জান্নাত জুটবে কিরূপে?

 

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

মাগফিরাতের পথই জান্নাতের পথ

মহান আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো জান্নাত। অতুলনীয় ও অভাবনীয় নিয়ামত ভরা হলো সে জান্নাত। সেখানে মানুষ পাবে এক নিরবচ্ছিন্ন আনন্দময় জীবন। সেখানে কোন মৃত্যু নাই; রোগ-বেদনা-দুঃখও নাই। সেখানে, অফুরন্ত শান্তি এবং অভাবেরই অভাব।  জান্নাত পাওয়াই হলো জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া। তবে সেটির একটি মূল্য আছে। কোন ব্যক্তির পক্ষেই জান্নাতের সে মূল্য পরিশোধের সামর্থ্য নাই। সমগ্র পৃথিবীর স্থল ভাগ, জল ভাগ ও পাহাড়-পর্বত যদি স্বর্ণ হয়ে যায়, তা দিয়েও জান্নাতের এক বর্গহাত জমি কেনা যাবে না। জান্নাত পেতে হয় আল্লাহ তায়ালার দান রূপে। সে দানটি পেতে হয় করুণাময় থেকে মাগফিরাত লাভের মধ্য দিয়ে। মাগফিরাতের পথই জান্নাত পাওয়ার পথ। তবে শর্ত হলো, সে মাগফিরাত লাভের জন্য নিজেকে অবশ্যই যোগ্যতর করতে হয়। যোগ্যতর করার সে দায়টি একান্তই ব্যক্তির নিজের। সেটি বলিষ্ঠ ঈমান, তাকওয়া ও নেক আমল দিয়ে। নেক আমল হলো মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ক্যারেন্সি। আপন জনদের চোখের পানি, দোয়া-দরুদ ও দান-সাদকায়ে সে মূল কাজটি হয়না।

তবে মাগফিরাত অর্জনের পূর্ণ সামর্থ্য দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি নারী ও পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন। পথটিও বাতলিয়ে দিয়েছেন। মাগফিরাত কিরূপে জুটে, পবিত্র কুর’আন অসংখ্য বার সেটি সেটি বর্ণনা করেছেন। লক্ষাধিক নবী-রাসূল এসেছেন সে পথটি দেখাতে। সে পথটি অনুসরণ করে ভেড়ার রাখাল, দরিদ্র কৃষক ও দিনমজুর যেমন মাগফিরাত পেতে পারে, তেমনি পারে পল্লীর দরিদ্র গৃহবধু। মাগফিরাত লাভের পথটি ঈমান, তাকওয়া ও নেক আমলের। শুরুটি হয় মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল উপর ঈমান আনার মধ্য দিয়ে।

ঈমানদার হতে দৈহিক বল, অর্থ বল বা বিশ্ববিদ্যালের ডিগ্রি লাগে না; লাগে ভাবনার সামর্থ্য। লাগে, সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা রূপে সনাক্ত করা ও বিশ্বাস করার সামর্থ্য। লাগে, নেক আমলের নিয়ত ও তাড়না। এবং লাগে, মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডা সাথে একাত্ম হওয়ার সামর্থ্য। একমাত্র এ পথেই জুটে মাগফিরাত। মাগফিরাত লাভের পথটিই হলো জান্নাতের পথ।

 

সামর্থ্যটি ফেরশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হওয়ার

মানুষকে দেয়া মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া সামর্থ্যটি বিশাল। তাঁকে সামর্থ্য দেয়া হয়েছে মহান রব’য়ের খলিফা তথা নির্বাহী অফিসারের। যে কোন রাজাও ব্যক্তির যোগ্যতা ও সামর্থ্য দেখে খলিফার দায়িত্ব দেয়; কোন অযোগ্য ব্যক্তির উপর সে দায়িত্ব চাপায় না।  ফলে সহজেই বোধগম্য যে, সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালাও কোন অযোগ্য সৃষ্টিকে এ পুথিবী পৃষ্ঠে তাঁর খলিফা রূপে নিয়োগ দেননি। মানবের উপর অর্পিত খলিফার দায়ভারই তার যোগ্যতার পরিমাপ দেয়।। তাঁর পক্ষ থেকে দেয়া দৈহিক, মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেয়ামত ও ইবাদতের সামর্থ্যের সঠিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যে কোন নিংস্ব মানুষও ফিরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হতে পারে -যেমনটি সাহাবীদের মাঝে দেখা গেছে। সে নিয়ামতগুলি কাজে লাগিয়ে একজন ভেড়ার রাখাল, দরিদ্র কৃষক এবং নিঃস্ব দিনমজুরও নিজেকের মাগফিরাত লাভের জন্য যোগ্য করতে পারে। স্রেফ মুখের কথা ও লেখনী দ্বারা এমন নেক আমল করা যায় -যা কোটি টাকা দান করেও সম্ভব নয়। সেটি সম্ভব হয় সত্য বাণী প্রচার করে এবং সত্যের পক্ষে সাক্ষী দিয়ে, এবং সম্ভব মিথ্যা ও দুর্বৃত্তি নির্মূলের জিহাদে নেমে।

নবী-রাসূলগণ সম্পদশালী ছিলেন না। তাদের নেক আমলের মূল হাতিয়ারটি ছিল জিহবা তথা মুখের কথা। সে জিহবাকে তাঁরা ব্যবহার করেছেন অন্যদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর কাজে। এর চেয়ে বড় নেক কর্ম আর কি হতে পারে? তাঁরা পথহারা মানুষদের জান্নাতের পথ দেখিয়েছেন। হাজার কোটি টাকা দানেও কি এমন নেক আমল সম্ভব? নেক আমলের রয়েছে আরো অসংখ্য পথ। সেটি যেমন পথ থেকে কাঁটা তুলে, পথিককে পথ দেখিয়ে, ক্ষুদার্ত ব্যক্তিকে খাদ্য দিয়ে, জ্ঞানহীনকে জ্ঞান দিয়ে এবং বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দিয়ে। নেক আমল করতে পারে নির্বাচনে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দিয়ে। মানুষ শিক্ষিত হবে, নানারূপ দক্ষতা অর্জন করবে এবং উপার্জনের নামবে শুধু নিজের আনন্দ বাড়াতে নয়, বরং নেক আমলের সামর্থ্য বাড়াতে। সে ব্যক্তির চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আর কে যে তার সকল সামর্থ্য শুধু নিজের আরাম-আয়াশ বৃদ্ধিতেই ব্যয় করলো এবং কিছুই যোগ করলো না নেক আমলের ভান্ডারে? এরূপ ব্যক্তিরাই ব্যর্থ হয় মাগফিরাত পেতে। তারাই বাসিন্দা হয় জাহান্নামের। 

 

কিরূপে জাহান্নাম জুটে?

জীবনের সবচেয়ে বড় খেয়ানত হলো আল্লাহ তায়ালা-প্রদত্ত দৈহিক, অর্থনৈতিক ও চিন্তা-ভাবনার সামর্থ্যকে শয়তানের  এজেন্ডাকে বিজয়ী করায় ব্যয় করা। প্রশ্ন হলো, শয়তানের এজেন্ডা কি? সেটি হলো, আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনকে বিলুপ্ত করার রাজনীতি। সেটি হলো, প্যান-ইসলামী ঐক্যের বদলে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চলের নামে মুসলিম দেশকে বিভক্তি করার জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। সেটি হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের বদলে সেক্যুলার রাষ্ট্র নির্মাণের রাজনীতি। শয়তানের সে নাশকতার এজেন্ডার সাথে একাত্মতাই হলো রাব্বুল আলামীনের সাথে নিকৃষ্টতম গাদ্দারী। এরূপ গাদ্দারী জাহান্নামকে অনিবার্য করে। এমন ব্যক্তির নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত এবং দোয়া-দরুদ কাজ দেয়না।

নেক আমল যেমন জান্নাতে নেয়, তেমনি পাপ কর্ম নেয় জাহান্নামে। তাই শুধু নেক আমল করলেই চলে না, বাঁচতে হয় পাপকর্ম থেকেও। সবচেয়ে বড় পাপ কর্মটি শুধু মহান আল্লাহ তায়ালাকে অবিশ্বাস করা নয়, বরং সেটি তার তাঁর শরিয়তী বিধানকে অস্বীকার করা এবং সে বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়া। রাজার আইন অমান্য হলে কি রাজার রাজত্ব বাঁচে? এ অপরাধে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। তেমনি শরিয়তী আইন পালিত না হলে কি মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব বাঁচে? তাই দেশের আদালতে শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা না দেয়াটি হলো এক ভয়ংকর পাপ। এ পাপ ব্যক্তিকে কাফের, জালেম ও ফাসেকে পরিণত করে –যা বলা হয়েছে সুরা মায়াদের ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে। অথচ সে পাপটিই প্রতিক্ষণ হচ্ছে বাংলাদেশে। এ ভয়ংকর পাপের সাথে জড়িত যেমন শাসক চক্র, তেমনি জড়িত জনগণও। এক্ষেত্রে জনগণের পাপটি হলো, শরিয়তের বিলুপ্তিকে বিনা জিহাদ ও বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়ায়। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে মুসলিমদের পক্ষ থেকে এটি হলো বড় মাপের পাপ।     

 

জিহাদ: মাগফিরাত লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার

নেক আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষেত্রটি হলো জিহাদ। কারণ, জিহাদই হলো মাগফিরাত লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। হাদীসে বলায় হয়েছে, জিহাদের ময়দানে রক্ত ঢেলে দেয়ার সাথে সাথে সে মাগফিরাত পায়। শহীদের জীবনে কখনো মৃত্যু আসে না, সে মৃত্যুহীন জীবন পায় সরাসরি প্রবেশ করে জান্নাতে। শহীদ হওয়ার পরও সে রিযিক পায়। রোজ হাশরের বিচার দিনে শহীদকে বিচারের কাঠগড়ায় উঠতে হবেনা। প্রশ্ন হলো, জিহাদ কি? মিথ্যা ও অন্যায়ের নির্মূল এবং কুর’আনী সত্য ও ন্যায়কে বিজয়ী করার প্রতিটি প্রচেষ্টাই হলো জিহাদ। এটি হলো শয়তানী শক্তির নির্মূলের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার যুদ্ধ। সে জিহাদ যেমন কথার সাহায্যে হতে পারে, তেমনি হতে পারে লেখনী, অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যেও। নবীজী (সাা:)’র হাদীস: জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা উত্তম জিহাদ। জালেমের নির্মূলে যে ঈমানদারগণ নিজের জান বিলিয়ে দেয় -তারাই শহীদের মর্যাদা পায়।

যে দেশের মানুষের মাঝে মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার আগ্রহটি প্রবল, সে দেশে নেক আমলের জোয়ারটিও প্রবল। সে দেশে জালেম শাসক থাকতে পারে না। কারণ, জালেম শাসকের নির্মূলকে তারা আল্লাহকে খুশি করা ও জান্নাত লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম মনে করে। মাগফিরাত লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যমটি যেহেতু দুর্বৃত্ত শাসক নির্মূলের জিহাদ, ঈমানদারদের প্রচণ্ড ভিড় জমে জিহাদের ময়দানে। জনপদে বিষাক্ত সাপ বা হিংস্র পশু ঢুকলে সভ্য মানুষ মাত্রই সেটিকে বধ করে। একই কাণ্ড ঘটে শাসনক্ষমতায় কোন দুর্বৃত্ত বসলে। দুর্বৃত্তমুক্ত সভ্য রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজ তো এভাবেই গড়ে উঠে। এভাবেই পরিশুদ্ধি আসে রাষ্ট্রে।

কিন্তু যে দেশে চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত, খুনি ও সন্ত্রাসীর দীর্ঘ দিনের শাসন এবং জনগণের মাঝে নাই কুর’আনের জ্ঞান এবং নাই দুর্বৃত্ত শাসক নির্মূলের জিহাদ, বুঝতে হবে সে দেশে মাগফিরাত লাভে আগ্রহী মানুষের সংখ্যাটি অতি নগন্য। এমন দেশে প্রচণ্ড ভিড় জমে জাহান্নামের পথে। সেটি বুঝা যায় জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, সেক্যুলার শিক্ষা-সংস্কৃতি, সূদের  অর্থনীতি এবং দুর্বৃত্তির পথে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিড় দেখে। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে তেমন একটি দেশে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *