বাংলাদেশে কেন অসভ্য সরকার?

কেন এ নৃশংস অসভ্যতা?

যে দেশের সেনাবাহিনীর লোকেরা নিজ দেশের নাগরিকদের খুন করে লাশ নদীতে ফেলে অর্থ কামায় সে দেশকে কি সভ্য দেশ বলা যায়? সে সরকারও কি সভ্য, যে সরকার নিরস্ত্র মানুষের উপর সশস্ত্র সেনা লেলিয়ে দিয়ে শতশত মানুষকে হতাহত করে এবং নিহতদের লাশ ময়লার গাড়িতে তুলে গায়েব করে দেয়? অথচ রাজধানীর শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ই মে তারিখে তো সেটিই হয়েছিল। বহু হাজার সৈনিককে ভারি অস্ত্রসহ সেদিন শাপলা চত্ত্বরে হাজির করা হয়েছিল নিরস্ত্র মুসল্লিদের উপর গুলি চালানোর জন্য। কোন সভ্য সরকার কি নিজ দেশের নিরস্ত্র নাগরিকদের উপর সেনাবাহিনী দিয়ে গুলি চালায়? সারিবদ্ধ বালিবুঝাই ট্রাক দিয়ে অবরোধ করে কি বিরোধী দলীয় নেত্রীর বাসা? বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করা, গুম করা, রিমান্ডের নামে নির্যাতন সেলে নিয়ে দৈহীক অত্যাচার করা -কোন ধরণের সভ্যতা? বিরোধী দলের অফিসে ভাংচুর করা, তাদের অফিসে তালা লাগিয়ে দেয়া, বিরোধী পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া, বিরোধীদের দলীয় নেতাকর্মীদের রাজপথে সমাবেশ করতে না দেয়া, এমন কি তাদেরকে নিজ অফিসে মিটিং করতে না দেয়াও কি সভ্যতা? অথচ বিরোধী দল দমনে এরূপ নৃশংস বর্বরতাই হলো শেখ হাসিনা সরকারের নীতি। কোন সভ্য সরকার কি কখনো নির্বাচনের নামে ভোট ডাকাতি করে? সংসদের অর্ধেকের বেশী সিটে নির্বাচন ছাড়াই কি সংসদ গঠন করে? কোন সভ্যদেশের আদালত কি দলীয় ক্যাডারদের দাবীতে বিচারের রায় পাল্টায়? অথচ বাংলাদেশে এরূপ অসভ্যতা অহরহ হচ্ছে। এরূপ নানা অসভ্যতার পাশাপাশি দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হওয়াটিও কি কম বর্বরতা? তাছাড়া সরকারের অসভ্যতা শুধু ঘটে যাওয়া নৃশংস বর্বর অপরাধগুলোর বিচার না করা নয়,বরং এরূপ অসংখ্য অপরাধের সাথে তার নিজের সংশ্লিষ্টতাও।

জাতীয় জীবনে কদর্যতা স্রেফ সরকারের ব্যর্থতার কারণে আসে না। সেটি অনিবার্য হয় সর্বসাধারণের ব্যর্থতায়। জাতির অর্জিত সফলতার কৃতিত্ব যেমন প্রতিটি নাগরিকের, তেমনি ব্যর্থতার দায়ভারও প্রতিটি নাগরিকের। দেশগড়ার কাজে সমগ্র দেশবাসী একটি দলবদ্ধ টিম রূপে কাজ করে। টিম হারলে যেমন সে টিমের সবাই হারে, তেমনি জাতির বেলায়ও। দেশ গড়া, শান্তিপ্রতিষ্ঠা ও দেশের প্রতিরক্ষার দায়-দায়িত্ব তাই কিছু নিছক রাজনৈতিক নেতা,দেশের প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের নয়। এ কাজ সমগ্র দেশবাসীর। এটি খেলার বিষয় নয় যে,মুষ্টিমেয় খেলোয়াড়গণ খেলবে এবং আমজনতা দর্শকরূপে তা দেখবে। বরং এ কাজ রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, আলেম-উলামা, ছাত্র-শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মচারি, সেনাসদস্য, কৃষক-শ্রমিকসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের। একটি জাতি যখন নীচে নামতে থাকে তখন সে নীচে নামার কারণ বহু। তবে মূল কারণটি হলো,দেশ গড়া ও দেশের প্রতিরক্ষার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ কাজে জনগণের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনা না করা। জাতির ঘাড়ে যখন দুর্বৃত্ত্ব সরকার চেপে বসে তখন পাড়া থেকে চোর-ডাকাত তাড়ানোর মত ঘাড় থেকে সে দুর্বৃত্ত্ব সরকার নামানোর  দায়িত্বটিকে জনগণকে নিজ হাতে নিতে হয়। বহু  জাতি সে কাজে যুদ্ধও করেছে। কিন্তু জাতি বিপদে পড়ে যখন সে কাজগুলি মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির হাতে সীমাবদ্ধ হয় এবং বাঁকিরা দর্শকে পরিণত হয়। সকল বিফলতার জন্য তখন শুধু সেই মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের দায়বদ্ধ করা হয়।পলাশির যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা যখন অস্তমিত হলো তখন শুধু সিরাজুদ্দৌলার পরাজয় হয়নি বরং পরাজিত হয়েছিল বাংলার সমগ্র মানুষ। এ পরাজয়ের জন্য শুধু মীর জাফরকে দায়ী করে অসুস্থ চেতনার মানুষই শুধু নিজের দায়ভার ও দুঃখ কমাতে পারে, বিবেকবান মানুষ তা পারে না। সে পরাজয়ের জন্য দায়ী ছিল বাংলার সমগ্র মানুষ।

একটি দেশ কতটা সভ্য -সে বিচারটি দেশের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, গাছপালা, ক্ষেত-খামার দিয়ে হয় না। ইট-পাথর ও লোহালক্কর দিয়ে নির্মৃত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বা কলকারখানার সংখ্যা দিয়ে হয় না। বরং সে বিচারটি হয় সেদেশের মানুষের মান, শাসকের মান এবং আদালতের বিচার ও আইনের মান দিয়ে। হালাকু-চেঙ্গিজের ন্যায় চোর-ডাকাতের হাতে দেশ গেলে সেখানে ঘরবাড়ি,রাস্তাঘাট ও প্রাসাদ নির্মিত হলেও সভ্যতা নির্মিত হয়না। ইসলাম তার প্রাথমিক কালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা জন্ম দিয়েছে কোন তাজমহল,পিরামিড বা কোন বিস্ময়কর প্রাসাদ না গড়েই। তারা জন্ম দিয়েছিল এমন বিবেকমান শাসকের যারা চাকরকে উঠের পিঠে চড়িয়ে নিজে উঠের রশি ধরে সামনে চলাকে নিজের নৈতীক দায়িত্ব মনে করেছে। প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল এমন উন্নত আইনের যে আইনের স্রষ্টা কোন মানুষ ও পার্লামেন্ট ছিল না, ছিলেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। সে শরিয়তি আইনে নারী-পুরুষ তার মৌলিক স্বাধীনতা ও অধিকার পেয়েছিল। বিলুপ্ত হয়েছিল আদি আমল থেকে চলে আসা দাসপ্রথা। নারী শিশুরা সেদিন জীবন্ত দাফন হওয়া থেকে বেঁচেছিল। সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল চোর-ডাকাতেরা। বিলুপ্ত হয়েছিল মদ্যপান, জুয়া ও ব্যাভিচারের ন্যায় আদিম অপরাধ। নানা ধর্মের মানুষ সে সমাজে নিরাপদে বাস কবতে পারতো। সে রাষ্ট্রে কোন কালেই কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেনি।অথচ বাংলাদেশ আজ হালাকু-চেঙ্গিজের ন্যায় বর্বর চোর-ডাকাত ও খুনিদের হাতে অধিকৃত। এদের হাতে যে শুধু ব্যাংক ডাকাতি হচ্ছে বা শেয়ার বাজার লুট হচ্ছে তা নয়, ডাকাতি হচ্ছে ভোটের বাক্সতেও। হাত পড়ছে মানুষের ইজ্জত-আবরু ও জানের উপরও। সাধারণ মানুষ আজ পথে-ঘাটে লাশ হচ্ছে। মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্র আজ আস্তাকুঁরে গিয়ে পড়েছে। স্বৈরাচার আাজ মুজিব আমলের বাকশালী নিষ্ঠুরতার চেয়েও ভয়ংকর রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে। ডাকাতেরা যেমন গৃহকর্তার হাত-পা বেঁধে বা তাকে খুন করে লুন্ঠন করে, তেমনি দেশবাসীকে বন্দি করে এবং তাদের উপর অত্যাচার ও হত্যাকান্ড চালিয়ে অতিশয় দুর্বৃত্ত্বরা আজ দেশ শাসন করছে। দেশ অসভ্যতায় রেকর্ড গড়ছে তো একারণেই।

তবে এরূপ ভয়াবহ অবস্থায় দেশ একদিনে পৌঁছেনি। রোগ ধীরে ধীরে বেড়ে অবশেষে একদিন শরীরের পতন ঘটায়। যে চোর-ডাকাত ও খুনিদের হাতে আজ বাংলাদেশ অধিকৃত তারা ইংরেজদের মত বিদেশ থেকে আসেনি। আসমান থেকেও পড়েনি। তারা তো বেড়ে উঠেছে জনগণের মাঝেই।মানুষকে শুধু চাষাবাদ বা ব্যবসাবাণিজ্য জানলে চলে না। স্রেফ বিষাক্ত শাপ ও হিংস্র বাঘ-ভালুকদের চিনলেও চলে না। সেগুলি জানার পাশাপাশি সমাজের চোর-ডাকাত ও খুনিদেরও চিনতে হয়। তাদের ঘৃনা করার সামর্থও থাকতে হয়। সেটিই তো বিবেকের সুস্থ্যাতা। সেটিই তো চেতনার বল। বাংলাদেশের মানুষ সে সুস্থ্যতা নিয়ে তেমন বেড়ে উঠেনি। চেতনায় সে বলও পায়নি। সে অসুস্থ্যতা যে শুধু স্বল্পসংখ্যক মানুষের -তা নয়। বরং সে রোগ বিপুল সংখ্যক মানুষের। এবং সে রোগটি নিখুঁত ভাবে ধরা পড়ে নির্বাচন কালে। এমন অসুস্থ্যতা মানুষের আধিক্যের কারণে কোন বিবেকমান সৎ মানুষের পক্ষে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া অসম্ভব। বিলেতে কোন এমপি একবার মিথ্যুক প্রমাণিত হলে তার আর এমপি পদ থাকে না। অথচ বাংলাদেশে শুধু মিথ্যুক নয়, চোরডাকাত প্রমাণিত হলেও বিপুল ভোটে সে নির্বাচিত হয়।সেটি চেতনায় চরম অসুস্থ্যতার কারণে।বস্তুতঃ এমন এক অভিন্ন অসুস্থ্যতার কারণে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মহম্মদ (সাঃ)কেও মক্কার কাফেরদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে রাতের আঁধারে গোপনে জন্মভূমি ছাড়তে হয়েছে। একই অবস্থা হয়েছিল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)ও হযরত মূসা (আঃ)র মত মানব ইতিহাসের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ মানবদের।

 

যে আযাব নিজেদের অর্জিত

অন্যায় ও অসত্যকে ঘৃণা,আর ন্যায় ও সত্যকে ভালবাসার সামার্থই মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সামর্থ। এমন সামর্থের বলেই মানব ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হয়। সে সামর্থটি দৈহীক বলে আসে না, সে জন্য নৈতীক বল লাগে। সে জন্য লাগে চেতনায় সুস্থ্যতা। লাগে চিন্তা ও দর্শনর বল। বাংলাদেশের মানুষের সে নৈতীক বল অতি সামান্যই। তাদের মূল সমস্যাটি নৈতীক অসুস্থ্যতার।সে অসুস্থ্যতাটি ছড়িয়ে গেছে সমগ্র দেশ জুড়ে। আওয়ামী লীগ কি আজ হঠাৎ করে চোর-ডাকাত ও খুনিদের দলে পরিণত হয়েছে? এ রোগটি তো দলটির জন্মলগ্ন থেকেই।পাকিস্তান আমলেও কি এ দলের লোকজন চুরিডাকাতি কম করেছে? সরকারি অর্থচুরির অপরাধে ঢাকার আদালতে খোদ শেখ মুজিবের সাস্তি হয়েছিল, যদিও পরে ঢাকার উচ্চ আদালত তাকে ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর বহুলক্ষ অপরাধী বহু খুনখারাবী ও চুরিডাকাতি করে। কিন্তু ঢাকার উচ্চআদালত তাদের ক’জনকে শাস্তি দেয়? মুজিবকেও তারা দেয়নি। মুজিব ও তার অনুসারিরা কি পাকিস্তান আমলেও কোন বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ সভা করতে দিয়েছে? তারা তো সংসদের অভ্যন্তরে ডিপুটি স্পীকার শাহেদ আলী হত্যা করেছে কয়েক শত সংসদ সদস্যের সামনে।কিন্তু সে হত্যাকান্ডের অপরাধে কোন আদালত কি কাউকে একদিনেরও জেল দিয়েছে? ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি ও নুরুল আমীন সাহেবের পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টিসহ কোন দলকেই মুজিব শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচনি জনসভা করতে দেয়নি। সর্বত্র গুন্ডা লেলিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের আগেই তারা রাজপথের রাজনীতির উপর নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছিল। শাপলা চত্বরের নৃশংস ভয়াবহতা নিয়ে তারা হাজির হয়েছিল ১৯৭০ সালে ১৮ই জানুয়ারিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে জামায়াতে ইসলামির নির্বাচনি জনসভায়। সেদিন পল্টন ময়দানের পাশের রাস্তাগুলো উপর দাঁডিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের খুনিরা বৃষ্টির মত পাথর নিক্ষেপ সমাগত জনতার উপর। অবশেষে জনসভার অভ্যন্তরে ঢুকেও তারা মানুষ খুনে নেমেছিল। সেদিন জামায়াতের দুই জন নিরাপদ কর্মীকে তারা শহীদ করেছিল এবং আহত করেছিল বহুশত মানুষকে। নৃশংস হত্যাকান্ডের নিন্দার সামর্থ্য যে কোন সাধারণ মানুষেরই থাকে। এমন কি শিশুদেরও থাকে না। মুমিনের ঈমানদারি শুধু নামায-রোযায় নয়, বরং প্রকাশ পায় অন্যায়কে নিন্দা করার সামর্থ্যের মাঝে। কিন্তু সে সামর্থ্য যেমন অসভ্য খুনিদের থাকে না, তেমনি বেঈমানদেরও থাকে না। ফলে সমাজে যখনই কোন বর্বর অন্যায় কর্ম ঘটে, তখন ঈমান ও মানবনতার পরীক্ষা হয় দেশবাসীর –বিশেষ করে নেতানেত্রী ও বু্‌দ্ধিজীবীদের। লক্ষ্যণীয় হলো, সেদিন সে পরীক্ষায় ফেল করেছিল বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও নেতানেত্রীগণ। সেদিনের হত্যাকান্ডকে নিন্দা করে সে সময়ের বাঙালী বুদ্ধিজীবীগণ কোন বিবৃতি দেয়নি। কেউ রাজপথেও নামেনি। বরং পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ খবর ছেপেছিল জামায়াতের কর্মীরাই সমবেত শ্রোতাদের উপর হামলা চালিয়েছে। ছাত্রলীগের ক্যাডারগণ যে জনসভার বাইরে থেকে বৃষ্টির ন্যায় খোয়া ছুড়েছিল পত্রিকায় তার কোন উল্লেখই পর্যন্ত ছিল না। এই হলো বিপুল সংখ্যক বাঙালীর বিবেক ও মানবতার মান! এরূপ ফ্যাসিবাদী বর্বরতা শুধু ঢাকাতেই সীমিত থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র দেশে। এমন এক ফ্যাসিবাদী প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সে নৃশংস বর্বরতার স্বপক্ষীয় শক্তিই সেদিন বিপুলভাবে বিজয়ী করেছিল। মুজিবের শাসনামলেও কি এসব খুনিগণ কম অপরাধ করেছে? তারপরও জনগণ তাদেরকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে ১৯৯৬ সাল ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে। নির্বাচন পরিণত হয়েছে প্রহসনে। অপর দিকে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের তাদেরকে জনগণের ভোটের উপর নির্ভর করতে হয়নি।তারা নিজেরাই নিজেদের নির্বাচিত করতে হয়েছে। ফলে যে চোর-ডাকাত ও খুনিদের হাতে দেশ আজ অধিকৃত তারা বিদেশ থেকে আসেনি, তারা বেড়ে উঠেছে প্রতিরোধহীন জনগণের মাঝে। অনেকে তাদের সাহায্য-সমর্থণও দিয়েছে। ফলে আজ বাংলাদেশে যে অসভ্য বর্বরতা নেমে এসেছে তার কারণ মূলতঃ দুটি। এক. দুর্বৃত্ত শক্তির রাজনৈতিক ইঞ্জিনীয়ারিং; দুই. জনগণের দায়িত্বহীনতা। কিন্তু জনগণের সে দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতা নিয়ে কি কোন কালেও কোন হিসাব নিকাশ হয়েছে?

 

স্বৈরাচারের নাশকতা

নিজ ঘরে আগুন লাগলে সে আগুন থামানোর দায়িত্ব সে গৃহে বসবাসকারী সবার। সে সাথে পাড়ার লোকেরও। ঘর জ্বলতে দেখেও সে পরিবারের বা পাড়ার কেউ যদি সে আগুন নিভাতে উদ্যোগী না হয় তবে কি তাকে আদৌ সুস্থ বলা যায়? খন্দকের যুদ্ধে আরবের কাফেরদের সম্মিলিত হামলায় মদিনা নগরী যখন অবরুদ্ধ তখন প্রতিটি পুরুষই শুধু নয়,প্রতিটি নারীও মোকাবেলায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শত্রুর সে হামলার মুখে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল শতকরা শতভাগ। আল্লাহতায়ালাও তাদের জানমালের বিনিয়োগ দেখে ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন। ফলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র সেদিন আসন্ন বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু উপনিবেশিক বৃটিশ হামলার মুখে শতকরা ১ জন বাঙালী মুসলমান কি সেদিন ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিল? হয়নি। ফলে এমন জাতির স্বাধীনতা রক্ষা পায় কি করে? জাতির প্রতিরক্ষার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমাদের পূর্ব পুরুষরা সেদিন মুষ্টিমেয় ষড়যন্ত্রকারীর খেলায় পরিণত করেছিলেন। মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষাকে ইসলামে যেখানে জিহাদের ন্যায় পবিত্র বলা হয়েছে, সেটিকে সংগঠিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। অথচ একই বৃটিশ বাহিনী যখন আফগানিস্তানে ঢুকেছিল তখন আফগান জনতা সে হামলা ঠেকাতে সরকারের মুখের দিকে চেয়ে থাকেনি। হাতে যা ছিল তা নিয়েই ময়দানে নেমেছিল। ফলে হামলাকারি বিশাল বৃটিশ বাহিনীর মাত্র একজন সৈনিক ছাড়া কেউই সেদিন জ্যান্ত ফিরতে পারেনি। সে লোমহর্ষক পরাজয়ের কথা বৃটিশ জাতি আজও ভুলতে পারেনি। তবে জনগণের সাথে সরকারের দায়িত্বও বিশাল। তাদের কাজ হলো জনগণকে প্রস্তুত করে যুদ্ধে নামানো। তাদের হাতে প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিং তুলে দেয়। কিন্তু স্বৈরাচারি শাসনে সে কাজটিই হয় না। দেশগড়া, দেশের প্রতিরক্ষা ও দেশ শাসনের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে তখন মুষ্টিমেয় বেতনভুকের খেলা-তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়। এ নিয়ে রচিত হয় নানা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। দেশের আপামর সর্বসাধারণ পরিণত হয় নীরব দর্শকে। স্বৈরাচারী শাসনকালে তাই যুদ্ধ হয় দুটি প্রতিপক্ষ শাসকগোষ্ঠির। দেশ গড়ার বিষয়টি গণ্য হয় তাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারীক বিষয়রূপে।জনগণকেও তারা শত্রু বা প্রতিপক্ষ ভাবে। নিজেদের গদী বাঁচাতে তারা বরং জনগণকে অস্ত্রহীন ও শক্তিহীন করে। স্বৈরাচারের এটিই সবচেয়ে বড় নাশকতা।

আজকের বিশ্বে ১৫০ কোটি মুসলমানের যে পতিত দশা তার কারণ মূলতঃ এই স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা। অথচ রাষ্ট্রের নির্মাণে, উন্নয়তে ও প্রতিরক্ষায় অংশ নেয়া ইসলামে কোন পেশাদারিত্ব নয়, চাকুরিও নয়;এটি ইবাদত। শুধু শ্রম ও অর্থ দানই নয়,অনেক সময় সে কাজে প্রাণদানও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এরূপ চেতনা বলেই প্রাথমিক কালের মুষ্টিমেয় দরিদ্র মুসলমানেরা সে আমলের দুটি বৃহৎ শক্তিকে পরাজিত করে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এযুগের মুসলিম শাসকেরা নানা বাহানায় সে ইবাদত পালনকে অসম্ভব করেছে। রাজনীতিতে সর্বসাধারণের অংশগ্রহণকে তারা ফৌজদারী অপরাধে পরিণত করেছে। অথচ রাজনীতি হলো রাষ্ট্রের উন্নয়নে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের নীতি। ফলে প্রতিটি নাগরিকের এটি মৌলিক অধিকার। অথচ সৌদি আরবের ন্যায় মধ্যপ্রাচ্যের বহুদেশে এটি মৃত্যুদন্ডনীয় অপরাধ। শেখ মুজিবও এটি নিষিদ্ধ করেছিল ইসলামপন্থীদের জন্য। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ অবধি দেশের ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক দলগুলোকে মুজিব বেআইনী ঘোষিত করেছিল এবং ১৯৭৪ এ এসে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজকে পরিণত করেছিল তার পরিবার ও দলের নিজস্ব আভ্যন্তরীণ বিষয়ে। প্রতিষ্ঠা করেছিল একদলীয় বাকশালী শাসন। জনগণকে ক্ষমতাহীন করাই স্বৈরাচারের কাজ। কারণ জনগণের ক্ষমতাকে তারা ভয় করে। ফলে যে কোন স্বৈরাচারীর ন্যায় মুজিবও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ক্ষমতাহীন দর্শকে পরিণত করেছিল। কোন টীমের শতকরা নিরানব্বই ভাগ খেলোয়াড়কে দর্শকের গ্যালারীতে বসিয়ে কোন দলই বিজয়ী হতে পারে না। তেমনি পারেনি মুজিব আমলের বাংলাদেশও। তার হাতে রাজনীতি পরিণত হয়েছিল লুণ্ঠনের হাতিয়ারে। ফলে নিঃস্ব হয়েছিল সরকারি তহবিল ও জনগণ, এবং তার কুশাসনে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল লজ্জাজনক তলাহীন ঝুড়ির খেতাবটি। তার শাসনামলে দরিদ্র মানুষ কাপড়ের অভাবে মাছধরা জাল পরে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। দেশগড়ার কাজকে সফল করতে হলে এ কাজে জনগণের ব্যাপকতর সম্পৃক্ততা জরুরী। কিন্তু তা থেকে জনগণকে দূরে সরিয়েছিল স্বৈরাচারি মুজিব। মুজিব সেটিকে তার নিজের ও নিজদলে মনোপলিতে পরিণত করেছি। মুজিবের সে পলিসি নিয়ে আজ দেশ শাসন করেছে তার কণ্যা শেখ হাসিনা। ফলে দেশ গড়ায় অংশ নেয়া দূরে থাক, লক্ষ লক্ষ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতক অবস্থায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এরূপ অবস্থায় কোন দেশে শান্তি আসে? নির্মিত হয় কি সভ্য সমাজ? বরং যা বাড়ে তা তো অসভ্যতা ও বর্বরতা। বাংলাদেশ যে কারণে এ শতাব্দীর শুরুতে দুর্নীতিত বিশ্বে ৫ বার প্রথম হলো এবং আজও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রথমসারির একটি দেশ -তার প্রেক্ষাপট তো নির্মিত হয়েছে এভাবেই।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *