কারণ, ঈমানের খাদ্য ও ইসলামিকরণের মূল হাতিয়ার হল এই কোরআনী জ্ঞান। পানাহার ছাড়া যেমন স্বাস্থ্য বাঁচে না তেমনি কোরআনী জ্ঞান ছাড়া ঈমানও বাঁচেনা। দেশের মানুষের শারীরিক সুস্থ্যতা বাড়াতে যেমন প্রতি গ্রামের প্রতি ঘরে খাদ্যের সরবরাহকে সুনিশ্চিত করতে হয় তেমনি মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা নিশ্চিত করতে প্রতি ঘরের প্রতি ব্যক্তির কাছে কোরআনের জ্ঞানকে পৌঁছাতে হয়। মুসলিম রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের এর চেয়ে বড় দায়িত্ব নেই। রাস্তাঘাট, কলকারখানা ও কৃষির উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ, তবে ঈমানদার গড়ার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নেই। একমাত্র এ পথেই মানুষের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি নিশ্চিত হয়। নবীজীর আমলে মুসলমানদের সে সীমিত লোকবল ও অর্থবল থাকা সত্ত্বেও নবী পাক (সাঃ) এমন কি অনিরাপদ স্থানেও তাঁর সাহাবাদের পাঠিয়েছেন এবং বহু সাহাবা শহীদও হয়েছেন। কিন্তু সে জন্য কোরআনের জ্ঞান প্রচারের কাজ বন্ধ করেননি। এভাবে যতই বেড়েছে কোরআনের জ্ঞান, ততই বেড়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের ইসলামিকরণ। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজ গুরুত্ব পায়নি। ফলে বেড়েছে ডি-ইসলামাইজেশন। বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও আইন-আদালত থেকে ইসলাম হঠানোর কাজ এতটা সফলতা পাচ্ছে তো একারণেই। তেমনি ভোটের লড়াইয়ে বিজয়ী হচ্ছে ইসলাম বিরোধী পক্ষ। বিশাল বাজার পাচ্ছে মদের দোকানদার, পতিতা, সূদী ব্যাংকার, অশ্লিল সিনেমা ও নাচগানের নট-নটিরা। 

কোরআনী জ্ঞানের অভাবে এমনকি নামায কালাম পড়েও সাধারণ মুসলমানেরাও বেড়ে উঠছে ইসলামের প্রতি চরম দায়িত্বশূণ্যতা নিয়ে। ফলে চোখের সামনে আল্লাহর দ্বীন পরাজিত ও তার বিধান ডাস্টবিনে যেতে দেখেও তাদের মধ্যে কোন শিহরন জাগে না। আল্লাহর এ সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত কোরআনকে কিছু লোকের মাঝে সীমিত রেখে সমগ্র সমাজকে কি ইসলামী করা যায়? তাই একটি সমাজ কতটা ইসলামি হল সেটির সঠিক ধারণা মসজিদ-মাদ্রাসা গণনা করে পাওয়া যায় না। মুসলমানের শতকরা হার গণনা করেও সে পরিচয় মেলে না। দেখতে হয় সে সমাজে কোরআনী জ্ঞানের বিস্তার ও সে জ্ঞানে অনুপ্রাণিত মানুষের সংখ্যা। বাংলাদেশে মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা ৯০ভাগের বেশী। নবীজী (সাঃ)র আমলে আরবের মানুষ এমন হারে ঈমান আনেনি। বাংলাদেশের একটি জেলায় যত মুসলমানের বাস সে সময় সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রে এত মুসলমানের বাস ছিল না। কিন্তু সে আমলে মদিনার ন্যায় এক ক্ষুদ্র শহরে যত আলেম গড়ে উঠেছিলেন তা বাংলাদেশের ন্যায় অতি জনবহুল দেশে বিগত হাজার বছরেও গড়ে উঠেনি। মুসলমানদের প্রতিটি ঘর পরিণত হয়েছিল মাদ্রাসায়। ফলে মাত্র কয়েক বছরে ইসলামি জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার গড়ে উঠেছিল। অথচ বাংলাদেশে ইসলামের ইতিহাস ৮ শত বছরেরও বেশী। কিন্তু ১০০ বছর আগেও বাংলাদেশের মুসলমানেরা কোরআনের একখানি তফসিরও লেখেনি। কোরআনী জ্ঞানের এমন দারিদ্রতা নিয়ে কি রাষ্ট্রে ইসলামাইজেশনের স্বপ্ন দেখা যায়? বিজয়ী হয় কি ইসলাম?       

ডি-ইসলামাইজেশনের কাজটি যে শুধু অমুসলিম কাফেরদের দ্বারা হচ্ছে তা নয়, হচ্ছে মুসলমানদের দ্বারাও। সেকুলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, এনজিও, সেকুলার মিডিয়া, সেকুলার সাহিত্য ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিই ডি-ইসলামাইজেশনের মূল কারণ নয়। এ কাজটি চরম ভাবে হচ্ছে দেশের আলেম ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বনি ঈসরাইলের বিরুদ্ধে যে মূল অভিযোগ এনেছেন সেটি এ নয় যে তারা পৌত্তলিক, নাস্তিক বা কাফের হয়ে গিয়েছিল। এটিও নয় যে, তারা মূসা (আঃ) ও তাঁর উপর নাযিলকৃত তাওরাত কিতাবকে অবিশ্বাস করতো। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি এনেছেন তা হল, আল্লাহর দ্বীনকে তারা পূর্ণভাবে অনুসরণই করেনি। আল্লাহর বাণীতে তারা ইচ্ছামত পরিবর্তন এনেছিল। গাফলতি করেছিল আনুগত্যে। সিরাতুল মোস্তাকিমের পুরা পথটি তারা চলেনি। গন্তব্যস্থলে পৌঁছার বহু আগেই তারা বিচ্যূত হয়েছে। ভেসে গেছে সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক স্রোতে। ভেসে গেছে নিজেদের স্বার্থ চিন্তায়। মূসা (আঃ) মাত্র ৪০ দিনের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন, আর এর মধ্যেই তারা গরু-পুঁজা শুরু করেছিল। মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে সিনা উপত্যাকার ধূসর মরুর বুকে ৪০ বছর মেঘের ছায়া দিয়েছিলেন। আসমান থেকে মান্না সালওয়া নামিয়ে খাইয়েছেন। এরপর তাদেরকে যখন কানান থেকে জালেমদের জবর দখল হটানোর হুকুম দিলেন তখন তারা হযরত মূসা (আঃ)কে বলেছিল, “যাও তুমি ও তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।” ইসলামি চেতনা সমৃদ্ধ কোন জনগোষ্ঠি কি এমন কথা বলতে পারে? এ ভাষা তো বিদ্রোহের। আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে এমন বিদ্রোহ তাদের উপর আল্লাহর আযাবকেই ত্বরান্বিত করেছিল। 

ডি-ইসলামাইজেশন একটি উম্মাহকে কিভাবে আল্লাহর প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত করে সে বিষয়ে জ্ঞানদান করেছেন মহান আল্লাহতায়ালা স্বয়ং নিজে। সে বিষয়ে তিনি উপমা পেশ করেছেন বনি ইসরাইলের ইতিহাস থেকে। মহান আল্লাহতায়ালার অপার নেয়ামত পেয়েছে বনি ইসরাইল। সবচেয়ে বড় নিয়ামত ছিল, আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রদর্শিত সিরাতুল মোস্তাকিম যা অবিরাম দেখাতে তিনি ইহুদীদের জনপদে বহু নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। কিন্তু তারা সে পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। ডি-ইসলামাইজেশনের এ এক করুণ চিত্র। তবে এ বিচ্যুতির কারণ সেকুলার মিডিয়া, সেকুলার এনজিও, পৌত্তলিক কাফের বা বিধর্মী মিশনারী ছিল না। আল্লাহপাক সে জন্য বনি ইসরাইলের আলেমদের দোষী বলেছেন। রাষ্ট্র জুড়ে অজ্ঞতার অন্ধকার দেখে সেটিকে গালী দেওয়া অহেতুক। প্রকৃত দোষী তো সেসব ব্যক্তি যাদের উপর আলো জ্বালানোর দায়িত্ব ছিল কিন্তু তারা সে দায়িত্বই পালন করেনি। বনি ইসরাইলের আলেমগণ সে অপরাধে অপরাধী। আজকের মুসলিম বিশ্বের বিশেষ করে বাংলাদেশের আলেমদের অপরাধ ও ব্যর্থতাও তাদের চেয়ে ভিন্নতর নয়। পবিত্র কোরআনে প্রচন্ড জোর দেয়া হয়েছে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, 
“তোমাদের মধ্যে অবশ্যই একটি উম্মাহ থাকতে হবে যারা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে এবং ন্যায়ের হুকুম দিবে এবং অন্যায়কে রুখবে। এবং তারাই হল সফলকাম।” –(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৪)। 

সফলতার পথ নিছক নামায-রোযা নয়, হ্জ্ব-যাকাতও নয়, বরং সে লক্ষ্যে ঈমানদারকে আরো সামনে এগুতে হয়। সফলতা আসে কল্যাণের পথে ডাকা এবং ন্যায়ের হুকুম এবং অন্যায়কে রুখার মধ্যে। রাষ্ট্রে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলের এটিই হল মূল কৌশল। এটিই হল ইসলামাইজেশন। মুসলমানের জীবনের এটিই হল মূল মিশন এবং এ পথেই আসে পরকালের সফলতা। যে ব্যক্তি পবিত্র কোরআন মনযোগ সহকারে পড়বে সে ব্যক্তির কাছে আল্লাহর সহজ সরল এ নির্দেশটিও সুস্পষ্ট হবে যে, সফলতা লাভের পথ শুধু তাবলীগের পথ নয়। তাকে আরো সামনে যেতে হয়। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরো্ধেও তাকে বহু দূর অগ্রসর হতে হয় এবং সে পথে অগ্রসর হলে সংঘাত ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনিবার্য। এমন যুদ্ধ এড়াতে পারেননি মহান নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম। বাংলাদেশের মুসলমানদের সমস্যা, লক্ষ লক্ষ মানুষ দ্বীনের তাবলীগে পথে বেরুলেও এর বেশী তারা এগুতে রাজী নয়। অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার যে কোন উদ্যোগকে তারা বলছে মৌলবাদ। এমন চেতনাকে বলছে চরমপন্থি ইসলাম। অথচ মুসলমানের ঈমানের মূল পরীক্ষাটি তো হয় এক্ষেত্রটিতেই। কোরআনের মূল জোর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় ও অন্যায়ের প্রতিরোধে। এ কাজের মধ্যেই ইসলামিকরণের মূল চাবিকাঠি। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম তো এগুলোই করেছেন।            

বাংলাদেশের মুসলমানদের বড় দূর্ভাগ্য হল, ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে তাদের পরিচয় লাভই হয়নি। এদেশটিতে ইসলাম প্রচার লাভ করেছে বিদেশ থেকে আগত সূফীদের দ্বারা। সূফীগন ইসলামের কিছু মজহাবগত বিষয়ের প্রচার করলেও নবীজী (সাঃ) ও তার সাহাবাগণ যে সিরাতুল মোস্তাকিমটি পুরাপুরি অতিক্রম করেছিলেন, তা তারা করেননি। তারা কোরআনের বিধানকে বিজয়ী করতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নেননি। অথচ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের বিষয়টি নবীজীর অতিগুরুত্বপূর্ণ সূন্নত। একাজ ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য ব্যক্তি বা বাদশাহদের হাতে ছেড়ে দিলে সে সমাজে ইসলামের বিজয় আসে না, রাষ্ট্রের ইসলামিকরণও হয় না। অথচ সূফীগণ নবীজী (সাঃ)র সে সূন্নত বা আদর্শকে নিজেরা যেমন পালন করেননি তেমনি বাংলাদেশের মুসলমানেরকেও সেটি পালনে অনুপ্রাণিত করেননি। ইসলামেরর পথে কিছু দূর এগিয়ে তারা আর এগুননি। ফলে শুরু থেকেই বাংলাদেশে ইসলামিকরণের কাজটি পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। 

কোরআনের সাথে আলেমদের এমন আচরণ শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। একই পথের পথিক ভারতীয় আলেমগণ। বরং বাংলাদেশের আলেমগণ এক্ষেত্রে ভারতীয় আলেমদের অনুসারি মাত্র। একথা অনস্বীকার্য যে তারা বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা গড়েছেন। আজীবন কোরআন-হাদিসের জ্ঞান বিতরণও করেছেন। কিন্তু সে সব মাদ্রাসায় কোরআনচর্চা কীরূপ হয়েছে তার উপর অভিমত এসেছে উপমহাদেশের দুইজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন থেকে। তাদের্ একজন হলেন শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদুল হাসান। আরেকজন হলেন মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী। শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদুল হাসানকে অনেকে সে সময়ের মোজাদ্দেদও মনে করেন। তাঁকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে মাল্টা দ্বীপে কারাবন্দী করেছিল। মাল্টা জেল থেকে মূক্তি পাওয়ার পর দেওবন্দে তিনি তৎকালীন ভারতের প্রখ্যাত আলেমদের এক বৈঠক ডাকেন। সে জলসায় মাওলানা মূফতি শফি (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের গ্রান্ড মূফতি), মাওলানা হোসেন আহমেদ মাদানী, মাওলানা শাব্বির আহম্মদ ওসমানিসহ ভারতের বড় আলেমরা উপস্থিত ছিলেন। সে জলসায় মাওলানা মাহমূদুল হাসান বলেন, আমি মুসলমানদের দুরাবস্থার কারণ নিয়ে যা কিছু চিন্তা ভাবনা করেছি তা থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে মুসলমানদের এ দূর্দশার কারণ মূলতঃ দু’টি। 

প্রথম কারণটি হল, কোরআনের জ্ঞানার্জনে গুরুত্ব না দেওয়া। দ্বিতীয় কারণটি, মুসলমানদের অনৈক্য। এসব আলেমগণ বেশী জোর দিয়েছেন হাদীস ও ফিকাহর উপর। তাদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলো বহু হাদীস বিশারদ জন্ম দিয়েছে, কিন্তু খুব কমই মোফাস্সিরে কোরআন সৃষ্টি করেছে। মুফতি শফি লিখেছেন, মাওলানা মাহমূদুল হাসান দু’টি কারণের কথা বল্লেও তা মূলতঃ একটি। আর সেটি হল, কোরআনের জ্ঞানে অনিহা। মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী উপমহাদেশের আরেক প্রখ্যাত দেওবন্দি আলেম। তারই এক শিষ্য তাঁকে একদিন অতিশয় বিচলিত ও পেরেশান দেখলেন। তাকে তাঁর পেরেশানির কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, বড় দুশ্চিন্তায় আছি আল্লাহর দরবারে কি করে জবাব দিব। তার শিষ্য জিজ্ঞেস করলেন, “হুজুর, আপনি সারাজীবন হাদিস পড়িয়েছেন, দ্বীনের খেদমত করেছেন। আপনার দুশ্চিন্তার তো কারণ দেখি না। আপনি কেন এত পেরেশান হবেন।” আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী বলেন, “সারাজীবন হানাফী মজহাবের ফিকাহগত ফায়সালাগুলোকে সঠিক প্রমাণিত করার চেষ্টা করেছি। অথচ শাফেয়ী মজহাবের বিষয়গুলোও তো সঠিক হতে হবে।” এ অবস্থা শুধু আনোয়ার শাহ কাশ্মিরীর নয়, অনুরূপ অবস্থা প্রায় অধিকাংশ আলেমদেরও। তারা ফেরকাগত ও মাজহাবগত বিষয়ে এতটা বেশী ডুবে ছিলেন যে কোরআনের জ্ঞান বিতরণের তেমন ফুরসতই পাননি।         

কোন ঈমানদার ব্যক্তি মুসলিম উম্মাহর বিভক্তিতে কখনই খুশি হতে পারেনা, তেমনি সে বিভক্তির কাজে অংশ নিতে পারে না। আর বিভক্তি সৃষ্টি করা যেমন হারাম তেমনি সেটিই টিকিয়ে রাখাও হারাম। সমাজ যখন ইসলামি হয় তখন সে বিভক্তিগুলোও বিলুপ্ত হয়। আর যখন অনৈসলামের পথে যাত্রা শুরু করে তখন সে বিভক্তি আরো গভীরতর হয়। তাই ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশে যেরূপ প্যান-ইসলামী চেতনা ছিল সেটির কথা এখন ভাবাই যায় না। বাংলাদেশে যতই বাড়ছে ডি-ইসলামাইজেশন ততই বাড়ছে বিশ্বের অন্যভাষার মুসলমানদের থেকে দূরত্ব। ভারতের নানা ভাষাভাষী হিন্দুরা আজ একতাবদ্ধ। একতাবদ্ধ ইহুদী ও খৃষ্টানরাও। কিন্তু প্রচন্ডভাবে বিভক্ত মুসলমানেরা। আল্লাহর কাছে এমন বিভক্তি বড্ড অপছন্দের। যার অন্তরে ঈমান আছে, মুসলিম বিশ্বের এমন বিভক্তি তার মনে মাতম সৃষ্টি করবে সেটিই কি কাঙ্খিত নয়? কিন্তু সে মাতম সাধারণ মুসলমান দূরে থাক এমনকি আলেম-উলামা ও ইসলামি সংগঠনের নেতাদের মাঝেও সৃষ্টি হয় না। বরং সে বিভক্তি আজ তাদের কাছেও উৎসবের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎসবের সে আয়োজনে আলেম ও ইসলামী দলের নেতারাও মিলিত হচ্ছে দেশের ইসলামের দুষমন সেকুলারদের সাথে। ডি-ইসলামইজেশন যে কতটা গভীরভাবে দেশের আলেম ও তথাকথিত ইসলামি সংগঠনগুলোকে গ্রাস করেছে এ হল তার নমুনা। সারা জীবন নামায পড়েও লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী মুসলমান মুসলিম উম্মাহর একতার পক্ষে কিছু করা দূরে থাক তা নিযে বলিষ্ঠ কোন আওয়াজও তুলছে না। ময়দানে নামছে না অন্যায়ের প্রতিরোধে ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায়। অথচ এমন আচরণ হল আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, প্রশাসন ও আইন-আদালতসহ দেশটির সর্বত্র জুড়ে এ বিদ্রোহীরাও আজ বিজয়ী। ডি-ইসলামাইজেশনের এর চেয়ে বড় নজির আর কি হতে পারে?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *