শুরুর কাজটিই শুরুতে করা হয়নি

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

যে জরুরি কাজটি কোন কালেই করা হয়নি

পূর্ণ ইসলাম পালন, ইসলামী রাষ্ট্র ও সভ্যতার নির্মাণ এবং ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠার কাজে বাঙালি মুসলিমদের ব্যর্থতাটি বিশাল। সে ব্যর্থতার কারণে গৌরব যুগের মুসলিমদের সাথে বাঙালি মুসলিমদের অবদান ও চারিত্রিক পার্থক্যটিও বিশাল। সে কালে তাঁরা ইতিহাস গড়েছিলেন সর্বকালের সভ্যতা নির্মাণে এবং ইসলামের দ্রুত প্রসার ঘটিয়ে; অথচ বাঙালি মুসলিম ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশকে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম করে। ইতিহাস গড়েছে ভারতের অধিনত ভূমি, ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি ও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে। তবে বাঙালি মুসলিম ব্যর্থতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। প্রতিটি রোগের পিছনে সুনির্দিষ্ট কারণ ও প্যাথোলজি থাকে, তেমনি বাঙালি মুসলিমের এহেন ব্যর্থতারও সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। এ ব্যর্থতার মূল কারণ, নবীজী (সা:) যেখান থেকে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার কাজের শুরু করেছিলেন, সে কাজটিই বাংলাদেশে কোন কালেই হয়নি। একই রূপ অবস্থা ভারতীয় মুসলিমদেরও। সে কাজটি যেমন সুলতানী ও মোগল আমলে হয়নি, তেমনি আজও হচ্ছে না। ব্রিটিশ আমলে তো হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এর অর্থ, নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত পূর্ণাঙ্গ ইসলামের সাথে বাঙালি মুসলিম এবং সে সাথে ভারতীয় মুসলিমদের পরিচয়টি কোন কালেই ঘটেনি। এর ফল হলো, নবীজী (সা:)’র ইসলামকে সঠিক ভাবে না জেনে এবং ইসলাম পালনের কাজটি পূর্ণ ভাবে না করেও তারা মুসলিম পরিচয় নিয়ে বাঁচে।

নবীজী (সা:)’র আমলে ইসলামের পথে চলার কাজটি শুরু হয় কুর’আন বাণীগুলিকে হৃদয়ে বসিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে। সর্ব প্রথম নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ করা হয়নি, ফরজ করা হয়েছে কুর’আন বুঝা। “ইকরা বিসমে রাব্বিকাল্লাযী খালাক” – এটিই হলো মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নবীজী (সা:) এবং সে সাথে সমগ্র মানবের প্রতি প্রথম নির্দেশ। ইসলামের মূল নীতি হলো, যে নির্দেশ মহান রব’য়ের পক্ষ থেকে আসে -সেটির পালন প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ হয়ে যায়। মুসলিম জীবনের শুরুটি নিজ চেতনার পরিশুদ্ধির মধ্য দিয়ে। আমলের তথা কর্ম ও চরিত্রের পরিশুদ্ধি  আসে চেতনার পরিশুদ্ধির পর। সে চেতনার পরিশুদ্ধির কাজটি ঘটে নিজ মনের জাহিলিয়াত নির্মূলের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এটিই হলো মু’মিনের বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। ইসলামের পথে মু’মিনের যাত্রা শুরু হয় এ জিহাদের মধ্য দিয়ে। সে জিহাদের মূল হাতিয়ার হলো পবিত্র কুর’আন। পবিত্র কুর’আনে সে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের নির্দেশটি এসেছে এভাবে:      

فَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَجَـٰهِدْهُم بِهِۦ جِهَادًۭا كَبِيرًۭا

অর্থ: “অতঃপর তোমরা কাফিরদের অনুসরণ করো না, এবং তাদের বিরুদ্ধে কুর’আন দিয়ে বড় জিহাদটি করো।” –(সুরা ফুরকান, আয়াত ৫২)।

ব্যক্তির চেতনা নিয়ন্ত্রন করে তার স্বপ্ন, ভাবনা, কর্ম ও আচরণ। তাই চেতনার ভূমি মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা মতবাদ ও নানা রূপ শয়তানী কুমন্ত্রনায় অধিকৃত রেখে মুসলিম হওয়া যায় না। চরিত্রের পরিশুদ্ধির জন্য প্রথম জরুরি কাজটি চেতনার পরিশুদ্ধি। চেতনার পরিশুদ্ধির জন্য অপরিহার্য হলো কুর’আনের জ্ঞান, তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ  হলো পবিত্র কুর’আন সঠিক ভাবে এবং মনকে পূর্ণ নিবিষ্ট করে বুঝে পাঠ করা । তাই নবীজী (সা:)’র উপর সে নির্দেশটি এসেছে প্রথম দিকে নাযিলকৃত সুরা মুজাম্মিলে। বলা হয়েছে:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلْمُزَّمِّلُ ١

قُمِ ٱلَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًۭا ٢

نِّصْفَهُۥٓ أَوِ ٱنقُصْ مِنْهُ قَلِيلًا ٣

أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ ٱلْقُرْءَانَ تَرْتِيلًا ٤

অর্থ‍: “হে চাদর আবৃত ব্যক্তি (হে মহম্মদ!); খাড়া হয়ে যান রাতের কিছু অংশ বাদে সমগ্র রাতের জন্য: রাতের অর্ধেক বা তার চেয়ে কিছু কম সময়ের জন্য; অথবা তা থেকে কিছু অধিক রাতের জন্য, আর ধীরে ধীরে স্পষ্ট ভাবে পাঠ করুন কুর‌আন।” –(সুরা মুজাম্মিল, আয়াত ১-৪)।

উপরিউক্ত ৪টি আয়াত নাযিল হয়েছে নির্দেশের ভাষায়। এবং সেটি এমন এক সময় যখন ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়নি। ইসলামের বিধান হলো, যখন মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নবীজী (সা:)’র উপর কোন নির্দেশ আসে তখন সেটি সকল মুসলিমদের উপর ফরজ ইবাদত হয়ে যায়। এখানে হুকুম এসেছে ধীরে ধীরে ও স্পষ্ট ভাবে পাঠ করুন কুরাআন তেলাওয়াতের এবং সেটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আধা রাত বা তার চেয়ে বেশী সময় ধরে। এটিই ছিল মুসলিমদের জন্য সে সময়ের ইবাদত। এটি ছিল কুর’আনের পবিত্র বাণীকে মুসলিমদের মনের গভীরে বসিয়ে দেয়ার মহান আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব হিকমত। কোন ব্যক্তি যদি কোন কবিতার কয়েকটি চরণ রাতের অর্ধেক ভাগ জুড়ে একাকী ধীরে ধীরে বার বার পাঠ করে -তবে সে কবিতার প্রতিটি শব্দ তার মনে বসে যাবে। সে আর কোন দিন সে কবিতার কথা আর ভুলবে না। আর এখানে যা তেলাওয়াত করতে বলা হচ্ছে সেটি কোন কবিতার চরণ নয়, বরং সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত পবিত্র কুর’আনে আয়াত। একজন মুসলিমের কাছে তার মর্যাদা ও গুরুত্বই ভিন্ন।

 

ব্যর্থ হচ্ছে নামাজ

মুসলিমদের উপর ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছে নবীজী (সা:) যখন মিরাজে যান তখন। মিরাজের ঘটনা ঘটেছে হিজরতের এক বছরের সামান্য কিছু কাল আগে। এর অর্থ, ইসলামের প্রায় প্রথম ১২ টি বছর ধরে মুসলিমদের ইবাদত ছিল এভাবে রাত জেগে জেগে ধীরে ধীরে স্পষ্ট ভাবে উচ্চারন করে পবিত্র কুর’আন তেলাওয়াত। আজও নামাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ক্বিয়ামের অংশটি অর্থাৎ যখন নামাজে দাঁড়িয়ে কুর’আনের আয়াত পাঠ করা হয়। পবিত্র কুর’আন যখন পাঠ করা হয় তখন মহান আল্লাহ তায়ালা সে বান্দার সাথে কথা বলেন। তাই ক্বিয়ামের সময় যত দীর্ঘ হয় ততই দীর্ঘ হয় সে কথোপকথন। এতে বাড়ে নামাজের ওজন। এভাবেই নামাজ মুমিনের হৃদয়ে কুর’আনকে তথা আল্লাহর বাণীকে বাঁচিয়ে রাখে। এজন্যই নামাজকে বলা হয় যিকর তথা আল্লাহর স্মরণ। এজন্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো নামাজে পবিত্র কুর’আন থেকে যা পাঠ করা হয়- তা পুরোপুর বুঝা। সে বুঝার কাজটি না হলে নামাজ তার কাঙ্খিত ফল দিতে ব্যর্থ হয়। তাই নামাজকে ফলবান করতে মিশর, সুদান, ইরাক,সিরিয়া, মরক্কো, লিবিয়া, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়াসহ বহু দেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে আরবী ভাষা গ্রহণ করেছে।    

ইসলামের প্রথম দিকে মদ্যপান যখন হারাম হয়নি, তখন অনেকে মদ খেয়ে নেশগ্রস্ত অবস্থায় নামাজে খাড়া হতো; এতে নামাজে যা পাঠ করা হতো -তারা তা বুঝতো না। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে এমন নামাজ ভাল লাগেনি। এতে ব্যর্থ হচ্ছিল নামাজের মূল উদ্দেশ্য। তাই তিনি হুকুম দেন, মাদকাসক্ত অবস্থায় কেউ যেন নামাজে না আসে। এরশাদ হয়েছে:

        يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَقْرَبُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنتُمْ سُكَـٰرَىٰ حَتَّىٰ تَعْلَمُوا۟ مَا تَقُولُونَ

   অর্থ: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়োনা যখন তোমার মাদকাসক্ত অবস্থায় থাকো, এবং যতক্ষন না তোমরা নামাজে যা বলছো -তা বুঝতে না পারো।”‍ –(সুরা নিসা, আয়াত ৪৩)।

মাদকাসক্ত হলে মগজ কাজ করে না; মুখে যা বলে তা বুঝতে পারে না। অথচ আল্লাহ তায়ালা চান, নামাজী ব্যক্তি নামাজে দাঁড়িয়ে যা তেলাওয়াত করে -তা তাকে পুরোপুরি বুঝতে হবে। মদ্যপান সে সামর্থ্য কেড়ে নেয় বলেই যতক্ষণ মদের আছড় থাকে ততক্ষণ নামাজ থেকে দূরে থাকতে নির্দশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে অবশ্য মদ্যপান পুরোপুরি হারাম করে দেয়া হয়। কিন্ত প্রশ্ন হলো, মদ পান না করেও যারা নামাজে যা পাঠ করা হয় তা বুঝতে পারে না -তাদের নামাজে কি মহান আল্লাহ তায়ালা খুশি হবেন? তাদের নামাজ গৃহিত হবে কিনা -সেটি একমাত্র আল্লাহতায়ালাই ভাল জানেন। তবে তাদের সেরূপ অবুঝ নামাজ যে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে পছন্দের নামাজ নয় -তা তো তিনি উপরিউক্ত আয়াতে স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন।  নামাজ মুমিনের যে যিকির -তা তো সে অবুঝ নামাজে হচ্ছে না। তাছাড়া  নামাজ যেভাবে নামাজীর সাথে পবিত্র কুর’আনের বন্ধন গড়তে চায় -সে লক্ষ্যও তো সে নামাজে অর্জিত হয় না। বুঝতে হবে, কুর’আনকে মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা আল ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে হাবলিল্লাহ তথা আল্লাহর রশি বলেছেন। তাই কুর’আনের সাথে যে ব্যক্তি বন্ধন মজবুত করে, সে বন্ধন মজবুত করে মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে। ফলে কুর’আন বুঝায় অক্ষম ব্যক্তি নামাজ থেকে তেমন লাভবান হয়না। মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে তাদের বন্ধনহীনতা স্পষ্ট দেখা যায় তাদের কর্ম,  চরিত্র, আচরণ, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে।  এমন নামাজীরাই নামাজ পড়ে ঘুষ খায়, সূদ খায়,মিথ্যা বলে, মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত ও শরিয়তকে বিলুপ্ত রাখার রাজনীতি করে। এরা বিরোধীতা করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে কোন উদদ্যোগকে। এমন নামাজী মুসলিম উম্মাহর ঘরের শত্রু। মুনাফিক উৎপাদিত হয় এমন নামাজীদের মধ্য থেকেই।          

 

যে জিহাদ প্রতিক্ষণের

 ঈমান নিয়ে বাঁচতে হলে অবশ্যই প্রতিক্ষণ জিহাদ নিয়ে বাঁচতে হয়। এ জিহাদ ঈমান বাঁচানোর। জিহাদ এখানে চেতনার ভূমিকে দূষিত ধারণা, শয়তানের কুমন্ত্রণা, মিথ্যা ধর্ম, ভ্রান্ত মতবাদের হামলা থেকে প্রতি মুহুর্ত প্রতিরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে। সে জিহাদের মূল অস্ত্রটি হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান -যার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে উপরিউল্লিখিত সুরা ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে। যার সে জ্ঞান নাই, তার চেতনার ভূমি অতি সহজেই অধিকৃত হয়ে যায় অনৈসলামী ধ্যান-ধারণায়। এজন্য বহু বাঙালি মুসলিম নামাজ পড়েও জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও কম্যুনিজমের স্রোতে ভেসে যায় এবং শরিয়ার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ প্রতিরোধে খাড়া হয়। সেরূপ স্রোতে ভাসাদের এক দৃষ্টান্ত হলো মাওলান ভাষানী। তিনি মাওলানা পদবী ধারণ করেও তিনি ভেসে গেছেন বামধারার স্রোতে। ইসলামের পক্ষে না দাঁড়িয়ে তিনি চীনমুখী হয়েছেন এবং ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্প নিয়ে হিন্দুত্ববাদী ভারতের কোলে গিয়ে উঠেছেন।  

বাঙালি ও ভারতীয় মুসলিমদের মূল সংকটটি হলো, বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে তারা নিরস্ত্র। কারণ, তাদের ভাণ্ডারে নাই  কুর’আনী জ্ঞানের অস্ত্র।  তারা কুর’আন তেলাওয়াত করে বটে, কিন্তু তারা কুর’আন বুঝার চেষ্টা করে না এবং তা থেকে জ্ঞান অর্জনও করে না। সে ব্যর্থতাটি প্রকট ভাবে ধরা পড়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের দিকে নজর দিলে। মুসলিমকে নামাজ দিনে ৫ বার এবং রোজা বছরে এক মাস পালন করলেই চলে, কিন্তু জিহাদ নিয়ে বাঁচতে হয় প্রতি দিনি ও প্রতিক্ষণ। কারণ চেতনার ভূমিতে শয়তানের হামলাটি প্রতিক্ষণ। রণাঙ্গণে হামলার মুখে দাঁড়িয়ে কি নিষ্ক্রিয় থাকা যায়? সেখানে অস্ত্র হাতে সব সময় প্রস্তুত থাকাই ফরজ। এজন্যই নামাজ-রোজায় ক্বাজা থাকলেও জিহাদে কোন ক্বাজা নাই। এবং সে জিহাদটির শুরু বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ দিয়ে। সেটি শুরু হয় মুসলিম হওয়ার প্রথম দিন থেকেই। কুর’আনী জ্ঞান এখানে অস্ত্র।

 

মহান আল্লাহ তায়ালা চান, শয়তানী পক্ষের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে মুসলিমগণ বিজয়ী হোক। সে জন্যই ঈমানদারের হাতে পবিত্র কুর’আনের ন্যায় মোক্ষম অস্ত্রটি তুলে দিয়েছেন। সে কুর’আনের কারণে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ সে আমলের বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে প্রবল ভাবে বিজয়ী হয়েছিলেন। কারণ, তারা প্রচণ্ড সফল হয়েছিলেন কুর’আন থেকে জ্ঞান লাভের কাজে। কুর’আনের মোকাবেলায় কাফিরদের হাতে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র ছিল না। এবং আজও সেটি নাই।

তবে ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদকে শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে সীমিত রাখলে চলেনা, শয়তানী শক্তির নির্মূলের কাজটি করতে হয় রাষ্ট্রীয় অঙ্গণ থেকেও। তখন সে জিহাদ শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ থাকে না, পরিণত হয় সশস্ত্র জিহাদে। সে উভয় জিহাদে শামিল হয়েছিলেন সেদিনের প্রতিটি মুসলিম। এখানেই বাঙালি মুসলিমের ব্যর্থতা। তার যেমন হতে পারিনি বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের মুজাহিদ, তেমনি হতে পারিনি সশস্ত্র জিহাদের মুজাহিদ।  ফলে চেতনার ভূমিতে যখন জাতীয়তবাদ, সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজম ও হিন্দুত্ববাদের হামলা হলো -তখন মোকাবেলা না করে সে সব মতবাদের স্রোতে তারা ভেসে গেল। আবার যখন ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ কাফির শক্তি এবং  ১৯৭১ সালে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের হামলা হলো -তখনও তাদের দেখা যায়নি সশস্ত্র জিহাদে।     

 

 বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে নিরস্ত্র বাঙালি মুসলিম

 বাংলার বুকে মুসলিম শাসনের শুরুতে শাসকগণ ব্যস্ত থেকেছে রাজ্য বিস্তার, রাজ্য শাসন ও তাদের আরাম আয়েশ নিয়ে। ইসলামের প্রচারে তাদের কোন আগ্রহ ছিলনা, তাদের মূল আগ্রহটি ছিল স্রেফ নিজ শাসনের সুরক্ষা নিয়ে। সেটি করতে গিয়ে পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে, ভাই ভাইকে বন্দী বা হত্যা করেছে। বাংলা ও ভারতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তুর্কি ও আফগানদের শাসন; তাদের সাথে তাদের নিজ দেশ থেকে সুফিরাও এসেছেন। বাংলার বুকে ইসলামের প্রচার এসব সুফিদের হাতেই হয়েছ; আরবদের হাতে হয়নি। ফলে ইসলামে দূষণ ঘটে গেছে বাঙালি মুসলিমদের হাতে পৌঁছার আগেই। ইসলাম নিয়ে বাঁচার অর্থ অন্যদেরক ইসলামের দিকে ডাকা ও যে জিহাদ নিয়ে বাঁচা -সে ধারণাই তারা পাননি।  ফলে যারা মুসলিম হয়েছেন, ইসলামের স্রোত তাদের কাছে এসেই থেমে গেছে। তারা আর অন্যদের ইসলামের দাওয়াত পৌছে দেয়ার চেষ্টা করেনি। এমন কি নিজ পাড়ার প্রতিবেশীদের কাছেও নয়। ফলে মিশর, সুদান, ইরাক, সিরিয়া, আলজিরিয়া, লিবিয়া, তুরস্ক ও মরক্কোর ন্যায় দেশগুলিতে যেরূপ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলাম কবুল করেছে, সেটি বাংলা ও ভারতের ক্ষেত্রে ঘটেনি। কারণ, কুর’আন বুঝার ক্ষেত্রে ভারতে আগত অনারব তুর্কি, ইরানী ও আফগান মুসলিমদের নিজেদেরই ছিল বিশাল অপূর্ণতা। তারা নানারূপ সুফি ত্বরিকার প্রচার ঘটালেও কুর’আনের জ্ঞানের তেমন প্রসার ঘটাননি। নওমুসলিমদের মাঝে কুর’আন বুঝার সামর্থ্যও সৃষ্টি করেননি। অথচ সেটি করেছেন প্রাথমিক যুগের আরব মুসলিম প্রচারকগণ। এর কারণ, এই সুফিদের নিজেদের ছিল আরবী ভাষা ও কুর’আনী জ্ঞানের অভাব। ফলে নিজেদের চেতনার ভূমিতেও ইসলামের পক্ষে তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটিও ঠিক মত লড়েননি। সুফিগণ মাদ্রাসা না গড়ে সুফি খানকাহ গড়েছেন। তাদের মাঝে ছিল না নবীজী (সা:)’র প্রচারিত পূর্ণ ইসলাম।  আল্লাহর কুর’আনী বাণীর বদলে তারা নিজেদের বাণীকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা নবীজী (সা:)ও তাঁর সাহাবাদের ত্বরিকা অনুসরণ করেননি।

সাহাবাদের আমলে ইসলামের প্রচার কোন সুফি ত্বরিকা মতে হয়নি; সেটি হয়েছে নবীজী (সা:)’র দেখানো পথে। ফলে সে আমলে ইসলাম যেখানে গেছে সেখানকার প্রায় শতভাগ মানুষ মুসলিম হয়ে গেছে। এবং যারা মুসলিম হয়েছে তারা নিজেরাও ইসলামের প্রচারকে পরিণত হয়েছে। অথচ সুফিদের হাতে কুর’আনের ন্যায় ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্রটি ততটা ব্যবহৃত হয়নি।  ফলে সে অপূর্ণাঙ্গ ইসলামের দ্রুত প্রসার রুখতে শ্রী চৈতন্যদেব ও তার সাথীরা যখন ভক্তিমূলক গান নিয়ে হাজির হলেন, তখন দ্রুত থেমে গেল বাংলাসহ সমগ্র ভারতে ইসলামের প্রসার। চৈতন্যদেব ও তার সাথীদের রুখতেও এসব সুফিরা ব্যর্থ হলেন। চৈতন্যদেব হাজির হয়েছিল হিন্দু সুফি রূপে। এরই পরিণত হলো, ৬ শত বছরের মুসলিম শাসনের পরও মুসলিমগণ ভারতে সংখ্যালঘিষ্ঠই থেকে গেছে। ফলে বিশল ভূ-ভাগ জুড়ে ধর্মীয় অঙ্গণে বিজয়ী থেকে গেছে পৌত্তলিকতার আদিম অজ্ঞতা। ফলে ভারতে মুসলিম বিজয়টি সামরিক বিজয় হলেও ইসলামের বিজয় হতে পারেনি। ভারতে মুসলিম শাসনের এটিই হলো সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার কারণ, এসব মুসলিম শাসকগণ অন্যদের আর কি মুসলিম করবে -তারা নিজেরাই ব্যর্থ হয়েছিল পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হতে। সূর্যের আলো মেঘে ঢাকা পড়লে সেটি পূর্ণভাবে দেখা যায়না। সুফিরাও তেমনি ইসলামের পূর্ণ রূপটি মানুষের সামনে আসতে দেননি।  

সুফি-দরবেশগণ ব্যস্ত থেকেছে খানকা, হুজরা ও দরগা নির্মাণ ও যিকির ও ওজিফা পাঠ নিয়ে। তাদের কাছে কুর’আন বুঝা ও জনগণকে কুর’আন বুঝানো তেমন গুরুত্ব পায়নি। ফলে মিশর, ইরাক, সুদান, লিবিয়া, আলজিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ার জনগণ মুসলিম হওয়ার সাথে সাথে যেরূপ কুর‌’আন বুঝার লক্ষ্যে মাতৃভাষাকে পরিত্যাগ করে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছিল -তেমনটি বাংলাদেশে ঘটেনি। ফলে সাধিত হয়নি সঠিক ভাবে সে কুর’আনী ইসলাম বুঝার কাজ। ফলে নবীজী (সা:) যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা দিয়ে যান তা বাংলাদেশে কোন কালেই প্রতিষ্ঠা পায়নি। ইসলাম পালন সীমিত থেকে গেছে নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, দোয়া-দরুদ, ওজিফা পাঠ, কবর জিয়ারতের মাঝে। ফলে নবীজী (সা:) যেভাবে ইসলাম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন সেটি বাংলা বা ভারতের কোথাও প্রতিষ্ঠা পায়নি। ফলে নবীজী (সা:)’র আমলের ইসলাম বাদ দিয়েই বাংলা ও ভারতের মুসলিমগণ ইসলাম পালন করেছে।

 

ঈমানে অপূর্ণতা ও সাংস্কৃতিক দূষণ

মুসলিমের ঈমানের অপূর্ণতা দেখা যায় প্রশাসনিক, বৈচারিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক অঙ্গণে দূষণ ও ভ্রষ্টতায়। সে দূষণ ও ভ্রষ্টতা দেখা গেছে বাংলা ও ভারতের মুসলিম শাসনালে।  রাজদরবার, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের গুরুত্ব পূর্ণ স্থানে থেকে গেছে পৌত্তলিকগণ। এমনটি আরব মুসলিম শাসকদের হাতে ঘটেনি। মোগল সম্রাট আকবর ইসলাম থেকে এতোটাই দূরে সরেছিল যে, সে ইসলামকে বাদ দিয়ে এক নতুন ধর্ম “দ্বীনে ইলাহী”র জন্ম দিয়েছিল এবং যুদ্ধ শুরু করেছিল ইসলামের বিরুদ্ধে। তার প্রাসাদে হিন্দু রমনীগণ স্থান পেয়েছিল। মুর্শিদকুলি খানের শাসনামলে বাংলা বেশীর ভাগ জমিদার ছিল হিন্দু। নবাব আলিবর্দী এবং সিরাজুদ্দৌলার আমলেও অবস্থা একই রূপ ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল জগৎশেটদের মত হিন্দুদের আধিপত্য। পরবর্তিতে এরাই পরিণত হয়েছে মুসলিমদের শত্রু ও ইংরেজদের সহযোগীতে।

বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে ব্যর্থতার কারণে যেমন বিশুদ্ধ ঈমান বাঁচেনি, তেমনি প্রতিষ্ঠা পায়নি বিশুদ্ধ ইসলামী সংস্কৃতি। এরই ফলে অনেক বাঙালি মুসলিমের মাঝে বহু হিন্দুয়ানী সাংস্কৃতিক আচার অক্ষত থেকে যায়। মুসলিম মনে হিন্দু প্রভাব বেঁচে থাকার কারণেই ২১শে ফেব্রেয়ারিতে রড-সিমেন্টে নির্মিত স্তম্ভের পাদদেশে নগ্ন পদে ফুল দিয়ে হিন্দুদের মত পূজা করার সংস্কৃতি দ্রুত প্রসার পায়। তাছাড়া হিন্দু সংস্কৃতির প্রবল প্রকাশ দেখা যায় বাঙালি মুসলিমের বর্ষবরণ ও বসন্তবরণ অনুষ্ঠানে। এমন কি দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকার রিপোর্টার ব্যর্থ হন ঢাকার বর্ষবরণ ও বসন্তবরণ অনুষ্ঠানের সংস্কৃতিকে কলকাতার পূজাপার্বনের সংস্কৃতি থেকে পৃথক করতে। তার কাছে দুটিই অভিন্ন সংস্কৃতি মনে হয়েছে; আর সে অভিন্ন সংস্কৃতিটি হলো হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। অনেক সেক্যুলার বাঙালি মুসলিম অতি গর্বিত এরূপ হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচায়। তারা এটিকে বাঙালি সংস্কৃতির লেবেল লাগায়।

অথচ সংস্কৃতি হলো ব্যক্তির ঈমান ও বেঈমানী বাইরের রূপ। ঈমান বা বেঈমানী দেখা যায়না, কিন্তু দৃশ্যমান হয় সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। তাই সংস্কৃতি যেমন সুস্থ সংস্কৃতি হতে পারে, তেমনি দূষিত অপসংস্কৃতিও হতে পার।  সংস্কৃতির অর্থ শুধু নাচ-গান, পোষাক-পরিচ্ছদ ও শিল্প-সাহিত্য নয়; বরং সংস্কৃতি হলো মানুষ কিভাবে বাঁচে, কিভাবে অন্যকে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আপ্যায়ন জানায়, কিভাবে নিজের স্বপ্ন, দুঃখ, আনন্দ ও মনের ভাবকে প্রকাশ করে, কিভাবে উৎসব ও  ইবাদত করে -এরূপ সবকিছু নিয়েই হলো সংস্কৃতি। এক্ষেত্রে একজন মুসলিম পৌত্তলিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। সে ভিন্নতা না থাকার অর্থ ঈমানের দূষণ বা বিলুপ্তি।

তাই প্রতি বছর ২১শে ফেব্রেয়ারিতে স্তম্ভের পাদদেশে নগ্ন পদে ফুল দিয় শ্রদ্ধা দেয়াতে যা প্রকাশ পায় -সেটি ঈমান নয়, সুস্পষ্ট বেঈমানী। এটি পৌত্তলিক পূজার সংস্কৃতি। এ থেকে প্রকাশ পায়, বাঙালি মুসলিমগণ নামে মুসলিম হলেও তারা ইসলামের আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি বাঙালি মুসলিমের এক বিশাল ব্যর্থতা। বাংলাদেশে অনেকের গরু কুর’বানীতে অনাগ্রহ তো চেতনায় পৌত্তলিকতা বেঁচে থাকার কারণে। অথচ এমনটি আরব মুসলিম দেশগুলিতে দেখা যায় না। কারণ সে দেশগুলিতে ইসলাম প্রচারের শুরুতেই পৌত্তলিক সংষ্কৃতির নির্মূল হয়েছিল পূর্ণ ভাবেই। আর এ সাংস্কৃতিক দূষণ প্রকাশ করে দেয় বাঙালি মুসলিমের মুসলিম হওয়ায় ব্যর্থতা।

 

যারা নিজেদের ইসলামী দলের নেতাকর্মী রূপে দাবী করে, তারাও কুর’আন বুঝার ক্ষেত্রে ও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে তেমন একটানেই। এক্ষেত্র তাদের নিজেদের সামর্থ্যও অতি সীমিত। তাদের ব্যস্ততা রাজনৈতিক বয়ান নিয়ে। তাদের লক্ষ্য যে কোন ভাবে ক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার আগেও যে বহু কাজ বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে করতে হয় -সে কাজে তারা নেই। যেন ভিত না গড়েই তারা ইসলামী রাষ্ট্রের ইমারত গড়তে চান!  এটি তো নিশ্চিত ব্যর্থতার পথ। সাফল্যের পথ তো একমাত্র নবীজী (সা:)’র প্রদর্শিত পথ। এবং নবীজী (সা:)’র পথটি হলো পদে পদে কুর’আন অনুসরণের পথ। সেটি কুর’আন নিজে বুঝা ও অন্যদের বুঝানোর পথ। অথচ সে কাজটি জনগণের স্তরে বাংলার বুকে কোন কালেই হয়নি -না অতীতের মুসলিম শাসনামলে হয়েছে, না আজ হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, যারা কুর’আন বুঝলোই না, তারা সে পথ অনুসরণ করবে কিরূপে? সফলই বা হবে কিরূপে? এ পথ যে নিশ্চিত ব্যর্থতার পথ -তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? আর এ ব্যর্থতা যে জাহান্নামে হাজির করবে -তা নিয়েও কে সন্দেহ থাকে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *