বিবিধ ভাবনা ৭২

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১. ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তি ও অধর্মের জয়

অধিকাংশ মুসলিমের মাঝে সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি ও সবচেয়ে বড় অধর্ম ঘটছে ধর্ম নিয়ে। এ বিভ্রান্তি ও অধর্মের কারণ, ধর্ম নিয়ে গণমনে গভীর অজ্ঞতা। অজ্ঞতা নিয়ে কখনোই ধর্ম পালন হয় না। মুসলিমও হওয়া যায় না। মুসলিম হতে হলে তাই প্রথমে অজ্ঞতা সরাতে হয়। সেটি নবীজী (সা:) প্রথম করেছেন। অজ্ঞতার আরবী পরিভাষা হলো জাহিলিয়াত। ইসলামপূর্ব আরবের যুগকে বলা হয় আইয়ামে জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতার যুগ। মহান নবীজী (সা:) ইসলামের আবাদ বাড়িয়েছেন এ অজ্ঞতা দূর করে। এবং কুর’আনী জ্ঞানের আলোও জ্বেলে।

বস্তুত মানব জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো মন থেকে অজ্ঞতা সরানো। এটাই ইসলামে পবিত্রতম ইবাদত। তাই নামায-রোযা ফরজ হওয়ার এক দশকেরও বেশী আগে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়। পবিত্র কুর’আনের প্রথম শব্দটি তাই নামায-রোযা নিয়ে নয়, বরং সেটি হলো “ইকরা” তথা “পড়” অর্থাৎ জ্ঞানবান হও।  কিন্তু বাংলাদেশে সে জ্ঞানবান করার কাজটি হয়নি। বরং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার নামে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজটি অধিক হয়েছে। ফলে বেড়েছে অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি। ফলে বেড়েছে ইসলামচ্যুত জাতীয়তাবাদী, সমাজবাদী, ফ্যাসিবাদী, ও সেক্যুলারিস্টদের সংখ্যা। এ কারণেই বাংলাদেশে ইসলাম পরাজিত এবং বিজয় এসেছে ইসলাম বিরোধী শক্তির।

ধর্মকর্ম বলতে সাধারণতঃ বুঝা হয় নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়া-দরুদের মত কিছু আনুষ্ঠিকতাকে। মুসলিম জীবনে বাধ্যতামূলক এ ধর্মীয় বিধানগুলির অবশ্যই গুরুত্ব আছে। কিন্তু ধর্মের মূল কথা কি স্রেফ নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়া-দরুদ? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গুণটি হলো মিথ্যার ভীড়ের মাঝে সত্যকে চেনার সামর্থ্য। ফিরাউনের ইঞ্জিনীয়ারদের বিস্ময়কর পিরামিড গড়ার সামর্থ্য থাকলেও সত্যকে চেনার সামর্থ্য তাদের ছিল না। ফলে ফিরাউনকে তারা খোদা বলতো। একই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারী বহু লক্ষ বাঙালীর। অজ্ঞতার কারণেই তারা জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় ভ্রান্ত মতবাদের অনুসারি হয়েছে। বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ব্যর্থতা হলো তারা ছাত্রদের চেতনা থেকে জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা সরাতে পারিনি। বরং নব্য জাহিলিয়াতে দীক্ষা দিয়েছে।

অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মকর্ম হলো সদা সত্য কথা বলা, হারাম উপার্জন থেকে দূরে থাকা এবং নেক আমলে লেগে থাকা। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে সেটিও গুরুত্ব পায়নি। ফলে সৎ আমলের বদলে দেশে প্লাবন এসেছে দুর্নীতিতে। অপর দিকে শুধু গাছ লাগালেই চলে না, আগাছাও নির্মূল করত হয়। ধার্মীক ব্যক্তিকে তাই শুধু মিথ্যা ও দুর্বৃত্তি থেকে দূরে থাকলেই চলে না, দুর্বৃত্তি নির্মূলেও নামতে হয়। ইসলামে নির্মূলের একাজটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে সেটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা জিহাদের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রে ইসলাম বিজয়ী হয় এই জিহাদের কারণে। স্রেফ নামায-রোযার কারণে নয়। ব্যক্তির প্রকৃত ঈমান তো এ জিহাদের মধ্যেই ধরা পড়ে। সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে জিহাদকে তাই ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। যাদের জীবনে জিহাদ আছে একমাত্র তাদেরকেই সত্যিকার ঈমানদার বলা হয়েছে। নবীজী (সা:) ও তাঁর প্রতিটি সাহাবার মাঝে তাই জিহাদ ছিল। নামায-রোযা-হ্জ্জ-উমরাহ এবং দান-খয়রাত বহু ঘুষখোর, চোরডাকাত ও দুর্বৃত্তও করে। কিন্তু তাদের সত্য বলার সামর্থ্য থাকে না; সামর্থ্যও থাকে না দুর্বৃত্তি হারাম উপার্জন থেকে বাঁচার। তারা দুর্বৃত্ত নির্মূলের জিহাদেও নামে না।

 

২. ইসলামর খুঁটি

ইসলামের খুঁটি ৫টি। ইসলামের বিশাল ঘরটি দাঁড়িয়ে থাকে এই ৫টি খুঁটির উপর। সেগুলি হলো ঈমান, নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিটি হলো ঈমান। ঈমান সঠিক হলেই নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাতের ন্যায় ইবাদতগুলি সঠিক হয় এবং মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সেগুলি গ্রহনযোগ্য হয়। ঈমানই আমলের ওজন ও মূল্য বাড়ায়। ঈমানে ভেজাল থাকলে অন্যান্য ইবাদতগুলিতে ভেজাল দেখা দেয়। ঈমানই মু’মিনের জীবনে কম্পাসের কাজ করে। ঈমানের মূল কথাটি হলো, মহান আল্লাহতায়ালার উপর গভীর বিশ্বাস এবং প্রতিটি কর্মে ও আচরণে তাঁকে খুশি করার চেতনা। যে কর্মগুলি মহান আল্লাহতায়ালার অপছন্দের তা থেকে দূরে থাকার সার্বক্ষণিক চেতনা। প্রতি পদে এ বিশ্বাস ও চেতনা নিয়ে বাঁচাই হলো তাকওয়া। এটিই হলো প্রকৃত আল্লাহভীতি।

মু’মিনের ঈমানদারী তথা তাকওয়া শুধু তার নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতে ধরা পড়ে না। ধরা পড়ে চরিত্র, আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাই কথাবার্তায় সে যেমন সত্যবাদী হয়, তেমনি তাঁর রাজনীতিতে থাকে অন্যায়ের নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার তীব্র তাড়না। থাকে, দেশের আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার তীব্র প্রেরণা। তাঁর রাজনীতি হয় ভাষা, বর্ণ, ভূগোল-ভিত্তিক বাঁধনের উর্দ্ধে উঠে প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্বের। তার রাজনীতি তখন সেক্যুলার বা ধর্মহীন না হয়ে পবিত্র জিহাদে পরিণত হয়। অথচ বেঈমানের রাজনীতিতে সেটি থাকে না। তার বেঈমানী নামায-রোযায় ঢাকা পড়লেও সুস্পষ্ট ধরা পড়ে তার রাজনীতিতে। বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হলে কি হবে দেশটিতে জিহাদের সে রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পায়নি, পেয়েছে ইসলাম বিরোধীতার রাজনীতি। এখানেই ধরা পড়ে ঈমানের অঙ্গণে ভেজালটি।

বেঈমানী যেখানে প্রবল হয়, সেখানে রম রমা ব্যবসা জমে উঠে ধর্মের নামে। বাংলাদেশে সেটি বহুশত কোটি টাকার ব্যবসা। কোভিড, ম্যালেরিয়া বা কলেরার ন্যায় দৈহিক রোগগুলি চেনা যেমন সহজ, তেমনি সহজ হলো ঈমানের রোগ চেনা। সহজ হলো ধর্মব্যবসায়ীদের চেনা। ঈমানদারের লক্ষণ: তারা নিজেদের জান-মাল দিয়ে জিহাদ করে ইসলামের বিজয় ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দিতে। এ জিহাদে তারা তারা কারাবন্দী হয়, নির্যাতিত হয় ও শহীদ হয়। অপর দিকে ধর্ম ব্যবসায়ীদের লক্ষণ: এরা অর্থ দেয় না, বরং অর্থ নেয়। এদের জীবনে শরিয়তের লক্ষে জিহাদ থাকে না, ফলে তারা তেমন নির্যাতিত হয় না, তেমনি কারাবন্দীও হয় না। বরং থাকে ক্ষমতাসীন জালেমে সাথে তাদের সখ্যতা। তাদের জীবনে থাকে নিজ মত, নিজ ফেরকা, নিজ দল ও নিজ নেতাকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার লড়াই। ফলে বাংলাদেশে এসব ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যবসা জমলেও ইসলাম বিজয়ী হচ্ছে না।    

 

৪. মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা ও শয়তানের খলিফা

মুসলিমদের সংখ্যা আজ প্রায় ১৬০ কোটি। ১৬০ কোটি গরু দুধ দিলে সাগর হয়ে যায়। ১৬০ কোটি গাছ ফল দিলে পাহাড় হয়ে যায়। অথচ ১৬০ কোটি মুসলিম আজ কি দিচ্ছে? অথচ মুসলিমদের সংখ্যা যখন ১ কোটিও ছিল না তখন তারা জন্ম দিয়েছে বিশ্বশক্তির। জন্ম দিয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রের। বিশ্ববাসীকে দিয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও শিক্ষা। কিন্তু আজকের এ ব্যর্থতা নিয়ে মুসলিমদের মাঝে ভাবনা কই? যে পথে চলে বিজয় ও গৌরব জুটলো সে পথে চলার উদ্যোগই বা কই? এ নিয়ে কোথায় সে আত্মসমালোচনা? বাঙালী মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ এ নিয়ে নীরব কেন? বিবেকবান মানুষের বড় পরিচয় হলো, তারা আত্মসমালোচনা নিয়ে বাঁচে। নিজের ব্যর্থতা নিয়ে ভাবে। খোঁজে সাফল্যের পথ। কিন্তু মুসলিম জীবনে আজ কোথায় সে ভাবনা? 

পবিত্র কুর’আনে বর্ণীত মুসলিমদের মূল পরিচয়টি হলো, তারা মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত খলিফা। রোজ হাশরের বিচার দিনে তাদের পুরস্কার মিলবে খলিফা রূপে তারা কতটা দায়িত্ব পালন করেছে তার ভিত্তিতে। দায়বদ্ধতাটি এখানে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে। প্রতি দেশে রাজার খলিফা হলো দেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সেনা সদস্য, আদালত-বাহিনী ও থানার পুলিশ। তাদের কাজ রাজার সার্বভৌমত্ব ও আইনের প্রতিষ্ঠা দেয়া। শুধু প্রশিক্ষণ নিলে বা নিয়মিত অফিস করলে সে দায়িত্ব পালিত হয় না। প্রয়োজনে রাজার পক্ষে যুদ্ধও করতে হয়। সে যুদ্ধে প্রাণও দিতে হয়। রাজ্যের ভিতর ও বাহির থেকে বিদ্রোহীদের নির্মূল করতে হয়। তেমনি মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হলো মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। অর্থাৎ বিদ্রোহীদের নির্মূল করে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করা। নবীজী (সা:) ও তাঁর মহান সাহাবাগণ তো সেটাই করেছেন। তাঁরা ধর্মকর্মকে নিছক নামায-রোযা ্ হজ্জ-যাকাতে সীমিত রাখেননি। দ্বীনের শত্রুদের বিরুদ্ধে সমাজের প্রতি অঙ্গণে যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেছেন, তেমনি রণাঙ্গণেও প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, ১৬০ কোটি মুসলিমের মধ্যে ক’জন ইসলামকে বিজয়ী করতে একটি দিন ব্যয় করে? ক’জন প্রান দেয়? ক’জন ইসলামের পক্ষে কলম ধরে বা কথা বলে? ক’জন অর্থ ব্যয় করে? অথচ ভাষার নামে, দলের নামে, দেশীয় বা আঞ্চলিক স্বার্থের নামে হাজার হাজার মুসলিম কথা বলছে, কলম ধরছে এবং প্রান দিচ্ছে। এমন কি অনেকে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে কাফেরদের বাহিনীতে যোগ দিয়ে।

প্রশ্ন হলো, আজকের ১৬০ কোটি মুসলিম কি পৃথিবীর কোথাও কি মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয় এনেছে? প্রতিষ্ঠা দিয়েছে কি তাঁর শরিয়তী আইন? বরং তাদের হাতেই সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মানুষের তৈরী কুফরি আইন। এবং বিলুপ্ত হয়েছে শরিয়ত। তাদের রাজনীতির কারণে বিজয়ী হয়েছে জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, সেক্যুলারিজম, স্বৈরাচারের ন্যায় শয়তানী বিধান। তবে কি মুসলিমগণ পরিণত হয়েছে শয়তানের খলিফায়?

 

৫. বিজয়টি দুর্বৃত্তদের

বাংলাদেশে প্রবল বিজয়টি দুর্বৃত্তদের। এবং পরাজয় ইসলামের। এ দুর্বৃত্তদের মূল হাতিয়ারটি হলো মিথ্যাচার। এরা ইসলামের সত্য বিধানগুলিকেও মিথ্যা বলে। এবং শরিয়তের ন্যায় ইসলামের সে বিধানগুলি প্রতিষ্ঠা্র পথে বাধা সৃষ্টি করে। মিথ্যচারী এসব চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত, সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তগণ কথা বলে ফেরেশতাদের মত। অতীতে তারা ওয়াদা দিয়েছে সোনার বাংলার। প্রচার করেছে, তারাই একমাত্র দেশপ্রেমিক। এবং চরিত্রহরন করেছে অন্যদের। সেটি বুঝা যায়, শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে ও শেখ হাসিনার ব্ক্তৃতা শুনলে। এরা বলে, তারা নাকি দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করবে! বলে, জনগণের ভোটের অধিকার দিবে ও ভাগ্য পাল্টাবে!

এদের প্রকৃত চেহারাটি এখন আর গোপন বিষয় নয়। এরাই দেশে চুরি-ডাকাতি, ভোট-ডাকাতি, গুম, খুন, ভারতের ন্যায় বিদেশের দালালী, সন্ত্রাস ও ফাঁসির রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। মুখে এরা গণতন্ত্রের কথা বলে, অথচ এরাই গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নিরেট ফ্যাসিবাদের। এরাই বিরোধীদের তীব্র সমালোচনা করে, কিন্তু নিশ্চুপ থাকে নিজেদের কুকর্মগুলো নিয়ে। দেশকে অধিনত করেছে ভারতের। এরাই ক্ষমতায় গেলে সত্য কথা বলা এবং ইসলামী বিচার ব্যবস্থা তথা শরিয়তের প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত করে। এরাই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দুর্বৃত্ত বিস্তারের হাতিয়ারে পরিণত করেছে।  এভাবে সম্ভব করেছে দুর্বৃত্তি এবং অসম্ভব করেছে ন্যায়-নীতি নিয়ে বাঁচা।

 

৬. বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ ও জিহাদহীন মুসলিম

অস্ত্রের যুদ্ধে বিরতি আছে। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও বিরতি নাই বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটি হলো মিথ্যা, অজ্ঞতা, অসত্য ও দুর্বৃত্তির বিরুদ্ধে। এ লড়াই অজ্ঞতা সরিয়ে আলো জ্বালানোর। এ যুদ্ধ হয় কথা, কলম ও বুদ্ধি দিয়ে। ইসলামে এটিও পবিত্র জিহাদ। বুদ্ধিবৃত্তিক এ যুদ্ধটি না হলে কখনোই অস্ত্রের যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। সে যুদ্ধে সৈনিক জুটে না, এবং বিজয়ও আসে না। ঘোড়ার আগে যেমন গাড়ি জোড়া যায় না, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের আগে অস্ত্রের যুদ্ধ করায যায় না। নবীজী (সা;)’র জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক এ যুদ্ধটি শুরু হয় নবুয়ত লাভের প্রথম দিন থেকেই। এবং বদরের যুদ্ধ তথা অস্ত্রের যুদ্ধটি আসে নবুয়তের প্রায় ১৫ বছর পর। ইসলামের শত্রু শয়তান ও তার অনুসারিগণ কখনোই তাদের শত্রুদের চিনতে ভূল করে না। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক যোদ্ধাদেরও তারা একই রূপ শত্রু রূপে দেখে, যেমন দেখে রণাঙ্গণের সশস্ত্র যোদ্ধাদের। বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণের মুজাহিদগণও তাই শত্রু শক্তির টার্গেটে পরিণত হয়। এবং তারই প্রমাণ, ইসলামের শত্রু শক্তির হাতে নিহত হতে শহীদ কুতুবের ন্যায় মিশরের প্রখ্যাত মুফাচ্ছিরে কুর’আনকে তাই অস্ত্র হাতে ময়দানে নামতে হয়নি। তার বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ তথা লেখনির কারণেই তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

বুদ্ধিবৃত্তিক যোদ্ধাদের মূল কাজটি হলো কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যা -সেটিকে জনগণের সামনে সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা। ভ্রান্ত পথের ভিড়ে জনগণকে সিরাতুল মুস্তাকীম দেখানো। জনগণের চেতনায় বাড়াতে হয় শত শত মিথ্যার মাঝে সত্যকে চেনার সামর্থ্য। এবং জনগণকে অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মুজাহিদ রূপে গড়ে তোলা। পবিত্র কুর’আন এবং নবীজী (সা:)’র সূন্নত তো সেটিই শেখায়। বুদ্ধিবৃত্তিক এ লড়াইয়ে বিজয় না এলে রণাঙ্গণের যুদ্ধে বিজয় জুটেনা। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের মূল লক্ষ্যটি হলো, চেতনার ভূমিকে শত্রুর হামলা থেকে যেমন প্রতিরক্ষা দেয়া, তেমনি শত্রুপক্ষের আরোপিত অস্ত্রের যুদ্ধের মোকাবেলায় লড়াকু সৈনিক গড়ে তোলা।

বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ যে পবিত্র জিহাদ এবং এ জিহাদের মূল হাতিয়ারটি যে পবিত্র কুর’আন –মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কুর’আনে। বলা হয়েছে, “ফালা তুতিয়ীল কাফিরিনা ওয়া জাহিদ’হুম বিহি জিহাদান কাবিরা।” অর্থ: “অতঃপর কাফিরদের অনুসরণ করো না, এবং তাদের বিরুদ্ধে বড় সে জিহাদটি করো সেটি দিয়ে তথা কুর’আন দিয়ে।”-(সুরা ফুরকান, আয়াত ৫২)। উপরুক্ত আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা যে “জিহাদান কাবিরা” তথা বড় জিহাদের কথা বলেছেন সেটি অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, সেটি বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। এবং সে জিহাদের হাতিয়ার রূপে বলা হয়েছে পবিত্র কুর’আনকে। উপরক্ত আয়াতটি এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট হুকুম রূপে। তাই এ হুকুম পালন করা প্রতিটি মুসলিমের উপর নামায-রোযার ন্যায় ফরজ। তাই প্রতিটি মুসলিমকে শুধু নামায-রোযা পালন করলে চলে না, তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের সৈনিকও হতে হয়। এজন্য তার জিহ্ববা, কলম ও জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হয়। কিন্তু ক’জনের রয়েছে সে ফরজ পালন তথা বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে অংশ নেয়ার সামর্থ্য?

অস্ত্রের জিহাদে চাই অস্ত্র চালানোর সামর্থ্য। তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে চাই কুর’আনী জ্ঞান প্রয়োগের সামর্থ্য। কিন্তু পবিত্র কুর’আন যারা না বুঝে তেলাওয়াতে দায়িত্ব সারে তারা কি সে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে কুর’আনের জ্ঞানকে ব্যবহার করতে পারে? তারা কি সেই বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে মুজাহিদ হতে পারে? হাতিয়ারহীন সৈনিকদের ন্যায় এরূপ জ্ঞানশূণ্যরা সে জিহাদের দর্শকে পরিণত হয়। শয়তান তো সেটিই চায়। শয়তান চায় মুসলিমগণ বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে হাতিয়ারহীন হোক এবং জিহাদ থেকে দূরে থাকুক। এবং চায়, বিনা যুদ্ধে বিজয়ী হোক তার দল। সে লক্ষ্য সাধনে শয়তান তার খলিফাদের মাধ্যমে প্রচার করে কুর’আন বুঝার প্রয়োজন নাই, না বুঝে পড়লেই অনেক ছওয়াব। শয়তান এভাবে মানুষদের ছওয়াবে মনযোগী করে, বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে নয়। মুসলিম দেশগুলিতে শয়তানের বিজয় ও ইসলামের পরাজয়ের মূল কারণ তো বুদ্ধিবৃত্তিক এ পবিত্র জিহাদে লড়াকু মুজাহিদের অভাব।      

 

৭. পবিত্র কুর’আনের শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্ব

পবিত্র কুর’আনের আরেক নাম হলো নূর তথা আলো। যেমন সুরা তাগাবুনের ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ফা আ’মিনু বিল্লাহি ওয়া রাসূলিহি ওয়া নূরিল্লাযী আনজালনা..।” অর্থ: অতঃপর বিশ্বাস করো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর এবং সে নূরের (কুর’আনের) উপর -যা আমি নাযিল করেছি। তাই এ কুর’আনকে বাদ দিলে  মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এবং অসম্পূর্ণ থেকে যায় ইসলামের মিশন। পৃথিবী পৃষ্ঠে পবিত্র কুর’আন কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালার মুখপত্র ও হাতিয়ার রূপে। তাই যেখানে পবিত্র কুর’আনী জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা ও ব্যপ্তি নাই, সেখানে ইসলা্মও নাই। পবিত্র কুর’আনের আলো ব্যক্তির জীবন থেকে অন্ধকার সরায়। তাই কুর’আনী জ্ঞান না থাকলে, জাহিলিয়াত বা অজ্ঞতা থাকবে সেটিই সুনিশ্চিত। সে অজ্ঞতার অন্ধকারে সঠিক পথ তথা সিরাতুল মুস্তাকীম চেনা অসম্ভব। যে ব্যক্তি কুর’আনের আলো পায়, একমাত্র সে ব্যক্তিই কুর’আনী আলোয় সে সিরাতুল মুস্তাকীম দেখতে পায়। এমন আলোকিত ব্যক্তিই মিথ্যাসেবী, ধর্ম-ব্যবসায়ী ও ক্ষমতালোভী দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদদের ধোকায় পড়ে না।

কুর’আনের আরেক নাম হিকমাহ। হিকমাহ’র অর্থ প্রজ্ঞা। তাই পবিত্র কুর’আন দেয় গভীর প্রজ্ঞা। ফলে যে ব্যক্তি কুর’আন বুঝলো সে কখনোই বেওকুফের ন্যায় আচরন করে না। সে প্রজ্ঞার বলেই তার চেতনায় থাকে অনন্ত-অসীম আখেরাতের ভাবনা। সে জাহান্নামের আযাবে ভয় তাকে পাপে পথ থেকে দূরে রাখে। এবং মনযোগী করে নেক আমলে। এরূপ ব্যক্তিগণই আখেরাতের ভান্ডারে লাগাতর সঞ্চয় বাড়ায়। এমন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিগণই ধর্ম, বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতির ময়দানে কখনোই কুর’আনী জ্ঞানের জ্ঞানশূণ্য বেওকুফদের অনুসারী হয় না। তাই যে দেশের রাজনীতিতে মিথ্যাচারী দুর্বৃত্তদের বিজয় এবং পরাজয় ইসলামের, বুঝতে হবে সে দেশে মানবদের প্রজ্ঞাবান করে গড়ে তোলার কাজটি হয়নি। তখন বুঝা যায়, সে সমাজে কুর’আনী জ্ঞান বিতরণের কাজটি হয়নি। পানাহার না পেলে যেমন দেহের পতন ঘটে, তেমনি কুর’আনী জ্ঞানের অভাবে মৃত্যু ঘটে প্রজ্ঞার। 

পবিত্র কুর’আনের অপর নাম হলো হুদা অর্থাৎ পথ-প্রদর্শনকারী রোডম্যাপ। যেমন সুরা বাকারার দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, “যালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফি’হি হুদাল লিল মুত্তাকীন।” অর্থ: “এই হলো সেই কিতাব যাতে নাই কোন সন্দেহ এবং মু্ত্তাকীনদের জন্য এই হলো পথ-প্রদর্শনকারী রোডম্যাপ।” অর্থাৎ নানা ভ্রান্তপথের মাঝে একমাত্র এই কুর’আনই আল্লাহভীরু মানবদেরকে সঠিক পথটি দেখায়। তখন প্রাপ্তি ঘটে সিরাতুল মুস্তাকীমের। তাই যারা কুর’আনের জ্ঞান পায়, তারাই জান্নাতের পথ পায়। তাই যে ব্যক্তি কুর’আন বুঝে না -সে ব্যর্থ হয় জীবনের চলার পথে সঠিক পথটি খুঁজে পেতে। এরূপ পথহারাদের পথচলাটি হয় জাহান্নামের পথে। এরূপ পথভ্রষ্টরাই সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, বর্ণবাদী, ও স্বৈরাচারী রাজনীতির নেতাকর্মী হয়।

পবিত্র কুর’আনের আরেক নাম হলো আয-যিকরা তথা স্মরণ। সুরা ক্বাফ’য়ের ৩৭ নম্বর আয়াতে তাই বলা হয়েছে, “ইন্না ফি জালিকা লা যিকরা লি’মান কানা লাহু ক্বালবুন আও আলক্বাস সাময়া ওয়া হুয়া শাহীদ। অর্থ: “নিশ্চয়ই এই কুর’আনের মধ্যে তাঁর জন্য রয়েছে (মহান আল্লাহতায়ালার) যিকর (স্মরণ) যার রয়েছে আলোকিত হৃদয়, রয়েছে শ্রবনের সামর্থ্য এবং রয়েছে পর্যবেক্ষণ ও সাক্ষ্যদানের ক্ষমতা।” পবিত্র কুর’আনের পাঠ তাই ঈমানদারের হৃদয়ে জাগ্রত করে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ। তখন তার স্মৃতিতে জেগে উঠে মহান প্রভুর অপার মহিমা, করুণা ও তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতার কথা। এবং স্মরণে আসে রোজ-হাশরের বিচার দিন, জান্নাত ও জাহান্নামের কথা। তাই সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর হলো অর্থ বুঝে পবিত্র কুর’আন তেলাওয়াত।

 কুর’আনের আরেক নাম হলো ফুরকান -যা সামর্থ্য দেয় কোনটি সত্য ও কোনটি মিথ্যা এবং কোনটি ন্যায় ও কোনটি অন্যায় –সেগুলির মাঝে পার্থক্য করার সামর্থ্য। তাই বেঈমানের বেঈমানী, দুর্বৃত্তের দুর্বৃত্তি ও মিথ্যুকের মিথ্যাচার -কুর’আনের জ্ঞানে যারা আলোকিত তাদের কাছে অজানা থাকে না। অথচ যে ব্যক্তি কুর’আন বুঝে না, সে ব্যর্থ হয় সে সামর্থ্য অর্জনে। এরাই রাজনীতিতে মিথ্যাচারী দুর্বৃত্তদের চিনতে ব্যর্থ হয় এবং তাদের পক্ষ নেয়। বাংলাদেশের মত দেশে দুর্বৃত্তদের বিজয়ের বড় কারণ হলো জনগণের মাঝে কুর’আনী জ্ঞানের এই শূণ্যতা। অন্ধকার যেমন চোর-ডাকাতের অপরাধকর্ম সহজ করে দেয়, তেমনি সমাজ থেকে কুর’আনী জ্ঞানের আলো বিলুপ্ত হলে সহজ হয়ে যায় ইসলাম বিরোধী দুর্বৃত্তদের দুর্বৃত্ত । ইসলামের শত্রুপক্ষ এজন্যই পবিত্র কুর’আন শিক্ষার এতো বিরোধী। ১১/০৮/২০২১

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *