কোর’আন বুঝায় ব্যর্থতা ও তার পরিণাম

ডাক্তারী বই বুঝতে অতি অপরিহার্য হলো, বইয়ের ভাষা, জীববিদ্যা, মানব শরীরের এ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রিসহ বহু বিষয়ের জ্ঞান। তেমনি কোর’আন বুঝার জন্য শুধু আরবী ভাষা জানলেই চলে না। কোর’আন বুঝার সামর্থ্য বাড়াতে অতি জরুরী হলো, ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, এবং কোর’আন নাযিল কালে আরবদের মাঝে প্রচলিত রীতি-নীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিসহ বহু বিষয়ের জ্ঞান। অথচ বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞানদানের ক্ষেত্রটি অতি সীমিত। গুরত্ব পায়নি ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর শিক্ষাদান। ফলে লক্ষ লক্ষ ছাত্র সেখান থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে বের হলেও কোর’আনের উপর উন্নত মানের তাফসির-কারক সৃষ্টি হচ্ছে না। বাংলা ভাষায় যেসব তাফসির গ্রন্থ্ বাজারে পাওয়া যায় –সেগুলির অধিকাংশই উর্দু বা আরবি ভাষা থেকে অনুদিত। বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার এ এক বিশাল ব্যর্থতা।

অথচ পবিত্র কোর’আন বুঝার সামর্থ্য না থাকলে “আব্‌দ”, “ইবাদত”, “আব্দুল্লাহ’ “ইবাদুর রাহমান”য়ের ন্যায় পবিত্র কোর’আনে ব্যবহৃত অতি গুরুত্বপূর্ণ বহু পরিভাষাই বুঝতে দারুন ভূল হয়। এতে অজ্ঞতা থেকে যায় প্রকৃত ইসলাম নিয়ে। তখন অসম্ভব হয় প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। “আব্‌দ”য়ের অর্থ গোলাম এবং “ইবাদত”য়ের অর্থ গোলামী। মুসলিম হওয়ার দায়বদ্ধতা হলো তাকে বাঁচতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার একনিষ্ঠ “গোলাম”য়ের পরিচিতি এবং ইবাদত তথা গোলামীর দায়ভার নিয়ে। কিন্তু কীরূপ হবে গোলামের সে পরিচিতিটি এবং কীরূপ হবে সে গোলামী? কোথা থেকে জানবে সে প্রকৃত গোলাম ও গোলামীর পরিচিতি? শুধু কোর’আনের হাফিজ বা ক্বারী হলে সে পরিচিতি বুঝা বা চেনা যায় না। এবং সে পরিচিতি নিয়ে বেড়েও উঠাও যায় না। অথচ বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এখানে ভূল হলে ভূল হবে মুসলিম রূপে বাঁচায়। ফলে ব্যর্থতা জুটবে পরকালে। আবদ (গোলাম) ও ইবাদত (গোলামী)’র সঠিক অর্থ বুঝতে হলে নবীজী (সাঃ)র সমকালীন সময় থেকে এর অর্থ  বুঝতে হবে। এ শব্দ দু’টির অর্থ বাংলাদেশের বা আধুনিক আরব দেশগুলির প্রেক্ষাপটে বুঝলে তার প্রকৃত অর্থ জানায় যেমন ভূল হবে, তেমনি মুসলিম রূপে বাঁচাতেই প্রচণ্ড বিচ্যুতি আসবে।

 

নবীজীর যুগে আরবের বহু ঘরে গোলাম ছিল এবং তাদের সর্বজন স্বীকৃত একটি পরিচিতিও ছিল। গোলামকে বাঁচতে হতো তার মনিবের প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ-আনুগত্য নিয়ে। মনিবের এজেন্ডা পূরণে শুধু ঘরসংসার ও ক্ষেতখামারে কাজ করাই যথেষ্ট ছিল না, মনিবের নির্দেশে তার শত্রুদের বিরুদ্ধে সর্বসামর্থ্য দিয়ে যুদ্ধেও নামতে হতো। সে যুদ্ধে প্রয়োজনে প্রাণও দিতে হতো। মনিবের কোন হুকুমের অবাধ্যতার শাস্তি স্বরূপ তাকে যদি মনিব আগুণের অঙ্গারের উপর শুইয়ে রাখতো, হত্যা করতো বা জীবিত কবর দিত -তবুও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কোনরূপ অধীকার গোলামের ছিল না। সমাজে তা নিয়ে প্রতিবাদও উঠতো না। কারণ সেটিই ছিল তৎকালীন সমাজের রীতি। তাই হয়রত সুমাইয়া ও তাঁর স্বামী হযরত ইয়াছিরকে যখন তাঁদের কাফের মনিব ইসলাম কবুলের শাস্তি স্বরূপ নির্মম ভাবে হত্যা করে তখন সমাজে কোন প্রতিবাদ উঠেনি। হযরত খাব্বাবকে যখন তাঁর মালিক মক্কার লোকালয়ে আগুণের অঙ্গারের উপর শুইয়ে রেখেছিল তখনও কোন প্রতিবাদ উঠেনি। অথচ গোলাম নয় এমন কোন মানুষকে হত্যা করলে সে আরবের বুকেই তৎকালে যুদ্ধ শুরু হতো। তখন গোলামদের হাটেবাজারে কেনাবেচা হতো এবং তাদের উচ্চ মূল্যও ছিল। মনিবের কাছে বিক্রয় হওয়ার কারণেই তাদের বাঁচতে হতো মালিকের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে। কিন্তু আধুনিক যুগে গোলামের সে পরিচয়টি বেঁচে নাই। গোলাম এখন আল ক্রীতদাস নয়, ফলে মনিবের হুকুম না মানলে বড় জোর চাকুরি যায়, কিন্তু নিহত হতে হয় না। ফলে আজকের যুগের বিরাজমান এ ধারণা নিয়ে কোরআন “আবদ” ও “ইবাদত”য়ের  যে ধারণা পেশ করেছে সেটি বুঝা অসম্ভব।

 

নবীজী (সাঃ)র যুগে ক্রীতদাস বা গোলামের জীবনে গোলামীর যে সার্বক্ষণিক এক দায়বদ্ধতা ছিল তেমন এক দায়বদ্ধতা নিয়ে বাঁচতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার বান্দাহ বা গোলামকে। প্রকৃত অর্থে কেউ ঈমান আনলে মহান আল্লাহতায়ালা সে ব্যক্তির সাথে তাঁর জানমাল কিনে নেয়ার একটি পবিত্র চুক্তি সমাধা করেন। বিক্রয়কৃত গোলাম রূপে তাঁকে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া কিছু কাজও করতে হয়। সেটিই অতি সুস্পষ্ট ভাবে বর্নীত হয়েছে সুরা তাওবার ১১১ নং আয়াতে। বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের থেকে ক্রয় করে নিয়েছেন তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। (আর ক্রয়কৃত গোলাম রূপে) তাঁরা যুদ্ধ করে আল্লাহতায়ালার রাস্তায়; অতঃপর তাঁরা হত্যা করে (ইসলামের শত্রুদের) এবং নিজেরা্ও (শত্রুদের হাতে) নিহত হয়। আল্লাহর সে প্রতিশ্রুত ওয়াদাটির সত্যতা বর্ণীত হয়েছে তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোর’আনে। আর প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আল্লাহর চেয়ে কে শ্রেষ্ঠতর? অতএব তোমরা উৎফুল্ল হও মহান আল্লাহতায়ালার সাথে কৃত এ ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিতে। আর এটিই তো হলো সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য।”

মহান আল্লাহতায়ালার ক্রয়কৃত গোলাম রূপে ঈমানদারের দায়িত্ব তাই শুধু নামায-রোযা আদায় নয়,বরং সে দায়ভারটি আরো বিশাল। সেটি হলো মহান প্রভুর প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য। অবাধ্যতা হলে সে কাফেরে পরিণত হয়। তাই ঈমানদার কখনোই নিজে সার্বভৌম শাসক হতে পারে না। বরং তাঁর দায়িত্ব হয়, মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তক প্রতিষ্ঠা দেয়া। সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট ও স্বৈরাচারি শাসকদের ক্ষমতায় বসিয়ে সে কাজ সম্ভব নয় বলেই অনিবার্য হয়ে উঠে যুদ্ধ। মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তের প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিত করতে মহান নবীজী (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাগণও তাই যুদ্ধ এড়াতে পারেননি। বরং তিনি নিজে যেমন গুরুতর আহত হয়েছেন, তেমনি তাঁর সাহাবাদের শতকরা ৭০ ভাগের  বেশী শহীদ হয়েছেন। শরিয়ত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, মুসলিমগণ বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছে এবং দেশে দেশে ইসলামের বিজয় ছড়িয়ে পড়েছে তো তাদের সে কোরবানীর ফলেই।

 

কিন্তু এক্ষেত্রে আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতাটি বিশাল। তারা ব্যর্থ হয়েছে “আবদ” ও “ইবাদত”র অর্থ বুঝতে। তাদের ইবাদত সীমিত হয়ে আছে নামায-রোযা, হজ-যাকাতের ন্যায় কিছু আনুষ্ঠিকতার মাঝে। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, যুদ্ধবিগ্রহ, আইন প্রণয়ন ও বিচার-আচারের অঙ্গণে সে যেন স্বাধীন ও সার্বভৌম।   অথচ এরূপ স্বাধীন ও সার্বভৌম হওয়াটাই কুফরি। মুসলিমের দায়িত্ব এখানে খেলাফতের তথা গোলামসুলভ প্রতিনিধিত্বের। কোর’আন বুঝায় ব্যর্থতার কারণেই হাফিজ, ক্বারী, মাদ্রাসার শিক্ষক বা মসজিদের ইমাম হওয়া সহজ হয়েছে; কিন্তু অতি কঠিন হয়েছে আল্লাহতায়ালার কাছে বিক্রয়কৃত গোলাম হওয়াটি।  ফলে মুসলিম দেশগুলিতে শরিয়তের বিলুপ্তি এবং ইসলামের আত্মস্বীকৃত শত্রুদের বিজয় যেমন আজ এক নিরেট বাস্তবতা, তেমনি আরেক বাস্তবতা হলো আল্লাহর কাছে বিক্রয়কৃত গোলাম রূপে বেড়ে উঠতে মুসলিমদের ব্যর্থতা। বরং তারা নিজেদের শ্রম, মেধা ও জানমাল বিক্রয় করছে ইসলামের শত্রুদের বিজয়কে বাঁচিয়ে রাখতে। এদের কারণেই মুসলিম দেশগুলিতে প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, মিডিয়া এবং রাজনৈতীক দল চালাতে ইসলামের ঘোরতর শত্রুদেরও লোকবলের অভাব হয় না। বিপুল লোকবল পাচ্ছে চোর-ডাকাত, ভোট-ডাকাত এবং গুম-খুনের রাজনীতির অপরাধী নেতা-নেত্রীগণও। ঔপনিবেশিক শাসন আমলে এমনকি ইউরোপীয় কাফেরদের কাছেও তারা নিজেদের বিক্রয় করেছে অতি সস্তা মূল্যে। পরিতাপের বিষয় হলো, কোর’আন বুঝায় গভীর ব্যর্থতার কারণে এরাও মুসলিম সমাজে মুসলিম রূপে পরিচিতি পায়।  মুসলিমদের সবচেয়ে ব্যর্থতা তাই কৃষি, অর্থনীতি, বা ব্যবসা-বাণিজ্যে নয়, বরং সেটি হলো কোর’আন বুঝায়। মহান আল্লাহতায়ালা তার নবীকে দিকে যেখান থেকে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি শুরু করেছিলেন সেটিই আজ গুরুত্ব হারিয়েছে মুসলিম দেশগুলিতে। ফলে ব্যর্থতা শুধু দুনিয়াতেই বাড়ছে না, ভয়াবহ ব্যর্থতা অপেক্ষা করছে আখেরাতেও। এবং সেটি অনন্ত-অসীম কালের জন্য। ০২/০৭/২০‌৯  

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *