বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের সংকট: অভাব বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে অস্ত্রের ও সৈনিকের

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

জিহাদ দুই রকমের। এক, অস্ত্রের তথা সামরিক; অপরটি বুদ্ধিবৃত্তিক। বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের অস্ত্র হলো দর্শন, জ্ঞান এবং জ্ঞানগর্ভ বই। যে কোন বিপ্লবের শুরু হয় এই বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের মধ্য দিয়েই। পরে আসে রাজনৈতিক ও সামরিক জিহাদ। নবীজী (সা:)’র জীবনের ১৩ বছর কেটেছে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে। এবং সেটি মক্কায়। সে যুদ্ধে তার অস্ত্রটি ছিল পবিত্র কুর’আন। উল্লেখ্য হলো, কুর’আনই হলো আরবী ভাষায় প্রথম কিতাব।  

মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ এ বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্রের মোকাবেলার সামর্থ্য কাফিরদের ছিল না। সে পরাজয় থেকে বেছে নেয় যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের পথ। নবীজী (সা:) যখনই কুর’আনের বাণী শোনানোর চেষ্টা করতেন, কাফিরগণ তাতে বাধা দিত। তাঁর মাথার উপর পাথর ছুড়তো, উচ্চ শব্দ করতো এবং মানুষকে তাঁর কাছে ভিড়তে বাধা দিত না। কারণ, তাদের ভয় ছিল, নবীজী (সা:)’র ওয়াজ শুনলে শ্রোতারা মুসলিম হয়ে যাবে। উল্লেখ্য যে, আজও ইউরোপ-আমেরিকার হাজার হাজার মানুষ যে ভাবে মুসলিম হচ্ছে তা মুসলিমদের দেখে নয়; বরং কুর’আন অধ্যয়ন করে।     

অতি পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের বুকে ইসলামপন্থীরা তেমন কোন বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ প্রবলভাবে গড়ে তুলতে  সফল হননি। কারণ, তাদের না আছে সে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের সৈনিক; না আছে অস্ত্র তথা দর্শনসমৃদ্ধ বই। বাঙালি ইসলামপন্থীরা লেখালেখির জগতে তেমন একটা নেই, যেমন  আছে বাঙালি বামপন্থী, সেকুরালিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীরা। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের শতকরা ৫ ভাগ বইয়ের লেখকও তারা নন। সেগুলিরও অধিকাংশ উর্দু ও আরবী ভাষা থেকে অনুদিত। পত্র-পত্রিকার জগতেও তারা তেমন নজরে পড়ার মত অবস্থানে নাই। প্রশ্ন হলো, বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে না নেমে তারা সে ময়দানে যুদ্ধ করবেন কিরূপে? আর বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে তারা রাজনৈতিক অঙ্গণেও দুর্বল ও পরাজিত।

যারা ইসলামের সৈনিক তাদের মূল লক্ষ্যটি হয়, জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো এবং জান্নাতে নেয়া। এরচেয়ে অধিক কল্যাণকর কোন কাজ এ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নাই। অর্থদান, বস্ত্রদান, গৃহদান অনেকে সূদখোর ও ঘুষখোর দুর্বৃত্তও করতে পারে। কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর কাজটি সে করতে পারে না। বুঝতে হবে দৈহিক পুষ্টিহীনতার  কারণে কেউ জাহান্নামে যাবে না; জাহান্নাম যাবে জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতার কারণে। অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জিহাদকে পবিত্র কুরআনের সূরা ফুরকানের ৫২ নাম্বার আয়াতে বড় জিহাদ (জিহাদান কবিরা) বলা হয়েছে। সে জিহাদের অস্ত্র হলো পবিত্র কুর’আন এবং কুর’আনী জ্ঞানসমৃদ্ধ  বই। তাই শ্রেষ্ঠ দান অর্থদান বা বস্ত্রদান নয়, সেটি হলো বই দান। 

নবী-রাসুলগণ অধিকাংশই দরিদ্র ছিলেন। তারা  অর্থ-সম্পদ দান করার সামর্থ্য রাখতেন না। তারা জ্ঞান দান করতেন; এবং সেটি পথে ঘাটে, বাড়ীতে বাড়ীতে ও হাটে বাজারে -তথা সর্বত্র। তাই জ্ঞানদান করা নবী-রাসূলদের সূন্নত। সেটি মহান আল্লাহ তায়ালার সূন্নত। তিনিও কুর’আনী জ্ঞানদানের মাধ্যমে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে অর্থাৎ ইসলামের পথে নিয়ে আসেন। কুর’আনী জ্ঞান মানুষকে জান্নাতে নেয়, অর্থ দানে সে কাজটি হয় না। বরং অপাত্রে অর্থ পড়লে তাকে বিপদগামী করতে পারে, পাপের পথে নিয়ে জাহান্নামেও নিতে পারে।

অপর দিকে বইয়ের কদর বুঝে শয়তানের শক্তিবর্গও। বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের কোণে কোণে যেভাবে লক্ষ লক্ষ ছাত্র, যুবক ও প্রবীন ব্যক্তি কম্যুনিজমে দীক্ষা নিল -সেটি কোন অর্থদানের ফলে নয়। কম্যুনিস্ট বানানোর জন্য তাদের মাঝে কেউ অর্থ বিতরণ করেনি, বরং বিতরণ করা হয়েছে মার্কস, এঙ্গেলস ও  লেলিনের লেখা লক্ষ লক্ষ বই। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন। বই পড়িয়ে বিশ্বের বহু কোটি মানুষকে তারা কমিউনিস্ট বানিয়েছে। 

বাংলাদেশে এখন চলছে এক অবিরাম বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জিততে হলে প্রচুর উন্নত মানের বই চাই। অথচ বাংলাদেশের বুদ্ধিভিত্তিক অঙ্গনের দখলদারি এখনো বামপন্থী, সেকুলারিসট ও হিন্দুত্ববাদীদের হাতে। দেশের অধিকাংশ পত্র পত্রিকা এবং সেসব পত্রিকার লেখকগণ অধিকাংশই ইসলামবিরোধী সেক্যুলারিস্ট ও বাম শিবিরের। ‌এসব ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীরা এখনো অনেক পিছনে। সোসাল মেডিয়াতেও তাদের তেমন দেখা যায় না। ওয়াজের ময়দানের বেশীর ভাগই ধর্মব্যবসায়ীদের দখলে। দেশের অধিকাংশ লেখক, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, পত্রিকার সম্পাদক হলো বামপন্থী ও সেকুলার।

বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের গুরুত্বটি বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা অতীতে যেমন অনুভব করেনি; এখনো করছে না। ফলে জিহাদের এ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গণে তাদের মনোযোগ ও বিনিয়োগ খুবই নগন্য। সেটি বোঝা যায়  ইসলামপন্থীদের বৃহত্তম সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের বিনিয়োগ দেখে। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, ইসলামী ছাত্র শিবির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গরু জবাই করে ছাত্রদের গোশতো খাওয়াচ্ছে। এভাবে অর্থব্যয় না করে তারা যদি গরীব ছাত্রদের মাঝে জ্ঞানসমৃদ্ধ ইসলামী বই বিতরণ করতো তবে তাদের মনের পুষ্টি বৃদ্ধি পেত। দূর হতো তাদের মনের অপুষ্টি। বুঝতে হবে, দেহের অপুষ্টির চেয়ে মনের অপুষ্টি অধিকতর ক্ষতিকর। মনের অপুষ্টির কারণেই মানব বেঈমান, সন্ত্রাসী,  ড্রাগসেবী ও ইসলামবিরোধী হয়। অনেকে পরিণত হয় ভ্রষ্ট রাজনীতির ক্যাডারে । 

তাই বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিপ্লবের পূর্বে চাই বইয়ের বিপ্লব অর্থাৎ জ্ঞানের বিপ্লব। নবীজী (সা:)‌’র হাতে সে জ্ঞানের বিপ্লবই সর্বপ্রথম এসেছিল, রাজনৈতিক বিপ্লব এসেছিল পরে। অথচ সেরূপ একটি বিপ্লব বাংলার ইতিহাসে বিগত হাজার বছরেও আসেনি। ঈমান ও আমলে বাঙালি মুসলিমদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ এই জ্ঞানের রাজ্য তথা বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে পশ্চাদপদতা। পশ্চাদপদতা কাটিয়ে উঠতে হলে ইসলামপন্থীদের কাছে তাই গুরুত্ব পাওয়া উচিত অর্থদানের চেয়ে বইদান বা জ্ঞানদান। 

অবস্থা দেখে মনে হয় , বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির গুরুত্বই বুঝছে না। সেটি বোঝা যায় তাদের খরচের প্রায়োরিটির দিকে তাকালে। এটি আরো ভাল বোঝা যাবে আগামী নির্বাচনে। তখন তারা শত শত কোটি টাকা খরচ করবে নির্বাচনী প্রচারণায়।  অথচ আজ যদি তারা সে অর্থের কিছু অংশ বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের অস্ত্রের পিছনে তথা বই লেখা, বই প্রকাশ ও বইয়ের বিতরণে ব্যয় করতো -তাহলে বাংলাদেশে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব আসতো। তখন রাজনীতির ময়দানে তারা অনেক সৈনিক পেত। 

তারা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে যে, গরুর গোশতো আর বিরানি কখনো বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে বিপ্লব আনে না। তা দিয়ে কাউকে ইসলামের সৈনিক দূরে থাক, সমর্থকও বানানো যায় না। মনের উপর আদর্শিক বিজয়ই অর্জন করতে হলে কাজ করতে হয় চেতনার ভূবনে। এজন্য চাই দর্শন,  চাই বহু দর্শনসমৃদ্ধ বই। চাই বহু জ্ঞানবান লেখক। এ কাজে পিছিয়ে থেকে রাজনৈতিক অঙ্গণে বিজয় জুটে না।  সেটি ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মত। ১১‌/০৬/২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *