পরিশুদ্ধ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্মাণ কিরূপে?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

 চরিত্রে বিপ্লব আনে পরকালের ভয়

 সকল বিপ্লবের মূলে হলো চারিত্রিক বিপ্লব। এবং সকল  চারিত্রিক বিপ্লবের মূলে হলো দর্শনের বিপ্লব -তথা জীবন ও জগত নিয়ে ব্যক্তির ধারণা ও বিশ্বাসে বিপ্লব। ঈমানদারদের জীবনে সে বিপ্লবটি আনে পরকালের ভয় -তথা বিচার দিনে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদেহীতার ভয়। সে ভয় না থাকলে জীবন-যাপনে স্বেচ্ছাচারীতা আসে; তখন ব্যক্তি পরিচালিত লোভ-লালসা ও প্রবৃত্তির তাড়নায়। তখন রাজনীতিতে আসে উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ, বর্ণবাদী নির্মূল, গণহত্যা, যুদ্ধ এবং বিশ্বযুদ্ধ। পরকালের ভয় থেকেই পরিশুদ্ধি আসে ব্যক্তির ধর্ম-কর্ম, আচার-আচরণ ও নীতি-নৈতিকতায়। সে ভয় থেকেই নির্ণীত হয় তাঁর রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, যুদ্ধনীতি ও শিক্ষানীতি। একমাত্র সে ভয় থেকেই জন্ম নেয় গুম, খুন, ধর্ষণ, প্রতারণা, চুরি-ডাকাতি ও ফ্যাসিবাদের বদলে সভ্য ও জন-কল্যাণকর রাষ্ট্র নির্মাণের রাজনীতি। তখন বিপ্লব আসে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। এমন রাষ্ট্রে প্রতিযোগিতা শুরু হয় বেশী বেশী নেক আমলে। সাহাবাদে জীবনে তো সেটিই দেখা গেছে।

নবীজী (সা:) আরবের বুকে কোন কৃষি বা শিল্প বিপ্লব আনেননি; বরং বিপ্লব এনেছিলেন চেতনার ভূবনে -যার মূলে ছিল আখেরাতের ভয়। মহান আল্লাহ তায়ালাকে মক্কার কাফেরগণও বিশ্বাস করতো। নিজ সন্তানদের নাম তারা আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান রাখতো। আবরাহার বিশাল বাহিনী যখন ক্বাবা ধ্বংসে উদ্যত হয় তখন নবীজী (সা‍)’র দাদা আব্দুল মোত্তালিব হাত তুলে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে যে দোয়া করেছিলেন -সে দোয়ার ভাষা থেকেই বোঝাযায় আল্লাহ তায়ালার উপর তাঁর গভীর বিশ্বাসের কথা। সেদিন আবরাহার বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সামর্থ্য কুরায়েশ নেতা আব্দুল মোত্তালিব ছিল না। তাই সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালার দরবার দুই হাত তুলে দোয়া করেছিলেন,  নিজ ঘর বায়তুল্লাহ ক্বাবার সুরক্ষার দায়িত্ব যেন তিনি নিজ হাতে নেন।

আব্দুল মোত্তালিবের সে দোয়া সেদিন কবুল হয়েছিল। দোয়া শেষ হতেই ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখি উড়ে আসে এবং আবরাহার বাহিনীর উপর ছোট ছোট পাথরের মিজাইল বর্ষণ শুরু করে। আবরাহার বাহিনীর হাতিগুলি ও সৈনিকরা সেদিন রক্ষা পায়নি। মহান আল্লাহ তায়ালার এভাবেই সেদিন তাঁর পবিত্র ঘরকে রক্ষা করেন। আব্দুল মোত্তালিবের এক পুত্রের নাম ছিল আব্দুল্লাহ তথা আল্লাহর দাস; এবং আব্দুল্লাহর ঔরসেই জন্ম হয় মহান নবীজী (সা:)’র। সেদিন আরবের কাফিরদের মূল সমস্যা ছিল, তাদের ছিল না আখেরাতের উপর বিশ্বাস। ছিল না মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে রোজহাশরের দিনে জবাবদেহীতার ভয়। নবীজী (সা:) চেতনার এ ভূমিতেই বিপ্লব আনেন; প্রতিষ্ঠা দেন আখেরাতের ভয়কে। আর তাতেই আমূল বিপ্লব আসে আরবদের বাঁচার এজেন্ডায় এবং কর্ম, চরিত্র ও রাজনীতিতে। ফলে চরিত্রে তারা ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হন।

মানব জীবনে সবচেয়ে ভয়ানক অভাবটি সম্পদের নয়; দৈহিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যেরও নয়। বরং সে শূন্যতাটি আখেরাতের ভয়েরও। মানব জাতির সকল বিপর্যের কারণ এই আখেরাতের ভয়শূণ্যতা। আখেরাতের ভয় থাকলে মু’মিনের জীবনে ব্যস্ততা বাড়ে বেশী বেশী নেক আমলে। প্রতি মুহুর্তের তাড়না হয় আখেরাতের খাতায় সঞ্চয় বাড়ানোতে। তখন অতি ক্ষুদ্র এ পার্থিব জীবনটি মনে হয় পরীক্ষা কাল রূপে। তখন পরকালের সঞ্চয় বাড়াতে বিশাল রাষ্ট্রের শাসকও চাকরকে উঠের পিঠে বসিয়ে নিজে রশি ধরে টানে। মিথ্যাচার, চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবী ও ব্যভিচারের ন্যায় নানারূপ পাপের পথে নামার মূল কারণটি হলো পরকালের ভয়শূন্যতা। মানব মনের এটিই হলো সবচেয়ে গুরুতর রোগ -যা অসম্ভব করে সভ্য মানুষ রূপে বেড়ে উঠা। পরকালের ভয়শূন্যতা মানুষকে ভয়ানক অপরাধীতে পরিণত করে। তখন জন্ম নেয় চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম-খুন-ধর্ষণ, সন্ত্রাস নিয়ে বাঁচার তাড়না। তখন রাজনীতিতে জন্ম নেয় সেক্যুলারিজম, স্বৈরাচার, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, বর্ণবাদী নির্মূল, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, যুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধ। মানব মনের সে ভয়ানক রোগের ডায়োগনোসিসটি অন্য কারো নয়, সেটি মহান আল্লাহতায়ালার। এবং সে রোগের ঘোষণা দিয়েছেন সুরা আল-ক্বিয়ামার ২০ ও ২১ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

كَلَّا بَلْ تُحِبُّونَ ٱلْعَاجِلَةَ ٢٠

وَتَذَرُونَ ٱلْـَٔاخِرَةَ ٢١

অর্থ: “না, (তোমাদের মূল সমস্যা হলো) তোমরা ভালবাস পার্থিব জীবনকে এবং ছেড়ে দিয়েছো আখেরাতের ভাবনাকে”।

যে কারণে এ জীবনে বাঁচাটাই পুরো ব্যর্থ হয় তা হলো, পার্থিব জীবনের মোহ এবং আখেরাতকে ভূলে থাকা। এ রোগ ব্যক্তিকে নিশ্চিত জাহান্নামে হাজির করে; এবং অসম্ভব করে জান্নাতে পৌঁছা। তাই যারা জান্নাতে পৌঁছতে চায় তাদেরকে এ রোগ থেকে অবশ্যই মুক্ত হতে হয়। পথ চলতে মূল গন্তব্যস্থল জান্নাতকে সামনে রেখে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার তাড়না নিয়ে। 

আখেরাতকে ভয় ব্যক্তির মনের গভীরে বসে পুলিশের কাজ করে; তাকে অপরাধ থেকে বাঁচায় । মুসলিমদের গৌরব যুগে দুর্নীতি বিলুপ্ত হওয়ার মূল কারণ, মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের উপর পুলিশ রূপে কাজ করতো। এমন ঘটনাও ঘটেছে, প্রবৃত্তির তাড়নায় জ্বিনাতে লিপ্ত হওয়ার পর নবীজী (সা:)’র কাছে জ্বিনার শাস্তি রূপে মৃত্যুদন্ড দাবী করেছেন। এর কারণ, মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদেহীতার ভয়। সমাজকে তাই দুর্নীতি মুক্ত করতে হলে শুধু পুলিশের সংখ্যা বাড়ালে চলে না, পরকালের ভয়ও বাড়াতে হয়। সে কাজে মুল হাতিয়ারটি হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। এ পৃথিবীতে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, আইনবিদ, কৃষিবিদ বানানোর টেক্সটবুক অনেক; কিন্তু অভাব মানুষকে মানুষ বানানো এবং জান্নাতর যোগ্য বানানোর টেক্সটবুকের। সে শূণ্যস্থান পূরণ করেছেন খোদ মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালা।

মানুষকে মানুষ বানানো এবং পরিশুদ্ধির মধ্য দিয়ে জান্নাতের যোগ্য বানানোর সর্বশ্রেষ্ঠ টেক্সটবুক হলো পবিত্র কুর’আন। এ পবিত্র গ্রন্থই হলো মানব জাতির জন্য মহান স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। তাই এ গ্রন্থ থেকে পাঠ দেয়া হলো এ পৃথিবী পৃষ্ঠে  সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম। সওয়াব এখাএন জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে নেয়ার। এ পবিত্র টেক্সটবুক থেকে পাঠ নেয়ার কারণেই সাহাবাগণ সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হতে পেরেছিলেন। আর আজ সে গ্রন্থ থেকে দূরে সরে মুসলিমগণ ইতিহাস গড়ছে চারিত্রিক কদর্যতায়। তাই এ বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্য পাপ কর্ম হলো কাউকে পবিত্র কুর’আন থেকে দূরে রাখা। অথচ বাংলাদেশে সে অপরাধ কর্মটি বেশী বেশী হচ্ছে। তাই সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কুর’আন থেকে পাঠ দেয়া হয়নি। ফলে দেশে বিপুল সংখ্যায় ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, কৃষিবিদ, আইনবিদ, প্রশাসক, বিচারক উৎপাদিত হলেও বাড়ছে না সত্যিকার মানুষের সংখ্যা। ফলে নির্মিত হচ্ছে না দুর্নীতিমুক্ত সভ্য রাষ্ট্র ও সমাজ। বরং বাংলাদেশ বিশ্বরেকর্ড গড়ছে দুর্বৃত্তিতে। কুর’আন পদে পদে পথ দেখায়। কুর’আনী  জ্ঞান থেকে সৃষ্টি হয় আল্লাহর ভয়। আর যার মধ্য থাকে আল্লাহর ভয়, একমাত্র তার মাঝেই থাকে পরকালে জবাবদেহীতার ভয়।

 

আল্লাহ কথা বলেন বান্দার সাথে

পবিত্র কুর’আনের মধ্য দিয়েই মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজের ভাষায় বান্দাদের সাথে কথা বলেন। এবং বান্দাকে পথ দেখান। মহান আল্লাহ তায়ালা সে পবিত্র ওয়াজে থাকে প্রগাড় emotional force; সে ওয়াজ বুঝতে হলে চাই কুর’আনের ভাষ বোঝার সামর্থ্য, না বুঝে তেলাওয়াতে সেটি সম্ভব নয়। এমন কি অনুবাদ পড়েও বোঝার সে কাজটি যথার্থ ভাবে হয়না। বুঝতে হবে, যারা কুর’আনে সাথে সম্পৃক্ত হয়, একমাত্র তারাই পায় সিরাতাল মুস্তাকীম। কারণ কুর’আন হলো মহান আল্লাহ তায়ালার রশি। অথচ বাংলাদেশে কুর’আন বোঝার সে কাজটিই হচ্ছে না। সে লক্ষে রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষ থেকে তেমন বিনিয়োগ নাই। ফলে ছাত্রদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হয় পবিত্র কুর’আনের একটি আয়াত বোঝার সামর্থ্য অর্জন না করেই। শিক্ষাদানের নামে এমন দায়িত্বহীন কর্ম কি মুসলিম ইতিহাসের কোন কালে হয়েছে? মহান আল্লাহ তায়ালার কিতাবের সাথে এর চেয়ে বড় বেয়াদবি আর কি হতে পারে? আর এরূপ বেয়াদবিতে কি তার রহমত জুটবে?

আখেরাতের ভয় থেকেই ব্যক্তির মনে জন্ম নেয় পরিশুদ্ধ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের নির্মাণের এজেন্ডা। মানব জীবনে এর চেয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা বা কর্ম নাই। যারা সে সংস্কার বা পরিশুদ্ধির কাজে সফল হলো তারাই প্রকৃত সফলকাম; এবং যারা এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলো তারাই সবচেয়ে ব্যর্থ। তখন তাদের সমগ্র বাঁচাটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। তারা বাঁচে অন্ধকারে আচ্ছন্ন জাহেল মন নিয়ে। এবং সে জাহেলদের স্থান হয় জাহান্নাম। তাই মহান আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট ঘোষণা:

قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّىٰ

অর্থ: “নিশ্চয়ই তারা সফল হলো যারা পরিশুদ্ধ হলো।” –(সুরা আলা, আয়াত ১৪)।

ইবাদতের লক্ষ্য: ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি

ইবাদতের লক্ষ্য শুধু মহান আল্লাহ তায়ালার দাসত্বের প্রকাশ নয়, বরং এটি হলো নিজেকে এবং সে সাথে নিজের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধির প্রচেষ্টা। বস্তুত এভাবেই ব্যক্তির ইবাদত তাকে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ব করে। কারণ তিনি চান, কুর’আনের আলোকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি। তখন মুসলিম জীবনে আসে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের এজেন্ডা -যেমনটি দেখা গেছে নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের জীবনে। যে ইবাদত ব্যর্থ হয় মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ব করতে -সে ইবাদত ব্যর্থ। সে ইবাদত মুনাফিকের ইবাদত।   

রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি আনে নাগরিক জীবনে পরিশুদ্ধি; এবং ব্যক্তির পরিশুদ্ধি আনে রাষ্ট্রের অঙ্গণে পরিশুদ্ধির। অর্থাৎ একটির পরিশুদ্ধি আরেকটির পরিশুদ্ধির পরিপূরক। অপর দিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে দুবৃত্তায়ন ঘটলে তা দুর্বৃত্তায়ন ঘটায় নাগরিক জীবনে। সেটি সম্যক বুঝা যায় বাংলাদেশের দিকে নজর দিলে। রাষ্ট্র যখন অধিকৃত হয় সেক্যুলারিস্ট দুর্বৃত্ত অপরাধীদের হাতে, তখন রাষ্ট্র জুড়ে প্লাবন আসে চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, অর্থ পাচারের ন্যায় নানাবিধ অপরাধের। দেশ তখন দুর্বৃত্তিতে বার বার বিশ্বরেকর্ড গড়ে। সেটিই বাংলাদেশের ইতিহাস। অপর দিকে  জনজীবনে পরিশুদ্ধি না আসার বিপদটিও অতি ভয়ানক। সে অজ্ঞ ও অপরিশুদ্ধ জনগণ যখন জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, হিন্দুত্ববাদ, ভোগবাদ ও স্বার্থপরতার জোয়ারে ভেসেছে তখন তারা মুজিব-হাসিনার ন্যায় অপরাধীদের বিজয়ী করতে রাস্তায় নেমেছে এবং ভোট দিয়েছে। এবং মুজিবের ন্যায় চরিত্রহীন খুনি, গণতন্ত্রের খুনি, নৃশংস ফাসিস্ট এবং ভারতের গোলামকে পিতা, নেতা ও বন্ধুর আসনে বসিয়েছে।  

তাই মুসলিমের ইবাদত-বন্দেগী শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও কুর’আন তেলাওয়াতে শেষ হয়না, বরং সে ইবাদতের মূল লক্ষ্য হয় মানবের চিন্তা-চেতনা, কর্ম-চরিত্র, রাজনীতি-বুদ্ধিবৃত্তিতে পরিশুদ্ধি আনা। যার জীবনে বহু বছর, বহু মাস বা বহু দিন ইবাদতে অতিক্রান্ত হলো অথচ তার জীবনে কোন পরিশুদ্ধি আসলো না -তার চেয়ে ব্যর্থ ও দুর্ভাগা ব্যক্তি আর কে হতে পারে? খনির ধুলোয় ঢাকা স্বর্ণের টুকরো তখনই মূল্যবান গহনা রূপে উচ্চ মূল্য পায় যখন সেটি এক দীর্ঘ পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশুদ্ধ স্বর্ণে পরিণত হয়। পরিশুদ্ধির অর্থ মূল্য সংযোজন (value add)। যেখানে পরিশুদ্ধি নাই সেখানে মূল্যের বৃদ্ধিও নাই। বিষয়টি অবিকল সত্য প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রেও। ব্যক্তি তো তখনই জান্নাতের যোগ্য হয় যখন সে পরিশুদ্ধির মধ্য দিয়ে মুত্তাকী রূপে গড়ে উঠে। মানব জীবনে পরিশুদ্ধির শুরু জ্ঞানার্জন তথা শিক্ষার মধ্য দিয়ে। সে পরিশুদ্ধির পর্বকে সফল করার জন্যই মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে পবিত্র কুর’আন।

কুর’আনই হলো মানবের জন্য মহান স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। কারণ, পবিত্র কুর’আন না হলে অসম্ভব হতো মানব চরিত্রের পরিশুদ্ধির কাজ। পরিতাপের বিষয় হলো বাংলার বুকে ইসলামের আগমন হাজার বছর আগে হলেও পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনে কাজটি কোন কালেই হয়নি। আজও হচ্ছে না। আয়োজন বেড়েছে কেবল না বোঝে কুর’আন তেলাওয়াতের, কুর’আন বোঝায় নয়। এটিই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে বাঙালি মুসলিমের সবচেয়ে গাদ্দারী। সে সাথে এটি তাদের চরম ব্যর্থতার কারণও।  

 

রাষ্ট্রই শক্তিশালী হাতিয়ার -যেমন পরিশুদ্ধির, তেমনি দুর্বৃত্তায়নের

মানবের পরিশুদ্ধিকে অসম্ভব করে তার মনের গভীরে বসে থাকা জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা। তাই ইসলামের শ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা জিহাদে আকবর হলো এই অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জিহাদ। এবং সে জিহাদের মূল অস্ত্র হলো পবিত্র কুর’আন। তাই সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ করেননি; বরং সেগুলি ফরজ করার প্রায় এক যুগ আগে ফরজ করেছে কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জন। তাই কুর’আন থেকে জ্ঞান অর্জন না করে পরিশুদ্ধির কাজটি অসম্ভব। তেমনি ব্যক্তি ও সমাজ পরিশুদ্ধির বড় হাতিয়ার হলো পরিশুদ্ধ রাষ্ট্র। কারণ, শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়া, প্রশাসন, পুলিশ, আদালত -এসবই রাষ্ট্রের হাতে।

অপর দিকে জনগণের চেতনা-চরিত্রে দুর্বৃত্তায়নের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো রাষ্ট্র -যদি তা অধিকৃত হয় শয়তানী শক্তির হাতে। রাষ্ট্রকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেই ফিরাউন সমগ্র মিশরবাসীর কাছে নিজেকে খোদা রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। তার হাতে রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলি না থাকলে সেটি অসম্ভব হতো।  তেমন বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও কম্যুনিজমের ন্যায় ভয়ঙ্কর মতবাদগুলি পৃথিবী পৃষ্ঠে বর্ণবাদী নির্মূল, গণহত্যা ও গণনির্মূলের ন্যায় নাশকতাব কাণ্ড ঘটাতে পেরেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকে থাকার কারণে।

 

রাষ্ট্র কিরূপে আযাবের হাতিয়ার হয়?

ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো রাষ্ট্র পরিশুদ্ধকরণের জিহাদ। জিহাদই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার একমাত্র হাতিয়ার। এ জিহাদ যেমন রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক, তেমনি সামরিক। পচা জীবজন্তু ও আবর্জনাপূর্ণ জলাশয়ে গা ডুবিয়ে কখনোই সুস্বাস্থ আশা করা যায় না, তেমনি পরিশুদ্ধ চেতনা, চরিত্র ও কর্ম আশা করা যায় না দুর্নীতির প্লাবনে ভাসা রাষ্ট্রে বসবাস করে। কারণ, দুর্বৃত্ত অধিকৃত সে রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, মিডিয়া তখন দূষিতকরণের শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। অপর দিকে পরিশুদ্ধ রাষ্ট্র পরিশুদ্ধি আনে ব্যক্তির জীবনে। তখন বহু দুর্বৃত্ত জাহেলও বিজ্ঞ আলেম ও মুজাহিদে পরিণত হয় -যেমনটি নবীজী (সা:)’র জামানায় দেখা গেছে। অপর দিকে দুর্বৃত্ত কবলিত রাষ্ট্র দেশের জনগণকে দুর্বৃত্ততে পরিণত করে। একারণেই নমরুদ-ফিরাউন এবং মুজিব-হাসিনার ন্যায় দুর্বৃত্তদের বিশাল দুর্বৃত্ত বাহিনী গড়তে লোকবলের অভাব হয়নি।

এমন কি আলেম, মাদ্রাসা শিক্ষক ও মসজিদের ইমামগণও সে দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ার হাতিয়ারে পরিণত হয়। তাই হিফাজতে ইসলামের হুজুরদের দেখা গেছে খুনি হাসিনার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে কওমী জননী বলতে এবং তার ন্যায় দুর্বৃত্তের হাত থেকে সার্টিফিকেট নিতে। দুর্বৃত্তকরণের রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া প্রবল থাকার কারণেই শাপলা চত্বরের গণহত্যা, ২০২৪’য়ের জুলাই-আগস্টের গণহত্যা, ২০১৮ সালে ভোটডাকাতি, ২০১৪ ও ২০২৪ সালের একদলীয় নির্বাচন, আয়নার ঘরের নির্যাতন ও গুম-খুন-সন্ত্রাসের রাজনীতি চালাতে হাসিনার লোববলের অভাব হয়নি। শুধু তার রাজনৈতিক দল-অঙ্গদল নয়, রাষ্ট্রের পুলিশ, প্রশাসন, RAB, বিজিবি, সেনাবাহিনী সবাই তার পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছে।

সভ্য রাষ্ট্র ও পরিশুদ্ধ জনগণ গড়ে তোলার জন্য তাই জরুরি হলো এরূপ রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ার সমূলে নির্মূল। একাজ প্রতিটি ঈমানদারের। এরূপ ফরজ কাজ থেকে দূরে থাকার অর্থ শতভাগ কুফুরি তথা বেঈমানী। সে বেঈমান যদি নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করল -বুঝতে হবে সে কপট মুনাফিক। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দুর্বৃত্ত নির্মূলের কাজটি এতোই গুরুত্ব পেয়েছে যে, তিনি এটিকে পবিত্র জিহাদের তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছেন। যারা জিহাদে শহীদ হয় -তাদেরকে তিনি সরাসরি জান্নাতের নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

একটি রাষ্ট্রের জনগণ মহান আল্লাহ তায়ালাকে কতটা ভালবাসে এবং তাঁর কাছে কতটা প্রিয়তর হতে চায় সেটি মানুষের দাড়ি টুপি ও নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, আলেম-আল্লামার পদবি, আশেকে খোদার  ব্যানার দেখে বুঝা যায় না। সেগুলি বহু দুর্বৃত্ত প্রতারকও করে। সেটি বোঝা যায় জিহাদে সংশ্লিষ্টতা দেখে। পরিশুদ্ধ ব্যক্তি ও রাষ্ট্র নির্মাণের একমাত্র হাতিয়ার হলো এই জিহাদ। একাজ দোয়াদরুদ, যিকিরের মজলিস ও মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের মধ্য দিয়ে হয়না। অতীতে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছে একমাত্র জিহাদের পথ ধরেই। নবীজী (সা:)’র যুগে অর্ধেকের বেশী সাহাবা সে জিহাদে শহীদ হয়ে গেছেন। আগাছা নির্মূল না করলে তা বিশাল জঙ্গলে পরিণত হয়। তাই যেখানে সে জিহাদ নাই, সেখানে বাঁচতে হয় দুর্বৃত্ত অধিকৃত রাষ্ট্রের আযাব নিয়ে। তখন সে রাষ্ট্র হয়ে যায় পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুত আযাবের হাতিয়ারে। তিনি শয়তানকেও এভাবে আযাবের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেন।      

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *