মুসলিম দেশে ইসলামের পরাজয়

ফিরোজ মাহবুব কামাল

যুদ্ধটি আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে

ইসলামের শত্রুপক্ষের মূল যুদ্ধটি কোন ইসলামি দল বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। বরং সেটি মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধের মূল লক্ষ্য: মুসলিম ভূমিতে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তার শরিয়তী আইনকে পরাজিত বা বিলুপ্ত রাখা। বিস্ময়ের বিষয় হলো, সে যুদ্ধটি হচ্ছে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলোতে। খোদ মহান আল্লাহতায়ালা মানব দৃষ্টির অগোচরে। কিন্ত তাঁর নাযিলকৃত পবিত্র কোরআন ও শরিয়তী বিধান তো চোখের সামনে। ফলে আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহটি যাদের মধ্যে প্রবল, তাদের মনের আক্রোশটি গিয়ে পড়ছে তাঁর কোরআনী বিধানটির বিরুদ্ধে। এ জন্যই তাদের রাজনীতির স্থায়ী নীতিটি হলো শরিয়তী বিধানের বিরুদ্ধাচরন। ভারত যখন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাতে অধিকৃত হয় তখনও দেশটিতে হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসাগুলি ছিল। সেগুলোকে তারা গুড়িয়ে দেয়নি। বরং তারা নিজেরা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু নির্মূল করেছে শরিয়তী আদালত। কারণ সে আদালতগুলো ছিল মহান আল্লাহর জমিনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা দেয়ার মুল হাতিয়ার। বাংলাদেশের বুকেও যারা কাফের, ফাসেক, জালেম, মুশরিক, মুনাফিক ও স্বৈরাচারি তারা যে বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে তালা লাগিয়েছে -তা নয়। বরং আল্লাহর শরিয়তী আাইনের প্রয়োগকে তারা নিষিদ্ধ করেছে। আর এভাবেই মুসলিম দেশে পরাজয় এনেছে ইসলামের।

প্রশ্ন হলো, ঔপনিবেশিক বিদেশী শত্রুদের থেকে ইসলামের দেশী শত্রুদের নীতি কি আদৌ ভিন্নতর? উভয়ের নীতি যে অভিন্ন –সেটি বুঝা যায় বাংলাদেশের ন্যায় দেশে ক্ষমতাসীন সেক্যুলারিস্টদের পলিসি থেকে।  আইন-আদালতে ব্রিটিশ কাফেরদের প্রবর্তিত আইন যে আজও বহাল তবিয়তে চালু রয়েছে -তার কারণ তো ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের উভয়ের অভিন্ন নীতি। আদালতে প্রতিষ্ঠিত কুফরি আইনই যে তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ আইন -সে আইনকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে তারা সেটি প্রমাণও করেছে। কোর’আনী আইনের বিরুদ্ধে তাদের প্রধান যুক্তিটি হলো, এটি ১৪ শত বছরের পূরনো। অতএব আধুনিক যুগে তা অচল। মহান আল্লাহতায়ালার আইনের বিরুদ্ধে তাদের দুষমনিটা এতটাই প্রবল যে, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার যে কোন উদ্যোগকে তারা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস  বলে। শরিয়তের প্রতিষ্ঠাকামিদের তারা হত্যা করছে বা জেলে তুলছে। প্রশ্ন হলো, খোদ কোর’আনও তো ১৪ শত বছরের পুরনো। তবে কি পুরনো হওয়ার কারণে কোর’আনকেও বাদ দিতে হবে? তাছাড়া খোদ ইসলাম এসছে তো হযরত আদম (আঃ), হযরত নূহ (আঃ) ও হযরত ইব্রাহীম (আঃ)’র ন্যায় প্রাচীন নবীদের থেকে। তবে কি বাদ দিতে হবে ইসলামকেও। অপর দিকে সেক্যুলারিস্টদের রীতি-নীতি ও ধ্যান-ধারনাগুলোও কি আধুনিক? সেক্যুলারিজমের আভিধানিক অর্থ ইহজাগতিক স্বার্থ চেতনা। সেক্যুলারিজমের জন্ম তো হযরত আদম (আঃ)’য়ের পুত্র কাবিলের হাতে। ইহজাগতিক সে চেতনা নিয়েই সে তার ভাই হাবিলকে হত্যা করেছিল। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তের এরূপ বিরোধীতা ও অবমাননা কোন মুসলিম দেশে হলে সেদেশের মুসলিম জনগণ নিজেদেরকে নবীজী (সাঃ)’র উম্মত রূপে দাবী করে কি করে? শরিয়তের এরূপ অবমাননা তারা সহ্যই বা করে কি করে?

প্রশ্ন, শরিয়ত বলতে কি বুঝায়? শরিয়ত হলো ন্যায়-অন্যায়, সিদ্ধ-অসিদ্ধ, বৈধ-অবৈধ, আইনী-বেআইনী, হালাল-হারামের বাছবিচারে কোরআনে নাযিলকৃত মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া মানদন্ড। সে মানদন্ড শুধু অপরাধকে অপরাধ বলেই সনাক্ত করে না, সে অপরাধের শাস্তিও নির্ধারণ করে দেয়। মহান আল্লাহতায়ালার হিদায়েত শুধু ইবাদত বা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেই নয়, সেটি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও। ইসলাম তো এজন্যই মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। সেক্যুলারিস্টদের মূল সমস্যাটি হলো তাদের ঈমানশূণ্যতা।  ইসলামের উপর ঈমান না থাকার কারণেই সেক্যুলারিস্টগণ আদালত থেকে শরিয়তের আইনকে বাদ দেয়। কোন সভ্য সমাজ বা রাষ্ট্রই শুধু ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, চাষাবাদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য দিয়ে গড়ে উঠে না। সে জন্য চাই ন্যায় বিচার। চাই, ন্যায় বিচারের জন্য ন্যায্য আইন। একটি জনগোষ্ঠি কতটা সভ্য ও অসভ্য সেটি ধরা পড়ে আইন-আদালতের মান থেকে। জঙ্গল এ কারণেই জঙ্গল যে সেখানে কোন আইন-আদালত থাকে। ইসলাম যেরূপ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল তার মূলে ছিল শরিয়তের ন্যায় মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ আইন। এ আইনের প্রণেতা খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। এ আইনে নারী তার ন্যায্য অধিকার পেয়েছিল। প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মানবিক অধিকার এবং জানমালের নিরাপত্তা। বিলুপ্ত হয়েছিল দাসপ্রথা, বর্ণবিদ্বেষ ও গোত্রবিদ্বেষ। প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল আইনের শাসন।

মানব সমাজে সবচেয়ে জটিল ও দুরুহ কাজটি হলো সঠিক আইন প্রণোয়ন ও ন্যায় বিচারের প্রতিষ্ঠা। মানুষ তার বড় ভূলটি ঘর বাঁধায়, চাষাবাদে বা যন্ত্র আবিস্কারে করে না। বরং সেটি করে ন্যায়-অন্যায়, সিদ্ধ-অসিদ্ধ, বৈধ-অবৈধের তারতম্য নির্ধারণে। এক্ষেত্রটিতেই ধরা পড়ে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতার মান। একই আলো-বাতাস ও জলবায়ুতে বাস করে তাই নানা মানুষের নানারূপ বিচারবোধ। এরূপ ভিন্নতর বিচারবোধের কারণেই সূদ, ব্যভিচার, পর্ণগ্রাফি, অশ্লিলতা, দাসপ্রথা, সমকামিতা, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ড্রোন-হামলা ও পারমানবিক বোমা হামলাও অনেকের কাছে বৈধ বা আইনসিদ্ধ রূপে গণ্য হয়। এরূপ একটি অপরাধ প্রবনতা নিয়ে বৃহৎ শক্তিবর্গ বিগত দু’টি বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। পাশ্চাত্যবাসী তো এরূপ বহু  কুকর্মের মধ্যেও নিজেদের তথাকথিত আধুনিক ও সভ্য রূপটি দেখে। এমন এক অসুস্থ্য বিচারবোধের কারণেই বর্ণবাদ, দাসপ্রথা, নারিপুরুষে বৈষম্য, উপনিবেশবাদের মত অসভ্যতাও তাদের সমাজে মাত্র কিছুকাল আগেও প্রচণ্ড দাপট নিয়ে বেঁচেছিল। অথচ ইসলাম সেগুলিকে ১৪ শত বছর আগেও অসিদ্ধ ও গর্হিত পাপাচার রূপে চিহ্নিত করেছিল।

কথা হলো, শরিয়তী আইনের বদলে অন্য কোন আইনকে শ্রেষ্ঠ বললে এবং সে অনুসারে আদালতে বিচার কাজ পরিচালনা করলে কি কারো ঈমান থাকে? এ বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালার ষোষণা, “নাযিলকৃত (কোরআনের) বিধান অনুযায়ী যারা বিচারকার্য পরিচলনা করে না তারাই কাফের।– তারাই জালেম। —তারাই ফাসেক।” –(সুরা মায়েদা, আয়াত ৪৪, ৪৫ ও ৪৭)। অথচ বাংলাদেশের আদালতগুলোতে তো সেটিই হচ্ছে। এবং সেটি হচ্ছে কোটি কোটি নামাযী-রোযাদারের ট্যাক্সের অর্থে। কিন্তু সে হুশই বা ক’জনের? প্রশ্ন হলো, ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে অধিকৃত হওয়ার পূর্বে এমন কি কোন মুসলিম রাষ্ট্র ছিল যেখানে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ছিল না? বাংলা ও ভারতে মুসলিমগণ যখন বিজয়ী হয় তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল অমুসলিম। কিন্তু সে জন্য কি শরিয়তের প্রতিষ্ঠা বিলম্বিত হয়েছিল? অমুসলিম দেশে ঘর বাঁধার কারণে মুসলিম যেমন তাঁর নামায-রোযা পরিহার করতে পারে না, তেমনি কোন অমুসলিম দেশে বিজয় লাভের পর শরিয়তি বিধানও পরিহার করতে পারে না। তাই ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে যখন বাঙলা বিজিত হয় তখন দেশটির আদালতে হিন্দু সেন-আমলের আইন ও বিচার-ব্যবস্থা থাকেনি। প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ইসলামি শরিয়ত। কারণ মুসলিমদের কাছে আইনের এই একটি মাত্র শরিয়তী উৎস ছাড়া আর কোন উৎসের সাথে তাদের পরিচিতিই ছিল না। কিন্তু ইংরেজদের হাতে অধিকৃত হওয়ার পর দেশটির আইন আদালতে আর শরিয়তী আইন থাকেনি। প্রতিষ্ঠা পায় ইংরেজদের কুফরি আইন। কারণ, কাফেরগণও তো তাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও আচার নিয়ে বাঁচে এবং তা দিয়ে রাজ্য শাসন করে। ফলে কাফেরদের শাসনে শরিয়ত বেঁচে থাকবে -সেটিও কি আশা করা যায়? ফলে ব্রিটিশের প্রবর্তিত আইনে সূদ, জুয়া ও মদ যেমন বৈধতা পায়, তেমনি ব্যাভিচার এবং পতিতাবৃত্তিও সিদ্ধ কর্ম রূপে স্বীকৃতি পায়। এবং নিষিদ্ধ হয় কোরআন প্রবর্তিত হুদুদের শাস্তি। 

ব্যক্তির ন্যায় রাষ্ট্রেরও নিজস্ব চরিত্র থাকে। সে চরিত্রটি দেশের মাঠঘাট, জলবায়ু বা আলোবাতাস নির্ধারণ করে না। সেটি নির্ধারিত হয় দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আইন-আদালত থেকে। বাংলাদেশের বুক থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান হয়েছে। দেশের ভূগোলও পাল্টে গেছে। কিন্তু দেশের চরিত্র এখনো পাল্টে যায়নি। ব্যক্তি-চরিত্রের ন্যায় রাষ্ট্রের চরিত্রেও বিপ্লব আনে কোর’আন। অথচ সে কোর’আনী বিধানকে নিষিদ্ধ বা অকার্যকর করা হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা ও আইন-আদালতে। ফলে রাষ্ট্রের চরিত্রে ইসলামি বিপ্লব আসবে -সেটিও কি কখনো আশা করা যায়? মুসলিম দেশগুলি আজ বিদেশী কাফেরদের সামরিক দখলাদারি থেকে মূক্ত হলেও তাদের পূর্ণ দখলদারি এখনো রয়ে গেছে দেশের আদালতের উপর। ফলে অক্ষত রয়ে গেছে কাফিরদের প্রবর্তিত আইন-কানূন ও বিচার ব্যবস্থা। তাদের হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেক্যুলারিস্টগণ এখনো আদালতের বিচারক। মুসলিম সমাজ ও মুসলিম রাষ্ট্র নির্মাণের পথে মূল বাধাটি আসছে তাদের পক্ষ থেকেই। শরিয়তের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামাটি কাফের দেশের আদালতে যেমন অপরাধ রূপে গণ্য হয়, তেমনি অপরাধ রূপে গণ্য হয় বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশের আদালতেও। এ অপরাধে ঈমানদারদের ফাঁসীতে ঝুলানো হয়। এরাই রাজনীতিতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করতে চায়। 

 

আলেমদের ব্যর্থতা

মুসলিম সমাজে আলেম হওয়ার দায়ভারটি বিশাল। সাধারণ মানুষ তো তাদের থেকেই নির্দেশনা পায়। অথচ শরিয়ত প্রতিষ্ঠার কাজে আলেমদের নিরবতা ও নিষ্ক্রীয়তা কি কম বিস্ময়ের? তাদের অপরাধটিও কি কম? তারা আজীবন কোর’আন-হাদীসের শিক্ষালাভ ও শিক্ষাদান নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু কোর’আন-হাদীসের যে মূল শিক্ষা -তার প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাদের আগ্রহটি কোথায়? দ্বীন প্রতিষ্ঠার সে লক্ষ্যে আল্লাহর নির্দেশিত যে জিহাদ, সে জিহাদে তাদের কোরবানীই বা কই? আল্লাহর নির্দেশিত শরিয়তি আইনের প্রতিষ্ঠায় প্রচন্ড গাফলতি করেছিল বনি-ইসরাইলের আলেমগণ। তারাই ইসলামের ব্যর্থ ছাত্র। পবিত্র কোর’আনে তাদের ব্যর্থতাগুলো বিষদ ভাবে তুলে ধরার কারণ, মুসলিমগণ যেন তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তাদের ব্যর্থতার মূল কারণ, হযরত মূসা (আ:)’র উপর তাওরাতে যে শরিয়তী আইন নাযিল করা হয়েছিল তার প্রতি তাদের সীমাহীন গাদ্দারী। সে গাদ্দারীর কারণে আল্লাহতায়ালার প্রচন্ড ক্রোধ গিয়ে পড়েছে তাদের উপর। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে ভারবাহি গাধার সাথে তুলনা করেছেন। কারণ, গাধার কাজ শুধু ভার বহন করা, পিঠে যা বহন করে সেটি বুঝা ও তার প্রতিষ্ঠায় গাধার কোন আগ্রহ থাকে না। মহান আল্লাহতায়ালার নিজের ভাষায় তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগটি বর্ণিত হয়েছে এভাবে: “যাদের উপর তাওরাতের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল, (কিন্তু) তারা সে দায়িত্বভারটি বহন করেনি। তাদের উদাহরণ হলো, তারা যেন কিতাব বহনকারি গর্দভ। কত নিকৃষ্ট সে সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে। আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।” –(সুরা জুমুয়া, আয়াত ৫)।

বনি ইসরাইলের আলেমগণ সদাসর্বদা তাওরাত নিয়ে বহন করে চলা ফেরা করতো, তাওরাতের সে বিধানগুলো সুললিত কন্ঠে পাঠও করতো। কিন্তু সেগুলির প্রতিষ্ঠায় তাদের মাঝে কোন আগ্রহ ছিল না। তারা চিত্রিত হয়েছে জালেম রূপে। কারণ, তাদের জুলুমটি ছিল শরিয়তী বিধানের সাথে। প্রশ্ন হলো, আজকের মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে এমন আলেমের সংখ্যা কি কম? এ আলেমদের মাঝে মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোথায় সে আগ্রহ? বাংলাদেশে আজ হাজার হাজার মাদ্রাসা। সে সব মাদ্রাসায় লক্ষ লক্ষ ছাত্র ও শিক্ষক। বাংলাদেশে যতজন ডিগ্রিধারি আলেম ও তথাকথিত আল্লামার বসবাস, নবীজী (সাঃ)র আমলে সাহাবাদের সংখ্যা তার ১০ ভাগের এক ভাগও ছিল না। অথচ তারা বিজয়ের পর বিজয় এনেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের আলেমদের হাতে কোথায় সে বিজয়? বাংলাদেশের পথেঘাটে বহু দাবি-দাওয়া নিয়ে মিছিল হয়। কিন্তু শরিয়তের প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে কি আলেমগণ একবারও রাস্তায় নেমেছেন?    

আল্লাহর আইন তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার লড়াইটি জায়নামাযে বা মসজিদে হয়না। সেটি হয় বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও সামরিক রনাঙ্গণে। ফলে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায় যার সামান্যতম আগ্রহ আছে সে কখনোই আইনের সে পাঠকে মসজিদ-মাদ্রাসায় বন্দি রাখাতে খুশি হয়না। বরং সে আইনের প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও প্রয়োজনে সামরিক রনাঙ্গণেও হাজির হয়। মুসলিমের জীবনে জিহাদও তো এভাবে অনিবার্য হয়ে উঠে। কিন্তু বাংলাদেশের ক’জন আলেমের জীবনে সে জিহাদ। ক’জনের জীবনে উচ্চতর সে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক লড়াই। যেন মসজিদ মাদ্রাসায় চাকুরি করে কোন রকম বেঁচে থাকাটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে গেছে। অথচ নবীজী(সাঃ)’র কোন সাহাবী খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি জিহাদে অংশ নেননি এবং প্রাণদানে প্রস্তুত ছিলেন না। মুনাফিকগণ তাই নামাযী, রোযাদার ও হাজী হতে পারে। কিন্তু সে কখনোই আল্লাহর রাস্তায় সৈনিক হতে পারে না। প্রকৃত মু’মিনও হতে পারে না। ফলে তার জন্য অসম্ভব হয় জান্নাত লাভ। ফলে পুরা ব্যর্থ হয়ে যায় পৃথিবীর বুকে সমগ্র বাঁচাটাই। কারণ, মুনাফিকের জিহাদশূণ্য নামায-রোযা, হজ-যাকাত ও ইবাদতে মহান আল্লাহতায়ালা খুশি নন।

মু’মিন ব্যক্তিকে পরীক্ষায় মধ্যে ফেলাই মহান আল্লাহতায়ালার রীতি। জিহাদ হলো সে উচ্চতর পরীক্ষা। মু’মিনের জীবনে সে পরীক্ষার পর্বটি কতটা কঠোর হতে পারে মহান আল্লাহতায়ালা সে বর্ণনাটি দিয়েছেন এভাবে: “তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের উপর এখনো সেরূপ সময় আসেনি যেমনটি এসেছিল তাোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। অর্থসংকট, দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে এতটাই ঘিরে ধরেছিল এবং তারা এতটাই ভীত ও প্রকম্পিত হয়ছিল যে, এমন কি রাসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা বলে উঠেছিল, “কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য? জেনে রাখ আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই নিকটে।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২১৪)। আরো বলা হয়েছে, “তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেয়া হলো যদিও তোমাদের নিকট তা অপ্রিয়। কিন্তু তোমরা যা অপছন্দ করো, সম্ভবত সেটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। এবং যা তোমরা যা পছন্দ করো সম্ভবত সেটিই তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২১৮)। এমন জিহাদই দেয় বিশ্বমাঝে বিজয়ী শক্তি রূপে বেড়ে উঠার সামর্থ্য। এবং প্রতিষ্ঠা দেয় আল্লাহর জমিনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের। জিহাদ সংগঠিত করার দায়িত্ব তাই ইসলামি রাষ্ট্রের। ইসলামি রাষ্ট্র তো এভাবেই মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য নিশ্চিত জান্নাত লাভের পথ করে দেয়। তাই মুসলিম যেখানে ঘর গড়ে সেখানে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসাই গড়ে না, ইসলামি রাষ্ট্রও গড়ে। সে রাষ্ট্রের মাধ্যমে জিহাদেরও আয়োজন করে। অপর দিকে অনৈসলামিক রাষ্ট্র প্রজার জীবনে বাড়ায় পাপাচার, ফিতনা ও পথভ্রষ্টতা। এভাবে গড়ে জাহান্নামের পথ। অনৈসলামিক রাষ্ট্রের বড় বিপদটি তো এখানেই।

 

মূল কারণটি জাহেলিয়াত

বাঙালী মুসলিমের ব্যর্থতাটি বিশাল। তবে ব্যর্থতার মূল কারণ জাহিলিয়াত তথা জ্ঞানহীনতা। এ জ্ঞানহীন অবস্থাটি এসেছে কোর’আনের জ্ঞান না থাকায়। জ্ঞানহীনতাই মানুষকে চেতনাহীন করে। জ্ঞানহীন এমন মানুষেরা জেগে জেগেও ঘুমায়। ঘুমন্ত মানুষের ন্যায় এরা এতটাই চেতনাহীন হয় যে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই দূরে থাক, শত্রুর উপস্থিতিও তারা টের পায় না। কোন দেশে কোটি কোটি এমন জ্ঞানহীন মানুষ জেগে থাকলেও কি কল্যাণ হয়? ইংরেজ বাহিনীর হাতে যখন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা অধিকৃত হয় তখন কি এ বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের কোটি কো্টি মানুষ ঘুমিয়ে ছিল? তারা তো জেগে জেগেই নিজ দেশের উপর সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের দখলদারি প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছে। সে দখলদারির বিরুদ্ধে কেউ কি ময়দানে নেমেছে? সে আগ্রাসন রুখতে প্রতিটি মুসলমানের উপর জিহাদে যোগ দেয়া যে ফরজ ছিল -সেটিই বা ক’জন অনুভব করেছে? একটি জনগোষ্ঠি যখন এরূপ চেতনাহীন ও প্রতিরোধহীন হয় তখন সে দেশটি দখলে নিতে ও তাদের উপর শাসনে কি বেশী জনবল ও অস্ত্রবল লাগে? ফলে ভারতের ন্যায় বিশাল ভূ-ভাগের উপর সাম্রাজ্য কায়েম করতে ইংরেজদের বিশাল রাজকীয় বাহিনীর প্রয়োজন পড়েনি। ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর ক্ষুদ্র পেটুয়া বাহিনীর দ্বারাই সে কাজটি অতি সহজে সমাধা হয়েছে। অথচ শত্রুর হামলার বিরুদ্ধে মুসলিমদের জিহাদ শুরু হলে শত্রুর উপর বিজয়টি সহজ হয়ে যায়। কারণ, জিহাদ সম্পৃক্ততা গড়ে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর ফেরেশতা বাহিনীর সাথে। সে সম্পৃক্তার কারণেই অতীতে আল্লাহর সাহায্য নিয়ে ফেরশতাগণও বার বার রণাঙ্গণে নেমে এসেছেন। মুসলিমদের কাজ তাই প্রতিটি যুদ্ধকেই খালেছ জিহাদে পরিণত করা।

শত্রুর বিরুদ্ধে ঈমানদারদের যুদ্ধটি জিহাদে রূপ নিলে বিজয়টি কি ভাবে আসে তার উদাহরণ হলো আফগানিস্তান। জনবলে দেশটি বাংলাদেশের সিকি ভাগেরও কম। অথচ ইসলামের শত্রুগণ বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে যতটা না ভয় পায়, তার চেয়ে বেশী ভয় করে ৪ কোটি আফগানকে। কারণ বিপুল সংখ্যক আফগান মুসলিমদের মাঝে জিহাদী চেতনা এখনো প্রবল ভাবে বেঁচে আছে। এ জিহাদের বলেই জনবলে ও সম্পদে দুর্বল হয়েও পর পর তিনটি বিশ্বশক্তিকে তারা পরাজিত হয়েছে। সেটি যেমন ব্রিটিশকে, তেমনি সোভিয়েত রাশিয়া ও সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। আফগান মোজাহিদদের উপর্যপরি বিজয়ের কারণ, ইসলামের শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধকে তারা শতভাগ জিহাদের পরিণত করেছে। আর জিহাদ শুরু হলে মুসলিমগণ কি একাকী থাকে না। ক্ষুদ্র কংকরও তখন বোমায় পরিণত হয়। আবরাহার বিশাল বিশাল হাতি মারা পড়েছিল তো সে কংকরের আঘাতে। মশামাছিও তখন মিজাইলে পরিণত হয়। মাছি যেমন নমরুদের ঘায়েল করেছিল। এমনকি সমুদ্রও সে জিহাদে সৈনিক রূপে যোগ দেয়। ফিরাউনের বিশাল সেনাবাহিনীকে তো সাগরের পানিই ডুবিয়ে মেরেছিল।

প্রশ্ন হলো, মুসলিমগণ কি অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিবে না? যে দায়বন্ধতার কারণে তাঁরা মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা -সে দায়ভার কি তারা পালন করবে না? মুসলিম দেশগুলোতে আজ যে যুদ্ধটি মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে চলছে -সেটি তো হওয়া উচিত ছিল শয়তান ও তার সেক্যুলারিস্ট অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এবং বিজয়ী করা উচিত ছিল শরিয়তী বিধানকে। প্রশ্ন হলো, এ বিশাল ব্যর্থতা নিয়ে কে তারা রোজ হাশরের বিচার দিনে মহান আল্লাহতায়ালার সামনে হাজির হতে চায়? ১ম সংস্করণ ২২/০৩/২০১৪; ২য় সংস্করণ ০৪/০২/২০২১।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *