একাত্তরের গণহত্যা (৯)
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on January 12, 2021
- Bangla Articles, অতিথি লেখক
- No Comments.
যে কাহিনী শুনতে নেই (১৪)
সংগ্রহে: কায় কাউস
================
দিনাজপুর হত্যাকান্ড
০১.
“… জামাল হায়দার তার অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন। মার্চ মাসে তিনি পার্টির নির্দেশে দিনাজপুর ছিলেন। ২৫ মার্চের পর দিনাজপুর ছিল স্বাধীন। সেখানে রাজনৈতিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল। ছয়জনকে নিয়ে একটা কমিটি গঠিত হয়েছিল, যারা দিনাজপুরের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সে কমিটিতে ছিলেন হাজী দানেশ (ভাসানী-ন্যাপ), অধ্যাপক ইউসুফ আলী (আওয়ামী লীগ), গুরুদাস তালুকদার (কমিউনিস্ট পার্টি), এস এ বারী (ভাসানী-ন্যাপ), মোস্তফা জামাল হায়দার ও এজেডএম ইউসুফ মোজাফফর (মুসলিম লীগ, পরবর্তীতে ইউপিপি)। দিনাজপুরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। পরিস্থিতি বেশ ভালই ছিল। এমন সময় সৈয়দপুর থেকে পশ্চাৎপসরণরত বাঙালি সৈন্য ও ইপিআর সদস্যরা দিনাজপুর শহরে চলে এলে উক্ত কমিটি তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বাঙালি সৈন্যরা উর্দুভাষীদের হত্যা করতে শুরু করে। তখনকার এক মর্মস্পর্শী কাহিনী শুনিয়েছেন জামাল হায়দার।
আমাদেরই দলের এক কিশোর বালুবাড়িতে থাকতো। তাদের প্রতিবেশী ছিল পাঞ্জাবি সেনা অফিসার। তার এক কিশোরী কন্যা ছিল। দু’জন পরস্পরকে চিনতো, হয়তো পরস্পরকে ভালো লাগতো। কিন্তু যাকে বলে প্রেম তেমন কিছু ছিল না।
নদীর পাড়ে দাঁড় করানো হয়েছে পাক সৈন্য ও অবাঙালি পরিবারদের। ইপিআর সদস্যরা তাদের গুলি করে মারবে। বালুবাড়ির সেই কিশোরটি দেখছে, তার প্রতিবেশী পরিবার ও সেই কিশোরী মৃত্যদন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্তদের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটি ছটফট করছে, হয়তো ভাবছে কোনভাবে বাঁচানো যায় কিনা তার চেনা সেই কিশোরীটিকে। হোক না সে উর্দুভাষী। কিন্তু সে তো কোন অন্যায় করেনি। ভালো লাগার দাবি নিয়ে কি তাকে বাঁচানো যায় না? না, যায় না। এমন পরিবেশে কিছুই করা যায় না। এ যে যুদ্ধ। তবু ছেলেটির মন মানছে না, সে ছটফট করছে।এমন সময় সেই কিশোরী দেখতে পেল উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতিবেশী কিশোর। মেয়েটি তখন তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে আরম্ভ করলো’ — ‘ভাই, মুঝে বাঁচাও, মুঝে বাঁচাও।’ এক পর্যায়ে মেয়েটি উচ্চস্বরে বলে উঠলো, — ‘মুঝে বাঁচাও, ম্যায় তুমকো শাদী করোঙ্গা, মুঝে বাঁচাও।’ কিন্তু কোন আর্ত নিবেদন কোন কাজে আসেনি। অপরদিক থেকে একটি রাইফেলের গুলি মেয়েটির কন্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিল॥”
— হায়দার আকবর খান রনো / শতাব্দী পেরিয়ে ॥ [ তরফদার প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ । পৃ: ২৬২-২৬৩ ]
০২.“
… আমরা যারা ছাত্রলীগে ছিলাম তারা স্কুল কলেজগুলোতে ক্যাম্পেইন চালাতাম কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী। ২৫ মার্চের আগে এই এলাকায় বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিলো। এই এলাকার পার্বতীপুর এবং সৈয়দপুরে বিপুলসংখ্যক বিহারী (অবাঙালি মুসলিম) ছিলো। ফুলবাড়ি এবং অন্যান্য স্থানেও বিহারী ছিলো। কিন্তু তারা আইসোলেটেড অবস্থায় ছিলো। আমার কিছু ক্লাসমেটও বিহারী ছিলো। ফুলবাড়ি যেহেতু একটা ছোট এলাকা সেহেতু ঐ সময় বাঙালি বিহারীদের মধ্যে তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দিনাজপুরে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছিলো। কিন্তু সেগুলোও অতো বড় নয়। খুব একটা লার্জ স্কেলে তেমন ঘটনা ঘটেনি। পার্বতীপুরে সে সময় বাঙালিরা খুব কম যাতায়াত করতো। কিন্তু তারপরও ছোটোখাটো কিছু ঘটনা সেখানে ঘটেছে। তখন বিহারীরা সংগঠিত হচ্ছিলো। বাঙালিরাও সংগঠিত হচ্ছিলো। আমরা সংবাদ পেতাম যে, বিহারীরা মিছিল বের করেছে। তখন বাঙালিরাও তাদের প্রতিরোধ করার জন্য মিছিল নিয়ে বেরিয়েছে। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে মারামারি হয়েছে। একদম শেষের দিকে অর্থাৎ ২৫ মার্চের আগ দিয়ে দিনাজপুরে বাঙালি বিহারী সংঘাত হয়েছে। দিনাজপুর হাউজিংয়ে বিহারীরা বসবাস করতো। সেখানে একটা সংঘাত হয়॥”
— মেজর জেনারেল (অব:) আবু লায়েস মো: ফজলুর রহমান / (সাক্ষাৎকার)
তথ্যসূত্র : দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ / সম্পা : মোহাম্মদ সেলিম ॥[ সুবর্ণ – মার্চ, ২০১১ পৃ: ১৫০ ]
০৩.
“… সেই স্মৃতি কিছুটা বেদনাদায়ক। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমাদের এলাকায় বেশ কিছু অবাঙালি বাঙালিদের হাতে নিহত হয়েছিলো, যেটা আমার কাছে অমানবিক বলে মনে হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের পর্যন্ত যেভাবে মারা হয়েছিলো তা ছিল বেদনাদায়ক। এমন ঘটনাও দেখা গেছে যে, অবাঙালি ইপিআর অফিসারের বউকে গোল পোস্টের বারে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে সাধারণ মানুষকে দেখাবার জন্যে। এই সমস্ত ঘটনা আমার কাছে পৈশাচিক বলে মনে হয়েছিলো। আমাদের ইপিআর-এর সাথে আনসার ও মুজাহিদরা মিলে এই খুন-খারাবিগুলো করেছিলো বলে জানি। আমি তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারা বলেছিলো, উকিল সাহেব আমাদের রাইফেলটা কিন্তু উল্টো দিকে ঘুরে যেতে পারে, কথা বলবেন না। তখন আমি তাদেরকে কিছু বলিনি। কিন্তু মর্মাহত হয়েছিলাম।
মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের ১২ তারিখের মধ্যে এ সব ঘটনা ঘটেছিলো। দিনাজপুর জেলার গোটাটাতেই ঘটেছে। কিন্তু সব ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখিনি। ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছি।
ঠাকুরগাঁও শহরের উত্তর পাশে গার্লস স্কুলের পাশে নদী ছিলো। সেই নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে তাদের গুলি করে মারা হতো। অনেকের নাম আমার মনে পড়ে। বিহারী হায়াত আশরাফ ও তার ছেলে। আমাদের বন্ধু আনোয়ার, কমর সলিম, ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার, সাইফুল্লাহ, কুদ্দুস — এদের কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলো। আর এক খাঁ ও তার ছেলে পেলেরা। তার এক ছেলে অবশ্য বেঁচে আছে।
অবাঙ্গালিদের হত্যার ব্যাপারে ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি বা আর যারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাদের কোনো হাত ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় ইপিআর ক্যাম্প থেকে যারা অস্ত্রসহ বেরিয়ে আসলো এবং আনসার ও মুজাহিদ যাদের কাছে রাইফেল ছিলো, গুলি ছিলো, তারাই এ সব কাজ করেছে। তাদের সঙ্গে অবশ্য কিছু দুষ্কৃতিকারীও ছিলো। তাদের উপর প্রকৃতপক্ষে কারোরই নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। কোনো ধরণের নিয়ন্ত্রই ছিলো না। যারা অবাঙ্গালি নিধন করেছিলো — তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমি পরে কথা বলেছি। তাদের ভীতিটা ছিলো এই রকম — পরবর্তীকালে দেশে যদি শান্তি ফিরে আসে এবং সরকার কাজ করে তখন এই অবাঙালিরাই আমাদের চিনিয়ে দেবে যে এরা ইপিআর ছিলো। এরা এই কাজ করেছে। তখন আমাদের কোর্ট মার্শাল হবে। আমরা মারা যাবো।
কমর সলিমের বাড়িতে বহু অবাঙালি আশ্রয় নিয়েছিলো, সেখানে গিয়ে গুলি করে করে হত্যা করা হয় তাদেরকে। পাশবিক অত্যাচার করে গুলি করা হয়েছে এমন ঘটনা আমাদের এলাকায় কম। জেলখানায় কিছু লোক রাখা হয়েছিলো। জেলখানা থেকে বের করে তাদের গুলি করে মারা হয়েছিলো। আমি এবং কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল হোসেন আমরা দু’জনেই চেষ্টা করেছিলাম খুন খারাবিটা বন্ধ করতে। কিন্তু তারা বন্ধ তো করেইনি, উল্টো আমাদের ভীতি প্রদর্শন করলো যে, তাদের রাইফেলের নল আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। বস্তুত: সে সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব কার্যকর ছিলো না, ছিলো রাইফেলধারীদের নেতৃত্ব। আজ আমার নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। এই সমস্ত লোককে আমরা আশ্বাস দিয়েছিলাম যে, চিন্তা করো না, কোনো অসুবিধা হবে না। আসলে আমাদেরও ধারণা ছিলো না যে, তাদেরকে এভাবে গুলি করে মারা হবে। আমরা যদি তাদেরকে বলতাম যে, রাতের অন্ধকারে যে যেদিকে পারো পালিয়ে যাও, তাহলেও হয়তো অনেক জীবন রক্ষা পেতো। কিন্তু আমরা তাদের বলেছি চিন্তা করবেন না, আমরা তো আছি। কিন্তু প্রয়োজনের সময় আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ছিলো না। যার হাতে অস্ত্র তার হাতেই ক্ষমতা। আমি বাধা দিতে গিয়ে বিপদগ্রস্থ হয়েছিলাম। আমরা পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা।
হত্যার সঙ্গে সম্পদ লুন্ঠনের ব্যাপার ছিলো। লুন্ঠনটা কোনো বিশেষ অর্থে কাজ করেছে বলে মনে হয় না। লুন্ঠনটা যে কেবল গুটিকয়েক অস্ত্রধারীরা করেছে তা নয়, বরং আমার জানা মতে, লুন্ঠনটা করেছে সাধারণ মানুষ। গ্রাম-গঞ্জ থেকে লুন্ঠনকারীরা এসে বিভিন্ন জায়গায় তারা লুট করেছে। এ সব আমরা নিজ চোখেই দেখেছি। এরা পলিটিক্যালি মটিভেটেড নয়। তারা কোনো রাজনৈতিক দল বা সেই দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলো না। তাদের মূল কাজটাই ছিলো লুট করা। গ্রাম থেকে লোকজন এসে পাগলের মতো সব লুট করেছে। আর আমরা অসহায়ের মতো তা দেখেছি, কিছুই করতে পারিনি। অবাঙালিদের তো বটেই, আমরা যখন চলে গিয়েছি বা যাচ্ছি তখন আমাদেরগুলোও লুট হয়েছে।আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে গেছে
আমার যেটা বেশি করে মনে হয় সেটা হলো — অবাঙালিদের কেউ কেউ আমাদের উপর অনেকটাই নির্ভর করেছিলো। তারা ভেবেছিলো, বিপদের সময় আমরা তাদের সাহায্য করতে পারবো। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারিনি। এটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমরা যখন দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে লাগলাম তার আগ পর্যন্ত অবাঙালিদের মারা হয় এবং তাদের সঙ্গে যে গহনা ও টাকা-পয়সা ছিলো সেই সব গহনা ও টাকা-পয়সা কন্ট্রোল রুমে জমা হচ্ছিলো এবং সেটার পরিমাণ ছিলো প্রচুর। সোনাদানা, টাকা সব ট্রাঙ্কে রাখা হচ্ছিলো এবং সার্বক্ষণিক সেখানে পাহারাদার ছিলো। যাদের মারা হচ্ছিলো বিভিন্ন জায়গায় সেখান থেকেই সংগৃহীত অর্থ-সম্পদ কন্ট্রোল রুমে জমা করা হচ্ছিলো। যারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো তারা কিছু নিয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু বেশিরভাগই জমা হয়েছিলো কন্ট্রোল রুমে। এক সময় এই জমার পরিমাণটা, সোনা-দানা এবং টাকা-পয়সায় বেশ বড় আকার ধারণ করলো। ঠাকুরগাঁও যখন পতন হতে শুরু করলো তখন কতিপয় নেতা এ সব সম্পদ নিয়ে পালিয়ে গেলো। আমি তাদের নাম বলবো না। আমি নিজ চোখে দেখেছি কারা এ সব নিয়ে গেছে। ঐ সব ব্যক্তিরা কিন্তু ভারতে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো অবদান রাখেনি। তারা ঐ সব গয়নাগাটি, টাকা-পয়সা কিভাবে কোথায় রাখবে এইসব নিয়ে ব্যস্তছিলো
এরা কোন দলে সেটা আমার জানা। কারণ ঠাকুরগাঁও ছোট জায়গা। আমি সবাইকে বিশেষভাবে চিনি। কিন্তু আমি তাদের নাম বলবো না। কারণ আমার নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। কোন্ ব্যক্তি, কোন্ দলের, কারা কারা ব্যাঙ্ক লুট থেকে টাকা নিয়েছে এ সবই আমি জানি।কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারবো না।
আমাদের এলাকার অবাঙালিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখন — যখন পাকিস্তানিরা ঠাকুরগাঁও দখল করলো। তারা এটা করেছে জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য। আমি জানি, ঠাকুরগাঁওয়ে এ সময় রাজনৈতিকভাবে এমন কোন অবাঙালী নেতৃত্ব ছিলো না যে, তারা রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষে বা আমাদের বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে পাকিস্তানি আর্মিরা যখন আমাদের এলাকা দখল করে নিলো এবং আমরা আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে আসলাম তখন তারা অনেক অন্যায় কাজ করেছে। কেউ অর্থ-সম্পদ লুন্ঠনের জন্য করেছে আবার কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে করেছে এ কথা আমরা বলতে পারি॥”
— এডভোকেট বলরাম গুহঠাকুরতা / (সাক্ষাৎকার)
তথ্যসূত্র : দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ / সম্পা : মোহাম্মদ সেলিম ॥ [ সুবর্ণ – মার্চ, ২০১১ । পৃ: ১৭৯-১৮২ ]
০৪.
“… ১৯৭১ সালে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে দিনাজপুরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উসকানিমূলক ভাষণে বাঙালিদের উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছে। প্রতিবাদ বিক্ষোভ, সহিংসতা এবং অবাঙালিদের ভয়ভীতি প্রদর্শনে তাদের এ উন্মত্ততার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আওয়ামী লীগের জঙ্গিরা স্থানীয় প্রশাসন অচল করে দেয় এবং তারা ভয়ভীতি প্রদর্শনের রাজত্ব কায়েম করে।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বিদ্রোহ এবং বেসামরিক প্রশাসন অচল করে দেয়ার সাফল্য আওয়ামী লীগকে আরো দুঃসাহসী করে তোলে। তাতে সহিংসতার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এসময় অবাঙালিদের ওপর দুর্যোগ নেমে আসে। মার্চের দ্বিতীয় পক্ষকালে এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দানবীয় শক্তিতে অবাঙালি জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করার অভিযান পরিচালনা করা হয়। দিনাজপুর শহরে আওয়ামী লীগের এক মাসের সন্ত্রাসে অবাঙালিদের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ৩০ হাজার। অন্যদিকে গোটা দিনাজপুর জেলায় অবাঙালিদের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল এক লাখ। কাঞ্চন নদীর তীরে উন্মূক্ত কসাইখানায় হাজার হাজার অবাঙালিকে হত্যা করা হয়। বসত বাড়ির লোকজনকে হত্যা করার পর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। জলন্ত বাড়িঘরে লাশশুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করছেন যে, কাঞ্চন নদীতে অসংখ্য লাশ ভাসিয়ে দেয়ায় এবং জলন্ত আগুনে পুড়িয়ে ফেলায় নিহতদের সংখ্যানিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়
২২ মার্চ স্টেনগান ও রাইফেল উঁচিয়ে আওয়ামী লীগ শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি জঙ্গি মিছিলের নেতৃত্ব দেয়। মিছিল থেকে অবাঙালিদের উৎখাতে বাঙালিদের উসকানি দেয়া হয়। ২৫ মার্চ উন্মত্ত জনতা দিনাজপুরের উপকণ্ঠে অবাঙালি মালিকানাধীন একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে। বাসের চালক এবং সাত জন অবাঙালি যাত্রীকে হত্যা করা হয়। একইদিন বাঙালি বিদ্রোহীরা দিনাজপুর-সৈয়দপুর সড়কে পোস্টাল সার্ভিসের একটি ভ্যান ভস্মীভূত করে। ভ্যানের কন্ডাক্টরকে গুলি করে হত্যা এবং চালককে আহত করা হয় । তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জীপে হামলা চালায় এবং জীপের আরোহী পাঁচ জন সৈন্যকে আহত করে। হাজার হাজার অবাঙালি মহিলা ও শিশুর সঙ্গে পৈশাচিক ও হীন আচরণ করা হয়। পিছু হটা বিদ্রোহীরা চার শ”র বেশি অবাঙালি যুবতী মহিলাকে ভারতে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
১৯৭১ সালে মার্চের শেষ সপ্তাহে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়। অবাঙালি মালিকানাধীন সকল স্টোর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে সহিংসতার বিস্তার ঘটে। ক্ষুদ্ধ, উন্মত ও ক্রুদ্ধ জনতার মিছিল কখনো কখনো ১০ হাজারে পৌঁছতো। জনতা গোটা শহরে মিছিল ও সমাবেশ করতো। এসব সমাবেশে অবাঙালিদের হত্যা এবং ধ্বংসের জন্য শপথ গ্রহণ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারকে অচল করে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। মার্চের শেষ সপ্তাহে প্রতি রাতে বিদ্রোহী সৈন্য ও সশস্ত্র বাঙালিদের নিক্ষিপ্ত গুলির আওয়াজ, দোকানের দরজা ও জানালা ভাঙ্গার শব্দ, শ্লোগানের বজ্রধ্বনি এবং লুটপাটের শোরগোল শোনা যেতো। অবাঙালিদের বাড়িঘরে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলতে দেখা যেতো। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তাদের জ্বালাময়ী ভাষণে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতেন এবং তাদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুট এবং আগ্নিসংযোগকে বাঙালি দেশপ্রেমের পরিচয় বলে ঘোষণা করতেন। নদী তীরবর্তী কসাইখানাগুলোতে নিষ্ঠুর পৈশাচিকতা প্রদর্শন করা হতো। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সৈন্যরা অবাঙালি নিধনে স্থাপিত কসাইখানাগুলোতে নিয়োজিত জল্লাদ ও রক্তপিপাসু দানবদের তত্ত্বাবধান করতো।
দিনাজপুরে এক মাসে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ পরিচালিত সন্ত্রাসে এত লোক নিহত হয়েছিল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ শহরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর সেখানে জীবিতদের মধ্যে ছিল মাত্র কয়েকজন বৃদ্ধা মহিলা ও শিশু। অবাঙালিদের সমুচিত শিক্ষা দানে গাছের ডগায় বহু লোকের মাথা টানিয়ে রাখা হয়েছিল॥”
— ব্লাড এন্ড টীয়ার্স / কুতুবউদ্দিন আজিজ (মূল: Blood and Tears । অনু: সুশান্ত সাহা) ॥ [ ইউপিপি – ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ৯৭-৯৮ ]
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- মুসলিম বিশ্বে মার্কিনী সন্ত্রাস: প্রতিরোধ কীরূপে?
- রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, গণহত্যা ও আগ্রাসন যেখানে গণতন্ত্র
- আধিপত্য বিস্তারে আগ্রাসী মার্কিন প্রজেক্ট
- বিবিধ ভাবনা (১৪)
- বিভক্ত মুসলিম এবং অর্জিত আযাব
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
MOST READ ARTICLES
- বিবিধ প্রসঙ্গ-৫
- Political, religious & demographic dynamics in South Asia & threatened co-existence of people with pluralities
- My COVID Experience
- The Hindutva Fascists & the Road towards Disintegration of India
- দিল্লিতে সরকারি উদ্যোগে মুসলিম গণহত্যা