ইসলামের রাজনৈতিক গোলপোষ্ট এবং বাঙালী মুসলিমের ব্যর্থতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

গোলপোষ্ট: ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ

যারা কোন বিশ্বাস বা আদর্শ নিয়ে বাঁচে, সে বিশ্বাস বা আদর্শ শুধু মগজে সীমিত থাকে না। একটি রাজনৈতিক লক্ষ্যও থাকে। সেটি হলো, সে বিশ্বাস ও আদর্শের আলোকে রাষ্ট্র নির্মাণ। নবীজী (সা:) সেটিই করেছেন মদিনায় হিজরতের প্রথম দিন থেকে। তিনি নিজে ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক। এবং সে আসনে বসে তিনি শিখিয়েছেন, সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় প্রধানের আসনে বসাতে হয়। নবীর আমলে খোদ নবী বসবেন; এবং তার মৃত্যুর পর তার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অনুসারি বসবেন। ইসলামের বিজয়ে অঙ্গিকারহীন কোন ব্যক্তিকে সে আসনে বসানো তাই নবীজী (সা:)’র সূন্নতের খেলাফ। এটি হারাম। অথচ সে হারাম কাজটিই বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোতে লাগাতর হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রধানের আসনটি ছিনতাই হচ্ছে ইসলামের শত্রু দুর্বৃ্ত্তদের হাতে। রাষ্ট্রই হলো মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। মানবের ভাগ্য পরিবরর্তনে রাষ্ট্রের বিকল্প নাই।  মুসলিমগণ অতীতে রোমান সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তি রূপে আবির্ভুত হয়েছিল এবং নির্মাণ করেছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা –তা তো সম্ভব হয়েছিল শক্তিশালি রাষ্ট্র গড়ার কারণেই। ইসলামী রাষ্ট্র না গড়ে কি সে বিশাল অর্জনের কথা কি কল্পনা করা যায়?

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজটি যেমন ফরজ, তেমনি ফরজ হলো তার প্রতিরক্ষা দেয়া। রাষ্ট্রকে শত্রুর হামলা থেকে প্রতিরক্ষা দিতে খোদ নবীজী (সা:) বহু যুদ্ধ লড়ছেন। তিনি নিজে আহত হয়েছেন। বহু সাহাবী সে জিহাদে শহীদ হয়েছেন। মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে কিছু মানুষকে দ্বীন শেখানো যায় এবং কিছু মানুষের জীবনে পরিবর্তনও আনা যায়। কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের ভাগ্য পাল্টানো যায় না। এমন কি পূর্ণ দ্বীনপালনও সম্ভব নয়। সম্ভব নয় ইসলামী সভ্যতার নির্মাণ। মসজিদ-মাদ্রাসার কাজও সেগুলি নয়। এ জন্যই মুসলিম রাজনীতির গোলপোষ্টি হলো ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। নবী-জীবন ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনের মূল শিক্ষাটি তো এটিই। বস্তুত মুসলিমদের অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের সবচেয়ে বেশী ব্যয় হয়েছে তো রাষ্ট্রের নির্মাণে। এবং লড়তে হয়েছে অসংখ্য যুদ্ধ। সেকালে আদালতে শরিয়তী আইনের পূর্ণ প্রয়োগের ন্যায় অতি ফরজ কাজটি সম্ভব হয়েছিল তো ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকার কারণেই্।

ইসলামের আগমন ওযু-গোছল, নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের বিধান শেখাতে ঘটেনি। বরং সেটি হলো মানব জাতিকে প্রতি পদে সঠিক পথ দেখাতে। সে কাজে একমাত্র ইসলাম হলো মহান আল্লাহতায়ার দেয়া পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের গুরুত্ব বুঝতে হলে বস্তুত বুঝতে হবে রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুরুত্ব। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশাল অংশ জুড়ে রাজনীতির দখলদারী। যিনি দেশের কর্ণধার তার দখলদারিটি শুধু দেশের ভূগোল বা প্রশাসনের উপর থাকে না, থাকে জনগণের চেতনার ভূমিতেও। জাতি কোন দিকে যাবে সিদ্ধান্তটি মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে আসে না, আসে শাসকের চিন্তা-চেতনা থেকে। তাই শাসক পৌত্তলিক চেতনার হলে দেশের রাস্তা-ঘাটগুলো মুর্তিতে ভরে উঠে। মুর্তিপূজা তখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। তাছাড়া রাজনীতির অঙ্গণই হলো একটি দেশের সবচেয়ে বড় অঙ্গণ। তাই ইসলামকে রাজনীতির বাইরে রাখলে মানব জীবনের সে বিশাল অঙ্গণটিতে মহান আল্লাহতায়ার দেয়া রোডম্যাপের অনুসরণ কীরূপে সম্ভব? গন্তব্যে পৌছতে হলে তো রোডম্যাপের সবটুকুই অনুসরণ করতে হয়; একটু পথ বাঁকি রাখলে গন্তব্যে পৌঁছা যায় না। রাজনীতির অঙ্গণকেও তাই সিরাতুল মুস্তাকিমে শামিল করতে হয়। নবীজী (সা:)’র জীবনের সেটিই তো শিক্ষা।

সফলতার মাপকাঠি মুসলিম ও অমুসলিমে জীবনে এক নয়। মুসলিমকে বাঁচতে হয় প্রতিপদে ইসলামের পূর্ণ অনুসারি হয়ে। তখন অনুসরণের প্রসঙ্গটি শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতে সীমিত থাকে না। রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও আইন-আদালতের অঙ্গণে যখন পা ফেলতে হয় তখনও তাকে অনুসরণ করতে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়ে কোর’আনী রোডম্যাপকে। এটি হলো মুসলিম হওয়ার ঈমানী দায়বদ্ধতা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব অঙ্গণে কতটুকু অনুসরণ করা হয় কোর’আনী রোডম্যাপকে? আর অনুসরণ না করে মুসলিমই বা থাকা যায় কীরূপে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুসলিমদের ব্যর্থতাগুলো বিশাল। চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দূর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, অকার্যকর শিক্ষা এবং বিলুপ্ত আইনের শাসন বস্তুত সে ব্যর্থতাগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অথচ ইতিহাসটি ভিন্নতর হওয়া উচিত ছিল। কারণ, একমাত্র মুসলিমদের কাছেই রয়েছে উন্নত সভ্যতা নির্মাণের পরীক্ষিত এক নির্ভূল মডেল। এবং সমগ্র মানব ইতিহাসে একমাত্র সে মডেলটিই সাফল্য দেখিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে মহান আল্লাহতায়ালার সে শ্রেষ্ঠ নিয়ামতটির প্রয়োগ করা হয়নি। এটি নির্ভূল প্রেসক্রিপশন থাকা সত্ত্বেও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মত।

আলেমদের ব্যর্থতাও কি কম? গাড়ি যখন খাদে পড়ে, তখন মূল দোষটি চালকের। তেমনি যখন মুসলিম উম্মাহ পথভ্রষ্ট হয়, তখন মূল দোষ আলেমদের। বুঝতে হবে, জনগণকে পথ দেখানো ও নেতৃত্ব দেয়ার কাজটি যথাযথ হয়নি। পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা ইহুদীদের বিপর্যয়ের জন্য তাই ইহুদী আলেমদের দায়ী করেছেন। সুরা জুম্মা’য় তাদেরকে ভারবাহী গাধার সাথে তূলনা করেছেন। গাধা কিতাব বইতে পারে, কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে না। একই কারণে নবীজী(সা:)’র শিক্ষা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি এবং বিজয়ী হয়নি দ্বীন। অথচ নবীজী (সা:)’র অবর্তমানে দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজ করার মূল দায়িত্বটি আলেমদের। অথচ হয়েছে, ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করার কাজ। বিভক্তি গড়া যে হারাম -সে কথাটিও তারা বলেন না। না বলার কারণ, ফিরকার নামে নিজেদের গড়া বিভক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় বিশ্বের অন্য কোন দেশে এতো নামাযী নেই, এতো মসজিদ-মাদ্রাসাও নেই। নেই এতো আলেম। বাংলাদেশের আলেমদের সংখ্যাই খোলাফায়ে রাশেদার আমলের মুসলিমদের চেয়ে অধিক। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের এ দেশটিতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নাই। অথচ শরিয়ত হলো সিরাতুল মোস্তাকিম; শরিয়ত না মেনে চলার অর্থ হলো সিরাতুল মুস্তাকিমের বাইরে দিয়ে পথ চলা। এবং সে পথটি হলো নিশ্চিত বিপদ ও জাহান্নামের পথ। সে পথে শান্তি আসতে পারে -সেটি বিশ্বাস করাই হারাম। এবং দেশের আইন-আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠিত না থাকার অর্থ, শয়তানের পূর্ণাঙ্গ বিজয়। এতে পরাজিত হয় ইসলাম। এবং সে পরাজয় মেনে নেয়ে জীবন যাপন করাটাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের সাথে গাদ্দারী।

সভ্য মানুষ কোথাও বসতি গড়লে শুধু ঘর নয়, রাস্তাও গড়ে। রাস্তায় সিগনাল পোষ্টও স্থাপন করে। সে সিগনালগুলো রীতিমত মানতে হয়। নইলে পথ চলায় বিভ্রান্তি আসে, দূর্ঘটনায় প্রাণনাশও হয়। তেমনি মুসলিম যেখানে রাষ্ট্র গড়ে সেখানে শরিয়তেরও প্রতিষ্ঠা দেয়। নইলে অসম্ভব হয় সিরাতুল মুস্তাকিমে পথ চলা। কারণ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, শ্লিল-অশ্লিল, কল্যাণ-অকল্যাণ এরূপ হাজারো পথের মোহনায় প্রতিনিয়ত দাঁড়াতে হয় প্রতিটি মানুষকে। কোন দিকে যেতে হবে সে পথটি নিজে আবিস্কার করতে গেলেই মহাবিপদ। কারণ সে সামর্থ্য মানুষকে দেওয়া হয়নি। এমনকি নবীদেরও নয়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, “ইন্না আলাইনা লাল হুদা” অর্থাৎ পথ দেখানোর দায়িত্ব আমার। মানুষকে যে সামর্থ্য দেয়া হয়েছে সেটি হলো সে পথ অনুসরণের। এবং মহান আল্লাহ-প্রদর্শিত এ পথটির ইসলামী পরিভাষা হলো শরিয়ত। অথচ রাষ্ট্রে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা না পেলে জনগণ সঠিক পথ পাবে –সেটি বিশ্বাস করাই শিরক। কারণ, তখন এ ধারণা শক্তি পায়, শরিয়ত ছাড়াও শান্তি ও সাফল্য সম্ভব। শরিয়তের প্রতিষ্ঠা –এ জন্যই ঈমানের এত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মুসলিম রূপে বাঁচা ও মরার সাথে এর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক।

 

উপেক্ষিত মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা  

বুঝতে হবে, মানব জাতির জন্য হলো শরিয়তই মহান আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। যারা সে শরিয়ত থেকে দূরে থাকে তারা বস্তুত নিজেদের বঞ্চিত রাখে সে শ্রেষ্ঠ নেয়ামতটি থেকে। সে এজেন্ডা তাই মানবের দুশমন শয়তানের। পানাহার তিনি জন্তুজানোয়ার ও কাফেরদেরও দেন, কিন্তু সেগুলো জান্নাতে নেয় না। জান্নাতে যেতে হলে শরিয়তের অনুসরণ ছাড়া উপায় নাই। তাই মানবকে জান্নাতে নেয়ার লক্ষ্যে শরিয়তের প্রতিষ্ঠাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। শুধু এই একটি মাত্র কারণেই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা মানব সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম। বস্তুত এটিই মহান আল্লাহতায়ালার প্রধান এজেন্ডা। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোতে মহান আল্লাহতায়ালার সে এজেন্ডাই সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত। শরিয়তকে বিলুপ্ত করে নিজেদের কুফরি আইনের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ। ব্রিটিশ কাফেরদের বিজয়ে বিজয়ী হয় শয়তানী এজেন্ডা। ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়েছে; কিন্তু তাদের সে শয়তানী এজেন্ডা এখনও বলবৎ রয়েছে মুসলিম ভূমিতে। ব্রিটিশ-প্রণীত কুফরি আইন নিয়ে বাঙালী মুসলিমদের আজও চলে বিচার-আচার। অথচ পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহর ঘোষণা, “যারা আল্লাহর নাযিলকৃত  বিধান নিয়ে বিচার করে না তারা কাফের, ..তারা জালেম ও …তারা ফাসেক।”–(সুরা মায়েদা, আয়াত ৪৪, ৪৫, ৪৭)। ঈমানের পরীক্ষাটি শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত পালনে হয় না, কতটা শরিয়ত পালিত হলো তা থেকেও হয়। প্রশ্ন হলো, সে পরীক্ষায় বাঙালী মুসলিমগণ যে ফেল করেছে -সেটি কি দেশের আদালতে শরিয়তী আইনের বিলুপ্তিই বলে দেয় না? সে হুশ সাধারণ মুসলিম দূরে থাক, যারা নিজেদের আলেম বা আল্লামা রূপে জাহির করেন -তাদেরও কি আছে?

দেশে আন্দোলন হয় সরকার বদলের। আন্দোলন হয় বেতনবৃদ্ধির। আন্দোলন হয় সার্টিফিকেট নিয়ে। কাওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের সার্টিফিকেট দিয়েছে -এ খুশিতে তারা ভোটচোর ও গুম-খুন-সন্ত্রাসের নেত্রী শেখ হাসিনাকে “কাওমী জননী” উপাধী দিয়েছে। তারা কি জন্য কোর’আন শেখে এবং বাঁচে সেটি বুঝবার জন্য তাদের এরূপ আচরণই কি যথেষ্ট নয়? লক্ষ্য, নিজেদের উপার্জন বাড়ানো। অথচ মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করায় আগ্রহ থাকলে তারা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নামতো। হালাল খাদ্যে আগ্রহ অনেকের। কিন্তু হালাল শিক্ষা-সংস্কৃতি, হালাল আইন-আদালত ও হালাল পোষাক-পরিচছদে আগ্রহ ক’জনের? ফলে হারাম রীতিনীতি ঢুকেছে সংস্কৃতিসহ সর্বত্র। এতে বেড়েছে পৌত্তলিকতা ও উলঙ্গতার তান্ডব। অসংখ্য মুর্তি স্থাপিত হয়েছে রাজপথে। নগরে বন্দরে গড়ে উঠেছে হাজারো পতিতাপল্লী। পতিতারা উপচে পড়ছে শহরের পার্কে ও রাজপথে -এমনকি আবাসিক মহল্লাগুলোতেও। যে অপরাধের শাস্তি ইসলামে প্রানদন্ড, সে অপরাধকে আইনসিদ্ধ বানিজ্য রূপে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যারা নামায-রোযা পালন করে তাদের কাজ হয়েছে রাজস্ব দিয়ে এ পাপাচারের প্রতিপালনে বেশী বেশী পুলিশ নিয়োগ। তাজ্জবের বিষয়, এসব প্রকাশ্য পাপাচারের বিরুদ্ধে আলেমগণও নিশ্চুপ। নামাযী জনগণের পক্ষ থেকেও এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ নাই, আন্দোলনও নাই। পাপের সাথে এরূপ শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান কি মুসলিম জীবনে কল্পনা করা যায়? অথচ এটিই বাঙালী মুসলিমের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এ পাপাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যোগ দিয়ে কোন আলেম বা মুসল্লি জেলে গেছেন -সে ইতিহাসও নেই। অথচ অতি তুচ্ছ বিষয়েও দেশ জুড়ে হরতাল হয়। অথচ মুসলিমদের যে কারণে মহান আল্লাহতায়ালা শ্রেষ্ঠ উম্মত বলেছেন সেটি এজন্য যে, “তারা দুর্বৃত্তির নির্মুল করে এবং ন্যায় কর্মের প্রতিষ্ঠা দেয়।” -(সুরা আল-ইমরান আয়াত ১১০)।এটিই মুসলিম জীবনের মিশন। অথচ এ মিশনই মুসলিম জীবনে সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত। বরং তারা বাঁচছে দুর্বৃত্তির পরিচর্যা দিয়ে। ফলে বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশ দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে।   

মানুষ কর্মে প্রেরণা পায় তার ভাবনা থেকে। আর রাজনীতিতে মুসলিমের মূল ভাবনাটি তো শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। যে রাজনীতি সে মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়তাই দেয় না –সে রাজনীতি নিয়ে কোন মু’মিন কি সন্তুষ্ট থাকতে পারে? শরিয়ত প্রতিষ্ঠার নাম মুখে আনতে রাজী নয় -এমন ব্যক্তির শত বছরের রাজনীতিতেও কি শরিয়ত প্রতিষ্ঠা পায়? দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা বাড়ছে। কিন্তু মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য কি?  শুধু ইবাদত আর ইলম শিক্ষার মাঝে ধর্মকর্ম সীমিত হলে রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা কি আদৌ সম্ভব? প্রতিটি ধর্ম বা মতবাদই সমাজে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চায়। প্রতিষ্ঠান চায় এমনকি পাপীষ্ঠরাও। পতিতাপল্লী, মদ্যশালা, জুয়ার আড্ডা, যাত্রা ও নাচের ক্লাব, সূদী ব্যাংক, সেক্যুলার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এসব তাদেরই প্রতিষ্ঠান। নির্জন কুঠিরে, বনে জঙ্গলে বা তাঁবুতে ইসলামী সমাজ বেড়ে উঠে না। এজন্য ইসলামের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চাই। ইসলামী পরিবার চাই, মসজিদ চাই, সমাজ চাই, শিক্ষাকেন্দ্র চাই এবং সে সাথে পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্রও চাই। এগুলীর কোন একটি সঠিক ভাবে কাজ না করলে সে সমাজে মুসলিমও সঠিক ভাবে বেড়ে উঠে না।

ইঞ্জিনের হাজারো যন্ত্রের মাঝে একটি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ যদি যথাস্থানে না থাকে তবে উড়োজাহাজ উড়তে পারে না, তেমনি অবস্থা ইসলামেরও। পরিবার, সমাজ, মসজিদ, শিক্ষালয়, আইন-আদালত, প্রশাসন, হাট-বাজার, রাষ্ট্র – সবগুলীই হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সমাজ পরিবর্তনের এগুলো হলো চালিকা শক্তি। ব্যক্তি ও সমষ্ঠির জীবনে ইসলামের প্রতিষ্ঠা পূর্ণাঙ্গতর করার ক্ষেত্রে এ সব প্রতিষ্ঠানের সক্রীয় ভূমিকা শুধু প্রয়োজনীয়ই নয়, অপরিহার্য। আর রাষ্ট্রতো  ইঞ্জিন। আর এ ইঞ্জিনকে পথ দেখায় শরিয়ত। ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে কোন পথে চলতে হবে শরিয়ত সেটিরই সিগনাল দেয়। যে সমাজে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নেই সে সমাজে দিক-নির্দেশনাও নেই। রাষ্ট্র তখন দিশেহারা হয়। জনগণ তখন ধাবিত হয় পাপচার, জুলুম ও কুফরির দিকে। এজন্যই মুসলিম যেখানেই ঘর বাঁধে সেখানে শরিয়তেরও প্রতিষ্ঠা করে। মদিনায় হিজরতের পর নবীজী (সাঃ) এ কাজটিই প্রথমে করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে সেটিই হয়নি। ফলে হাজারো মুসলিম নির্বিচারে সূদ খাচেছ, ঘুষ খাচেছ, লাখে লাখে যুবকেরা ঢুকছে অশ্লিল নাচগানের আসরে, এমনকি বেশ্যালয়েও। সিনেমার নামে অগণিত মানুষ আনন্দ ভরে উলঙ্গতা দেখছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মুর্তি গড়ার খরচও জোগাচেছ। কুফরি আইনের ফয়সালাও এরা মাথা পেতে মেনে নেয়। ইসলাম থেকে বিচ্যুতির এর চেয়ে বড় দলিল আর কি হতে পারে? মসজিদে নামায পড়ে, প্রতি বছর রমযানে রোযা রেখে, বার বার হজ্ব ও উমরাহ করে কি এ পাপের সাজা থেকে মূক্তি মিলবে?

 

এতো বিচ্যুতির হেতু কী?

বিচ্যুতির কারণ বহুবিধ। তবে মূল কারণ, ইসলামী প্রতিষ্ঠান সমূহের বিনাশ এবং কোর’আন থেকে দূরে সরা। ধর্মীয় চেতনার মূলোৎপাটনে এটিই শত্রুর কার্যকর পদ্ধতি। ধর্মের পরিচর্যা দেয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এরা পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করে এবং জন্ম দেয় এমন সব প্রতিষ্ঠানের যার দূরে সরায় কোর’আন থেকে। মুসলিম দেশসমূহে ঔপনিবেশিক শাসনামলে বৃটিশগণ সেটিই করেছে। ইসলামের প্রতিষ্ঠানসমূহ বিনাশপ্রাপ্ত হলে অবস্থা কীরূপ হয় -তারই উজ্বল দৃষ্টান্ত হলো বসনিয়া, কসোভো এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মুসলিমগণ। এককালে দাস হিসাবে আফ্রিকা থেকে যে অসংখ্য মুসলিমদের বলপূর্বক আমেরিকায় নেওয়া হয়েছিল তারাও হারিয়ে গেছে একই কারণে। লক্ষ লক্ষ মুসলিম পাশ্চাত্য দেশে আজ যেভাবে বিলুপ্ত হচেছ সেটিও ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহ না থাকার কারণে। ইসলামের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের যে কাজ শুরু হয়েছিল কাফের শত্রুদের হাতে আজ সে একই কাজ হচেছ বাংলাদেশের ন্যায় সেক্যুলারিস্টদের শাসিত মুসলিম দেশগুলোতে। এবং সেটি হচেছ ইসলামে অঙ্গিকারহীন পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামদের হাতে। বৃটিশের শাসন বিলুপ্ত হলেও তাদের গড়া প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়নি। ফলে টিকে আছে পতিতালয়, ক্লাব, জুয়া ও নাচের আড্ডা, সিনেমা এবং শিক্ষা, বিচার ও শাসন ব্যবস্থা। পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামদের হাতে এগুলো বরং দিন দিন আধুনিকতা পাচেছ। এ আধুনিকতাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষে অবিরাম আর্থিক, কারিগরি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাহায্যও আসছে। এরই ফল হলো, ইসলামে নামে যা টিকে আছে তা নবীজী (সা:)’র ইসলাম নয় –যাতে ছিল ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়ত, শুরা, জিহাদ ও প্যান-ইসলামিক ঐক্য।

 

শরিয়তের প্রতিষ্ঠা কীরূপে?

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা কীরূপে সম্ভব? সম্ভব কি ইরানী মডেলের বিপ্লব বা আফগান স্টাইলের জিহাদের মধ্য দিয়ে? বাংলাদেশ ইরান নয়, আফগানিস্তানও নয়। এখানে প্রেক্ষাপট যেমন ভিন্ন, তেমনি শরিয়ত প্রতিষ্ঠার স্ট্রাটেজীও হতে হবে ভিন্ন। পার্বত্য এলাকার যুদ্ধ আর সমতলের যুদ্ধ এক হয় না। বাংলাদেশে সুবিধা হলো, এখানে মতামত প্রকাশের উত্তম সুবিধা রয়েছে। পত্র-পত্রিক ও মিটিং-মিছিলসহ জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে আন্দোলনের যে সুযোগ রয়েছে সেটি ইরান ও আফগানিস্তানে ছিল না। এমন সুযোগ মুসলিম দেশসমূহের মাঝে খুব কম দেশেই রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসাটি কোন ইসলামী দলের পক্ষেই নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব নয়। তবে কি এতদিন তারা অপেক্ষায় থাকবে? আর অপেক্ষায় থাকলে কি তাদের জনপ্রিয়তা বাড়বে? বরং অধিক বিলম্বে শয়তানী প্রতিষ্ঠানগুলোর ফসল এতই বাড়বে যে, সামান্য ঈমান নিযে বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। 

ক্ষমতায় না গিয়েও সমাজ পরিবর্তনে অনেক কিছুই করা যায়। সোসালিষ্ট বা কম্যুনিষ্টরা ইংল্যান্ডে কোন কালেই ক্ষমতায় যায়নি। কিন্তু লাগাতর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা শ্রমিকদের জন্য যে সব সুযোগ-সুবিধা আদায় করেছে তা কম্যুনিষ্ট দেশের শ্রমিকরাও পায়নি। ইংল্যান্ড পরিণত হয়েছে ওয়েলফেয়ার স্টেটি। ক্ষমতায় না গিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদাহরণ হলো পাকিস্তাান। সে দেশটিতে ইসলামপন্থিরা কোন কালেও ক্ষমতায় যায়নি। অথচ তারা কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা করেছে ভূট্টোর মত একজন মদ্যপায়ীকে দিয়ে। পঞ্চাশের দশকেই আলেমদের সম্মিলিত আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত হয়েছিল ২২ দফা ইসলামী মূল নীতি। সেকালের বাঘা বাঘা সেক্যুলারিষ্টরাও সেটি মানতে বাধ্য হয়েছিল। আজও সেটি শরিয়ত প্রতিষ্ঠার মূল বুনিয়াদ। দেশটির আইন ধাপে ধাপে ইসলামী হচেছ সে পথ ধরেই। ক্ষমতার বাাইরে থেকেও ইসলামপন্থিরা ব্লাসফেমি আইনের মত কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। এতে তসলিমা নাসরিনদের ফাঁসীতে ঝুলানোর সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। সে দেশটিতে সকল ব্যাংক থেকে সূদ ভিত্তিক ব্যাংকিং প্রথার বিলোপে দেশটির সৃপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছে। কামাল পাশার অনুরাগী জেনারেল মোশাররফ ব্লাসফেমী আইনের সংশোধন আনতে চেয়েছিল। কিন্তু ধর্মীয় রাজনৈতিক দল সম্মিলিত ভাবে এর বিরোধীতা করেছে, ফলে তৎক্ষনাৎ পিছু হটেছে সরকার।

পাপ যখন বদ্ধঘরে সংগোপনে ঘটে তখন সাধারণ মানুষ বা সরকারের দায়ব্ধতা থাকেনা। কারো বিছানায় আবর্জনা নিয়ে শয়নের অভ্যাস কেউ রুখতে পারে না। কিন্তু কেউ যখন সে আবর্জনা লোকালয়ে নিক্ষেপ করে বা তা নিয়ে দোকান খুলে তখন সেটি রুখার দায়িত্ব সবার। এবং সে দায়িত্ব সবচেয়ে বেশী সরকারের। নইলে সেটি দেশবাসীর জন্য বিপদজনক হয়। বাংলাদেশে সেটি রুখার দায়িত্ব পালিত হয়নি। নানা প্রকার পাপাচপার নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে প্রায় প্রতিটি জনপদে। অথচ এ আবর্জনা বা পাপাচার সরকারে না গিয়েও হটানো যায়। অতীতে নারায়নগঞ্জের টানবাজার পতিতাপল্লী উৎখাতে মন্ত্রী হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। তবে এজন্য প্রয়োজন হলো ইসলামী শক্তিসমূহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের মুখেই তাসলিমা নাসরিনও দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল দাউদ হায়দার।

 

চাই ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন

কোন বিশেষ দল বা নেতাকে বিজয়ী করার বিষয়ে অনেকেরই আপত্তি থাকে, কিন্তু বিশুদ্ধ ধর্মীয় আন্দোলনে জনগণের সহায়তা মিলবেই। কারণ আপামর জনতা এ পূণ্য কাজকে ইবাদত ভাববে। তখন লাখে লাখে এগিয়েও আসবে। এটিই তো জিহাদ।  এমন জিহাদে সমর্থণ থাকবে প্রতিটি প্রকৃত ঈমানদারের। এজন্যই ইস্যুভিত্তিক ধর্মীয় আন্দোলনের সাথে জনগণ যতটা নিজেদের একাত্ম করে ততটা কোন দলের সাথে করে না। এভাবেই ধাপে ধাপে শয়তানী প্রতিষ্ঠানের নির্মূলে হাত দিতে হবে। এপথেই নির্মূল হতে পারে ইসলামবিরোধী শক্তিসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি। নারায়নগঞ্জের টানবাজার পতিতাপল্লী উৎখাতে এমনকি অনেক সেক্যুলার নেতাও সমর্থণ দিয়েছে। পরকালের ভয় জাগতে কোন দিন-ক্ষণ লাগে না। আজকে যারা ইসলামের বিরোধীতা করছে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হলে তাদের অনেকে শুধূ অর্থ, সময় ও শ্রমই শুধু নয়, প্রাণও দিবে। নেতাদের দায়িত্ব হলো জিহাদ এবং শহিদ হওয়ার ১০০% বিশুদ্ধ ক্ষেত্র তৈরী করা। তখন সে জান্নাতের পথে কোরবানি পেশের লোকের অভাব হয় না। আফগানিস্তানে তেমন বিশুদ্ধ জিহাদের ক্ষেত্র নির্মিত হয়েছিল বলেই বহুদেশ থেকে হাজার হাজার মুজাহিদ সেখানে নিজেদের জান ও মালের বিনিয়োগে আত্মনিয়োগ করেছিল। বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোর ব্যর্থতা হলো সে জিহাদের সেরূপ বিশুদ্ধ ক্ষেত্র নির্মাণে তারা সফলতা দেখাতে পারিনি।

যারা ইসলামের বিজয় চায় তাদের জন্য সংসদ-সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে অধিক গুরুত্বপুর্ণ হলো ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন। সে বিশেষ ইস্যুটি হতে হবে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। ইসলামি দলগুলো থেকে নির্বাচনে যে ক’জন সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয় সে সংখ্যাটি ২০ গুণ বাড়লেও ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার কাজ সুদূর পরাহত। অথচ আন্দোলনের সামর্থ্য তাদের পুরাই রয়েছে। তাছাড়া আন্দোলন ছাড়া কোন সংগঠনও বেড়ে উঠে না। সংগঠন পুষ্টি পায় আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। আন্দোলন না থাকলে সংগঠন শুধু দূর্বলই হয় না, বহু ক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটে। স্রোতহীন নদীতে যেমন চরা জেগে উঠে তেমনি আন্দোলনহীন সংগঠনগুলোতে বাড়ে কোন্দল। যেমনটি হয়েছিল ১৯৪৭ সালের পর মুসলিম লীগের। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তারা আরা কোন জনপ্রিয় ইস্যুই সৃষ্টি করতে পারিনি। অপর দিকে কোন সংগঠন না থাকলেও মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলী নিছক খেলাফত রক্ষার ইস্যুতে তৎকালীন উপমহাদেশে সর্ববৃহৎ গণআন্দোলনের সৃষ্ঠি করতে পেরেছিলেন, যা ছিল উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম গণআন্দেলন। বলা যায় আন্দোলনই সংগঠনের জন্ম দেয়। আন্দোলন যত গণমুখী ও বৃহত্তর হয়, সংগঠনও ততই শক্তিশালী হয়। তাছাড়া সব আন্দোলনই শুরু হয় ইস্যু নিয়ে।

বাংলাদেশের ইসলামি সংগঠনগুলোর বড় ব্যর্থতা হল, তারা ইস্যু ভিত্তিক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। মুসলিম জীবনে সবচেয়ে বড় ইস্যু হল শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। তার রাজনীতি থেকে যদি এ ইস্যুটিই বাদ পড়ে যায়, তবে মুসলিম জীবনে সে রাজনীতির আদৌ প্রয়োজন কি? সে রাজনীতি তখন সেক্যুলার রাজনীতিতে পরিণত হয়। এমন রাজনীতিতে সকল অর্থব্যয়, শ্রমব্যয় বা রক্তব্যয় তখন ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়। এবং মূল্যহীন হয় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে। মুসলিম এমপি হবে এবং প্রয়োজনে মন্ত্রীও হবে নিছক ইসলামের বিজয় ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা বাড়াতে। লক্ষ্য পূরণে। মন্ত্রীত্ব সে লক্ষ্যে সহাযক না হলে সে রাজনীতিও জায়েজ হতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের মাঝে এমপি ও মন্ত্রী হওয়া নিয়ে যত আগ্রহ ও ব্যস্ততা -শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে তা নাই। নির্বাচন এলে এজন্যই তারা প্রাণ ফিরে পায়। এমপি বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য শরিয়ত প্রতিষ্ঠার চিহ্ণিত শত্রুদের সাথে জোট বাঁধতে এরা সামান্যতম ইতস্ততা করে না।  ফলে ইসলামের নামে নেতা বা দলের সংখ্যা বাড়লেও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেগবান হচ্ছে না। তথাকথিত এসব ইসলামপন্থিরা রাজনীতির ময়দান খেলছে ইসলামের গোলপোষ্টটি না জেনেই।

ইসলামের পরাজয়ের অর্থ এ নয়, বিলুপ্ত হবে নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও মসজিদ। মুসলিম ভূমি বহুবার অমুসলিমদের হাতে অধিকৃত হয়েছে, কিন্তু কোনকালেই তেমনটি হয়নি। বরং পরাজয়ের প্রকৃত অর্থ হলো শরিয়তের বিলুপ্তি। রাষ্ট্রের বুকে আইন যার, সার্বভৌমত্বও তার। তাই দেশের আইন অনৈসলামিক হলে বিজয়টি শয়তানের। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহর ঘোষণা, “মা হুকুমু ইল্লা লিল্লাহ”। অর্থ: “হুকুম তথা আইন দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর”।  তাই মুসলিমকে বাঁচতে হয় মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও আইনকে নিয়ে। মুসলিম জীবনে বিষয়টি এতোই গুরুত্বপুর্ণ যে সে লক্ষ্য পূরণে প্রাণ কোরবাণীতে দু’পায়ে খাড়া হননি এমন সাহাবা খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশে ইসলাম কতটা বিজয়ী -সেটির পরিমাপে মসজিদ-মাদ্রাসা বা মুসলিমের সংখ্যা গণনার প্রয়োজন পড়ে না। ভারতের মুসলিম শাসনামলে কোন কালেই মুসলিম ও মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা হিন্দু ও তাদের মন্দিরের চেয়ে অধিক ছিল না। কিন্তু বৃটিশের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল শরিয়তি আইন। কাযীরা সেখানে বিচার চালাতো শরিয়ত অনুযায়ী। ভারতের মুসলিম শাসকগণের নানারূপ দুর্বলতা ছিল। কিন্তু এ বোধটুকু ছিল, শাসকের পদে বসে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা না দিলে শাসক আর মুসলিমই থাকে না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ঘোষনা নিয়ে তাদের অজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু সে মৌলিক কোরআনী জ্ঞানটুকু বাংলাদেশে যারা প্রধান মন্ত্রীর আসনে বসেন তাদের আছে কী?

 

পথ গণ-আন্দোলনের

ভারতের আদালত থেকে শরিয়তি আইন সরাতে বৃটিশ সরকার গণরায় নেইনি। তাদের পেনাল কোড, বিচার-পদ্ধতি, শিক্ষানীতি, সূদীব্যাংক, পতিতাপল্লী, মদ্যশালা তথা কোন আবর্জনাই নির্বাচনের মাধ্যমে জেঁকে বসেনি। তাই এসব সরাতেই বা নির্বাচন লাগবে কেন? এগুলো হলো বৃটিশ আমলে জেঁকে বসা জঞ্জাল। জাতীয় জীবন থেকে জঞ্জাল সরানোর দায়িত্ব তো প্রতিটি নাগরিকের। এ দায়িত্ববোধের প্রেরণাতেই শুরু হতে পারে এক জাতীয় গণআন্দোলন। এ আন্দোলনে সুস্পষ্ট দাবী হতে হবে পাপের সকল প্রতিষ্ঠানের নির্মূল। লক্ষ্য শুধু পতিতাপল্লী নয়, বরং উলঙ্গতাসহ সকল অশ্লিলতার বিলোপ। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক সকল আইনের বাতিল। তাসলিমা নাসরীনদের মত শত্রুর লেলিয়ে দেয়া মুরতাদদের দমন করতে প্রণয়ন করতে হবে কঠোর ব্লাসফেমি আইন। করতে হবে শিক্ষার বিশুদ্ধকরণ। সে সাথে থাকতে হবে সুনির্ন্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা। পাপাচারের প্রতিষ্ঠানগুলো যতই বেঁচে থাকবে ততই বাড়বে পাপীর সংখ্যা। রোগের ভাইরোসের ন্যায় পাপের ভাইরাসও দ্রুত ছড়ায়। ৩০ বছর পূর্বে দেশে পাপাচারির যত সংখ্যা ছিল এখন সে সংখ্যা বহু গুণ। এ পাপাচারিরাই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের পর্যায়ে। কারণ, পাপের প্রতিষ্ঠানের নির্মূলে অতীতে তেমন কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। এ কাজে প্রচুর বিলম্ব হয়েছে, অধিকতর বিলম্ব বিপন্ন করবেবাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকেও।

তাছাড়া শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়। এজেন্ডাটি মহান আল্লাহতায়ালার। ঈমানদারের দায়িত্ব হলো সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে লেগে যাওয়া। নিজেদেরকে যারা মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়, তাদের সামনে এ ছাড়া ভিন্ন পথই নেই। যে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম সে দেশে শরিয়ত কেন প্রতিষ্ঠিত নয় -সে হিসাব কি মহান আল্লাহর দরবারে দিতে হবে না? বাংলাদেশের একটি ইউনিয়নের জনসংখ্যার চেয়ে কম সংখ্যক মুসলিম নিয়ে নবী পাক (সাঃ) শরিয়তী আইনের বিজয় এনেছিলেন। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিম এ বিশাল ব্যর্থতা নিয়ে আল্লাহর দরবারে মুখ দেখাবো কীরূপে?  মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দেওয়ার আগে এ ব্যর্থতার হিসাব কি তারা নেবে না? ১ম সংস্করণ ১৭/১২/২০০৫; ২য় সংস্করণ ১৩/০১/২০০২১।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *