ব্যর্থ শিক্ষাব্যবস্থাই সকল ব্যর্থতার মূল

ফিরোজ মাহবুব কামাল

দেখায় না সিরাতাল মুস্তাকীম

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতাটি গুরুতর ও ভয়ানক। এ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য এ শিক্ষা নীতি কিছু ভাষা জ্ঞান, কিছু পেশাদারী জ্ঞান এবং কিছু হিসাব-নিকাশের জ্ঞান দেয় বটে, কিন্তু কেন বাঁচতে হবে এবং কিভাবে বাঁচতে হবে -সে মৌলিক জ্ঞানটুকু দেয় না। ফলে অজ্ঞতা থেকে যায় জীবনের মূল লক্ষ্য ও দর্শন নিয়ে। অজ্ঞতা থেকে যায় অনন্ত অসীম পরকাল নিয়েও। শিক্ষাঙ্গণে পরিকল্পিত ভাবে চলছে ছাত্রদের সামনে পরকালকে আড়াল করার শয়তানী ষড়যন্ত্র। মৃত্যুহীন ওপারের বিশাল জীবন যেন জীবনের কোন অংশই নয়। সে অন্তহীন জীবনকে ভূলিয়ে রাখার চেয়ে বড় অপরাধ আর কি হতে পারে? সে অপরাধটিই করছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। অথচ চরিত্রে আমূল বিপ্লব আনে পরকালের ভয়। নবীজী (সা:) তাই পরকালের ভয় সৃষ্টির কাজটিই সর্ব প্রথম করেছিলেন -যা আরবদের জীবনকেই পাল্টে দিয়েছিল। আখেরাতে জবাবদেহীতার ভয় থেকে তারা এক পরিশুদ্ধ নতুন জীবন পেয়েছিল। নইলে মক্কার পৌত্তলিকরাও সৃষ্টিকর্তা রূপে মহান আল্লাহকে শত শত বছর পূর্ব থেকেই বিশ্বাস করতো এবং সন্তানের নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান রাখতো।

বাংলাদেশের এ সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা শেখায় না এবং দেখায় না সিরাতাল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের রোডম্যাপ। এবং সে রোডম্যাপটি হলো পবিত্র কুর’আন। মানবকে শ্রেষ্ঠ মানব রূপে গড়ে তোলার এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ টেক্সটবুক -যা দিয়েছে মানবের স্রষ্টা সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালা। এ টেক্সটবুক সর্বশ্রেষ্ঠ মানব গড়ার বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের যুগে। অথচ বাংলাদেশের সরকারি শিক্ষাদানে এ টেক্সটবুকের কোন স্থান নাই। মহান আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ এ নিয়ামত থেকে দূরে রাখার চেয়ে গুরুতর অপরাধ আর কি হতে পারে? অথচ সে অপরাধ করছে বাংলাদেশ সরকার ও তার শিক্ষাব্যবস্থা। শয়তান ও তার অনুসারীগণ এক্ষেত্রে দারুন সফল; তারা জান্নাতের যোগ্য মানব গড়ার মুল হাতিয়ারটিই নিজ দখলে নিতে পেরেছে এবং ব্যর্থ করে দিতে পেরেছে মহান আল্লাহ তায়ালার কুর’আনী জ্ঞান দানের প্রকল্প।

সিলেবাসে কুর’আন স্থান না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী জীবনের চলার পথে সিরাতাল মুস্তাকীম পায়না, তারা ভূল পথে তথা পাপের পথে চলে। তারা মিথ্যাবাদী, প্রতারক, ধর্ষক, খুনি, সন্ত্রাসী, সূদখোর ও ঘুষখোর হয়; এবং চুরি-ডাকাতি, ভোট ডাকাতি, হত্যা, গণহত্যা, গুম-খুন ও আয়না ঘরের ন্যায় অপরাধ জগতের সাথে জড়িত হয়। এবং রাজনীতিতে বামপন্থী, জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী ও সেক্যুলারিস্ট শিবিরের সন্ত্রাসী নেতা-কর্মী হয়  এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। উল্লেখ্য যে, চারিত্রিক কদর্যতায় বিশ্ব বিদ্যালয়ের এসব ডিগ্রিধারীদের যা রেকর্ড -তা থেকে দেশের নিরক্ষর কৃষক-শ্রমিক-তাঁতিগণ বরং অনেক উত্তম। অথচ দেশের বাজেটের সিংহ ভাগ ব্যয় হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বাঁচিয়ে রাখতে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের আমলে এতো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা ছিল না। অথচ মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবগণ গড়ে উঠেছে সে সময়েই । তাদের সে সাফল্যের কারণ নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত এবং তাদের পথটি পদে পদে অনুসরণ করা উচিত। যে পথটি পরীক্ষিত সাফল্যের পথ -সে পথটি পরিহার করে ভিন্ন পথ অনুসরণের চেয়ে ভয়ানক বোকামী আর কি হতে পারে?        

 

চরিত্র বদলাতে পাল্টাতে হয় দর্শনের মডেল

দেশ পাল্টাতে হলে প্রথমে জনগণকে পাল্টাতে হয়। আর জনগণকে পাল্টাতে হলে তাদের দর্শন তথা চেতনার মডেল পাল্টাতে হয়। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে paradigm shift বলে।  যে কোন বিপ্লবের মূলে হলো এই paradigm shift। সে পাল্টানোর কাজটি ভাত-মাছ ও দুধ-কলা খাইয়ে হয় না। ক্ষেত-খামারেও হয় না। সে জন্য চাই শ্রেষ্ঠ দর্শন এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থা। সে কাজটি না হলে মানব গড়ার কাজ ও দেশ গড়ার কাজ কোনটাই হয়না। চেতনার সে পুরনো মডেল পাল্টানোর কাজটিই সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম করেছেন তাঁর রাসূল (সা:)কে ময়দানে নিয়োগ দিয়ে। সেটি করেছেন জ্ঞানার্জনকে ফরজ করে; এবং সেটি  নামাজ-রোজা ও হ্জ্জ-যাকাত ফরজ করার এক দশকেরও বেশী আগে। এবং নাজিল করেছেন জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ টেক্সটবুক পবিত্র কুর’আন। এবং “ইকরা” তথা “পড়” হলো কুর’আনের প্রথম শব্দ।

অথচ জ্ঞানদানের ক্ষেত্রে নবীজী (সা:) সে কুর’আনী মডেল বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে স্থান পায়নি। দেশটিতে এখনো চালু আছে ব্রিটিশের প্রবর্তিত সেক্যুলার মডেল। এ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় চাকর-বাকর উৎপাদনের জন্য -যারা বিদেশী শাসকের কাছে নিজের পরিচয় পেশ করবে your most obedient servant রূপে। সে সাথে এ শিক্ষা ব্যবস্থার আরো লক্ষ্য ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের মন থেকে ঈমান ও আখেরাতের ভয় ধ্বংস করা। কারণ ঈমান ও আখেরাতের ভয় থাকলে কেউ কখনো ব্রিটিশদের ন্যায় ঔপনিবেশিক কাফিরদের চাকর-বাকর হতে পারে না। ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়েছে; কিন্তু দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য চাকর-বাকরের প্রয়োজন কমেনি। বরং দেশ-বিদেশে তাদের চাহিদা বহুগুণ বেড়েছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার মূল নীতি ও মূল লক্ষ্য একই রয়ে গেছে। ফলে এখনো শিক্ষাঙ্গণে চলছে ঈমান ধ্বংস ও পরকালের ভয় ধ্বংসের কাজ।

 

শিক্ষাঙ্গণ: ঘরের শত্রু উৎপাদনের কারখানা

নবীজী (সা:)’র শিক্ষা ব্যবস্থায গুরুত্ব পেত মানবকে কিরূপে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রিয়তর করা যায় এবং কি করে তাদেরকে জান্নাতের যোগ্য করা যায় -সে বিষয়টি। অর্থাৎ সে শিক্ষায় গুরুত্ব পেত মৃত্যুর ওপারে জীবনের যে অন্তহীন ও মৃত্যুহীন জীবন -সে বিশাল জগতটি।  কিন্তু তা আজ পরিত্যক্ত হয়েছে পাঠদানের সিলেবাস থেকেই। দ্বীনিয়াতের কিছু পাঠ দেয়া হলেও ছাত্র-ছাত্রীদের চেতনা বা দর্শনের মডেল পাল্টানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়। তা নিতান্তই অতি সামান্য। একজন ছাত্রকে ডাক্তার বানাতে হলে তাকে কম পক্ষে ৫ বছর মেডিক্যাল কলেজে নিবীড় শিক্ষাদানে ব্যস্ত রাখতে হয়। আর জান্নাতের যোগ্য ঈমানদার বানানোর সিলেবাস তো আজীবনের জন্য। পাঠ শালা থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি তা চালু রাখতে হয়। তাই নবীজী (সা:) বলেছেন: উতলুবুল ইলম মিনাল মাহদে ইলাল লাহাদ। অর্থ: দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো।

কিন্তু বাংলাদেশে সে ইসলামী দর্শন কাজ করছে না। ফলে শিক্ষা খাতে বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে দেশের বা জনগণের কল্যাণ হচ্ছে না। বরং তাতে বিপুল সংখ্যায় বাড়ছে শয়তানী শক্তির জনবল।  ফলে দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত, মিডিয়া, বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণ তাদের হাতেই অধিকৃত। ফলে গুম, খুন, ঘুষ বাণিজ্য, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, হত্যা, পিলখানায় সেনাহত্যা, শাপলা চত্বরের গণহত্যা, ক্যান্টনমেন্টগুলিতে আয়নাঘর, ভূমির উপর ডাকাতি এবং বিচারের নামে প্রহসন চালাতে লোকবলের অভাব হয়না। এদের কারণে আল্লাহ দ্বীন বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতেই দারুন ভাবে পরাজিত। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি পরিণত হয়েছে ইসলামের ও জনগণের শত্রু উৎপাদনের বিশাল বিশাল কারখানায়।

  

সরকারি খরচে জাহান্নামী বানানোর ষড়যন্ত্র

জ্ঞানার্জনের ফরজ দুই রকমের। একটি ফরজে আইন; অপরটি ফরজে কেফায়া। জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্র যেটি ফরজে আইন -সেটি হলো নামাজ-রোজার ন্যায় প্রত্যেকের উপর ফরজ। এ ফরজের কোন ক্বাজা নাই। ফরজে আইন হলো, পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জন। এ ফরজ পালন না করলে মুসলিম হওয়াই অসম্ভব। তাই এটি ফরজ প্রতি পুরুষ ও নারীর উপর। সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো সে ফরজ পালনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ ফরজ পালন করতে গিয়ে মিশর, সিরিয়া, ইরাক, সুদান, মরক্কো, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, আলজিরিয়ার জনগণ মাতৃভাষা কবরে পাঠিয়ে আরবি ভাষাকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু আজকের মুসলিমগণ অর্থের লোভে ইংরেজী, ফরাসী, চাইনিজ, কোরিয়ান ইত্যাদি ভাষা শিখতে কোর্স করতে রাজী, কিন্তু কুর’আন ও কুর’আনের ভাষা বুঝতে রাজী নয়। এ থেকে বুঝা যায় তাদের জীবনের প্রায়োরিটি কি। তাদের কাছে আখেরাতের সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো পার্থিব জীবনের কামিয়াবী। শয়তান তো এটিই চায়।

অপর দিকে জ্ঞানার্জনে ফরজে কেফায়া হলো জানাজার নামজের মত, কিছু লোক পালন করলে সেটি পালন হয়ে যায়। তখন তা পালন না করলেও গুনাহ হয় না। সেটি ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, কৃষিবিদ বা হিসাববিদ হওয়ার ন্যায়। অতি পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের সরকারি স্কুল-কলেজে জ্ঞানার্জনের ফরজ আদায় হচ্ছে না। ফলে ছাত্রদেরকে সরকারি খরচে সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। এ বিজয় নিয়ে শয়তান ও তার অনুসারীদের প্রতিদিন উৎসব হওয়া উচিত। কারণ সরকারি খরচে বিশাল বিজয় পাচ্ছে ইবলিস শয়তানের পূর্ব ঘোষিত এজেন্ডা।

ছাত্র-ছাত্রীদের সিরাতাল মুস্তাকীম দেখানোর কাজটি হলে দেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে প্রচুর লোক পাওয়া যেত। তখন দেশের রাজনীতি, পুলিশ, প্রশাসন, মিডিয়া, বিচার ব্যবস্থা  মুক্ত হতো শয়তানের চাকর-বাকরদের দখলদারী থেকে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। বরং বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কাজ করছে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ইসলামী বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে। ফল দেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রশাসন, পুলিশ, আদালত ও মিডিয়ার জগতে যারা ইসলামের প্রতিপক্ষ রূপে যুদ্ধ করছে তারা অন্য গ্রহের লোক নয়, তারা বরং এ শিক্ষা ব্যবস্থারই উৎপাদিত ফসল। বাংলাদেশে ইসলামকে পরাজিত রাখার কাজে তাই কোন বিদেশী কাফির শক্তিকে যুদ্ধে নামতে হচ্ছে না। সেটি সাফল্যের সাথে সমাধা করছে নিজ ঘরে উৎপাদিত ইসলামের এ শত্রুরা। এভাবেই বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশে সরকারি খরচে ছাত্র-ছাত্রীদের জাহান্নামী বানানো হচ্ছে।  ০৪/০৭/২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *