পতিত হাসিনার দুর্বৃত্তায়ন ও হিন্দুত্বায়ন প্রকল্প এবং বাঙালি মুসলিম জীবনে নাশকতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

                                                                                                                                          হাসিনার দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি             

বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আকারের চুরি-ডাকাতিগুলি মহল্লার চোর-ডাকাতগণ করেনি। সেটি করে এসেছে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীগণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরি এবং সবচেয়ে বড় ডাকাতির কাজটি করেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই আওয়ামী ডাকাত-সর্দারনীর হাতে সবচেয়ে বড় ডাকাতির কান্ডটি ঘটেছে ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বরে। পৃথিবীর প্রায় দুইশত দেশের মাঝে আর কোন দেশেই ডাকাতগণ এতো বড় ডাকাতি কোন কালেই করতে পারিনি। অন্য দেশে ডাকাতগণ বড় জোর কিছু গৃহ, কিছু দোকান-পাট বা কিছু ব্যাংকের উপর ডাকাতি করে, কিন্তু সমগ্র দেশকে ডাকাতি করে নিয়েছে -সে ইতিহাস কোথাও নেই। কিন্তু সে ইতিহাস নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশে। রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ তহবিল, ব্যাংকগুলিতে গচ্ছিত জনগণের অর্থ, বিদেশী লোনের অর্থ, প্রকল্পের অর্থ, সরকারি জমি, রাস্তার গাছ, দেশের হাট-বাজার -এরূপ সবকিছুর উপর ডাকাতি হয়েছে এ ডাকাত সর্দারনীর ও তার সহযোগীদের হাতে।

প্রতিটি চোর, ডাকাত, ভোটডাকাত, গুম-খুনের নায়ক এবং স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তই হলো শয়তানের এজেন্ট। তাদের কাজ শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করা এবং সে সাথে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে পরাজিত রাখা। তাদের কাজ, রাষ্ট্রকে জাহান্নামের বাহনে পরিণত করা। এবং সে সাথে সিরাতাল মুস্তাকীমের পথে চলা কঠিন করা। শয়তানের অধিকৃত এ দেশে ইসলামপন্থীদের ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে এবং শাপলা চত্বরের গণহত্যায় শহীদ হতে হয়েছে। ডাকাতের দল কি কখনো শান্তি ও উন্নয়ন দিতে পারে? তারা যা দিতে পারে তা হলো আরো নৃশংস চুরি-ডাকাতি।

যে কোন সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হলো মানবোন্নয়ন। আর সবচেয়ে বড় নাশকতাটি হলো দেশবাসীর চরিত্র ধ্বংস। চারিত্রিক ধ্বংসের অর্থ, জাহান্নামের উপযোগী হওয়া। সমগ্র দেশ জুড়ে ডাকাতির জন্য চাই বিশাল ডাকাত দল। সেজন্য জরুরি হলো বিপুল সংখ্যায় ডাকাত উৎপাদনের প্রক্রিয়া। নইলে সবগুলি শহর, থানা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের প্রতিটি অফিসে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাকাত বসানো যায় না। নইলে জনগণের ভোট, তাদের সম্পদ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর সফল ডাকাতি করা যায়না। তাই ডাকাতদের কাছে জরুরি হলো দেশবাসীর চরিত্র-বিনাশ এবং ডাকাত উৎপাদনের কাজে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যবহার করা। বাংলাদেশে সে কাজটি এতোটা ব্যাপক ভাবে হয়েছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষক একসাথে বিবৃতি দিয়ে ভোটডাকাতের পক্ষে খাড়া হয়েছে। তারা পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর কোন ভোটডাকাতি হয়নি, সুষ্ঠ নির্বাচন হয়েছে! তারা হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাতকে শ্রদ্ধেয় ও  মাননীয় বলেছে। এ হলো বাংলাদেশীদের নৈতিক ব্যর্থতার চিত্র।

কোন সভ্য দেশে একজন ভদ্র মানুষও কি কখনো পাওয়া যায় যে চুরি-ডাকাতিকে ভাল কাজ বলে? এবং ডাকাতকে শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় বলে? সেটি অসম্ভব। যার বিবেক বেঁচে আছে তাঁর দ্বারা সে কাজটি হয়না। কিন্তু বাংলাদেশে বিবেকহীন মানুষের সংখ্যাটি বিশাল। কারণ রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে জনগণের বিবেক হত্যার হাতিয়ারে। সেটি কুশিক্ষা, কুপ্রচারনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দূষণের মাধ্যমে। ফলে শেখ হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাতও তাদের কাছে মাননীয়, শ্রদ্ধেয় ও দেশনেত্রী গণ্য হয়েছে। এবং মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের খুনি, বিচার বহির্ভুত হত্যার নায়ক, নৃশংস ফ্যাসিস্ট ও ভারতের সেবাদাসকেও জাতির পিতা, নেতা ও বন্ধুর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মুজিবের শত শত মূর্তিও গড়া হয়েছে। এসবই হলো বড় রকমের চেতনার দূষণ ও অসভ্যতার আলামত। এমন অসভ্য মানুষদের নিয়ে কি সভ্য রাষ্ট্র নির্মিত হয়? এমন দেশে খুন, গুম, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, ব্যাংক ডাকাতি, চুরিডাকাতি ও ভোটডাকাতির প্লাবন আসবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? বাংলাদেশে চোর-ডাকাত তৈরীর কাজটি বেশি বেশি হয়েছে বলেই ভোটডাকাত হাসিনার শাসন এতো দীর্ঘ মেয়াদী হয়েছে। কারণ, পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিচারক বাহিনী, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে তার পক্ষে খাড়া হওয়া লোকের সংখ্যাটি বিশাল। ফলে ২০২৪ সালের জানুয়ারীতে প্রহসনের নির্বাচনে পুণরায় সফল হয়েছে।

আওয়ামী-বাকশালী শাসনে লাগামহীন স্বাধীনতা পেয়েছিল দলীয় দুর্বৃত্তগণ। এবং স্বাধীনতা হারিয়েছিল দেশের জনগণ -বিশেষ করে যারা ইসলামপ্রেমী ও গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি। আওয়ামী-বাকশালীদের ডাকাতির শিকার হয়েছে যেমন রাষ্ট্রীয় সম্পদ, তেমনি ডাকাতি হয়ে গেছে জনগণের নাগরিক অধিকার। ডাকাতির শুরু শেখ মুজিবের আমল থেকে, সে ডাকাতি প্রক্রিয়াকে আরো বলবান করেছে শেখ হাসিনা।  ফলে গণতন্ত্র দীর্ঘকাল কবরে স্থান পেয়েছে। এদের আরেকটি পরিচয় হলো, তারা ভারতপন্থী। ভারতের যুদ্ধটি একাত্তরে শেষ হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে আওয়ামী-বাকশালীদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্থিক প্রতিপালন দেয়ার কাজটিও শেষ হয়নি। বরং দিন দিন সেগুলি প্রবলতর হয়েছে।  

হাসিনার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো, জাহান্নামের সে পথটিকে তার সকল কদর্য বৈশিষ্ট্যসহ জনগণের সামনে হাজির করেছিল। জাহান্নামের এ পথে যেমন গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চুরিডাকাতি ও ভোটডাকাতি আছে, তেমনি আছে মহান আল্লাহতায়ালার উপর আস্থার বিলুপ্তি, মূর্তি নির্মাণ ও মূর্তিপূজা। নামাজ-রোজায় যেমন ঈমানের প্রকাশ, মূর্তি নির্মাণের মাঝে তেমনি বেঈমানী ও হিন্দুত্বের প্রকাশ। মক্কার আবু লাহাব, আবু জেহেলদের দল ইসলামের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেনি। পরাজিত হয়ে আরবের মাটি থেকে তারা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। ফলে মক্কা ও মদিনার বুকে বিগত সাড়ে চৌদ্দশত বছরে একটি মূর্তিও নির্মিত হয়নি। অথচ হাসিনার আমলে আবু লাহাব ও আবু জেহেলদের মূর্তিনির্মাণ ও মূর্তিকে পূজা করা বা সম্মান দেখানোর সে পৌত্তলিক রীতি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছিল। মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে অসংখ্য মুর্তি। সেটি হাসিনা সরকারের আর্থিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পৃষ্ঠপোষকতায়। এবং হাসিনার পাশে প্রবল দাঁড়িয়েছিল পৌত্তলিক ভারত।  

মূর্তি নির্মাণে শেখ হাসিনার এরূপ আগ্রহ মূলত তার মনের পৌত্তলিক জাহেলী রূপটিকেই নগ্ন ভাগে প্রকাশ করে দিয়েছে। কোন ঈমানদার কি তাকে সমর্থন করতে পারে? অতি বিস্ময়ের বিষয় হলো, হাসিনার মত একজন হিন্দুত্ববাদী নেত্রী বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন দখল করতে পেরেছে! বিস্ময়ের বিষয়, জনগণ দূরে থাক, আলেমদের পক্ষ থেকেও এরূপ পৌত্তলিকের দখলদারীত্বের বিরুদ্ধে কোন প্রবল প্রতিবাদও হয়নি! ২০২৪’য়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লব না হলে তাদের নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতা নিশ্চিত আরো বহুকাল অব্যাহত থাকতো।  আরো বিস্ময়ের বিষয় হলো, দেওবন্দী আলেমদের অনেকে হাসিনার মত হিন্দুত্ববাদীকে কউমী জননী বলে সম্মানিত করেছে! তাই শেখ হাসিনার শাসনকাল যেমন বাঙালি মুসলিমদের ঈমানী ব্যর্থতার শো’কেস (showcase), তেমনি শো’কেস হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে গাদ্দারীরও। এজন্য কি রোজ হাশরের বিচার দিনে শেখ হাসিনার সাথে বাংলাদেশের জনগণকেও আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না? মুসলিম জনগণের গুরুতর অপরাধ হলো, মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে দায়িত্ব পালন না করার। একমাত্র শয়তানের খলিফাগণই শরিয়তের বিলুপ্তি ও মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার পরাজয় দেখেও নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে।

 

বাংলাদেশে হিন্দুত্বায়ন

বাংলার বুকে মুসলিম শাসনের শুরু প্রায় ৮ শত বছর আগে। কিন্তু কোন মুসলিম শাসকের হাতে একটি মূর্তিও নির্মিত হয়নি। একাজ ছিল একমাত্র হিন্দুদের। মূর্তিপূজা শিরকের প্রতীক। ইসলামের আগমন মূর্তি গড়তে আসেনি; বরং মূর্তি ভাঙ্গাই ছিল নবীজী (সা:)‌র ও ইব্রাহিম (আ:)’র সূন্নত। ইসলামের শুরুই হয়েছে পৌত্তলিকতা নির্মূলের যুদ্ধ নিয়ে। তাই বাংলার বুকে মূর্তি একমাত্র মন্দিরে শোভা পেয়েছে, কোন রাজপথে ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে নয়। পাকিস্তান আমলেও পূর্ব পাকিস্তানে কোন মূর্তি রাজপথে বসানো হয়নি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পরও হাসিনার পূর্বে কেউই রাজপথে মূর্তি বসায়নি -যদিও শেখ মুজিব তার নিজের মূর্তি সিরাজ শিকদারের বোন শামীম শিকদারকে দিয়ে গড়িয়ে নিয়েছিলেন এবং ঢাকার জেল খানায় বসিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা হাজির হয়েছে হিন্দুত্ববাদের সেপাহী রূপে। হাসিনা শত শত মূর্তি বসিয়েছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। এভাবেই হিন্দুত্বায়নের কাজটি করেছে বাংলাদেশের ন্যায় সংখ্যাগরষ্ঠ মুসলিমের দেশে।

হিন্দুত্ববাদীগণ এতোটাই প্রশ্রয় পেয়েছে যে, হিন্দুত্ববাদের নেতারা বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের সাথে সংযুক্ত করার পক্ষে প্রকাশ্যে দাবী তুলেছে। তাই গোবিন্দ প্রামানিকের মত বাংলাদেশীয় রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (RSS) সদস্য এক আলোচনা সভায় বলেছে, “‌‍আমাদের এই বাংলায় বহু ঋষির জন্ম হয়েছে, তাই এ ভূমিকে অখণ্ড ভারতের বাইরে রাখতে পারি না; অবশ্যই সংযুক্ত করতে হবে।” তার সে বক্তৃতার ভিডিও ইউটিউবে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এতো বড় বক্তব্য পেশের পরও তাকে হাসিনার আমলে গ্রেফতার করা হয়নি। তাকে নিয়ে হাসিনা সরকারের এরূপ নীরবতার সুস্পষ্ট কারণও রয়েছে। কারণ, গোবিন্দ প্রামানিকের রয়েছে খুঁটির জোর। যে হিন্দুত্ববাদী সরকার থেকে গোবিন্দ প্রামানিক ইন্ধন পায়, সে অভিন্ন হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্য পায় খোদ হাসিনা। ভারতের সাহায্য নিয়ে শেখ হাসিনা ভোটডাকাতি করছে এবং দুঃশাসন চালাচ্ছে। উভয়ই গোলাম একই প্রভুর। তাই গোবিন্দ প্রামানিককে শেখ হাসিনা গ্রেফতার করবে কোন সাহসে? হাসিনার মিশন, বাংলাদেশ যাতে কোন ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত না হয় -সেটি রোধ করা। এবং কখনোই তার মিশন অখণ্ড ভারতের অংশ হওয়া থেকে ঠেকানো ছিল না। গোবিন্দ প্রামানিকগণ একারণেই অখণ্ড ভারতে শামিল হওয়া নিয়ে নিজেদের মনের বাসনাটি এতোটা জোরের সাথে বলতে পারে।

আবু লাহাব, আবু জেহেল ও তাদের সাথীরা শয়তানের পৌত্তলিক প্রকল্পকে এতো বড় বিজয় দিতে পারিনি -যা দিয়েছিল হাসিনা। এবং হিন্দুত্ববাদের সে বিশাল বিজয়টি ৪ লাখ মসজিদের দেশ বাংলাদেশে? বাংলাদেশ শুধু মসজিদের দেশ নয়, এদেশের শতকরা ৯১ ভাগ জনগণ নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী কর। হিন্দুত্ববাদের পক্ষে এ বিশাল কাজের জন্যই ভারতের মূর্তিপূজারী শিবিরে হাসিনার গ্রহনযোগ্যতা এতোটা প্রবল। হাসিনাকে তারা একান্তই নিজেদের লোক মনে করতো। ফলে হাসিনার পতনে তারা এতোটা মর্মাহত। তারা কিছুতেই এ পরাজয় মেনে নিতে পারছে না। ছাত্র-জনতার এ বিশাল বিপ্লবকে তারা বিদেশী শক্তির ষড়যন্ত্র বলছে। ভারতীয় মিডিয়ার কথা, হাসিনাকে ষড়যন্ত্র করে তাড়িয়েছে পাকিস্তানী ISI এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  CIA। যেন বাংলাদেশের মানুষ বিপ্লব করতে জানে না।   

যেহেতু সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনার বিজয় অসম্ভব ছিল, সেজন্যই ভারত তাকে ভোটডাকাতির পূর্ণ লাইসেন্স দিয়েছিল। ভারতীয় কুটনীতিকেরা ভোটডাকাতিকে সুষ্ঠ নির্বাচন বলে বিশ্বের দরবারে প্রচার করতো। এবং বিভিন্ন দেশের নেতাদের বুঝাতো মৌলবাদ-আক্রান্ত বাংলাদেশে এর চেয়ে ভাল নির্বাচন সম্ভব নয়। ২০২৪ সালের নির্বাচন-পূর্বে ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছিল, বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদের উত্থান রোধে হাসিনার বিকল্প নাই। আরো বলেছিল, হাসিনার বিরুদ্ধে কোনরূপ হস্তক্ষেপ নিলে সেটি ভারতের নিরাপত্তার জন্য সংকট সৃষ্টি করবে। এবং সংকট সৃষ্টি করবে পাশ্চাত্য বিশ্বের জন্যও। ভারতের আরো যুক্তি, নির্বাচন যে ভাবেই হোক -সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সে যুক্তি মেনে নেয়। কারণ, ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ভারতের নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও। ভারতের ন্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চায় না একটি মুসলিম দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাক এবং মুসলিমদের ক্ষমতায়ন হোক। কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার শক্তির মুখে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকল্প টিকেনি; হাসিনাকে প্রাণ ভয়ে পালাতে হয়েছে।       

শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিজয়কে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের বিজয় মনে করে। এবং তাদের পরাজয়কে তারা নিজেদের পরাজয় মনে করে। ফলে ২০২৪’য়ের ৫ আগস্ট হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও পলায়নকে ভারত মেনে নিতে পারছে না। বাংলার মাটিতে পাকিস্তান আমলে বিহারীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, পাকিস্তান ভাঙ্গার পর ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির নির্মূলের যুদ্ধটি ভারত সব সময়ই লড়েছে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। তাদের যৌথ যুদ্ধটি ভারতীয় দখলদারী বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে। ভারত শুধু ভিতরে লড়ছে না, বাইরেও লড়ছে। তাদের লড়াই এরূপ সকল শক্তির বিরুদ্ধে যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায়। বাংলাদেশে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ চায়, তাদেরকে অবশ্যই নজরে রাখতে হবে ইসলামের-বিরোধী শয়তানী শক্তির পক্ষ থেকে পরিচালিত এ চলমান যুদ্ধকে। সমু্দ্র যাত্রায় সমুদ্রের স্রোতধারা ও বায়ুপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি জানতে হয়, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণে মুজাহিদদের জানতে হয় শয়তানী শক্তির চলমান যুদ্ধ ও তাদের রণকৌশলগুলিকে। তাই আগ্রাসী ভারতের উপর থেকে তারা তাদের দৃষ্টি কখনোই ফিরিয়ে নিতে পারে না। তবে বিদেশী শত্রুদের চেনার সাথে চিনতে হয় ঘরের শত্রুদেরও।

 

বাঁচতে হবে অনৈক্য ও নিষ্ক্রিয়তার  বিপদ থেকে

গৃহ নির্মাণ করতে হলে প্রথম সে স্থান থেকে আবর্জনা ও আগাছা নির্মূল করতে হয়। আশে পাশের এলাকা থেকে বিষাক্ত পোকামাকড় ও হিংস্র বাঘ-ভালুকদেরও নির্মূল করতে হয়। নইলে সেখানে বসবাস কখনোই নিরাপদ হয়না। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে নবীজী (সা:) ও তাঁর অনুসারী সাহাবাগণ তাই শুধু মক্কা, মদিনা ও আরব উপদ্বীপকে কাফিরমুক্ত করেননি, বরং শত্রুশক্তির বিলুপ্ত ঘটিয়েছেন এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল ভূ-ভাগ থেকে। এমন কি নবীজী (সা:) সাহাবীদেরকে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটান্টিনোপল (আজকের ইস্তাম্বুল) দখলের নসিহত করেছিলনে। এতে বুঝা যায়, নবীজী (সা:) বিশ্বের ভূ-রাজনীতিকে কতটা গভীর ভাবে বুঝতেন। যারা শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের মাঝে ইসলামের বিজয় ও মুসলিমদের কল্যাণ দেখেন তাদের এ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।  

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুসলিমদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশটিতে ইসলামের শত্রুদের সংখ্যাটি বিশাল। ইসলামের প্রতিষ্ঠা প্রতিরোধে এবং মুসলিমদের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে শত্রুশক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধটি বহু দিনের। তারা একা নয়, তাদের পিছনে রয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারত। ভারতের পিছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। ভারতের নিজের ইসলামবৈরীতা ও মুসলিম ভীতিও অতি গভীর। ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী ভারতের নিজের যুদ্ধটিও বহুকালের। তাই ভারতসেবী হওয়ার কারণে আওয়ামী বাকশালীরা শুধু গণতন্ত্রের শত্রু নয়, তারা শত্রু ইসলামেরও। ভারতের ন্যায় তারাও চায় না, বাংলাদেশের মাটিতে নবীজী (সা:)‌’র ইসলাম প্রতিষ্ঠা পাক। তারা ২০২৪’য়ের আগস্ট বিপ্লবে পরাজিত হলেও বিলুপ্ত হয়নি। তারা গর্তে ঢুকেছে আগামীতে আরো বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামার জন্য। যারা বাংলাদেশে স্বাধীনতা ও মুসলিমদের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবে তারা কি কখনো শত্রুর এ ষড়যন্ত্রের মুখে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে? মুসলিম জীবনে যেমন নামাজ-রোজায় বিরতি নেই, তেমনি বিরতি নেই জিহাদেও। মুসলিম মাত্রই তো আল্লাহতায়ালার সৈনিক। আর সৈনিকের প্রতিক্ষণের কাজ: হয় সে যুদ্ধে থাকে, অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকে।     

 

বুঝতে হবে, একতার বিকল্প একমাত্র একতাই। ইসলামে একতা ফরজ; এবং বিভক্তি হারাম। একতা বিজয়ের পথ খুলে দেয়, বিভক্তি আনে পরাজয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনৈক্য ও বিভক্তি শুধু নিন্দনীয়ই নয়, গুরুতর অপরাধও। অপরাধ এখানে বিভক্তির মধ্য দিয়ে শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সকল উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেয়ার। মুসলিমদের মাঝে চলমান অনৈক্য এজন্যই শয়তানের কাছে এতো প্রিয়। তারা চায় বিরাজমান অনৈক্য আরো গভীরতর ও স্থায়ী হোক। যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা চায় -এ বিষয়টি বুঝতে তাদের আদৌ ভূল হওয়ার কথা নয়। যারা একতার পথে নাই, বুঝতে হবে, তারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা চায় না। ইসলামের নাম নিয়ে তারা ব্যবসা করে মাত্র। অপর দিকে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা চায় অথচ একতার পথে নাই, বুঝতে হবে তারা বাংলাদেশের ন্যায় শত্রু-অধিকৃত একটি দেশের বাস্তবতা বুঝে না। তারা কি এতোটাই বেকুব যে মনে করে, শত্রুশক্তির দীর্ঘ দিনের বেড়ে উঠা বিশাল বটগাছকে একাই উপড়িয়ে ফেলবে? এমন বেকুবদের দিয়ে কি কখনো মুসলিম ও ইসলামের কল্যাণ হয়? তারা কি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সৈনিক হতে পারে? ঐক্যের পথ ধরতেই হবে। বাংলাদেশে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ চায় তাদেরকে এ বাস্তবতা অবশ্যই বুঝতে হবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *