ঈমানদারী ও বেঈমানীর স্বরূপ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ঈমান: সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক গুণ

মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মানবের যে গুণটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ -সেটি হলো তাঁর ঈমান। এটিই মানবের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। এবং দেয় ব্যক্তিত্বের সেরা পরিচয়টি। ব্যক্তির প্রকৃত মূল্য ও মর্যাদা নির্ভর করে তাঁর ঈমানের উপর। ঈমানের উপর ভর করেই ঈমানদার ব্যক্তি তাঁর নেক আমলের বিশাল প্রাসাদ গড়ে তোলে। ব্যক্তির জীবনে চুড়ান্ত সাফল্য –যেমন ইহকালে তেমনি আখেরাতে নির্ভর করে তাঁর ঈমানের উপর। একজন ব্যক্তি অসংখ্য ভাল কাজ করতে পারে, সে কোটি কোটি টাকা দান করতে পারে, এমনকি নিঃস্বার্থ ভাবে দেশের বা দশের জন্য নিজের প্রাণও বিলিয়ে দিতে পারে – কিন্তু সেগুলির বিনিময়ে পরকালে সে কোন মূল্যই পাবে না যদি তার ঈমান না থাকে। জীবনের প্রতি পদে ঈমান যেমন দিক-নির্দেশনা দেয়, তেমনি ব্যক্তির প্রতিটি কর্মে মূল্য সংযোজনও করে। ওজন বাড়ায় তার আমলের। এ নির্দেশনা কখনোই অর্থসম্পদ থেকে আসে না। অপরদিকে বেঈমানী আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্ম দেয় এবং বৃদ্ধি ঘটায় পাপের অংকে। ঈমানদারের হাতে পথ থেকে একটি কাঁটা তূলে নেয়ার ছওয়াব বেঈমানের শত শত কোটি টাকার দানের ছওয়াবের চেয়েও অধিক। কারণ, যে কোন নেক কাজে ঈমানদারের মনে কাজ করে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার ভাবনা, সেরূপ ভাবনা বেঈমানের থাকেনা। তাই ব্যক্তির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি দৈহিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়া নয়, সম্পদের বৃদ্ধিও নয়; বরং ঈমানকে বলিষ্ঠতর করা। সুস্বাস্থ্য ও বিপুল অর্থ জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায় না। বাঁচায় মজবুত ঈমান। যাকে ঈমান বলে একজন গর্বিত –সেটি হয়তো যথার্থ ঈমান নাও হতে পারে। প্রকৃত ঈমান কাকে বলে এবং কীরূপে সত্যিকার ঈমানদার হওয়া যায় -সেটি মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার বিষয়। এখানে ভূল হলে সমগ্র বাঁচাটাই জাহান্নামের পথে হয়। দৈহিক স্বাস্থ্যহীনতা নিয়েও অনেকে জান্নাতে যাবে। কিন্তু সেটি অসম্ভব হবে ঈমানহীনতায় ও ঈমানের স্বাস্থ্যহীনতায়।

প্রশ্ন হলো, ঈমান বলতে কী বুঝায়? এটি কি শুধু মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর নবী-রাসূল, আসমানী কিতাব, ফিরিশতা, আখেরাত ও তাকদিরের উপর বিশ্বাস? ঈমানের পরিসীমা এর চেয়ে অধিক বিস্তৃততর ও গভীরতর। এটি বিস্তৃত ব্যক্তির প্রতিটি কর্ম, ভাবনা ও আচরনে। মহান আল্লাহতায়ালাকে শুধু সৃষ্টিকর্তা রূপে মেনে নিলেই চলে না, তাঁকে মেনে নিতে হয় সর্বময় সার্বভৌম শক্তি ও একমাত্র আইনদাতা রূপে। মানুষ বাঁচবে হুদয়ে তাঁর স্মরণকে ধারণ করে শুধু নয়, বরং তাঁর সকল কর্ম এবং প্রতি মুহুর্তের বেঁচে থাকা -এমন কি প্রাণ দান হবে একমাত্র তাঁকে খুশি করার লক্ষ্যে। মানবকুলের সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে রয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার নিজস্ব এজেন্ডা। ঈমানদারী হলো সে এজেন্ডার বাস্তবায়নে তাঁর সৈনিকে পরিণত হওয়া। একমাত্র তখনই একজন ব্যক্তি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সাচ্চা ঈমানদার রূপে গণ্য হয়। পরিপূর্ণ সে ঈমান তখন কাজ করে জান্নাতের চাবী রূপে। পবিত্র কুর’আনে ঈমানদারের চরিত্রের সে বর্ণনাটি এসেছে এভাবে: “ইন্নাস সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ’ইয়াআ ও মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন।” অর্থ: নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু বিশ্বপ্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য।   

 

ঈমানদারী ও বেঈমানীর showcasing (প্রদর্শনী)

ব্যক্তির ঈমান অদৃশ্য নয়; সেটি খালি চোখে দেখা যায়। তেমনি দেখা যায় বেঈমানীও। ঈমানদারের ঈমানদারী শুধু তাঁর নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতে প্রকাশ পায় না, প্রকাশ পায় তাঁর রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইন-আদালত ও আচরনের ন্যায় জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে। তাঁর জীবন পরিণত হয় ঈমানের এবং সে সাথে ইসলামের জীবন্ত “showcase” (প্রদর্শনী)তে। অর্থাৎ তাঁকে দেখলে ইসলাম দেখা যায়। যেমন কুর’আন দেখা যেত নবীজী (সা:)’র চরিত্রে। হয়রত আয়েশা (রা:) তো সেটিই বলেছেন নবীজী (সা:) সম্পর্কে। অপরদিকে বেঈমানের জীবনে নানারূপে প্রকাশ ঘটে তার বেঈমানীর। তার কথা, কর্ম, আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্য দিয়ে শয়তান কথা বলে। তাই বেঈমানী শুধু মহান আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা নয়, বরং নিজ কর্ম, নিজ চেতনা ও নিজ আচরণে এমন কিছুর প্রকাশ ঘটানো যাতে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা হয় মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা ও এজেন্ডার। বেঈমান ব্যক্তি পরিণত হয় মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতার প্রতীকে তথা “showcase”য়ে। অর্থাৎ তাকে দেখলে দেখা যায় একজন মানবরূপী শয়তানকে।

মহান আল্লাহতায়ালা চান, এ বিশ্বচরাচরে একমাত্র তাঁরই ইবাদত হবে। বিজয়ী হবে তাঁরই প্রদত্ত একমাত্র দ্বীন ইসলাম এবং প্রতিষ্ঠা পাবে একমাত্র তাঁরই শরিয়তী আইন। কেউ যদি দেবদেবী, যিশু খৃষ্ট বা বুদ্ধের ন্যায় কোন ব্যক্তির পূজা শুরু করে -তবে সেটি গণ্য হয় চরম বেঈমানী রূপে। তবে সেটিও কি কম বেঈমানী যখন মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনকে বাদ দিয়ে কোন শাসক বা কোন পার্লামেন্ট আইন তৈরী শুরু করে বা কোন সরকার কাফেরদের রচিত আইনের প্রতিষ্ঠা দেয়? বেঈমানী হয়, ইসলামের কুর’আনী বিধানকে বাদ দিয়ে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদের ন্যায় হারাম মতবাদের প্রতিষ্ঠা দেয়ায়। কারণ তখন অবিশ্বাস ও অনাস্থার প্রকাশ ঘটে মহান আল্লাহতায়ালার বিধান ইসলামের বিরুদ্ধে।

       

বেঈমানীর প্রদর্শনী

এ পৃথিবীতে যারা নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করে তাদের সংখ্যাটি বিশাল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা যে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তার চরিত্র কতটা মুসলিম? সেগুলির মধ্যে কতটা প্রকাশ পায় ঈমানদারী? ঈমানদারী যেমন দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় বেঈমানীও। যে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত নিয়ে তাদের বসবাস – ঈমানদারীর প্রকাশ তার মধ্যে কতটুকু? বরং বাস্তবতা হলো, মহান আল্লাহতায়ালা বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বেঈমানীর প্রামাণ্য দলিল হলো মুসলিম দেশগুলির মানচিত্র, সীমান্তের বেড়া, শাসনতন্ত্র, জাতীয় সঙ্গিত, আইন-আদালত ও শিক্ষা-সংস্কৃতি। মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো, ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে সিসাঢালা দেয়ালসম একতা গড়া। ফরজ হলো: “ওয়া তাছিমু বি’হাবলিল্লাহি জামিয়াঁও ওয়া’লাতাফার্রাকু।” অর্থ: “এবং তোমরা আল্লাহর রশি (কুর’আন)কে সবাই মিলে আঁকড়ে ধরো, এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না।” উপরুক্ত আয়াতের সুস্পষ্ট ঘোষণা হলো, বিভক্ত গড়া হারাম -যেমন হারাম হলো ব্যাভিচারি, মদ্পান, সূদ ও শুকরের মাংস খাওয়া। মদ্পানে কিছু লোকের স্বাস্থ্যহানী হয়। ব্যাভিচারির ফলে কিছু লোক জাহান্নামে যায়। কিন্তু বিভক্তিতে স্বাস্থ্যহানী ও শক্তিহানী  ঘটে সমগ্র উম্মাহর। তখন শত্রুর হাতে যুদ্ধ, পরাজয়, হত্যা, ধর্ষণ ও অধিকৃতি আসে। সে মহাবিপদ থেকে বাঁচাতেই মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা নামায-রোযার ন্যায় ফরজ করেছেন একতাবদ্ধ থাকাকে। তাই নামায-রোযা না পড়ে কেউ যেমন মুসলিম হতে পারে না, তেমন মুসলিম হতে পারে না ঐক্যের নিয়েত ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে সচেষ্ট না হয়ে। প্রকৃত ঈমানদারী তাই একতার মধ্যে এবং বেঈমানী হলো বিভক্তির মধ্যে। একতার সে ফরজ বিধানটি মুসলিম মাঝে বলিষ্ঠ থাকাতেই  নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা গোত্র ও নানা অঞ্চলের শত শত বছর খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া খেলাফত অখণ্ড ভৌগলিক মানচিত্র বসবাস করেছে।

অথচ মুসলিমগণ বেছে নিয়েছে বেঈমানী তথা মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথ। ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের বিভক্ত মানচিত্র বস্তুত সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় সে বেঈমানীর। একতার বদলে তারা রাষ্ট্র গড়েছে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিক ভিন্নতার নামে বিভক্তির দেয়াল গড়তে। এবং গর্বের ও উৎসবের বিষয়ে পরিণত হয়েছে মুসলিম উম্মাহর বুকে ছুরি চালানোটি। হৃদয়ে সামান্য ঈমান থাকলে মুসলিম দেশে কি এমন বেঈমানী প্রশ্রয় পেত? মুসলিম উম্মাহর যখন বিশ্বজুড়া গৌরব ছিল তখন কি এরূপ বিভক্তি ছিল? আরব, ইরানী, তুর্কী, কুর্দি, মুর, মিশরী, আফগানী ইত্যাদি পরিচয়ের মুসলিমগণ মুসলিম বিশ্বের যেখান ইচ্ছা সেখানে গিয়ে যেমন ঘর বাঁধতে পারতো, তেমনি দোকান খুলতে এবং বিবাহ-শাদী করতে পারতো। মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া মসলিমদের পরিচয় হলো পরস্পরের ভাই রূপে। এ বিষয়ে পবিত্র কুর’আনের ঘোষণাটি হলো, “ই্ন্নামাল মু’মিনুনা ইখওয়াতুন” অর্থ: মু’মিন মাত্রই পরস্পরে ভাই ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এক ভাই আরেক ভাইয়ের দেশে গিয়ে ঘর বাঁধবে বা দোকান দিবে -তাতে কি অন্য ভাই বাধা দিতে পারে? বরং ঈমানের দাবী তো এটাই, ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন এলাকা থেকে আগত ভাইকে প্রাণভরা ভালবাসা দিয়ে আলিঙ্গণ করবে। সে ভালবাসার মধ্যেই তো ঈমানদারী। এবং দূরে ঠেলে দেয়া ও ঘৃণার মধ্যে তো বেঈমানী ও অসভ্যতা।

জাতীয়তাবাদের ন্যায় একটি শয়তানী মতবাদ মানুষকে যে কতটা হিংস্র, নৃশংস ও নির্মম বানাতে পারে সেটিই এক কালে দেখা গেছে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে। সে নৃশংস জাহিলী মতবাদ মুসলিম দেশে ডেকে আনে সেক্যুলারিস্ট জাতীয়তাবাদীগণ। ফলে ভাষার পরিচয় ভিন্ন হওয়ায় অন্য মুসলিমগণ হত্যাযোগ্য দুশমন গণ্য হয়েছে। বাঙালী মুসলিমের জীবনে সে নৃশংসতা দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। শুধু অবাঙালী হওয়া কারণে বহু হাজার বিহারীকে হত্যা করা হয়েছে এবং হাজার হাজার বিহারী মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। এবং প্রায় তিন বা চার লাখ বিহারীর ঘরবাড়ী, দোকানপাট কেড়ে নিয়ে বস্তিতে পাঠানো হয়েছে। এ অসভ্য কর্মে ও লুণ্ঠনে সহযোগী রূপে ডেকে আনা হয়েছে ভারতীয় লুটেরাদের। একই রূপ জাহেলী অসভ্যতা দেখা গেছে আরবদের মাঝে ১৯১৭ সালে। তারা ব্রিটিশদের অস্ত্র নিয়ে তুর্কী মুসলিমদের রক্তে মক্কা-মদিনার পবিত্র ভূমি রঞ্জিত করেছে। তারা উসমানিয়া খেলাফতের হাত থেকে ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্দান, লেবানন ছিনিয়ে নিয়ে তুলে দিয়েছে ইংরেজ, ফরাসী ও ইহুদীদের হাতে।       

ভারতের বাঙালী, গুজরাতী, মারাঠী, পাঞ্জাবী, বিহারী, তামিল, ইত্যাদি ভাষাভাষী হিন্দুগণ একত্রে এক মানচিত্রে বসবাস করছে। বিশ্বে ভাষার সংখ্যা হাজারের অধিক। কিন্তু রাষ্ট্রের সংখ্যা দুই শতের মত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অখন্ড মানচিত্রে ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান, ইটালীয়, স্পানীশ, এশিয়ান ও আফ্রিকানগণ একসঙ্গে একত্রে বসবাস করছে। ভাষার নামে রাষ্ট্র গড়ার নেশা তাদের মাঝে নাই।  কিন্তু একই ভাষা ও একই বর্ণের আরবদের জন্য প্রয়োজন পড়েছে ২২টি ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের। অতীতে কাতার, কুয়েত, দুবাই, আবু ধাবী, বাহরাইনের মত ক্ষুদ্র এলাকাগুলি জেলা রূপেও পরিচিত ছিল না, কিন্তু সেগুলি পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রে। ইসলামের মৌল শিক্ষার বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় বেঈমানী আর কি হতে  পারে? একতার বিরুদ্ধে গাদ্দারীর কারণেই বাঙালী মুসলিমদের প্রয়োজন পড়েছিল ভারতের ন্যায় কাফের শত্রু শক্তির সাথে মৈত্রী গড়ার। ভারতের সাহায্য নিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে বিভক্ত করা হয়। এরূপ ভাতৃঘাতি বিভক্তি গড়ে শয়তানকে খুশি করা যায়, প্রতিবেশী কাফেরদের শিবিরে উৎসবও উপহার দেয়া যায় -কিন্তু তা দিয়ে কি মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা যায়?

প্রতিটি হারাম কাজই আযাব নামিয়ে আনে। তেমনি আযাব নামিয়ে আনে অনৈক্যের ন্যায় হারাম কর্মও। পবিত্র কুর’আনে প্রতিশ্রুত আযাবের সে হুশিয়ারীটি শোনানো হয়েছে সুরা ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “এবং তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সুস্পষ্ট বয়ান আসার পরও পরস্পরে বিভক্ত হলো ও মতভেদ গড়লো। তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব।” তাই মুসলিমগণ বিভক্ত হলো অথচ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত সে আযাবটি এলো না –সেটি কি ভাবা যায়? ১৯৭১’য়ের পর বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ অপমান কুড়িয়েছে ভিক্ষার তলাহীন ঝুড়ি রূপে। দেশ লুন্ঠিত হলো ভারতের হাতে। ১৯৭৩-৭৪’য়ের দুর্ভিক্ষে মারা গেল বহু লক্ষ বাঙালী মুসলিম। এগুলি কি নেয়ামত? ফিলিস্তিন, কাশ্মির, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার ন্যায় মুসলিম দেশগুলি কাফের শক্তির হাতে যেরূপে অধিকৃত হচ্ছে, যেরূপে বিধ্বস্ত হচ্ছে মুসলিম দেশগুলির নগর-বন্দর, এবং নিহত ও ধর্ষিতা হচ্ছে মুসলিম নরনারী –সেগুলি কি পবিত্র কুর’আনে প্রতিশ্রুত সে আযাব নয়? বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে কাফের সেনাবাহিনীর পদধ্বনি শোনা না গেলেও রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আইন-আদালতে তাদের অধিকৃতি কি কম? মুসলিম দেশগুলিতে শত্রুর দখলদারীর এ কঠিন আযাব মুসলিম জনসংখ্যার কমতির কারণে আসেনি। মসজিদ-মাদ্রাসা বা সম্পদের কমতির কারণেও নয়। বরং এসেছে অনৈক্যের কারণে। কিন্তু বাঙালী মুসলিম জীবনে তা নিয়ে ভাবনা কই?             

 

ঈমানের সংজ্ঞা

ঈমানদারী কি শুধু মুখে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ বা উপাস্য নাই এবং মুহম্মদ(সা:) তাঁর রাসূল) বলার মধ্যে? মহান আল্লাহতায়ালাকে উপাস্য বলার অর্থ, তাঁর প্রতিটি হুকুমের পূর্ণ আনুগত্য। প্রতিটি অবাধ্যতাই তো বেঈমানী। ফলে প্রচণ্ড বেঈমানী হয় যদি রাষ্ট্রের আইন-আদালত থেকে শরিয়তী আইনকে বাদ দিয়ে কুফরী আইনের প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়। পবিত্র কুর’আনে দেয়া হয়েছে হারাম-হালালের বিস্তারিত বিধান। আছে যাকাত, গণিমতের মাল ও মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির বন্টনের আইন। আছে বিবাহ-শাদী ও তালাকের বিধান। আছে হত্যা, চুরি-ডাকাতি, ব্যভিচার, মিথ্যাচারসহ নানারূপ অপরাধের শাস্তির আইন। ঈমানদার হওয়ার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালাকে শুধু উপাস্য রূপে মেনে নেয়া নয় বরং তার নির্দেশিত প্রতিটি আইনকে মেনে নেয়া। মুসলিমদের গৌরব যুগে এমন একটি দিনও কি অতিক্রান্ত হয়েছে যে তারা শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা দেয়নি? শরিয়তী আইনের কোন একটি বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হলে তো বিলুপ্ত হয় ঈমানদারী। সেটি তো বেঈমানীর আলামত।

মুসলিম হওয়া এবং ঈমানদার হওয়া এক কথা নয়। মুসলিম হওয়ার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করা। কিন্তু ঈমানদার হতে হলে তাঁকে আত্মসমর্পণের পরও আরো বহুদূর এগিয়ে যেতে হয়। নিজের চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, পেশাদারী, অর্থনীতিসহ জীবনের প্রতিটি অঙ্গণকে কুর’আনী শিক্ষার আলোকে পরিশুদ্ধ করে নিতে হয়। পরাজিত বাহিনীর সৈনিকেরা বিজয়ী সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে। কিন্ত আত্মসমর্পণের পর ব্যক্তিটির জীবনে কাঙ্খিত পরিশুদ্ধি নাও আসতে পারে। আত্মসমর্পণের অর্থ এ নয়, পরাজিত ব্যক্তিটি জীবন ও জগত নিয়ে বিজয়ী সেনাদলের প্রতিটি ধারণা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আইনকে নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠা দিবে। পুরাপুরি ঈমানদার হওয়ার পথে অনেক পথ বাঁকি থাকতে পারে। এজন্যই বাংলাদেশ ও ভারতে বহু মুসলিমের জীবনে দেখা যায় পূর্বপুরুষের হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে। এরাই ২১ শে ফেব্রেয়ারিতে শহীদ মিনারের নামে গড়া স্তম্ভে নগ্ন পদে গিয়ে ফুল দেয়। মঙ্গল প্রদীপ নিয়ে মিছিল করে। নবীজী (সা:)’র যুগেও ঈমানে অপূর্ণতা দেখা গেছে। পবিত্র কুর’আনে তাই তাদেরকে পূর্ণ ঈমানদার হওয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সুরা হুজরাতের ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আরবগণ বলে তারা ঈমান এনেছে। বল (হে মুহম্মদ), তোমরা ঈমান আনো নাই, তোমরা মুসলিম  হয়েছো মাত্র। (অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করেছো মাত্র)। ঈমান এখনো তোমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেনি। এবং তোমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো তবে তোমাদের আমলের প্রতিদানে কোনরূপ কমতি করা হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কৃপাশীল ও মেহেরবান।”

উপরুক্ত আয়াতের মূল শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো, মুসলিম হওয়াই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলো মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য। যেখানে সে আনুগত্য নাই, বুঝতে হবে সে ব্যক্তির হৃদয়ে পূর্ণ ঈমানও নাই। সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী পূর্ণ ঈমানের দাবীতে। যে দেশের আদালতে প্রতিষ্ঠা পায়নি শরিয়তী আইন, এমন দেশের সরকারকে কি তাই ঈমাদার বলা যায়? শুধু তাই নয়, শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় জনগণের জীবনে যদি প্রবল আগ্রহ ও জিহাদ না থাকে, তবে সে জনগণকে কি প্রকৃত ঈমানদার বলা যায়? ঈমানদারী ব্যক্তিকে একাত্ম করে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে, অপর দিকে বেঈমানী একাত্ম করে শয়তানের এজেন্ডার সাথে।

ঈমানের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বব আয়াতে। বলা হয়েছে, “ঈমানদার একমাত্র তারাই যারা ঈমান আনলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর, অতঃপর তার উপর আর কোনরূপ সংশয় পোষণ করলো না এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করলো নিজেদের জান ও মাল দিয়ে। তারাই হলো ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী।” উপরুক্ত আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা জিহাদকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থাৎ ঈমানদার হতে হলে জিহাদ থাকতেই হবে; এবং জিহাদ না থাকার অর্থ ঈমান না থাকা। সেরূপ ঈমানের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের জীবনে। তাই এমন কোন সাহাবা ছিলেন না যাদের জীবনে জিহাদ ছিল না। শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। মুসলিম হওয়ার দাবী করতো অথচ যাদের জীবনে জিহাদ ছিল না, তারা চিহ্নিত হয়েছে মুনাফিক রূপে।   

অথচ আজকের মুসলিম জীবনে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি এখানেই। ব্যর্থতা এখানে ঈমানের সঠিক অর্থ বুঝাতে। শুধু ব্যর্থতা নয়, মুসলিম জীবনে সবচেয়ে বড় ভ্রষ্টতা ঘটেছে এ ক্ষেত্রটিতে। এর কারণ, কুর’আন বুঝায় ব্যর্থতা। কুর’আন না বুঝে তেলাওয়াতে এমন ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা বাড়বে -সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? ফলে চরম ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায়। ঈমানদারী সীমিত হয়ে গেছে স্রেফ আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রাসূলের উপর বিশ্বাসের সাথে আসমানী কিতাব, রোজহাশর, জান্নাত-জাহান্নাম, তাকদির ও আখেরাতের উপর বিশ্বাসের মধ্যে। ঈমানের শর্ত রূপে জিহাদকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়না। ফলে ইসলাম পরাজিত হলে বা মুসলিম দেশ কাফেরদের হাতে অধিকৃত হলেও মুসলিম জীবনে জিহাদ শুরু হয়না। শুধু তাই নয়। উপরুন্ত ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে জিহাদের ন্যায় ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকে সন্ত্রাস রূপে চিত্রিত করার। বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পুলিশের কাজ হয়েছে জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করা। ইসলামের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ আর কি হতে পারে?                 

জান-মালের বিক্রয়-চুক্তি

মু’মিনের ঈমানদারী স্রেফ কালেমায়ে শাহাদত পাঠে শেষ হয় না, বরং আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে চুড়ান্ত কুরবানী ও পেশ করতে হয়। মু’মিন হওয়াটি কোন মামূলী বিষয় নয়। যেমন মামূলী নয় আখেরাতে জান্নাত পাওয়া। ঈমানদারীর অর্থ: নিজের জান-মালের বিক্রয়ে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া। খোদ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এমন একটি চুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে সুরা তাওবার ১১১ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন এ শর্তে যে তাদের জন্য বরাদ্দ হবে জান্নাত। (সে চুক্তি অনুযায়ী) তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়; অতঃপর শত্রুদের হত্যা করে এবং নিজেরাও নিহত হয়। (মু’মিনদের প্রতি) এটিই হলো সেই সত্য ওয়াদা যা ঘোষিত হয়েছে তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুর’আনে। আর আল্লাহর চেয়ে কে বেশী ওয়াদা পালনকারী? অতএব আল্লাহর সাথে কৃত এ বিক্রয়চুক্তি নিয়ে তোমরা আনন্দ প্রকাশ করো। এটিই হলো সবচেয়ে বড় বিজয়।”      

তাই ঈমান আনার সাথে সাথে মুমিনের জান ও মালের মালিকানা তার নিজের হাতে থাকে না। সে তার নিজের নতুন পরিচয়টি পায় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আত্মবিক্রয়কৃত ব্যক্তি রূপে। সে নিজে বাঁচে নিজের উপর মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অর্পিত বিশাল আমানতের দায়ভার নিয়ে। মু’মিন ব্যক্তির হাতে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর ক্রয়কৃত মালকে এ শর্তে গচ্ছিত রাখেন যে, সে আমানত ব্যয় করা হবে একমাত্র তাঁর পথে তথা তাঁর দ্বীনের বিজয়ে। এবং তা কখনোই ব্যয় হবে না শয়তানের বিজয় ও আনন্দ বাড়াতে। বস্তুত, এ পথেই ঈমানদারের জীবনে আসে প্রকৃত বিজয় এবং জুটে জান্নাত। ঈমানদার তাই কখনোই জাতীয়তাবাদী, সমাজবাদী, সেক্যুলারিস্ট হতে পারে না। কোন জালেম সরকারের সমর্থকও হয় না। কোন সেক্যুলার দল বা সেনাদলের ক্যাডার রূপে নিজের জীবনও বিলিয়ে দেয় না। কারণ সে জানে, তাঁর উপর অর্পিত আমানতকে ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন ধর্ম বা মতবাদকে বিজয়ী করার কাজে ব্যয় হলে –সেটি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে গণ্য হয় পবিত্র আমানতের খেয়ানত রূপে। এ খেয়ানত জাহান্নামে পৌঁছায়। প্রশ্ন হলো, মুসলিম জীবনে সে খেয়ানতই কি বিপুল ভাবে হচ্ছে না? এরই প্রমাণ, মুসলিমগণ আজ নিজ দেশে নিজ ভোট, নিজ অর্থ ও নিজ মেহনতে ইসলামকে পরাজিত করে রেখেছে। এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষের শাসন, কুফরী আইন, সূদী ব্যাংক, সূদ-ঘুষ, পতিতা পল্লি, অশ্লিলতা ও নাচ-গানের সংস্কৃতি।   

 

ঈমানের ফসল

ঈমানের কল্যাণকর ফসল বহুবিধ। ঈমান থেকেই জন্ম নেয় নেক আমলে অদম্য আগ্রহ। এরূপ হতেই পারে না যে এক ব্যক্তি ঈমান আনলো, অথচ নেক আমলে তৎপর হলো না। ঈমান বস্তুত নেক আমলে ইঞ্জিনের কাজ করে। বেঈমানের জীবনে সৎকাজে আগ্রহ না থাকার কারণ হলো এই ঈমানহীনতা। ঈমানদার ব্যক্তি তাঁর প্রতি কর্মকে দেখে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম রূপে। সে বাঁচে শুধু বাঁচার জন্য নয় বরং প্রতি মুহুর্তে মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার জন্য। জীবনের প্রতিটি মুহৃর্ত সে গণ্য করে মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত মহামূল্য আমানত রূপ। তাই মূল্যহীন বাজে কথা ও বাজে কাজে সে সময়ের অপচয় করে না। ঈমান দেয় ব্যক্তির অন্তরলোকে সদাপ্রজ্বলিত কুর’আনী জ্ঞানের নূর। সে নূরের আলোকে সে যেমন সত্যকে দেখতে  পায়, তেমনি দেখে অসত্যকেও। ঈমান পুষ্টি পায় যেহেতু কুর’আনের জ্ঞান থেকে, ঈমানদার ব্যক্তিকে তাই দেখা যায় কুর’আনের জ্ঞান সংগ্রহে।

হাদীস মতে ঈমানের ৭০টি শাখা। ঈমান থেকে গজায় নেক আমলের নানাবিধ শাখা-প্রশাখা। সর্বোচ্চ শাখা হলো আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ। সবচেয়ে নিম্নের শাখাটি হলো পথের উপর থেকে কাঁটা তুলে নেয়া। ঈমান দেয় ছবর বা ধৈর্য। হযরত আলী (রা:) বলেছেন, ঈমান হলো দেহ আর ছবর হলো তার মস্তক। ঈমান থেকেই জন্ম নেয় মহান আল্লাহতায়ালার উপর নির্ভরতা। ঈমানদার বিশ্বাস করে, রিযিকের মালিক মহান আল্লাহতায়ালা। রিযিকের ভাবনা তাই তাকে জালেমের ফাঁদে ফেলে না। সুরা তালাকের ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং তিনি এমন স্থান থেকে তাকে রিযিক দেন যা সে কল্পনাও করতে  পারে না। এবং যে আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।”  আল্লাহর উপর যার গভীর ভরসা, সে কি তাই ধৈর্যহীন হয়? ধৈর্যের কারণে ঈমানদার ব্যক্তি অভাবে পরেও চুরি করে না। বিপদে পড়েও মিথ্যা বলে না। রাগের মাথায় কাউকে গালি দেয় না এবং ক্ষতিও করে না। ঈমানদার ব্যক্তি এভাবেই মহামানবে পরিণত হয়। মুসলিম ইতিহাসে অতীতে বিস্ময়কর বিজয় ও গৌরব এসেছে তো তাদের কারণেই্।

 

খুলে দেয় নেয়ামতের দরজা

ব্যক্তির জন্য ঈমান নিয়ামতের অসংখ্য রাস্তা খুলে দেয়। তাঁর জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামতটি হলো: তখন স্বয়ং মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর ওলী তথা অভিভাবক হয়ে যান। তখন তাঁর জীবন পায় অন্ধকারের মাঝে আলোর সন্ধান এবং পরিচালিত হয় সিরাতাল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের পথে। ঈমানদার ব্যক্তি এভাবেই রক্ষা পায় পথভ্রষ্টতা থেকে। এটিই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। অপরদিকে বেঈমানদের অভিভাবক হলো শয়তান। এবং শয়তান তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়, ফলে তার জন্য অসম্ভব করে সিরাতাল চলা। এবং পরকালে জাহান্নামে পৌঁছা। এটিই হলো মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। পবিত্র কুর’আনের সুরা বাকারার ২৫৭ নম্বর আয়াতে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে, “যারা ঈমান এনেছে তাদের অভিভাবক হলো আল্লাহ। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হলো শয়তান। সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নেয়। এরাই হলো আগুনের বাসিন্দা যেখানে তারা চিরকাল থাকবে।”  সুরা তাগাবুনের ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি ঈমান আনে আল্লাহর উপর, তাঁর ক্বালবকে তিনি হিদায়েত দেন।” এর অর্থ দাঁড়ায়, যার ঈমান নাই তার জীবনে হিদায়েত তথা সঠিক পথপ্রাপ্তিও নাই। অতএব বেঈমানের জন্য যা নির্ধারিত হয় তা হলো জাহান্নামের পথে চলা। মানব জীবনে এর চেয়ে ভয়ানক পরিণতি আর কি হতে পারে?   

 

বেঈমানীর স্বরূপ

ঈমান তখনই ফায়দা দেয় যখন তা পরিপূর্ণ ঈমানে পরিণত হয়। ঈমান অবিভাজ্য। তাই ইসলামে আংশিক ঈমান বা আংশিক মুসলিম বলে কিছু নাই। কেউ নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত পালন করে, কিন্তু সে সাথে সূদ খায়, ঘুষ খায় এবং সেক্যুলার রাজনীতিও করে –এরূপ আংশিক দ্বীন পালনের অনুমতি ইসলামে নাই। ইসলামের সাথে এটি মস্করা। পবিত্র কুর’আনে তাই হুশিয়ারি শুনানো হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণ ভাবে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২০৮)। অথচ উপরুক্ত আয়াতের সাথে মুসলিম নামধারী অনেকের বেঈমানীটি বিশাল। মসজিদের নামাযে দেখা গেলেও তারা রাজী নয় জিহাদের ময়দানে হাজির হতে। রাজী নয়, দেশের আদালতে শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা দিতে। রাজী নয়, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠায়। এবং রাজী নয়  ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। তারা ইসলাম পালন করে ইসলামে পূর্ণভাবে প্রবেশ না করেই। মসজিদে গেলেও তারা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতির ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গণগুলিতে। চিকিৎসকের দেয়া প্রেসক্রিপশনের সবগুলো ঔষধ সেবন না করলে রোগ সারে না। তেমনি মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া প্রেসক্রিপশনের সবগুলি বিধান না মানলে কি কল্যাণ আসে? তাই কোটি কোটি মুসলিমের নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত পালনে কল্যাণ আসছে না। পরাজয় এবং অপমান থেকেও মুক্তি মিলছে না। বস্তুত মুসলিম উম্মাহর আজকের দুরবস্থার মূল কারণ, এই আংশিক ঈমানদারী ও আংশিক ইসলাম পালন।

ঈমানদারীর অর্থ প্রতি মুহুর্ত মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে বাঁচা। তাকে বাঁচতে হয় আল্লাহতায়ালার সাহায্যকারি রূপে। যেমন সুরা সাফ’য়ের ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহর আনসার তথা সাহায্যকারি হয়ে যাও।” আল্লাহর আনসার হওয়ার অর্থ, তাঁর দ্বীন বিশেষ করে তাঁর শরিয়ত প্রতিষ্ঠার কাজে লেগে যাওয়া। কিন্তু শরিয়তকে বাদ দিয়ে যারা কুফরী আইনের প্রতিষ্ঠা দেয় তারা তো শয়তানের সাহায্যকারি। ইসলামের মিশন তো অন্যায়ের নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। একাজে অনিবার্য হয়ে উঠে অন্যায়কারিদের সাথে রক্তাত্ব সংঘাত। কারণ, অন্যায়কারি দুর্বৃত্তগণ সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর থেকে তাদের দখলদারী স্বেচ্ছায় ছাড়তে রাজী নয়। একটি গাছের শিকড় নির্মূল করেই সেখানে আরেকটি গাছ লাগানো যায়। ফলে শয়তানী শক্তির উপস্থিতিতে সম্ভব নয় ইসলামী সমাজের নির্মাণ। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা চান, তাদের শিকড়ের নির্মূল। এবং সেটি ফিরিশতাদের সাহায্যে নয়, বরং মুসলিমদের হাত দিয়ে।

মহান আল্লাহতায়ালার আনসার রূপে ঈমানদারের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিশন হলো, ইসলামের শত্রু শক্তির শিকড় কর্তন। সেটি ঘোষিত হয়েছে সুরা আনফালের ৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে, “আল্লাহ চান তাঁর কালেমার দ্বারা তাঁর সত্যদ্বীনকে সত্য রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে এবং কর্তন করতে চান কাফেরদের শিকড়কে।” অথচ আজ মুসলিম জীবনে সবচেয়ে বিকট ভ্রষ্টতাটি হলো, তারা নেমেছে শয়তানী মতবাদগুলিকে বিজয়ী করার মিশন নিয়ে। তারা নিজ দেশে শিকড় কাটছে ইসলামের। ভোট দিয়ে, রাজস্ব দিয়ে, অস্ত্র ধরে অসম্ভব করছে ইসলামের বিজয়কে। এবং প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, সেক্যুলারিজম, ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার ও রাজতন্ত্রের ন্যায় নিরেট অসভ্যতাকে। মহান আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর প্রিয় রাসূল(সা:)’র সাথে এর চেয়ে বড় বেঈমানী আর কি হতে পারে? তাজ্জবের বিষয় হলো, নিজেদের এ সুস্পষ্ট বেঈমানীকে তারা বেঈমানী বলতে রাজী নয়। বরং সে বেঈমানীকে তারা ঈমানদারী বলে। এবং তা নিয়ে গর্বও করে। যারা সে ভ্রষ্টতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তাদেরকে তারা শত্রু মনে করে। মরণাপন্ন যে রোগী নিজের রোগকে অস্বীকার করে, তাকে কি চিকিৎসা দেয়া যায়? মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তার উপায় থাকে না। আদ, সামুদের ন্যায় বহু জাতি এ কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। তেমন এক মহাবিপদ ঘিরে ধরেছে আজকের মুসলিমদেরও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *