বাঙালি মুসলিমের অপরাধনামা ও ভাবনাশূন্যতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

শূন্যতা ইতিহাস জ্ঞানের

বাঙালি মুসলিমের বড় শূন্যতা ইতিহাস জ্ঞানে। সে শূন্যতার কারণেই ভারতের ন্যায় একটি পরীক্ষিত শত্রু দেশকে অনেক বাংলাদেশী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবী অকৃত্রিম বন্ধু বলে। সেটি যেমন আওয়ামী ঘরানার লোকরা বলে; তেমনি বিএনপি ঘরানোর লোকেরাও বলে। এমন কি অনেক ইসলামপন্থী দলের নেতারাও সে কথা বলে। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি শত্রু-মিত্র চিনতে এভাবে ভূল করে -তবে দেশের স্বাধীনতার জন্য সেটি এক মহা সংকটা। বাঙালি মুসলিমের এ সংকটটি পাকিস্তান আমল থেকেই। এমন সংকট পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে কোন কালেই ছিল না। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে তেমন ভারতীয় চর সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছে -এবং সেটি বিপুল সংখ্যায়। আওয়ামী লীগের মত একটি বিশাল দল ভারতের পকেটে চলে গেছে। দলটির প্রধান খোদ শেখ মুজিব পরিণত হয়েছে ভারতের চরে। সেটি ধরা পড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্রে তার সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে। হাসিনার পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছিল, ভারতের বিজয় আমাদের বিজয়। সে আরো বলেছিল, “দিল্লিতে গিয়ে বলেছি, হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে।” এ থেকে বুঝা যায়, তার মগজে বাসা বেধেছিল, বাংলাদেশে কে ক্ষমতায় যাবে সেটি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

এসব ভারতপন্থীগণ ভারতকে স্বাধীন বাংলাদেশের জনক মনে করে। তারা বলে, ভারত তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে দিয়েছে। সে সাথে আরো বলে, বাংলাদেশীদের চিরকালের জন্য ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। এখানে তাদের গভীর অজ্ঞতা ধরা পড়ে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে। অথচ ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের কাছে বাংলাদেশ হলো অখণ্ড ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি -যার অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান, তাদের কাছে গণ্য হয় ভারতের অঙ্গহানী রূপে। স্বাধীন বাংলাদেশ বাঁচলে বৈধতা দিতে হয় সে অঙ্গহানীকে; ভারতে কাছে তাই অসহ্য হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব। তাই বাংলাদেশ নামক ভারতের খণ্ডিত অংশকে ভারতে একীভূত করতে চায়। ভারতীয় রাজনীতির এটিই হলো মূল দর্শন। সিকিমকে স্বাধীন দেশ রূপে একটি বিশেষ সময় কাল পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল, কিন্তু সুযোগ বুঝে তারা সিকিমকে ভারতভূ্ক্ত করে নিয়েছে। কাশ্মীর, হায়দারাবাদ ও মানভাদাড়কে সে সময়টুকুও দেয়নি। ভারতের সে অভিন্ন নীতি বাংলাদেশ নিয়েও। বাংলাদেশকে তারা বড় জোর একটি গোলাম রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছিল -যেমনটি ছিল মুজিব ও হাসিনার আমলে ছিল। তারা চায়, বাংলাদেশ বাঁচুক ভারতের প্রভাব বলয়ের অধীনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সৈনিক হতে হলে এতটুকু ইতিহাস জ্ঞান থাকা অপরিহার্য।

ভারতপন্থীরা বুঝতে ব্যর্থ হয়, ১৯৭১’য়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য ভারত যুদ্ধ করেনি। বরং যুদ্ধ করেছে তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ১). চিরপ্রতিদ্বন্দী পাকিস্তানকে খণ্ডিত করা ও দুর্বল করা; ২). বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশ নামের ভারত নিয়ন্ত্রিত একটি জেলে বন্দী করা; ৩). দক্ষিণ এশিয়ার বুকে অপ্রতিদ্বন্দী শক্তি রূপে ভারতের উত্থান। ভারত তার প্রথম লক্ষ্যে আংশিক ভাবে সফল হয়েছে। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তানকে খণ্ডিত করতে পারলেও দুর্বল করতে পারিনি। ভেঙ্গে যাওয়ার পর দেশটি দুর্বল না হয়ে বরং পারমানবিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০২৫’য়ের মে’মাসের ঝটিকা যুদ্ধে পাকিস্তান বরং ভারতকে ভাল আঘাত হেনেছে। তবে ভারতের সবচেয়ে বড় বিজয়টি এসেছে বাংলাদেশের অঙ্গণে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পরিণত হয়েছিল ভারতের নিয়ন্ত্রিত জেলখানায়। এবং মুজিব, এরশাদ ও হাসিনা ছিল ভারতের পক্ষ থেকে নিযুক্ত জেলাখানার ভারাপ্রাপ্ত কারারক্ষক। দিল্লি যা বলেছে সেভাবেই চলেছে এসব কারারক্ষকগণ। শেখ হাসিনার শাসনের অবসান হয়েছে, এখন ভারত আরেক কারারক্ষীকে বসানোর চেষ্টায় আছে।

 

গাদ্দারী একটি স্বপ্নের সাথে

ইসলামের সাথে বিপুল সংখ্যক বাঙালি মুসলিমদের গাদ্দারীও কি কম? মদ-ব্যভিচার যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো কোন মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করা। ইসলাম ভূগোল গড়তে ও বড় করতে শেখায় এবং সে গড়ার কাজকে পবিত্র জিহাদের মর্যাদা দেয়। ভূগোল বাড়ানোর সে চেতনা নিয়ে মদিনার ক্ষুদ্র এক গ্রামীন শহর থেকে শুরু করে মুসলিমগণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছে। পরাজিত করেছে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের ন্যায় সে সময়ের দুইটি বিশ্বশক্তিকে। বৃহৎ ভূগোল গড়ার সে চেতনা নিয়েই ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের মুসলিমগণ সে সময়ের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ পাকিস্তান গড়ে। তাই পাকিস্তান শুধু একটি দেশের নাম ছিল না, ছিল একটি আদর্শ, একটি স্বপ্ন এবং ইসলামী সভ্যতা নির্মাণের প্রকল্প নিয়ে বেড়ে উঠার নাম। সে প্যান-ইসলামিক প্রকল্প নিয়েই ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতার উদ্ধে উঠে বাঙালি, বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান পাকিস্তানের জন্ম। এটি ছিল এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।

দেশের ভূগোল ভাঙ্গার কাজকে ইসলাম সব সময় হারাম গণ্য করে। অপর দিকে মুসলিম দেশ ভাঙ্গার কাজে সহযোগিতা দিতে কাফেরগণ সব সময়ই হাজির। সে লক্ষ্যে কাফের শক্তিবর্গ অস্ত্র দেয়, প্রশিক্ষণ দেয় এবং প্রয়োজনে যুদ্ধও করে দেয় -যেমন ১৯৭১’য়ে ভারত করে দিয়েছে। তাদের কারণেই মুসলিম বিশ্বজুড়ে আজ শুধু বিভক্তি আর বিভক্তি। আরবগণ বিভক্ত হয়েছে ২২ টুকরোয়। যেখানেই মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রকল্প, সেখানেই কাফের ও মুনাফিকদের প্রকল্প হলো সেটি বানচালের। তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্র ছিল দেশটির জন্মের পূর্ব থেকেই। সে কাজে নেতৃত্বে ছিল ভারতের হিন্দুত্ববাদীগণ। হিন্দুত্ববাদী সে ভারতীয় প্রকল্পের সাথে যোগ দেয় মুজিবের নৃতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদীগণ। যোগ দেয় ইসরাইল ও সোভিয়েত রাশিয়া। একাত্তরে বিজয়ী হয় হিন্দুত্ববাদী ভারত ও তাদের বাঙালি মিত্রগণ।

এমন কি ক্রিকেট খেলায় ভারতের কাছে পাকিস্তান হেরে গেলে একজন সাধারণ মুসলিমও মনে দুঃখ পায়। মুসলিমের কাছে যে কোন মুসলিমের যে কোন ময়দানে পরাজয়ই বেদনাদায়ক। এটিই তো মুসলিম ভাতৃত্ববোধ। এটুকু না থাকলে বুঝতে হবে তার মধ্যে বিন্দু মাত্র ঈমান নাই। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ লিখেছিলেন, “বলকানের যুদ্ধে কোন তুর্কি সৈনিকের পায়ে গুলী লাগলে সে গুলীর ব্যাথা যদি তুমি হৃদয়ে অনুভব না করো তবে খোদার কসম তুমি ঈমানদার নও।” এজন্যই বলা হয়, মুসলিম উম্মাহ এক দেহের ন্যায়। দেহের এক অঙ্গ ব্যাথা পেলে, অন্য অঙ্গ তা অনুভব করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সবচেয়ে বড় নাশকতাটি হলো, তারা বিলুপ্ত করতর পেরেছে বাঙালি মুসলিমের চেতনা থেকে মুসলিম ভাতৃত্ববোধ। ধ্বংস করেছে ঈমান ও চরিত্র। এরূপ নাশকতায় শেখ মুজিব ও তার অনুসারীদের সফলতাটি বিশাল। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছে তাই বাংলাভাষী একজন মুসলিম রাজাকারের চেয়ে ভারতের হিন্দু বাঙালি বেশী আপন। তাই সে রাজাকারকে গালী দেয়, কিন্তু ভারতের যে সৈনিক বাংলাদেশের সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করে কাঁটা তারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে তাকে বাঙালির মুক্তিদাতা বন্ধু বলে সন্মান করে। এবং ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলে। অপর দিকে একাত্তরে ভারতের বিজয়ের পর ধর্ষণ, লুটলাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য দখলে বাঙালিগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভারত থেকে বাঁচতে আসা বিহারীদের উপর।

অপরাধটি শত্রুকে বিজয়ী করার

ঈমানদার তো প্রতিবেশী মুসলিমের ঘর ভাঙ্গলেও দুঃখ পায়। সে ব্যাথা না থাকাটি বেঈমানীর লক্ষণ। ফিলিস্তিন অধিকৃত হলো, সে অধিকৃত ভূমিতে ইসরাইল নির্মিত হলো -সেটি কি কোন ঈমানদার মেনে নেয়। অথচ কি বিস্ময়! ১০ লাখের বেশী আরব মুসলিম ব্রিটিশ সেনাদলে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করেছে উসমানিয়া খেলাফত থেকে ফিলিস্তিনকে ছিনিয়ে নিয়ে ইংরেজদের হাতে তুলে দিতে। অথচ সেটিই ইতিহাস।  ১৯৭১’য়ে সেরূপ কাণ্ড ঘটেছে তৎকালীন  পূর্ব পাকিস্তানেও। বহুলক্ষ বাঙালি মুসলিম ভারতের অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে ভারতকে বিজয়ী করেছে। প্রশ্ন হলো, ভারতের ন্যায় একটি কাফের দেশের হাতে একটি মুসলিম দেশ  হেরে গেল ও ভেঙ্গে গেল, এবং তাতে যদি কোন মুসলিম মনে কষ্ট না পায়, তবে তার মধ্যে যে শরিষার দানা পরিমান ঈমান নাই – তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? সে যদি নিজেকে ঈমানদার রূপে দাবী করে এবং নামাজ-রোজা পালন করে -তবে সে তো মুনাফিক। ঈমানের হিসাব-নিকাশ তো এখানে অতি সহজ।

অথচ পাকিস্তান সৃষ্টির মূলে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি ছিল বাঙালি মুসলিমদের -সেটি পাকিস্তানীরাও স্বীকার করে। কারণ মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল ঢাকায়। এবং সমগ্র ভারতে মুসলিম লীগের হাতে সরকার ছিল একমাত্র বাংলায়। অন্যান্য প্রদেশে ক্ষমতা পায় অনেক পরে। পশ্চিম পাকিস্তানী শিশুরাও ভাবতে পারিনি যে ভারতীয় হিন্দুদের সাথে নিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ পাকিস্তান ভাঙ্গবে। অথচ সেটিই বাঙালি মুসলিমের ইতিহাস। মুজিবের ন্যায় ক্ষমতালোভী বাকশালী ফ্যাসিস্টগণ ক্ষমতায় থাকলে ইতিহাস তো এরকমই হয়।  

হিন্দুদের বিজয় ও গৌরব বাড়াতে বাঙলী মুসলিমদের ভূমিকাটি বিস্ময়কর। হিন্দুগণ এরূপ বিজয় বিগত হাজার বছরেও পায়নি। ইন্দিরা গান্ধির মূল্যায়ন তাই সঠিক। একাত্তরের সে বিশাল বিজয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “হাজার সালকা বদলা লে লিয়া।” অর্থ: (মুসলিমদের থেকে) হাজার বছরের প্রতিশোধ নিলাম। ভারতীয় হিন্দুদের ঘরে ঘরে সেদিন আনন্দের যে বন্যা বয়েছিল, তাতে যোগ দিয়েছিল ভারতসেবী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলিমগণ। ভারতের সে বিজয় নিয়ে আজও বাংলাদেশের সেক্যুলার শিবিরে প্রতি বছর উৎসব হয়। অথচ একাত্তরে ভারতের সে বিজয়ে বাংলাদেশের জনগণ পেয়েছে ভারতীয় লুণ্ঠন, বাকশালী ফ্যাসিবাদ, ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ভিক্ষার তলাহীন ঝুলির খেতাব, বার বার গণহত্যা, আয়না ঘর ও ফাঁসির রাজনীতি। 

হিন্দুদের হাজার বছরের সাধ একাত্তরে পূরণ হয়েছে। তাদের একার পক্ষে এ বিজয় কখনোই সম্ভব হতো না। এ বিজয় হিন্দুদের ঘরে তুলে দিয়েছে বাঙালি মুসলিমগণ। অন্য কোন কারণে না হোক, অন্তত এ কদর্য ইতিহাস নিয়ে সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে বাঙালি মুসলিমগণ নিশ্চিত একটি স্থান পাবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পরাজয়ে শুধু পাকিস্তান, ভারত, কাশ্মিরের মুসিলমদের গৃহেই শুধু নয়, সারা বিশ্বের মুসলিমদের গৃহে দুঃখের মাতম উঠেছিল। সে খবর কি বাঙালি মুসলিমগণ কখনো নিয়েছে? অথচ সেটি জানা আদৌ কঠিন নয়। সে সব দেশের প্রবীণ মুসলিমদের জিজ্ঞাসা করলে আজও সেটি জানা যায়। কারণ পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াটি তাদের কাছে ছিল সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রটি ভেঙ্গে যাওয়া। পাকিস্তান তাদের কাছে ছিল একটি অভিভাবক রাষ্ট্র।

মুনাফিকদের সংখ্যা যেসর মুসলিম দেশে অধিক, সেসব দেশে ভারতের ন্যায় কাফের দেশের পক্ষে যুদ্ধ করার লোকের কমতি হয় না। তাই একাত্তরের ভারতের পক্ষে যুদ্ধ লড়তে লাখ লাখ বাঙালি খুঁজে পেতে দিল্লির শাসকচক্রের কোন অসুবিধাই হয়নি। কথা হলো, যারা কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলে যুদ্ধ করে -তাদের কি আদৌ ঈমানদার বলা যায়? পবিত্র কুর’আনের মহান আল্লাহ তায়ালা একাধিক আয়াতে একাজকে হারাম বলা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে,

لَّا يَتَّخِذِ ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلْكَـٰفِرِينَ أَوْلِيَآءَ مِن دُونِ ٱلْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ ٱللَّهِ فِى شَىْءٍ

অর্থ: “মুমিনগণ কখনো মুমিনদের ছাড়া কাফিরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করেনা। যারা সেরূপ করবে, আল্লাহ থেকে তাদের কিছু পাওয়ার নাই।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ২৮)।   

উপরিউক্ত হুশিয়ারটি অতি সাংঘাতিক। যারা কাফিরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করবে, তাদের হারাতে হবে আল্লাহ তায়ালাকে। আল্লাহ তায়ালাকে হারানোর অর্থ জান্নাত হারানো। আখেরাতে তাদের স্থান হবে জাহান্নামে। একই রূপ হুশিয়ারি শুনানো হয়েছে সুরা মুমতাহেনার প্রথম আয়াতে। কিন্তু ইসলাম থেকে দূরে বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও কম্যুনিস্টগণ মহান আল্লাহ তায়ালার এরূপ হুশিয়ারিতে কর্ণপাত করনি। তারা বরং ভারতীয় কাফিরদের শিবিরে গিয়ে উঠেছে। তাদের সেখানে প্রতিপালন পেয়েছে, অস্ত্র ও অর্থ নিয়েছে এবং তাদের ঘরে বিজয় তুলে দিতে যুদ্ধ করেছে। লক্ষণীয় হলো, একাত্তরে সে হারাম থেকে বেঁচেছে সকল ইসলামী পন্থী দল, সকল আলেম  এবং সকল পীর সাহেব। পাকিস্তান ভাঙ্গাকে তারা সমর্থন করেননি। ইসলামপন্থী মানেই যে রাজাকার –ভারতপন্থী বাঙালিদের এ কথা বলার যৌক্তিক ভিত্তি তো এ বাস্তবতা।

 

সবচেয়ে বড় নেক কর্ম ও সবচেয়ে বড় পাপকর্ম

বাঙালি মুসলিম জীবনের সবচেয়ে বড় নেক কর্মটি হলো ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি। বুঝতে হবে, একতা গড়ার প্রতিট কর্মই হলো নেক কর্ম। বিশ্বের সকল মহান সৃষ্টিকর্মই হলো একতার ফসল। আর সে নেক কর্মটি যখন হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নির্মাণ -তখন সেটিই হয় সবচেয়ে বড় নেককর্ম। সেটিই বাঙালি মুসলিমগণ করেছিল ১৯৪৭য়ে। সেদেশটি অখণ্ড থাকলে তা হতো চীন ও ভারতের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। সে সাথে একটি পারমানবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটে থাকতো বাঙালি মুসলিমরা। কারণ তারাই হতো দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক। তাছাড় পাকিস্তানের ২৩ বছরে ৪ জন প্রধানমন্ত্রী, দুই জন রাষ্ট্রপতি এবং তিনজন স্পীকার হয়েছেন বাঙালী মুসলিম।

শত্রুদের শক্তির মূল উৎস হলো তাদের একতা। বহু বর্ণ, বহু ধর্ম ও বহু ভাষার মানুষ নিয়ে গঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এবং ভারত হলো সে একতার নমুনা। অপর দিকে মুসলিম উম্মাহর শক্তিহীনতার মূল কারণ হলো তাদের বিভক্তি। আরবগণ এক ভাষার হয়েও ২২ রাষ্ট্রে বিভক্ত।  বিভক্ত হলো পাকিস্তান। মানব ইতিহাসের বড় বড় নাশকতাগুলি ঘটেছে বিভক্তির কারণে। মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রতিটি বিভক্তিই হারাম। আর সে হারাম কর্মটি যদি হয় পাকিস্তানের ন্যায় সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ ভাঙ্গা -তবেই সেটিই হলো সবচেয়ে বড় হারাম। বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসের এটিই হলো সবচেয়ে বড় পাপকর্ম। তারা সে বিশাল পাপটি করেছে ১৯৭১ সালে ভারতী কাফিরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ খেলাফত ভাঙ্গার পর মুসলিম উম্মাহর সমগ্র ইতিহাসে এটিই হলো দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় মাপের পাপকর্ম। বাঙালি মুসলিমের সে পাপ কর্মে নেতৃত্ব দিয়েছিল বাঙালি মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধী, সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্ত এবং পৌত্তলিক কাফিরদের সবচেয়ে বড় দালাল বাকশালী মুজিব। তার সাথে ছিল ইসলাম থেকে দূরে সরা মুসলিম নামধারী বিশাল এক পাল ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও কম্যুনিস্ট।

 

বাঙালি মুসলিমের ভাবনাশূন্যতা

পরিতাপের বিষয় হলো, বাঙালি মুসলিমগণ তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নেক কর্ম নিয়ে যেমন ভাবে না, তেমনি ভাবে না তাদের সবচেয়ে বড় পাপ কর্ম নিয়েও। কেন এমনটি হলো -তা নিয়েও তারা ভাবে না। এমন কি ভাবে না তারাও -যারা নিজেদের আলেম বা ইসলামপন্থী নেতাকর্মী রূপে জাহির করে। বরং পরিতাপের বিষয় হলো, ১৬ ডিসেম্বর এলে এমন কি ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ কোন কোন ইসলামপন্থী সংগঠন বাঙালি মুসলিমের সবচেয়ে বড় পাপ কর্মটি নিয়ে উৎসব করে! বিস্ময়ের বিষয় হলো, পাপও তাদের কাছে পুণ্যকর্ম হয়ে উঠেছে। অথচ যে কর্ম নিয়ে তারা প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বরে উৎসব করে, ১৯৭১’য়ের যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের শীর্ষ নেতারা সে কর্মকে হারাম বলেছে। বুঝা যায়, তারা ইতিহাস পড়ে না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ায় তাদের সামান্যতম আগ্রহ নাই। এতে বুঝা যায়, তারা কতটা গভীরে ডুবে আছে ভাবনাশূন্যতায়। অথচ পশু থেকে মানুষ শ্রেষ্ঠতর তো চিন্তা-ভাবনার কারণেই। নবীজী (সা:) চিন্তা-ভাবনাকে শ্রেষ্ঠ ইবাদত বলেছেন। হাদীস: আফজালুল ইবাদাহ তাফাক্কুহ। প্রশ্ন হলো, চিন্তাভাবনা বাদ দিলে সভ্য মানব ও সভ্য রাষ্ট্র কিরূপে নির্মিত হবে? বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বড় সংকট হলো এই ভাবনাশূণ্যতা। ১৬/০৬/২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *