বিবিধ ভাবনা ৬৫

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১. জাতির পতন হয় কীরূপে এবং উত্থানই বা কেমনে?

জাতির পতন কীরূপে এবং উত্থানই বা কীরূপে –সেটি কোন জটিল রকেট সায়েন্স নয়। মানব জাতির ইতিহাস সে জ্ঞানে পরিপূর্ণ। যে কেউ তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়াই আরেক ইতিহাস। ব্যক্তির যোগফলেই গড়ে উঠে জাতি। ভাল ইট না হলে যেমন ভাল বিল্ডিং গড়া যায় না, তেমনি ভাল মানুষ ছাড়া উন্নত জাতি গড়া যায় না। তাই যারা জাতি গঠনে আগ্রহী তারা ব্যক্তির গঠনে মনযোগী হয়।

পুষ্টিকর পানাহারই ব্যক্তির গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সুশিক্ষা। পুষ্টিকর পানাহার পশুপাখিও পায়। কিন্তু তাতে তাদের ইতর জীবনে বিপ্লব আসে না। তেমনি চোর-ডাকাত, ঘুষখোর, সূদখোরও ভাল পানাহার পায়, কিন্তু তাতে তাদের চরিত্রে পরিশুদ্ধি আসে না। চরিত্রের শুদ্ধি আসে চেতনার শুদ্ধি থেকে। এবং চেতনার ভূবনে শুদ্ধির কাজটি করে জ্ঞান। এবং জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া পবিত্র কুর’আন। বাংলাদেশে নানা রূপ দুর্বৃত্তির জোয়ার দেখে নিশ্চিত বলা যায়, চেতনার শুদ্ধির কাজটি আদৌ হয়নি। এর কারণ, দেশটিতে কুর’আনী জ্ঞানের বিতরণের কাজটি হয়নি। সেটি সীমিত রয়েছে কিছু মাদ্রাসায়। মহান আল্লাহতায়ালা চান তাঁর বান্দাহগণ কুর’আনের আলোয় আলোকিত হোক এবং জান্নাতের পথে পাক। এবং শয়তান, চায় কুর’আন থেকে দূরে সরিয়ে অন্ধকারে নিতে। এটিই জাহান্নামের পথ। বাংলাদেশে শয়তানই বিজয়ী হয়েছে।

কুশিক্ষার নাশকতাটি ভয়ানক। দূষিত পানাহারে কিছু ব্যক্তির স্বাস্থ্যহানী ঘটে। কিন্তু শিক্ষায় দূষণ ঘটলে চরিত্রহানী ঘটে সমগ্র জাতির। তাই যারা সভ্য জাতি গড়তে চায় তারা শিক্ষার অঙ্গণে সামান্যতম দুর্নীতির প্রশ্রয় দেয়না। শিক্ষার নামে ছাত্রদের মগজে তারা কদর্য ধ্যান-ধারণা ঢুকতে দেয়না। তাই জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি বা রাস্তাঘাট গড়া নয়, সেটি শিক্ষায় শতভাগ শুদ্ধি আনা। শিক্ষার গুণেই জাতি এগুয় এবং ধ্বংস হয় শিক্ষায় ব্যর্থতায়। অথচ বাংলাদেশে সীমাহীন ব্যর্থতাটি শিক্ষাঙ্গণে। দুর্নীতিতে ডুবে গেছে শুধু ছাত্ররা নয়, শিক্ষকগণও। থানার পুলিশের ন্যায় স্কুলের শিক্ষকগণ কম দুর্নীতিপরায়ন নয়। তাদের কারণেই পরীক্ষায় নকল সহনীয় হয়ে গেছে। নকল হয় শিক্ষকদের চোখের সামনে। স্বাভাবিক হয়ে গেছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াটি। এসব দুর্নীতিতে কারো কোন শাস্তি হয়না। এবং শিক্ষাঙ্গণ গড়ে উঠছে খুনি, সন্ত্রাসী ও ধর্ষকের লালনক্ষেত্র রূপে। কোন সভ্য দেশে কি এটি ভাবা যায়? শিক্ষকদের মাঝে রয়েছে দায়িত্ব পালনে প্রচণ্ড অবহেলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদেরকেও স্মরণ করিয়ে দিতে হয় তাদের দায়িত্বের কথা। তাদের আগ্রহ নেই গবেষণায়। নজরদারী রাখতে হয় তাদের কাজের উপর। ক’জন শিক্ষক সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে আসে এবং যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে পাঠদান করে? শিক্ষকের মাঝে যেখানে প্রচণ্ড ফাঁকিবাজি, ছাত্ররা সেখানে সততা নিয়ে বেড়ে উঠবে কীরূপে?

জাতির ভাগ্য ক্ষেত-খামার বা কলকারখানায় নির্ধারিত হয় না, সেটি হয় শিক্ষাঙ্গণে। ক্ষেতের ফসল বানের পানিতে ভেসে গেলেও দেশ ধ্বংস হয়না। আমদানী করে চালিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল নষ্ট হয়ে গেলে বিদেশ থেকে আমদানী করা যায় না। কারণ, খাদ্য শস্যের ন্যায় অন্যদেশের হাট-বাজার থেকে দেশপ্রেমিকদের কেনা যায় না। তাদেরকে নিজ দেশে গড়ে তুলতে হয়। সেটি না হলে জাতীয় জীবনে বিপর্যয় আসে। তাই যারা জাতিকে সামনে নিতে চায় তারা প্রথমে শিক্ষার সংস্কারে হাত দেয়। এবং এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। সর্ব-প্রথম নামায-রোযা বা হজ্জ-যাকাত ফরজ না করে তিনি ফরজ করেছেন শিক্ষাকে। এবং সেটি কুর’আন শিক্ষাকে। ইকরা তথা “পড়ো” তাই পবিত্র কুর’আনের প্রথম শব্দ। নামায-রোযা যেমন প্রতিটি নর ও নারীর উপর ফরজ, তেমনি ফরজ হলো কুর’আন শিক্ষা। কিন্তু বাংলাদেশে ক’জনের জীবনে পালিত হচ্ছে এ গুরুত্বপূর্ণ ফরজটি?

 

২. ভিত না গড়ে ছাদ গড়ার ভাবনা

আমার এক বন্ধুর বড় আফসোস হলো, তিনি ঢাকায় এক গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি করেছিলেন। এতে তিনি এক মহা বিপদে পড়েছিলেন। একপাল দুর্নীতিবাজ ও উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক নিয়ে ছিল কায়-কারবার। তাদের কন্ট্রোল করতে সর্বক্ষণ অন-কল থাকতে হতো। ফলে বছরের পর তিনি তার গ্রামের বাড়ি যেতে পারেননি। অবশেষে সামাল দিতে না পেরে কারখানাই বন্ধ করে দেন। একই কারণে আমার আরেক বন্ধু গার্মেন্ট কারখানা করে চালাতে না পেরে সে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তিনি বলতেন, শ্রমিকরা যখন ডিউটি ছেড়ে বাসায় ফিরতো তখন নারী-পুরুষ সবাইকে তল্লাশী রুমে ন্যাংটা করে চেক করতে হতো। নইলে তারা সেলাই মেশিনের দামী যন্ত্রাংশ অন্তর্বাসের নীচে লুকিয়ে নিয়ে চোরা বাজারে বিক্রি করতো। আমার এক সিনিয়র মুরব্বী বিদেশ থেকে অনেক অর্থ নিয়ে ঢাকায় এক বিশাল অত্যাধুনিক প্রেস বসিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তারা প্রিন্টিং প্রেসের দামী যন্ত্রাংশ প্রায়ই শ্রমিকরা চুড়ি করে নিত। পাহারা বসিয়েও রোধ করা মুশকিল হত। সে সব যন্ত্রপাতি একবার হারালে ঢাকার বাজারে তা পাওয়া যেতনা। বিদেশ থেকে অর্ডার করে আনতে হত। ফলে যন্ত্রাংশের অভাবে দিনের পর দিন প্রেস বন্ধ থাকতো। ব্যবসায় তিনি সুবিধা করতে পারেননি। এই হলো বাংলাদেশের ব্যবসায়ী জগতের ফাস্টহান্ড রিপোর্ট।

গতকাল পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত প্রখ্যাত দৈনিক ডন পত্রিকার পোষ্ট এডিটরিয়াল পড়ছিলাম। লেখক একজন পদার্থবিদ এবং ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট। ভদ্রলোকের লেখাতে দেশের উন্নয়ন-বিষয়ক গভীর ভাবনা থাকে। মুসলিম বিশ্বের যে দুটি দেশ সামনে এগুনো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত তার মধ্যে একটি হলো পাকিস্তান, অপরটি হলো তুরস্ক। এ দুটি দেশের পত্র-পত্রিকায় বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের যে আয়োজন থাকে –তা থেকে বাংলাদেশীদেরও অনেক কিছু শেখার আছে। দেশের ব্যর্থতা নিয়ে দৈনিক ডনের কলামিস্টের একই রূপ বেদনা যা আমরা নিজেরা অনুভব করি বাংলাদেশ নিয়ে। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানে শ্রমিকের মজুরি চীনের চেয়ে কম। কিন্তু উৎপাদন খরচ চীনে পাকিস্তানের চেয়ে কম। কারণ, পাকিস্তানী শ্রমিকগণ কাজে অদক্ষ ও অমনযোগী। তারা চাকুরী করে, কিন্তু কাজে আনন্দ পায়না ও মনও দেয়না। তাদের ধান্দা থাকে কাজে ফাঁকি দেয়ার। কাজ না করে আড্ডা দেয়াতেই তাদের বেশী আনন্দ। অথচ এরূপ ফাঁকিবাজী ও বিবেকশূণ্যতা চীনে নাই। তারা কাজে আনন্দ পায় এবং ফাঁকিবাজীকে অপরাধ মনে করে। চীনের উন্নতির মূলে এই উন্নত মানের শ্রমিক।

শুধু ভূমি ও মোটা অর্থের পুঁজি হলেই শিল্প গড়ে উঠে না। অর্থের সাথে জরুরি হলো উন্নত মানের মানব-পুঁজি (হিউম্যান ক্যাপিটাল)। অর্থনীতির ভাষায় এটিই হলো সামাজিক পুঁজি। বাংলাদেশে সে পুঁজির বড়ই দৈন্য দশা। মানব এখানে বেড়ে উঠে সমস্যা রূপে, পুঁজি রূপে নয়। মানবিক পুঁজি গড়ার স্থানটি শিক্ষালয়। জাপান, চীন, ও কোরিয়ার ন্যায় যে দেশগুলি শিল্পে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছে তাদের সে সাফল্যের মূলে হলো তাদের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। ঘোড়ার আগের গাড়ি জোড়া যায় না। তাই কারখানা গড়ার আগে তারা উন্নত মানের স্কুল কলেজ গড়েছে। এসব দেশের শিক্ষাঙ্গণে কোন রূপ ফাঁকিবাজি বরদাশত করা হয় না। প্রাইমারি পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছাত্রদের নিরবিচ্ছন্ন ব্যস্ত থাকতে হয় জ্ঞান-আর্জনে। শিক্ষকদের ব্যস্ত থাকতে হয় জ্ঞানদানে। ছাত্রদের রাজনীতি ও সন্ত্রাস করার সুযোগ নাই। পরীক্ষায় সামান্যতম দুর্নীতি নেই। ভর্তিপরীক্ষায় কোনরূপ দলীয় সুপারিশ, কোটাবাজী ও দখলদারী চলে না। অথচ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সন্ত্রাসী ও খুনি তৈরী হয়। আবরার ফাহাদদের মত ছাত্রদের খুন করতে তাই বাইরে থেকে খুনি আনতে হয়না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই সে কাজটি দলবেধে সমাধা করে। জাপান, চীন, কোরিয়া বা ভিয়েতনামের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কান্ড কি কোন কালে ঘটেছে?

মজার ব্যাপার, দৈনিক ডনের উক্ত কলামিস্ট পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জাঁদরেল প্রফেসরদের প্রতি একটি দারুন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, এসব প্রফেসরদের কেউই চীনের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া দূরে থাক, ভর্তি পরীক্ষাতেও পাশ করতে পারবে না। বিষয়টি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের জন্যও যে খাটে –তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? পাকিস্তানের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের তবুও বিশ্বের মাঝে পরিচিতি আছে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির তো তাও নাই। বহু ব্যর্থতার পরও পাকিস্তান যে এগিয়ে আছে সে প্রমাণ তো অনকে। দেশটি একটি পারমানবিক শক্তি। তারা যুদ্ধ বিমান, বালিস্টিক মিজাইল ও ট্যাংক বানায়। যারা এগুলো বানানোর সাথে জড়িত তারা পাকিস্তানের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই গড়ে উঠেছে। 

বাংলাদেশের সকল দুরবস্থা ও সকল দুর্নীতির জন্য দায়ী হলো শিক্ষাঙ্গণের দুর্নীতি। সভ্য দেশে শিক্ষাঙ্গণ থেকে সকল প্রকার অসভ্যতা ও দুর্নীতির নির্মূলে লড়াকু সৈনিক তৈরী হয়। অথচ বাংলাদেশ হচ্ছে উল্টোটি। দুর্নীতি, অসভ্যতা ও সন্ত্রাস জন্ম নিচ্ছে শিক্ষাঙ্গণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পরিণত হচ্ছে দুর্বৃত্ত ভোটডাকাত সরকারের লাঠিয়ালে। আরো সমস্যা হলো, বাংলাদেশের শিক্ষাখাতের এ ব্যর্থতা নিয়ে ভাবনাই বা ক’জনের। কোন রোগী যদি বুঝতেই ব্যর্থ হয় যে তার দেহে মারাত্মক ব্যাধী রয়েছে –তবে কোন চিকিৎসক কি সে রোগের চিকিৎসা করতে পারে? অনুরূপ অবস্থা বাংলাদেশেরও। বাংলাদেশের সরকার ভিত না গড়ে ছাদ দেয়া নিয়ে ভাবে।  

 

৩. ব্যর্থতা মুসলিম হওয়ায়

মুসলিম একজন বিপ্লবী মানুষের নাম। মুসলিম তো সেই যার চেতনায় আসে আমূল বিপ্লব। চেতনায় সে বিপ্লব না এলে তাকে কি মুসলিম বলা যায়? সে বিপ্লবের ফলেই অন্যরা জগতকে যেভাবে দেখে মুসলিম সে ভাবে দেখে না। সে বিপ্লবের মূলে হলো কুরআনী জ্ঞান। এ জ্ঞান তার দেখবার ও ভাবনার ক্ষমতাই পাল্টে দেয়। মুসলিমকে মুসলিম রূপে গড়ে তোলার জন্য কুর’আনী জ্ঞানের গুরুত্ব এতোই অধিক যে, নামায-রোযার আগে কুর’আন শিক্ষা ফরজ করা হয়েছিল। প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ হলো কুর’আন বুঝার সামর্থ্য অর্জন করা। নামায-রোযার পালনের দায়িত্ব প্রতিটি ব্যক্তির একান্তই নিজের। তেমনি প্রত্যেকের নিজ নিজ দায়িত্ব হলো কুর’আনের জ্ঞানার্জন। যতদিন সে সামর্থ্য অর্জতি না হয়, ততদিন দায়িত্ব হলো যার কাছে সে জ্ঞান আছে তার থেকে শিক্ষা নেয়া।

জ্ঞান থেকেই ব্যক্তির চেতনা, চরিত্র ও কর্ম স্থির হয়। অজ্ঞ ও জ্ঞানী তাই এক নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মুসলিমকে মুসলিম করা। লক্ষ্য, পরকালের পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য দেয়া। আর যারা পরকালের পরীক্ষায় পাশের সামর্থ্য অর্জন করে তারাই উত্তম মানুষ হয়। কিন্তু মুসলিমদের আজকের বিপর্যয়ের মূল কারণ, তাদের কাছে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, উকিল, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানী অন্য বহু কিছু হওয়াই গুরুত্ব পেয়েছে, কিন্তু গুরুত্ব পায়নি মুসলিম হওয়া। ফলে ব্যর্থ হচ্ছে ভাল মানুষ হতে। বাংলাদেশের ন্যায় দেশগুলিতে শিক্ষার মূল ব্যর্থতা এখানেই।

৪. দায়িত্বহীনতার পাপ

মুসলিম মাত্রই মহান  আল্লাহতায়ালার খলিফা তথা ভাইসরয়। পৃথিবী পৃষ্ঠে এটি হলো সবচেয়ে মর্যাদাকর ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়ভার। এ কাজের পুরস্কারটিও বিশাল। সেটি অনন্তকালের জন্য নেয়ামত ভরা জান্নাত –যার এর বর্গহাত ভূমি পৃথিবীর সকল সম্পদ দিয়েও কেনা যায় না। রোজ হাশরের বিচার দিনে কে কোন পেশায় বা চাকুরীতে কতটা সফল হলো -সে প্রশ্ন উঠবে না। বরং প্রশ্ন উঠবে, মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে কে কতটা দায়িত্ব পালন করলো -সে বিষয়টি। ফলে মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হলো, খলিফার দায়িত্বপালন। খলিফার কাজ শুধু নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত নয়, বরং রাষ্ট্র জুড়ে সুরক্ষা দিতে হয় তাঁর নিয়োগদাতা মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমতাকে। রুখতে হয় তাঁর শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে। যেমন রাজার আইন রক্ষার দায়িত্ব নিতে হয় রাজকর্মচারীদের। তাই আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে প্রতিটি মুসলিমকে দেখতে হয় রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত, যুদ্ধ-বিগ্রহসহ সর্বক্ষেত্রে ইসলামের স্বার্থ। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে উল্টোটি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে পরাজয়টি ইসলামের এবং বিজয় শয়তানের। বিলুপ্ত হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আইন। এর কারণ, বিপুল সংখ্যক মানুষ খাটছে শয়তানের খলিফা রূপে এবং তারাই পরাজয় এনেছে ইসলামের। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে খুন, ধর্ষণ ও চুরিডাকাতির কারণে নয়। বরং সেটি রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ও আইন-আদালতে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা হওয়ার বদলে শয়তানের খলিফা হওয়ার কারণে।

ঈমানদারের জীবন অতিশয় দায়িত্বশীল জীবন। তাঁকে শুধু নিজের ব্যবসা-বানিজ্য, চাকুরি-বাকুরি ও পরিবার-পরিজনের সুখ-স্বচ্ছন্দ নিয়ে ভাবলে চলে না। শুধু কুর’আন-হাদীস শিক্ষা, নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতে ব্যস্ত থাকলেও চলে না। তাকে ভাবতে হয়ে এবং ময়দানে নামতে হয় সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ববাসীর কল্যাণেও। সেরূপ কল্যাণ-কর্মকে  ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় হক্কুল ইবাদ তথা জনগণের হক। এবং নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত হলো হক্কুল আল্লাহ তথা মহান আল্লাহতায়ালার হক। আল্লাহতায়ালা ও বান্দা -উভয়ের হক পালনই ইবাদত। কারণ তাতে পালিত হয় মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম।  নবীজী (সা:) তাঁর সাহাবাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলেছেন। হেতু কী? সেটির কারণ এটিই, তারা শুধু নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত পালনের মাঝে নিজেদর দায়িত্ব সারেননি। মানবজাতির কল্যাণে তারা তাদের জান ও মালের বিশাল বিনিয়োগ করেছেন। অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। তাদের কুরবানীর কারণেই মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন বিজয়ী হয়েছে, মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং কুর’আনের বানী কোটি কোটি মানুষের ঘরের আঙিনায় পৌঁছতে পেরেছে। এরূপ কুর’বানী অন্য কোন নবীর উম্মতই দেয়নি। তাদের কুর’বানীর বিনিময়েই কোটি কোটি মানুষ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পেয়েছে। এতবড় কল্যাণ আর কোন জনগোষ্ঠি করেছে? বহু ট্রিলিয়ন ডলার দান করেও কি এতবড় কল্যাণ করা যেত? আজ প্রায় ১৫০ কোটি মুসলিমের যে জনসংখ্যা সেটি তো তাদের কুর’বানীর বরকতেই।

মানব-কল্যাণের কাজটি শুধু কুর’আন-হাদীস বুঝায় ও তার প্রচারে সীমিত নয়। হক্কুল ইবাদ তথা মানব-কল্যাণের শক্তিশালী হাতিয়ারগুলি হলো চিকিৎসা, কৃষি, ইঞ্জিনীয়ারিং, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি, ভূগোল, দর্শনসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখার জ্ঞান। হক্কুল ইবাদের সে সামর্থ্য বাড়াতে মহান নবীজী (সা:) এমন কি চীনে জ্ঞানার্জনে যেতে বলেছেন। অতীতের গৌরব কালে মুসলিমগ তাই শুধু কুর’আন-হাদীস-ফিকাহ’র উপরই পান্ডিত্য অর্জন করেননি। তারা চিকিৎসা, গণিত, বিজগণিত, রসায়ন,পদার্থ বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় তারা বিস্ময়কর অবদান রেখেছেন। অথচ পবিত্র কুর’আনের পূর্বে আরবী ভাষায় কোন বই ছিল না। অথচ আজ মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যসূচী অতি সীমিত; কুর’আন-হাদীসের বাইরে অন্য কিছু শেখানো হয় না।

সবচেয়ে বড় হক্কুল ইবাদত তথা জনকল্যাণ-মূলক কাজটি হয় জনগণকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচানোর মধ্য দিয়ে। এবং সে বিশাল কাজটির জন্য চাই দেশের শিক্ষানীতি, রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ। নইলে সেগুলি শয়তানের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। হক্কুল ইবাদত সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী হাতিয়ারটি হলো রাজনীতি। কারণ দেশ কোন দিকে যাবে, শিক্ষানীতি কি হবে, দেশের কল্যাণে কোন কোন খাত গুরুত্ব পাবে, কোন খাতে কত বিনিয়োগ হবে, দেশের প্রতিরক্ষা কীরূপে সুনিশ্চিত করা যাবে  -সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নির্ধারিত রাজনীতির অঙ্গণে। এজন্যই নবীজী (সা:)কে রাষ্ট্র প্রধানের আসনে বসেছেন। সে পদে তিনি ১০ বছর আসীন ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর সে আসনে বসেছেন খোলাফায়ে রাশেদার মহান খলিফাগণ। কিন্তু নবীজী(সা;) এবং খোলাফায়ে রাশেদার সে সূন্নত বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলির মোল্লামৌলভীগণ মানতে রাজী নয়। তারা সাংবাদিক সন্মেলন করেন দাবী করেন তারা রাজনীতিতে নাই। হক্কুল ইবাদ বলতে তারা বুঝেন মিলাদ পাঠ, কুর’আন খতম, মুরদা দাফন, মুয়াজ্জিনী ও ইমামতি। অথচ তারাই নবীজী (সা:)’র উত্তরাধিকারী হওয়ার দাবী করেন। যাদের উপর ছিল পথ দেখানোর দায়িত্ব, তারাই আজ পথভ্রষ্ট। আজকের মুসলিমদের বিপর্যয়ের মূল কারণ তো এখানেই। ১২/০৭/২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *