বাংলাদেশে অপরাধীদের শাসন ও বর্ধিষ্ণু অসভ্যতা

অধিকৃতি অপরাধীদের

গবেষক ও কলামিস্ট জনাব বদরুদ্দীন উমর এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, দেশে উম্মাদের শাসন চলছে। তাঁর মূল্যায়নটি সঠিক নয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ। উম্মাদের শাসন বললে সে ভয়াবহতার সঠিক প্রকাশ ঘটে না। উম্মাদদের দেশ শাসনের সামর্থ্য থাকে না। জেনে বুঝে অপরাধও তারা করে না। সেটি স্বেচ্ছায় এবং সজ্ঞানে করে অপরাধীরা। এটি তাই উম্মাদনা নয়, বরং নিরেট অসভ্যতা। এ অসভ্যতা রাস্তাঘাট, প্রাসাদ ও জাঁকজমক পোষাক-পরিচ্ছদ দিয়ে ঢাকা যায়। মিশরের দুর্বৃত্ত ফিরাউনগণ বহু বিস্ময়কর পিরামিড গড়েও সে অসভ্যতা ঢাকতে পারিনি। উম্মাদেরা যা করে, সেটি করে তাদের মানসিক বিকলঙ্গতার কারণে। ফলে তারা যা করে সেটি যেমন সজ্ঞানে করে না, তেমনি মটিভ নিয়েও করে না। সে সামর্থ্যও তাদের থাকে না। ফলে তারা খুন করলে বিচার হয় না। সে খুন নিয়ে গবেষণাও হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে যারা শাসন ক্ষমতায়, তারা আদৌ উম্মাদ নয়,মটিভহীনও নয়। তাদের প্রতিটি কর্মের পিছনে রয়েছে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাস।রয়েছে সুনির্দ্দিষ্ট মটিভ,রয়েছে দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। তাদের মটিভ আদৌ কোন গোপন বিষষ নয়। সে মটিভটি তখনও সুস্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পেয়েছিল যখন তারা সকল দলের সম্মতিতে গৃহীত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধিকে বিলুপ্ত করেছিল। মটিভটি তখনও গোপন থাকেনি যখন ২০১৪ সালে ভোটার বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। ভোটডাকাতি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার সে মটিভটি আবার প্রকাশ পায় ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের তথাকথিত নির্বাচনে। দেশের প্রশাসন ও সরকার যখন অপরাধীদের থাকে অধিকৃত হয় তখন অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্তরাও আপরাধে উৎসাহ পায়। ফলে দেশে দূর্নীতির সয়লাব আসে।  এবং তারই নজির বাংলাদেশ। ফলে দেশে আজ শুধু অপরাধই বাড়ছে না, বাড়ছে অপরাধীদের সীমাহীন আধিপত্য ও দৌরাত্ম। বস্তুতঃ দেশ আজ তাদেরই দখলে। দেশের আইন-আদালত, পুলিশ, প্রশাসন,সেনাবাহিনী ও মিডিয়া নেমেছে তাদের প্রতি সহায়ক ভূমিকায়। যেমনটি ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে তাদের ভূমিকা। নিরীহ জনগণ এখানে যেমন শক্তিহীন, তেমনি প্রতিরক্ষাহীন।

সভ্যতার যেমন সুস্পষ্ট মানদণ্ড আছে, তেমনি আছে অসভ্যতারও। সভ্যতার মানদণ্ড এ নয় যে, দেশ মানব-রপ্তানি, বস্ত্র- রপ্তানি, চিংড়ি-রপ্তানিতে ইতিহাস গড়বে এবং দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হবে। সভ্যতার মানদণ্ড হলো আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু শত শত মানুষকে যখন বিনাবিচার হতা করা, গুম করা হয়, কেড়ে নেয়া হয় কথা বলার স্বাধীনতা এবং বিচারের নামে বিরোধীদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয় –সেটি কি কোন সভ্যতা? এটিকে সভ্যতা বললে অসভ্যতা কোনটি? দেশে মশামাছি যখন বাড়ে তখন রোগভোগও বাড়ে। কারণ, মশামাছি কখনই একাকী আসেনা, সাথে নানারূপ রোগভোগও আনে। তেমনি অপরাধীরা যখনক্ষমতা পায় তখন বাড়ে অপরাধ। দৃর্গন্ধের ন্যায় তাদের দুষ্কর্মও পরিবেশকে বিষিয়ে তোলে। দৃর্গন্ধময় আবর্জনার উপস্থিতি অন্ধব্যক্তিও টের পায়। তেমনি দেশ অপরাধ কর্মে ভরে গেলে সেটি বুঝতে কি বাঁকি থাকে দেশ কাদের দখলে? ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জোটের ক্ষমতায় আসার পর তিন বছর ধরে দেশে অপরাধকর্মের সুনামী শুরু হয়েছিল। তখন দৈনিক “আমার দেশ” পত্রিকা ২৬শে ডিসেম্বর (২০১১সাল) সংখ্যায় সরকারের তিন বছরের অপরাধ কর্মের একটি রিপোর্ট ছেপেছিল।  লিখেছিল, সে তিন বছরে খুন হয়েছিল ১২ হাজার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ৩৫৯টি এবং গুম হয়েছিল ১০০ জন। সাংবাদিক নিহত হয়েছিল ৪ জন এবং গ্রেফতার হয়েছিল ৩ জন। বিভিন্ন স্থান থেকে সাদা পোশাকধারীদের হাতে আটক প্রায় ১শ’ জনের খোঁজ মেলেনি,তারা চিরতরে হারিয়ে গেছে এদেশের বুক থেকে। পত্রিকাটি আরো রিপোর্ট করেছিল, রাজধানী ঢাকাতেই চলতি বছর গুম হয়েছিলের ৩০ জন। ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছির নদী, হাওর ও জঙ্গল থেকে। গুম হয়ে যাওয়া বিএনপি নেতা ও ঢাকার ৫৬ নং ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমেরও কোনো হদিস মেলেনি। ভয়ানক দুশ্চিন্তার আরো কারণ হলো, সরকার মুক্তি দিয়েছে ২২ জন ফাঁসির আসামীকে। কারণ, সে অপরাধীগণ ছিল সরকারি দলের। ফলে সরকারের অবস্থানটি সুস্পষ্ট। তাদের অবস্থানটি অপরাধীদের পক্ষে। অপরাধীগণও আইন-আদালত থেকে নিজেদের বাঁচাতে দলে দলে সরকারি দলের সেপাহীতে পরিণত হচ্ছে।

 

বন্দুকের নল জনগণের বিরুদ্ধে

বিপদের আরো কারণ, জনগণ শুধু খুনি, সন্ত্রাসী ও পেশাদার দুর্বৃত্তদের হামলার শিকারই নয়,অপরাধ দমনের নামে যেসব সরকারি বাহিনীকে ময়দানে নামানো হয়েছে তাদের বন্দুকের নলও এখন জনগণের দিকে। আপনজন–হারা পরিবারগুলোর অভিযোগে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটিলিয়ন তথা র‌্যাবের বিরুদ্ধে। র‌্যাব হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে ক্রসফায়ারের নামে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে ক্রসফায়ারের কঠোর বিরোধিতা করছিল। কিন্তু এখন সেটি ভূলে গেছে। র‌্যাবের মধ্যে অপরাধীদের সংখ্যা দুয়েক জন নয়, শত শত। দৈনিক “আমার দেশ’য়ে প্রকাশ, র‌্যাবের দেয়া তাদের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১০ সালের মাত্র এক বছরেই র‌্যাবের ৭৫৬ জন সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এটি এক বিশাল সংখ্যা। এদের মধ্যে ৩১৪ সদস্যকে গুরুদণ্ড, ৩১০ জন লঘুদণ্ড এবং ১৩২ জনকে স্ব-স্ব হিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ যে শরিষা ভূত ছাড়াবে তার মধ্যেই এখন ভূতের বাসা।

খুন শুধু রাতের আঁধারে হচ্ছে না, মানুষ খুন হচ্ছে দিনেদুপুরে এবং প্রকাশ্য রাজপথে।সরকারি বাহিনীর হাতে কেউ খুন হলে কি সে খুনের বিচার হয়? র‌্যাব বা পুলিশের বিরুদ্ধে কেস করতে থানায় যাবে, সে সাহস ক’জনের? যেন জঙ্গলের অরাজকতা। জঙ্গলে হিংস্র পশুর হাতে কেউ নিহত হলে সে পশুর বিরুদ্ধে কোন পুলিশই তদন্তে নামে না। আদালতও সমন জারি করে না।ফলে তা নিয়ে কোন বিচারও বসে না। বাংলাদেশে সে শিকারী জন্তুটির স্থানটি নিয়েছে পুলিশ,র‌্যাব ও সরকারি দলের গুণ্ডারা। র‌্যাব ও পুলিশ পরিণত হয়েছে দেশের সবচেয়ে সংগঠিত সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠানে। এদের হাতে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডকে বলা হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। সভ্য দেশে হত্যার প্রতিটি ঘটনাই গুরুতর অপরাধ। তাই প্রতিটি হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হয়, কঠোর শাস্তিও হয়। বিচারের আগে খুনিদের উপর থেকে মামলা তুলে নেয়া মহাপরাধ। হত্যা হত্যাই – কোন হত্যাকে বিচারবহির্ভূত করে তাকে আলাদা মর্যাদা দেয়ার বিধান কোন সভ্য দেশে নেই। বাংলাদেশের সরকারি খুনিবাহিনীর এ এক নব্য আবিস্কার। ভাবটা এমন,এরা জঘন্য অপরাধী,বিচার হলে এদের প্রাণদণ্ড হতোই। তাই কে নেয় তাদের গ্রেফতার, এবং গ্রেফতার শেষে বিচারে অপরাধি প্রমাণের ঝামেলা? তাই সরকারি বাহিনী কাজ হয়েছে,বিচারের আগে তাদের হত্যা করা! খুনের মত একটি গুরুতর অপরাধকে এভাবে তারা লঘুতর করে নিয়েছে। এমন খুনের কাজ প্রথমে শুরু করেছিলেন স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান, এবং সেটি সিরাজ সিকদারের হত্যার মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ মুজিবের সে ধারাকে সযত্নে শুধু ধরেই রাখেনি, তীব্রতরও করেছে।

অথচ সভ্য সমাজে গুরুতর অপরাধীরও বিনা বিচারে হত্যা করার অধিকার কারো থাকে না, এমন কি দেশের রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধানেরও থাকে না। এটি এক নিরেট সন্ত্রাস। নিহত ব্যক্তিটি তখন লাশ হয়ে বিদায় নেয়। রাষ্ট্রের জীবিতদের থেকে সে আর কোনদিন পানাহার চাইবে না, অর্থও চাইবে না। কিন্তু জীবিতদের কাছে তার একমাত্র চাওয়াটি হলো,খুনির শাস্তি। বিচারের সে দায়ভার রেখে যায় জীবিতদের কাঁধে। সভ্যদেশে জনগণের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রতি সে দায়ভারটি পালন করে সরকার। সে দায়ভারটি যথার্থ ভাবে পালিত না হলে খুনিরা প্রশ্রয় পায়, তাতে প্রতিষ্ঠিত পায় খুনের কালচার। বাংলাদেশে তো সেটিই হয়েছে। প্রলয়ংকরি প্লাবন ঠেকাতে হলে সরকারকে বহু কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ দিতে হয়, নইলে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচে না। তেমনি দেশে খুনের সয়লাব ঠেকাতে হলে যত অর্থব্যয়ই হোক খুনিদের বিচার করতে হয়। এমন খুনের বিচারের উদাহরণ সৃষ্টি হয় ৩/০১/১২ তারিখে লন্ডনের এক আদালতে। সেদিন থেকে ১৮ বছর আগে স্টেফেন লরেন্স নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক দক্ষিন পূর্ব লন্ডনের এক রাস্তায় বর্নবাদী হামলায় নিহত হয়েছিল। সে হত্যার তদন্ত ও বিচার হয়েছে তিনবার। প্রথম দুইবারে অপরাধীকে সনাক্ত করতে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু আদালত হাল ছাড়েনি। খুন যখন ঘটেছে, খুনিও নিশ্চয় আছে। অতএব খুঁজে বের করতেই হবে। শেষ বারে দুইজন খুনিকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে এবং আদালত তাদের শাস্তিও দিয়েছে। শুধু তদন্ত কাজে ব্যয় হয়েছে ৪০ লক্ষ পাউন্ড -যা প্রায় ৫০ কোটি টাকার সমান। রাষ্ট্রের এ বিনিয়োগ শুধু একটি খুনের বিচারে নয়,বরং লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুনিদের হাত থেকে বাঁচানোর তাগিদে। লন্ডনের রাস্তায় গভীর রাতে মহিলাও রাস্তায় একাকী নামতে পারে তো সে বিনিয়োগের কারণেই। রাষ্ট্রে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিছক রাস্তাঘাট, কল-কারখানা বা স্কুল কলেজ নির্মানে বাড়ে না। বাড়ে সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ইসলামে একাজ ফরজ। বিচারক এ মামলার রায়ে বলেছেন,খুনের সাথে আরো ব্যক্তি জড়িত ছিল,অতএব পুলিশকে অন্য খুনিদের খুঁজে বের করা। ফলে পুলিশের কাজ এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের আদালতে ন্যায় বিচার মারা পড়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। কোন খুনের মামলার বিচার হবে কি হবে না সে সিদ্ধান্ত নেয় রাজনৈতিক নেতারা। নিজ দলের নেতাকর্মীদের বাঁচাতে তদন্তের আগেই খুনের মামলা যেমন তুলে নেয়া হয়, তেমনি সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের ছেড়েও দেয়া হয়। নেতারা শুধু আইনবহির্ভূত হত্যার নির্দেশই দেন না, তেমন হত্যা নিয়ে বুক ফুলিয়ে গর্বও করেন। যেমন সিরাজ শিকদারের হত্যার পর শেখ মুজিব সংসদে তাই বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, “কোথায় আজ সিরাজ শিকদার।” শেখ হাসিনার নিজেই বলেছেন এক খুনের বদলে দশ খুন করতে। পুলিশ ও আদালত পরিনত হয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার। পুলিশের কাজ হয়েছে,সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গ্রেফতার করে রিমাণ্ডে নিয়ে পেটানো। আদালতের কাজ হয়েছে,বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের রিমোণ্ডের নামে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া এবং তাদের কারারুদ্ধ করার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশে প্রতিবছর বহু হাজার খুন হয়, কিন্তু কটি খুনের তারা বিচার করতে সমর্থ হন? ক’জনেরই বা শাস্তি দেন? শত  শত খুনী যেখানে প্রকাশ্যে ঘুরছে, তাদের না গ্রেফতার না করে রাজনৈতিক বিরোধীদের শায়েস্তা করার মতলবে বছরের পর গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা, মামলার সাক্ষিসাবুদ ও নথিপত্র তৈরি এবং পুলিশী রিমাণ্ডে নিয়ে নির্যাতন করাটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমনটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে । ফলে আদালত ভরে উঠেছে হাজার হাজার মিথ্যা মামলায়। বাংলাদেশে জীবিতরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে,তেমনি মৃতরা বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায় বিচার থেকে। অথচ নিহতদেরও বেঁচে থাকার ন্যূন্যতম মানবিক অধিকার ছিল। খুনির হাতে অহরহ ছিনতাই হচ্ছে সে অধিকার। মানব জীবনে এটিই সবচেয়ে বড় ছিনতাই। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কাউকে (বিনা বিচারে) হত্যা করে সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করলো। আইনের দৃষ্টিতে এটিই সবচেয়ে বড় অপরাধ। আর সরকারের সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো সে হত্যাকাণ্ডের বিচার না করা। র‌্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং সে হত্যার বিচার না করে বাংলাদেশের সরকার সুস্পষ্ট জড়িত উভয় অপরাধের সাথেই।

 

প্রশাসন জিম্মি খুনিদের হাতে

দালান-কোঠা, রাস্তাঘাট,কলেজ-­বিশ্ববিদ্যালয় বা কলকারখানার কমতি থাকলেও সে সমাজকে অসভ্য বলা যায় না। নবীজী (সাঃ)র সময় দালান-কোঠা,রাস্তাঘাট, বিশ্ববিদ্যালয় বা কলকারখানায় বিল্পব আসেনি। কিন্তু মানুষ পেয়েছিল মানবিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার, পেয়েছিল ন্যায় বিচারের অধিকার। হাজার হাজার টাকা ব্যয়ে তখন বিচার কিনতে হতো না। বরং বিনা খরচে সুবিচার নিশ্চিত করাটি ছিল সরকারের মূল দায়িত্ব।কোন মানুষ যখন মুসলমান হয় তখন সে নামায-রোযা পালন করে। সে ব্যক্তিটি যদি রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পায় সে তখন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে। এতেই ঈমানের পরিচয়। হাতে তসবিহ, মাথায় পটি, ঘন ঘন মাজার জিয়ারত এবং ওমরাহ পালনে ভণ্ডামিও থাকতে পারে। অপরাধী ব্যক্তি শাসক হলে সুবিচার প্রতিষ্ঠায় যেমন তার আগ্রহ থাকে না, তেমনি সামর্থ্য থাকে না অন্যায় ও অপরাধকে ঘৃনা করার।অথচ একটি জাতি কতটা সভ্য বা অসভ্য তার বিচার হয় অপরাধীদের প্রতি ঘৃনা ও তাদের বিরুদ্ধে বিচারের আয়োজন দেখে। অথচ বাংলাদেশের সরকারের তা নিয়ে ভাবনা নেই। বিচারের আয়োজনও নেই। র‌্যাব ও পুলিশের হাতে প্রতি বছর বহুশত মানুষের মৃত্যূ ঘটে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে রাজনৈতিক গুণ্ডা এবং সন্ত্রাসীদের হাতে। কিন্তু তা নিয়ে বিচার নেই। বরং সরকার ব্যস্ত খুনিদের মাফ করে দেয়ায় এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নেয়ায়। একটি সরকারের জন্য এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কি হতে পারে? অথচ এরূপ অপরাধীদের হাতেই দেশ আজ জিম্মি।

সরকার জানে, নিহতগণ কোনদিনই তাদের বিরুদ্ধে কৃত নৃশংস খুনের ঘট্না নিয়ে মিছিল করবে না, ভোট দিতেও আসবে না। কোনদিনই তারা আদালতে বিচার নিয়েও আসবে না। তারা তো চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। কিন্তু ভোট দিবে এবং নির্বাচনী বিজয়ে সাহায্য করবে তো পুলিশ, র‌্যাব ও দলীয় গুণ্ডা বাহিনী। ফলে তাদের শাস্তি দিলে তার পক্ষে লাঠি ধরবে কে? নির্বাচন কালে বিরোধীদের দমন এবং তাঁর পক্ষে জাল ভোটের আয়োজনই বা কে করবে? রাজনৈতিক স্বার্থটাই এখানেই বড়। ফলে গুরুত্ব পাচেছ নিহতদের কথা ভূলে খুনিদের নিয়ে ক্ষমতায় থাকার রাজনীতিকে মজবুত করা। ফলে খুনিরা পরিনত হয়েছে রাজনৈতিক যুদ্ধের অবৈতনিক সৈনিকে। ফলে খুনিদের গ্রেফতার ও তাদের বিচারের বিষয়টি আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়েছে। এ এক নিদারুন জিম্মিদশা।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগ শাসনের ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন বছরে (৩৫ মাসে) ৩৫৯ জন ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হন। এর মধ্যে রয়েছেন ২০০৯ সালে ১৫৪ জন, ২০১০ সালে ১২৭ জন ও ২০১১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ৭৮ জন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৪ সালে র‌্যাবের যাত্রা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত র‌্যাবের বিরুদ্ধে ৭০০ লোককে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিযোগ বিস্তর। হরতাল চলাকালের জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর পুলিশের নির্মম নির্যাতন করে। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে আটক হয়ে প্রাণ হারান বিশিষ্ট আইনজীবী এম.ইউ. আহমেদ। বিএনপি নেতা ও ডিসিসির সদ্য বিদায়ী মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে পুলিশের সামনে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত, দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আটক করে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রেখে নির্মম নির্যাতন ও বস্ত্রহীন করা –এগুলো হলো অতি ন্যক্কারজনক ঘটনা। গ্রেফতার করে নিয়ে সরকারি বাহিনী দীর্ঘ দিনের জন্য শয্যাশায়ী ও পঙ্গু করেছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র তারেক জিয়াকেও। যেদেশে নেতৃস্থানীয় লোকদেরই মানবাধিকারের এরূপ অবস্থা সে দেশে সাধারণ মানুষ যে কতটা অসহায় সেটি কি বুঝতে বাঁকি থাকে? পেশাদার অপরাধীরা আজ আর শুধু ডাকাত পাড়া ও সন্ত্রাসীদের দলে নয়, স্থান করে নিয়েছে পুলিশ বাহিনী ও র‌্যাবের দলে এবং সুযোগ পেলেই তারা মানুষ শিকার করছে। কথা হলো, দেশের রাজনীতি, পুলিশ ও প্রশাসনের মাঝে যখন এরূপ অপরাধের কালচার, তাতে কি কখনো সভ্যসমাজ গড়ে উঠে? তাতে বরং তীব্রতর হয় অসভ্যতা।

 

সরকারের মূল কাজঃ জাহান্নামের আগুণ থেকে জনগণকে বাঁচানো 

জনজীবনে রাষ্ট্রের প্রভাব অপ্রতিরোধ্য। কারণ, দেশের ড্রাইভিং সিটে থাকে সরকার। দেশ কোন দিকে যাবে সেটি নির্ধারণ করে ক্ষমতাসীন সরকার। তাই কোন সভ্য সরকারের কাজ শুধু রাস্তাঘাট, কলকারখানা, দালান-কোঠা ও ব্যবাসা-বাণিজ্যে উন্নয়ন আনা নয়; বরং জনগণকে দুর্বৃত্তদের সৃষ্ট আযাব ও অসভ্যতা থেকে মুক্তি দেয়া। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি হলো পরকালে জাহান্নামের আগুণ থেকে তাদেরকে মুক্তি দেয়া এবং জান্নাতের পথে নেয়া । এজন্য জরুরী হলো, রাষ্ট্রীয় অর্থ ও বিশাল অবকাঠামোকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক সোসাল ইঞ্জিনীয়ারিং। এ জন্য জরুরী হলো, উপযোগী ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি। সে মহান মিশনকে সফল করতেই রাষ্ট্র-প্রধানের আসনে খোদ মহান নবীজী (সাঃ) বসেছিলেন। এভাবেই তিনি শিখিয়ে যান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আসনে সমাজের সবচেয়ে যোগ্য ও ন্যায়পরায়ন ব্যক্তিকে বসানো কতটা গুরত্বপূর্ণ। তাই তাঁর ইন্তেকালের পর সে আসনে বসেছিলন শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণ।মুসলিমদের হাতে সে আমলে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা গড়ে উঠার মূল কারণ তো এটি। এ আসনে দুর্বৃত্তকে বসানো হারাম। সেটি হলে রাষ্ট্রে দুর্নীতির জোয়ার আসে।

প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রপ্রধানের যে আসনে বসেছিলেন খোদ নবীজী (সাঃ) ও তাঁর মহান সাহাবীগণ -সে আসনে ভোট-ডাকাত, দুর্বৃত্ত ফ্যাসিস্ট ও কাফেরশক্তির দাসদের বসিয়ে কি সভ্য-সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখা যায়?  বরং তারা যেটি করে তা হলো, জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য প্রবল সোসাল ইঞ্জিনীয়ারিং। একাজে তারাও ব্যবহার করে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক অবকাঠামো। এজন্যই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো জনগণকে দুর্বৃত্ত জালেম সরকার থেকে মুক্তি দেয়া ও ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। ইসলামে এটিই হলো জিহাদ। সে সমাজে ইসলামী রাষ্ট্র নাই এবং জনজীবনে জিহাদ নেই সে সমাজে প্রবলতর হয় জাহান্নামের পথে চলার স্রোত। স্রেফ নামায-রোযা ও তাসবিহ-তাহলিল দিয়ে সে স্রোতের টান থেকে নিজেকে বাঁচানো অতি কঠিন। ২/৩/২০১৯      

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *