স্বৈরশাসনের নিপাত কেন জরুরী?

বিপদ বিরামহীন যুদ্ধের

যে কোন মুসলিম দেশেই স্বৈরশাসনের আপদটি ভয়াবহ। ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠা দূরে থাক, তখন অসম্ভব হয় সভ্য মানুষ রূপে বেড়ে উঠা। ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, মহামারি বা প্লাবনে এতবড় বিপদ ঘটে না। ফিরাউন-নমরুদের ন্যায় তারাও মহান আল্লাহতায়ালার আযাবকে অনিবার্য করে তোলে। কারণ, এরা শুধু জনগণের শত্রু নয়, শত্রু মহান আল্লাহতায়ালারও। তাদের এজেন্ডা স্রেফ নিজেদের খেয়ালখুশির প্রতিষ্ঠা। নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা বাঁচাতে এরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় মহান আল্লাহতায়ালার কর্তৃত্ব ও তাঁর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। আইন তৈরীর অধিকার তারা নিজ হাতে নিয়ে নেয়। ফলে তাদের যুদ্ধ মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়ত, হুদুদ ও কেসাসের বিধানের বিরুদ্ধে। পবিত্র কোরআন এদেরকে চিত্রিত করা হয়েছে মুস্তাকবিরীন রূপে। আরবী ভাষায় মুস্তাকবিরীন বলতে তাদের বুঝায় যারা নিজেদেরকে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা বড় মনে করে। অথচ নিজেকে শ্রেষ্ঠ বা বড় মনে করার অধিকারটি একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। মুস্তাকবিরীনদের কলাবোরেটর রূপে থাকে এমন এক দালাল শ্রেণীর দুর্বৃত্ত নেতা, কর্মী ও বুদ্ধিজীবী -যাদের কাজ স্বৈরশাসকের সকল দুষ্কর্মের সমর্থণ করা। তাদের আরো কাজ, স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যখনই সত্য ও ন্যায়ের বানি নিয়ে ময়দানে নামে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা। হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারিদের নির্মূলে ফিরাউনের পাশে এদের অবস্থানটি ছিল তার মন্ত্রি, পরামর্শদাতা, সভাসদ, গোত্রপতি, সেনাপতি ও লাঠিয়াল রূপে। মানব ইতিহাসে এরাই হলো অতি নিকৃষ্ট শ্রেণীর দুর্বৃত্ত। এদের অপরাধ সাধারণ চোর-ডাকাতদের চেয়েও জঘন্য। সাধারণ চোর-ডাকাতগণ স্বৈরশাসকদের বাঁচাতে গণহত্যায় নামে না, কিন্তু এরা নামে। যুগে যুগে ফিরাউনগণ দীর্ঘায়ু পেয়েছে বস্তুতঃ এদের কারণেই।

পবিত্র কোরআনে ফিরাউনের ন্যায় স্বৈরশাসকদের সহযোগীদের মালাউন বলে অভিহিত করা হয়েছে। মালাউন শব্দটি মহান আল্লাহতায়ালার নিজের বাছাইকৃত বিশেষ এক বর্ণনাত্মক পরিভাষা তথা ন্যারেটিভ। এর কোন বিকল্প নেই। এর কোন অনুবাদও হয় না। মালাউন শব্দটির মধ্য দিয়ে মানব ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে মহান আল্লাহতায়ালা এমন এক শ্রেণীর দুর্বৃত্তদেরকে হাজির করেছেন -যাদের অপরাধের তুলনা একমাত্র তাদের নিজেদের সাথেই চলে। তাদের মূল অপরাধটি হলো, আল্লাহতায়ালা, তাঁর নবী-রাসূল ও তাঁর দ্বীনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। ফলে মহান আল্লাহতায়ালার ক্রোধ শুধু ফিরাউনদের উপর নয়, এসব মালাউনদের বিরুদ্ধেও। তাই মহান আল্লাহতায়ালা তাই শুধু ফিরাউনকে নয়, মালাউনদেরও ডুবিয়ে হত্যা করেছেন। পরকালে তাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন জাহান্নামের অনন্ত কালের আযাব। স্বৈরাচারকে বস্তুতঃ বাঁচিয়ে এ মালাউন শ্রেণী। ফলে যে দেশেই স্বৈরাচার আছে, সে দেশেই মালাউন আছে। এসব মালাউনদের কারণেই গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে লক্ষ লক্ষ মানব হত্যার কাজটি হিটলারকে নিজ হাতে করতে হয়নি। শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যায় বা ফাঁসি ঝুলিয়ে জামায়াত নেতাদের হত্যার কাজটিও শেখ হাসিনাকে নিজে হাতে করতে হয়নি। বাংলাদেশ আজ অধিকৃত বস্তুতঃ এরূপ মালাউন শ্রেণী ও তাদের প্রভু স্বৈরশাসকের হাতে। ফলে জুলুম নেমে এসেছে সেসব নিরীহ মানুষের উপর -যারা গণতান্ত্রিক অধিকার চায় এবং ইসলামের বিজয় ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা চায়।

স্বৈরশাসনের আরেকটি ভয়ানক কুফল হলো, দেশ বিভক্ত হয় দ্বি-জাতিতে। সে বিভক্তির পিছনে কাজ করে দু’টি ভিন্ন লক্ষ্য, দুটি ভিন্ন মূল্যবোধ এবং দু’টি ভিন্ন দর্শন। সে বিপরীতমুখি লক্ষ্য, মুল্যবোধ ও দর্শনকে ঘিরে শুরু হয় রাজনীতির তীব্র মেরুকরণ। এক মেরুতে অবস্থান নেয় স্বৈরশাসক ও তার অনুসারিরা; এবং অন্য মেরুতে অবস্থান নেয় স্বৈরাচারবিরোধী সকল দল ও সেসব দলের নেতাকর্মীগণ। সে মেরুকরণের রাজনীতিতে স্বৈরশাসকের পক্ষ থেকে ধ্বনিত হয় বিরোধীদের বিরুদ্ধে নির্মূলের চিৎকার। যেমন ফিরাউন ও তার সঙ্গি মালাউনগণ ধ্বনি তুলেছিল হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারিদের নির্মূলে এবং আবু জেহল-আবু লাহাব নির্মূলে নেমেছিল হযরত মহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর অনুসারিদের। নির্মূলের লক্ষ্যে সৃষ্টিহয় যুদ্ধাবস্থা।

স্বৈরশাসক মাত্রই বিজয় খুঁজে নিরস্ত্র বিরোধীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র  যুদ্ধে। ভোটে নয়, বন্দুকের জোরে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা শুরু হয়। স্বৈর-শাসকের সে লক্ষ্য পূরণে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর লোক-লশ্করেরা পরিণত হয় চাকর-বাকরে। ফলে দেশের সেনাবাহিনী দেশ বা জনগণকে কি প্রতিরক্ষা দিবে, তারা ব্যর্থ হয় এমন কি নিজেদের অফিসারদের জীবন বাঁচাতে। তাদের সে অক্ষমতার প্রমাণ, ২০০৯ সালে ঢাকার পিলখানায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৩ জন সেনা-অফিসারের নৃশংস মৃত্যু। পাকিস্তান ১৯৬৫ সালে ও ১৯৭১ সালে দুটি প্রকাণ্ড যুদ্ধ লড়েছে। কিন্তু কোন যুদ্ধেই দেশটির ৫৩ জন অফিসারের মৃত্যু হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশে এতো বড় হত্যাকাণ্ড কোন রণাঙ্গণে হয়নি, বরং রাজধানীর সেনা ছাউনিতে। অন্যদের প্রাণ বাঁচানো নিয়ে স্বৈরশাসকদের গরজ থাকে না; তাদের গরজ স্রেফ নিজের গদি বাঁচানো। সে কাজে তারা ব্যবহার করে পুলিশের সাথে দেশের সেনাবাহিনীকেও। নিরস্ত্র নাগরিক হত্যায় তখন ব্যারাক থেকে হাজার হাজার সৈন্য, মেশিন গান, ভারী কামান -এমন কি টাংক নামিয়ে আনে রাজপথে। জন্ম দেয় গৃহযুদ্ধের। বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণ সেনা বাহিনী, বিজিবি, RAB এবং মুজিব আমলের রক্ষি বাহিনী পালনে হাজার হাজার কোটি ব্যয় করেছে। বিগত ৪৬ বছরে দেশের সীমান্তে তারা কোন যুদ্ধ লড়েনি। বরং যুদ্ধ লড়েছে সে সব নিরস্ত্র নাগরিক হত্যায় -যারা তাদেরকে রাজস্ব দিয়ে পালে এবং অভিজাত এলাকায় প্লট দিয়ে রাজার হালে বাঁচার সুবিধা করে দেয়।

গণতন্ত্রে স্বৈরশাসক বাঁচে না। এজন্যই নিজেদের শাসন বাঁচাতে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারের যুদ্ধটি অবিরাম। অথচ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অর্থ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনকে সুরক্ষা দিতে জনগণের বিরুদ্ধে সে রক্তাত্ব যুদ্ধটি লড়েছিল রক্ষি বাহিনী। তিরিশ হাজারেরও বেশী নাগরিককে তারা হত্যা করেছিল। একই কারণে শেখ হাসিনার স্বৈর শাসন বাঁচাতে  সেনা বাহিনী, বিজিবি, RAB, এবং পুলিশের সেপাহীদের এতটা নৃশংস হতে দেখা যায়। ২০১৩ সালে ৫ই মে শাপলা চত্ত্বরে এসব বাহিনীর সেপাহীগণ সম্মিলিত ভাবে গোলাবারুদ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র মুছল্লীদের উপর। সে গণহত্যায় হাজার হাজার মানুষ নিহত ও আহত হয়েছিল। নিহতদের সংখ্যাটি গোপন করতে সরকারের আয়োজনটি ছিল চোখে পড়ার মত। হত্যাযজ্ঞ চলা কালে সেখানে কোন নিরপেক্ষ সাংবাদিককে থাকতে দেয়নি। নিভিয়ে দেয়া হয়েছিল রাস্তার আলো। খামোশ করে দেয়া হয়েছিল টিভি ক্যামেরা। ঐ রাতেই বন্ধ করে দেয় ইসলাম টিভি চ্যানেল। পেশাদার খুনি যেমন রাতের আঁধারে খুন করে পালিয়ে যেতে চায়, তেমন স্ট্রাটেজী ছিল শাপলা চত্ত্বরের খুনিদেরও। গণহত্যার কাজে সরকারি খুনিদের সুবিধাগুলি এমনিতেই বিশাল। তখন অপরাধ ঘটে এবং অপরাধের আলামত গায়েবের চেষ্টা হয় পুলিশী প্রহরায়। শাপলা চত্ত্বর থেকে লাশ গায়েব ও রক্তের দাগশূণ্য না হওয়া পর্যন্ত সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। গণহত্যার আলামত গায়েব করতে মিউনিসিপালিটির ময়লা বহনের গাড়িতে করে নিহতদের লাশ রাতারাতি সরানো হয়েছে। রক্ত দাগ মুছে ফেলা হয়েছে পানি ঢেলে। পরের দিন বুঝার উপায় ছিল না, সেখান কামান দাগা হয়েছে, হাজার হাজার রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে এবং শত শত মানুষকে সেখান নিহত ও আহত করা হয়েছে।

মানব ইতিহাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলি কোন কালেই হিংস্র পশুকুলের হাতে হয়নি। এমন কি ডাকাতদল বা সন্ত্রাসী দলের হাতেও নয়। এমন গণহত্যা একমাত্র জালেম স্বৈরশাসকের পক্ষেই সম্ভব। কয়েক হাজার নয়, কয়েক লক্ষ মানুষ হত্যা করলেও আদালতে তাকে আসামী রূপে দাঁড়াতে হয় না। সে হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেমন তদন্ত হয় না, তেমনি বিচারও বসে না। ফলে কারো শাস্তিও হয় না। কারণ, স্বৈরশাসকগণ শুধু খুন, গুম, ধর্ষণের ন্যায় অপরাধকেই বেগবান করে না, অচল করে বিচার ব্যবস্থাকেও। বরং বিচারকদের উপর ফরমায়েশ দেয়া হয় বিরোধীদের ফাঁসিতে ঝুলানোর তাগিদ দিয়ে –যেরূপ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েশাস্তিযোগ্য অপরাধ স্বাইপীর কথোপকথনে ধরা পড়েছে। স্বৈরাচারি শাসনের আযাবে তাই হাজার হাজার মানুষকে লাশ হয়ে হারিয়ে যেতে হয়। কিন্তু কেন তারা লাশ হলো, কীরূপে লাশ হলো এবং কারা লাশ করলো -সে বিষয়টি কখনোই জনগণের জানতে দেয়া হয় না। সেসব নৃশংস অপরাধের ঘটনাগুলিকে বলা হয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার গোপন বিষয়। অপরাধ গণ্য হয় সেগুলি জনগণকে জানানো। সে গোপন বিষয় যারা সাহস করে প্রকাশ করে, স্বৈর সরকার তাদেরকে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার শত্রুরূপে অভিযুক্ত করে। রিমান্ডে নিয়ে তাদের উপর নির্যাতন করে এবং দীর্ঘকালীন জেলশাস্তি দেয়।

 

অপরাধ হক কথা বলাও

স্বৈর-সরকারের ক্ষমতার কোন কোন সীমা-সরহাদ থাকে না। ইচ্ছামত তারা গ্রেফতার করে, গুম ও খুন করে, এবং সেনাবাহিনীকে দিয়ে গণহত্যা চালায়। শুধু তাই নয়, নিজ দলের ক্যাডাদের দিয়ে ধর্ষণ করায় এবং দলের নেতা-কর্মিগণ ব্যাংক, ট্রেজারি ও শেয়ার মার্কেট লুণ্ঠনে নামে। ভাবটা এমন, এসবই যেন শাসক দলের শাসনতান্ত্রিক অধিকার। তাদের কথা, ক্ষমতায় থাকতে হলে এগুলি করতেই হয়। তারা অনুসরণ করে ফিরাউন-নমরুদ-হিটলারের সুন্নত। তারা যেহেতু করে গেছে, অতএব এগুলি অপরাধ হবে কেন? তাদের বিচারই বা হবে কেন? বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধ তো ঘটে যাওয়া নৃশংসা ঘটনাগুলির চিত্র বাইরে প্রকাশ করা –বিশেষ করে বিদেশীদের কানে তুলে দেয়া। তাদের কথা, এসব গোপন বিষয় অন্যরা জানলে দেশের সম্মানের ক্ষতি হয় এবং দেশের শান্তি বিনষ্ট হয়। অতএব যারাই সরকারের গোপন বিষয় প্রকাশ করে তাদের শাস্তি দেয়াই বাংলাদেশের স্বৈর-সরকারের নীতি। একই নীতি মায়ানমার সরকারেরও। এবং বিচারের রায়ে তো সেটিই কার্যকর হয় -যা সরকার চায়। সম্প্রতি মায়ানমারের সরকার “রয়টার” সংবাদ সংস্থার দুইজন বার্মিজ সাংবাদিককে এরূপ অপরাধে গ্রেফতার করেছে এবং বিচার করেছে। এবং বিচারে ৭ বছরের জেল দেয়া হয়েছে। তাদের অপরাধ, রোহিঙ্গাদের গ্রামে গিয়ে আর্মির গণহত্যা ও গণকবরের কিছু চিত্র তাঁরা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে। একই রূপ অপরাধে বাংলাদেশের সরকার চিত্রশিল্পী শহীদুল আলমকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে। শহীদুল আলমের অপরাধ, নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামা কিশোর বিদ্রোহীদের উপর পুলিশ ও সরকার দলীয় ক্যাডারদের নৃশংসতার কিছু বিবরণ তিনি আল-জাজিরা’কে জানিয়েছেন।

স্বৈরশাসকের নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা যে এক নয় –সে আইনগত ও নৈতিক বিষয়টি স্বৈরশাসগণ নিজ স্বার্থে ইচ্ছা করেই বুঝতে রাজি নয়। বুঝতে রাজী নয়, তাদের অনুগত আদালতের বিচারকগণও। ফলে প্রকাশ পায়, জনকল্যাণ নিয়ে তাদের যেমন আগ্রহ নাই, তেমনি আগ্রহ নেই অপরাধের নির্মূল নিয়েও। ফলে গরজ নেই, যেসব ভয়ংকর অপরাধীদের হাতে দেশ জিম্মি -তাদের বিচার নিয়েও। কারণ, অপরাধীগণ জনগণের শত্রু হলেও সরকারের শত্রু নয়। প্রতিবছর বাংলাদেশে একমাত্র বাস ড্রাইভারদের হাতেই প্রায় ৮ হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে। কিন্তু তাতে স্বৈর-সরকারের ক্ষতি কি? মানুষ মারা পড়লেও স্বৈর-সরকারের কর্তাব্যক্তিদের গায়ে যে আঁচড় লাগছে না –তাতেই সরকার খুশি। অতএব, অপরাধীদের গ্রেফতার করা বা তাদের বিচার করা –সরকারের কাছে গুরুত্ব পাবে কেন? তাদের এজেন্ডা তো সরকার-বিরোধীদের নির্মূল করা। হিফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে এজন্যই শাপলা চত্ত্বরে ভারী কামান ও গোলাবারুদ দিয়ে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছিল।

হত্যা, গুম ও নির্যাতনে স্বৈরশাসকের এতোটা নির্ভয় ও নৃশংস হওয়ার কারণ, ক্ষমতায় থাকার জন্য তাকে নিহত, আহত ও নির্যাতিতদের পরিবারের কাছে গিয়ে ভোট চাইতে হয় না। স্বৈরশাসক জানে, নির্বাচনে জিতবার জন্য জনগণের ভোটের দরকার নেই। সে কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি চাকর-বাকরগণই যথেষ্ঠ। প্রয়োজনীয় ভোট তারা কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভোটের বাক্সে ঢালতে পারে। অতএব পরওয়া কিসের? ফলে গদি বাঁচাতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা, অসংখ্য নগর ধ্বংস এবং নিজ দেশে বিদেশী শত্রুদের ডেকে আনতেও তারা পিছুপা হয় না। নিজের গদি ছাড়া কোন কিছুর উপরই স্বৈরশাসকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ তো তারই দৃষ্টান্ত। একই নীতি যে শেখ হাসিনারও। সেটি বুঝার জন্য শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যার পর আর কোন প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে কি? শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যাটি কীরূপ নৃশংস এবং কতোটা বিশাল ছিল সেটি জানার জন্য google’য়ে শাপলা চত্ত্বর লিখে টোকা মারাই যথেষ্ট। তখন দেখা যায়, সে বীভৎসতার অসংখ্য ছবি।

 

যুদ্ধ ঈমান ও অধিকার বিনাশে

স্বৈর-শাসকগণ কখনোই তাদের নিজেদের শত্রুদের চিনতে ভুল করে না। কারণ, এখানে ভূল হলে তাদের শাসন বাঁচে না। তাদের সে মূল্যায়নে শত্রু রূপে গণ্য হয় যেমন সাধারণ জনগণ, তেমনি তাদের উদ্দীপ্ত ঈমান। স্বৈরশাসকগণ সব সময়ই জনগণকে দুর্বল দেখতে চায়। কারণ, একমাত্র তাতেই বাড়ে তাদের গদির নিরাপত্তা। নির্বাচন যেহেতু জনগণের শক্তি প্রয়োগের হাতিয়ার, ফলে স্বৈরাচারি শাসক মাত্রই চায় সে হাতিয়ারটি বিকল করতে বা কেড়ে নিতে। স্বৈরশাসকদের দুষমনি তাই বিশেষ কোন রাজনৈতিক দল বা কোন নেতা বা নেত্রীর বিরুদ্ধে নয়, বরং সেটি খোদ জনগণের বিরুদ্ধে। চোর-ডাকাতের অপরাধ, তারা হাত দেয় জনগণের অর্থসম্পদে। কিন্তু স্বৈরশাসকদের অপরাধ তার চেয়েও নৃশংস। তাদের হানাটি শুধু অর্থসম্পদের উপর নয়, জনগণের নাগরিক অধিকারের উপরও। ফলে স্বৈর-শাসনামলে জনগণের রাষ্ট্রীয় অর্থভাণ্ডারের উপর চুরি-ডাকাতিটা মামূলী বিষয়ে পরিণত হয়; ছিনতাই হয় জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। এবং প্রহসনে পরিণত হয় নির্বাচন।

গণতান্ত্রিক অধিকার বিনাশের পাশাপাশি নরনারীর ঈমান ধ্বংসেও স্বৈরাচারি সরকারের যুদ্ধটি লাগাতর। কারণ তারা জানে, ঈমানদার মাত্রই স্বৈরাচার নির্মূলের মিশন নিয়ে বাঁচে। স্রেফ নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত নিয়ে নয়, তারা বাঁচে একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়েও। সেটি হলো, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের নির্মূল। আল-কোরআনের ভাষায় “আমিরু বিল মারুফ, নেহী আনিল মুনকার।” ফলে তারা জানে, ঈমানদার ব্যক্তি কখনোই স্বৈরশাসকের মিত্র হয় না। মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত সে মিশনটির কারণেই নবী-রাসুলগণ যুগে যুগে দুর্বৃত্ত শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। অপরদিকে স্বৈরশাসকগণ নেমেছে তাদের নির্মূলে। স্বৈরশাসকের এজেন্ডা তাই স্রেফ জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া বা নির্বাচন প্রক্রিয়া বিকল করা নয়, বরং জনগণের ঈমান বিলুপ্ত করাও। কারণ, স্বৈরশাসকদের সমস্যা ঈমানদারের দেহ, ভাষা বা বর্ণ নিয়ে নয়, বরং তাদের ঈমান নিয়ে। ঈমান বিলুপ্ত হলেই তাদের মিত্র হতে আর কোন বাধা থাকে না।

এজন্যই জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে রাখা এবং তাদের ঈমান, আমল ও নৈতিকতা বিনষ্ট করার কাজে স্বৈরচারি শাসকচক্রের রাজনৈতিক ও সোসাল ইঞ্জিনীয়ারিংটি বাংলাদেশেও চোখে পড়ার মত।  ফিরাউন, নমরুদ ও আবু জেহলগণ যুগে যুগে ইসলাম ও নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে ক্ষেপিয়েছে। মহান নবীজী (সাঃ)র গায়ে পাথর মারতে কিশোরদের উস্কে দিয়েছিল তায়েফের সর্দারগণ। অবিকল সেরূপ একটি পরিকল্পণার অংশ রূপেই বাংলাদেশের স্বৈর-সরকারও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তায় নামিয়েছে ইসলামপন্থি নেতাদের ফাঁসির দাবী তুলতে। ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে শহরে শহরে নির্মূল কমিটিরও জন্ম দিয়েছে। তাদের কাছে সন্ত্রাস এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলো জিহাদ, শরিয়ত, হুদুদ ও খেলাফতের পক্ষ নেয়াটি।

 

সবচেয়ে বড় নাশকতাটি স্বৈর-শাসকের

মানবজীবনে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি সম্পদের ক্ষতি নয়; বরং সেটি ঘটে ঈমানের বিরুদ্ধে নাশকতায়। অথচ জনগণের বিরুদ্ধে সে ভয়ানক নাশকতাটি ঘটায় দেশের স্বৈর সরকার। সেটি শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মিডিয়া, সাহিত্য তথা নানা রূপ সোসাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের মাধ্যমে। প্রশ্ন হলো, জনগণের এত বড় ক্ষতি কি কোন হিংস্র জন্তু-জানোয়ার, বিষাক্ত কীটপতঙ্গ বা রোগজীবাণূর হাতে ঘটে? সমাজের চোর-ডাকাতগণও কি মানব জীবনে এতবড় নাশকতা ঘটায়? জনগণের আর্থিক ক্ষতি করলেও তাদেরকে তারা জাহান্নামে নেয় না। ভয়নাক সে নাশকতাটি ঘটে স্বৈরাচারি সরকারের হাতে। তাই মহান আল্লাহতায়ালার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় নেক কর্মটি কোটি কোটি টাকার দান-খয়রাত নয়, শত শত স্কুল- কলেজ-মাদ্রসা বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাও নয়। জঙ্গলের হিংস্র পশু বা বিষাক্ত কীট হত্যাও নয়, বরং সেটি হলো স্বৈরাচারি শাসক নির্মূল। পৃথিবীপৃষ্টে এরাই হলো শয়তানের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি। অন্যায়ের নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের নির্মূল ছাড়া কি ভিন্ন পথ আছে? এরূপ শাসকদের বিরুদ্ধে হক কথা বলাটিও উত্তম জিহাদ; আর তাদের নির্মূলের যুদ্ধে প্রাণ গেলে জুটে শহীদের মর্যাদা।

কোন মুসলিম দেশে স্বৈরশাসন দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার বিপদটি অতি ভয়াবহ। তারা বাঁচলে জনগণের জীবনে বাড়ে ইসলাম থেকে দুরে সরাটি। আর ইসলাম থেকে দুরে সরার অর্থ তো জাহান্নামের পথে ধাবিত হওয়া। এবং বাংলাদেশে দুরে সরানোর সে কাজটি চলছে জনগণের রাজস্বের অর্থে এবং ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, মিডিয়া ও সাহিত্য-সংঙ্গিতের নামে। বস্তুতঃ এটি হলো জনগণকে ঈমানশূণ্য করার সরকারি পরিকল্পনা। ঈমানশূণ্য করার সে পরিকল্পনা কতটা সফল হচ্ছে সেটি বুঝা যায়, দেশে চুরি-ডাকাতি, গুম,খুন, ধর্ষণ, ব্যাভিচারি, সন্ত্রাস কতটা বাড়লো -তা দিয়ে। আরো বুঝা যায়, দুর্বৃত্তগণ দেশের রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, প্রশাসন ও আইন-আদালতে কতটা অধিকার জমালো এবং ফিরাউনের ন্যায় শাসকগণ কতটা আয়ু পেল -তা থেকে। এরূপ দুর্বৃত্তকরণ প্রক্রিয়া বলবান হলে ফিরাউনগণ শুধু শাসকের পদে থাকে না, তারা ভগবানেও পরিণত হয়। তখন রাষ্ট্রের নীতি এবং সে সাথে উৎসবের বিষয় রূপে গণ্য হয় আল্লাহভীরু মানুষদের হত্যা করাটি। অপরাধীদের হাতে অধিকৃত এরূপ রাষ্ট্র পরিণত হয় পৃথিবীর পৃষ্ঠে সবচেয়ে বিপদজনক প্রতিষ্ঠানে। সমাজের বুকে সবচেয়ে বড় নেক কর্মটি চোর-ডাকাত নির্মূল নয়। বাঘ-ভালুক তাড়ানোও নয়। বরং এরূপ বিপদজনক রাষ্ট্রের হাতে থেকে পরিত্রানের ব্যবস্থা করা। এটিই তো নবীজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। নির্মূলের সে কাজে নবীজী (সাঃ) ও তারঁ সাহাবাদের লাগাতর জিহাদ করতে হয়েছে। সে সূন্নতের বরকতেই আরবভূমিসহ বিশ্বের বিশাল ভূভাগ থেকে অপরাধীদের শাসন বিলুপ্ত হয়েছিল। অথচ আজকের মুসলিমগণ নবীজী (সাঃ)র সে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূন্নতটি বাদ দিয়েই তাঁর অনুসারি হতে চায়।  ১৮.০৩.২০১৯

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *