ইসলামপন্থীদের চেতনায় সেক্যুলারিজমের দূষণ এবং বাংলার আকাশে কালো মেঘ

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

 সেক্যুলারিজম ও ইসলাম: দ্বন্দটি কোথায়?

 ইসলামপন্থী দলগুলি এখন ঘন ঘন একতার কথা বলছে। এখন একতার কথা বলার মধ্যে তাদের পার্থিব স্বার্থপরতা আছে। কারণ, সামনে নির্বাচন। তারা জানে, বিভক্ত থাকলে নির্বাচনে বিজয় মিলবে না। এবং একতা গড়লে সংসদে সিট মিলতে পারে।  এরূপ ইহজাগতিক স্বার্থপরতার নীতিই হলো সেক্যুলারিজম। সেক্যুলারিজমের আভিধানিক অর্থ হলো, আখেরাতের ভাবনা অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার কাছে জবাবদেহীতার চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্রেফ দুনিয়ার লাভ-লোকসানের দিকে দৃষ্টি রেখে সিন্ধান্ত নেয়া। সেটি যেমন রাজনীতির ক্ষেত্রে, তেমনি হতে পারে বিচার-আচার, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অন্যান্য কাজকর্মের ক্ষেত্রেও। সেক্যুলারিস্টদের কথা, ধর্মীয় চেতনার প্রয়োগ হতে হবে শুধু জায়নামাজে, তাসবিহ পাঠ ও কুর’আনে তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে; সেটিকে রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, বিচার, প্রশাসন ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের বাইরে রাখতে হবে।

অথচ ইসলাম বলে, জীবনের পথ চলার প্রতিটি পদক্ষেপ হলো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ; সে অঙ্গকে কখনোই ইসলামের বিধানের বাইরে রাখা যাবেনা। শুধু জায়নামাজে নয়, যেখানেই পদচারনা, সেখানেই চলতে হবে ঈমানকে সাথে নিয়ে। তাই রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে সে যেমন পূর্ণ ঈমানদার, তেমনি ঈমানদার যখন সে বিচারক, মন্ত্রী, সচিব, জেনারেল, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, লেখক, শিক্ষক বা পত্রিকার সম্পাদকের আসনে বসে।  তাই তার মুসলিম পরিচয়টি শুধু জায়নামাজের বিষয় নয়, বরং জীবনের সর্বত্র জুড়ে। ইসলামপন্থীদের রাজনীতিতে যদি মহান আল্লাহ তায়ালার  কাজে জবাবদেহী তথা তাকওয়া গুরুত্ব পেত তা হলে তাদের মাঝে সবসময় একতা প্রতিষ্ঠার তাড়না দেখা যেত। তখন সকল ইসলামপন্থীদের একই মঞ্চে দেখা যেত। কারণ, একতা প্রতিষ্ঠার নির্দেশটি মহান রব’য়ের। তা পালন করা তাই নামাজ-রোজা এবং হজ্জ-যাকাতের ন্যায় ফরজ। এবং হারাম হলো বিভক্তি নিয়ে বাঁচা। তাই ইসলামপন্থীদের মধ্যে নানা দল ও নানা ফেরকার যে বিভক্তি তা মূলে কাজ করে দলীয় স্বার্থপরতা নিয়ে বাঁচার তাড়না। সেটিও এক প্রকারের সেক্যুলারিজম।   

  

 জামায়াতে সেক্যুলারিজমের দূষণ

সম্প্রতি  জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মহম্মদ তাহের সম্প্রতি বলেছেন, জামায়াতের বর্তমান নেতাদের কেউই একাত্তরের সাথে জড়িত ছিলেন না। তার এ কথার মধ্যেও রয়েছে সেক্যুলারিজম। এ কথা বলে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, ১৯৭১’য়ে যারা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের কেউই এখন আর জামায়াতের নেতৃত্বে নাই। এ কথা বলে তিনি কি একাত্তের চেতনাধারী বাঙালি সেকুলারিস্ট, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী এবং বামধারার লোকদের শিবিরে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে চান? তার এ কথার মধ্যে রয়েছে গণমুখী হওয়া এবং আগামী নির্বাচনে বেশী বেশী ভোটপ্রাপ্তির তাড়না। তার রাজনৈতিক বিচারে ইসলামী মূল্যবোধ স্থান পেলে কখনোই একথা বলতেন না।

প্রশ্ন হলো, সৈয়দ আবদুল্লাহ মহম্মদ তাহের কি তবে বুঝাতে চান জামায়াতের আজকের নতুন নেতৃত্ব মাওলানা আব্দুর রহিম, অধ্যাপক গোলাম আজম, শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা আব্দুস সোবহান, মাওলানা ইউসুফ, শহীদ আলী আহসান মুজাহিদ, শহীদ কামরুজ্জামান -প্রথম সারীর এসব নেতৃবৃন্দ যারা ১৯৭১’য়ের সাথে জড়িত ছিলেন তথা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের চেয়ে অধিক উত্তম? তিনি কি বুঝাতে চান, বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা ও কল্যাণের বিষয়গুলি একাত্তরের নেতাদের চেয়ে আজকের নেতারা বেশী বুঝেন? একটু ভেবে দেখুন এবং নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কতটুকু ইসলামের মানদণ্ডকে সামনে রেখে কথাটি বলেছেন। সেক্যুলার মানদণ্ডে জ্বিনাও জায়েজ -যদি দুই পক্ষের সম্মতিতে হয়। তেমনি সেক্যুলার বিচারে পাকিস্তান ভাঙ্গাও জায়েজ -কারণ সেটি আওয়ামী লীগ, বামপন্থী ও ভারতপন্থী শিবিরের লোকেরা চেয়েছে। কিন্তু ইসলামী বিচারে তো সেটি হারাম তথা গুরুতর অপরাধ। একজন  মুসলিমদের কাছে তো সেটিই গুরুত্ব পায় -যা ইসলাম বলে।

 

একাত্তর নিয়ে ইসলামপন্থীদের বয়ান

একাত্তর নিয়ে ইসলামপন্থীদের রয়েছে সুস্পষ্ট বয়ান। জামায়াতসহ বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলির গুরুতর অপরাধ, সে বয়ানকে জনগণের সামনে তারা তুলে ধরেনি। বরং তারা নিজেরা ভেসে গেছে সেক্যুলার বয়ানে। ইসলাম শুধু পানাহার ও আয়-উপার্জনে হালাল-হারামের বিধান দেয়। হারাম-হালাল রয়েছে ভূ-রাজনীতিতেও। কোন একটি মুসলিম দেশের ধ্বংসে ভারতের ন্যায় একটি কাফের দেশের সাথে জোট বেঁধে যুদ্ধ করাটি হারাম। কাফিরদের বিজয়কে কখনোই কোন মুসলিম নিজের বিজয় বলে উৎসব করে না। ১৯৭১’য়ে ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে হারাম বলেছেন মাওলানা আতাহার আলী, মাওলানা সিদ্দিক আহমেদ মাওলানা মোস্তাফা আল মাদানীসহ একাত্তরের সকল প্রখ্যাত আলেম । তারা পাকিস্তান বাঁচানোর যুদ্ধকে তারা জিহাদ বলেছেন। যুদ্ধকালীন নয় মাসে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকাগুলোতে আলেমদের দেয়া ফতোয়াগুলির দিকে তাকালেই সেটি জানা যাবে। ভারতীয় কাফেরদের আয়োজিত সে যুদ্ধে যোগ দিতে তাই কোন ইসলামী দলের নেতা-কর্মী, কোন আলেম, কোন ইমাম, কোন পীর সাহেব বা পীরভক্তরা ভারতে যায়নি। উল্লেখ্য যে,শর্ষিণার পীর, ফুলতলীর পীর, হাফেজজী হুজুরসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব একাত্তরে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন।

জনাব আবদুল্লাহ মহম্মদ তাহেরের জন্য উচিত হলো, ১৯৭১’য়ের যুদ্ধকালীন ৯ মাসের পত্রিকাগুলি সংগ্রহ করে পড়া। তখন জামায়াতে ইসলামী, নিজামী ইসলামী, মুসলিম লীগ, নুরুল আমীন-শাহ আজিজের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টি (PDP), জমিয়তে উলামে ইসলাম, খেলাফতের রাব্বানী পার্টি, ফরায়েজী আন্দোলন, কৃষকশ্রমিক পার্টিসহ সকল পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর নেতাগণ বলতেন, পাকিস্তান ভাঙ্গা হারাম এবং পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে যারা লিপ্ত তারা ইসলামের শত্রু এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের দালা।ল। তাদের বক্তব্য কি সঠকি ছিল না? তাদের যুক্তি, মুসলিম দেশ ভাঙ্গা ও দুর্বল করার কাজটি কাফির ও মুনাফিকদের; কোন ঈমানদার তাতে জড়িত হতে পারেনা। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে দেখা গেছে ইসলাম থেকে দূরে সরা ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে অঙ্গীকারহীন আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, বামপন্থী ও হিন্দুত্বাবাদীদের। এবং তাদের সে কাজে সমর্থন দিয়েছে ভারতের ন্যায় পৌত্তলিক শক্তি। কোন মুসলিম দেশ থতেকে তারা কোন সমর্থন পায়নি। পাকিস্তান ভাঙ্গার অর্থ ছিল মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করা এবং ভারতকে বিজয়ী ও শক্তিশালী করা। সেসাথে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশকে ভারতের অধীনত গোলাম রাষ্ট্র বানানো।  একাত্তরের পর তো সেটিই হয়েছে। ।

প্রশ্ন হলো, আজ জামায়াতের নেতৃত্বের দায়িত্বে পাকিস্তাপন্থী চেতনাধারীরা নাই -সেটি গর্বের হয় কি করে? সত্য শাশ্বত; তা কখনোই তার বয়ান পাল্টায় না। ১৯৭১’য়ে যেটি সত্য ছিল, আজও তা সত্য। মুসলিম হওয়ার অর্থ তো সব সময় সত্যের পক্ষ নেয়া।  রাজনৈতিক স্বার্থে বয়ান পাল্টানোই হলো মুনাফিকি। এটি সেক্যুলারিজম অর্থাৎ ইহজাগতিক স্বার্থ উদ্ধারের ভাবনা। এ চেতনা নিয়ে কেউ ঈমানদার হতে পারে না।  ঈমানদারকে ভাবতে ও কাজ করতে মহান আল্লাহকে খুশি করার তাড়না নিয়ে। জনাব আবদুল্লাহ মহম্মদ তাহেরের বয়ান শুনে মনে হয়না তার মধ্যে সে তাড়না কাজ করে। এখানেই ধরা পড়ে ইসলামের সঠিক ধারা থেকে জামায়াতের বিচ্যুতির লক্ষণ। বাংলাদেশে আগামী দিনের ইসলামী রাজনীতির জন্য এটি এক বিপদ সংকেত।  

মহান আল্লাহ তায়ালা একাত্তরের জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরকে হাসিনার ন্যায় ফ্যাসিস্ট ফেরাউনের হাতে শহীদ হওয়ার মর্যাদা দিয়েছেন। এটি এক বিশাল অর্জন। শত বছর পরও জামায়াতের এ বিশাল অর্জনটি মুসলিম উম্মাহর নতুন প্রজন্ম শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে। মানব জীবনে এর চেয়ে বড় অর্জন আর কি হতে পারে? শহীদ নেতারা সেটি পেয়ে গেছেন। জামায়াতের নেতাকর্মীদের তো তাদের নিয়ে গর্ব করা উচিত।  শহীদের রক্ত জীবিতদের ঈমানকে বলবান করে। যে আন্দোলন শহীদ পয়দা করতে পারে না, সে আন্দোলন কখনোই ইসলামকে বিজয়ী করতে পারেনা। অথচ কি বিস্ময়! তারা আজ জামায়তের নেতৃত্বে নাই  -সেটিই যেন আজকের জামায়াত নেতা-কর্মীদের নিকট অতি গর্বের বিষয়ে পরিণত হয়েছে! তাই গর্ব ভরে জনাব তাহের বলছেন, তারা আজ আর নেতৃত্বে নাই। এটা কি জামায়াতের অতীত নেতাদের চেতনার সাথে গাদ্দারী নয়? এটা কি আজকের জামায়াতের আদর্শিক পরাজয় ও বিচ্যুতির আলামত নয়? তাদের ভাবনা ও এজেন্ডা কি জামায়াতকে বিজয়ী করা, না ইসলামকে বিজয়ী করা?  

 

জামায়াত ও শিবিরের ১৬ই ডিসেম্বর উদযাপন

জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীগণ ১৬ই ডিসেম্বর এলেই ভারতীয় পৌত্তলিক কাফির, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট ও বামধারার নাস্তিকদের থেকেও এক ধাপ এগিয়ে একাত্তরের ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয়কে নিজেদের বিজয় রূপে প্রচার দিতে রাস্তায় বিজয় মিছিল বের করে। স্লোগান দেয় “স্বাধীনতা এনেছি, স্বাধীনতা রাখবো।” প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতা বলতে যদি তারা একাত্তরের পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের নির্মাণ বুঝায়, তবে কি সে স্বাধীনতাটি জামায়াত শিবির এনেছিল? ইতিহাস নিয়ে এ মিথ্যাচার কেন? এটুকুও তারা বুঝতে পারে না, একাত্তরের বিজয়টি ছিল ভারতের এবং ভারতসেবী বাঙালি ফ্যাসিস্ট, হিন্দুত্ববাদী পৌত্তলিক ও বামপন্থী নাস্তিকদের বিজয়। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ন্যায এরাও সবাই ইসলামবিরোধী। তাদের উৎসব তো পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করায়। রাজার বিজয়ে যেমন তার চাকর-বাকরেরাও উৎসব করে, তেমনি একাত্তরের বিজয় নিয়ে উৎসব করে ভারতসেবী বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও কম্যুনিস্টরাও।

 

জামায়াতের inclusiveness

সম্প্রতি এক মিটিংয়ে সন্তোষ শর্মার মত র’য়ের এজেন্টকে মঞ্চে ডেকে এনে জামায়াত তাকে সম্মানিত করেছে। যুক্তি দেখানো হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গণে জামায়াত inclusive তথা অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির প্রদর্শন করতে চায়। কথা হলো, এরূপ inclusiveness কি নবীজী (সা:)’র নীতি ছিল? তিনি তার দলে বা সেনাবাহিনীতে কাফিরদেরও কি স্থান দিয়েছিলেন? কম্যুনিস্টরাও কি inclusive? সেখানে কি পুঁজিবাদীদেএ কোন স্থান আছে? যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট তারাও কি inclusive? তাদের দলে কি ইসলামপন্থীদের কোন স্থান আছে? যারা আদর্শ নিয়ে কাজ করে তাদের পক্ষে inclusive হওয়ার কোন সুযোগ নাই। তাদের রাজনীতি করতে হয় তাদের আদর্শে যারা বিশ্বাসী তাদের নিয়ে। তাই মুসলিম দল বা উম্মাহ হলো exclusive ঈমানদারদের জন্য; সেখানে ইসলামে অবিশ্বাসীদের জন্য স্থান নাই। অথচ জামায়াত তাদের জলসায় র’য়ে এজেন্টকে ডেকে এনে নিজেদের inclusive রূপে জাহির করছে।     

 

১৯৪৭’য়ের দান এবং ১৯৭১’য়ের দান

জামায়াতের বর্তমান নেতৃবৃন্দ তাদের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে এতো স্পর্শকাতর কেন? অথচ একাত্তরের ভূমিকাই জামায়াতের জন্য সবচেয়ে বড় পজিটিভ রাজনৈতিক এসেট হতে পারতো -বিশেষ করে ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর। কারণ এখন তো বয়ান পাল্টানোর উপযুক্ত সময়।  একাত্তরের হিন্দুত্ববাদী বয়ান তো পরাজিত হয়েছে। অথচ মনে হচ্ছ জামায়াত এখনো একাত্তরের সে হিন্দুত্ববাদী বয়ানকেই বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাদের তো জোর গলায় বলা উচিত: ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান সৃষ্টিই ছিল বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। ১৯৪৭’য়ের অবদান: নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল গণতন্ত্র, নির্মূল হয়েছিল শোষণের হাতিয়ার জমিদারি প্রথা, এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বাঙালি মুসলিমগণ পেয়েছিল বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করার সুযোগ। উল্লেখ্য যে অখণ্ড পাকি৪৪স্তানের ২৩ বছরে ৪ জন প্রধানমন্ত্রী, ২ জন প্রেসিডেন্ট,তিনজন স্পীকার এবং ৩ জন প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন বাঙালি।  এবং একথাও জোর গলায় বলা উচিত, পলাশীর পরাজয়ের পর বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নাশকতার কাণ্ড ঘটেছে ১৯৭১’য়ে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান খণ্ডিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ঐদিন ভারতের বিজয়ে বাঙালি মুসলিমগণ হারিয়েছে গণতন্ত্র এবং পরিণত হয়েছে ভারতের অধীনত এক গোলাম রাষ্ট্রে।  ১৯৭১’য়ের ফসল হলো:বাকশালী ফ্যাসিবাদ, ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ভোটডাকাতি, গুম-খুন, গণহত্যা ও আয়নাঘরের রাজনীতি।      

অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে দেশটি হতো চীন ও ভারতের পর ৪৪ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। মুসলিম উম্মাহর আজকের সবচেয় বড় প্রয়োজন বৃহৎ ভূগোলের একটি বিশাল রাষ্ট্র; ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, শিল্পপতি বড় বড় শহর, বহু কল-কারখানা ও বিপুল সংখ্যায় মানব রপ্তানি করে বৃহৎ রাষ্ট্রের শূণ্য দূর করা যায় না। তাই লাগাতর দেশের ভূগোল বাড়ানো নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামের সূন্নত। তাই ইসলামী রাষ্ট্র ক্ষুদ্র মদিনা থেকে আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপে বিস্তৃত বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে|।  বৃহৎ ভূগোল না থাকলে শক্তি, স্বাধীনতা ও ইজ্জত থাকে না। রাশিয়ার অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে দুর্বল, কিন্তু দেশটি বিশ্বশক্তি। সেটির কারণ, রাশিয়ার বিশাল ভূগোল। একই কারণে ভারতও শক্তিশালী।  মুসলিম দেশকে ক্ষুদ্রতর করা তো ইসলামের শত্রুদের এজেন্ডা। খেলাফত ভাঙ্গতে তাই ইংরেজ ও ফরাসী যুদ্ধ করেছ। আর পাকিস্তান ভাঙ্গতে যুদ্ধ করেছে পৌত্তলিক ভারত ও তার বাঙালি দালালেরা।

একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গাতে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব প্রচণ্ড শোকাহত হলেও তা নিয়ে উৎসব করেছে শয়তানপন্থী পৌত্তলিক ভারত। উৎসব করেছে ভারতসেবী বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও কম্যুনিস্টগণ। কারণ, মুসলিমদের দুর্বল দেখার মধ্যেই তাদের আনন্দ। বিস্ময়ের বিষয় হলো, প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় মিছিল বের করে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। তাদের এ মিছিল দেখে মনে হয় তারাও একাত্তর নিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের এ বয়ানটি মেনে নিয়েছে যে, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ অবধি আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা পরাধীন ছিলাম? এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বর। চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে জামায়াত-শিবিরের বর্তমান নেতারা একাত্তরের নেতাদের থেকে কতটা দূরে সরেছে -এ হলো তার নজির। 

 

মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর

 এ নিয়ে বিতর্ক নাই যে, একাত্তরে বহু লক্ষ বাঙালি ও অবাঙালি নিহত হয়েছে। এমন মানব হত্যা অতি নিন্দনীয় ও অতি ক্ষতিকর। তবে মানব হত্যার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর হলো একটি মুসলিম দেশ খণ্ডিত হয়ে যাওয়া। সাম্প্রতিক কালে মার্কিন, ইংরেজ ও ফরাসীদের হাতে লক্ষ লক্ষ আরব মুসলিম নিহত হয়েছে। ফরাসীদের হাতে একমাত্র আলজিরিয়ার নিহত হয়েছে ১৫ লাখ মুসলিম। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনসহ আরব দেশগুলিতে মাকিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বহু লক্ষ নাগরিককে হত্যা করেছে।

কিন্তু আরবগণ এরূপ গণহত্যার জন্য দুর্বল হয়নি। তারা দুর্বল হয়েছে অখণ্ড আরব ভূখণ্ড ২২ টুকরোয় খণ্ডিত হওয়ার কারণে। সেটি আত্মঘাতী ফিতনার কারণে। এজন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারায় ২১৭ নম্বর আয়াতে ফিতনাকে মানব হ্ত্যার চেয়ে অধিকতর গুরুতর অপরাধ বলেছেন। কারণটি সুস্পষ্ট।  ফিতনা উম্মাহর মাঝে বিভক্তি আনে। এবং সে বিভক্তির পথ ধরে পরাজয় ও পরাধীনতা আসে। তখন আসে গণহত্য, ধর্ষণ ও গণনির্যাতন। বাংলাদেশে বাঙালি ফ্যাসিস্টদের হাতে সেটি অতি নৃশংস ভাবে সংঘটিত হয়েছে। বাংলাদেশ তাই ২৫ মার্চের গণহত্যার কারণে দুর্বল ও গোলাম হয়নি। বরং ভারতের হাতে স্বাধীনতা হারিয়েছে বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও কম্যুনিস্টদের সৃষ্ট আত্মঘাতী ফিতনার কারণে। এরা শুধু গণতন্ত্রকেই কবরে পাঠায়নি, দেশবাসীকে বার বার গণহত্যার শিকার করেছে এবং তারা ১৫ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ ডেকে এনে।      এজেন্ডা

 

উৎসব শয়তানপন্থীদের নাশকতার বিজয় নিয়ে

মুসলিম বিশ্ব জুড়ে ফিতনার প্রচারক হলো জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট এবং সেক্যুলারিস্ট ও নাস্তিক কম্যুনিস্টরা। এরা সবাই শয়তানের বিশ্বস্থ পক্ষ। শয়তানের এ পক্ষটিই আরবদের ২২ টুকরোয় বিভক্ত করেছে। ফলে গাজার মজলুমদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। এরাই একাত্তরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভেঙ্গেছে। ফলে কাশ্মীর ও রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাঁড়াবার কেউ নাই। ইসলামের শত্রুরা নিজেদের এ ভয়াবহ নাশকতাকে উৎসবে পরিণত করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের লড়াইটি হওয়া উচিত ছিল পাকিস্তানে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার লড়াই, দেশভাঙ্গায় নয়। অথচ ফ্যাসিস্ট মুজিবের এজেন্ডা ছিল গণতন্ত্রের কবর দেয়া ও ভারত সেবা; গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় তার সামান্যতম আগ্রহ ছিল না।  

দেশে দেশে এরূপ শয়তানপন্থীরাই মুসলিমদের বিভক্ত ও শক্তিহীন করে রেখেছে। পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে শয়তানের এ পক্ষই একাত্তরে বিজয়ী হয়েছে। ইসলাম থেকে দূরে সরা এই ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও কম্যুনিস্টগণ যেহেতু হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে, তাদের কাছে তারা অতি প্রিয়। তাদের কাঁধে অস্ত্র রেখে ভারত ইসলামপন্থীদের কুপায়। ইসলামকে তথা মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনকে পরাজিত রাখাই তাদের এজেন্ডা। এরূপ ভারতসেবীদের কারণেই ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হলেও বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা মেলেনি। বরং জুটেছে ভারতের পদতলে দাসত্ব। মুজিব, এরশাদ, হাসিনা ছিল ভারতের অনুগত খলিফা। অপরদিকে নাগরিক হতে পারিনি বাংলাদেশের জনগণ, তারা প্রজাই থেকে গেছে। 

প্রশ্ন হলো, ভারতের পদতলে আত্মসমর্পিত দাসত্ব নিয়েই কি প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীগণ বিজয় উৎসব করেছে? হাসিনার শাসনমলে স্বাধীনতা লাভের বিজয় উৎসব পালন করলে কি ২০২৪’য়ের ৫ আগস্টের বিপ্লবকে “দ্বিতীয় স্বাধীনতা” বলা যা‌য়? বিষয়টি ভাবনার বিষয়। যারা নিজেদের ইসলামপন্তী রূপে দাবী করে এ বিষয়গুলি নিয়ে তাদের বেশি বেশি ভাবতে হবে, এবং গভীর ভাবে ভাবতে শিখতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা শুধু নামাজ-রোজা এবং হজ্জ-যাকাতই ফরজ করেননি, ফরজ করেছেন চিন্তা-ভাবনাকেও। হিরা পর্বতের গুহায় রাতের পর রাত ভাবনা করতে করতে নবীজী (সা:) নবুয়ত পেয়েছিলেন। এখানেই ভাবনার গুরুত্ব। যারা চিন্তা-ভাবনা করে তারাই সিরাতাল মুস্তাকীম পায়। এবং যারা চিন্তাশূণ্য, তারা পথ হারায় এবং জাহান্নামের যাত্রী হয়। চিন্তাভাবনাকে ফরজ করতেই” পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ, “আফালা তাদাব্বারুন” এবং “আফালা তা’কীলুন” অর্থ: তোমরা কেন গভীর ভাবনায় মননিবেশ করো না? তোমরা কেন আক্বলকে কাজে লাগাও না?  

 

মাওলানা মামুনূল হক ও মাওলানা আজহারীর সেক্যুলারিজম

এক ভিডিওতে মাওলানা মামুনূল হককে বলতে শোনা গেল, জামায়াতে ইসলামীর সাথে ঐক্য গড়া অসম্ভব। তার যুক্তি, জামায়াত একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে। ঐক্যের জন্য শর্ত, একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতকে প্রথমে মাফ চাইতে হবে। সেক্যুলারিজমের প্লাবনে মাওলানা মামুনূল হকের চেতনার ভূবন যে কতটা প্লাবিত -সেটি বুঝতে এরপরও কি কিছু বাকি থাকে? অপর দিকে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীকে এক ভিডিওতে মনের মাধুরি মিশিয়ে গাইতে শোনা গেল: “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা আনলো যারা আমরা তোমাদের ভুলবো না” গানের চরণ।  এ গানটি হলো ১৯৭১’য়ে যুদ্ধে সেক্যুলারিস্টদের গাওয়া অতি পরিচিত বিজয়ের গান। এ গান সাধারণত গায় বাঙালি ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বাম শিবিরের লোকেরা।

১৯৭১ হলো ইসলামপন্থীদের জন্য পরাজয় ও বিপর্যয়ের বছর। হাজার হাজার ইসলামপন্থীকে একাত্তরের শহীদ ও নির্যাতিত হতে হয়েছে। একাত্তরের জের ধরে ইসলামপন্থীরা শহীদ ও নির্যাতিত হয়েছে হাসিনার ১৬ বছরের শাসন কালে। তাই কোন ইসলামপন্থী ব্যক্তিকে এরূপ গান কখনো গাইতে শোনা যায়নি। অথচ সে গানটি গেয়েছেন মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী। ব্যক্তির  কথা, লেখনি, বয়ান ও গানের মধ্য দিয়ে তার ঈমান, তাকওয়া, দর্শন ও  চেতনা কথা বলে। তাই ঈমানদারের গান আর সেক্যুলারিস্টদের গান কখনো একই রূপ হয়না। তাই মাওলানা আজহারীর মুখে সেক্যুলারিস্টদের গাওয়া গানটি শুনে তাকে বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের থেকে তাকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ থেকে বুঝা যায় সেক্যুলারিজমের প্লাবনে কতটা প্লাবিত ইসলামপন্থীদের চেতনার ভূমি।    

 

সংকট চিন্তাশূণ্যতার

বাংলাদেশে চিন্তাশূণ্য মানুষদের সংখ্যাটি বিশাল। চিন্তাশূণ্যর কারণে বঙ্গীয় বদ্বীপে পথ হারানো ব্যক্তিদের সংখ্যাটি বিশাল। তাই এদেশে মূর্তি, গরু, সাপ ও লিঙ্গপূজারীরা সংখ্যায় কোটি কোটি। একই কারণে এদেশে বিপুল সংখ্যায় অনুসারী পায় জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, গোত্রবাদ, বর্ণবাদ, আঞ্চলিকতা ভিত্তিক মতবাদী রাজনীতি।  যেসব ইসলামপন্থীরা ১৬ ডিসেম্বর এলে হিন্দুত্ববাদী ভারত এবং বাঙালি ফ্যাসিস্ট ও সেক্যুলারিস্টদের বিজয়কে নিজেদের বিজয় রূপে উৎসব করে, তারাও যে পথ হারিয়েছে -তা নিয়ে কি সন্দেহ করা চলে? ক্ষমতার নেশায় যারা পাগল -তাদের হুশ থাকে না; দেশপ্রেমও থাকে না। তাদের রাজনীতিতে তখন পাগলামী দেখা যায়। তাদের থাকে ক্ষমতার প্রতি প্রচণ্ড মোহ। ক্ষমতার নেশা থেকে যারা নিজেদের বাঁচাতে পারে না, তাদের হাতে দেশও বাঁচে না।

মুজিবের ন্যায় চিন্তাশূণ্য নেতার হাতে যেমন অখণ্ড পাকিস্তন বাঁচেনি, বাংলাদেশও বাঁচেনি। মুজিব বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছে ভারতের হাতে। এরা যেমন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর শত্রু, তেমনি তারা নিজেদেরও শত্রু।  ক্ষমতালিপ্সু মুজিব তাই নিজেকেও বাঁচাতে পারিনি। তাই বাঙালি মুসলিমদের বেশী বেশী ভাবতে হবে। বেশী বেশী ভাবাটি ইবাদতে পরিণত করতে হবে। সেক্যুলারিজমের স্রোতে ভাসা বন্ধ করে ইসলামের ধারায় ফিরে আসতে হবে।  নইলে ১৯৪৭ য়ের স্বাধীনতার ফসল যেমন সেক্যিলারিজমের প্লাবনে ভেস গেছে, তেমনি  ২০২৪’য়ের ৫ আগস্ট বিপ্লবের ফসলও ভেসে যাবে। ২৫/০৬/২০২৫    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *