রাষ্ট্রের শক্তি ও গুরুত্ব এবং মুসলিমদের ব্যর্থতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 রাষ্ট্রের শক্তি

 পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি হলো রাষ্ট্র। কি সৃষ্টি কাজে, কি অনাসৃষ্টিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা তূলনাহীন। বড় বড় গণহত্যা, যুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্রের হাতে। এ রাষ্ট্র পরিণত হতে পারে ভয়ানক আযাবের হাতিয়ারে। তেমনি মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কাজও কোন মসজিদ বা মাদ্রাসা থেকে হয়নি, হয়েছে রাষ্ট্রীয় শক্তির হাতে। চরিত্রবান মানব গড়ার কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটিও হলো এই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্ব এখানেই। আদর্শ ও নীতি যত শ্রেষ্ঠই হোক, রাষ্ট্র হাতে না থাকলে সেগুলিকে কখনোই প্রতিষ্ঠা দেয়া যায় না। তাই পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদসহ যে কোন মতবাদের অনুসারীরাই প্রথমে রাষ্ট্রের উপর দখলদারী প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইসলামের নীতিও এক্ষেত্রে ভিন্নতর নয়। ইসলামও রাষ্ট্রকে দখলে নিতে বলে। সেটি দেখা গেছে নবীজী সা:র জীবনে। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো রাষ্ট্রকে দুর্বৃত্ত শক্তির দখলদারী থেকে বাঁচানো এবং ঈমানদারদের দখলে আনা। একাজটি হলো পবিত্র জিহাদ।

কোন একটি রাষ্ট্র শয়তানী শক্তির দখলে গেলে সে রাষ্ট্রের সকল সামর্থ্য দুর্বৃত্ত প্রতিপালনে ব্যয় হয়। তখন দেশের রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি, প্রশাসন ও মিডিয়া সবকিছুই দুর্বৃত্ত প্রতিপালনে নিয়োজিত হয়। রাষ্ট্র তখন শয়তানী শক্তির দুর্গে পরিণত হয়। তখন গুম, খুন, সন্ত্রাস ও নির্যাতন চালানো রাষ্ট্রের নীতি হয়ে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনার আমলের বাংলাদেশ এবং ফিরাউনের আমলের মিশর হলো তারই উদাহরণ। এমন রাষ্ট্রে ফিরাউনেরর ন্যায় নৃশংস দুর্বৃত্তকে মাননীয়, শ্রদ্ধেয় ও ভগবান রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়। এমন রাষ্ট্রে লাখ লাখ মসজিদ-মাদ্রাসা, ইসলামী সংগঠন ও শত শত  তাবলীগী ইজতেমা করে সমাজে ও মানুষের চরিত্র কোন বিপ্লব আনা  যায়না। এবং থামানো যায় না দুর্বৃত্তির প্লাবন। তখন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বড় জোর মুষ্টিমেয় কিছু চরিত্রবান মানুষ গড়া যায় মাত্র। কিন্তু তা দিয়ে দুর্বৃত্তির জোয়ার রুখা যায় না। সভ্যতর সমাজও নির্মাণ করা যায় না।

 সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত

 রাষ্ট্রের উপর ঈমানদারদের দখলদারী প্রতিষ্ঠার কাজটি ইসলামে পবিত্র জিহাদ। এটিই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ নেককর্ম। একাজটি হলো নির্যাতন ভোগ এবং জান-মালের সর্বাধিক খরচের খাত। তাই এর পুরস্কারও মহান আল্লাহতায়ালা সর্বাধিক রেখেছেন। সারা জীবন প্রতিদিন রোজা রেখে এবং জীবনর প্রতিরাত তাহাজ্জুদ নামাজে কাটিয়েও সে সওয়াব জুটে না। এ জিহাদে কেউ নিহত হলে সে শহীদ হয় এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে যায়। মহান নবীজী সা: তাই মদিনায় হিজরতের পর নিজের ঘর না গড়ে প্রথমে ইসলামী রাষ্ট্র গড়ায় হাত দিয়েছিলেন। অর্ধেকের বেশী সাহাবা সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দিতে ও শক্তিশালী করতে শহীদ হয়েছেন। সে রাষ্ট্র থেকেই জন্ম নেয় সে কালের সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তির। জন্ম নেয় সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার। সমগ্র মানব ইতিহাসে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম। এমন একটি ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার পরই আরবের বুকে উন্নত মানুষ গড়ার জোয়ার সৃষ্টি হয়।

ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার আগে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে মক্কার বুকে মহান নবীজী সা: মাত্র প্রায় ২০০ জনের মত ঈমানদার মানুষ গড়তে পেরেছিলেন। অথচ ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার সাথে ইসলামে প্রবেশে জোয়ার সৃষ্টি হয়। সামা্ন্য কয়েক বছরের মাথায় এ রাষ্ট্রটি তৎকালীন বিশ্বের পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য -এই দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করে। এই হলো ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি। শয়তান ও তার অনুসারীগণ সেটি জানে। তাই তারা মসজিদ গড়ার অনুমতি এবং হোয়াইট হাউসে ইফতারী দিলেও পৃথিবীর কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার অনুমতি দেয় না। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, বিশ্বের কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র গড়লে সেটি বোমা মেরে গুড়িয়ে দেয়া হবে।

আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। রাষ্ট্রের হাতে থাকে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশাল মিডিয়া্।  এবং থাকে প্রশাসন, পুলিশ ও আইন-আদালত।‌ মানুষ গড়া ও দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণের কাজে এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। হযরত ঈসা আ: ও হযরত মুসা আ:য়ের বিখ্যাত নবীগণ ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে পারেননি। তাই মানুষ গড়ায় তারা বিপ্লব আনতে পারেননি। তারা ইসলামী রাষ্ট্র বা খোলাফায়ে রাশেদাও গড়তে পারেননি। তাবলীগ জামায়াত গত প্রায় ১০০ বছর ধরে মানুষ গড়ার কাজ করছে। কয়জন মানুষ তারা গড়তে পেরেছে? সে মানুষ দিয়ে কোথাও কি কোন বিপ্লব এসেছে? সে আলামত কি কোথাও আছে? বাংলাদেশে অন্যান্য যেসব ইসলামী সংগঠন, আন্দোলন, পীরমুরিদী ও মসজিদ-মাদ্রাসার মাধ্যমে মানুষ গড়ার কাজ করছে তারাই বা কতদূর সফল হয়েছে?  

সূন্নত বিরোধী কথা

যারা বলে, রাষ্ট্রের বুকে প্রথমে বিপুল সংখ্যক ভাল মানুষ তথা ঈমানদার গড়ার কাজ শেষ করতে হবে, তারপর তাদের সম্মতি বা ভোট নিয়ে রাষ্ট্র গড়তে হবে তারা সঠিক বলেন না। এটি চরম সূন্নত বিরোধী কথা। নবীজী সা: আরবের মানুষদের প্রথমে মুসলিম করার পর ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার কথা ভাবেননি। জনগণের সমর্থন বা ভোট নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র গড়েননি। বরং তিনি রাষ্ট্রকে মানব গড়ার কাজে ব্যবহার করেছেন। বিষাক্ত পানিতে  ডুবে দেহ বাঁচে না। তেমনি দুর্বৃত্ত কবলিত দূষিত সমাজে বসবাস করে ঈমান বাঁচানো যায় না। তখন ঘুষ-সূদ কুশিক্ষার আছড় থেকে পরিত্রাণ মেলে না। বিষাক্ত পানি থেকে বাঁচা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি হলো দূষিত রাষ্ট্র থেকে বাঁচাও। বাঁচার সে কাজটি জরুরি ভাবে করতে হয়। তাছাড়া মুসলিম নির্দেশ নেয় একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা থেকে, জনগণ থেকে নয়। আরব জনগণের সমর্থণ নিয়ে নবীজী সা: ইসলামী রাষ্ট্র গড়েননি।

 নবীজী সা: যখন মদিনার বুকে ইসলামী রাষ্ট্রের পত্তন করেন তখন আরবের শতকরা ৯৫ ভাগের বেশী মানুষ কাফের ছিল। মাত্র কয়েক শত মানুষ নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এরপর যা কিছু হয়েছে -তা তো ইতিহাস। এটিই হলো নবীজী সা:র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। এ সূন্নতের মধ্যে ছিল পবিত্র জিহাদ। দেশের আলেমগণ নবীজী সা:র বহু ছোট খাটো সূন্নতের উপর বহু জোর দেন এবং তা নিয়ে দীর্ঘ ওয়াজও করেন। কিন্তু নবীজী সা:র যে সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নতটির কারণে ইসলাম বিজয়ী হলো, শরিয়ত প্রতিষ্ঠা পেল, সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মিত হলো -সে সূন্নত নিয়ে তারা ওয়াজ করেন না। সে সূন্নত পালনে আগ্রহও দেখান না। এটি হলো আলেমদের জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা। এই জাহিলিয়াতের কারণেই মুসলিম দেশে ইসলাম আজ পরাজিত এবং দেশ অধিকৃত ইসলামের শত্রু শক্তির হাতে। এবং এ জাহিলিয়াতের কারণে মুসলিম জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে জিহাদ। অথচ এরূপ জাহিলিয়াত নিয়ে বাঁচাই হলো সবচেয়ে বড় পাপ তথা কবিরা গুনাহ। ০৭/০৪/২০২২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *