শত্রুশক্তির যুদ্ধ ও ইসলাম বিনাশী নাশকতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

শেষ হয়নি শত্রুর যুদ্ধ

বাংলার বুকে ইসলামের শত্রুশক্তির যুদ্ধ শেষ হয়নি। বরং দিন দিন  তীব্রতর হচ্ছে। যুদ্ধটির শুরু আজ নয়; সূচনা ১৭৫৭ সালে। নবাব সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী কাফের শক্তির গোলাবারুদের যুদ্ধ পলাশীতে শেষ হলেও শেষ হয়নি ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের মূল যুদ্ধটি। সে যুদ্ধটি বরং লাগাতর চলছে দেশের আদর্শিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গণে। দেশের আইন-আদালত থেকে ঔপনিবেশিক শত্রুশক্তি যেরূপ ইসলামের শরিয়তি বিধানকে বিলুপ্ত করেছিল এবং অসম্ভব করেছিল মুসলিম শক্তির উত্থানকে, আজও সেটিই তাদের মূল এজেন্ডা। তাই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হলেও আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সে যুদ্ধটি এখনো শেষ হয়নি। শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে সেটিই ইসলামের শত্রুপক্ষের মূল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তাদের শত্রুর নিষ্ঠাবান দাস সৈনিক রূপে খাটছে ব্রিটিশ প্রনীত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠা বিশাল কর্মীবাহিনী। রাজনৈতিক শক্তি রূপে মুসলিমদের উত্থানকে ইংরেজগণ যেরূপ তাদের ১৯০ বছরের শাসনামলে রুখেছিল এবং দূরে রেখেছিল ইসলামের শরিয়তি বিধানকে – ইসলামের সেরূপ একটি পরাজিত অবস্থা বলবৎ রাখাই তাদের উপর শত্রুপক্ষের পক্ষ থেকে অর্পিত মূল দায়ভার। এ কারণেই পাশ্চাত্যের কাফেরদের ন্যায় তারাও সর্বভাবে ইসলামের বিজয়কে রুখতে চায়। দেশের সেনানীবাস, সিভিল প্রশাসন, বিচার বিভাগ, অফিসার্স ক্লাব ও মন্ত্রীপাড়ার ন্যায় গুরুত্বপূ্র্ণ স্থানগুলি আজও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সুরক্ষিত দ্বীপ। সে সাথে প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রও। সেসব অধিকৃত সামরিক ও প্রশাসনিক ঘাঁটিতে বাংলার সাধারণ জনগণের মুসলিম রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি দেখতে পাওয়া যায় না। সে মহলে দেশী বিষয় বিদেশী মনে হয়। কারো কারো জীবনে নামাজ-রোযা থাকলেও সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ নবীর যুগের ইসলামের -যাতে রয়েছে শরিয়ত, খেলাফত, জিহাদ এবং ভাষা ও বর্ণের নামে গড়ে উঠা দেয়াল ভাঙ্গার বিধান। ইংরেজদের প্রস্থানের বহু বছর পরও তাই বাংলার মুসলিম ভূমিতে আজও বহাল তবিয়তে বেচেঁ আছে তাদের প্রতিষ্ঠিত দেহব্যবসা, জুয়া, সূদী ব্যাংকের ন্যায় নানারূপ হারাম কর্ম। রাজনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে মহান আল্লাহতায়ালা ও আখেরাতের ভয়কে ভূলিয়ে দেয়াই ইসলামবিরোধী এ দখলদার দেশী শক্তির মূল কাজ। ফলে শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত শরিয়তি বিধানকে পরাজিত রাখতে ও ইসলামপন্থিরদের হত্যায় বিদেশী কাফের শক্তিকে ময়দানে নামতে হয় না। সে কাজটি নিষ্ঠুরতার সাথে সমাধা করে পাশ্চত্য-পূজারী বাঙালীগণ। ঢাকার শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যার ন্যায় নিষ্ঠুর গণহত্যাগুলিতেও তাই কোন বিদেশী কাফেরকে  নামতে হয়নি। একাত্তরের গণহত্যাও ছিল দিল্লি, মস্কো, চীন ও পাশ্চাত্যের অনুসারি ইসলামের শত্রুপক্ষের নিজস্ব কাণ্ড –যাদের হাতে মারা গিয়েছিল অগণিত বাঙালী ও অবাঙালী মুসলিম।

কোন মুসলিম ভূমিতে কাফের শক্তির বিজয়ের নাশকতাটি এমনিতেই বিশাল। কিন্তু সে অধিকৃতি যদি ১৯০ বছরের হয় তবে সে নাশকতাটি ভয়ংকর রূপ নেয়। বাঙালী মুসলিমের জীবনে ক্ষতির সে অংকটি তাই বিশাল। এ কারণেই নবীজী (সা:)’র যুগের কোরআনী ইসলাম থেকে বাঙালী মুসলিমদের অবস্থানটি বহু দূরে। নবীজী (সা:)’র ইসলামে কাফের শক্তির অধিকৃতির বিরুদ্ধে জিহাদ ছিল, শরিয়তের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ছিল এবং নানা বর্ণ ও নানা ভাষার মুসলিমদের মাঝে সীসাঢালা প্রাচীরসম এসকতা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সে ইসলামের প্রতিষ্ঠা চিহ্নিত হয় সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ রূপে। নবীজী(সা:)’র প্রবর্তিত সে কোরআনী ইসলামের তারা নির্মূল চায়। তাদের ইচ্ছা, মুসলিম বেঁচে থাক নবীজী (সা:)’র ইসলামকে বাদ দিয়ে। এবং গ্রহণ করুক জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, ফেরকাবাদ, স্বৈরাচার ও সেক্যুলারিজমের ন্যায়  নানারূপ পথভ্রষ্টতা। ইসলামের যে বিকৃত রূপকে তারা মেনে নিতে বলছে তাতে রয়েছে শরিয়তের বদলে ব্রিটিশদের প্রণীত কুফরি আইন। তাতে আছে সূদী ব্যাংক, দেহব্যবসা, সূদ–ঘুষ, মদজুয়া, বেপর্দা ও নাচগানের ন্যায় নানারূপ কবিরা গুনাহ ও পাপাচারের আইনগত বৈধতা। প্রকৃত ইসলামের সাথে সম্পর্কচ্যুৎ এমন ভণ্ড মুসলিম গড়ে তোলার লক্ষ্যে অতীতে তারা যেমন মাদ্রাস গড়েছে, তেমনি গড়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ও। সে সাথে ময়দানে নামিয়েছে মুসলিম নামধারী দালাল শ্রেণীর সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী। মুসলিম ভূমিতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার লক্ষ লক্ষ সৈনিক পেয়েছে বস্তুত ইসলামি চেতনা বিনাশী এরূপ প্রকল্প সফল হওয়ার ফলে। দুর্বৃত্তিতে বাংলাদেশ যেরূপ বার বার বিশ্বরেকর্ড গড়েছে এবং আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা যেরূপ অসম্ভব হয়েছে -তা মূলতঃ তাদের প্রবর্তীত সে বিকৃত ইসলাম ও মানসিক গোলামদের শাসন দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার কারণে।

 

শত্রুর যুদ্ধ কখনোই হয়না

ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে শত্রুর যুদ্ধ কখনোই শেষ হয়না; অস্ত্র ও কৌশল পাল্টায় মাত্র। সময় ও সুযোগ বুঝে তারা গড়ে নতুন কোয়ালিশন; এবং সংগ্রহ করে নতুন সৈনিক। তাই শেষ হয়নি ইসলাম নির্মূলে শয়তান ও তার অনুসারিদের মূল যুদ্ধটিও। বাংলাদেশ তো তাদর হাতেই অধিকৃত। অধিকৃত এ ভূমিতে তাই শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, সিরাতুল মুস্তাকীমে চলা, বিভক্তির দেয়াল ভাঙ্গা এবং সে পবিত্র লক্ষ্যে জিহাদে লিপ্ত হওয়াটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেটি যেমন কাফের ব্রিটিশদের আমলে ছিল, তেমনি আজও। এমন অধিকৃত দেশে বাক স্বাধীনতা, লেখালেখীর স্বাধীনতা, ধর্মশিক্ষা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতার দাবি করাটাই সন্ত্রাস। স্বাধীনতা নাই সিরাতুল মুস্তাকীমে চলার। সিরাতুল মুস্তাকীমে চলার পথ তো শরিয়তের প্রতিষ্ঠাসহ ইসলামের পূর্ণ বিজয় ও পূর্ণ ইসলাম পালনের পথ। সেটি তো আল্লাহর জমিনে তাঁর দ্বীনের বিজয়ে অর্থ, শ্রম, মেধা ও প্রাণদানের পথ। গভীর জঙ্গলে কি মহাসড়ক গড়া যায়? সে জন্য তো জঙ্গল কেটে পথ করতে হয়। সিরাতুল মুস্তাকীম গড়তেও তেমনি অপরিহার্য হলো কুফরি শাসনের নির্মূল। অথচ অন্ধকারের পূজারীগণ সেটি হতে দিতে রাজী নয়। সমাজের নমরুদ-ফিরাউন-আবু জেহলগণ সর্বশক্তি দিয়ে সে কাজে বাধা দেয়। অথচ জাহিলিয়াতের সে অন্ধকার না সরালে কি ইসলাম পালন হয়? সে যুগের জাহিলিয়াতে ছিল পৌত্তলিকতা, অজ্ঞতা, নানারূপ দুবৃত্তি ও ট্রাইবাইলিজম। আর আজকের জাহিলিয়াতটি হলো জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদ ও সেক্যুলারিজমের। ইসলামের নির্মূলে এ নব্য জাহিলিয়াত আদিম জাহিলিয়াতের চেয়ে কম যুদ্ধাংদেহী ও কম নৃশংস নয়। প্রতি যুগেই ইসলাম পালনের পথটি তাই জাহিলিয়াত নির্মূলের পথ; তথা লাগাতর জিহাদের পথ। যার জীবনে সে জিহাদ নাই, বুঝতে হবে সে ব্যক্তির জীবনে কোরআনী ইসলামও নাই। মুসলিম জীবনে এরূপ জিহাদ না থাকলে সে মুসলিমদের রাষ্ট্রে কি ইসলাম বাঁচে? সে রাষ্ট্রে বরং প্রবল প্লাবন আসে জাহিলিয়াতের; এবং সেসাথে নানারূপ দুর্বৃত্তি ও পাপাচারের। বাংলাদেশ হলো তারই নমুনা। বাংলাদেশের একটি থানায় যত মুসলিমের বাস নবীজী (সাঃ)র  প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রে সে সংখ্যক মুসলিম ছিল না। কিন্তু জাহিলিয়াত ও দুর্বৃত্তির বিরুদ্ধে মহান নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের জীবনে আমৃত্যু জিহাদ এসেছিল। ফলে সমগ্র আরব ভূমি থেকে নির্মূল হয়েছিল দুর্বৃত্তদের আধিপত্য; এবং দেশে দেশে বিজয়ী শক্তিরূপে আাবির্ভুত হয়েছিল ইসলাম। তখন জনগণ পেয়েছিল সিরাতুল মুস্তাকীমে চলার স্বাধীনতা। অথচ নমরুদ, ফিরাউন ও আবু জেহলদের যুগে সে স্বাধীনতা ছিল না। অজ্ঞতার বিরুদ্ধে নবীদের আওয়াজ তোলাটিও তখন হত্যাযোগ্য সন্ত্রাস গণ্য হত। একই অবস্থা বাংলাদেশেও। দেশটির স্বৈরাচারি শাসকদের কাছে নবীদের সে পবিত্র সূন্নত নিয়ে বাঁচাটি গণ্য হয় সন্ত্রাস রূপে।

 

সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি প্রসঙ্গে

মানবের উপর অর্পিত মিশনটি স্রেফ নামায-রোযা এবং হজ-যাকাত পালন নয়। স্রেফ তাসবিহও পাঠ নয়। বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টিই  মহান আল্লাহতায়ালার নামে তাসবিহ পাঠ করে। “ইউসাব্বিহু লিল্লাহি মা ফিস সামাওয়াতি ওয়া মা ফিল আরদি” এবং “সাব্বাহা লিল্লাহি মা ফিস সামাওয়াতি ওয়া মা ফিল আরদি” –পবিত্র কোরআনে এরূপ বাক্য বার বার ব্যবহার করে মহান আল্লাহতায়ালা সে সত্যটি বার বার ব্যক্ত করেছেন। তাই স্রেফ তাসবিহ পাঠের মাধ্যমে পাহাড়-পর্বত, জন্তু-জানোয়ার, কীটপতঙ্গ, গাছপালা ও উদ্ভিদ থেকে কোন মানব সন্তানই শ্রেষ্ঠতর হতে পারে না। মানবের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সে পথটি ভিন্নতর। সেটি হলো, পৃথিবী জুড়ে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তের  প্রতিষ্ঠা। সেটি পৃথিবী জুড়ে ইসলামের বিজয়ে আত্মনিয়োগ। ঈমানদারের জীবনে মূল মিশনটি তাই মহান আল্লাহতায়ালার ভিশনের সাথে একাত্ম হওয়া। পবিত্র কোরআনে বর্নিত মহান আল্লাহতায়ালার সে ভিশনটি হলো, “লি’ইয়ুযহিরাহু আলা দ্দীনে কুল্লিহী” অর্থঃ “সকল দ্বীনের উপর ইসলামের বিজয়”। সে নির্ধারিত মিশন পালনে একজন ব্যক্তি কতটা সফল হলো, তাতেই নির্ধারিত হয় জন্তু-জানোয়ার, কীটপতঙ্গ,গাছপালা ও উদ্ভিদ থেকে তার শ্রেষ্ঠতর মর্যাদা। দায়িত্ব এখানে খেলাফতের।

মানবসৃষ্টির প্রকৃত মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তাই মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা বা প্রতিনিধি রূপে দায়িত্ব  পালনের মাঝে। সাহাবাগণ মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করতে পেরছিলেন খেলাফতের সে গুরু দায়িত্বটি সুষ্ঠভাবে পালনের মাধ্যমে। সে কাজে তারা নিজেদের জীবনের শ্রেষ্ঠতর অর্জন ব্যয় করেছেন; শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবী শহীদ হয়েছেন। ব্যক্তির প্রতিটি সামর্থ্য তা অর্থনৈতিক, দৈহীক বা বুদ্ধিবৃত্তিক হোক –সবই মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া আমানত। ব্যক্তির প্রকৃত ঈমানদারি হলো, মহামূল্য সে আমানতকে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয়ে বিনিয়োগ করবে। নইলে ভয়ানক খয়ানত হয় যা আযাব ডেকে আনে। সাহাবাদের সে বিনিয়োগটি ছিল বিশাল; তাতে ইসলামের অনুসারিগণ বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছিল। অথচ সেরূপ বিনিয়োগে আজকের মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বেড়েছে ইসলামের পরাজয়। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে আমানতের বিনিয়োগ হয়েছে মূলতঃ জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, সেক্যুলারিজম ও স্বৈরাচারের ন্যায় নানারূপ  ভ্রষ্টতাকে বিজয়ী করতে। বিনিয়োগ সীমিত রেখেছে স্রেফ নামায-রোযা ও  তাসবিহ পাঠে। অথচ তাসবিহ পাঠ যত লক্ষ বারই হোক -তাতে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া বিশাল সামর্থ্যের বিনিয়োগ ঘটেনা। ফলে শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশও ঘটে না। গবাদী পশুর মিশন শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নয়,খলিফা হওয়াও নয়। সেটি তো কৃষকের হাল টানা, দুধ দেয়া, পরিধেয় জুতা বা খাবার টেবিলে কোর্মা-কাবাব রূপে হাজির হওয়া। পশুগণ সে মিশন পালনে ব্যর্থ হচ্ছে না। কিন্তু মানুষ ব্যর্থ হচ্ছে তার উপর অর্পিত মিশন পালনে। কাফের ও মুনাফিকগণ এজন্যই পশুরও অধম। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা সে সত্যটিও তুলে ধরেছেন। বলা হয়েছে, “বাল হুম আদাল’ অর্থঃ তারা (পশুর) চেয়েও নিকৃষ্ট।  পশু, কীটপতঙ্গ বা গাছপালা তাই জাহান্নামে যাবে না, কিন্তু জাহান্নামের খোরাক হবে অবাধ্য ও বিদ্রোহী মানব।


বিশাল বিজয় শত্রুপক্ষের

শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি উগ্রবাদ নয়, সন্ত্রাসও নয়। এটি নামায-রোযার ন্যায় ইসলামের অতি অপরিহার্য বিষয়। নামায-রোযা ছাড়া যেমন মুসলিম হওয়া যায় না, তেমনি ইসলামের বিজয় ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় জান ও মালের বিনিয়োগ ছাড়াও মুসলিম থাকা যায় না। রাষ্ট্রটি মুসলিম না অমুসলিমের সেটি বুঝা যায় সে রাষ্ট্রে শাসকের অঙ্গীকার ও আদালতে আইনের স্বরূপ দেখে। তাই ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতের পরিচয় ছিল ব্রিটিশ ভারত, মুসলিম ভারত রূপে নয় –যদিও সে সময় ব্রিটশদের সংখ্যা প্রতি লাখে একজনও ছিল না। সেটিই স্বাভাবিক ছিল। অপর দিকে বাংলার বুকে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল শরিয়তী আইনের শাসন। অথচ সে সময় দেশটির মুসলিম জনসংখ্যা আজকের ন্যায় শতকরা ৯১ ভাগ ছিল না। এমনকি সিকিভাগও ছিল না। মুসলিম জনসংখ্যা কম হলেও খিলজী আমল, সুলতানী আমল, মোঘল আমল বা নবাবী আমলে ছিল শরিয়তী আইন। ফলে পরিচয় পায় মুসলিম আমল রূপে। ভারত থেকে শরিয়তি আইন বিলুপ্ত হয় ব্রিটিশ কাফেরদের শাসন প্রতিষ্ঠার পর। ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে অধিকৃত হওয়ার এটিই হলো সবচেয়ে বড় বিপদ। তখন অসম্ভব হয় ইসলামের মৌল বিধানগুলি মেনে চলা।

ঔপনিবেশিক কাফেরদের শাসন শেষ হয়েছে। কিন্তু শেষ হয়নি তাদের গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইসলামের শত্রুপক্ষের শাসন। ঔপনিবেশিক আমলের সেক্যুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারণে ইসলামের শত্রু বিপুল ভাবে বেড়েছে নিজ ভূমিতে। অতীতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রোধে মুসলিম জনগণের পক্ষ থেকে কোনরূপ বিরোধীতা হয়নি। মুসলিম কি কখনো নামায-রোযার প্রতিষ্ঠার বিরোধীতায় রাস্তায় নামে? তাতে কি তার ঈমান থাকে? তেমনি শরিয়তি আইনের প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা কি কোন মুসলিমের নীতি হতে পারে? অথচ সেটিই হচ্ছে বাংলাদেশে! শরিয়তি আইনের নির্মূলে এক কালে যা ছিল সাম্রাজ্যবাদি শাসকদের নীতি, সে অভিন্ন নীতি নিয়ে দেশ শাসন করছে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশের স্বৈরাচারি শাসকগণ। নিজেদের মুসলিম রূপে পরিচয় দিলেও দেশের রাজনীতি, আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে তারা ইসলামের জন্য সামান্যতম স্থানও ছেড়ে দিতে তারা রাজী নয়। বরং কাফেরদের অর্থ, অস্ত্র ও এজেন্ডা নিয়ে দেশে-বিদেশে যুদ্ধ করতে রাজি। বাংলার ন্যায় মুসলিম ভূমি এরূপ ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে অধিকৃত হওয়ায় কঠিন হয়ে পড়ছে জান্নাতের পথে চলা।

বাংলাদেশে ইসলামের শত্রুপক্ষের বিজয়টি বিশাল। ইসলামের বিজয় বা উত্থানকে তারা সফল ভাবেই রুখতে পেরেছে। এবং অব্যাহত রাখতে পেরেছে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত কুফরি আইনের শাসন। দেশটির জনসংখ্যার শতকরা ৯১ ভাগ নিজেদেরকে মুসলিম রূপে দাবী করলে কি হবে, ধর্মের নামে দেশে যা পালিত হয় তার সাথে নবীজী (সা:)’র ইসলামের মিলের চেয়ে অমিলই প্রচুর। দেশটিতে আজও পৌত্তলিকতা বেঁচে আছে তার আদিম সনাতন পরিচয় নিয়ে। কিন্তু এ মুসলিম ভূমিতে নবীজী (সা:)’র ইসলাম তার পরিচয়টি হারিয়ে ফেলেছে বহু আগেই। এবং বেঁচে নাই কোরআনে বর্নিত জিহাদ, শরিয়ত, হদুদ ও খেলাফতের ধারণা। ফলে পবিত্র কোরআনের সনাতন ইসলাম বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী অপরিচিত। ইসলাম থেকে দূরে সরা জনগণ অতি আনন্দ চিত্তে বরণ করে নিয়েছে বর্ষবরণ, বসন্তবরণ, মঙ্গল প্রদীপসহ নানারূপ পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে। লক্ষ লক্ষ মুসলিম সন্তান হাজির হচ্ছে এমন কি পূজা মন্ডপে।

ইসলামের এ বি‌শাল পরাজয় নিয়ে দেশের লক্ষ লক্ষ আলেমও নিরব, যেন এ পরাজয়কে নিশ্চুপ মেনে নেয়া ছাড়া তাদেরও কিছু করার নাই। মসজিদ ও মাদ্রাসায় চাকুরির মাঝে সীমিত তাদের জীবন। কোর’আনকে তারা তেলাওয়াত করতে পারে -সে সামর্থ্যকেই তারা সামান্য মূল্যে ঘরে ঘরে ও মসজিদে মসজিদে বিক্রি করে বেড়াচ্ছে। শরিয়তী বিধানকে যেভাবে আঁস্তাকুড়ে ফেলা হয়েছে -তা নিয়েও এসব আলেমদের মাঝে সামান্যতম মাতম নাই। শরিয়তের পুণঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে নেই সামান্যতম আগ্রহ। শরিয়ত পালন ছাড়া যে ইসলাম পালন হয়না -সে হুশও কি তাদের মাঝে বেঁচে আছে? ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে দেশ অধিকৃত হলে তখন জিহাদ আর ফরজে কেফায়া থাকে না, ফরজে আইনে পরিণত হয়। প্রতিটি মুসলিমকে তখন লড়াইয়ে নামতে হয়। তাদের মাঝে কতটুকু বেঁচে আছে ইসলামের সে মৌলিক জ্ঞানটুকু? ফলে ইসলামের শত্রুশক্তির অধিকৃতি মোচনের কোন প্রচেষ্ঠাও নেই। ইসলামকে তারা নিজেদের পছন্দ মত বানিয়ে নিয়েছে; এবং নিজেরা যা করছে -সেটিকেই তারা খাঁটি ইসলাম বলছে। ঘরে ঘরে পবিত্র কোর’আনকে রাখা হয় স্রেফ না বুঝে তেলাওয়াতের জন্য; মহান আল্লাহতায়ালা কি বলেছেন সেটি জানা বা অনুসরণের জন্য নয়।

নবীজী (সা:)’র যুগে ইসলাম বলতে যা বুঝাতো তাতে ছিল রাষ্ট্রের উপর একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব; রাজা, জনগণ বা পার্লামেন্টের নয়। শাসকের পরিচয় ছিল নবীজী (সা:)’র খলিফা বা প্রতিনিধি রূপে; অধিকার ছিল না জনগণের উপর নিজের খেয়াল-খুশিকে চাপিয়ে দেয়ার। আইনের উৎস ছিল পবিত্র কোর’আন ও সূন্নাহ; ফলে দেশের আদালত কখনোই দেশের শাসকদের বা নির্বাচিত সদস্যদের প্রণীত আইনের হাতে অধিকৃত হয়নি। সূদ, ঘুষ, মদ, জুয়া সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি ও দেহব্যবসা চিহ্নিত হতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ রূপে। ফলে রাষ্ট্রের বুক থেকে সে পাপ ও পাপাচারের পথগুলোও নির্মূল হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশ অধিকৃত ভয়ানক অপরাধীদের হাতে। এদের চরিত্র, এরা শুধু স্বৈরাচারি ও চরম দুর্বৃত্তই নয়; ইসলামের প্রতিষ্ঠা প্রতিরোধে এরা আপোষহীনও। ফলে সরকার ও দখলদার রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক এজেন্ডাও সুস্পষ্ট। দেশের ক্রমবর্ধমান গুম-খুন, চুরি –ডাকাতি, শেয়ারমার্কেট লুট, ব্যাংক লুট নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তারা যেহেতু নিজেরাই অপরাধী, অপরাধীদের নির্মূল তাদের লক্ষ্য নয়। তারা চায় নিজেদের রাজনৈতিক শত্রুদের নির্মূল ও গদীর দীর্ঘায়ু। তারা নির্মূল করেত চায় তাদের যারা চায় ইসলামের বিজয়। নির্মূলের সে কাজটি সহজ করতেই তারা দেশের সকল ইসলাম বিরোধী ব্যক্তি, দল ও দুর্বৃত্তদের পক্ষে টেনেছে। এসব দুর্বৃত্তদের কেউ কেউ খুনের অপরাধে আদালতে প্রাণদণ্ড পেলেও দেশের সরকার ও প্রেসিডেন্টের কাজ হয়েছে তাদের প্রাণদণ্ডকে মাফ করে দেয়া।

 

শাসনতন্ত্রে শয়তানের এজেন্ডা

রাজা, জনগণ বা পার্লামেন্টের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারি হওয়ার ধারণা পবিত্র কোর’আনে নাই। তাই সেরূপ কোন ধারণার অস্তিত্ব নবীজী (সা:)’র যুগে ছিল না। এরূপ ধারণাই কুফরি। শাসকগণ কাজ করতেন নবীজী(সা:)’র খলিফা রূপে। সার্বভৌমত্ব দাবী করার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। সে কাজ কাফেরদের। দেশে দেশে সেরূপ যুদ্ধ বস্তুত শয়তানের খলিফাদের। অথচ তেমন একটি যুদ্ধ ঘোষিত হয়েছে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে। এভাবে শাসনতন্ত্র ব্যাহৃত হচ্ছে শয়তানের এজেন্ডা পূরণে। নবীজী (সা:)’র আমলে ইবাদত বলতে বুঝাতো নামায-রোযা, হজ-যাকাত পালনের সাথে সাথে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং নবীজী (সা:)’র সূন্নতের পূর্ণ অনুসরণ। ফলে মু’মিনের জীবনে অনিবার্য রূপে দেখা দিত ইসলামের বিজয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ। তখন শুরু হতো কোর’আনে নাযিলকৃত মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র বানী আত্মস্থ করার ধ্যানমগ্নতা; ঈমানদারের প্রয়াস তাই স্রেফ তেলাওয়াতে সীমিত ছিল না। সে সাথে ছিল কোরআনের বানীকে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়ার তাড়াহুড়া। ঘরে ঘরে ছিল নিজ জান ও মাল নিয়ে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক জিহাদের প্রস্তুতি। সেসব জিহাদে সাহাবগণ শুধু সঞ্চয়ের সিংহভাগই বিলিয়ে দেননি, শহীদও হয়েছেন। মুসলিমগণ তো সে পথ ধরেই বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে সনাতন ইসলামকে তার বিশুদ্ধ পরিচয় নিয়ে বাঁচতে দেয়া হয়নি। নবীজী (সা:)’র ইসলামে যেরূপ শরিয়ত, খেলাফত, জিহাদ ও অন্য ভাষা বা অন্য বর্ণের মুসলিমদের সাথে একাত্ম হওয়ার আকুল আগ্রহ ছিল, বাঙালী মুসলিমের ইসলামে তার কোনটাই নাই। সে সনাতন ইসলাম ছেড়েছে দেশের আলেমগণও। এজন্যই রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি অঙ্গণে ইসলামের এ পরাজয় নিয়ে তাদের মাঝে কোন মাতম নেই।

বাংলাদেশে ইসলাম বেঁচে আছে মুষ্টিমেয় লোকের টুপি-দাঁড়ি, দোয়া-দরুদ ও নামায-রোযার মাঝে। সবচেয়ে বড় নেককর্ম রূপে গণ্য হয় কোর’আন পাঠ, দরুদ পাঠ ও মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ। সে তালিকায় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূল যেমন নাই, তেমনি নাই শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোন আগ্রহ। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠতর হওয়ার কারণ, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় ও অন্যায়ের নির্মূলে আত্মনিয়োগ। -(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১১০)। অথচ পবিত্র কোর’আনের সে কথা ভূলে তারা বাঁচছে সম্পূর্ণ বিপরীত মিশন নিয়ে। সেটি মিথ্যা ও অন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং সত্য ও ন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। তেমন একটি মিশনের কারণেই বাংলাদেশ দূর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার বিশ্বরেকর্ড গড়েছে। তাদের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে কোর’আন বুঝা ও নবী-আদর্শের প্রতিষ্ঠা। মহান আল্লাহতায়ালাকে মুখে প্রভু রূপে স্বীকার করা হলেও রাষ্ট্রের উপর তাঁর কোন প্রভুত্ব বা সার্বভৌমত্ব নাই। তাঁর সে সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোন আগ্রহ নাই। আইন-আদালতে প্রবেশধাধিকার নাই শরিয়তী আইনের। সাহাবায়ে কেরামের যুগে সেটি কি ভাবা যেত? সময় শয়তানী শক্তি কি মুসলিম ভূমিতে এরূপ বিজয়ের কথা কল্পনা করতে পেরেছে? অথচ আজ আইনগত বৈধতা পেয়েছে পতিতাদের দেহব্যবসা। বৈধতা পেয়েছে সূদের ব্যবসা, মদের ব্যবসা ও জুয়া। নাচগানের অশ্লীল আসর জমানোও অপরাধ নয়। পাপাচারীদের সারাক্ষণ নিরাপত্তা দেয় জনগণের অর্থে প্রতিপালিত পুলিশ। দেশে রাজনীতিতে পূর্ণ আজাদী রয়েছে নাস্তিক, সোসালিস্ট, সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট –তথা সকল প্রকার ইসলামবিরোধীদের। কিন্তু সন্ত্রাস রূপে চিহ্নিত হয় মহান আল্লাহতায়ালার আইনের প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে ময়দানে নামা। ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডকে বলা হয় আইনের শাসন। সেরূপ নির্মূলকরণকে বৈধতা দিতে আরো নতুন আইন প্রণোয়ন করা হচ্ছে। আইন প্রণোয়নের মূল লক্ষ্য, এখানে স্বৈরাচারি সরকারকে নিরাপত্তা দেয়া, সে সাথে ইসলামের প্রতিষ্ঠাকে প্রতিরোধ করা। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের কোন ভাবনা নাই। ফিরাউন, নমরুদ, হালাকু-চেঙ্গিজ ও হিটলারের আমলেও একই রূপ আইনের শাসন ছিল। সে আইনে সরকার বিরোধীদের গ্রেফতার করা, নির্যাতন করা ও হত্যা করা আইনসিদ্ধ গণ্য হত। অনুরূপ অবস্থা চেপে বসেছে বাংলাদেশের বুকেও। দেশের পুলিশ, আদালত ও প্রশাসনের কাজ হয়েছে সে আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। সরকারি দলের দুর্বৃত্তেদর হাতে লুণ্ঠিত হচ্ছে ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা, ধর্ষিতা হচ্ছে হাজার হাজার মহিলা এবং নিহত হচ্ছে শত শত মানুষ। গুম হচ্ছে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী। কিন্তু এরূপ ভয়ানক অপরাধের নায়কদের কি গ্রেফতার করা হয়েছে? দেয়া হয়েছে কি শাস্তি। অপরাধের নায়ক যেহেতু সরকারি দলের নেতাকর্মী, তাদের গ্রেফতারের ক্ষমতা পুলিশের নাই। কিন্তু  হত্যাযোগ্য অপরাধ হলো ইসলামের পক্ষে রাস্তায় বিক্ষোভে যোগ দেয়া বা সত্য কথা বলা। নিরস্ত্র মানুষের বিক্ষোভ দমনে ২০১৩ সালের ৫ মে’র রাতে শাপলা চত্ত্বরে তাই সেনাবাহিনী নামানো হয়েছিল এবং হেফাজতে ইসলামের শত শত নিরীহ মানুষকে লাশ করে গায়েব করা হয়েছিল।


দখলদারী শয়তানপন্থীদের

ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চলের নামে মানব জাতি শত শত রাষ্ট্র ও গোত্রে বিভক্ত হলেও মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আসল বিভাজনটি মূলতঃ দ্বি-ভাগে। এক). আনসারুল্লাহ অর্থাৎ মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্যকারী দল, দুই). আনসারুশ শায়তান অর্থাৎ শয়তানের সাহায্যকারী দল। মহান আল্লাহতায়ালার বিচারে তৃতীয় কোন দল নাই। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্যকারী হয়ে যাওয়া। লক্ষ্য, ইসলামের বিজয়। মুসলিম নর-নারীর উপর সেটি ফরজ। সে লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশ এসেছে পবিত্র কোরআনের সুরা সা’ফ’য়ের ১৪ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর আনসার (সাহায্যকারী) হয়ে যাও”। মুসলিম হওয়ার অর্থ তাই মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্যকারী হওয়া। এ হুকুমের অবাধ্যতা হলো সুস্পষ্ট কুফরী। মহান আল্লাহতায়ালা সাহায্যকারী  হওয়ার অর্থ শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত আদায় নয়; বরং তাঁর  ভিশন বা ইচ্ছা পূরণে সাহায্যকারি হয়ে যাওয়া। নবীজীবনের এটিই তো মূল শিক্ষা। সাহাবায়ে কেরাম তো নবী জীবনের সে শিক্ষাকেই জীবনের মিশন বানিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে বিজয়ী হয়েছিল ইসলাম; এবং  প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল শরিয়ত। যারা মহান আল্লাহতায়ালা সাহায্যকারি  হতে ব্যর্থ, তাদের সামনে শয়তানের সাহায্যকারি হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাদের নামায-রোযা ও হজ-যাকাতে তখন মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন বিজয়ী হয় না। আর তারই উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশে মসজিদ, মাদ্রাসা ও নামাজীর সংখ্যা বাড়লেও তাতে ইসলামের বিজয় না বেড়ে দাপট বেড়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষের। সরকার পরিণত হয়েছে শয়তানের সাহায্যকারীতে। সহযোগিতা বাড়ছে ভারতসহ বিশ্বের তাবত কাফের শক্তির সাথে।

যারা মহান আল্লাহতায়ালার উপর বিশ্বাসী তারা আত্মসমর্পণ করে তাঁর প্রতিটি হুকুমের কাছে। এ আত্মসমর্পণ নিয়ে তারা কোন রূপ দ্বিধাদ্বন্দে ভোগে না। আনসারুল্লাহ হওয়ার কোর’আনী হুকুমটি তারা শুধু পাঠই করে  না, নিজ জীবনের মূল মিশনেও পরিণত করে। অপর দিকে যারা মহান আল্লাহতায়ালাতে অবিশ্বাসী, তাদের আগ্রহ থাকে না মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্যকারি হতে। বরং সে হুকুমের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহী হয় ও যুদ্ধে নামে। পবিত্র কোর’আনে এরাই চিহ্নিত হয়েছে কাফের রূপে। কাফেরদের এ বিদ্রোহে কোন কপটতা বা প্রতারণা নাই। অথচ সে কপটতা বা প্রতারণা ধরা পড়ে মুনাফিকদের জীবনে। মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়া সত্ত্বেও মুনাফিকদের যুদ্ধটি মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন ও তাঁর শরিয়তের বিরুদ্ধে। পবিত্র কোর’আনে এ বিষয়গুলো নিয়ে বার বার আলোচনা হয়েছে –যাতে মানুষ তার মৃত্যুর পূর্বে কোন দলে অবস্থান সেটি জানতে ভূল না করে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে শত্রুতায় ও নাশকতায় মুনাফিকদের জুড়ি নাই। ইসলামের বিজয় তাদের কাছে অসহ্য। নবীজীর যুগে এরাই নব্য মুসলিম রাষ্ট্রের নির্মূলে কাফের ও ইহুদীদের সাথে কোয়ালিশন গড়েছিল। প্রতি মুসলিম দেশে শয়তানের সাহায্যকারিদের সেটিই সনাতন নীতি। সে অভিন্ন নীতি বাংলাদেশেও। তবে পার্থক্য হলো, মদিনার মুনাফিকগণ ছিল পরাজিত। অথচ বাংলাদেশে এরা হলো বিজয়ী। ফলে মদিনার মুনাফিকদের ন্যায় ইসলামের শত্রুপক্ষ তথা কাফেরদের সাথে তারা গোপনে জোট বাঁধে না। তারা সেটি প্রকাশ্যেই করে। নিজেদেরকে আনসারুল্লাহ  বা ইসলামের পক্ষের শক্তি রূপেও তারা দাবী করে না। শরিয়তের প্রতিষ্ঠা প্রতিরোধ ও ইসলামের পক্ষের শক্তির নির্মূল যে তাদের রাজনীতির প্রধানতম লক্ষ্য -সেটিও তারা খোলাখোলি বলে। তাদের কারণেই দেশটিতে ইসলামের বিজয় ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রুখতে কোন কাফের শক্তিকে ময়দানে নামতে হচ্ছে না। সেটি তারা নিজেরাই করছে। প্রতিটি মুসলিম দেশে এরাই ইসলাম ও মুসলিমের ঘরের শত্রু। নিজেদের মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়ার যে ভণ্ডামী -সে জন্য তাদের জাহান্নামের শাস্তিটা হবে কাফেরদের চেয়েও অধীক। পবিত্র কোরআনে তাই বলা হয়েছে, এরূপ মুনাফিকদের অবস্থান হবে জাহান্নামের সবচেয়ে নীচের স্তরে।

মহান নবীজী (সা:)’র যুগে এরূপ নিকৃষ্ট জীব তথা মুনাফিকদের সংখ্যা নগন্য ছিল না। ওহুদের যুদ্ধের সময় সে সংখ্যা ছিল প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ। সে পরিসংখ্যানটি ধরা পড়ে তখন যখন নবীজী (সা:) মাত্র এক হাজার সৈন্য নিয়ে মদিনা থেকে ওহুদের যুদ্ধে বের হন। তখন মুনাফিকদের ৩০০ জন সে বাহনী থেকে বেরিয়ে যায়। মুনাফিকদের চেনা ও আলাদা করার ব্যাপারে জিহাদ এভাবেই ছাঁকুনীর কাজ করে। এসব মুনাফিকগণ নবীজী (সা:)’র পিছনে নামায পড়তো এবং রোযা, হজ্ব, ওমরাহও পালন করতো। কিন্তু গোপনে গোপনে এরাই ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিনাশে ইহুদী ও কাফেরদের সাথে কোয়ালিশন গড়েছিল। এমন মুনাফিক আজও বেঁচে আছে প্রতিটি মুসলিম দেশে, এবং বিশাল সংখ্যা নিয়ে।  নবীজী (সা:)’র যুগে সংখ্যায় কম ও পরাজিত হওয়ায় তারা লুকিয়ে লুকিয়ে ষড়যন্ত্র করতো। কিন্তু বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে তারা সংখ্যায় বিশাল, সে সাথে বিপুল ভাবে বিজয়ীও। ইসলামের বিরুদ্ধে এরা এতটাই উগ্র ও উদ্ধত যে ইসলামের শত্রুপক্ষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা প্রকাশ্যে যুদ্ধে নামে। বঙ্গীয় এ ভূমিতে তাদেরকে ১৭৫৭’য়ে দেখা গেছে ইংরেজদের সাথে; ১৯৭১’য়ে দেখা গেছে ভারতীয়দের সাথে। আজ দেখা যায় মুসলিম বিরোধী আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের সাথে। নবীজী (সা:)’র যুগে এরূপ প্রকাশ্যে যুদ্ধ নামার সাহস মুনাফিকগণ পায়নি।

 

সংকটে পরকালীন মুক্তি

ইসলামের যে শত্রুপক্ষের হাতে বাংলাদেশ আজ অধিকৃত, তারা দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, সংবিধান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সেনাবাহিনী ও আইন-আদালতের ন্যায় অঙ্গণে ইসলাম ও ইসলামপন্থিদের জন্য সামান্যতম স্থান ছেড়ে  দিতে রাজী নয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একমাত্র তাদেরই স্থান দেয়, যারা সমাজে পরিচিত মুর্তিপূজারী কাফের, নাস্তিক, সেক্যুলারিস্ট ও সোসালিস্ট রূপে। তাদের মনের ভূবনের সবটুকু দখল করে আছে ইসলাম প্রসঙ্গে নিজেদের মনগড়া ধারণা। পবিত্র কোর’আনের ব্যাখ্যা হতে হবে তাদের মনপুত, নইলে সেটির প্রচার হতে দিতে তারা রাজী নয়। যে সব বইয়ে জিহাদ বিষয়ক আয়াতের উল্লেখ আছে -সেগুলিকে তারা সন্ত্রাসের বই রূপে চিহ্নিত করে। ঘরে বা দোকানে সে সব বই রাখা বা সেগুলি পাঠ করাকে তারা দণ্ডনীয় অপরাধ গণ্য করে। মসজিদে নামায পাঠ, দরুদ পড়া বা রোযা পালন নিয়ে তাদের আপত্তি নাই; কিন্তু নবীজী (সা:)’র যুগের ন্যায় সমাজ ও রাষ্ট্রের পূর্ণ ইসলামীকরণ হতে দিতে তারা রাজী নয়। ইসলামীকরণের সে স্বপ্ন দেখাটিই তাদের কাছে অপরাধ। যারা সে স্বপ্ন দেখে তাদের বিরুদ্ধে দেয় নির্মূলের হুংকার। ফলে বাংলার মুসলিম ভূমিতে অসম্ভব হয়েছে নবীজী (সা:)’র সে সব গুরুত্বপূর্ণ সূন্নতের অনুসরণ যাতে ছিল তাঁর রাজনীতি, প্রশাসন, জিহাদ ও শরিয়ত পালন। এভাবে অসম্ভব করা হয়েছে পরিপূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। বাঙালী মুসলিমের জীবনে এটিই হলো সবচেয়ে বড় সংকট। এভাবে সংকটে পড়েছে তাদের পরকালীন মুক্তি।

গুরুতর এ সংকটের কারণ, ঈমানদারীর দায়ভারটি স্রেফ নামায-রোযা, হজ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিল নিয়ে বাঁচা নয়। বরং সে জন্য হলো পরিপূর্ণ মুসলিম রূপে বাঁচা। এখানে কোন আপোষ চলে না। কাফের হওয়ার জন্য মহান আল্লাহতায়ালার একটি মাত্র হুকুম অমান্যই যথেষ্ট। প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য অপরিহার্য হলো,  মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ। একটি মাত্র হুকুম অমান্য করায় ইবলিস পাপীষ্ট শয়তানে পরিণত হয়েছে। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার বহু হুকুম অমান্য করায় বাধ্য করছে বাংলাদেশের সরকার। পবিত্র কোর’আনে ঘোষণা, “আমার নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী যারা বিচারের কাজ করে না তারা কাফের। ..তারাই জালেম। … তারাই ফাসেক।” –(সুরা মায়েদা, আয়াত ৪৪, ৪৫ ও ৪৬)।  কিন্তু বাংলাদেশে কি মহান আল্লাহতায়ালার এ হুকুম মান্য করা সম্ভব? সে জন্য তো রাষ্ট্রের আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা চাই। কোন অনৈসলামিক দেশে বসবাসের বড় বিপদ তো এটিই। সে বিপদ থেকে বাঁচতে ঈমানদার ব্যক্তি নিজ দেশ ছেড়ে ইসলামী দেশে হিজরত করে। অথচ সে বিপদটাই প্রকট রূপে বেড়েছে বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশে। বাংলাদেশে ইসলাম বিরোধী শক্তির এটিই হলো সবচেয়ে বড় নাশকতা। এটিই তাদের পরিকল্পিত ডি-ইসলামাইজেশন প্রজেক্ট। তাদের লক্ষ্য, মুসলিম জনগণকে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম পালন থেকে জোর পূর্বক দূরে রাখা। নবীজী (সা:)’র ইসলাম থেকে এভাবে দূরে সরিয়ে তাদেরকে ভণ্ড মুসলিমে পরিণত করা। নামায-রোযা, হজ-যাকাতে অংশ নিয়েও মিথ্যা বলা, সূদ-ঘুষ খাওয়া, সেক্যুলার রাজনীতি ও শরিয়তি আইনের প্রতিষ্ঠা বিরুদ্ধে লাঠি ধরাও তখন এ ভণ্ডদের জন্য সহজ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এবং সে সাথে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে, ভয়ানক ক্ষতিটি হয়েছে এরূপ অনৈসলামিক শাসকদের হাতে। বিগত হাজার বছরে খুব কম সংখ্যক মুসলিমই খৃষ্টান, বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। কিন্তু তাদের মাঝে ইসলামের অনুসরণে নিষ্ক্রীয় করার কাজটি হয়েছে বিপুল সংখ্যায়। ইসলাম থেকে দূরে সরা এরূপ মুসলিমগণ ইসলাম নির্মূল করার যুদ্ধে হাত মিলিয়েছে শত্রুপক্ষের সাথে। এরই ফলে বিগত কয়েক শত বছরে মুসলিমদের সংখ্যা বহুগুণ বাড়লেও শক্তি বাড়েনি। সম্মানও বাড়েনি। বরং বেড়েছে উপর্যুপরি পরাজয়। এদের কারণেই মুসলিম উম্মাহ আজ বিভক্ত। এবং আইন-আদালত থেকে নির্বাসিত হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইন। এভাবে নবীজী (সা:)’র ইসলাম অজানা ও অপরিচিত রয়ে গেছে খোদ মুসলিম দেশগুলিতে। মুসলিমের জীবনে সবচেয়ে বড় ইবাদত তাই নামায-রোযা, হজ-যাকাত, তাসবিহ-তাহলিল নয়। এরূপ ইবাদত নবীজী (সা:)’র যুগে মুনাফিকগণও করতো। আজ কোটি কোটি বাঙালী মুসলিমও সেটি করে। বরং সে পবিত্র ইবাদতটি হলো এমন জিহাদ যা রাষ্ট্রের বুক থেকে সেসব  দুর্বৃত্ত শাসকদের নির্মূল করে -যারা মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমগুলোর পূর্ণ পালনকে অসম্ভব করে। যারা সে জিহাদে প্রাণ দেয় তারা পায় বীনা হিসাবে জান্নাত। অন্য কোন ইবাদতে কি সেটি জুটে? করুণাময়ের দরবারে শহীদদের এরূপ বিশাল মর্যাদার কারণ, তাদের কারণেই মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন বিজয়ী হয়; প্রতিষ্ঠা পায় শরিয়ত। এবং বাড়ে বিশ্বজুড়ে মুসলিমের শক্তি ও গৌরব। নবীজী (সা:)’র সাহাবাগণ তো সে পথে অর্থ, শ্রম, মেধা ও প্রাণদানের মধ্য দিয়েই মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করেছিলেন। কিন্তু যে বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের ইতিহাস তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি ও দুর্নীতিতে বিশ্বে শিরোপা লাভে -তাদের কি এ মহান মিশনে আগ্রহ থাকে? বাঙালী মুসলিমের বিপদের মূল কারণ, দেশ জিম্মি এ দুর্বৃত্তদের হাতে। ২১/০২/২০২১

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *