গণতন্ত্র কেন ব্যর্থ হয়?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

গণতন্ত্র: সভ্য জনগণ ও সভ্য শাসনের আলামত

সভ্য রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, মানবিক গুণে বেড়ে উঠা ও উচ্ততর সভ্যতার নির্মাণে সব জাতি সমান ভাবে সামনে এগুয় না। অনেকেই দ্রুত এগুয়, অনেকেই পিছনে পরে থাকে। কে কতটা সামনে এগুলো দেশের গণতন্ত্র চর্চার মান সেটিরই নিখুঁত পরিমাপ দেয়। গণতান্ত্রিক শাসন হলো মানব সভ্যতার উন্নয়নে ও মানবিক গুণাবলীর উৎকর্ষের বিচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। অপরদিকে স্বৈরাচারি দুঃশাসন হলো পশ্চাদপদ, অসভ্য ও দুর্বৃত্ত কবলিত রাষ্ট্রের পরিচায়ক। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্য ১৯২। কিন্তু অধিকাংশ রাষ্ট্রই সভ্যতার ও মানবতার এ উচ্চমানে পৌঁছতে পারিনি।

২২টি আরব রাষ্ট্রের মাঝে ইরাক ও আলজিরিয়াতে কিছুটা গণতন্ত্র চর্চা হলেও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র কোথাও প্রতিষ্ঠা পায়নি। অধিকাংশ আরব গুলিতে জেঁকে বসেছে রাজতান্ত্রিক বা সামরিক বাহিনীর ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার। তিউনিসিয়া, মিশর ও ইয়েমেনে স্বৈরাচার উৎখাতের মাধ্যমে যে গণতন্ত্র চর্চার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সে প্রক্রিয়া উল্টে দেয়া হয়েছে। কারণ আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের শত্রুরা শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ। মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র চায় না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলিও। একটি দেশে সফল গণতন্ত্র দেখে বুঝা যায় দেশবাসী নৈতিকতা, বিচার বিবেচনা ও সভ্যতার মানদন্ডে কতদূর এগিয়েছে –সে বিষয়টি। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে গণতন্ত্র চর্চায় পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপাল এগিয়ে গেলেও, বাংলাদেশ দারুন ভাবে পিছিয়ে পড়েছে। তাই বাংলাদেশীরা ঘানি টানছে অসভ্য ও নৃশংস ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের।

কোন দেশের সভ্যতা ও মানবতার মান  রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বড় বড় প্রাসাদ, কল-কারখানা, তাজমহল বা পিরামিড দেখে ধরা পড়ে না। এগুলো স্বৈরাচার ও দুর্বৃত্ত কবলিত অসভ্য সমাজেও নির্মিত হয়। বরং‌ জনগণের চরিত্র ও বিবেকের মান ধরা পড়ে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে দেশবাসীর সফলতা দেখে। গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ঠ হলো সে সমাজে জনগণ ইজ্জত পায়, স্বাধীনতা পায় ও নিজ যোগ্যতা নিয়ে বেড়ে উঠার সুযোগ পায়। এমন দেশে জনগণকে প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়তে হয় না, এবং নিজ দেশে আত্মগোপন করতে হয় না। কিন্তু দেশে দেশে যতই বাড়ছে স্বৈরাচারি দুঃশাসন, ততই বাড়ছে গৃহছাড়া উদ্বাস্তুদের সংখ্যা।

 

মানব ইতিহাসের প্রথম গণতন্ত্র

সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম সফল গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা পায় মুসলিমদের হাতে। সে শাসন প্রতিষ্ঠায় জনগণের ভূমিকাও কম ছিল না। গণতান্ত্রিক চেতনা সমৃদ্ধ দায়িত্ববান ও বিবেকবান চরিত্রের অতি উন্নত জনগণ দেখা গিয়েছিল খোলাফায়ে রাশেদার সময়। জনগণ এই প্রথম পায় শাসকের সামনে মন খুলে কথা বলা ও অভিযোগ তোলার পূর্ণ স্বাধীনতা। পেয়েছিল কে শাসক হবে তা নিয়ে নিজেদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মসজিদের মিম্বরে খলিফা হযরত উমর (রা:)’র গায়ে লম্বা পিরহান দেখে সাধারণ মুসল্লী প্রশ্ন তুলেছিল, “হে আমিরুল মুমিনিন, আপনি কোথায় পেলেন আপনার পিরহানের বাড়তি কাপড়?” খলিফাকে প্রথমে সে প্রশ্নের জবাব দিয়ে তারপর জুম্মার খোতবা দিতে হয়েছে।

সে সময় সমগ্র বিশ্বজুড়ে রেওয়াজ ছিল একমাত্র রাজপুত্র ও রাজকন্যারাই রাজা বা রানী হবে। তারা ভিন্ন অন্য কোন সাধারন মানুষ – যত যোগ্যবানই হোক শাসকের আসনে বসতে পারে, সাধারণ মানুষ সেটি ভাবতেই পারতো না। বসলে জনগণ সেটিকে গ্রহন করতো না। অথচ রাজপুত্র ও রাজকন্যা নাবালক বা দুর্বৃত্ত হলেও তারা মেনে নিত। ইসলামই সর্বপ্রথম শাসক নির্বাচনে জনগণের রায়কে প্রথম গুরুত্ব  দেয়। তখন জনগণের রায়ে শাসন ক্ষমতায় বসেছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ। ফলে হযরত আবু বকর (রা:), হযরত উমর (রা:), হযরত উসমান (রা:) ও হযরত আলী (রা:)’র ন্যায় ব্যক্তিদের দেশের শাসনক্ষমতায় বসতে রাজপুত্র হতে হয়নি। আরো লক্ষণীয় হলো, তারা শাসক হয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের জন্য কোন প্রাসাদ নির্মিত হয়ে। পূর্বের ঘরেই আগের মত বাস করতেন। অথচ যে বিশাল রাষ্ট্রের তারা শাসক হয়েছেন সে এলাকার সম্পদের প্রাচুর্য্যে মিশরে বহু পিরামিড এবং ইরানে ও রোমের রাজধানীতে বহু রাজ প্রাসাদ নির্মিত হয়েছে।

গণতন্ত্রের সুফল হলো, এ বিধানটি জনগণকে দেশের উপর দখলদারীত্ব দেয় এবং অধিকার দেয় ‌শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা প্রয়োগের। গণতন্ত্র নির্মূল করে রাজা, বাদশাহ ও স্বৈরাচারী শাসকদের শাসন। গণতন্ত্রে দেশের জনগণ পরিণত হয় সর্বোচ্চ বিচারকে। এবং সমগ্র দেশ পরিণত হয় সর্বোচ্চ আদালতে। জনগণের এ আদালতে বিচার বসে শাসকদের চরিত্র ও কর্ম নিয়ে। জনগণের রায়ে অযোগ্য শাসক বরখাস্ত হয় এবং নতুন শাসক নির্বাচিত হয়। মানব সমাজের এই হলো সবচেয়ে সভ্যতর বিবর্তন। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকগণ জনগণকে সে অধিকার দিতে রাজী নয়। তারা জনগণের ঘরে ডাকাতি করে এবং সে অধিকার কেড়ে নেয় –যেমনটি হয়েছে বাংলাদেশে। তাই স্বৈরাচারী শাসক মাত্রই হলো জনগণের পরম শত্রু। সে সাথে মানবতার ও সভ্যতার শত্রু।

 

গণতন্ত্র কেন ব্যর্থ হয়?

যে কোন আদালতই ব্যর্থ হতে বাধ্য যদি আদালতের বিচারকগণ বিচক্ষণ, নিরপেক্ষ, শিক্ষিত ‌ও যোগ্য না  হয়। তখন‌ সে‌ দুর্বৃত্ত কবলিত আদালতে সুবিচার হয় না বরং অবিচার হয়। তেমনি  জনগণের আদালতও ব্যর্থ হয় যদি দেশের জনগণ শিক্ষিত, বিজ্ঞ, নিরপেক্ষ ও বিচক্ষণ না হয়। তখন দুর্বৃত্তরা নির্বাচিত হয়। জনগণের ব্যর্থতায় গণতন্ত্র চর্চা যে ব্যর্থ হয় তারই উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। বাঙালীর সে ব্যর্থতাটি দেখা গেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। শেখ মুজিব ১৯৭৪-৭৫ সালে এসে হঠাৎ ফ্যাসিবাদে দীক্ষা নিয়েছে –বিষটি তেমন নয়। মুজিব আগাগোড়াই ছিল ফ্যাসিবাদী। গণতন্ত্রের কথা বলেছে স্রেফ ভোট নেয়ার জন্য, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য।

শেখ মুজিবের মাঝে প্রচণ্ড ফ্যাসিবাদ ধরা পড়েছিল পঞ্চাশের দশকেরই। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের তান্ডবে নিহত হয়েছিলের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ডিপুটি স্পীকার জনাব শাহেদ আলী। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সদ্য আওয়ামী লীগ থেক পদত্যাগ করা মাওলানা ভাষানীকে তাঁর নবগঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টীর (ন্যাপের) মিটিং করতে দেয়নি। শেখ মুজিব এমনকি ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ভাষানী ন্যাপের প্রতিষ্ঠা সভার উপরও গুন্ডা দিয়ে হামলা করেছে। মুজিবের ফ্যাসিবাদ প্রবল ভাবে প্রকাশ পায় ১৯৭০ সালের নির্বাচন কালে। নির্বাচনে আগেই আওয়ামী গুন্ডারা মাঠ দখলে নেয়। ১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাসে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ফজলুল কাদের চৌধুরীর মুসলিম লীগ, নূরুল আমীন-শাহ আজিজের পিডিপি এবং জামায়াতে ইসলামীর কোন নির্বাচনী জনসভা করতে দেয়া হয়নি। গুন্ডা লাগিয়ে সবগুলি দলের মিটিং পন্ড করা হয়েছে। এ দলগুলির মিটিং করতে দেয়া হয়নি মফস্বলের শহর গুলিতেও। ১৯৭০ সালের ১৮ই জানুয়ারীতে জামায়াতের মিটিংয়ে হামলা করে ২ জনকে শহীদ করা হয় ও বহু মানুষকে আহত করা হয়।

বাঙালী জনগণের চরম ব্যর্থতা হলো মুজিব ও তার আওয়ামী লীগের এ নৃশংস খুনি চরিত্রকে দেখেও না দেখার ভান করেছে। বরং বিপুল ভোটে মুজিবের ন্যায় সেই ফ্যাসিস্টকেই নির্বাচিত করেছে। এই জনগণই বাংলাদেশ আমলে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে মুজিব কন্যা ফ্যাসিবাদী হাসিনাকেও। প্রশ্ন হলো, এমন জনগণ কি কখনো গণতন্ত্রের সুফল পায়? জনগণের এরূপ অযোগ্যতার কারণে গণতন্ত্র কবরে যাবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?

গণতান্ত্রিক সভ্য শাসন পেতে হলে জনগণকেও অবশ্যই সভ্য আচরণ করতে হয়। অবশ্যই থাকতে হয় অসভ্য দুর্বৃত্তদের ঘৃণা করার সামর্থ্য। থাকতে হয় যোগ্য ও সৎ মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর সামর্থ্য। কিন্তু অধিকাংশ বাংলাদেশী সে যোগ্যতা দেখাতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। বরং তারা গণতন্ত্রের শত্রু একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিস্টকে ভোট দিয়েছে এবং তাকে নানা ভাবে সম্মানিত করছে। তাকে বন্ধু, পিতা ও নেতার আসনে বসিয়েছে। এখন তাদের রাজস্বের অর্থে দেশের নানা প্রান্তে এক ফ্যাসিবাদীর মুর্তি বসাচ্ছে।

মানুষের ঈমান, বিবেকবোধ ও চরিত্র ধরা পড়ে কাকে সে সম্মান করে তা থেকে। এখানেই হয় মানবের ঈমানের বড় পরীক্ষাটি। ফিরাউনকে ভগবান বলে মিশরবাসী নিজেদের উপর আল্লাহর গজব নামিয়ে এনেছিল। সে পথ ধরেছে বাংলাদেশীরাও। জনগণের এরূপ ব্যর্থতায় মিথ্যাচারী ও পেশীশক্তির অধিকারী সন্ত্রাসীরা ভোটডাকাতি করে জনগণের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিবে এবং জনজীবনে আযাব নামিয়ে আনবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? এমন দেশে নির্বাচন বার বার হলেও সেটি হয় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ন্যায় ভোট ডাকাতির নির্বাচন। ‌ গণতন্ত্র এভাবেই পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। নৃশংস ফ্যাসিবাদ তো এভাবেই চেপে বসে।

 

গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কীরূপে?

ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া যায় না। তেমনি দেশের জনগণকে শিক্ষিত ও বিচক্ষণ রূপে গড়ে না তুললে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা দেয়া যায় না। ভাল ইমারাত গড়তে হলে ভাল ইট লাগে। তেমনি সভ্য রাষ্ট্র গড়তে হলে সভ্য মানুষ লাগে। সে জন্য জনগণকে দায়িত্ববান, শিক্ষিত ও আত্মমর্যাদাশীল হতে হয়। জনগণকে অশিক্ষিত রেখে আর যাই হোক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দেয়া যায় না। অশিক্ষিত জনগণকে দিয়ে বড় জোর গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়। যেমনটি হয়েছে ভারতে। এমন ভ্রষ্ট গণতন্ত্রে নরেন্দ্র মোদীর ন্যায়  খুনিও বিপুল ভোটি নির্বাচিত হয়।

জনগণের বড় সম্পদ হলো তার ভোট। সে ভোটের পাহারা দেয়ার দায়িত্ব নিতে হয় খোদ জনগণকেই। নইলে সে ভোট ডাকাতি হয়ে যায়। যে কোন দেশে সভ্য ভাবে বাঁচার খরচটি বিশাল। গরুছাগলের ন্যায় গলায় গোলামীর রশি নিয়ে স্রেফ পানাহারে বাঁচায় তেমন খরচ নাই। কিন্তু নিজ দেশের উপর নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে হলে যুদ্ধ করতে হয়। এ যুদ্ধটি স্বৈরাচারি দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। ইসলামে একাজটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। এ কাজটি সেক্যুলারিস্টদের কাছে রাজনৈতিক পেশাদারিত্ব মাত্র। কিন্তু ঈমানদারের কাছে এটি হলো পবিত্র জিহাদ। সে জিহাদে অর্ধেকের বেশী সাহাবীকে শহীদ হতে হয়েছে। তাদের সে বিশাল কুরবানীতে নির্মূল হয়েছে দুর্বৃত্তদের শাসন এবং নির্মিত হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। কিন্তু বাংলাদেশীগণ সে মূল্য পেশ করেনি। লড়াই দূরে থাক, তারা এমনকি একজন সভ্য, সৎ ও ঈমানদার মানুষকে ভোট দিতেও রাজী নয়। তাদের আচরণ বিবেকশূণ্য মিশরবাসীর মত যারা ফিরাউনকে খোদার আসনে বসিয়েছিল।

 

 অপরাধী যখন জনগণ

 বাংলাদেশে অপরাধী শুধু ফ্যাসিবাদী স্বৈর সরকার নয়, অপরাধী জনগণও। যে আদালতে খুনির শাস্তি না দিয়ে বরং বেকসুর খালাস দেয়া হয় -তাকে কি আদালত বলা যায়? ব্যর্থতা এখানেই বিচারকদের। এমন আদালতের  বিচারকগণ আদৌ বিচারক নয়, বরং প্রচণ্ড অপরাধী। সভ্য দেশে এমন বিচারকদেরও বিচার হয় এবং কঠোর শাস্তি হয়। তেমনি জনগণের যে আদালতে একজন প্রমাণিত ফ্যাসিস্ট ও খুনি শাস্তির হয় না বরং বিপুল ভোটে নির্বাচিত করা হয় -সেটিকে কি গণতন্ত্র বলা যায়? বিচারক হিসাবে ব্যর্থতা এখানে জনগণের। তাই অপরাধী শুধু বিজয়ী দুর্বৃত্তই নয়, ভোটদাতা জনগণও।

‌বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে‌ সফল করতে ‌হলে জনগণকে অপরাধী হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে। তাদের বিজ্ঞ বিচারকের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। সে জন্য জনগণকে সচেতন, বিবেকবান ও দায়িত্ববান করে গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্রের অর্থ পরিবারতন্ত্রকে সমর্থন করা নয়। পরিবারতন্ত্র হলো রাজতন্ত্রের প্রতীক। পরিবারতন্ত্র রক্তের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা দেয়। এখানে যোগ্যতার গুরুত্ব পায়না, গুরত্ব পায় পরিবারের অযোগ্য ব্যক্তিও। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার চেয়ে অধিক শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ লোক আছে। কিন্তু তারা দলীয় নেতার আসনে বসার জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়নি। এর কারণ, পরিবারতন্ত্র। এটিকে প্রশ্রয় দিলে গণতন্ত্র বাঁচানো যায়না। গণতন্ত্র বাঁচাতে হলে সততা, যোগ্যতা,  ঈমানদারীকে গুরুত্ব দিতে হয়। দূরে সরতে হয় রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র থেকে। বাড়াতে হয় জনগণের মনে ঈমান বৃদ্ধি ও ঈমানী দায়িত্ব পালনের চেতনা। বাড়াতে হয় আল্লাহর ভয় ও‌ আখেরাতের ভয়।‌ বুঝাতে হয়, ভোট একটি আমানত। জনগণকে হুশিয়ার করতে হয় যেন, আমানতের খেয়ানতের কারণে দেশের উপর যেন দুর্বৃত্ত শাসন চেপে না বসে। সেটি হলে সে দুর্বৃত্ত শাসনের গুনাহর ভাগটি ভোটদাতাকেও বইতে হয়।

আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কবিরা গুনাহ। তেমনি কবিরা গুনাহ হলো নির্বাচনে একজন দুর্বৃত্তের পক্ষ ভোট দেয়া। এতে অসম্ভব হয় যোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসানো। ফলে ব্যর্থ হয় সুশাসন ও সভ্য সমাজের নির্মাণ। তাই এটি হারাম ও গুরুতর অপরাধ। দুর্বৃত্তের পক্ষে এমন ভোটদান তাই কবিরা গুনাহ। এখানে গুনাহটি হলো একজন চোর, ডাকাত, খুনি ও‌ বেইমানের পক্ষে জনগণের আদালতে ভালো মানুষ রূপে সাক্ষ্য দেয়া। ‌এরূপ সাক্ষ্যদানে অপরাধী তার প্রাপ্য শাস্তি থেকে মুক্তি পায়। অথচ বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগণ সে অপরাধে অপরাধী। তাদের সে অপরাধের কারণেই অতীতে গণতন্ত্রের হত্যাকারীরা নির্বাচিত হয়েছে। এবং পরবর্তীতে তারাই জনগণের ভোটের অধিকারই কেড়ে নিয়েছে। আর এতে অসম্ভব হচ্ছে সভ্য সমাজের নির্মাণ এবং তাতে দীর্ঘজীবী হচ্ছে দুর্বৃত্ত।

 

যে ইবাদতটি হচ্ছে না

প্রতিটি নাগরিকের উপর দায়িত্বটি বিশাল। প্রতিটি ব্যক্তি যেমন সামর্থ্যহীন নয়, তেমনি দায়িত্বহীনও নয়। সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালার নজর সবার উপর। তিনি সবাইকে প্রতিক্ষণ দেখছেন। যখন ব্যক্তির জীবনে বা জাতির জীবনে কোন সংকট আসে, তখন সেটি চরম পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়। বাঙালী মুসলিম জীবনেও আওয়ামী ফ্যাসিবাদও এক মহা পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা দেখতে চান কারা সে পরীক্ষায় পাশ করে। ঈমানদার তো তারাই যাদের প্রতিক্ষণের তাড়না সে পরীক্ষায় পাশ করা নিয়ে। কারণ পরকালে জাহান্নামের অন্তহীন আগুনে যাবে, না জান্নাতে যাবে –সেটি নির্ভর করে এ পরীক্ষায় পাশের উপর। এবং পাশ তো তারাই করে যারা মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা তথা প্রতিনিধি রূপে দায়িত্ব পালনে নিজের শ্রম, মেধা, অর্থ, রক্ত ও বুদ্ধিবৃত্তির বিনিয়োগ করে।

বাংলাদেশীদের সমস্যা হলো তাদের সমগ্র বিনিয়োগটি শুধু নিজের পার্থিব জীবনকে সফল করায়। আখেরাত নিয়ে ভাবনা নাই। পবিত্র কুর’আনের সুরা কাহাফের ১০৪ নম্বর আয়াতে এমন ব্যক্তিদের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বলা হয়েছেন। আখেরাতের ভাবনা থাকলে তো বিরামহীন জিহাদ শুরু হতো –যেমনটি এসেছে সাহাবাদের জীবনে। তখন ফ্যাসিবাদী শাসন নির্মূলের প্রতিটি উদ্যোগই ইবাদত গণ্য হতো। আর যেখানে ইবাদত নাই -সেখানে কি কখনো মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য আসে? আসে কি বিজয়? নির্মিত হয় কি শান্তিময় সভ্য সমাজ?

বুঝতে হবে, মুসলিমের ইবাদত শুধু নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত নয়, বরং সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতটি হলো দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ। মহান আল্লাহতায়ালা সুরা আল-ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে যে কারণে মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদায় ভূষিত করেছেন সেটি নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত নয়। বরং সেটি হলো দুর্বৃত্তির নির্মূল (নেহী আনিল মুনকার) এবং ন্যায় তথা সুবিচারের প্রতিষ্ঠা (আমারু বিল মারুফ)’র এই পবিত্র মিশন। এই সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের মাধ্যমেই পৃথিবীপৃষ্টে সবচেয়ে বড় বিপ্লবী কাজটি ঘটে। ঘটে ইসলামী বিধানের বিজয়। যেমনটি ঘটেছিল সাহাবায়ে কেরামের যুগে। অথচ বাঙালী মুসলিমগণ নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতে আগ্রহ দেখালেও সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতে তেমন একটা নাই। পূর্ণ ইসলাম পালনে তারা যে কতটা অমনযোগী ও ফাঁকিবাজ -সেটি বুঝতে কি এরপরও বাঁকি থাকে? এমন ফাঁকিবাজী নিয়ে পরীক্ষায় পাশ জুটে? জুটবে কি মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে মুক্তি?  ফাঁকিবাজীর কারণেই  বাঙালী মুসলিম জীবনে নাই ফ্যাসিবাদী দুর্বৃত্ত শাসন নির্মূলের জিহাদ।

তাই বুঝতে হবে, মুসলিম জীবনের লড়াইটি শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই নয়, সেটি ইসলামের পূর্ণ মিশন নিয়ে বাঁচার জিহাদ। এটি হলো ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদ। শুধু তাই নয়, এটি পূর্ণ মুসলিম রূপে বাঁচার জিহাদও। ইসলামের বিজয় এবং শরিয়ত পালনসহ পূর্ণ ইসলাম পালন কখনোই ফ্যাসিবাদী জালেম সরকারকে ক্ষমতায় রেখে কি সম্ভব? তাই ইসলামের শত্রু শক্তির নির্মূলের যে লড়াইয়ে খোদ নবীজী (সা:)কে নামতে হয়েছে, সে লড়াইকে নামতে হবে প্রতিটি ঈমানদারকেও। তাছাড়া নবীজী (সা:)’র সূন্নত পালন হবে কীরূপে? ১২.০৪.২০২২।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *